» » প্যারীচাঁদ রচনাবলী

বর্ণাকার

প্যারীচাঁদের গ্রন্থপরিচয়॥

কথায় বলে, ‘ফলেন পরিচীয়তে’। প্যারীচাঁদের যাবতীয় বাংলা রচনা এই সঙ্কলনে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক-পাঠিকা ইচ্ছা করলে নিজেরাই সেই সমস্ত গ্রন্থের পরিচয় নিয়ে হাতে-হাতে ফল পাবেন। তাই এখানে শুধু গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচয় সূত্রাকারে দেওয়া গেল।

প্যারীচাঁদ ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে অধিকাংশ গ্রন্থ প্রচার করেছিলেন, অল্প কয়েকখানিতে শুধু নিজ নাম ব্যবহার করেছিলেন। তবে পরবর্তিকালে লেখা গ্রন্থের ভূমিকায় (‘বামাতোষিণী’) নিজেই নিজের ছদ্মনাম প্রকাশ করেছেন। অনেকগুলি বিচিত্রধরনের পুস্তক-পুস্তিকা লিখলেও তিনি পাঠক মহলে ‘আলালের ঘরের দুলালে’র লেখকরূপেই পরিচিত। ১৮৫৫ সালে ‘মাসিক পত্রিকা’য় ‘আলাল’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে, কিন্তু তার পূর্বেই তিনি গদ্যরচনার হাত পাকিয়েছিলেন। সুতরাং ‘আলাল’ তাঁর প্রথম ধারাবাহিক রচনা হলেও তার বেশ কিছু পূর্ব থেকেই তিনি বাংলা গদ্য রচনায় মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেছিলেন। ‘মাসিক পত্রিকা’ প্রকাশনার সময়ে তিনি স্ত্রী-শিক্ষা প্রচার ও স্ত্রীসমাজের উন্নতির জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বস্তুতঃ ‘মাসিক পত্রিকা’ প্রকাশের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল স্ত্রীসমাজের উন্নতি-সাধন। প্যারীচাঁদ বাংলায় যে সমস্ত পুস্তক-পুস্তিকা লিখেছেন তার অধিকাংশ স্থানেই স্ত্রীসমাজের কথা বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। তিনি নিছক সাহিত্য-রসের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না; স্ত্রীলোকের চরিত্র, শিক্ষা, সন্তান-পালন, পারিবারিক কর্তব্য, আধ্যাত্মিক উন্নতি ইত্যাদির প্রচারই ছিল তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য।1 এ-বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য আছে। বিদ্যাসাগরের লেখনীমুখে রসের বর্ষণ হলেও তিনি মুখ্যত শিক্ষাপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবেই সাহিত্যকে বেছে নিয়েছিলেন, প্যারীচাঁদও একই পথের পথিক। এই উদ্দেশ্যেই ‘মাসিক পত্রিকায়’ ধারাবাহিকভাবে তিনি পারিবারিক আখ্যান বর্ণনা শুরু করেন, যার নাম ‘আলালের ঘরের দুলাল’।2 উপন্যাসটির অধিকাংশই ‘মাসিক পত্রিকা’য় মুদ্রিত হয় (১৮৫৫-১৮৫৭), তারপর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ খ্রী৽ অব্দে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সকলেই এটিকে প্রথম বাংলা উপন্যাস বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরবর্তিকালে ‘আলালে’র দুটি ইংরেজী অনুবাদ হয়েছিল।3 এর নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তাঁর পুত্র হীরালাল মিত্র। ১৮৯৫ খ্রী৽ অব্দে বেঙ্গল থিয়েটারে এর অভিনয়ও হয়েছিল। মূল রচনার সঙ্গে নাট্যরূপের তুলনার জন্য উক্ত নাটক থেকে একটু নমুনা উদ্ধৃত হল :

দ্বিতীয় অঙ্ক। দ্বিতীয় গর্ভান্ত।

(বেচারামবাবুর বৈঠকখানা।)

(বেচারামবাবু আসীন।)

(বেণীবাবু ও মতিলালের প্রবেশ।)

বেচা। (বেণীবাবুকে দেখিয়া খোনা রবে) বেণী ভায়া যে! কও খপর কি?

বেণী। অপর এমন কিছু খপর নাই, মতি এখানে থেকে স্কুলে পোড়বে, কেবল শনিবারে শনিবারে এক একবার বাড়ী যাবে।

বেচা। তার আটক কি? আমার তো ছেলেপুলে কিছু নাই, কেবল দুটি ভাগনে আছে, মতি সচ্ছন্দে থাকুক, আর মতি তো আমার পর নয়?

মতি। (খোনা সুর শুনিয়া খিল খিল কোরে হাসিতে হাসিতে বেণীবাবুর প্রতি) মশায়!–

বেণী। (চোখ টিপিয়া) মতি! কেমন এখানে তোমার থাকা তো মত?

বেচা। আরে ভাষা! ছেলেটা দেখচি বড় ব্যাদড়া, বোধ করি ভারি আদুরে।

বেণী। মশায়! বয়েস কম, পড়া শোনা কোল্লে সব সুদ্‌রে যাবে, লেখা পড়া না শিখলে সহজেই একটু অসভ্য হয়। এখন আমাকে বিদায় দিন, মতিকে স্কুলে ভর্তি করে দিগে।

বেচা। অম্‌নি যাবে হ্যা, একটা পান টান কিছু খেলে ভাল হয় না?

বেণী। মশায়! এ তো আমার ঘর, এখানে চেয়ে খেতে হয়, আপনাকে বোলতে হবে কেন? এখন আসি।

বেচা। তবে আর কি বোলবো ভাই?4

১৮৫৮ খ্রী৽ অব্দে প্যারীচাঁদ প্রকৃতপক্ষে ঔপন্যাসিকরূপে অবতীর্ণ হলেন। তারপর তাঁর অনেকগুলি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর (১৮৮৩ খ্রী৽ অ৽) দু’ বছর আগে তাঁর সর্বশেষ বাংলা গ্রন্থ (‘বামাতোষিণী’— ১৮৮১) মুদ্রিত হয়। মোট তেইশ বৎসরের মধ্যে তাঁর এগারখানি বাংলা গ্রন্থ এবং আটখানি ইংরেজী নিবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।5 এ ছাড়াও দেশী-বিদেশী সাময়িক পত্রে তাঁর বহু প্রবন্ধ মুদ্রিত হয়েছিল যার অধিকাংশই গ্রন্থাকারে প্রচারিত হয় নি। কিন্তু তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘আলালের ঘরের দুলাল’-ই তাকে কালজয়ী গৌরব দিয়েছে। বাংলা উপন্যাসের জনকরূপে তিনি সাহিত্যের ইতিহাসে ও পাঠকসমাজে আজও স্বীকৃত হয়ে থাকেন।

