বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্যারীচাঁদ॥
প্যারীচাঁদ মিত্র আখ্যানের উপযোগী বাংলা গদ্য সৃষ্টি ও উপন্যাসের দ্বারোদ্ঘাটন করে এবং বাঙালীর সমাজ ও পারিবারিক জীবনের জীবন্ত চিত্র এঁকে বাংলা গদ্যসাহিত্যে যে অভিনবত্বের সূচনা করেন, পরের যুগে উপযুক্ততর প্রতিভাবান শিল্পীর আবির্ভাবে সে শাখার আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়। ইতিপূর্বে আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, প্যারীচাঁদের পূর্বে বাংলাভাষার যথার্থ মৌলিক উপন্যাসের প্রথম স্রষ্টা প্যারীচাঁদ। হানা ক্যাথারীন ম্যলেন্সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ ‘আলালে’র কিছু আগে প্রকাশিত হলেও এটি কেবলমাত্র দেশীয় খ্রীস্টান সমাজের জন্য লেখা বলে এর সঙ্গে বাঙালী হিন্দুসমাজের কোন যোগাযোগ ছিল না। সেই জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি এতদিনে অপাংক্তেয় হয়ে ছিল। তা ছাড়া শিল্পবিচারে ম্যলেন্সের চেয়ে প্যারীচাঁদ অনেক বেশী দক্ষ ও সার্থক লেখক। এ কথা ঠিকই, প্যারীচাঁদের কিছু পূর্ব থেকে ধনী ও ভ্রষ্ট সমাজকে ব্যঙ্গ করে সাময়িক পত্রে (‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় প্রকাশিত ‘সৌকীন বাবুর বিবরণ’ স্মরণীয়) যে-সমস্ত রঙ্গরসের কল্পিত-কাহিনী প্রকাশিত হত, তাতেই সর্বপ্রথম আখ্যানরসের ছিটেফোঁটা প্রকাশ পায়। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের এ অভিমত সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত :
“তিনি প্রথম দেখাইলেন যে, সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরেই আছে,—তাহার জন্য ইংরাজি বা সংস্কৃতের কাছে ভিক্ষা চাহিতে হয় না। তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, যেমন জীবনে তেমনই সাহিত্যে, ঘরের সামগ্রী যত সুন্দর, পরের সামগ্রী তত সুন্দর বোধ হয় না।” (‘লুপ্তরত্নোদ্ধার’- এর ভূমিকা)
ঘরের কথাকে ঘরোয়াভাবে পরিবেশন করে,1 চেনামানুষের মুখে বিস্ময়রস ফুটিয়ে তুলে, চরিত্রানুরূপ সংলাপ জুগিয়ে2 tale বা সাধারণ আখ্যানের মধ্যে চরিত্রসৃষ্টির চেষ্টা করে, সর্বোপরি কাহিনীকে পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়ে তিনি যে কিয়ৎপরিমাণে কথাসাহিত্যের দায়িত্ব পালন করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। উপসংহারে তাঁর ভাষা সম্বন্ধে দু’চার কথা বলা যাক। ‘আলালের ঘরের দুলালে’ মিশ্র রীতি ব্যবহৃত হয়েছে। প্যারীচাঁদ সাধুভাষা, কলকাতাই চলতি বুলি ও বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষার সাহায্য নিয়ে কৌতুকরসের মারতে চরিত্রের অধোগতি ও তার থেকে উদ্ধারলাভের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ‘আলালে’ সাধুভাষা ও চলতি ভাষার যথেষ্ট জগাখিচুড়ি পাকিয়েছে, পরে তাঁর ভাষা থেকে এদোষ অনেকটা লোপ পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের আগে পর্যন্ত প্রায় সমস্ত কথাসাহিত্যিকের এ দোষ পুরোমাত্রার ছিল। সাধুভাষা ও চলিতভাষার অসতর্ক সংমিশ্রণকে কেউ দোষাবহ বলে মনে করতেন না। যাঁরা আগাগোড়া সাধুভাষায় (মায় সংলাপ পর্যন্ত) উপন্যাস লিখতেন তাদের ভাষায় কিন্তু এদোষ বড়ো একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু যারা সাধুভাষায় আখ্যান বর্ণনা এবং সংলাপে চলতিভাষার সাহায্য নেবার চেষ্টা করতেন, তাঁদের লেখাতেই, বিশেষতঃ সংলাপে এই ত্রুটি বড়ো বেশী প্রকট হয়ে উঠত। অবশ্য সেযুগের পাঠকেরাও এ-দোষ সম্বন্ধে আগে অবহিত ছিলেন না। প্যারীচাঁদের প্রথম দুটি আখ্যানে ভাষাসংমিশ্রণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যাসাগরের ভারী ভারী সংস্কৃতগন্ধী ভাষা রীতির বিরুদ্ধেই নাকি প্যারীচাঁদ এই মিশ্র হাল্কা কৌতুকরসসিঞ্চিত ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। শোনা যায় এই ভাষারীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে মাইকেল মধুসূদনের তর্ক হয়েছিল। ‘মাসিক পত্রিকা’য় প্রকাশিত ‘আলালী’ ভাষা সম্পর্কে মধুসূদন প্যারীচাঁদের কাছে অনুযোগ করেন, “আপনি এ আবার কি লিখিতে বসিয়াছেন?—লোকে ঘরে আটপৌরে যাহা হয় পরিয়া আত্মীয়স্বজন সকাশে বিচরণ করিতে পারে; কিন্তু বাহিরে যাইতে হইলে সে বেশে যাওয়া চলে না। পোষাকী পরিচ্ছদের প্রয়োজনীয়তা এইখানে। আপনি দেখিতেছি, ‘পোষাকী’র পাঠ তুলিয়া দিয়া ঘরে বাহিরে সভা-সমাজে সর্বত্রই আটপৌরে চালাইতে চাহেন। ইহাও কি কখনও সম্ভব?” তার উত্তরে উত্তেজিত হয়ে প্যারীচাঁদ বলেছিলেন, “তুমি বাঙ্গালা ভাষার কি বুঝিবে? তবে, জানিয়া রাগ, আমার প্রবর্তিত এই রচনা-পদ্ধতিই বাঙ্গালা ভাষায় নির্বিবাদে প্রচলিত এবং চিরস্থায়ী হইবে।” তার উত্তরে মধুহুদন যথার্থ বলেছিলেন, “It is the language of fisherman, unless you import largely from Sanskrit.”3
গ্রন্থাকারে ‘আলাল’ প্রকাশের পূর্বেই বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭), ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ দ্বিতীয় ভাগ (১৮৪৮), ‘জীবনচরিত’ (১৮৪৯) ‘বোধোদয়’ (১৮৫১), ‘সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৩), ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪), ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (প্রথম ও দ্বিতীয় ১৮৫৫), ‘কথামালা’ (১৮৫৬), ‘চরিতাবলি’ (১৮৫৬)–এতগুলি পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ ও ‘সীতার বনবাসে’র ভাষা একটু গুরুভার। কিন্তু অন্য রচনায় সংস্কৃতগন্ধী জড়তার চিহ্ন অতি অল্পই আছে; এ গল্প অতি পরিচ্ছন্ন—পরবর্তীকালেরও আদর্শস্থল। সুতরাং কেন যে প্যারীচাঁদকে বিদ্যাসাগরীভাষার প্রতিপক্ষরূপে খাড়া করা হয়েছিল তা বোঝা যাচ্ছে না। বরং ‘আলালে’ যে ধরনের জগাখিচুড়ি ভাষা ও কৌতুকের বাড়াবাড়ি আছে, যাকে খানিকটা সাগরী ভাষার বিপরীত বলা যায়, উত্তরকালে সেই রীতি প্যারীচাঁদ নিজেই ত্যাগ করে প্রকারান্তরে সাগরী সত্যই অবলম্বন করেছিলেন সেকথা আমরা পূর্বেই বলেছি। ‘আলালী’ ভাষা শুধু ‘আলালের ঘরের দুলালে’ই রয়ে গেছে, প্যারীচাঁদের অন্যান্য রচনা এদিক থেকে আলালী প্রভাব মুক্ত।
