» » স্মৃতির জার

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

স্মৃতির জার : সাত

শেষবার যখন ইতু ওর ক্লিনিক থেকে নিজের সঙ্গে, একদা পালিয়ে-যাওয়া অমিতকে বাড়ি নিয়ে এলো, বিরোধের হল্কা প্রায় নিভে গিয়েছিল, কেননা ইতিমধ্যে একান্নবর্তী পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একে আরেকের সঙ্গে কথাহীন বার্তা-বিনিময় করে নিয়েছিলেন, যে, ইতুটাকে ঘাড় থেকে যদি নামানো যায় তাহলে স্থান-কাল-পাত্রের যেমন সুবিধা পাওয়া যাবে, তেমনই, আর্থিক দায়টাও বাড়ির বাইরে চালান করে দেয়া যাবে। এর আগে যখন অমিত এসেছে, সেদিন বিকেলেই চলে গেছে বা থেকে গেছে একদিন, বহিরাগতের মতন, অতিথির মতন নয়, বাড়ির সদস্যের মতন তো নয়ই।

শেষবার যখন অমিত এসেছিল, কোথায় শোবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল, ইতু প্রস্তাব দিল, তিনতলার ছাদে ওর ঘরেই রাতটা কাটাক অমিত, সঙ্গে টয়লেট-বাথরুম আছে, কোনো অসুবিধা হবে না; দোতলার বারান্দায় যে খাট পাতা আছে তাতে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়বে ইতু, একটা রাতেরই তো ব্যাপার। আগে ঘরটা ছিল সুশান্তর বাবার, তিনি মারা যেতে জাঠতুতো ভাই সমরেন্দ্রর দখলে গিয়েছিল; ওর বউ যমজ বাচ্চাদের ইতুদের বাড়ির জিম্মায় চাপিয়ে ঝাড়া হাত-পা ডিভোর্স দিয়ে নাচতে-গাইতে চলে গেছে, যার দরুণ নিজের বলার মতন একটা ঘর পেয়েছে ইতু।

অমিত যখন এই বাড়ির সদস্য ছিল, তখন ও একতলায় ওর রাঙাবাবা-রাঙামা, মানে ইতুর রাঙাকাকা-রাঙাকাকিমার ঘরে ওনাদের সঙ্গে থাকত। উধাও হবার পর প্রথমবার ফিরে, অমিত ওর রাঙাবাবা-রাঙামায়ের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখায়নি; ওনারাও কুন্ঠিত, হয়তো অমিত চলে যাওয়ায় ওনারা যেচে-নেয়া দায়ভার থেকে ছাড়ান পেয়েছেন।

শুকগে তিনতলার ঘরে, মরুকগে যাক, মেয়েটা মা-বাপকে খেয়েছে, এবার ছেলেটাকে খাক, বয়স্কদের মুখ দেখে, তাদের ঘিলুর ভেতরের মেঘে সেরকমই রুপোলি পাড় দেখতে পেয়েছিল ইতু।

সকলকে শুনিয়ে ইতু বলল, তুই চল, বিছানা পেতে দিচ্ছি, জিনিসপত্র নেই দেখছি, শুধু এই কাঁধব্যাগ?

—হ্যাঁ, এতেই আমার পেন আর খাতা আছে, সংবাদ যা পাই টুকে নিই, পরে অফিসে গিয়ে তথ্যগুলো খাতা থেকে লিখে নিই আর যা দেখেছি বা শুনেছি তা স্মৃতি থেকে লিখে নিই। অমিতের অভিনয়, সংলাপ।

—একটা ল্যাপটপ রাখলেই পারতিস, রিপোর্টাররা তো আজকাল ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এই সব নিয়ে কাজ করেন। ইতুর অভিনয়, সংলাপ।

—আমি এখনও টেকস্যাভি হতে পারিনি। হাতে কলম নিয়ে লিখতে ভালো লাগে আমার। অমিতের অভিনয়, সংলাপ।

—তুই স্নানটান করে রেডি হয়ে নে, খাবার সময় হলে ডেকে নেব। ইতুর অভিনয়, সংলাপ।

—আমার না খেলেও চলবে, রিপোর্টারের চাকরিতে সময়ে খাওয়া হয়ে ওঠে না, জানিসই তো, অভ্যাস হয়ে গেছে। অমিতের অভিনয়, সংলাপ।

—ও লজ্জা পাচ্ছিস। এমব্যারাসড ফিল করার কী আছে, আমি তোর ডিনার ঘরেই পৌঁছে দিচ্ছি। ডিনার মানে রুটি আর আলু-পটলের তরকারি হয়েছে আজকে। ছয়টা রুটি চলবে তো? ইতুর অভিনয়, সংলাপ।

—না না, দুটো রুটি হলেই হবে। অমিতের অভিনয়, সংলাপ।

রাঙাকাকা আর সুশান্তজেঠুর মা, যাকে ওনার ছেলেরা, ভাসুরপো-দেওরপোরা, তাদের বাচ্চারা, অন্নমা বলে ডাকে, অমিতকে বললেন, তুমি আসো বেশ ভালো লাগে বাবা, তুমি সুশান্তর সবচেয়ে কাছের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, এ-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েই বা কেন গিয়েছিলে, সব বাড়িতেই অমন মেলামেশা হয়, তাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় নাকি, কী আর বলব, আমার কোনো গুরুত্ব আর নেই, সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর কিছুই আর ভালো লাগে না। কিন্তু প্রতিবার অমন আপত্তি করো, আর যাই-যাই করো বলে মন খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই আমার মন বিষিয়ে থাকে, জানোই তো।