অবশ্য ‘আলাল’কে প্রথম উপন্যাসধর্মী আখ্যান বলা যায় কিনা বিচার্য।6 উনিশ শতকের ২য়-৩য় দশকে বাংলা সাময়িক পত্রে বাঙালীর সমাজ, ধর্ম, নীতি, আচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে যে সমস্ত নক্‌শা ধরনের স্কেচ প্রকাশিত হতে থাকে, তাকেই বাংলা আখ্যানের আদি বলে গ্রহণ করা যায়। সদ্য-গড়ে-ওঠা কলকাতায় তখন শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে প্রবল আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে। হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, কলিকাতা স্কুলবুক সোসাইটী, কলিকাতা স্কুল সোসাইটী7, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নব্যতন্ত্রের সঙ্গে পুরাতনের দ্বন্ধও প্রখর হয়ে উঠেছে। হঠাৎআলোকপ্রাপ্ত এবং স্বল্প-ইংরেজীজানার দল পুরাতনকে ভেঙেচুরে নতুন সমাজপত্তনের স্বপ্ন দেখছেন, প্রাচীনের দল এলোমেলো হাওয়ার মুখে বানচাল নৌকাকে কোনও প্রকারে কূলে ভেড়াবার চেষ্টা করছেন। এই যুগের সাময়িক পত্রে এই ধরণের সমাজঘটিত কৌতুকরসপূর্ণ অনেক কল্পিত আখ্যান ছাপা হত। এই আখ্যানে কেউ সেই জরাজীর্ণতার হাস্যকর মূর্তি ফুটিয়ে তুলতেন, কেউ-বা ইংরেজী-শিক্ষায়-মত্ত তরুণদের ঔদ্ধত্যকে শাণিত ব্যঙ্গে জর্জরিত করতে চেষ্টা করতেন। ‘সমাচার দর্পণে’ (২৩ ফেব্রুয়ারী, ৯ জুন, ১৮২১) ‘বাবুর উপাখ্যানে’ সর্বপ্রথম এই ধরনের ব্যঙ্গবিদ্রুপমূলক আখ্যায়িকা প্রকাশিত হয়। বোধ হয় তারই আদর্শে একটু বিস্তারিত আকারে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নববাবুবিলাস’ (১৮২৫) রচনা করেন। এরও মূল বিষয়—শিক্ষাদীক্ষার অভাবে ধনিসন্তানের উন্মার্গগামিতা। ভবানীচরণ সমাজ ও যুবকদের চরিত্র সংশোধনের স্পৃহায় গদ্যেপদ্যে এই আখ্যান রচনা করেছিলেন। রঙ্গকৌতুক থাকলেও এ-পুস্তিকা তখনও পুরোদস্তুর আখ্যানের রূপ পায় নি।8 দেখা যাচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক থেকে সপ্তম দশক পর্যন্ত সামাজিক ত্রুটিবিচ্যুতি, মদ্যপান, লাম্পট্য, অপকর্ম, নীতিভ্রষ্টতা, হিন্দুয়ানির বিরুদ্ধাচার প্রভৃতিকে ব্যঙ্গ করে কিছু কিছু স্যাটায়ারধর্মী আখ্যান কখনও সাপ্তাহিকে-মাসিকে, কখনও-বা পৃথগ্‌ভাবে পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বাবুর আখ্যান’, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গ নক্‌শা (‘নববাবুবিলাস’, ‘নববিবিবিলাস’, ‘দূতীবিলাস’) প্যারীচাদের ‘আলাল’, টেকচাঁদ ঠাকুর জুনিয়রের (অর্থাৎ প্যারীচাঁদের মধ্যমপুত্র চুনিলাল মিত্র) ‘কলিকাতার নুকোচুরি’ প্রভৃতি সরস আখ্যানে কলকাতার সামাজিক অনাচার ও চারিত্রিক অধোগতি রঙ্গকৌতুকের আখ্যানের সাহায্যে বর্ণিত হয়েছে। এই সমস্ত নক্‌শার উদ্দেশ্য ছিল সমাজসংস্কার এবং চরিত্রের উন্নয়ন প্রভৃতি সদ্গুণ আবার ফিরিয়ে আনা। কিন্তু ‘আলালে’র সামাজিক পরিবেশের একটু নূতনত্ব আছে। অন্য নক্‌শাগুলি মোটামুটিভাবে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতা ও নাগরিক জীবনকে পটভূমিকা হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু প্যারীচাঁদের ‘আলালে’র পটভূমিকা আরও পুরাতন,— অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাপ্তি থেকে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার (১৮১৭) পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘আলালে’ দেশী শিক্ষার কুফল প্রদর্শিত হয়েছে। এই কাহিনীতে বরং যে কয়টি সৎচরিত্র আছে (রামলাল ও বরদাবাবু) তারা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত। মদ্যপান, লাম্পট্য ও অসামাজিক বেলেল্লাপনাকে আক্রমণ করলেও প্যারীচাঁদ ইংরেজী শিক্ষা ও সভ্যতার দোষকীর্তন করেন নি। কারণ আধুনিক পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার অগ্রদূত হিন্দু কলেজেই তার শিক্ষাদীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছিল।

‘আলালের ঘরের দুলালে’ সর্বপ্রথম উপন্যাসলক্ষণ ফুটে উঠেছে তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য কেউ কেউ এই প্রসঙ্গে জনৈকা বিদেশিনী হানা ক্যাথারীন ম্যলেন্‌সের লেখা ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণে’র (১৮৫২) কথা তুলবেন। প্যারীচাঁদের ‘আলাল’ গ্রন্থাকারে প্রকাশের ছ’বছর আগেই উপন্যাসের অনুরূপ ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ মুদ্রিত হয়েছিল। সুতরাং কারও কারও মতে প্যারীচাঁদ প্রথম বাংলা ঔপন্যাসিকের গৌরব পেতে পারেন না।

সুইজারল্যাণ্ডের অধিবাসী রেভা. ফ্রাঁসোয়া পাকোরা (Rev. Alphonse Francois Lacroix) খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারের অভিপ্রায়ে লণ্ডন মিশনারী সোসাইটির কর্মী হিসেবে ১৮২১ খ্রী. অব্দের ১১ মার্চ চুঁচুড়ায় উপস্থিত হন। তাঁর কন্যা হানা ক্যাথারীন লাক্রোয়া ১৮২৬ খ্রী. অব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বালিকা লাক্রোয়া মাত্র বারো বছর বয়সে ভবানীপুর মিশনের স্কুলে খ্রীস্টান বালকবালিকাদের বাংলা শেখাতেন। বাল্যকালেই তিনি বাংলাভাষা মাতৃভাষাবৎ আয়ত্ত করেছিলেন। মিশনের অপর এক কর্মী জে. ম্যলেন্‌সের সঙ্গে বিবাহের পর তিনি হানা ক্যাথারীন ম্যলেন্‌স্ নামে পরিচিত হন। তিনি জেনানা মিশন স্থাপন করেছিলেন, একাধিকার য়ুরোপেও গিয়েছিলেন। ‘ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান ট্রাক্ট্  অ্যাণ্ড বুক সোসাইটি’র পক্ষ থেকে ১৮৫২ খ্রী. অব্দে শ্রীমতী মালেন্‌সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ প্রকাশিত হয়। দেশীয় খ্রীস্টান স্ত্রীসমাজের জন্যই কাহিনীটি রচিত হয়েছিল। প্রথম সংস্করণেই তিন হাজার কপি ছাপা হয়।9 স্বচ্ছ বর্ণনার গুণে বইখানি বাঙালী খ্রীস্টানসমাজে, বিশেষতঃ দরিদ্র অর্ধশিক্ষিত খ্রীস্টান পরিবারে ও মিশন স্কুলে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। জনপ্রিয়তার জন্য পুস্তকখানি ইংরেজী, কানাড়ী, মারাঠী, তেলুগু প্রভৃতি বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় তত্তৎ প্রদেশীয় খ্রীস্টান মিশন কর্তৃক অনূদিত হয়েছিল। শ্রীমতী ম্যলেন্‌স্ একাধিক বই লিখেছিলেন, কিন্তু দেশীয় খ্রীস্টানসমাজে ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ অধিকতর প্রচার লাভ করেছিল। মাত্র পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে (১৮৬১) হানা ম্যলেন্‌সের অকালমৃত্যু হয়।

