প্যারীচাঁদ রচনাবলী
প্যারীচাঁদ মিত্রের সংক্ষিপ্ত জীবনকথা॥
কলকাতার বিচিত্র জীবনরঙ্গের অংশীদার প্যারীচাঁদ মিত্র1 এই নগরীর যাবতীয় জীবনচর্যার অন্তরঙ্গতা লাভ করে বেশ ভালোভাবেই সুনাগরিকতার কর্তব্য পালন করেছিলেন। বস্তুতঃ উনিশ শতকের কলকাতার জীবনে যে বৈপরীত্য ঘনিয়েছিল, প্যারীচাঁদ নিজেও তার এলোমেলো হাওয়ায় আন্দোলিত হয়েছিলেন। কোন এক সমালোচক উনিশ শতকের কলকাতা সম্বন্ধে বলেছেন :
“একদিকে চাকুরি-গৌরব, আর একদিকে Mill, Bentham, Spencer, একদিকে দাশুরায়ের পাঁচালী, আর একদিকে Shakespeare, Milton, Byron; একদিকে মাহেশের রথ, বাগানবাড়ির আমোদ, অপরদিকে ব্রাহ্মমন্দিরে উপাসনা—সে যেন এক অপূর্ব প্রহসন।” (মোহিতলাল)
এই পরস্পরবিরোধী বৈষম্য, যার মধ্যে অসঙ্গতিজনিত হাস্যরস নিহিত রয়েছে, তার গভীরতর দিকটি প্যারীচাঁদের জীবনে ছায়াপাত করেছিল। হিন্দু কলেজের কৃতীছাত্র, ডিরোজিওর শিষ্য, স্ত্রীশিক্ষার একনিষ্ঠ প্রচারক প্যারীচাঁদ ব্যক্তিগত দিক থেকে কখনও মূর্তি-উপাসক, কখনও একেশ্বরবাদী, কখনও বৈদান্তিক, কখনও জনসেবার্থে সাহিত্যসাধক, কখনও নিছক শিল্পী, কখনও কৃষিতত্ত্ববিৎ হয়ে মানবজমিনে আসমান রচনার চেষ্টা, কখনও হিসাবীবুদ্ধির প্রেরণায় ব্যবসাবাণিজ্যে লক্ষ্মীর বরাসন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়, কখনও-বা নির্বিকল্প চিদাকাশে যোগস্থ বিহার—এই হল প্যারীচাঁদের ব্যক্তিগত জীবনচর্যা। সাহিত্যেও তাঁর দ্বিমুখী বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যাবে। একদিকে যেমন তিনি রঙ্গপরিহাসে উতরোল ঘটনা ও চরিত্র সৃষ্টি করে পাঠককে কৌতুকরসে বেসামাল করে তুলেছেন, আবার অন্যদিকে সমাজ ও ব্যক্তির জীবননীতি, উচ্চতর চারিত্রধর্ম, সজ্জীবন প্রভৃতি নৈতিক ব্যাপার নিয়েও খুব গভীর ধরনের আলোচনায় মগ্ন হয়েছেন। একদিকে গুরুমহাশয়, আর একদিকে বয়স্য—তাঁর পক্ষে এই দুই ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া আদৌ অস্বাভাবিক হয় নি।
তাদের আদিনিবাস হুগলী জেলার হরিপাল থানার অন্তর্গত পানিসেওলা গ্রাম। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে, যখন কলকাতায় বণিক-সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল, তখন (১৭৯৪ খ্রী৽ অ৽) প্যারীচাঁদের বিচক্ষণ পিতামহ গঙ্গাধর মিত্র পানিসেওলার শৈবালদামজীর্ণ গ্রাম্য পরিবেশ ত্যাগ করলেন এবং কলকাতার নিমতলা অঞ্চলে বাড়ী তৈরি করে স্থায়িভাবে বসবাস করতে লাগলেন। পরিণয়সূত্রে তিনি হাটখোলার বিখ্যাত ধনী পরিবার দত্তদের আনুকূল্য লাভ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রামনারায়ণ ইংরেজী বিদ্যা ও সাহেবী আচার-ব্যবহার নিপুণভাবে আয়ত্ত করেছিলেন এবং কোম্পানীর কাগজের লেনদেন করে প্রচুর বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন। তাঁর পাঁচ পুত্র। তন্মধ্যে শেষ দুই পুত্র প্যারীচাঁদ ও কিশোরীচাঁদ মিত্রের কথা বাঙালী ভুলে যায় নি।
১৮১৪ খ্রী৽ অব্দের ২২শে জুলাই (৮ শ্রাবণ, ১২২১) কলকাতায় প্যারীচাঁদের জন্ম হয়। সেকালের প্রথামতো শৈশবে তিনি কিছু সংস্কৃত ও ফার্সী শিখেছিলেন, পরে সংস্কৃত বিদ্যায় পরিপক্কতা অর্জন করেন। তেরো বৎসর বয়সে (১৮২৭ খ্রী৽ অ৽) তিনি হিন্দু কলেজের একাদশ শ্রেণীতে প্রবেশ করে ইংরেজী ভাষা ও পাশ্চাত্ত্য বিদ্যার্জনে সচেষ্ট হলেন। এই সময়ে তিনি হিন্দু কলেজের তরুণ বিপ্লবী-শিক্ষক হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং উক্ত কলেজের তরুণ ছাত্রদের সংস্পর্শে আসেন। কলেজের কৃতী ছাত্রের তালিকায় তাঁর নাম ছিল। ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে ছাত্রাবস্থাতেই বিশেষ অধিকার অর্জন করেছিলেন। উত্তরকালে নিজের বাড়ীতে তিনি ইংরেজী শেখাবার জন্য অবৈতনিক বালক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ডিরোজিও ও ডেভিড হেয়ার এই স্কুলে উপস্থিত হয়ে ছাত্র ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতেন।
