» » আমার নিবেদন

বর্ণাকার

“বিদ্যাসাগরের” তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইল। আমার কোন কোন বন্ধু বলেন যে, “বিদ্যাসাগরে”র আরও বেশী সংস্করণ হওয়া উচিত ছিল। আমার লেখার গুণে নহে, বিদ্যাসাগরের নামের গুণে। ইহার আরও বেশী সংস্করণ দেখিয়া যাইব, আমারও এইরূপ আশা ছিল; কিন্তু আশা ফলবতী হয় নাই। তবে দেশে পাঠকবৃন্দের যেরূপ অবস্থা, তাহা ভাবিলে এই যে তৃতীয় সংস্করণ হইল, ইহাকেই আমার ও আমার দেশের সৌভাগ্য বলিয়া মানি।

তৃতীয় সংস্করণ আরও কিছু পূর্ব্বে প্রকাশিত হইবার কথা ছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার শারীরিক অবস্থা সে পক্ষে কক্ত কটা পরিপন্থী হইয়া দাঁড়ায়। এই সংস্করণে অনেক জ্ঞাতব্য নুতন বিষয় সংযোজিত করিবার ইচ্ছা ছিল। কতক কতক নূতন বিষয় সংযোজিত হইয়াছে। তাহা বোধ হয়, পাঠকদিগের পক্ষে অপাঠ্য হইবে না, এমন ভরসা আছে। তবে, যতগুলি বিষয় সংগ্রহ করিবার সঙ্কল্প ছিল, শারীরিক অপটুতাবশতঃ তাহা করিতে পারি নাই। যদি ভগবৎকৃপায় ইহার চতুর্থ সংস্করণ দেখিয়া যাইবার সৌভাগ্য আমার ঘটে, তাহা হইলে, মনের বাসনা অপূর্ণ না থাকিলেও থাকিতে পারে।

দেশের অবস্থা বুঝিলে বুঝিতে হয় যে বাঙ্গালা-পাঠকের নিকট “বিদ্যাসাগরে”র কতকটা আদর হইয়াছে। ইহা বিদ্যাসাগরের নামগুণের পরিচায়ক। ইহা যাঁহার জীবনী, হৃদয়ে তাঁহার স্মৃতি জাগাইয়া, তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করিলাম। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনাস্তে তাঁহার গুণগ্রামস্মৃতির উন্মেষণায় অনেকে অনেক ভাবে আলোচনা করিয়াছিলেন। এতৎসম্বন্ধে পরলোকগত রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়, শ্রীযুক্ত সুবলচন্দ্র মিত্রের রচিত মনোজ্ঞ ইংরেজী “বিদ্যাসাগর চরিতে”র যে সুচনাপত্র লিখিয়াছেন, তাহা যেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গুণগ্রাম চিত্রপটে জীবন্তভাবে পূর্ণাঙ্কিত করিয়া তুলিয়াছে। পরিশিষ্টে তাহার ভাষানুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে। কলিকাতা টাকশালের ভূতপূর্ব্ব দেওয়ান সুধী সুবিদ্বান সঙ্গীতশাস্ত্রজ্ঞ রায় শ্রীযুক্ত বৈকুণ্ঠনাথ বসু বাহাদুর বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্বন্ধে যে কয়টী কথা আমায় লিখিয়া পঠাইয়াছেন এবং সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক সুলেখক শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ মহাশয় তাহার সম্বন্ধে যাহা আলোচনা করিয়াছেন, তাহ সর্ব্বজনের সুখপাঠ্য হইবে ভাবিয়া পরিশিষ্টে প্রকাশ করিলাম। ইহাতে বিদ্যাসাগর-জীবনের অনেক জ্ঞাতব্য বিষযের আলোচনা আছে। ইঁহারা কৃতী, যশস্বী, সুধী, সুলেখক। ইঁহাদিগের প্রতি যথাযোগ্য কৃতজ্ঞতা দেখাইবার ভাষা আমি অকৃতী লেখক কোথায় পাইব?

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সমকালে যে সকল শক্তিশালী ব্যক্তি নানাকারণে তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ ছিলেন, তাঁহাদের অনেকের এবং তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না, অথচ বাঙ্গালা সাহিত্যের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধসূত্রে জড়িত ছিলেন, এমন কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত জীবন-কথা পরিশিষ্টে সন্নিবেশিত হইয়াছে। ইহার জন্য বহু গ্রন্থ-প্রণেতা, ‘সাহিত্য সংহিতা’র সুযোগ্য সম্পাদক, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ইংরেজী জীবন-চরিত-লেখক, আমার প্রীতিভাজন সুহৃৎ স্ত্রীযুক্ত সুবলচন্দ্র মিত্রের নিকট আমি ঋণী। এই সকল শক্তিশালী ব্যক্তির মধ্যে অনেকের জীবন-কথা তাহার সঙ্কলিত ও সাহিত্যে সম্যক্ সমাদৃত “সরল বাঙ্গালা অভিধান” পুস্তকে প্রকাশিত হইয়াছে। আমি অনেকের জীবনকথা সেই অভিধান হইতে সংগ্রহ করিয়াছি। শ্রী সুবলচন্দ্র এই তৃতীয় সংস্করণের আদ্যন্ত প্রুফ দেখিয়া এবং অবশ্যকমত ভাষাদির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া আমাকে যদি সাহায্য না করিতেন, তাহা হইলে এই সংস্করণ বোধ হয়, আমার ইহজীবনে সাধ্যের সীমাবহির্ভূত হইয়া পড়িত।

এবার মুদ্রাঙ্কণের পরিপাটী সাধনসম্বন্ধে সাধ্যানুসারে প্রয়াস পাইয়াছি; কতকটা সফল হইয়াছি বলিয়া মনে হয়; তবে ঠিক মনের মতনটা যে হইয়াছে, এমন বলিতে পারিব না; যাহা হইয়াছে, তাহা পাঠকের যে একান্ত অপ্রীতিকর হইবে না, এ ভরসা করিতে পারি। এবারও দুই-চারিটি ভুলভ্রান্তি আছে। ভুলভ্রান্তি লইয়া সংসারে আসিয়াছি,ভুলভ্রান্তি লইয়া যাইতে হবে। কবে— কোথায় কে বা কি নির্ভুল হইয়াছে? তবে এটা ঠিক, “ভবতি বিজ্ঞতমঃ ক্রমশো জনঃ।” আমি অবশ্য “বিজ্ঞতমে”র তম রাখিতে পারি না, তবে যদি ইহার পুনঃসংস্করণ এ জীবনে সংঘটিত হয়, তাহা হইলে ভুলভ্রান্তি সম্বন্ধে মানুষের পক্ষে সাবধান হওয়া যতটুকু সম্ভব বা সাধ্য, তৎপক্ষে যত্নশীল হইতে ত্রুটি করিব না, এখন ইহাই মাত্র বলিয়া রাখিতে পারি। কেহ ইহার ভুল-ভ্রান্তি দেখাইয়া দিলে বা বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে কোন তথ্যের উল্লেখ করিয়া পাঠাইলে, তাহার জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, শুধু আমার জীবনে নহে, আমার বংশানুক্রমিক জীবনে অনুলিপ্ত হইয়া রহিবে। এখন সুধী পাঠকবর্গ আমার “বিদ্যাসাগর” পাঠ করিলে, আমি কৃতার্থ হইব।

শ্রীবিহারীলাল সরকার।