শ্রীমতী ম্যলেন্‌সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ কোন মৌলিক আখ্যান নয়, একখানি ইংরেজী গল্পগ্রন্থ অবলম্বনে এটি রচিত হয়। The Oriental Baptist ( আগস্ট, ১৮৫২, পৃ. ২০১) থেকে সেই তথ্যটি পাওয়া গেছে।10 মূল ইংরেজী গ্রন্থটির নাম The Week, লেখকের নাম জানা যায় না। তারই ছাঁচে শ্রীমতী ম্যলেন্‌স্ বাংলা কাহিনী ফেঁদেছিলেন। নিজের গ্রন্থের অনেক স্থানে লেখিকা মূল ইংরেজী গ্রন্থের সংলাপগুলি পুরোপুরি বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছেন, বর্ণনারও অনেক মিল আছে। ইংরেজী কাহিনীর প্রধান চরিত্র রবার্ট ও ম্যারি। তাদের ছেলেমেয়েদের নাম—ফ্যানি, উইলি, হানা। শ্রীমতী ম্যলেন্‌সের কাহিনীতে উক্ত চরিত্রের আদর্শে ফুলমণি, তার স্বামী প্রেমচাঁদ ও তিনটি সন্তান—সাধু, সত্যবতী ও প্রিয়নাথের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ইংরেজী The Week-এর অলস প্রকৃতির ন্যানী, তার মাতাল স্বামী ও বদ সন্তানদের অনুকরণে ম্যলেন্‌স্ এঁকেছেন করুণা, তার মদ্যপ বেহেড স্বামী এবং বংশী নবীন প্রভৃতি দুষ্ট ছেলেদের। মূল গ্রন্থের ভক্তিমতী বুদ্ধা নেলীর সঙ্গে বাংলা আখ্যানের প্যারীর বিশেষ সাদৃশ্য আছে। বাংলা গ্রন্থপরিচয়ে The Oriental Baptist-এর সমালোচকও স্বীকার করেছেন—Incidents and conversation which give life to the narration, are also freely borrowd from ‘The week’… সুতরাং ‘ফুলমণি ও করুণা’র বিবরণকে মৌলিক গ্রন্থের গৌরব দেওয়া যায় না। অবশ্য গ্রন্থটি ইংরেজীর প্রায়-অনুবাদ হলেও প্যারীচাঁদের ‘আলাল’ রচনারম্ভের (১৮৫৪) পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল তা স্বীকার করতে হবে। কাহিনী ও চরিত্র পরিকল্পনায় খ্রীস্টান ধর্মযাজকসুলভ ধর্মীয় একপার্শ্বিকতা ছাড়া লেখিকা বিশেষ কোন হৃদ্য আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেন নি, অনুমান হচ্ছে মূল কাহিনীতেই তা ছিল না। তাঁর একমাত্র গুণ, বিদেশিনী হয়েও তিনি পরিচ্ছন্ন বাংলা গদ্য লিখতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর কাহিনী ও চরিত্রগুলি রবিবাসরীয় নীতিবিদ্যালয়ের উপযোগী; খ্রীস্টান ধর্মতত্ত্ব ও আদর্শের গুরুভারে চরিত্রগুলি এতই ন্যূজ হয়ে পড়েছে যে, তারা ঠিক জীবন্ত নরনারীরূপে আমাদের কাছে আবির্ভূত হতে পারে নি। উপরন্তু এ আখ্যান বাঙালী হিন্দু-সমাজে কোন দিনই পরিচিত ছিল না। লং সাহেবের A Descriptive Catalogue of Bengali Works (1855), মার্ডকের খ্রীস্টান বাংলা লেখকদের তালিকা (Murdoch — Catalogue of the Christian Vernacular Literature of Bengal), Friend of India (28th Nov., 1869), The Twenty third Report of the Calcutta Christian Tract and Book Society, এবং শ্রীমতী ম্যলেন্‌সের ভগিনীর লেখা Brief Memorials of Mrs. Mullens-এ এই উপন্যাসের উল্লেখ আছে। পরবর্তী কালে প্রিয়রঞ্জন সেন Western Influence in Bengali Literature-এ এই উপন্যাসের কথা বলেছেন। যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার ও রাখালরাজ রায় সম্পাদিত ‘সাহিত্যপঞ্জিকা’য় (১৩২২) ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’কে প্রথম বাংলা উপন্যাস বলে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং গ্রন্থটি যে বাংলা সাহিত্যে একেবারে অজ্ঞাতকুলশীল তা নয়। কিন্তু সেযুগে কেবলমাত্র খ্রীস্টান সমাজের জন্য প্রচারিত বাংলা গ্রন্থ সম্বন্ধে বৃহত্তর হিন্দুসমাজ সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল, উপরন্তু ধর্মপ্রচারৈষণার জন্য কাহিনীটি উপনাসের কোঠায় উঠতে পারে নি। অপর দিকে প্যারীচাঁদ স্ত্রীসমাজের শিক্ষা এবং বালকদের চরিত্রগঠনের প্রতি গুরুত্ব দিলেও তাঁর নীতিমূলক কাহিনীতেই সর্বপ্রথম উপন্যাসের আভাস ফুটে ওঠে। শুষ্ক নীতি-আদর্শের চাপে পড়ে প্যারীচাঁদ আখ্যানের ক্ষতি করেন নি, অন্ততঃ প্রথম দিকে তো নয়ই। প্যারীচাঁদ শ্রীমতী ম্যলেন্‌সের মতোই সমাজসংস্কারের প্রেরণায় যাবতীয় গ্রন্থ লিখলেও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সরসতা ও কৌতুকরস নীতি-উপদেশের নখদন্ত ভেঙে দিয়ে কাহিনীকে মনোহারী করে তুলেছে। প্যারীচাঁদ নীতি প্রচার করলেও মূলতঃ শিল্পী; ম্যলেন্‌স্ কাহিনীর রস সৃষ্টি করতে চাইলেও মূলতঃ উপদেষ্টা ও প্রচারক।

‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর কাহিনী সরস, বাস্তব—যদিও নীতিঘেঁষা। কুশিক্ষা, বদসঙ্গ ও অভিভাবকের প্রশ্রয় ও অমনোযোগিতার ফলে ধনীর দুলাল মতিলালের বখে যাওয়া, মনের মতো কুসঙ্গীদের দলে পড়ে অপকর্ম করা, পরে বহু দুঃখের পর পুনরায় সজ্জীবনে ফিরে আসা এইটুকু মূল কাহিনী। কিন্তু মূল কাহিনী ও প্রধান চরিত্রের চেয়ে শাখাকাহিনী ও উপচরিত্রগুলি বেশ খুলেছে। বাঞ্ছারাম, বক্রেশ্বর, বটলর সাহেব, মতিলালের মর্কটবৃত্তিধারী সঙ্গীসাথী—সর্বোপরি এলেমদার ঠকচাচার চরিত্র টাইপ হয়েও ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যে অতি উজ্জ্বল। দুষ্ট, বজ্জাত, ধড়িবাজ, গেঁজেল, মাতাল ইত্যাদি বক্রচরিত্রগুলির প্রতি থিয়সফিস্ট প্যারীচাঁদের প্রথম প্রশ্রয় ও স্নেহপ্রবণ মমতা ছিল। বরং ‘আলাল’ ও অন্য গ্রন্থের আদর্শবান সৎ চরিত্রগুলি কিছু নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। মতিলালের কনিষ্ঠ রামলাল ও তার শিক্ষক বরদাবাবু আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে, কিন্তু ঐ সমস্ত “ঊনপাঁজুরে ররাখুরে” ও “গোকুলের ষাঁড়” হলধর-গদাধর-মতিলালের বখাটে চরিত্র আমাদের বিরক্ত করে তোলে না, তাদের দুষ্কর্ম আমাদের মনে বিরক্তির চেয়ে কৌতুক সঞ্চার করে বেশী। নানা দুঃখদুর্দশায় পড়ে যখন মতিলালের মতি ঘুরে গেল, তখন তার চরিত্র থেকে পূর্বেকার বাঁদরামিসহ তাজা ভাবও অনেকটা হ্রাস পেয়ে গেল। এর জন্য লেখক দায়ী নন। যা সুস্থ, স্বাভাবিক, নিয়মানুগ তার প্রতি আমাদের ততটা আকর্ষণ থাকে না। বরং যা বক্র, দলছাড়া, অদ্ভূত, উদ্ভট এবং যা সজ্জীবন থেকে কিছু ভ্রষ্ট, আদর্শের দিক থেকে না মানলেও, মন তাকেই যেন বেশী ভালবাসে। নীতিবাগীশ ও অধ্যাত্মপন্থী প্যারীচাঁদ তাঁর ‘আলাল’ ও অন্যান্য গ্রন্থে সেই মনেরই পরিচয় দিয়েছেন। ‘যৎকিঞ্চিৎ’, ‘অভেদী’ ও ‘আধ্যাত্মিকা’—তিনখানি গ্রন্থই নীতি-আদর্শের ভারে অতি মন্থর। কাহিনীগুলিতে তিনি যোগদর্শন, তন্ত্র, পুরাণ, অধ্যাত্মবিদ্যা, ‘second sight’, ‘clairvoyance’ প্রভৃতি শাস্ত্রকথা ও অলৌকিক রহস্যময় বর্ণনায় এত উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন যে, উক্ত আধ্যাত্মিক ও রূপক-উপন্যাস কোনও ক্রমেই উপন্যাসের সীমায় পৌঁছাতে পারে নি। অবশ্য একথা স্বীকার করতে হবে যে, গুরুতর তত্ত্বকথার অবতারণা করলেও ফাঁক পেলেই তিনি রঙ্গকৌতুকের আমদানি করেছেন। প্রবীণ প্যারীচাঁদ ধর্ম, অধ্যাত্মবিদ্যা, থিয়সফি, শিক্ষা, শিশুশিক্ষা প্রভৃতি গুরুতর ব্যাপারে অতিশয় আসক্ত থাকলেও তাঁর অন্তরে সর্বদা একজন পরিহাসরসিক ও চঞ্চলস্বভাব টেকচাঁদ ঠাকুর লুকিয়ে থাকত, সময় পেলেই সে গাম্ভীর্যের মুখোশ খসিয়ে দন্তরুচি কৌমুদীর ছটায় তত্ত্বকথার স্তব্ধ পরিমণ্ডলে উচ্চকিত হাল্‌কা হাসি আমদানি করত।

‘আলালে’র কাহিনী নিতান্ত ঘরোয়া ধরনের। এর আখ্যান, পরিবেশ, চরিত্র, সংলাপ সবই অভিজ্ঞতাপ্রসূত প্রত্যক্ষ ব্যাপার। অবশ্য মনের বিভিন্ন প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বজনিত উপন্যাসের চরিত্রের যে বিকাশ, তা বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বে কোন বাংলা আখ্যানেই ছিল না, প্যারীচাঁদের লেখায়ও থাকার কথা নয়। ‘আলালে’র চরিত্রের উপর যে সমস্ত আঘাত এসেছে, তা নিতান্ত বাইরের আঘাত, এবং সেদিক থেকে ‘আলাপ’ fiction হয় নি, হয়েছে tale—তবে তার মধ্যে উপন্যাসের সম্ভাবনা আছে। ঔপন্যাসিক উপন্যাসে মানব চরিত্রকে যে উদার পটভূমিকা থেকে দর্শন করতে চেষ্টা করেন, প্রচারধর্মী ও নীতিবাগীশ প্যারীচাঁদ ঠিক সেই উচ্চ চূড়া থেকে মানুষের নিয়তি লক্ষ্য করতে পারেন নি, অথচ ডিকেন্‌স ভালোই পড়েছিলেন।

