» » স্মৃতির জার

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

স্মৃতির জার : আট

ইতুকে দেখে অবাক হননি সুশান্ত ঘোষ, কেননা ইতু বাসে বসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে গর্দানিবাগের বাড়িতে অমিত বর্মণ এসেছে আর ও আজকেই অমিতের সঙ্গে পালাচ্ছে, সুশান্তজেঠুর বাড়িতে যাবে, বাসস্ট্যাণ্ডে সুশান্তজেঠু যেন ওদের নিতে আসেন। তার আগে সুশান্তর বড়জেঠি, মানে ইতুর বটঠাকুমা, ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দ্যাখ ইতু আর তোর ছেলেবেলাকার বন্ধু অতনুর ছেলে অমিত তোর বাড়ি পৌঁছোল বলে, এখানে হইচই ফেলে চলে গেছে, যা করেছে একশবার ভালো করেছে, ওদের মুখেই শুনিস।

বাসস্ট্যাণ্ডে বোলেরো নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সুশান্ত ঘোষ। দিয়ারায় পৌঁছে, পটলের পাহাড়, তরমুজ-শসা-ফুটির ডাঁই দেখে ইতু বলল, এ তো বেশ ভালো জায়গা গো, ভিলেজ-ভিলেজ টাইপ, যেমন টিভিতে দেখি। দিনকতক থেকে গেলে হয়না এখানে?

—না না, প্রায় আঁৎকে বলে উঠল অমিত, যত তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যায় ততই সবায়ের মঙ্গল।

—ঠিক আছে, যাসখন, কালকে সকালে তোদের জন্যে নৌকো করে দেব। আজকে রেস্ট নিয়ে নে। আমরা কি খাই কোথায় শুই এসব দেখে যা। আমাদের জীবন কম রঙিন নয়। আমার বউ, শশুর, শাশুড়ির সঙ্গে আগে পরিচয় করিয়ে দিই তোদের।

—হ্যাঁ, আমি তো আজ পর্যন্ত তোমার শশুরমশায়কে দেখিনি, শুনেছি যে উনি গর্দানিবাগের বাড়িতে এসে তোমাকে ফেরত দেবার জন্য দশ লাখ টাকা চেয়েছিলেন।

—উনি যখন জেঠা-বাবা-কাকার কাছে র‌্যানসাম চাইতে গিয়েছিলেন, তার আগেই বেবির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। উনি জানতেন যে বাবা-জেঠারা ফোতো-বড়োলোক, আর দশ লাখ টাকা দেবার মতো ক্ষমতা বাবা আর জেঠাদের নেই।

অমিত বলল, তোমার লাইফটা আনবিলিভেবল। অ্যাডভেঞ্চারস।

—এখানে এসে টের পাচ্ছি গো, কী ধরনের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছ নিজের জীবনে। ইতু বলেছিল।

সুশান্ত, এই যে আমার বউ বেবি, বলতে, একজন ঢ্যাঙা কালচে কৃশতনু যুবতী, দেখলেই বোঝা যায় সাজগোজ করে পারফিউম মেখে এলো, অমিত আর ইতুর পায়ে দুহাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। সুশান্তর বউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল ইতু, কেঁপে-কেঁপে কাঁদতে লাগল। ইতু বলল, হিন্দিতে, তুমি আমাদের পায়ে হাত দিচ্ছ কেন? বয়সে তুমি আমাদের বড়ো, তুমি তো আমার জেঠিমা হও।

বেবি : এই প্রথম শশুরবাড়ির লোক আমাদের বাড়ি এলো। শশুর শাশুড়িকে তো দেখিনি; তাদের প্রণাম তোমাদের পায়ে রাখলুম।

সুশান্তর শশুর তারিণী মণ্ডল আর শাশুড়ি মন্হরা দেবী ইতুদের আসার খবর পেয়ে হাজির হলে, ছফিটের ঋজু পালোয়ানি কালো তারিণী মণ্ডলকে দেখে ইতু বলে ফেলল, তোমার শশুর তো একেবারে কোমোডো ড্র্যাগন গো, সেরকমই জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছেন। বলে ফেলে, বলল, সরি, ওনাকে দেখে বেফাঁস বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।

—বেফাঁস বেরোয়নি, উত্তর দিল সুশান্ত, তারপর যোগ করল, ইতু তোর অবচেতনে ওনার সম্পর্কে যে ভীতি জমে আছে তা থেকেই বেরিয়ে এলো কোমোডো ড্র্যাগনটা। ঘাবড়াসনি, উনি কোনো ড্র্যাগনের কথাই জানেন না, নিজেকে ছাড়া।