ইতু জানে, সুশান্তজেঠুর অভাব, জেঠুর বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলের মাধ্যমে কিছুটা মেটাবার চেষ্টা করেন অন্নমা। অতনুজেঠুকে ইতু দেখেছে ছোটোবেলায়, সুশান্তজেঠুর মোটরসাইকেলে বসে এ-বাড়িতে আসতে, কিন্তু ভুলে গেছে ওনার মুখ। সুশান্তজেঠু কিডন্যাপ হয়ে চলে গেলেন, তারপর অতনুজেঠু চাকরি-বাকরি ছেড়ে চলে গেলেন কোথাও। তখন সবাই বলত উনি সাধু হয়ে গেছেন, কুম্ভ মেলায় ওনাকে জটাজুট দেখা গেছে। শেষে উনি যখন অমিতকে এবাড়িতে রাখতে এলেন, ইতু তখন স্কুলে, জানা গিয়েছিল যে উনি নওয়াদা জেলার কোনো গ্রামে মানসী বর্মণের সঙ্গে সংসার পেতেছেন, সেই বাড়িতে আবার মানসী বর্মণের স্বামীও থাকেন। আরও পরে, যে অফিসে উনি কাজ করতেন, সেখানের কর্মীদের সূত্রে, কানাঘুষা শোনা গিয়েছিল যে ওনারা নকসল্লি-মালে আন্দোলন করতেন, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন; ওনাদের বিপ্লবী জীবনে শিশু অমিত খাপ খাবে না ভেবেই হয়ত রেখে গিয়েছিলেন ইতুদের বাড়িতে। বাবা-মাকে খুঁজে পাবার আগে পর্যন্ত অমিত ছিল বাবাহীন-মাহীন।

তিন তলার ঘরে পৌঁছে ইতু বলল, তোর মেসেঞ্জার আমাকে যে চিরকুট দিয়েছিল তাতে তো লেখা ছিল তুই কালকে সকালে আসবি? মেসেঞ্জারদের দেখে বাড়ির লোকেদেরও খটকা লাগে; বলেন ওরা কে রে, তোর পেশেন্ট, অথচ তুই তো বলতিস যে তোর রোগি জোটে না। বানচোদ, তোর জন্য কতো আর মিথ্যার সিনেমা করব? আমি বিপদে পড়লে ক্ষতি নেই, বাড়িসুদ্দু লোকেরা যেন বিপদে না পড়ে।

—আমার বিহারশরিফে একটা কাজ ছিল। প্রতিবারের মতন আমি পাটনায় চলে এলুম। কতদিন তোর সঙ্গে দেখা হয়নি, মুখোমুখি কথা হয়নি। তোকে টাচ অ্যান্ড ফিল করতে ইচ্ছে করে।

ডিনারের বদলে একটু পরে ফোটো অ্যালবাম নিয়ে এলো ইতু। খাটের ওপর বসে, অ্যালবাম খুলে দ্যাখালো, এই দেখ, আমাদের দোল খেলার দিন তুই, তোর ক্লাসের বন্ধুরা সবাই এসেছিল, এই যে তোর ছবি, কতকাল হয়ে গেল, অবহেলায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

গোটা দশেক ফোটো ছিল ওদের, সেগুলো প্লাসটিকের খাপ থেকে বের করে অমিত যখন বলল, আমি কি এগুলো রেখে নেব, তখন ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ইতু বলল, রেখে আবার কী করবি? ডেসট্রয় করে ফেলতে চাইছিস তো?

—হ্যাঁ, এ-বাড়িতে আমার কোনো চিহ্ণ রাখতে চাই না।

—পরে কথা হবে, ফোটোগুলো ছিঁড়তে-ছিঁড়তে বলল ইতু। তারপর হাতের মুঠোয় দলাটা ধরে যোগ করল, জ্বালিয়ে ফেলতে হবে তো? ডিনার আনছি, ঘুমিয়ে পড়িসনি যেন। ফোটোগুলো থাকলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি হতো না। এই বাড়িতে এসে কে-ই বা তোর ফোটো খুঁজবে। যাদের খোঁজবার তারা যদি সন্দেহ করে থাকে তাহলে তোর স্কুল-কলেজের রেকর্ড থেকেই যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে ডোসিয়ার বানিয়ে ফেলে থাকবে।

—ফোটোগুলো কেনই বা রেখেছিলিস, আননেসেসারিলি।

—ফোটোগুলো ছমাস যাবত প্রায়ই দেখতুম আর আশা করতুম যে তোর চিরকুট আসবে বা তুই নিজে আসবি। তার বদলে এসেছে তোর মেসেঞ্জার, একজন চিঠি দিয়ে যায়, তো আরেকজন নিয়ে যায়। ভাগ্যিস ক্লিনিকটা বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হল।

রাতভোজন এনে, সামনে বসে অমিতকে খাইয়ে, বাথরুম থেকে অমিত হাত ধুয়ে এলে, ইতু বলল, সকলের খাওয়া হয়ে গেছে, তোর আর কিছু চাই?

—না, এত করছিস আমার জন্য, না চাইতেই। কাল সকাল-সকাল বেরিয়ে যাবো।

—বার-বার অমন যাই-যাই কোরিসনি তো, ইউ ইডিয়ট। কতদিন পর তো এলি। বলেছিলিস সঙ্গে নিয়ে যাবি অথচ প্রতিবার এড়িয়ে যাস, ইউ লায়ার। আমার তো কেমন সন্দেহ হওয়া আরম্ভ হয়েছে। তোর হয়তো কিছুই চাই না, আমার চাই, আমি এবার তোর সঙ্গে যেতে চাই, পালাতে চাই এখান থেকে।

—কিন্তু..

—থাম দিকিনি। ফোটো জ্বালিয়ে এলুম, আর এখন আবার গল্প ফাঁদবার তালে আছিস। তোর কাঁধব্যাগও দেখে নিয়েছি, শুধু একটা লুঙ্গি আর গামছা। জানতুম না যে সিক্রেট কাল্টের মানুষরাও মিথ্যাবাদী হয়। আমি এবার তোর সঙ্গে যাচ্ছিই। ফাইনাল।

অমিত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আত্মগ্লানির মতন করে বলল, সিক্রেট কাল্ট বলে অপমান করিস না প্লিজ, চে গ্বেভারার নাম শুনেছিস?