তাঁর রচনার ভাষা মূলতঃ সাধুভাষার কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যদিও ‘আলালে’র মধ্যে সাধু ও চলিত ভাষার জগাখিচুড়ি পাতায় পাতায় লক্ষ্য করা যাবে।11 কলকাতার ভাষা, শহরতলীর ভাষা, আঞ্চলিক উপভাষা, ইতরসাধারণের ভাষা—সবই তাঁর আয়ত্ত ছিল এবং সেই ভাষার মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, উইলিয়ম কেরী (‘কথোপকথন’) ও দীনবন্ধুর মতো তিনি সহজেই কৌতুকরস সৃষ্টি করতে পারতেন। তার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য আইন-আদালত জমিজমা, মামলামোকদ্দমা সংক্রান্ত নিখুঁত চিত্রে তৎকালীন দেশ-কাল-পাত্রের যথার্থ রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। অবশ্য ‘আলালে’র পরবর্তী গ্রন্থগুলিতে প্রকাশ্যভাবে তিনি নীতিশিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়লে এই সরস কৌতুকের ভাষা কিছু নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তবে একটু লাভও হয়েছিল, তার ভাষার গুরুচণ্ডালী যা ‘আলালে’ অতি প্রকট, তা পরবর্তী যুগের রচনা থেকে অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ যথার্থ উপন্যাসের কোঠায় উঠতে না পারলেও সরস কৌতুক, বাক্‌রীতির চাপল্য-চাঞ্চল্য, টাইপ চরিত্র সৃষ্টি ও বাস্তবধর্মী কাহিনী হিসেবে উপন্যাসের পূর্বাভাস বলেই গৃহীত হবে। নীতি-উপদেশ ও তত্ত্বকথার প্রতি কম আকর্ষণ থাকলে প্যারীচাঁদ বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বে স্বচ্ছন্দে উপন্যাসের প্রাঙ্গণে আসর জাঁকিয়ে বসতে পারতেন।

‘আলালে’র জনপ্রিয়তায় লেখক নিজ শক্তি সম্বন্ধে আশ্বস্ত হলেন,12 এবং শর্করামণ্ডিত তিক্তবটিকা বিতরণে অর্থাৎ গল্পের মোড়কে মুড়ে নীতিতত্ত্ব-অধ্যাত্মবিদ্যাঘটিত ভারী ভারী কাহিনী গ্রন্থনে প্রস্তুত হলেন। ‘আলালে’র পরে প্রকাশিত ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯) পুস্তিকা উপদেশমূলক নিতান্ত স্কেচ-ধরনের দুর্বল আখ্যান। এর প্রথম আখ্যানে (‘মদ খাওয়া বড় দায়’) মদ্যপানের দোষ এবং দ্বিতীয় আখ্যানে (‘জাত থাকার কি উপায়’) রক্ষণশীল সমাজে জাত মারার ঘোঁট দেখানো হয়েছে। লেখকের উদ্দেশ্য সাধু, এবং রচনাভঙ্গিমায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকরস যথেষ্টই আছে। কিন্তু নানা ত্রুটি সত্ত্বেও ‘আলালে’ যেমন একটি পূর্বাপর সঙ্গতিবিশিষ্ট কাহিনী ও কতকগুলি পূর্ণাঙ্গ চরিত্র আছে, তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে সে ধরনের সঙ্গতি ও পূর্ণতা নেই।13 তাঁর পরের কোন আখ্যানেই নেই। ‘মদ খাওয়া বড় দায়’ ইত্যাদিতে দুটি আখ্যানে ভবানীবাবু ও জয়হরিবাবুর মদ্যপানজনিত শোচনীয় পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য সমাজ সংস্কারের আশায় কলম ধরলেও মাতালদের রংদার চরিত্র ও কৌতুকজনক আচরণ বর্ণনায় তিনি পাঠককে আবার অন্তরঙ্গতার মধ্যে টেনে এনেছেন। নীতি প্রচারের বাড়াবাড়ির মধ্যেও লেখক গেঁজেল আগড়তোষের বিবাহবাতিক এবং তার হাস্যকর পরিণাম বর্ণনায় প্রচুর কৌতুকের আমদানি করেছেন—যদিও মূল আখ্যানের সঙ্গে তার বিশেষ যোগ নেই। দ্বিতীয় অংশ, অর্থাৎ ‘জাতি মারিবার মন্ত্রণা’য় কৌতুকরস তীব্র ব্যঙ্গে পরিণত হয়েছে। বাইরে প্রবীণ সমাজনেতৃবর্গ ও ধর্মসংরক্ষকেরা জাত রাখা ও মারার ব্যাপারে সদাসতর্ক, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা অতি নচ্ছার, কপট ও চরিত্রহীন। এদের ঘৃণ্য চরিত্রগুলি লেখক ভালোই ফুটিয়েছেন, কিন্তু আখ্যানে ও পরিবেশে পূর্বের মতো সজীবতা নেই। প্রচার-উদ্দেশ্য শিল্পের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে।

এরপর প্যারীচাঁদ শুধু স্ত্রীসমাজের কল্যাণের জন্য লিখেছিলেন ‘রামারঞ্জিকা’ (১৮৬০)। স্ত্রী পদ্মাবতীকে সুগৃহিণী, সুশিক্ষিতা ও সুমাতা করবার জন্য স্বামী হরিহর পৃথিবীবিখ্যাত নারী চরিত্রের আখ্যান বর্ণনা করেছেন। অবশ্য তাঁর পতিব্রতা স্ত্রী মাঝে মাঝে সরস টিপ্পনী কেটে উপদেশাত্মক ভারী আবহাওয়ার গুমোট অনেকটা কাটিয়ে দিয়েছেন। এই পুস্তিকায় বড়ো বড়ো আদর্শমূলক অনেক নারী-জীবনকাহিনী আছে, কিন্তু সেগুলিতে লেখক জীবন সঞ্চার করতে পারেন নি।

অতঃপর তিনখানি আধ্যান প্রকাশিত হয়— ‘যৎকিঞ্চিৎ’ (১৮৬৫), ‘অভেদী’ (১৮৭১) ও ‘আধ্যাত্মিকা’ (১৮৮০)— তিনখানিই ঈশ্বরমহিমাবিষয়ক ও তত্ত্ববহুল আখ্যান। ‘যৎকিঞ্চিৎ’-এ আখ্যানের ভাগ অতি অল্প জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ দেশভ্রমণে বেরিয়ে কত যে বিচিত্র ধরনের লোকের সংস্পর্শে এলেন তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তাদের ঈশ্বরাবিষ্ট চরিত্রের সান্নিধ্যে এসে বহু লোকের চিত্তে আধ্যাত্মিক ভাবের উদ্দীপন হল—এইটুকু মাত্র এর বক্তব্য।

১৮৬০ খ্রী. অঙ্গে স্ত্রীর মৃত্যুর পর শোকাচ্ছন্ন চিত্তে প্যারীচাঁদ প্রেমতত্ত্ব, আত্মাতত্ত্ব, অধ্যাত্মবিদ্যা, যোগদর্শন ইত্যাদিতে বিশেষভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন। হিন্দু কলেজে ছাত্রাবস্থাতেই তিনি দর্শন, বিশেষতঃ একেশ্বরবাদী ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে শ্রদ্ধাবান হয়েছিলেন। ‘যৎকিঞ্চিৎ’-এ সমাজ সংস্কারের চেয়ে আত্মাঘটিত ব্যাপারই অধিকতর প্রাধান্য লাভ করেছে। গ্রন্থটি আকারে রীতিমতো বড়ো, এবং যত বড়ো, তত্ত নীরস। তবে মাঝে মাঝে উন্নত ব্ৰাহ্মসমাজের (অর্থাৎ কেশবপন্থী দল) সম্পর্কে দু’ চারটি প্রচ্ছন্ন অম্লাক্ত মন্তব্য আছে, যার ফলে একঘেয়ে উপদেশাত্মক আধ্যাত্মিকতা অনেকটা হ্রাস পায়। এই গ্রন্থ থেকে প্রথম পরিচয় পাওয়া গেল যে, প্যারীচাঁদ মূলতঃ হিন্দুর ষড়দর্শনে, বেদ-উপনিষদে বিশেষভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। অবশ্য তখনও থিয়সফির রসে মজতে পারেন নি, তখন প্রেততত্ত্বের অনুশীলন চলেছে।