তারিণী মণ্ডলের শাশুড়ি বলল, এতদিন পরে আত্মীয়দের সঙ্গে জামাইবাবার খাঁটি বাংলায় কথা বলার সুযোগ হল। বলে নাও, বলে নাও, তারপর আমাদের পালা। অমিত-ইতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার নাতিও বাংলা, আংরেজি, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলি বলতে পারে।

তারিণী মণ্ডল গমগমে কন্ঠস্বরে গর্ব ঝরিয়ে বলল, আমার নাতি বাংলা বলতে, লিখতে আর পড়তে পারে। ইংলিশে কথা বলতে পারে, একদম আংরেজ পলটন জইসন।

বেবির প্রশ্নাতুর ভ্রু দেখে অমিতের মনে হল, এনারা বোধহয় প্রণাম বা নমস্কার আশা করছেন ওদের তরফ থেকে; বেবি এসেই ঝপ করে দুজনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে। ইতু নির্ঘাত প্রণাম করতে চাইছে না, হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করতেও ওর বাধো-বাধো ঠেকবে, একে বিহারি তায় আবার শিডুলড কাস্ট, হয়ত জীবনে কোনো বিহারির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেনি। হাতজোড় করে নমস্কার করাটাও বিসদৃশ। অমিত আচমকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুঠো পাকিয়ে নির্বাক রেড স্যালুট দিল সুশান্তর শশুর-শাশুড়িকে। দেখাদেখি ইতুও তাই করল।

তারিণী মণ্ডল বলল, চাবস চাবস, এই তো চাই, নেতাজির মতন স্যালুট দেবে, বলে, সুভাষচন্দ্র বসুর নাম উচ্চারিত হলেই যা করে থাকে, উরুতে চাপড় মেরে বিব্রত করল নিজের জামাই আর তার অতিথিদের। মন্হরা দেবী বেবিকে হুকুম দিল, এই বেবি, আজকে ওদের জন্য একটা কচি শুয়োর কাটতে বল, গরম-গরম শুয়োরের মাংস আর পুদিনার চাটনি দিয়ে ভুট্টার রুটি খেয়ে যাক।

শুয়োরের মাংস খেতে হবে শুনে অমিতের কব্জি আঁকড়ে ফেলেছিল ইতু। অমিত ফিসফিস করে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে হয়ত মহুয়ার রুটি আর ভাল্লুকের মাংস খেতে হতে পারে। পরে, নৌকোয় করে যাবার সময়ে, ছইয়ের ভেতরে বসে, নদীর ছলাৎছলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অমিত গল্প করেছিল মুরিয়া, মাড়িয়া, গোঁড় উপজাতিদের জীবন নিয়ে। অবুঝমাড়ের পাহাড়ি মানুষদের বিভিন্ন গোষ্ঠীদেবতা আছে। নাগবংশ, যারা কেউটে সাপের পুজো করে বলে কোনো সাপ খায় না, মরা সাপ দেখতে পেলে সেদিন শোক পালন করে গোষ্ঠীর সবাই। তেমনই আছে কাছিমবংশ, বকরাবংশ, বাঘবংশ, আর বোধমিকবংশ, মানে মাছের বংশ।

—হ্যাঁ, তাহলে আজকে থেকে অভ্যাস করে নিই। বমি পায় পাক, বমি করতে-করতে তো পোয়াতিরাও অভ্যস্ত হয়ে যায়; প্রসবের অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে বারবার বাচ্চার জন্ম দেয়। ইতু বলল ফিসফিসিয়ে। শুয়োরের মাংস তবু খেলো না ইতু, বলল, এখন পারছি না, ক্রমশ অভ্যাস করব। সুশান্তর ঘরে খেতে বসে বেবির দেয়া সিম আর ফুলকপির আচার দিয়ে মকাইয়ের রুটি খেলো। বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের বডি পারফিউম দেখে ইতু বলল, তুমিও তো তোমার এই জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারোনি দেখছি।

বেবি : ওই সব গ্যাসগুলো নাআআআ? ফিকফিকে দাঁতে বলল বেবি, ডেওডেরেন্টের দিকে তাকিয়ে ইতুকে কথা বলতে দেখে, ওই গ্যাস আমার গায়ে না মারলে আমার ঘুম আসে না।

ইতু : কার ঘুম আসে না? তোমার না আমার জেঠুর?