—শুনেছি। বিপ্লবীদের রোমান্টিক মৃত্যু নিয়ে বেশ একটা মুখরোচক রহস্য তৈরি করে ফেলিস তোরা। গুয়েমুতে মরে পড়ে-থাকা স্তালিনকে নিয়ে, কই, তোদের মুখে কিছু শুনতে পাই না। পল পটের বিষয়েও শুনি না। কিম জং উন, কিম জং ইন, কিম জং হিং এটসেটরা, তাদের কথাও তো শুনি না। যাকগে যাক, কী হবে আমার ওসব জেনে? তোর কাজের অংশীদার করার প্রয়োজন মনে করিসনি আমাকে। আমি যেন তোর ডাকবাক্স। একজন চিঠি দিয়ে যায়, আর আরেকজন এসে নিয়ে যায়। এতই যখন বিশ্বাস করেছিস আমাকে, তো সঙ্গে নিসনি কেন? এ-বাড়ি ছেড়ে যখন উধাও হয়ে গেলি তখনই তো সঙ্গে নিতে পারতিস? তোর নিজের বাবা-মাকে খুঁজে পেলি, তবু নিয়ে গেলি না।

—চেয়ার রয়েছে তো, বোস না আয়েস করে, গল্প করা যাক।

ইতু বিছানার ওপর নিজেকে, তেমনই মনে হল অমিতের, পাথর-চাঁইয়ের মতন ফেলে, বলে উঠল, তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে, চেয়ারে বসলে হবে না। অমিত অনুমান করতে পারেনি ইতু কী করতে চলেছে। ইউ কাওয়ার্ড আহাম্মক, অমিতকে সজোরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল প্রগলভা ইতু; আঁকড়ে ধরে, ইতু নিজের ঠোঁট অমিতের ঠোঁটে চেপে ধরে রেখেই বলল, তুই হয় আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবি, নয়তো আমি আজকে রাতেই আত্মহত্যা করে তোর আরেকবার উধাও হয়ে যাওয়া ভণ্ডুল করে দেব।

—তুই কী করতে চাইছিস বল তো? দু’জনে এভাবে ধরা পড়ে গিয়েছিলুম বলে, আমাকে তোদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এবার দেখে ফেললে ওনারা নির্ঘাত গলাধাক্কা দেবার আগে বেদম পিটুনি দেবেন। বলল উদ্বিগ্নবাক অমিত।

—ছাঁচি পেঁয়াজি মারিসনি। ভয়কে কাবু করতে শেখ, স্টুপিড। মার খেলে পালটা মার দিতে শেখ। নিজে তো মা-বাবার আদর-ভালোবাসা খাচ্ছিস। আমার কি ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে না? জড়িয়ে ধর আমায়, হোল্ড মি ইন ইওর আর্মস, শক্ত করে ধর। প্রেম কর আমার সঙ্গে। জানি আমি প্রায় চটা-ওঠা, তামাটে, নাক-নকশা ভালো নয়। হলেই বা তুই কোনো সিক্রেট কাল্টের জানগুরু, আমিও তো মানুষ, না কি, অ্যাঁ। সাধারণ মানুষের জন্য, দেশের জন্য, কিছু করার কাজে কি আমার কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না? ইতুর নিঃশ্বাসে তাপ। অমিতকে জাপটে বিছানায় শুয়ে ইতু বলল, তোর মনে আছে নিশ্চই তোর মা তোকে ভালোবাসা সম্পর্কে কী বলেছিলেন? তবে?

—অমিত বলল, মায়ের কথায় তো সঠিক উত্তর পাইনি। যতই যাই হোক, কেন মা-বাবা আমাকে, নিজের বাচ্চাকে, ফেলে চলে গিয়েছিলেন, আর কখনও পেছন ফিরে তাকাননি, তার সঠিক উত্তর আজও পাইনি।

—অত-শত জানি না, আই অ্যাম নট গ্রেট লাইক দেম; নিজের আর্জের কথা জানি। অবদমনের মানসিক অশান্তির কথা জানি।

—এই বারই এত চাপ দিচ্ছিস কেন, ছমাস আগে তো এরকম বিহেভ করিসনি। আমার জন্যেই তুই সবায়ের দ্বারা অপমানিত হয়েছিলি। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর কার ছবি সামনে রেখে মিষ্টিবিষ্টি করতিস?

—আহাআআ, আহাআআ, মেয়েদের কোড ওয়র্ডটাও জানিস দেখছি। বেগুন ব্যবহার করতুম, বুঝলি। নারকেল তেলে ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশান হয় না। আর কিছু? বিব্রত করার চেষ্টা করিসনি। তুই কার ছবি মনে করে মিষ্টিবিষ্টি করতিস? কোনো ফিল্মস্টারের বোধহয়?

—না, একটা বিশেষ অঙ্গ কল্পনা করে নিতুম, যা নেটে দেখেছি। একটু দেখতে দে না।

—দ্যাখ, দেখে নে, ইউ বিট্রেয়ার, চোখের জলের আলোয় দেখে নে, ইউ মেনিমুখো কাওয়ার্ড।

—মুখ দেবো? আমার তো সিংহের কালো কেশর গজিয়েছে, দ্যাখ হাত দিয়ে।

—তোর চোখের জলে ভিজিয়ে ওখানে মুখ দিবি, হাঁটু গেড়ে বসে। গেট অন ইওর নিজ। কাঁদ, ফোঁপা, তোর ফোঁপানি শুনতে চাই আমি, কাঁদ, কাঁদ, কাঁদ, ইউ আনগ্রেটফুল ডেজার্টার। অমিতের চুল দু’মুঠোয় ধরে বলল ইতু।

ঘর্মাক্ত প্রেমের শেষে, প্রস্তুতির জন্য এনে-রাখা ওষুধের বড়ি গলায় ফেলে, বেডসাইড টেবলের গেলাস থেকে জল খেলো ইতু। বলল, ভিতুরা হল লাশের মতন, স্রোতের সঙ্গে ভাসে; স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরাতে শেখ, তোর অস্তিত্বে প্রাণ আছে কিনা তা প্রমাণ করতে হলে তোকে স্রোতের বিরুদ্ধে ননস্টপ হাত-পা চালিয়ে যেতে হবে।

