প্রথম খণ্ড
- প্রথম খণ্ড : উপক্রমণিকা
- প্রথম পরিচ্ছেদ—গ্রন্থের উদ্দেশ্য
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণের চরিত্র কিরূপ ছিল, তাহা জানিবার উপায় কি?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ—মহাভারতের ঐতিহাসিকতা
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ—মহাভারতের ঐতিহাসিকতা
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ—কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কবে হইয়াছিল
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ—পাণ্ডবদিগের ঐতিহাসিকতা
- সপ্তম পরিচ্ছেদ—পাণ্ডবদিগের ঐতিহাসিকতা
- অষ্টম পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা
- নবম পরিচ্ছেদ—মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত
- দশম পরিচ্ছেদ—প্রক্ষিপ্তনির্বাচনপ্রণালী
- একাদশ পরিচ্ছেদ—নির্বাচনের ফল
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ—অনৈসর্গিক বা অতিপ্রকৃত
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ—ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়া কি সম্ভব?
- চতুর্দশ পরিচ্ছেদ—পুরাণ
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ—পুরাণ
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ—হরিবংশ
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ—ইতিহাসাদির পৌর্বাপর্য
দ্বিতীয় খণ্ড
- দ্বিতীয় খণ্ড
- প্রথম পরিচ্ছেদ—যদুবংশ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণের জন্ম
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ—শৈশব
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ—কৈশোর লীলা
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ—ব্রজগোপী-বিষ্ণুপুরাণ
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ—ব্রজগোপী-হরিবংশ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ—ব্রজ গোপী-ভাগবত-বস্ত্রহরণ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ—ব্রজগোপী-ভাগবত
- নবম পরিচ্ছেদ—ব্রজগোপী-ভাগবত
- দশম পরিচ্ছেদ—শ্রীরাধা
- একাদশ পরিচ্ছেদ—বৃন্দাবনলীলার পরিসমাপ্তি
চতুর্থ খণ্ড
- চতুর্থ খণ্ড
- প্রথম পরিচ্ছেদ—দ্রৌপদীস্বয়ংবর
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির-সংবাদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ—সুভদ্রাহরণ
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ—খাণ্ডবদাহ
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণের মানবিকতা
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ—জরাসন্ধবধের পরামর্শ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণ-জরাসন্ধ-সংবাদ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ—ভীম-জরাসন্ধের যুদ্ধ
- নবম পরিচ্ছেদ—অর্ঘাভিহরণ
- দশম পরিচ্ছেদ—শিশুপালবধ
- একাদশ পরিচ্ছেদ—পাণ্ডবের বনবাস
ষষ্ঠ খণ্ড
- ষষ্ঠ খণ্ড
- প্রথম পরিচ্ছেদ—ভীষ্মের যুদ্ধ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ—জয়দ্রথবধ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ—দ্বিতীয় স্তরের কবি
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ—ঘটোৎকচবধ
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ—দ্রোণবধ
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণকথিত ধর্মতত্ত্ব