প্যারীচাঁদ তার প্রথম গ্রন্থের দ্বারাই স্মরণীয় হয়েছেন, সেকাল এবং একালেও পাঠক-পাঠিকা তাঁকে এই জন্যই অন্তরঙ্গ জন বলে মনে করেন। একমাত্র রামগতি ন্যায়রত্ব (‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব’ – ১৮৭২) ছাড়া আর কেউ প্রকাশ্যে তাঁর ভাষারীতি ও রচনার নিন্দা করেন নি। তাঁকে বিদ্যাসাগরের ভাষার বিপরীতে দাঁড় করাবার চেষ্টা হয়েছিল বলেই সম্ভবতঃ বিদ্যাসাগরের ভক্ত শিষ্য রামগতি ন্যায়রত্ন ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাবে’ প্যারীচাঁদের গ্রন্থের বিষয়বস্তু ও ভাষার বিলক্ষণ সমালোচনা করেছিলেন। তার বিরুপতার আরও কারণ ছিল। প্যারীচাঁদ একাধিক লেখায় সেকালের অধঃপতিত ব্রাহ্মণসমাজকে ব্যঙ্গ করেছিলেন। এই ব্যঙ্গ বিদ্রূপনিন্দাকে ব্রাহ্মণপণ্ডিত রামগতি নিজের গায়ে মেখে নিম্নে প্যারীচাঁদকেও নিন্দাবাণে জর্জরিত করেছিলেন। রুষ্ট রামগতির মন্তব্য একালে কৌতুকের সঙ্গেই স্মরণীয় :
“কিন্তু পাঠকগণ। দেখুন, হিন্দু জাতির গৌরবস্থল সেই ব্রাহ্মণপণ্ডিত মহাশয় দিগের প্রতি টেক্চাঁদ বাবু কিরূপ বিজ্ঞোচিত বাক্য প্রয়োগ করিয়াছেন! তিনি বাবুরামের শ্রাদ্ধ বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন— “দিন রাত্রি ব্রাহ্মণপণ্ডিত ও অধ্যাপকের আগমন, যেন গো-মড়কে মুচির পার্বণ!” কেবল ব্রাহ্মণপণ্ডিতের উপরেই কেন? ব্রাহ্মণজাতির প্রতিই টেকচাঁদ বাবুর যেন কিছু বিদ্বেষ আছে বোধ হয়, যেহেতু তিনি আগড়পাড়াই ব্রাহ্মণপণ্ডিত গোষ্ঠীর বর্ণনায় লিখিয়াছেন, “বামুনে বুদ্ধি প্রায় বড় মোটা—সকল সময়ে সবকথা তলিয়ে বুঝিতে পারে না—ন্যায়শাস্ত্রের ফেঁকড়ি পড়িয়া কেবল ন্যায়শাস্ত্রীয় বুদ্ধি হয়।” ইত্যাদি—এক্ষণে টেকচাঁদ বাবুর প্রতি আমাদের জিজ্ঞাস্য এই যে, ন্যায়শাস্ত্র বোঝা কি মোটা বৃদ্ধির কর্ম? এ পর্যন্ত ঐ ‘মোটাবুদ্ধি’ ব্ৰাহ্মণ ভিন্ন কয়জন সরুবুদ্ধি ইতরজাতীয় লোকে4 ন্যায়শাস্ত্র বুঝিতে পারিয়াছেন?5
প্যারীচাঁদের ‘আলালী ভাষাও পণ্ডিত রামগতির মনে ধরেনি। তাঁর মতে, হাল্কা ব্যাপারে ‘আলালী’ ভাষার যৎকিঞ্চিৎ প্রয়োজনীয়তা থাকলেও “শিক্ষাপ্রদ বা প্রগাঢ় গুরুতর বিষয়ের বিবরণ কার্যে” বিশ্বাসাগরী ভাষা অধিকতর উপযোগী। রুচি পাল্টাবার জন্য ‘আলালী’ ভাষার সাহিত্যক্ষেত্রে যে কিছু মূল্য আছে, সে বিষয়ে রামগতি বলেন:
“যেমন ফলারে বসিয়া অনবরতঃ মিঠাই মণ্ডা খাইলে জিহ্বা একরূপ বিকৃত হইয়া যায়—মধ্যে মধ্যে আদার কুচি ও কুমুড়ার খাট্টা মুখে না দিলে সে বিকৃতির নিবারণ হয় না, সেইরূপ কেবল বিদ্যাসাগরী রচনা শ্রবণে কর্ণের যে একরূপ ভাব জন্মে, তাহার পরিবর্তন করণার্থ মধ্যে মধ্যে অপরবিধ রচনা শ্রবণ করা পাঠকদিগের আবশ্যক।” (বা. ভা. সা. বি. প্র. পৃ. ৩১৩)