—প্রথমবার প্রেম করতে গেলে যে ছড়ে যায়, জানতুম না, আমার ধারণা ছিল মেয়েদেরই ছেঁড়াছিঁড়ি হয়, বলল অমিত; তারপর যোগ করল, এসেছিলুম এক রাত কাটিয়ে চলে যাবো, এই ভেবে; তুই কি করলি জানিস? তুই আমাকে আইডেনটিটি দিলি, প্রেমিকের আইডেনটিটি, এ-ছাড়া আমার বলার মতো আত্মপরিচয় নেই। বাবা-মা বিসর্জন দিয়ে চলে গেল, তোদের বাড়ির লোকেরা যৌথ সম্পত্তিতে ভাগ বসাবো ভেবে দত্তক নিল না, পরিবারের অংশ বলে মনে করল না, প্রতি বছর আগের ছাত্রদের বই চেয়ে-চেয়ে পড়ে কোনো রকমে পাশ করতুম, স্কুলও ফালতু তকমা দিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসাতো। বাবা-মাকে যতটা বুঝেছি, ওনাদের কাছে আমি আরও হাজারখানেক কর্মীর একজন, গুরুত্বহীন। ওনারা যেসব তত্ত্বকথা আওড়ান, তা যে আমার জীবনে প্রযোজ্য, সেকথা ভুলে যান। বলতে-বলতে ছলছল-চোখ হয়ে গিয়েছিল অমিতের।

—তখন কাঁদতে বলেছিলুম, জাস্ট এ মোমেন্টারি রিভেঞ্জ, দ্যাট ওয়াজ এনাফ, আর ধ্যাড়াসনি, প্লিজ। কেন করলুম জানিস, বলল ইতু, তুই এবার আমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য হবি। তুই তো কাল্ট মেম্বার, কমিটেড, ডেডিকেটেড, আদর্শবাদী, অ্যান্ড হোয়াটএভার, ফেলে পালাতে তোর দায়বদ্ধ বিবেক বাধা দেবে। আই থিংক সো। আমাকে ধোকা দিয়ে পালাতেও পারবি না, আমি দোতলাতেই জেগে থাকব সারারাত, পাহারা দেব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে ছাড়াছাড়ি এটসেটরা, আই ডোন্ট কেয়ার, আমি একাই এনাফ। আর, গুছিয়ে বলি, তোর প্রাপ্য তোকে দিয়ে দিলুম, পরে দেয়া হয়ে উঠবে কিনা, দেবার সময়-সুযোগ হবে কিনা, তা তো জানি না।

—অমন অদ্ভূত সব খুঁতখুতে শব্দ কোথায় পেলি? না, তোকে ফেলে এবার পালাব না, পালাবার হলে আর আসতুমই না, তোদের বাড়ির গোমড়ামুখগুলো দেখতে; পাহারা দেবার দরকার নেই, তুই জানিস তোর টান ছিন্ন করতে পারিনি। তুই এবার আমার সঙ্গে যাবি। তোর কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয়ে গেছে। অকল্পনীয় কষ্টের জীবনে তোকে মানিয়ে নিতে হবে, শারীরিক কষ্টের। হয়ত পানীয় জল নেই, বিজলি বাতি নেই, শোবার ঘরবাড়ি নেই, প্রতিদিন খাবার জোটার সম্ভাবনা কম। পদে-পদে মৃত্যু ওৎ পেতে থাকতে পারে। সময়ে-অসময়ে ডাক্তারি করতে হতে পারে।

—বাড়ির কুচুটে নোংরা স্বার্থপর জঙ্গলে বসবাসের পর আমি আফ্রিকার সিংহ আর হায়েনাদের জঙ্গলে গিয়েও থাকতে পারব।

—জঙ্গলে নয়, ওরা সাভানার ঘাসভূমিতে থাকে।

—হোয়াটএভার, ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি। তোর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতুম।

—কেউ কোথাও আমাকে চিনে ফেললে, তুই বলবি তুই আমার সঙ্গী নোস, কোনো একটা জায়গায় যাবার নাম করে বলে দিস বাবা বা কাকার বাড়ি যাচ্ছিস।

—সে দেখা যাবে, কপি-পেস্ট সংলাপবাজি করিসনি। যখন অমন বিপদ আসবে তখন তার মোকাবিলা করব। তাছাড়া এটা পাটনা শহর। গয়া, নওয়াদা, সাসারাম, জেহানাবাদ, পালামউ নয়। এই শহরের জাতপ্রথার রাজনীতিকদের খেলা যতটা বুঝি, এখানে তোদের কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না; অবশ্য খুনোখুনি হলে আলাদা কথা।

—না, ওই লাইনে ভাবিসনি।

—কোথায় যাব আমরা? প্রশ্নটা এই জন্য করছি যে আমার যাবার সঙ্গে ইলোপ শব্দটা জুড়ে আছে।

—তুই যেখানে যাবি সেখানে যারা থাকে তারা মুরিয়া মারিয়া মাড় গোঁড়। দশ-পনেরো বছর আগে পর্যন্ত ওদের যুবতীরা পোশাক দিয়ে বুক ঢাকত না, খালি গায়ে গয়না পরে থাকত। কোনো-কোনো গ্রামে পৌঢ়ারা এখনও খালি গায়ে থাকে, যখন খুব গরম পড়ে। অবশ্য ওদের খুচরো জনবসতিগুলোকে গ্রাম বলা যায় না, এক জায়গায় চাষবাস করে আবার জনবসতি অন্য জায়গায় তুলে নিয়ে যেত, সেখানে গিয়ে এক ঋতু চাষবাস করে আবার অন্য কোথাও বসতি তুলে নিয়ে যেত। ব্রিটিশ গবেষকরা লিখে গেছেন ওদের মাড় শব্দটা নাকি এসেছে বনের আগুন, মানে, পলাশ ফুলের নাম থেকে। আমার তা মনে হয় না, কেননা গাছটাকে তো ওরা পুজো করে না। তার তুলনায় মহুয়াগাছকে শ্রদ্ধা করে।

—জঙ্গলমহলে? ঝাড়খণ্ডের খবরও তো পড়ি কাগজে।

—ওয়েস্ট বেঙ্গলে আর ঝাড়খণ্ডে কী গোঁড় বা মাড়িয়া উপজাতির মানুষ থাকে? আমি যাদের কথা বলছি তারা পশ্চিমবাংলার মানুষ নয়। সিলেবাসের বাইরে একটু-আধটু সাধারণ জ্ঞানের বই-টই পড়তে পারতিস। তুই যাবি দণ্ডকারণ্যের দুর্ভেদ্য, প্রায় দুর্ভেদ্য, জঙ্গলে। অবুঝমাড়।