১৮৩৬ খ্রী৽ অব্দে প্যারীচাঁদ ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী নামে বিখ্যাত গ্রন্থাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত হন এবং নানা ধরনের বিদেশী গ্রন্থপাঠের সুযোগ লাভ করেন। তখনই কলকাতার বিদ্যুৎসমাজে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। জে. পি. গ্র্যান্ট তাঁকে অতিশয় স্নেহ করতেন। তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা, পাঠস্পৃহা এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধি স্মরণ করে গ্র্যান্ট তাকেই উক্ত সহকারী প্রন্থাগারিকের পদে সুপারিশ করেন। তখনই তরুণ প্যারীচাঁদ “an admirable English Scholar” (গ্র্যান্টের উক্তি) রূপে ইংরেজমহলে বিলক্ষণ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। সেকালের শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে জ্ঞানে ও পরিমিত আচারে প্যারীচাঁদ সর্বজনমান্য হয়েছিলেন। ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরির আর্থিক সচ্ছলতা ও নানাপ্রকার উন্নয়নে যুবক প্যারীচাঁদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৮৪৮ খ্রী৽ অব্দে তিনি উক্ত গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক ও সম্পাদকের পদ লাভ করেন। ঐ গ্রন্থাগারের অন্যতম পরিচালক ওয়াকার ঐ পদে তাঁকে নিয়োগ সম্পর্কে আর এক শ্বেতাঙ্গ বন্ধুকে লিখেছিলেন, “As far as I have had an opportunity of forming an opinion he is very intelligent and will do our work better than a European.” সে-যুগের শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি এই কৃষ্ণাঙ্গকে কর্মকুশলতায় শ্বেতাঙ্গের উপরে স্থান দিতে চেয়েছিলেন, এতেই প্যারীচাঁদের দক্ষতা বোঝা যাচ্ছে। ১৮৬৬ খ্রী৽ অব্দে প্যারীচাঁদ এই গ্রন্থাগারের বৈতনিক সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন। কিন্তু গ্রন্থাগারের পরিচালকের অন্যতম হয়ে শেষ জীবন পর্যন্ত এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন।
যৌবনকালেই প্যারীচাঁদ শিক্ষা প্রচার, আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা, স্ত্রীশিক্ষার সম্প্রসারণ প্রভৃতি ব্যাপারে কলকাতার শিক্ষিত মহলে শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিলেন। লোকশিক্ষার জন্য তাঁকে অনেক সাময়িক পত্রের সঙ্গে সংযোগ রাখতে হয়েছিল। ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের বাণীবাহক দু’ খানি পত্রিকা— ‘জ্ঞানান্বেষণ’ ( ১৮৩১-১৮৪) এবং দ্বিভাষিক ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটরে’ (১৮৪২-১৮৪৩) তাঁর অনেক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। রেভা৽ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বিদ্যাকল্পদ্রুমে’র পঞ্চম খণ্ডেও (১৮৪৭) তাঁর তিনটি নিবন্ধ মুদ্রিত হয়েছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যে পাকাপাকিভাবে অবতরণের পূর্বেই তিনি বাংলা গদ্যে নিবন্ধাদি রচনা করে বাংলা রচনার আড়ষ্টভাব অনেকটা কাটিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারে সর্বাগ্রে ‘মাসিক পত্রিকা’র (১৮৫৪-১৮৫৮) উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৮৫৪ খ্রী৽ অব্দে বন্ধু রাধানাথ শিকদারের সহযোগিতায় স্ত্রীসমাজের মানসিক, নৈতিক ও পরিবারিক উৎকর্ষের জন্য প্যারীচাঁদ এই ক্ষুদ্র মাসিক পত্র সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। পত্রিকাখানি ১৮৫৮ খ্রী৽ অ৽ পর্যন্ত চলেছিল। তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এই পত্রিকার প্রথম বর্ষের কয়েক সংখ্যার পর থেকে (১৮৫৫, ১২ ফেব্রুয়ারি) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় (২০শ অধ্যায় পর্যন্ত)। পত্রিকাখানি স্বল্পশিক্ষিত বাঙালী মেয়েদের জন্য প্রকাশিত হত বলে সরস আখ্যানের ঢং বজায় রেখে অতি সহজ ভাষায়, কখনও কখনও একেবারে ঘরোয়া ভাষার গল্প ও রূপকের ছলে সমাজ ও পরিবারে স্ত্রীলোকের ভুমিকা সম্পর্কে নানা নিবন্ধ ও কাহিনী প্রকাশিত হত। পত্রিকার প্রতি সংখ্যার প্রারম্ভে এই মন্তব্য ছাপা থাকত :
“এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষত স্ত্রীলোকের অন্য ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক। বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান, পড়িবেন, কিন্তু তাঁহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই।”
এতে তাঁর আরও রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। সাংবাদিক হিসেবেও যে তাঁর একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল, তা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
শুধু সাহিত্য-সংস্কৃতি শিক্ষাব্যাপারেই নয়, ব্যবসাবাণিজ্যেও প্যারীচাঁদের বিশেষ দক্ষতা ছিল। সাধারণতঃ দেখা যায়, সারস্বত সাধকেরা ব্যবসাবাণিজ্যাদির মতো স্থুল ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ বোধ করেন না। কিন্তু প্যারীচাঁদ সংস্কৃতি ও বাণিজ্য–দু’ ব্যাপারেই সমভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁর পিতা পূর্বেই কোম্পানীর কাগজের লেনদেন করে প্রচুর বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, পুত্র এদিক থেকে পিতার কৃতিত্বের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তবে তিনি কোম্পানীর কাজের নিরাপদ দুর্গ পরিত্যাগ করে অধিকতর দায়িত্বপূর্ণ আমদানি-রপ্তানির কারবারে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ‘কালাচাঁদ শেঠ এণ্ড কোম্পানী’-র অন্যতম অংশীদার হয়ে তিনি ব্যবসায়ে যোগদান করেন, পরে স্বাধীনভাবে কারবারে প্রবৃত্ত হয়ে স্বয়ং ‘প্যারীচাঁদ মিত্র এও সন্স’ (১৮৫৬) নামে আমদানি-রপ্তানির বড়ো রকমের সংস্থা গঠন করেন। সে-যুগের কলকাতার বিত্তবান ব্যক্তিদের ঢিলেমি ও কুঁড়েমি তাকে স্পর্শ করে নি। অত্যন্ত পরিশ্রম করে তিনি কারবারটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। পরিশ্রমের সঙ্গে ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সততা ও ঐকান্তিকতা। ফলে যুরোপীয় বণিক মহলেও ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল, অনেক যুরোপীয় বণিকসংস্থায় তাঁকে পরিচালকরূপে গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ছাড়াও তিনি নানা জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জড়িত ছিলেন। সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, বীটন সোসাইটী, বেঙ্গল সোফাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিষদে তিনি সানন্দে যোগ দিয়েছিলেন। এককথায় কলকাতার নাগরিক সমাজে তাঁর মূল্যবান ভূমিকা ছিল, যুরোপীয় সমাজেও তাঁর অবাধ গতিবিধি ও শ্রদ্ধার্হ স্থান ছিল—অনেকটা বিজ্ঞ্যাসাগরের মতো।