বেবি : আমাদের দুজনেরই। তুমি নিয়ে যাও না কয়েকটা গ্যাস, বেশ ভালো লাগবে। দুজনে ঘুমোতে পারবে।

—আর ওই কসমেটিকসগুলো? বউকে তো হাল ফ্যাশানের সাজগোজের জিনিস কিনে দাও দেখছি, বলল ইতু।

—আমি কিনে দিই না, বেবি টিভিতে দ্যাখে আর কিনতে লোক পাঠায়। বলল সুশান্ত, শুয়োর মাংসের বড়ার ঢেঁকুর তুলে।

—সুশান্তজেঠু তোমার কাছে যদি থাকে তো তুমি ইতুকে মশা থেকে বাঁচার ক্রিম দিতে পারো, গিয়েই হয়তো অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না। অমিতের প্রস্তাব।

—আমি নিয়ে নিয়েছি সঙ্গে, কোথায় থাকবো শোবো কিছুই তো জানি না, প্রথম-প্রথম লাগবে। ওষুধ-বিষুধও নিয়েছি।

—অ্যালোপ্যাথিক? প্রশ্ন করল অমিত।

—হ্যাঁ, হারবাল মেডিসিন তোদের চারপাশ থেকে যোগাড় করে নেব।

—তোর দলের ডাক্তারের অভাব পুরণ করে দিল ইতু। বলল সুশান্ত।

—তোমার ছেলের নাম কি গো, গর্দানিবাগে তোমরা যখন এসেছিলে, আমি ছিলুম না? জানতে চাইল অমিত।

—অপু, সুশান্ত বলার আগেই জবাব দিল ইতু।

—ওর নাম আপ্রাধি ঘোষ, বলল বেবি, অপু আর নাম এই শব্দ দুটো থেকে প্রশ্নটা অনুমান করে।

সুশান্ত বলল, সামান্য হেসে, বেবি টের পাবে না এমন করে, ওর দাদুর মতে মহাকবি বাল্মিকী ছিলেন ওনার মতনই অপরাধী, তিনি যদি পূজিত হন, তাহলে কারোর নাম অপরাধী হলে সে পূজিত হবে না কেন। এরা সবাই জানে যে আমার ছেলের নাম আপ্রাধি : আমি স্কুলে ওকে অশ্বমেধ নামে ভর্তি করেছি, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট, বি এ পাশের ডিগ্রিতে আমার দেয়া নামটাই আছে। ছেলেকে বলা আছে যে এ-কথা এনাদের কাছে ফাঁস করার প্রয়োজন নেই, ওনারা যে নামে ডাকতে চান ডাকুন, পরিচয় করাতে চান, করুন।

—তুমি কিন্তু একেবারে বদলে গেছ, তাই না, উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি ছেড়ে? অমিতকে বলল সুশান্ত। ইতুর কাছে শুনলুম এন জি ওতে ঢুকে দেশোদ্ধারের কাজ নিয়েছ।

—দেশোদ্ধার? এই দেশের ব্যবস্থাকে আমূল উপড়ে না ফেললে, কারোর উদ্ধার হবে না। বাবার আওড়ানো বুলিকে, প্রয়োগ করল অমিত, তারপর বলল, তুমিও তো অন্যমানুষ হয়ে গেছ, দেখে মনে হচ্ছে, নিজের মতন করে শোষণের বিরুদ্ধে লড়ছ।

—না আমি সেই লোকটাই আছি, কেবল অভ্যাসগুলো পালটেছে। টাকাকড়ি করার লোভ ছিল, তা করেছি, আয়েস করার লোভ ছিল তা করছি। মানুষের ওপর আধিপত্যের নেশাই আলাদা, ও তুমি বুঝবে না, কারোর বিরুদ্ধেই লড়ছি না; আর শোষণের বিরুদ্ধে? কই? বরং শোষকের সিংহাসনে বসে পড়েছি হে। শোষিতরা শোষকের আনন্দের মজা বুঝতে পারে না। ধার্মিক গুরুদের দেখেছ তো? অনেকটা সেরকম। নিজেকে নিঃশব্দে বললেন, আমি আমার বিরুদ্ধে লড়ছি।

—ঈশ্বরে বিশ্বাস এটসেটরা হিন্দুগিরি করছ নাকি, চারিপাশে তাকিয়ে টের পাচ্ছি। রসুন, পেঁয়াজ, আদাবাটা, বেসন মাখানো, হামান দিস্তেতে থেঁতো করা শুয়োরের মাংসের বড়ে খেতে-খেতে বলল অমিত।

—ইসওয়র নাআআআআ? ছট পুজা করতে হ্যাঁয় ইনকে খাতির, বলে, সুশান্তর দিকে ইঙ্গিত করল বেবি; আপ ভি কিজিয়েগা ইতু দিদি, আপকে আদমি কা লমবিইইইই জিন্দগি কে লিয়ে।

—ঈশ্বর? ইউ মিন গড? ইয়েস, গড ইজ ওমনিকমপিটেন্ট ওমনিপ্রেজেন্ট। আই অ্যাম গোইং টু গেট হিম ইরেজড ওয়ান ডে, ওনার অবসান পৃথিবীতে অবধারিত। বক্তব্য রাখতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন সুশান্ত।