—হ্যাঁ, অবুঝই ছিলাম এতকাল। অবুঝ জীবনে পড়ে-পড়ে মার খেয়েছি। তুই যাবি মানে? তুই যাচ্ছিস না? কিন্তু তুই ওরকম ব্লাডি মোরোনদের মতন বসে-বসে পা দোলাসনি।

—এই তো বললি যে সাধারণ দুস্থ গরিব মানুষের সেবা করতে চাস। আমার থাকা-না-থাকার সঙ্গে তোর জীবনের উদ্দেশ্যকে কেন জড়াচ্ছিস? আমার মা-বাবা তো আমাকে এখনও পুরোপুরি জড়ায়নি তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, আলাদা দায়িত্ব দিয়েছেন! আমি চিরকাল পরিত্যক্ত সন্তান থেকে যাবো, ফর দেয়ার কজ।

—আমিও ইনডিপেন্ডেন্টলি কাজ করতে চাই, তোর লেজুড় হবো বলিনি। আমি কারোর লেজুড় হতে চাই না। কিন্তু তুই না থাকলে কী করে জানবো যে কোথায় যেতে হবে, কাদের সেবা করতে হবে? হোয়াট অ্যাবাউট টাকাকড়ি?

—গন্তব্য তো তোর, ঠিকই পৌঁছে যাবি। জানি তুই যথেষ্ট বোল্ড, আউটস্পোকন, সেল্ফ-মেড, এমনকি দুঃসাহসী। নিজেকে প্রয়োগ করে দ্যাখ-ই না। ভারতের এলোমেলো-হেলাফেলা মানুষদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হোক। টাকাকড়ির জন্য সুশান্তজেঠুর দরবারে ঢুঁ মারব।

—ওকে, তবে তা-ই হোক। এবার থেকে আমিই আমার গন্তব্য। কারেক্ট, আমার উদ্দেশ্য আমি নিজে। জানি, গন্তব্যের লক্ষ্যে চলতে থাকা জরুরি, চলাটাই সফলতা, লক্ষ্যবস্তুটা নয়। আজ থেকে আমার কাছে যুক্তি আর যুক্তিহীনতার পার্থক্য রইল না। আর তো ভার্জিন থাকার বিড়ম্বনা রইল না যে আগের মতন ওয়ান-ডে প্রেমিকদের দুর্ভাবনায় সিঁটিয়ে থাকবো।

ঘুমোতে যাবার আগে ইতু ড্রয়ার থেকে কাপড় কাটার কাঁচি এনে বলল, আমার আকর্ষণের কেন্দ্র বা ভ্যানিটি, যা-ই বল, তা হল আমার চুল, তুই তো জানিস, এই নে, ঘাড়ের কাছ থেকে ঘ্যাঁচাৎ করে কেটে দে দিকিনি।

—ভ্যানিটি? আকর্ষণের কেন্দ্র? তা তোর সুরাহিদার গর্দন, ভারি পাছা আর নিটোল বুক।

—শাট আপ, চাপলুসি করিসনি। হ্যাঁ, আমার বুক সম্পর্কে আমার গর্ব আছে। কিন্তু ওগুলো তো আর কেটে বাদ দিতে পারি না। চুল কেটে দিতে বলছি, কাট, এই নে।

—এরকম দীর্ঘ চুল, পুরো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আ্ছে, তাকে বাদ দিয়ে দিতে চাইছিস?

—হ্যাঁ, জাস্ট ডু ইট, কেটে ফ্যাল, এত বড়ো চুল বয়ে বেড়ানো যায় না। আমিও আর আয়নার মুখ দেখতে চাই না। যাদের মাঝে বড়ো হয়েছি, তাদেরই যদি বাদ দিতে পারি, তাহলে চুলটুকু কেন বাদ দিতে পারব না?

চুল কাটতে গিয়ে অমিতের নজরে পড়ল মাথার শিয়রে স্যাঁতসেতে দেয়ালে সেলোটেপ দিয়ে একটা ইংরেজি পোস্টার লাগানো, ফ্যাকাশে, পুরোনো, ছেঁড়া। রঙিন হরফে লাইনের তলায় লাইন উদ্ধৃতি। চুল কাটার শেষে লাইনগুলো জোরে পড়ে ফেলছিল, ইতু বলল, মনে-মনে পড়, ওটা ডাকবাংলো রোডের ফুটপাথ থেকে কিনে এনেছিলুম। বেশ ভালো, না? অমিত অনুবাদ করে পড়ল :

“কখনও নিজেকে গুরুত্বহীন মনে করবেন না

কখনও উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করবেন না

কখনও সদর্থক দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন না

কখনও শরীরে আরামের শিকড় গজাতে দেবেন না

কখনও নিজেকে অক্ষম মনে করবেন না

কখনও অসন্তোষে আপ্লুত হয়ে নিজের সঙ্গে মনে-মনে কথা কইবেন না

কখনও আত্মাভিমান বর্জন করবেন না

আনন্দের মুহূর্ত ছোট্ট হলেইবা তাকে সযত্নে উপভোগ করুন”

চুলের কাটা গোছাটা ইতুর হাতে দিয়ে অমিত ইতুর মুখের দিকে অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে তাকাতে, ইতু বলল, হ্যাঁ, জানি, আমার মুখময় ওই কথাগুলো লেখা আছে, বহুকাল, পাঁচ বছরের বেশি, লেখা আছে, মগজে গেঁথে গেছে ইন ফ্যাক্ট। এতক্ষণে বোধহয় তুই আমার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলি। ভাগ্যিস চুলটা কাটতে বলেছিলুম, নয়তো ওদিকে তোর চোখ যেত না।