প্যারীচাঁর কলকাতা নগরীর যাবতীয় সৎকর্ম ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারের পুরোভাগে স্বেচ্ছায় স্থান গ্রহণ করতেন। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিকভাবে কৃষিকার্য ও কৃষিতত্ত্ব প্রচারে তাঁর দান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। ড৽ উইলিয়ম কেরীর উদ্ভিদ প্রীতি সর্বজনবিদিত। তিনিই প্রথমে উদ্যোগী হয়ে Agricultural and Horticultural Society of India-র গোড়াপত্তন করেন। ১৮৪৭ খ্রী৽ অব্দে প্যারীচাঁদ এই সংস্থার সদ্য নির্বাচিত হয়ে কৃষিবিদ্যা সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন এবং বৈজ্ঞানিকভাবে কৃষিবিচার চর্চা করেন। এ-বিষয়ে ইংরেজীতে লেখা তাঁর অনেক গুলি মৌলিক প্রবন্ধ আছে। ১৮৮১ সালে তাঁর Agriculture in Bengal নামে যে পুস্তিকা প্রকাশিত হয়, তাতে দেখা যাবে, উন্নত ধরনের কৃষিবিদ্যা ও কৃষিজাত পণ্য সম্বন্ধে তিনি কতটা অভিজ্ঞ ছিলেন। বর্তমান আমরা তাঁর ‘কৃষিপাঠ’ (১৮৬১) নামে যে পুস্তিকা মুদ্রিত করেছি, পাঠক তার থেকে প্যারীচাঁদের কৃষিবিদ্যা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাবেন। এছাড়া The Calcutta Review পত্রে প্রকাশিত কৃষিবিষয়ক বহু প্রবন্ধে তাঁর বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যাবে।
ভূমিচারী কৃষিবিদ্যা ও অলৌকিক অধ্যাত্মবিদ্যার মধ্যে কোন দিক দিয়েই সংযোগ থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা প্রারম্ভেই বলেছি, বিপরীতে-বিষমে গড়ে উঠেছে উনিশ শতকের বাংলাদেশ, বিশেষতঃ নাগরিক বাংলা। প্যারীচাঁদ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিবিদ্যার যেমন প্রথম পথ নির্মাণ করেন, তেমনি এদেশে পরাবিদ্যা, বিশেষতঃ ভগবৎতত্ত্বানুসন্ধানী থিয়নকি আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান নেতা। বাল্যকালে তিনি মোটামুটি হিন্দুর পৌরাণিক আদর্শে লালিত হয়েছিলেন।2 হিন্দু কলেজে তিনি ‘ইয়ং বেঙ্গল’-দের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে এলেও ‘কালাপাহাড়’ তরুণ সম্প্রদায় এবং বিশুদ্ধ যুক্তিবাদী ডিরোজিওর (ইনি সম্ভবতঃ সংশয়বাদী ছিলেন— যা খানিকটা নাস্তিকতার ধার ঘেঁষে গেছে) ধর্মবিরোধিতা তাঁকে বিচলিত করতে পারে নি, ঈশ্বরসম্পর্কে তাঁর মনে কখনও কোন সংশয় জাগে নি।3 এ-সম্বন্ধে তিনি স্পষ্টই বলেছেন :
My desire to understand God and His Providence was earnest from the reading of standard works on those subjects and theistic and Christian authors, as well of the Arya works, in Sanskrit and Bengali, produced a living connection that there is but one God of infinite perfection. I became a theist or a Brahma. (On the Soul)
এতেই বোঝা যাচ্ছে, ঘূর্ণির মধ্যে পড়লেও নাস্তিকতা, সংশয় ও অহিন্দুসুলভ আচারদ্রোহ তাঁকে বিচলিত করতে পারে নি। খানিকটা পারিবারিক আবহাওয়া, খানিকটা স্বাভাবিক ঈশ্বরপরায়ণতা, খানিকটা সতীর্থ শুদ্ধাত্মা রামতনু লাহিড়ীর সাহচর্য তাঁকে আত্মহারা প্লাবণেও আত্মভ্রষ্ট করতে পারেনি। যৌবনের শেষ দিকে তিনি হিন্দু শাস্ত্রাদি মন্থন করে অদ্বৈততত্ত্বে স্থিরবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। ঋষি-মহর্ষি প্রোক্ত বেদ-উপনিষদ যোগ-তন্ত্র পুরাণের প্রতি তিনি স্বতঃই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৮৮২ খ্রী৽ অব্দের ১৯ মার্চ থিয়সফি আন্দোলনের নেতা কর্ণেল ওলকটের অভিনন্দনের জন্য আহুত সভায় বক্তৃতাপ্রসঙ্গে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন :
What the Maharshis and Rishis had taught in the Vedas, Upanishads, Yoga, Tantras and Puranas, is that Divinity is in humanity, and that the life assimilated to Divinity is the spiritual life—the life of a Nirvana which is attainable by extinguishing the natural life of Yoga, culminating in the development of the spiritual life.