১৮৭১ খ্রী. অব্দে প্রকাশিত ‘অভেদী’ পুরোপুরি আধ্যাত্মিক রূপক-উপন্যাস। এরপরে প্রকাশিত ‘আধ্যাত্মিকা’র ভূমিকায় তিনি নিজেই সেকথা স্বীকার করেছেন: “In 1871, I wrote the ‘Avedi’, a spiritual novel in Bengali, in which the hero and heroine have been described as earnest seekers after the knowledge of the soul, and how by the education of pain they obtained Spiritual light.’ নায়ক অন্বেষণচন্দ্র ও নায়িকা পতিভাবিনীর অধ্যাত্মজীবন, গৃহদাহের ফলে নায়ক-নায়িকার ছাড়াছাড়ি এবং নানা চিত্তসঙ্কটের পর তাদের আধ্যাত্মিক মিলন, সেই প্রসঙ্গে নানা শ্রেণীর লোকজন, সমাজ, ধর্মান্দোলন প্রভৃতি বাস্তব ব্যাপারের বর্ণনা এই আধ্যাত্মিক উপন্যাসকে কতকটা সহনীয় করেছে। বলা বাহুল্য নায়ক-নায়িকা অন্বেষণচন্দ্র ও পতিভাবিনী মুমুক্ষু নরনারীর রূপক মাত্র। বহু দুঃখ-কষ্টের পর অন্বেষণচন্দ্র গোদাবরী তীরে যোগীদের কাছে উপনীত হলেন এবং তাদের কাছে যোগ শিক্ষা করলেন। সেখানেই স্ত্রী পতিভাবিনীর সঙ্গে পুনমিলিত হলেন। কিন্তু এ মিলন পার্থিব মিলন নয়, আত্মার আত্মার মিলন। পতিভাবিনী যদিও সাধনার ব্যাপারে অতি উচ্চস্তরে আরূঢ়, তবু বহুকাল পরে স্বামীকে কাছে পেয়ে তার মনে নারীসুলভ আকাঙ্ক্ষার উদয় হল—”পতিভাবিনী স্বভর্তায় গুণ পুনঃপুনঃ চিন্তা করত ভাবান্তর হইলেন। আধ্যাত্মিকভাবের স্বল্পতা হইলে পার্থিব ভাবের উদয় হইল, তখন স্বামীর স্বন্ধে হস্ত দিয়া দ্বারা গনগদ ভক্তি ও প্রেম প্রকাশ করিলেন।” কিন্তু যোগ ও আধ্যাত্মিক পন্থার যাত্রী অন্বেষণচন্দ্র স্ত্রীর চিত্তে পার্থিবভাবের উদয় দেখে “তাঁহাকে নিষ্কাম চিত্তে চুম্বন করত বলিলেন—এভাব প্রশংসনীয় নহে—এ সামান্য ভাব—আত্মাকে উচ্চ কর। যদি আমি নিকটে থাকিলে চঞ্চল হইয়া পড় তবে আমাদিগের বিচ্ছেদই শ্রেয়। আমার প্রতি স্নেহ ও প্রেমশূন্য হইয়া আমার আত্মা দৃষ্টি করিয়া আত্মার দ্বারা আমার সহিত যোগ দেও, তাহা হইলেই আমাদিগের সম্বন্ধ সার্থক হইবে” (এই সঙ্কলন, পৃ. ৪৪৮)। ‘নিষ্কাম স্নেহ’ এবং ‘প্রেমশূন্য’ দাম্পত্য প্রেম খুব উচ্চ স্তরের সন্দেহ নেই, কিন্তু মানসিক আবেগকে কোতল করে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের উপর জোর দেওয়াতে এ উপন্যাস উপন্যাস হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। সর্বোপরি এ উপন্যাসের নামকরণও ঠিক হয় নি। গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে অন্বেষণচন্দ্র ও পতিভাবিনী আত্মজ্ঞান পাকা করার জন্য অভেদী নামে এক সিন্ধ পুরুষের কাছে উপনীত হলেন, এবং সেই সর্বত্যাগী সাধকের কাছে অভেদ অধ্যাত্মজ্ঞান সংগ্রহ করে ধন্য হলেন। শুধু এইটুকুর অন্য ‘অভেদী’ নামকরণ যুক্তিযুক্ত হয় নি। আগেই বলা হয়েছে ‘অভেদী’ আধ্যাত্মিক রূপক উপন্যাস। রূপকের ছলে দম্পতীর নিষ্কাম প্রেম ও সাত্বিক অধ্যাত্মসাধনার কথা বিবৃত করাই থিয়সফিস্ট প্যারীচাদের মূল উদ্দেশ্য। কাজেই এ গ্রন্থে যোগদর্শন, বেদান্ত প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত মুক্তি, নির্বাণ, ব্রহ্মসাধনা প্রভৃতি দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনাই অনেক স্থান জুড়ে আছে। মাঝেমাঝে ব্রাহ্ম সমাজ, সাকার-নিরাকার উপাসনা প্রভৃতি বিষয়ে লেখকের বিচক্ষণ মতামতও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু আধ্যাত্মিক উপন্যাসে জড়জগতের সঙ্গে চিন্ময়জগতের যে স্বন্দ্বসংঘাতের চিত্র এবং পরিশেষে লোভমোহ প্রভৃতি মানসিক কালিমামুক্ত আত্মার বিজয়ঘোষণা থাকে, এ-উপন্যাসে সে রীতি অনুসৃত হয় নি। এখানে সব আঘাতটাই এসেছে বাইরের দিক থেকে—অনেকটা গোল্ডস্মিথের Vicar of Wakefield-র মতো। অন্বেষণচন্দ্র ও পতিভাবিনী রক্তমাংসের দেহ ধারণ করে যেভাবে অক্লেশে পার্থিব কামকে উড়িয়ে দিয়ে উভয়ে যোগস্থ হলেন, তাতে তাত্ত্বিক পাঠক খুশি হলেও সাধারণ পাঠক বিশেষ প্রীতিলাভ করতে পারবেন না। লেখক যদি দু’ জনের হৃদয়ে অধ্যাত্ম চেতনার সঙ্গে পার্থিব কামনার দ্বন্দ্ব দেখাতে পারতেন, তা হলে এটি আধ্যাত্মিক উপন্যাস হিসেবে কিছুটা সার্থক হতে পারত। স্বামিসমাগমে উৎসুক পতিভাবিনীকে কামাদির দ্বারা ক্ষণকালের জন্য আবিষ্ট হতে দেখে তত্ত্বজ্ঞানী অন্বেষণচন্দ্ৰ যেই বললেন, “আত্মাকে উচ্চ কর,” অমনি পতিভাবিনী পার্থিব আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে একলম্ফে আধ্যাত্মিক, নিষ্কাম, নিষ্প্রেম ও ‘নির্মম’ রাজ্যে অভিপ্রয়াণ করলেন, এ বর্ণনা পাঠককে খুশি করতে পারে না।

অবশ্য উপন্যাসটি গম্ভীর তত্ত্বকথা প্রধান হলেও মাঝেমাঝে লঘুরস পরিবেশনে লেখকের স্বভাবসিদ্ধ হাল্‌কাভাব আবার ফিরে এসেছে। জেঁকোবাবু, বাবুসাহেব ও লালবুঝ কড়ের চরিত্রাঙ্কনে (যদিও চরিত্রগুলি অর্ধ-অঙ্কিত) তিনি কৌতুক-রসসিক্ত চিত্তের পরিচয় দিয়েছেন। অন্বেষণচন্দ্র, পতিভাবিনী ও অভেদীর উচ্চস্তরের নিষ্কাম ব্যাপারের চেয়ে এই স্বাভাবিক চরিত্রগুলিকে পাঠকের অনেকবেশী আপনার জন বলে মনে হবে।

১৮৮০ খ্রী. অব্দে প্রকাশিত ‘আধ্যাত্মিকা’ই প্যারীচাদের সর্বশেষ কাহিনী-ধৰ্মী রচনা। আত্মচিন্তামূলক স্ত্রীশিক্ষা, যোগের দ্বারা আত্মার উৎকর্ষসাধন, পরমাত্মার সমীপে জীবাত্মার অবস্থান, নানারূপ ‘সিদ্ধায়িতা’র বর্ণনা। আধ্যাত্মিক নারীর সম্পর্কে আলোচনা ইত্যাদি উচ্চস্তরের কথা বর্ণনা করবার জন্যই প্যারীচাঁদ বৃদ্ধবয়সে ‘আধ্যাত্মিকা’ উপন্যাস ফেঁদেছিলেন। বিদেশীরা যাতে এই উপন্যাস পড়ে এদেশীয় কথ্যভাষা ও আচার-আচরণ সম্পর্কে সম্যক পরিচয় পান, এ গ্রন্থ রচনার পিছনে লেখকের সে উদ্দেশ্যও ছিল।14