রাত দুটোয় তিনতলার ঘর থেকে নেমে দোতলার বারান্দায় ইতুর বিছানায় অমিত মশারি তুলে ঢুকতে গেলে, ইতু বলল, তুই যে আসবি জানতুম, তোর ভয়কে যে কাবু করতে পারলি, দ্যাখ, আমার কাছে নেমে আসাই তার প্রমাণ, আরো বড়ো প্রমাণ যে তুই জামাকাপড় খুলেই নেমে এসেছিস। তোর কাওয়ার্ডাইস থেকে তোকে বের করে আনার জন্য আমাকে কী করতে হল, ভেবে দেখেছিস? তুই আসবি জানতুম বলে আমিও শাড়ি-টাড়ি খুলে শুয়েছিলুম। দাঁড়া, এই খাটে আওয়াজ হয়, নিচের তলায় শোনা যায়। তিনতলার ছাদে চল, খোলা আকাশের তলায় শাড়ি পেতে সুহাগ-রাত করব। দ্বিতীয়বার আকুতিময় শ্বাসের ঘনঘটা আর স্পন্দনের লেনদেন শেষ হলে ইতু ওর দোতলার বিছানায় ফিরে যেতে যেতে বলল, স্কাউন্ড্রেল, কি তোড়ু লাভমেকিং করলি, বুকে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিস, হারামি কোথাকার; তূরীয়-মুহূর্তে সিংহরা সিংহীর মাথায় দাঁত বসায়, বুকে নয়।

ভোরবেলা বাড়ির লোকেরা জাগবার আগেই সদরের ছিটকিনি আলতো খুলে বেরিয়ে পড়েছিল দুজনে। কাঁধের ঝোলায় স্টেথোস্কোপ, মশার কামড়ের প্রতিষেধক মলম, কয়েকটা জরুরি ওষুধ, এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন, গামছা, পেনসিল টর্চ, এক সেট ডেনিম ট্রাউজার আর কটন-টপ পুরে নিয়েছিল ইতু; পায়ে জগিং করার কেডস। রাতের নোংরা হয়ে যাওয়া শাড়ি-শায়া আর চুলের গোছা দোতলার বিছানার ওপর ফেলে রেখে গেল, যাতে বাড়ির সদস্যরা আঁচ করতে পারেন যে ওরা দুজনে ষড় করে বাড়ি থেকে পালিয়েছে।

জানার পর আর ওনারা ইতুর খোঁজ করবেন না, জানে ইতু।

ইতুর পালানোর চাটনি-রসালো সংবাদ বাড়ির সদস্যরা শুনলেন কাজের বউয়ের মুখে। সকালে দরোজা খোলা পেয়ে সে অনুমান করেছিল যে বড়কর্তা প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে থাকবেন। তিনতলার ছাদে ইতুর ঘর থেকেই ঝ্যাঁটানো আর পোঁছা আরম্ভ করে। দেখলো ইতুদি বিছানা তোলেনি, দোতলাতেও আসার সময়ে দেখে এসেছে খাটের ওপর বিছানা গোটানো নেই, তার বদলে পড়ে আছে ইতুদির শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ। আর অনেকখানি চুল, দেখলেই বোঝা যায় ইতুদিদির চুল, বাড়িতে আর কারোর চুলই অমন কোঁকড়া আর লম্বা নয়। শাড়ি তুলে তাতে অতিপরিচিত আঠা দেখে, নাকের কাছে এনে মোহক গন্ধে আতঙ্কিত হয়ে উঠল বিহারি কাজের ব্‌উ রুকমিনি।

কাজের বউয়ের হাঁক, ইতুদিদি বিছৌনা তোলোনি কেন আজকে, ঘরে বসে খেয়েছ, বাসনও ফেলে রেখেছ, কলতলায় নিয়ে গিয়ে রাখেনি, ইতুদিদি, ইতুদিদি..

বাড়ির মেজবুড়োর কন্ঠস্বর শোনা গেল, ইতু ওপরেই আছে দ্যাখ, দোতলায় এখনও মশারি ফেলে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ডেকে তোল। ইতুর ঘরে একজন অতিথি আছে, টয়লেটে গিয়ে থাকবে, অমিত, আমাদের বাড়িতে থাকত আগে, তুই বোধহয় দেখিসনি, সৌদামিনী কাজ করত তখন।

রুকমিনি টয়লেটে-বাথরুমে ঢুঁ মেরে দেখল ফাঁকা, কেউই নেই। চেঁচিয়ে বলল, কেউ নেই, অতিথিও নেই, দোতলার বিছানায় ইতুদিদিও নেই। শাড়ি-শায়া-বেলাউজ পড়ে আছে, সঙ্গে ওনার কাটা চুল।

রুকমিনির হাঁকডাকে, যে হাঁকডাকে শাড়ি-শায়ায় আঠামাখা গন্ধের প্রচ্ছন্ন আহ্লাদ ছিল, শুনে, বাড়ির অধিকাংশ সদস্য, বৃদ্ধরা ছাড়া, দৌড়ে প্রথমে দোতলার বিছানায় দোমড়ানো শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ-চুলের গোছা আর তারপর তিনতলায় পৌঁছোলে, রুকমিনি পান-খাওয়া দাঁতে হাসি মাখিয়ে যখন বলল যে বাড়ির সদর দরজা খোলা ছিল, তখন সকলে ঠাহর করতে পারল যে ইতু অতিথির সঙ্গে উধাও হয়েছে।

—বিয়ে দিলে না তোমরা সময় মতন, পালাবে না তো কি করবে? বললেন সেজকর্তার গোলগাল ভারিভরকম স্ত্রী, সাতসকালে ওজনদার শরীর নিয়ে বাতের ব্যথা সত্ত্বেও তিনতলায় হাঁটু ভেঙে উঠতে হয়েছে বলে যিনি ক্লান্ত, হাঁপাচ্ছিলেন।

—অমিতের সঙ্গে ওদের সম্বন্ধটা করে ফেললেই হতো, তোমরাই অযথা ছেলেটার মা-বাবার সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে মেয়েটার জীবন গোলমাল করে দিলে। সুযোগ পেয়ে বলে নিলেন রাঙাকাকি। ওরা ভাইবোন নাকি? তোমরা ভাইবোন-ভাইবোন আওড়াতে লাগলে। এখন হল তো সেই-ই।