—বদলাওনি দেখছি, বলল ইতু, আগে গর্দানিবাগের বাড়িতে যেমন বলতে, তেমন ধরনের কথাই বলছ, ভগবানের ওপর বেশ চটে আছ, তাই না? এখন আর কি, এখন তো তুমিই-ই ভক্তের ভগবান, দেখতেই পাচ্ছি এসে অব্দি।

—হ্যাঁ, শুধু ঈশ্বর বদলে-বদলে যেতে থাকে। তারপর জিগ্যেস করলেন, আমার আর অতনুর বন্ধুবান্ধব, যেমন অরিন্দম মুখার্জি, মৌলিনাথ, মাহমুদ জোহের, এরিক পেজ, মলয় রায়চৌধুরী, ওদের খবর জানিস নাকি ইতু? দেখা-সাক্ষাৎ হয়? সবাই বুড়ো হয়ে গিয়ে থাকবে বোধহয়; আমিই কেবল যুবক থেকে গেলুম, বেবি আর বেবির বাবা-মায়ের খাঁচার খাবার-পানীয় সেঁটে।

—তোমাদের অফিসের শ্যামলী কর্মকারকে মনে আছে? যার পিঠে শিরদাঁড়ার দুপাশে জড়ুল, যেন প্রজাপতির ডানা, দেখাবার জন্য পিঠখোলা ব্লাউজ পরেন? ওনার মেয়ে তো আমার বন্ধু। সব খবরই পাই। অরিন্দম ওনার সাঁওতাল গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে কার অ্যাকসিডেন্টে পুড়ে মরে গেছেন, কলকাতায়। মৌলিনাথ কিডনি ফেল করে মরে গেছেন, কলকাতায়। মাহমুদ জোহের দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, করে, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পা ভেঙে হুইলচেয়ারে জীবন কাটাচ্ছিলেন; একদিন এক যুবক এসে মাহমুদ জোহেরের চোখের সামনেই ছোরা মেরে-মেরে ওনার দ্বিত্বীয় বউটাকে মেরে ফেললে, পাটনায়; যুবক ছিল দ্বিতীয় বউয়ের প্রেমিক।

—সে কি!

—হ্যাঁ গো। এরিক পেজ পাগল হয়ে গেছেন, বাড়িতে ওনাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে, মোকামায়; শুনেছি যে যখন বেশি চেঁচামেচি-গোলমাল করেন তখন ওনার হাতে একটা ব্রিটিশ আমলের রুপোর টাকা গুঁজে দিলে চুপ করে যান, আর টাকাটাকে শুধিয়ে-শুধিয়ে, হ্যালো মাউন্টব্যাটেন সাহেব, আপনি চলে গেলেন কেন, এখন আমাদের কী হবে, ইনডিয়াকে ফ্রিডাম দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু বেইমানি করে চলে গেলেন, কেউ-কেউ ফ্রি হল, সবাই কেন হল না, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, এই ধরনের কথা বলে নিজের মনে বকবক করেন।

—পাগল হয়ে গেল? অতনুদের গ্যাঙের তো ও লিডার ছিল রে! অমিতের দিকে ফিরে বললেন, সরি অমিত, তোমার বাবার অন্যধরণের বন্ধুবান্ধবও ছিল, নারী-নারকটিক গ্যাঙ বলত সবাই।

—মলয় রায়চৌধুরী, নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে, পাটনার বাড়ি ছেড়ে, গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরি নিয়ে কলকাতা চলে গেছেন; পাটনায় এসে হোটেলে উঠেছিলেন, এসেছিলেন আমাদের বাড়ি, বউকে নিয়ে। পাটনার বাড়িটা আর বসবাসের মতন নেই জানিয়েছিলেন, ওনার পাটনার বাড়ির লাইব্রেরি থেকে হাজার খানেক বই রঞ্জিত ভট্টাচার্য নামে ওনাদের এক আত্মীয় চুরি করে নিয়ে চলে গেছে। কলকাতায় আবার নাকি অনেক বই জড়ো করেছিলেন, মুম্বাই যাবার সময় সেসব বই যাকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই লোকটাকে রাজনৈতিক মাস্তানরা এমন পিটুনি দিয়েছিল যে মরো-মরো লোকটা প্রায় ছয় মাস ভেলোরে ট্রিটমেন্টের পর সুস্থ হয়েছে, কিন্তু হিন্দু বাঙালিদের ওপর চটে গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছে, চার্চ-টার্চ যায়।

— ওঃ, তুই তো অনেক খবর রাখিস রে। সমরেন্দ্রর কী খবর?