বারাণসী-প্রবাসী সম্পন্ন গৃহস্থ হরদেব তর্কালঙ্কারের একমাত্র কন্যা আধ্যাত্মিকার জীবনকথাই এ কাহিনীর মূল উপাদান। সুলক্ষণা কন্যার উজ্জল ভবিষ্যৎ স্মরণ করে তার নাম রাখা হল ‘আধ্যাত্মিকা’। নায়িকার এই নামকরণ ব্যর্থ হয় নি। বাল্যকাল থেকেই তার মধ্যে নানা অলৌকিক ব্যাপারের সমাবেশ ঘটতে লাগল। জীবে দয়া, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একান্তভাবে আত্মনিয়োগ এবং অসাধারণ মেধার দ্বারা অল্পবয়সেই যাবতীয় বিদ্যা অর্জন করে আধ্যাত্মিকা সকলের বিস্ময় ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করল। ক্রমে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক গুণের আরও অনেক পরিচয় পাওয়া গেল। মাতা-পিতার মৃত্যু, জ্ঞাতিদের দ্বারা সম্পত্তি গ্রাস, আরও নানা-ধরনের আপদ-বিপদ আধ্যাত্মিকাকে এতটুকু বিচলিত করতে পারল না, সে নিষ্কাম নিষ্কম্প্রচিত্তে সমস্ত দুর্ঘটনাকে গ্রহণ করল এবং উপনিষদের যুগের ব্রহ্মবাদিনীদের মতো ঘরসংসার বিবাহ না করে ঈশ্বরচিন্তায় কালাতিপাত করতে লাগল। যৌগিক শক্তির বলে দীনদুঃখীদের নিরাময় করে, দেশের দশের কাছ থেকে অসীম শ্রদ্ধাভক্তি লাভ করে কাল পূর্ণ হলে আধ্যাত্মিকা সজ্ঞানে গঙ্গাতীরে ইচ্ছামৃত্যু বরণ করল। এই আধুনিক ব্রহ্মবাদিনীর মায়িক সংসার ত্যাগে লোকে হায়-হায় করতে লাগল। এইটুকু এর গল্পাংশ। বলা বাহুল্য, এ আখ্যানও একপেশে, মানবিকতাবর্জিত ও দৈবীভাবনায় পূর্ণ। আধ্যাত্মিকার আধ্যাত্মিক জীবন বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক তার বাস্তব জীবন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। বিবাহ করে ঘরসংসার দেখা, স্বামীপুত্রের সেবা করা যেমন স্ত্রীর জীবন, তেমনি আবার সাংসারিক জীবন পরিত্যাগ করে ঔপনিষদিক মৈত্রেয়ীর মতো নিছক আত্মিক জীবন যাপন ও স্ত্রীলোকের অতি উচ্চস্তরের আদর্শ বর্ণনার বোধহয় এই ছিল উদ্দেশ্য। লেখক প্রাচীন আরণ্যক আদর্শে আধ্যাত্মিকার চরিত্র অঙ্কন করেছেন। আদর্শের দিক থেকে তিনি নিশ্চয় সফল হয়েছেন, কিন্তু শিল্পের দিক থেকে এ-উপন্যাস কোনক্রমেই হৃদ্য রচনা হয়ে ওঠে নি। অবশ্য মাঝেমাঝে প্যারীচাঁদ সাধারণ লোকের চরিত্র এঁকে এবং ঈষৎ লঘুভাবের অবতারণা করে, ‘আধ্যাত্মিকতা’র গুরুতর আধ্যাত্মিক ব্যাপারকে খানিকটা সহজ করতে চেষ্টা করেছেন। এ-দিক থেকে পরিহাসরসিক ও সবজান্তা ‘গতির্মম’-এর ক্ষণিক উপস্থিতি ভালোই লাগে।

এরপর প্রকাশিত হয় ‘বামাতোষিণী’ (১৮৮১), তাঁর সর্বশেষ বাংলা গ্রন্থ। এটিও স্ত্রীসমাজের জন্য রচিত এবং এতেও নীতিমূলক গল্পের রীতি অনুসৃত হয়েছে। কৃষ্ণনগরের অতিবিচক্ষণ গৃহস্বামী গোপালচন্দ্র দেব এবং তাঁর সাব্বী পত্নী শান্তিদায়িনী ও সন্তানদের সুখের সংসার বর্ণনাই লেখকের উদ্দেশ্য। কথা প্রসঙ্গে বিদেশের স্ত্রীসমাজ (গোপালচন্দ্র ব্যারিস্টার হবার অন্য বিলেতেও গিয়েছিলেন) এ-দেশের নারীসমাজের কুসংস্কার প্রভৃতি নানাবিষয়ের বর্ণনা এবং আদর্শ গৃহী গোপালচন্দ্র দেব এবং তাঁর বুদ্ধিমতী পতিব্রতা পত্নীর কথা লেখক অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে এঁকেছেন। এর ভাষাভঙ্গিমা ও রচনাপ্রণালী পূর্বাপেক্ষা অনেক সহজ ও স্বচ্ছন্দ হয়েছে, কিন্তু এতে আখ্যানরসের চেয়ে নীতি-উপদেশের বড়ো বাড়াবাড়ি। দেখা যাচ্ছে, বার্ধক্যে পৌঁছে লেখকের স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকরসেও ভাটা পড়েছে। এ-আখ্যানে একমাত্র ‘পিসিপেত্‌নি’ ছাড়া আর কোথাও কৌতুকরসের বিশেষ কোন পরিচয় নেই। অবশ্য এই স্থলাঙ্গিনী অর্ধোম্মাদিনীর চরিত্রে কৌতুকের চেয়ে করুণরাই বেশী ফুটেছে। ‘রামারঞ্জিকা’ ও ‘বামাতোষিণী’ একই উদ্দেশ্যে লেখা—আদর্শ পরিবার, বিশেষতঃ স্ত্রীসমাজের চিত্রাঙ্কনই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। সুতরাং কথাসাহিত্যের আদর্শে ‘বামাতোষিণী’ বিচার্য নয়। সেযুগে প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’-ই অখণ্ড জনপ্রিয়তা রক্ষা করেছিল অন্য উপন্যাস বা আখ্যানে গল্পরসের চেয়ে নীতি ও তত্ত্বকথার বাহুল্যের জন্য তার জনপ্রিয়তাও ছিল সীমাবদ্ধ। কারণ ১৮৮০ খ্রী. অব্দের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘মৃণালিনী’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, রমেশচন্দ্র দত্তের ‘বঙ্গবিজেতা’, ‘মাধবীকঙ্কণ’, ‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’, ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’, প্রতাপচন্দ্র ঘোষের ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’- এর প্রথম খণ্ড এবং তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’ (১২৭৯ বঙ্গাব্দে ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত, ১৮৭৪ খ্রী. অব্দে গ্রন্থাকারে প্রচারিত) প্রকাশিত হয়েছিল। এই সমস্ত সুখপাঠ্য উপন্যাস থেকে ঐকালের বাঙালী পাঠক প্রকৃত উপন্যাসের রসাস্বাদন করতে পেরেছিল। এই সমস্ত মানবজীবনকেন্দ্রিক বাস্তব জীবনরহস্যের সুখদুঃখহাসিকান্নায়-পূর্ণ উপন্যাসের পাশে প্যারীচাঁদের আধ্যাত্মিক ও রূপক-উপন্যাসের পাঠক সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পেয়ে যাবে তাতে আর সন্দেহ কি।

উল্লিখিত আখ্যান ছাড়াও প্যারীচাঁদ কয়েকখানি নিবন্ধগ্রন্থ লিখেছিলেন যার রচনারীতি ও বিষয়বস্তু প্রশংসার যোগ্য। ‘কৃষিপাঠ’ (১৮৬১), ‘ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিত’ (১৮৭৮) এবং ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদের পূর্বাবস্থা’ (১৮৭৮) —এই তিনখানি প্রবন্ধগ্রন্থ লিখে তিনি প্রাবন্ধিকরূপেও বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। কৃষিবিজ্ঞান ও উদ্ভিদ বিদ্যার তিনি বিশেষ অভিজ্ঞ ও কৌতূহলী ছিলেন। তাঁর উপন্যাসে নানাধরনের গাছপালা ও ফুলফলের যে সুদীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতেই বোঝা যাবে উদ্ভিদ-জাতের প্রতি তাঁর যথার্থ মমতার দৃষ্টি ছিল। ‘কৃষিপাঠ’ থেকে বাংলার কৃষিজাত পণ্য সম্বন্ধে তাঁর বিচক্ষণ মতামত আজও বিবেচনার যোগ্য। ডেভিড হেয়ারকে তিনি বিশেষ ভক্তি করতেন। তার কৈশোরকালে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের অবৈতনিক বালক বিদ্যালয়ে হেয়ার সাহেব প্রায়ই আসতেন, তরুণের দল এজন্য তাঁকে খুবই মান্য করত। তাঁর প্রতি সে যুগের শিক্ষিত বাঙালীর কতটা শ্রদ্ধা ছিল, প্যারীচাঁদের রচিত হেয়ার সাহেবের এই জীবনী থেকেই তার পরিচয় পাওয়া যাবে। তিনি ১৮৭৭ খ্রী. অব্দে ইংরেজীতে হেয়ার সাহেবের জীবনী লিখেছিলেন ( A Biographical Shetch of David Hare), এই বাংলা পুস্তিকাটি তারই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।

‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা’য় প্যারীচাঁদ প্রাচীন ভারতের স্ত্রীসমাজের শিক্ষাদীক্ষা ও চরিত্রকাহিনী বিবৃত করেছেন। তার অধিকাংশ রচনাতেই স্ত্রীসমাজের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। সুতরাং তাঁকে মিল সাহেবের মতো একজন হৃদয় ‘feminist’ বলেই গণ্য করতে হবে। অবশ্য তাঁর feminism-এর অর্থ ‘suffragette’ নয়। তাঁর মতে ভোটাধিকার অর্জনই নারীত্বের একমাত্র সাধনা নয়। পারিবারিক ও সাংসারিক দায়িত্বপালন এবং ঈশ্বরচিন্তায় মনঃসন্নিবেশ নারীজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। অবশ্য তিনি এও দেখিয়েছেন, ‘সদ্যোবধূ’ ও ব্রহ্মবাদিনী—প্রাচীন ভারতে দু ধরনের নারীই ছিলেন। সদ্যোবধূরা বিবাহ করে ঘরে সংসার করতেন। কিন্তু ব্রহ্মবাদিনীরা বিবাহ না করে ব্রহ্মচিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন। অবশ্য একটা ধারা ব্রহ্মবাদিনী ছিলেন, যুগভেদে তারাই হয়তো ঊনবিংশ শতাব্দীর নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনে suffragette-এর পতাকা বহন করে চলতে দ্বিধা করতেন না। প্যারীচাঁদ ‘রামারঞ্জিকা’ ও ‘বামাতোষিণী’তে স্ত্রীসমাজের পারিবারিক ও বৈবাহিক জীবনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু ‘অভেদী’-তে স্বামী-স্ত্রীর সংসারিক জীবনের স্থলে আধ্যাত্মিক জীবনের গৌরব করা হয়েছে। ‘আধ্যাত্মিকা’-তো পুরোদস্তুর আধ্যাত্মিক ব্যাপার । সে যাই হোক, এই সমস্ত প্রবন্ধগ্রন্থে তাঁর ভাষা অত্যন্ত সহজ সরস হয়েছে, গুরুচণ্ডালী দোষ প্রায়ই পাওয়া যায় না। তাঁর রচিত কোন কোন আখ্যানে কিছু ঢিলেঢালা ভাব ও বিশৃঙ্খলা দেখা যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই প্রবন্ধপুস্তিকাগুলিতে তাঁর চিন্তা প্রণালী অতিশয় নিয়মানুগ ও পরিচ্ছন্ন, চিন্তার প্রকাশও হয়েছে সংযত গদ্যে। এখানে দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাচ্ছে :

  1. “এদেশে স্ত্রীলোকদিগের সম্মান গৃহে ও বাহিরে একভাবে ছিল। বেদেতে, মনুতে ও পুরাণে স্ত্রীলোকদিগের সম্মানের প্রমাণ ভূরি ভূরি পাওয়া যায়। মনু বলেন স্ত্রীলোক যথার্থ পবিত্র। স্ত্রীলোক ও লক্ষ্মী, সমান। যে পরিবারে স্বামী স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত ও স্ত্রী স্বামীর প্রতি অনুরক্ত, সেই পরিবারে লক্ষ্মী বিরাজমান। স্ত্রীলোকেরা সর্বদা শুদ্ধ। যেখানে স্ত্রীলোকের সম্মান, সেখানে দেবতারা তুষ্ট। যেখানে স্ত্রীলোক অসম্মানিত, সেখানে সকল ধর্মের ভ্রষ্টতা।”— ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা’ (এই সঙ্কলন, পৃ. ৪৪৮)
  2. “হেয়ার সাহেব সামান্য লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। তাঁহার আহার সামান্য ছিল—মদ্য মাংসে রুচি ছিল না—তিনি বলিতেন, এদেশের ঋষিরা মিতাহারী ছিলেন—এটি বড় উত্তম। এদেশের মিঠাই, সন্দেশ, চন্দ্রপুলি, ডাবের জল ও মদ্‌গুর মৎস্য ভাল বাসিতেন। … প্রতিদিন দশটার মধ্যে পালকীতে ঔষধ ও পুস্তক পুরিয়া কলেজে আসিতেন। তাহার পর আপন স্কুলে যাইতেন। রেজিষ্টার দেখিয়া যে বালক অনুপস্থিত তাহাদিগের তালিকা করিতেন। পরে প্রত্যেক শ্রেণীতে যাইয়া প্রত্যেক বালক কেমন পড়িতেছে ও কিরূপ ব্যবহার করিতেছে তাহার অনুসন্ধান করিতেন। শিক্ষক ও ছাত্রদিগের যাহা বক্তব্য তাহা শুনিতেন ও যাহাকে পরামর্শ দেওয়া কর্তব্য তাহা দিতেন।”—‘ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিত’ (এই সঙ্কলন, পূ. ৪৬৪)

এই দুটি দৃষ্টান্ত থেকে মনে হচ্ছে, এ যেন বিদ্যাসাগর বা বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা। তাঁর নিবন্ধ গ্রন্থগুলি এই ধরনের পরিচ্ছন্ন সংযত সাধুভাষায় রচিত। ইংরেজীতে লেখা তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ও পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ সমূহে এই চিন্তাপ্রণালীর সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে। অবশ্য এই সমস্ত প্রবন্ধের অধিকাংশই প্রেততত্ত্ব ও অধ্যাত্মবিদ্যা অবলম্বনে রচিত। জীবনের আদর্শ ও দর্শন সম্বন্ধে তিনি মূলতঃ ভারতীয় পন্থার ঈশ্বরবাদী—যদিও মাদাম ব্লাভটস্কি ও কর্নেল ওলকটের থিয়সফির বিশেষ ভক্ত ছিলেন। তাঁর জীবনদর্শন যাই হোক না কেন, তাঁর ইংরেজী ও বাংলা প্রবন্ধে সর্বদা একটি যুক্তিবাদী ও মিতভাষী ব্যক্তির সংযম চিন্তার পরিচয় পাওয়া যাবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাঙালী পাঠক তাকে শুধু রঙ্গকৌতুকের লেখক বলেই জানে, তাঁর চিন্তা মনস্বিতার সংবাদ বড়ো কেউ রাখে না।

সর্বশেষে প্যারীচাঁদের একখানি সঙ্গীত পুস্তক ‘গীতাঙ্কুর’-এর (১৮৬১) উল্লেখ করি। এই ক্ষুদ্র পুস্তিকায় রাগরাগিণীসহ মোট পঁয়ত্রিশটি গান মুদ্রিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক ভাবনা, ব্ৰহ্মতত্ত্ব প্রভৃতি ব্যাপারই গানগুলির অবলম্বন। বোধ করি রামমোহনের ‘ব্রহ্মসঙ্গীতে’র (১৮২৮) আদর্শেই পারীচাঁদ এই আধ্যাত্মিক গানগুলি রচনা করেছিলেন এবং ভাবের দিক থেকেও রামমোহনের গানের সঙ্গে প্যারীচাঁদের গানের কিছু সাদৃত আছে। ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি, মনের উৎকর্ষ সাধন, কামক্রোধাদি রিপুকে ত্যাগ করে সাত্বিক ভাব গ্রহণ, পরিশেষে ঈশ্বর-সাযুজ্য লাভ—গানগুলির এই হল তাৎপর্য। বলা বাহুল্য যা মূলতঃ সাধ্যসাধনতত্ত্বের গান, সাধারণ কবিতার আদর্শে তার বিচার চলে না। কারণ এ সমস্ত গান ভাবে-ভাষায় রচনার পারিপাট্যে অনেক সময়েই যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠে না, কারণ এর রচনাকার মুখ্যতঃ সাধক ও তাত্ত্বিক, গৌণতঃ শিল্পী। ফলে উচ্চ তত্ত্বের কবলে পড়ে গানের কবিত্ব অনেক সময়েই মারা পড়ে। প্যারীচাঁদের ‘গীতাঙ্কুর’ তার বাইরে নয়। তবে দু’ একটি গানে কবির আন্তরিকতা আমাদের মনকেও স্পর্শ করে। যেমন—

নও তুমি কেবল কাশীবাসী, বিশ্বেশ্বর হে!