—যাক ভালোই হল একদিক থেকে, দায়িত্বটা বড় খচখচ করত এদান্তি। বললেন মেজকর্তা।

মেজকর্তার দুই যমজ নাতি, পাঁচে পড়েছে সবে, যাদের মা, মানে মেজকর্তার বড় ছেলের স্ত্রী, ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে, নাতিরা একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, ঘরটা আমরা নেবো, আমাদের নিজেদের ঘর নেই, পড়াশোনার ডিসটার্বেন্স হয়, একতলার বারান্দায় বড্ড চেঁচামেচি করে সবাই।

—পড়াশুনোর নামে নিজেদের ঘর মানে তো দেয়ালে সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে জেনিফার লোপেজ. লেডি গাগা আর কাটরিনা কাইফের ব্লোআপ, সৌরভের হাফ-টেকো পোস্টারটা বদলে ফেলিস, এখন ওর মাথায় আবার চুল গজিয়েছে। বললে দুই খোকাটে নাতির বাবা, পরোক্ষে তাদের দাবির সমর্থনে। দুই নাতির দিকে তাকিয়ে মুখে পানপরাগি-হাসি খেলালো রুকমিনি।

ইতুর পলায়নে তৃপ্ত অভিভাবকরা সিঁড়ির ধাপে চোখ রেখে, এক-পা দু-পা করে নেমে চলে গেলেন যে যার ঘরে। নাতি দুজন তিনতলার ছাদের ঘরে ঢুকে ইতুর আর ইতুর আগে ওদের বাবার চাকরানি-প্রেমী যৌনতার স্মৃতিকে নিশ্চিহ্ণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

—চুলটা আমি নিচ্ছি, খোঁপার ভেতরে ঢুকিয়ে বানখোঁপা বাঁধলে বেশ ভালো দেখাবে। নেবো তো? জিগ্যেস করল রুকমিনি, নেমে যেতে থাকা সিঁড়ির উদ্দেশ্যে।

—নিয়ে নে, বিছানার ওপর যা শাড়ি-টাড়ি আছে সেগুলোও যাবার সময় নিয়ে যাস।

—আর যেগুলো ইতুদিদির আলমারিতে আছে?

—নিয়ে যাস সময় করে, কিন্তু গিটারটা নিসনি যেন, ওটা নবনীতার, ফাইনাল ঝগড়া করবে বলে রেখে গেছে। জবাব দিল নামতে-থাকা সিঁড়ি।

রুকমিনিকে রাখা হয়েছে তার আগের কাজের বউ সৌদামিনির সঙ্গে দুই নাতির বাবা সমরেন্দ্রর আঠালো সম্পর্ক ধরা পড়ে যাবার পর। সৌদামিনির সঙ্গে দুপুরে বিছানায়, ওদেরই বিছানায়, দুই নাতি তখন শিশু, সমরেন্দ্র রঙ্গিলা-রতির ম্যাটিনি শো করছিল। শিশুদের দেখাশোনার জন্যই রাখা হয়েছিল সৌদামিনীকে, যার বর আরেকটা বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে গেছে হরিয়ানার খেত-খলিহানে কাজ করতে। সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা অনুমান করেছিল যে কিছু একটা গোলমাল চলছে, কেননা যখনই সৌদামিনীকে বকুনি দেয় নবনীতা, তখনই সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে সমরেন্দ্র ঝগড়া করত নবনীতার সঙ্গে। একবার তো নবনীতার গালে চড় কষিয়ে দিয়েছিল সমরেন্দ্র, শিশু দুটোর কান্না সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে শুনে অফিসের পোশাকেই সোজা তিন তলার ছাদের ঘরে পৌঁছে দ্যাখে বাচ্চা দুটো গুয়েমুতে মাখামাখি। যে ডায়াপার নবনীতা পরিয়ে গিয়েছিল, দুটো বাচ্চাই সেগুলো পরে আছে, আলগা ডায়াপারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গুয়ের স্রোত।

নবনীতা সৌদামিনিকে বকুনি দিতে, বুকে কাপড় চেপে ও সমরেন্দ্রর দিকে চোখ কুঁচকে তাকালে, সমরেন্দ্র সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল, কত কাজ করবে ও, সারা বাড়ির ফাই ফরমাস, তারপর দু-দুটো বাচ্চা সামলানো।

—ও, কাজের বউ তার মালিকের মুখ নিজের বুকে গুঁজে খাটছিল, তাই না? দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল নবনীতা।

—ও তুমি বুঝবে না, যাদের হৃদয় বড়ো হয় তাদের বুকের মাপও বড়ো হয়। সমরেন্দ্রর উত্তর।

—হৃদয় বড়ো না ছোটো তা বিয়ের আগে তো আন্দাজ করে থাকবে?

—তখন তো দেখে মনে হয়েছিল হৃদয় যথেষ্ট বড়ো। তা যে নকল কী করে জানব?

—নকল হৃদয়ের সুধারস পান করার সময় তো উচ্ছ্বসিত হতে।

হাঁ করে তাকিয়ে থাকা সৌদামিনীকে বুঝিয়েছিল সমরেন্দ্র, হৃদয় মতলব দিল, যিস অওরতকা দিল জিতনা বড়া, উস অওরতকা ছাতি ভি উতনাহি বড়া হোতা হ্যায়।

সমরেন্দ্র যখন ডিউটি আওয়ার্স পালটে রাতের শিফট নিল, সন্দেহে জারিত নবনীতা সেদিনই নির্ণয় নিয়েছিল যে ব্যাপারটাকে এবার ট্যাকল করতেই হবে। একদিন অফিস যাবার নাম করে অফিসে না গিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে সময় কাটিয়ে দুপুর বারোটা নাগাদ পা টিপে-টিপে ওপরে উঠে দরোজা আলতো ফাঁক করে দ্যাখে সৌদামিনি আর সমরেন্দ্র দুজনে উলঙ্গ হয়ে ঘুমোচ্ছে বিছানায়। তিনতলার ছাদে কেউ আসে না ভেবে ওরা দুজনে বেপরোয়া হয়ে গিয়ে থাকবে, তাই দরোজা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেনি।