—সমরজেঠুর গোলমালের কথা তুমি কী করে জানলে? জিগ্যেস করল ইতু।

—বড়জেঠিমাকে মোবাইল কিনে দিয়ে এই সুযোগটা পেয়েছি, উনি বহুক্ষণ আমার সঙ্গে গ্যাঁজাতে ভালোবাসেন। ওনার কাছ থেকে বাড়ির সব খবর পেয়ে যাই। বাংলায় কথা বলার সুযোগ পাই। আমি ওনার বেশ কিছু গল্প মোবাইলে রেকর্ড করে ল্যাপটপে ধরে রেখেছি। শুনি মাঝে-মাঝে।

—সমরজেঠুর লেটেস্ট সমস্যার কথা বলেছে জেঠি?

—কী সমস্যা?

—সৌদামিনীর বাচ্চাটাতো বেশ ফুটফুটে ক্যালেণ্ডার-খোকা হয়েছে। নবনীতাজেঠির দুই যমজ ছেলের চেয়ে ভালো দেখতে। তো সেই বাচ্চাটাকে মহাবীর নেমিচাঁদ নামে একজন বিলডার-কনট্রাক্টার লিফ্ট করিয়ে নিয়েছিল। বিলডারটার দুটো মেয়ে আছে, নয় বছর আর চোদ্দো বছরের; তবু ব্যাটা ছেলে-ছেলে করে অবসেসড ছিল। সৌদামিনী একদিন অটো করে বাচ্চাটাকে খগোলে ওর বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল মা-বাবাকে দেখাবার জন্য, তখন মোটর সাইকেলে দুজন লোক বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিয়ে দে চম্পট। সৌদামিনী, জানো বোধহয়, কেমন চালাকচতুর মেয়ে, মোটর সাইকেলের নম্বরটা মনে রেখেছিল। সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে কোতোয়ালিতে কমপ্লেন করার বারো ঘন্টার মধ্যে বাচ্চাটাকে ফেরত পায় ওরা। সবসুদ্দু সাতজন লোক ধরা পড়েছে। নেমিচাঁদ নাকি ওর বউকে সঙ্গে নিয়ে দানাপুরের এক মন্দিরে পুজো দিয়ে বেরোবার সময় সিঁড়িতে বাচ্চাটাকে পেয়ে ওর বউকে বুঝিয়ে ছিল যে বাচ্চাটা ঈশ্বরের দান। যে গুণ্ডাগুলোকে দিয়ে লিফ্ট করার কাজে লাগিয়েছিল, তারা, পরিকল্পনা অনুযায়ী বাচ্চাটাকে মন্দিরের সিঁড়িতে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে বাকি পেমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনই পুলিশ ওদের পাকড়াও করেছে। নেমিচাঁদ সৌদামিনিকে প্রোপোজাল দিয়েছে যে মামলাটা তুলে নিলে দুলাখ টাকা দেবে। সৌদামিনী সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে নেমিচাঁদের বাড়ি গিয়েছিল, এক লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে বিল্ডারটার কাছ থেকে, কিন্তু মামলা এখনও ফেরত নেয়নি সৌদামিনী, সমরজেঠু চাপ দিচ্ছে অ্যামাউন্ট বাড়াবার জন্য। পাটনার হিন্দি কাগজে তো সৌদামিনী আর সমরজেঠুর কোলে ওর বাচ্চা নিয়ে ফোটো বেরিয়েছিল, দেখোনি?

অমিত অবাক তাকিয়েছিল ইতুর দিকে। গল্প শেষ হলে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে কোনো গল্প পাবে না, কেবল শোষণ, অস্বাস্থ্য, মৃত্যু আর গুলিবারুদের রক্ত হিম করা গল্প পাবে। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শোষণ আর বঞ্চনার প্রতিদিনকার সত্যকার ঘটনা স্বচক্ষে দেখবে; তোমার এই গোপ্পুড়ে মস্তিষ্ক এখানে দিয়ারার গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে যাও। বাবার বক্তৃতার কয়েকটা কথা, যে কথাগুলোকে, শুনে-শুনে, অমিত মনে করে কিতাবি-বাকোয়াস, ব্যবহার করার সুযোগ ছাড়ল না।

উচ্ছ্বাসকে সামলে ইতু বলল, সরি, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই ছোটোবেলায় ফিরে গিয়েছিলুম, যখন ডাইনিং টেবিলে বসে বড়োরা সবাই মিলে শহরের নানা কেচ্ছা আলোচনা করত, আর আমরা ছোটোরা শুনতুম, তুইও তো হাঁ করে শুনতিস, ভুলে গেলি কেন।

—দু-দুটো মেয়ে রয়েছে লোকটার, আবার ছেলের কী দরকার? মেরে ফেলা মেয়ের কথা মনে পড়ল সুশান্তর, ওকে তো সেই মেয়ের মুখও দেখতে দেয়া হয়নি।

—সৌদামিনীর বডি দেখলে মাথা বিগড়োবেই। বটঠাকুমা বলেছিল যে একে রেখো না, এর ভাবগতিক ভালো নয়, কাজের বউয়ের অমন খাঁজ-দেখানো লোকাট ব্লাউজ কেন? কিন্তু সকলে মিলে সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল যে তিন তলা বাড়ি ঝ্যাঁটানো, পোঁছা আর এতগুলো লোকের বাসন মাজার জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য থাকা জরুরি।

সুশান্ত : আমার কাছে অমরেন্দ্রর গল্পটাও রেকর্ড করা আছে। বড়জেঠি বলেছিল একদিন, শুনবি?