যেথায় ভ্রমণ করি সেই বারাণসী।

তব রাজ্য সম্পূর্ণ, নানা রত্নে পরিপূর্ণ,

প্রকৃত অন্নপূর্ণা তুমি ব্রহ্মাণ্ড নিবাসী।

স্থানতীর্থ নাহি দেখি, চিত্ততীর্থে সদা সুখী,

ধনমান চাহি না যে, শাস্তি অভিলাষী।

(এই সঙ্কলন, পূ. ৩০৭)

এখানে আমরা প্যারীচাঁদের গ্রন্থগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলাম, কৌতূহলী পাঠক যাতে মূল গ্রন্থ পাঠে উৎসাহিত হন, এই জন্যই তাঁর গ্রন্থ সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা গেল!

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ‘আলাল’ উপন্যাস আকারে প্রচারিত হলে তার ভূমিকায় লেখক প্রচারধর্মিতারকথা স্বীকার করে নিয়ে বলেন, “IS (i. e. আলাল ) chiefly tests of the pernicious effects of allowing children to be improperly brought up, with remarks on the existing system of education, on self-formation and religious culture and partly of the atate of things in the Moffusail.”
  2. ‘মাসিক পত্রিকা’র ১ম বর্ষের ৭ম সংখ্যা (১২ ফেব্রুয়ারী ১৮৫৫) থেকে ‘আলালে’র এক এক অধ্যায় প্রকাশিত হতে থাকে। ৩য় বর্ষের ১২শ সংখ্যা (জুন, ১৮৫৭) পর্যন্ত (২০ অধ্যায়) এই উপন্যাস চলেছিল। কিন্তু ৪র্থ বর্ষে আর আলাল ছাপা হয়নি। লেখক গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় উপন্যাস সম্পূর্ণ করেন।
  3. লণ্ডন থেকে প্রকাশিত Journal of the National Indian Astotation পত্রিকায় (১২৮২-৮৩) এটি ‘The Spoilt Child’ নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। অনুবাদটি প্যারীচাঁদেরই। মিরিয়ম এস নাইট এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছিলেন। ১৮৯৩ সালে জি. ডি. অস্‌য়েল এর আর একটি অনুবাদ প্রকাশ করেন— ‘The Spoilt Child: Tale of Hindn Domestic Life.
  4. পাঠকগণ এর সঙ্গে মূল ‘আলাল’-এর (এই সঙ্কলন, পৃ. ১৪) তুলনা করলে দেখবেন মূলের চেয়ে নাট্যরূপ অনেক নীরেস হয়েছে। অবশ্য এ-সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ইহার (অর্থাৎ নাটক) ভাষা উৎকৃষ্ট চল্‌তি ভাষা; মূল পুস্তকের গল্পাংশের এবং কথোপকথন অংশের মর্যাদা যেভাবে নাটকে রক্ষা করা হইয়াছে, তাহাতে স্বভাবতই মনে হয়, ইহাতে প্যারীচাঁদের হাত ছিল” (সাহিত্য পরিষৎ পকাশিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’এর ভূমিকা, পৃ. ৪০, ৩য় সংস্করণ)। নাট্যরূপান্তরে প্যারীচাঁদের হাত থাক আর নাই থাক, নাটকটি উপন্যাসের তুলনায় নিষ্প্রাণ। তদুপরি মূল কাহিনী অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৃশ্যে বিভক্ত হওয়ার ফলে বহু স্থলে ঘটনার গতি ব্যাহত হয়েছে এবং মূল গ্রন্থের সরসতা নাটকে অতি অল্পই রক্ষিত হয়েছে।
  5. ইংরেজি গ্রন্থের তালিকা : Notes on the Evidence on Indian Affairs (1953); A Biographical Sketch of David Hare (1877); The Spiritual Stray Leaves (1870); Stray Thoughts on Spiritualism (1879): Life of Dewan Ramoomal sen (1880); Life of  Coleaworthy Grant (1881); On the Soul : Its Nature and Development (1881); Agriculture In Bengal (1881).
  6. শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, “কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদারের প্রণীত ‘বিজয়বসন্ত’ ও টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙ্গালায় প্রথম উপন্যাস (রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ)। ১৮৫৯ সালে বিমাতার অত্যাচারক্লীষ্ট রূপকথা অবলম্বনে বিশুদ্ধ সাধু ভাষায় হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ) এই আখ্যান রচনা করেন। এটিকে রূপকথাই বলতে হবে, যদিও দীর্ঘ আখ্যানের ঢঙে রচিত। সুতরাং এটি ‘আলাল’-এর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না।
  7. বঙ্গভাষানুবাদক সমাজের আনুকূল্যে প্রকাশিত ‘রবিনসন ক্রুশোর ভ্রমণ-বৃত্তান্ত’, ‘হংসরূপী রাজপুত্রের বিষয়’, ‘চকমকির বাক্স’, ‘মৎস্যনারীর উপাখ্যান’, ‘সুশীলার উপাখ্যান’, বেঙ্গল ফ্যামিলি লাইব্রেরীর গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত ‘ঈসপস্ ফেবল্‌স্’-এর বাংলা সংস্করণ ‘নবনীতিকথা’, ‘দশকুমার চরিত’, রামনারায়ণ ভট্টাচার্যের ‘পতিব্রতোপাখ্যান’, ‘নীলমণি বসাকের ‘নরনারী’ প্রভৃতি রচনায় গল্পের রস অনেক স্থলে ফুটেছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে তখনও উপন্যাসের সম্ভাবনা দেখা দেয় নি। সেই জন্য ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রে ‘আলাল’কে প্রথম বাংলা উপন্যাসের গৌরব দেওয়া হয়েছিল— “We hail this book as the finest novel in the Bengali Language. Tek Chand Thakur has written a tale, the like of which is not to be found within the entire range of Bengali Literature.” উক্ত সমালোচনায় প্যারীচাঁদের রচনাকে গোল্ডস্মিথের হাস্যরস ও ফিল্ডিং-এর কৌতুকরসের সমতুল্য বলা হয়েছিল।
  8. দ্রষ্টব্য : বিবিধার্থ সংগ্রহ, চৈত্র, ১৭৮০ শক। সেখানে ‘আলালে’র উৎস হিসেবে ভবানী- ভরণের ‘নববাবুবিলাস’, ‘নববিবিবিলাস’ ও ‘দূতীবিলাসে’র উল্লেখ করা হয়েছে। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’র সম্পাদক প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর ‘ধর্মবিলাস’ নামে সংস্কৃতে যে চম্পুকাব্য রচনা করেন, তাতেও আখ্যানের ছলে ধর্মসভা ও ব্রাহ্মসভার বিবাদ সরস কৌতুকের দ্বারা বর্ণিত হয়েছিল। কিন্তু সংস্কৃতে রচিত বলে এর বিশেষ কোন প্রচার হয় নি।
  9. শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ও ড. শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকাসহ গ্রন্থটির একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে (১৩৬৫)। দীর্ঘ এক শতাব্দীর পরে গ্রন্থটিকে দিবালোকে এনে সম্পাদক বাংলা গদ্যের মহদুপকার করেছেন।
  10. ডক্টর শ্রীমতী সবিতা দাশ এই তথ্যের সন্ধান দিয়েছেন।
  11. বিদেশীরা এই বই পড়ে বাংলা ভাষা শিখবে এবং হিন্দুর পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে উৎসাহিত হবে এই উদ্দেশ্যেই তিনি লিখতে উৎসাহী হয়েছিলেন। ভূমিকায় বলেছেন, “The work has been written in a simple style, and to foreigners desirous of acquiring an idiomatic knowledge of the Bengali language and an acquaintance with Hindu domestic life, it will perhaps be found useful.”
  12. এর ভূমিকা দ্রষ্টব্য: “Encouraged by the favourable reception of the novel entitled ‘আলালের ঘরের দুলাল’ I now beg to present the Reading community with another little work.”
  13. এ-বিষয়ে লেখক অবহিত ছিলেন। কারণ তিনি ভূমিকায় বলেছেন, “I crave the ludulgence of the Reader for the imperfection which this publication contains.”
  14. “The conversation and manners of different classes of people in different circumstances which have been portrayed in different styles and which may perhaps be useful to foreigners, wishing to acquire a colloquial knowledge of the Bengali language.” (ভূমিকা)