১৮৬০ খ্রী৽ অব্দে প্যারীচাঁদের স্ত্রীবিয়োগ হয়। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল আদর্শস্থানীয়। প্যারীচাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে যে সমস্ত স্বামী-স্ত্রীর চরিত্র আছে, সতীসাধ্বী স্বামিগতপ্রাণার স্নিগ্ধমধুর চিত্র আছে, তাঁর সহধর্মিণীই পরোক্ষে তার প্রেরণা দিয়ে থাকবেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্যারীচাঁদ শোকাবেগ ব্যাকুল হয়ে পড়েন। যিদি একদা কায়া ও কান্তি দিয়ে স্বামী সেবা করেছেন, গৃহলক্ষ্মী হয়ে সংসারে শান্তি রক্ষা করেছেন, তিনি কালসাগরের অতলে তলিয়ে গেলে প্যারীচাঁদ বোধ হয় তাঁকে ছায়ারূপেও প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন। ফলে তিনি spiritualism বা প্রেততত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন।4 কোন ব্যাপারেই তিনি মধ্যপথে ক্ষান্ত হতে পারতেন না। প্রেততত্ত্ব তাঁকে পুরোপুরি পেয়ে বসল। বিদেশ থেকে এ-বিষয়ে তিনি অনেক বই আনাতে শুরু করলেন। পাশ্চাত্য প্রেততত্ত্ববিদগণ তাঁর পরিচয় পেয়ে বিদেশের প্রেততত্ত্বসংস্থায় তাঁকে সাদরে আহ্বান করেন। ১৮৮০ খ্রী৽ অব্দে কলকাতায় ‘United Association of Spiritualists’ নামে প্রেততত্ত্ববিষয়ক যে সমিতি গঠিত হয়, তিনি তার সহকারী সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৮৭৭ সাল থেকেই তিনি ইংরাজীতে প্রেততত্ত্ববিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। সেগুলি ইংলণ্ড ও আমেরিকার প্রেততত্ত্বের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধের কিছু কিছু তাঁর দু’খানি ইংরেজী গ্রন্থে (The Spiritual Stray Leaves—1879, Stray Thoughts on Spiritualism—1880) সঙ্কলিত হয়েছে।
ক্রমে প্রেততত্ত্বের রহস্য রোমাঞ্চ তাকে ঈশ্বরতত্ত্বের স্থিরবিশ্বাসে পৌঁছে দিল। তিনি প্রেততত্ত্বের স্থলে ঈশ্বরকেন্দ্রিক থিয়সফি-কে গ্রহণ করলেন। ১৮৭৫ খ্রী৽ অব্দে নিউ ইয়র্ক শহরে যে ‘থিয়সফিকাল সোসাইটী’ গঠিত হয়, ১৮৭৭ খ্রী৽ অব্দ থেকে তার সঙ্গে প্যারীচাঁদ জড়িত হয়ে পড়েন। এই সভার সভাপতি ছিলেন কর্নেল ওলকট (H. S. Olcott) এবং অন্যতম প্রধান নেত্রী ছিলেন মাদাম ব্লাভ্টুস্কি (H. P. Blavtsky)। পাশ্চাত্য প্রেততত্ত্ববিষয়ক পত্রিকায় প্যারীচাঁদের প্রবন্ধ পড়ে তারা তার গুণগ্রাহী হয়ে পড়েন। ১৮৭৯ খ্রী৽ অব্দে ওলকট-ব্লাভ্টুস্কি বোম্বাই শহরে পৌঁছে ভারতে প্রথম থিয়সফিকাল সোসাইটী স্থাপন করেন, ঐ বৎসরে সমিতির মুখপত্র Theosophist পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর প্রথম সংখ্যায় প্যারীচাঁদ ‘The Inner God’ নামে যে প্রবন্ধ লেখেন তাতে বলেছিলেন, “The end of Spiritualism is Theosophy.” এর থেকে অনুমিত হচ্ছে, প্রেততত্ত্বই তাঁকে ঈশ্বরতত্ত্বে নিয়ে