রামগতি প্যারীচাঁদের ভাষা সম্বন্ধে অপ্রসন্ন চিত্তে যাই বলুন না কেন, তাঁর মন্তব্য যে নিতান্ত যুক্তিবিরোধী তা নয়। ‘আলালী’ ভাষা পরবর্তীকালে পুরোপুরি কখনই গৃহীত হয় নি, চিন্তামূলক রচনাতে তো নয়-ই। ‘হুতোম প্যাচার নক্শা’র (১৮৬২) ভাষাও যেমন প্রয়োজন মেটাবার পর বিদায় নিয়েছে, আলালী ভাষাও তাই। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, “বঙ্কিমবাবু স্বপ্রণীত গ্রন্থসকলে, এক নূতন বাঙ্গালা গদ্য লিখিবার পদ্ধতি অবলম্বন করিলেন। তাহা একদিকে বিদ্যাসাগরী বা অক্ষরী ভাষা ও অপরদিকে আলালী ভাষার মধ্যগা”।6 বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে ঘটনা বিবৃত করেছেন সেখানে যে ভাষার সাহায্য নিয়েছেন সেটি বিদ্যাসাগরের উদ্ভাবিত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু লঘু স্থানে বা সংলাপের অংশে তাঁর ভাষা পোষাকী ভাব ত্যাগ করে খানিকটা আটপৌরে ঢং আয়ত করেছে। তবে তাকে পুরোপুরি ‘আলালী’ রীতির অনুসরণ বলা যায় না। আলালী ঢং বলতে শুধু সংলাপে চলতি বুলির ব্যবহারই বোঝায় না, এ ভাষায় মাঝে মাঝে রঙ্গকৌতুক ও ফাজলামি ফুটে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের হালকা ভাষায় রঙ্গকৌতুক থাকলেও তাতে ছ্যাবলামি নেই। হুতোমের ভাষায় অশিষ্ট ছ্যাবলামির বাড়াবাড়ি ছিল বলে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে নিন্দামন্দ করেছেন। সে যাই হোক বঙ্কিমযুগে আলালী ভাষার হালকা ধরনের কৌতুকের দিকটি কারো কারো রচনায় কিছু প্রভাব বিস্তার করেছিল। অবশ্য একথা সত্য, প্যারীচাঁদই সর্বপ্রথম পরিচিত বাস্তব জীবনকে পরিচিত প্রত্যহের ভাষাতেই উপস্থাপিত করেছেন। এই জন্য বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃত হয়েছে।
একালে ক্লাসিক গ্রন্থের বড় অমর্যাদা, প্রকাশক জোটে তো পাঠক জোটে না। তবু যে প্যারীচাঁদের যাবতীয় বাংলা রচনা প্রকাশ করা হল, এর কারণ বিগত বিস্মৃতকে আবার নতুন করে স্মরণ করা, তাঁকে নতুন চিন্তার আলোকে উপস্থাপিত করা। প্যারীচাঁদের জীবিতকালে তার কয়েকটি গ্রন্থের একাধিক সংস্করণ হয়েছিল। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে ‘আলাল’ ছাড়া অন্য পুস্তকগুলি অপ্রচলিত হয়ে পড়লে বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশে তাঁর পুত্রেরা ‘লুপ্তরত্নোদ্ধার’ (১২৯১ বঙ্গাব্দ) নামে ক্যানিং লাইব্রেরি থেকে পিতার অজস্র রচনা প্রকাশ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র এর ভূমিকা লিখেছিলেন। তার পরেও প্যারীচাঁদের রচনাবলী একাধিকবার মুদ্রিত হয়েছিল। কিন্তু প্রায় অর্ধ শতাব্দী হয়ে গেল প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ভিন্ন (তাও text book-এর কল্যাণে) অন্য কোন গ্রন্থ বাজারে ছিল না। কিছুকাল পূর্বে চার খণ্ডে সম্পূর্ণ বিদ্যাসাগরের যাবতীয় রচনায় ভূমিকা সংযোজনার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, বিদ্যাসাগরের