- সপ্তম পরিচ্ছেদ—কর্ণবধ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ—দুর্যোধনবধ
- নবম পরিচ্ছেদ—যুদ্ধশেষ
- দশম পরিচ্ছেদ—বিধি সংস্থাপন
- একাদশ পরিচ্ছেদ—কামগীতা
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণপ্রয়াণ
দ্রৌপদীস্বয়ংবরের পর, সুভদ্রাহরণে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাই। সুভদ্রার বিবাহে কৃষ্ণ যাহা করিয়াছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর নীতিজ্ঞেরা তাহা বড় পছন্দ করিবেন না। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর নীতিশাস্ত্রের উপর, একটা জগদীশ্বরের নীতিশাস্ত্র আছে— তাহা সকল শতাব্দীতে, সকল দেশে খাটিয়া থাকে। কৃষ্ণ যাহা করিয়াছিলেন, তাহা আমরা সেই চিরস্থায়ী অভ্রান্ত জাগতিক নীতির দ্বারাই পরীক্ষা করিব। এ দেশে অনেকেই একব্বরি গজের মাপে লাখেরাজ বা জোত জমা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন; জমীদারেরা এখনকার ছোট সরকারি গজে মাপিয়া তাহাদিগের অনেক ভূমি কাড়িয়া লইয়াছে। তেমনি ঊনবিংশ শতাব্দীর যে ছোট মাপকাটি হইয়াছে, তাহার জ্বালায় আমরা ঐতিহাসিক পৈতৃক সম্পত্তি সকলই হারাইতেছি, ইহা অনেক বার বলিয়াছি। আমরা এক্ষণে সেই একব্বরি গজ চালাইব।
কৃষ্ণভক্তেরা বলিতে পারেন, এরূপ একটা বিচারে প্রবৃত্ত হইবার আগে, স্থির কর যে, এই সুভদ্রাহরণবৃত্তান্ত মূল মহাভারতের অন্তর্গত, কি প্রক্ষিপ্ত। যদি ইহা প্রক্ষিপ্ত এবং আধুনিক বলিয়া বোধ করিবার কোন কারণ থাকে, তবে সেই কথা বলিলেই সব গোল মিটিল—এত বাগাড়ম্বরের প্রয়োজন নাই। অতএব আমরা বলিতে বাধ্য যে, সুভদ্রাহরণ যে মূল মহাভারতের অংশ, ইহা যে প্রথম স্তরের অন্তর্গত, তদ্বিষয়ে আমাদের কোন সংশয় নাই। ইহার প্রসঙ্গ অনুক্রমণিকাধ্যায়ে এবং পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে আছে। ইহার রচনা অতি উচ্চশ্রেণীর কবির রচনা। দ্বিতীয় স্তরের রচনাও সচরাচর অতি সুন্দর। তবে প্রথম স্তর ও দ্বিতীয় স্তরে রচনাগত একটা প্রভেদ এই যে, প্রথম স্তরের রচনা সরল ও স্বাভাবিক দ্বিতীয় স্তরের রচনায় অলঙ্কার ও অত্যুক্তির বড় বাহুল্য। সুভদ্রাহরণের রচনাও সরল ও স্বাভাবিক, অলঙ্কার ও অত্যুক্তির তেমন বাহুল্য নাই। সুতরাং ইহা প্রথমস্তর-গত—দ্বিতীয় স্তরের নহে। আর আসল কথা এই যে, সুভদ্রাহরণ মহাভারত হইতে তুলিয়া লইলে, মহাভারত অসম্পূর্ণ হয়। সুভদ্রা হইতে অভিমন্যু, অভিমন্যু হইতে পরিক্ষিৎ, পরিক্ষিৎ হইতে জনমেজয়। ভদ্রার্জুনের বংশই বহু শতাব্দী ধরিয়া ভারতে সাম্রাজ্য শাসিত করিয়াছিল— দ্রৌপদীর বংশ নহে। বরং দ্রৌপদীস্বয়ংবর বাদ দেওয়া যায়, তবু সুভদ্রা নয়।
দ্রৌপদীর ন্যায় সুভদ্রাকেও সাহেবরা উড়াইয়া দিয়াছেন। লাসেন্ বলেন,—যাদবসম্প্রীতিরূপ যে মঙ্গল, তাহাই সুভদ্রা। বেবর সাহেবের আপত্তি ইহার অপেক্ষা গুরুতর। তিনি কেন কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রার মানবীত্ব অস্বীকৃত করেন, তজ্জন্য যজুর্বেদের মাধ্যন্দিনীশাখা ২৩ অধ্যায়ের ১৮ কণ্ডিকার ৪র্থ মন্ত্রটি উদ্ধৃত করিতে হইতেছে।
“হে অম্বে! হে অম্বিকে! হে অম্বালিকে! দেখ, এই অশ্ব এক্ষণে চিরকালের জন্য নিদ্রিত হইয়াছে, আমি কাম্পিলাবাসিনী সুভদ্রা হইয়াও স্বয়ং ইহার সমীপে (পতীত্বে বরণ করণার্থ) সমাগত হইয়াছি, এ বিষয়ে আমাকে কেহই নিয়োগ করে নাই।”[1]
“Kampila is a town in the country of the Panchalas. Subhadra, therefore, would seem to be the wife of the King of that district.” &c.