ইতু : শোনাও, বড় জেঠি ভেতরের খবর আরো বেশি জানেন। অমরকাকু চলে গেছে ব্যাঙ্গালোর। কী করবে বল? বউ পালিয়ে গেলে পুরুষদের যে কী অবস্থা, যেন জাঁতিকলে পড়া জ্যান্ত ইঁদুর। অমিতের দিকে ফিরে ইতু বলল, তুই তো জানিস, অমরেন্দ্রকাকু আমাদের নতুনদাদুর ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট ছিল, খড়গপুরে পড়েছে, নতুনদাদু ওকে পড়াবার জন্য মেমারির তিন কাঠা জমি বিক্রি করে টাকা তুলেছিলেন।

অমিতের উদাসীন মুখের পানে তাকিয়ে ইতু টের পেল যে প্রসঙ্গটা তোলা উচিত হয়নি। অমিতের মা মানসী বর্মণ, পালিয়ে না গেলেও, স্বামীর উপস্থিতিতেই আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে অমিতের জন্ম দিয়েছেন। হয়ত অমিতের বাবা-মা সেই কারণেই অমিতকে মানুষ করার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন রাঙাকাকু-কাকিমার ওপর; ওনারা অমিতকে আইনত দত্তক নিয়ে নিলে অমিত নিশ্চই গর্দানিবাগের বাড়ি থেকে অমনভাবে উধাও হয়ে যেত না।

সুশান্ত : শোন। স্পিকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দিই।

ইতু : তোমার তরমুজ মদ দাও তো একটু, খেয়ে দেখি, হুইস্কি, রাম, ব্র্যাণ্ডি, জিন, ভোদকা খেয়েছি, চিড়াইয়াটাঁড়ের দেশিদারুও খেয়েছি, এই ধরণের রঙিন কান্ট্রি লিকার খাইনি। বার্থ ডে সেলিব্রেট করতে বার-রেস্তরাঁয় গেলে, বাবা বিয়ার এলাউ করত, বড় জোর, দু’পেগ প্রিমিয়াম হুইস্কি।

সুশান্ত। এই নে, চুমুক দিতে-দিতে শোন।

…এদিকে কী হয়েছে জানিস তো…অ্যাঁ…অমরের বউটা একজনের সঙ্গে পালিয়েছে…অমর রে…অমরেন্দ্র…প্রেম করে বিয়ে করেছিল…আই আই টিতে পড়ার সময়ে…বামুন বাড়ির মেয়ে…তুই তো দেখিসনি….বাবা…কী দেমাগ…মাটিতে পা পড়ে না…পালিয়েছে এক ব্যাটা তামিলিয়ানের সঙ্গে…কোথায় জানিস…আমেরিকা…অমর কেন জানতে পারেনি…তুই-ই বল…পাসপোর্ট ওর বউয়ের আগে থাকতেই ছিল…কবে ভিসা হল…কবে টিকিট হল…কাকপক্ষীও টের পায়নি…আচ্ছা তুই আমাকে বল…অমর কেন জানতে পারেনি না যে ওর বউ কার সঙ্গে মিশছে…কোথায় যাচ্ছে…রাত করে কেন ফিরছে…অমরের মতন পুরুষদের উচিত শাস্তি…ওরা বউকে মনে করে যেন ফলের গাছ…যখন ইচ্ছে এই ডাল থেকে আম খাচ্ছি..ওই ডাল থেকে লিচু খাচ্ছি…সেই ডাল থেকে আপেল খাচ্ছি…তা খাচ্ছিস তো খা না…কে বারণ করেছে…কিন্তু বউ তো আর গাছ নয়…যে এক জায়গায় শেকড় বসিয়ে সারা জীবন তোমার পোঁতা মাটিতে থেকে যাবে…আর তুমি আজ হিল্লিতে কাল দিল্লিতে যত্তো নচ্ছার বন্ধুদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করে বেড়াবে…বউয়েরও তা সাদ আহ্লাদ আছে…শরীর আছে…রসের চাহিদা আছে…তাকেও তো সময় দিতে হবে…বউকে অবহেলার ন্যায্য পুরস্কার পেয়েছে ব্যাটা…তুই তোর বউকে সময় দিস তো…তোর বউ অবশ্য পালাবে না…বউ তো গাছের মতন নয় যে নট নড়ন-চড়ন এক জায়গায় থেকে যাবে…এখন বোঝো…গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ঘুমোও…আর গাছের গুণকেত্তন করো খঞ্জনি বাজিয়ে…পরে আবার গল্প করব, অ্যাঁ…পার্কে বসে তোকে ফোন করছি রে…বাড়িতে কে আড়ি পেতে শুনবে…তার চেয়ে পার্কে আসি সকালে…ডায়াবেটিস কমাতে হলে নাকি দুবেলা হাঁটতে হবে…এই এক বেলাই হাঁটি…বিকেলে টিভিতে একটা প্রোগ্রাম হয়…মেজকত্তা কচুর লতি এনেছিল ভুল করে…লতির ঘণ্ট তোর প্রিয় ছিল বলে কাজের বউকে বললুম ফেলে দিয়ে আসতে… ও কী আর ফেলে দেবে…নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজেদের মতন করে রাঁধবে….রাঁধলে তোর মা কান্না সামলাতে পারবে না….বিকেলে টিভির জন্য সময় পাইনা…ভালো থাকিস…তোর বউ ছেলেকে আশীর্বাদ দিস…সকালে পুজো-আচ্চা আছে…জানিস তো…