বড়জেঠি আর রাঙাকাকিকে চুপচাপ ডেকে এনে, দরোজা ঠেলে, সৌদামিনী পর্বের শেষ দৃশ্যের অভিনয় নবনীতা দেখিয়ে দিয়েছিল ওনাদের। তাৎক্ষণিক ঝগড়া, বড়ো-হৃদয়ের প্রাপ্তি সম্পর্কিত বুকের আদল, ইত্যাদি প্রগাঢ় মন্তব্য। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে নবনীতা সোজা বাপের বাড়ি, কয়েকদিন পর ডিভোর্সের নোটিস, ব্যাস। সমরেন্দ্র চালান হল দুই শিশুর সঙ্গে একতলায়, কেননা শিশুদের দেখাশোনা যাঁরা করবেন তাঁদের একতলা-তিনতলা করার ক্ষমতা ছিল না।

ইতু পেয়ে গেল ঘরটা। রুকমিনি পেয়ে গেল চাকরি।

সমরেন্দ্র আর বিয়ে করেনি। এখনও নাইট ডিউটি করে। দুপুরে বেরিয়ে যায় খেয়েদেয়ে, যেখানে যায় সেখান থেকেই নাইট ডিউটি করতে চলে যায়। বাড়ির সবাই জানে কোথায় যায়। রুকমিনি পেছন-পেছন গিয়ে দেখে এসেছে, সৌদামিনীর বস্তির ঘরে ঢুকছে সমরেন্দ্র। সৌদামিনীর তিন মাসের বাচ্চাটা যে সমরেন্দ্রর তাতে কোনো সন্দেহ নেই, অত চেকনাই-মার্কা বাচ্চা কী করেই বা হবে! সৌদামিনী সাঁওলা ওর পালিয়ে-যাওয়া বর কালো। বাচ্চা চেকনাই-মার্কা বলে সৌদামিনীর কত গর্ব, রুকমিনিকে বলেছিল, এরকম খোকা-বাচ্চা তোর কোনো কালেই হবে না; পারিস তো করে দ্যাখা। অটোতে বসিয়ে সৌদামিনীকে কুর্জি হোলো ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সমরেন্দ্র, বাচ্চা হবার সময়ে, ফর্মে বাপের জায়গায় নিজের নামই লিখেছে, রুকমিনিকে জানিয়েছে সৌদামিনী, নিজের স্কুটারের পেছনে বসিয়ে পোলিও ড্রপস খাওয়াতে, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় ওর বাংগালি আদমি, সাচ্চা দিলওয়ালা।

সমরবাবু বাচ্চাটার খাওয়াপরার খরচ দ্যায় আর বলেছে বড়ো হলে ওকে ভালো আংরেজি স্কুলে পড়াবে।

—কী করে শুরু হল তোদের প্যার-মোহোব্বত? জানতে চেয়েছিল রুকমিনি।

—বাচ্চা দুটো একদিন ভিষণ কাঁদছিল, একেবারেই চুপ করছিল না, কী করব ভেবে পাচ্ছিলুম না, তো সমরবাবু বলল, তোর দুই বুকে বাচ্চা দুটোর মুখ গুঁজে দে না, তোর বুক তো নবনীতা মেমসাবের চেয়ে বড়-বড়। আমি বললুম আমার বুকে তো দুধ নেই, ওরা কি হাওয়া খেয়ে চুপ করবে? জবাবে সমরবাবু বললে, বাচ্চারা যেভাবে চুষিকাঠি চুষে ঘুমিয়ে পড়ে, তুই ওদের মুখে তোর বুক গুঁজে দ্যাখ চুপ করে যাবে, ঘুমিয়েও পড়বে। সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল বাচ্চা দুটো। সমরবাবু আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বললুম, আমি রোজ-রোজ একাজ করতে পারব না। সমরবাবু জিগ্যেস করল, কেন, তোর অসুবিধা কিসের। আমি বললুম, বাচ্চারা আমার বুক চুষলে গা থিরথিরিয়ে যায়, মনে হয় কাউকে জড়িয়ে ধরি। তা সমরবাবু তক্ষুনি আমায় জড়িয়ে ধরলে পেছন থেকে আর বললে, যখনই তোর শরীর থিরথিরোবে, আমাকে বলবি, আমি শান্ত করে দেব। তারপর তো সমরবাবু দিনের বেলার অফিসের ডিউটিকে রাতের ডিউটি করে নিলে, আমরা দুজনে মিলে বাচ্চা দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে, নবনীতা দিদির বিছানায় শুয়ে পড়তুম। কত রকম ভাবে প্যার-মোহোব্বত করতে পারে সমরবাবু; কাঁইচিমার মোহোব্বত করতে শিখিয়েছে। চুল ওঠাবার কিরিম, বগলের পাউডার, বুকের কিরিম, গায়ে গন্ধমাখার গ্যাসের টিন, শ্যাম্পু, লিসটিপ, প্যার-মোহোব্বত করতে গেলে এসব জিনিস কত দরকার তা সমরবাবুর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। নবনীতা দিদি জানবার পর আমাকে যখন বকুনি দিচ্ছিল, সমরবাবু নবনীতাকে গালে কষে দিয়েছে এক থাপ্পড়, এইসান, ধাঁয়। ওনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, আমি সমরবাবুকে পেয়ে গেলুম, এখন আমি ডবল মাইনে পাই, কাজও করতে হয় না।

ডিভোর্স দেয়া সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা এখন নিজের মারুতি গাড়ি চেপে অফিস যায়, নিজে চালায়। বলেছে, যাদের বাড়ির পদবি নিয়ে বাচ্চা দুটো জন্মেছে, তারাই মানুষ করুক। সৌদামিনীকে স্কুটারে পেছনে বসিয়ে, রাজপথে নবনীতার গাড়ি দেখতে পেলে, তার পাশাপাশি চালায় সমরেন্দ্র। নবনীতার দিকে বাচ্চাটাকে তুলে দেখিয়েছে সৌদামিনী, বত্রিশপাটি হাসি ফুটিয়ে। সেই ঘটনার পর, আইনত নিষিদ্ধ হলেও, গাড়ির কাচে কালচে সানফিল্ম লাগিয়েছে নবনীতা।