সায়নাচার্য কাম্পিলবাসিনীর এইরূপ অর্থ করেন— “কাম্পিলশব্দেন শ্ল্যাঘ্যো বস্ত্রবিশেষ উচ্যতে” কিন্তু বেবর সাহেবের বিশ্বাস যে, তিনি সায়নাচার্যের অপেক্ষা সংস্কৃত বুঝেন ভাল, অতএব তিনি এ ব্যাখ্যা গ্রাহ্য করেন না, তাহা না-ই করুন, কিন্তু কাম্পিলবাসিনী কোন স্ত্রীর নাম সুভদ্রা ছিল বলিয়া কৃষ্ণভগিনীর নাম কেন সুভদ্রা হইতে পারে না, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। যে রাজাই অশ্বমেধ যজ্ঞ করুন, তাঁহারই মহিষীকে এই মন্ত্র পাঠ করিতে হইবে, তাঁহাকেই বলিতে হইবে, ৺“আমি কাম্পিলবাসিনী সুভদ্রা”। সুভদ্রা শব্দে সামশ্রয়ী মহাশয় এই অর্থ করেন,—কল্যাণী অর্থাৎ সৌভাগ্যবতী। মহীধর বলেন,—কাম্পিলনগরীর মহিলাগণ অতিশয় রূপলাবণ্যবতী। অতএব এই মন্ত্রের অর্থ এই যে, “আমি সৌভাগ্যবতী ও রূপলাবণ্যবতী হইয়াও এই অশ্বের নিকট সমাগত হইয়াছি।” অতএব বুঝিতে পারি না যে, এই মন্ত্রের বলে কৃষ্ণভগিনী অর্জুনপত্নী সুভদ্রার পরিবর্তে কেন একজন পাঞ্চালী সুভদ্রাকে কল্পনা করিতে হইবে। যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার বহুপূর্ববর্তী রাজগণও অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়াছিলেন, ইহাই মহাভারতে এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। অতএব ইহাই সম্ভব যে, অশ্বমেধ যজ্ঞের এই যজুর্মন্ত্র কৃষ্ণ-পাণ্ডবের অপেক্ষা প্রাচীন। এখন যেমন লোকে আধুনিক লেখকদিগের কাব্যগ্রন্থ হইতে পুত্রকন্যার নামকরণ করিতেছে,[2] তেমনি সে কালেও বেদ হইতে লোকের পুত্রকন্যার নাম রাখা অসম্ভব নহে। এই মন্ত্র হইতেই কাশিরাজ আপনার তিনটি কন্যার নাম অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা রাখিয়া থাকিবেন, এবং এইরূপেই কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রারও নামকরণ হইয়া থাকিবে। এই মন্ত্রে এমন কিছু দেখি না যে, তজ্জন্য কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা কেহ ছিলেন না, এমন কথা অনুমান করা যায়। অতএব আমরা সুভদ্রাহরণের বিচারে প্রবৃত্ত হইব।
এক্ষণে, সুভদ্রাহরণের নৈতিক বিচারে প্রবৃত্ত হইবার আগে পাঠকের নিকট একটা অনুরোধ আছে। তিনি কাশীদাসের গ্রন্থে অথবা কথকের নিকট, অথবা পিতামহীর মুখে, অথবা বাঙ্গালা নাটকাদিতে যে সুভদ্রাহরণ পড়িয়াছেন বা শুনিয়াছেন, তাহা অনুগ্রহপূর্বক ভুলিয়া যাউন। অর্জুনকে দেখিয়া সুভদ্রা অনঙ্গশরে ব্যথিত হইয়া উন্মত্ত হইলেন, সত্যভামা মধ্যবর্তিনী দূতী হইলেন, অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করিয়া লইয়া গেলে যাদবসেনার সঙ্গে তাঁর ঘোরতর যুদ্ধ হইল, সুভদ্রা তাঁহার সারথি হইয়া গগনমার্গে তাঁহার রথ চালাইতে লাগিলেন— সে সকল কথা ভুলিয়া যান। এ সকল অতি মনোহর কাহিনী বটে, কিন্তু মূল মহাভারতে ইহার কিছুই নাই। ইহা কাশীরাম দাসের গ্রন্থেই প্রথম দেখিতে পাই, কিন্তু এ সকল তাঁহার সৃষ্টি কি তাঁহার পরবর্তী কথকদিগের সৃষ্টি, তাহা বলা যায় না। সংস্কৃত মহাভারতে যে প্রকার সুভদ্রাহরণ কথিত হইয়াছে, তাহার স্থূলমর্ম বলিতেছি।