ইশারায় বেবিকে ডেকে ইতুদের গিফ্ট দিতে বলল সুশান্ত, ইতু বলল, আরে তুমি বিয়ে করলে, নতুনবউকে গিফ্ট তো আমরাই দেবো, তোমার বউ কেন দেবে? তুমি বরং আমাদের কিছু মোটা টাকা দিও। তোমার বউকে দেবার মতন আমার সঙ্গে অবশ্য কিছুই নেই। তোমার বউয়ের গালে বরং একটা চুমু দিই।

বেবি হাজার টাকার দুটো প্যাকেট এনেছিল। সুশান্ত বলল, ওরা যেখানে গিয়ে সংসার পাতবে সেখানে বোধহয় লোকে একশ টাকার নোটও দেখতে পায় না। শুনে, বেবি প্রকৃতই হতবাক, বলল, বাংগালের লোকেরা কি বিহারিদের চেয়েও কাংগাল?

সুশান্ত বলল, একশ আর দশ-পাঁচ টাকার প্যাকেট নিয়ে আয়, হাজার টাকা প্যাকেট খুলে নিয়ে আয়। এনে ইতুর ঝোলাতে রেখে দে।

—জি। আচ্ছা।

ইতু : এরকম করকরে টাটকা হাজার টাকার নোটের প্যাকেট? এ তো আমিও দেখিনি গো!

সুশান্ত : পলিটিশিয়ান আর ঠিকেদারদের দেয়া ডোনেশান। শশুরমশাই মাসোহারা পান।

ইতু : এরকম রাজত্ব পেয়েছ, সঙ্গে দীঘলচাউনি রাজকন্যা পেয়েছ। ও, তাই তো ভাবি, কীসের টানে আটকে রইলে। তোমার বউতো একেবারে হরিণী, অমন বড়-বড় চোখ, এই বয়সে ফিগারও মেইনটেইন করেছে, গায়ের রঙের কী করার আছে! ওনার ব্যবহার অনেক মিষ্টি। ট্রফি বলে একটা কথা আছে, জানো তো, তোমার বউ হল সেই ট্রফি।

বেবি : হরণ? না ওনাকে বাবা হরণ করে আনেননি, উনি নিজেই এখানে বাবার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। তখন ওনাকে দেখতে অনেক ভালো ছিল, এখন মদ আর শুয়োরের মাংস খেয়ে-খেয়ে ভমচৌলা কুম্ভকরণ হয়ে গেছেন। ওনাকে দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। আমি কেন দিয়ারার অন্য কাউকে বিয়ে করতুম, বলুন, যখন এত ভালো পাত্র আমাদের দরোজায় শ্রীরামচন্দ্রের মতন এসেছে!

সুশান্ত : আমাকে হরণ করার কথা বলছে না। বলছে যে তুই হরিণের মতন সুন্দরী।

বেবি হাঁটু মুড়ে ইতুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, এতদিনে শশুরবাড়ির আশীর্বাদ পেলুম। ইতু ওর মাথা ধরে কপালে একটা চুমো দিল, বলল, তুমি তো বাক্যবাগীশ হরিণী গো, আমি ভাবতুম আমিই বুঝি গায়েপড়া বেহায়া; সুশান্তজেঠু, আমার হয়ে তোমার বউকে একটা মুখরোচক চুমু দিও। নিজের দুই হাত থেকে চারগাছা চুড়ি আর কান থেকে টপ খুলে বেবিকে দিয়ে ইতু বলল, যেখানে যাচ্ছি সেখানে এগুলোর প্রয়োজন হবে না, তুমি রেখে নাও। বেবি সুশান্তর দিকে চাইতে, সুশান্ত বলল, লে লে, কুছ তো তুঝে তেরে সসুরাল সে মিলা।