গিয়েছিল। ১৮৮২ খ্রী৽ অব্দে কলকাতায় ওলট ও ব্লাভটুস্কির সংবর্ধনার জন্য যে সভা হয় তাতে তৎকালীন কলকাতার বহু গণ্যমান্য বাঙালী ও শ্বেতাঙ্গ উপস্থিত ছিলেন। প্যারীচাঁদ সেই সভায় থিয়সফি সম্বন্ধে ইংরেজীতে যে বক্তৃতা দেন, তাতেই দেখা যাবে, তিনি মূলতঃ সনাতন ভারতীয় মানসিকতায় দৃঢ়নিষ্ঠ ছিলেন। পুরাকালে ভারতীয় মুনিঋষিরা যে অধ্যাত্মবিদ্যার দ্বারা আত্মদর্শন করতেন, চর্চার অভাবে যা পরবর্তিকালে ভারতবর্ষ থেকে প্রায় মুছে গেছে, সেই পরাবিদ্যার নির্বাপিত দীপশিখাকে সাগরপারের দুই বিদেশী আবার জ্বালিয়ে দিলেন বলে প্যারীচাঁদ ‘Sister Blavtsky’ ও ‘Brother Olcott’-কে সাশ্রুনেত্রে হৃদয়ের অকৃত্রিম প্রীতি ও অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।5 কলকাতায় থিয়সফিকাল সোসাইটীর যে শাখা স্থাপিত হয় (১ এপ্রিল, ১৮৮২), প্যারীচাঁদ আমরণ তার সভাপতি ছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছুকাল এর সহকারী সভাপতি হয়েছিলেন। পরবর্তিকালে ভারতীয় স্বাদেশিক আন্দোলনে থিয়সফিকাল সোসাইটীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, তাই এখানে এ-বিষয়ে দু’চার কথা বলতে হল। প্যারীচাঁদ তাঁর রূপক ও আধ্যাত্মিক উপন্যাসে একাধিকবার থিয়সফি-সংক্রান্ত রহন্যবিদ্যার অবতারণা করেছেন। বস্তুতঃ তাঁর প্রথম আখ্যান ‘আলালের ঘরের দুলালে’র পর লেখা প্রায় সমস্ত আখ্যানেই তত্ত্ববিদ্যার কমবেশী উল্লেখ দেখা যায়।
বাংলা সাহিত্য, বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থেকে প্যারীচাঁদ কলকাতার সমাজে বিশেষ শ্রদ্ধালাভ করেছিলেন। কলকাতা মিউনিসিপাল বোর্ডের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট, তারপরে অবৈতনিক বিচারক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’, হাইকোর্টের গ্র্যাণ্ড জুরি, আইন সভার সদস্য প্রভৃতি দায়িত্বপূর্ণ পদে প্রতিষ্ঠিত থেকে প্যারীচাঁদ অক্লান্তভাবে দেশের-দশের সেবা করে গেছেন।6 ১৯৮০ খ্রী৽ অব্দে ২৩ নভেম্বর রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁর কর্মবহুল জীবনের অবসান হয়। তাঁর সম্বন্ধে রেভা৽ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন :
He was a link of union between European and Native Society which will be regretted now as a “missing link” by both those communities. No one was more fitted for the highest position open to native ambition than he was, and yet despising worldly ambition and indifferent to self-interest he adhered to the interests of his country and laboured indefatigably for those interests.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থেই এই ছদ্মনাম ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর এই অদ্ভুত ছদ্মনামের তাৎপর্য সমক্ষে বলা হয়েছে, “টেকো চাঁদ (অর্থাৎ সম্পূর্ণ মসৃণ ও গোলাকার) ঠাকুর ( অর্থাৎ দেবতা)” অর্থাৎ শালগ্রাম।—ছদ্মনামটি গ্রহণের কালে ই কথা বোধ করি লেখকের মনে ছিল” (ড৽ সুকুমার সেন—বাংলা সাহিত্যে গদ্য, ৪র্থ সংস্করণ, পৃ৽ ৭৩)। ‘টেকচাঁদ’ নামের এই অভিনব ভাষাতাত্ত্বিক তাৎপর্য প্যারীচাঁদের মস্তিষ্কে উদিত হয়েছিল কিনা সন্দেহ।