রচনাবলীর পাশেই প্যারীচাঁদের গ্রন্থসমূহের স্থান হওয়া উচিত। বিদ্যাসাগর রচনাবলীর দুঃসাহসী প্রকাশক মণ্ডল বুক হাউসের স্বত্ত্বাধিকারী শ্রীযুক্ত সুনীল মণ্ডলকে আমার মনোগত অভিপ্রায় ব্যক্ত করি। তিনি ব্যবসায়াত্মিকা সাবধানী বুদ্ধির চেয়ে সৎসাহিত্য প্রচার বুদ্ধির দ্বারা অধিকতর উদ্বুদ্ধ হলেন, আমিও সাগ্রহে এই ব্যাপারে সর্বাধিক সাহায্যদানে সম্মত হলাম। এই গ্রন্থ সম্পাদনে যে পরিশ্রম করা গেছে, প্রকাশক তার দ্বারা কিঞ্চিৎ লাভবান হলেই শ্রম সার্থক জ্ঞান করব। প্যারীচাঁদের এতাবৎকালের মধ্যে মুদ্রিত যাবতীয় গ্রন্থ এই সঙ্কলনে প্রকাশ করা হল। পরিশিষ্টে যে তিনটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তার কোনটি প্যারীচাঁদ-রচনাবলীর অন্য কোন সংস্করণের অন্তর্ভুক্ত হয় নি। এযুগের সাময়িক পত্রে তাঁর তিনটি অপ্রকাশিত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নানা কারণে এই সংস্করণে সেগুলি গ্রহণ করা সম্ভব হল না। দ্বিতীয় সংস্করণে নিবন্ধ তিনটি পুণঃ প্রকাশ করা যাবে।
প্যারীচাঁদের জীবিতকালের সংস্করণ থেকে পাঠ মেলাতে শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। গ্রন্থের মধ্যে পুরাতন বানান ও প্রকাশ পদ্ধতি যথাসম্ভব অবিকৃত রাখা হয়েছে, ভুল বানানও সংশোধন করার চেষ্টা করা হয় নি।
শ্রীযুক্ত ইন্দ্রনাথ মজুমদার প্যারীচাঁদের চিত্র সংগ্রহে আমাদের আনুকূল্য করেছেন, এই প্রসঙ্গে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। প্রকাশক শ্রীযুক্ত সুনীল মণ্ডল যেভাবে আর্থিক ঝুঁকি আপন স্বন্ধে তুলে নিয়ে প্যারীচাঁদ রচনাবলীর শোভন সংস্করণ প্রকাশ করলেন, তাতে সংস্কৃতিবান বাঙালী সমাজের পক্ষ থেকে তাঁকে সাধুবাদ জানাই।
শ্রীঅসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা বিভাগ,
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,
১৩৭৮|১৯৭১
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- জন বীম্স্ তাঁর Modern Aryan Languages of India-তে যথার্থ বলেছেন, “He puts in to the mouth of each of his characters the appropriate method of talking, and thus exhibits to the full the extensive range of vulgar idioms which his language posseses.”
- ‘কপালকুণ্ডলা’র ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকা লিখতে গিয়ে এইচ. এ. ডি. ফিলিপ্স্ বলেছিলেন, “The Allaler Gharer Dulal’ of the first mentioned author may be called a truly indigenous novel.”
- নগেন্দ্রনাথ সোম—মধুস্মৃতি, দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ, ১৩৬১, পৃ. ৮২-৮৩
- ‘ইতরজাতীয়’ গালিটি কি কায়স্থ প্যারীচাঁদের প্রতি নিক্ষিপ্ত?
- বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব, ১৩১৭, ৩য় সংস্করণ, চুঁচুড়া, পৃ. ৩১১।
- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, নিউ এজ সংস্করণ, ১৯৫৭, পৃ. ২৫৩।