—এই ছিঃ, গুরুজন না, ইতুর চুমু প্রসঙ্গে বলল অমিত।

—কোনো-কোনো গুরুজন ঝাঁসু হন, ইয়ার্কিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসেন। সুশান্তজেঠু তাদের এক ও অদ্বিতীয়। করে নিচ্ছি ইয়ার্কি। আর তো বোধহয় দেখা হবে না। তাছাড়া এই মদটা বেশ কড়া। তোমার ছেলে অপুকে দেখছি না, তোমার শশুরবাড়ির ট্র্যাডিশান ফলো করে ওর বিয়ে দাওনি এখনও?

বেবি বলল, আপ্পু নাআআআআ? ওকে বিলেতে পাঠাতে চান উনি, আরও পড়াশুনা করার জন্য; বিলেতে গেলে কি আর ফিরবে? থেকে যাবে সেখানেই, টিভিতে দেখি, কত সুন্দর ওদেশের মেমরা, বুড়িরাও জোয়ান।

অপুর সঙ্গে ওদের দেখা হল না। অপু তো দিল্লিতে।

সুশান্ত ওদের নৌকোয় চাপিয়ে দিলে, গর্দানিবাগের বাড়িতে দেয়া মোবাইলটা গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিল ইতু। সুশান্ত ওকে একটা চোরাই মোবাইল আর চারটে বেনামি সিমকার্ড দিয়েছেন।

অমিতরা চলে যাবার পর সুশান্তকে মনমরা দেখে মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বেবি জানতে চাইল, পুরোনো দিনের জন্য আপনার মন খারাপ লাগছে?

অমিত আর ইতু চলে যাবার পর সুশান্ত ঘোষের মনে হচ্ছিল যে উনি প্রকৃতপক্ষে একা, নিঃসঙ্গে। ওনার বউ রয়েছে, চারিপাশে হুকুমবরদার রয়েছে, শশুর-শাশুড়ি রয়েছে, তবু উনি একা বোধ করেন নিজেকে। কেন এমন হয়? কিছুরই তো অভাব নেই। ঠাণ্ডা একটা চাঞ্চল্য, বিক্ষোভ, অজানা অসন্তোষ লুকিয়ে রয়েছে, সেন্স অব বিলংগিং নেই ওনার, সদা সন্ত্রস্ত থাকেন, ভয়ে নয়, সন্ত্রস্ত থাকার অবস্থানকে ভালোবেসে ফেলেছেন বলে। মনে করেন যে ওনার বাইরের সঙ্গে ভেতরের মিল নেই। হোক না অস্বাস্থ্যকর, তবু একা থাকতে ওনার ভালোলাগে। উনি তো সেই চাকরি করার সময় থেকে মিশে আসছেন সবায়ের সঙ্গে, ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে, কিন্তু দিয়ারায় স্থায়ী হবার পর থেকে আসেপাশের সবাই ওনাকে হতাশ করে চলেছে। উনি যেমন জগতসংসারের পরোয়া করেন না, তেমনই পৃথিবী ওনার পরোয়া করে না, জানেন উনি। এই যে অমিত বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে চাইছে, রাষ্ট্রকাঠামো বদলে ফেলে ইউটোপিয়া আনার স্বপ্ন দেখছে, তাতে জগতসংসারের বয়েই গেছে। কাটার সময় শুয়োরগুলো যেমন আতঙ্কিত চিৎকার দেয়, তেমনই নিঃশব্দ চিৎকার ওঠে ওনার অস্তিত্ব জুড়ে। তিনি যেন তাঁর নিজের মগজের ফাঁকা পোড়োবাড়ির একমাত্র ভাড়াটে। কিসের সঙ্গে যে সংঘর্ষ করে চলেছেন তা উনি নিজেই জানেন না। কে জানে কোন আড়ালে ওৎ পেতে আছে বিষণ্ণ আতঙ্ক, ঘষা কাচের ভঙ্গুর আদলে ভেসে বেড়াচ্ছে শরীরময়, পেটের ভেতরের কুনকি-হাঁস, যাকে তরমুজের মদ প্রতিদিন গিলিয়েও বশে আনা যাচ্ছে না। বেবির সমর্পিত ভালোবাসার অতিউন্নত খোঁয়াড় সত্ত্বেও নিজেকে কেন অসম্পূর্ণ মনে হয়, পার্থিব সব কিছু পাবার পরও, চাহিদা মেটার পরও, নিজেকে অতৃপ্ত মনে হয়, আর এগুলো তো স্থায়ী হয়ে গেছে। এ থেকে যে মুক্তি নেই, তা আরও বিষময় যন্ত্রণাদায়ক এক সমস্যা।