- এ-বিষয়ে তাঁর নিজের উক্তিই প্রমাণ— “I was born in 1814, and was brought up as an idolator.” (On the Sont)
- কোন কোন বিষয়ে তিনি রক্ষণশীল ছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও ‘নববিধান’ দলের আচার-আচরণকে সমালোচনা করেছেন। বিধবা বিবাহের চেয়ে তিনি নারীর বৈধব্য ও ব্রহ্মচর্যের অধিক গুণগান করেছেন, সহমরণকও নারীর আত্মত্যাগের মহত্তম দৃষ্টান্ত বলে মেনে নিয়েছেন। তথাকথিত উন্নত ব্রাহ্মদের প্রতি কটাক্ষ করে বলেছেন, “ব্রাহ্মেরা আস্তিকতার বৃদ্ধি করিয়েছেন বটে, কিন্তু আসল ধর্মভাব কোথায়? অনেক স্থলে নামমাত্র” (আধ্যাত্মিকা, এই সঙ্কলন, পৃ৽ ৫২৪)। তাঁর গ্রন্থে একাধিকবার রামমোহন ও ব্রাহ্মমতের উল্লেখ আছে। কিন্তু তাঁর মন্তব্য থেকে মনে হয়, ব্রাহ্মমতকে তিনি ধর্মাচরণের চূড়ান্ত বলে মানতেন না। ‘অভেদী’-তে তিনি স্পষ্টই বলেছেন, “মহাত্মা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর যাঁহারা তাঁহার অনুগামী হইয়াছেন, তাঁহারা অসীম আয়াস ও ঈশ্বর পরায়ণত্ব দ্বারা দেশ উচ্ছল করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদিগের উপাসনা, উপদেশ ও সংগীতের দ্বারা আত্মদর্শিত্ব বিশেষরূপে প্রকাশ পায় না” (এই সঙ্কলন, পৃ৽ ৪২০)। আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতি তাঁর অধিকতর সহানুভূতি ছিল, কিন্তু ‘কৈশবী’ দলকে কোথাও কোথাও মৃদু ব্যঙ্গ করেছেন। উন্নত ব্রাহ্মদের বক্তৃতা বর্ণনা করতে গিয়ে প্যারীচাঁদ কৌতুকরসের আমদানিও করেছেন। (দ্রষ্টব্য : এই সঙ্কলন, পৃ৽ ৪৩১-৪৩৫)
- এ-বিষয়ে তিনি বলেছেন, “In 1860, I lost my wile, which rouvahed me much. I took to the study of spiritualism which, 1 contour, I would not lave thought of otherwise nor relished its charms.” (On the Soul)
- ভাবাবেগ বশতঃ প্যারীচাঁদ মাদাম ব্লাভ্টুস্কির চরণোপ্রান্তে নত হতেও চেয়েছিলেন, “That most oxalted lady Madame Blavtsky, at whose feet I feel inclined to Angel down with getetal tears.” অবশ্য সেদিন তখনও মাদাম কলকাতায় উপস্থিত হতে পারেন নি, এই সভানুষ্ঠানের পাঁচদিন পরে কলকাতায় হাজির হন।
- শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্যারীচাঁদ মিত্র’ এবং প্যারীচাঁদের গ্রন্থের ভূমিকা থেকে তাঁর জীবনী-সংক্রান্ত তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।