দ্রৌপদীর বিবাহের পর পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থে সুখে রাজ্য করিতেছিলেন, কোন কারণে অর্জুন দ্বাদশ বৎসরের জন্য ইন্দ্রপ্রস্থ পরিত্যাগপূর্বক বিদেশে ভ্রমণ করেন। অন্যান্য দেশপর্যটনানন্তর শেষে তিনি দ্বারকায় উপস্থিত হয়েন। তথায় যাদবেরা তাঁহার বিশেষ সমাদর ও সৎকার করেন। অর্জুন কিছু দিন সেখানে অবস্থিতি করেন। একদা যাদবেরা রৈবতক পর্বতে একটা মহান্ উৎসব আরম্ভ করেন। সেখানে যদুবীরেরা ও যদুকুলাঙ্গনাগণ সকলেই উপস্থিত হইয়া আমোদ আহ্লাদ করেন। অন্যান্য স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে সুভদ্রাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি কুমারী ও বালিকা। অর্জুন তাঁহাকে দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন। কৃষ্ণ তাহা জানিতে পারিয়া অর্জুনকে বলিলেন, “সখে! বনচর হইয়াও অনঙ্গশরে চঞ্চল হইলে?” অর্জুন অপরাধ স্বীকার করিয়া, সুভদ্রা যাহাতে তাঁহার মহিষী হন, তদ্বিষয়ে কৃষ্ণের পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। কৃষ্ণ যে পরামর্শ দিলেন তাহা এই :—
হে অর্জুন! স্বয়ংবরই ক্ষত্রিয়দিগের বিধেয়, কিন্তু স্ত্রীলোকের প্রবৃত্তির কথা কিছুই বলা যায় না, সুতরাং তদ্বিষয়ে আমার সংশয় জন্মিতেছে। আর ধর্মশাস্ত্রকারেরা কহেন, বিবাহোদ্দেশে বলপূর্বক হরণ করাও মহাবীর ক্ষত্রিয়দিগের প্রশংসনীয়। অতএব স্বয়ংবরকালে উপস্থিত হইলে তুমি আমার ভগিনীকে বলপূর্বক হরণ করিয়া লইয়া যাইবে; কারণ, স্বয়ংবরকালে সে কাহার প্রতি অনুরক্ত হইবে, কে বলিতে পারে?”
এই পরামর্শের অনুবর্তী হইয়া অর্জুন প্রথমতঃ যুধিষ্ঠির ও কুন্তীর অনুমতি আনিতে দূত প্রেরণ করেন। তাঁহাদিগের অনুমতি পাইলে, একদা, সুভদ্রা যখন রৈবতক পর্বতকে প্রদক্ষিণ করিয়া দ্বারকাভিমুখে যাত্রা করিতেছিলেন, তখন তাঁহাকে বলপূর্বক গ্রহণ করিয়া রথে তুলিয়া অর্জুন প্রস্থান করিলেন।
এখন, আজিকালিকার দিনে যদি কেহ বিবাহোদ্দেশে কাহারও মেয়ে বলপূর্বক কাড়িয়া লইয়া প্রস্থান করে, তবে সে সমাজে নিন্দিত এবং রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইবার যোগ্য সন্দেহ নাই। এবং এখনকার দিনে কেহ যদি অপর কাহাকে বলে, “মহাশয়! যখন আমার ভগিনীকে বিবাহ করিতে আপনার ইচ্ছা হইয়াছে, তখন আপনি উহাকে কাড়িয়া লইয়া পলায়ন করুন, ইহাই আমার পরামর্শ”, তবে সে ব্যক্তিও জনসমাজে নিন্দনীয় হইবে, তাহার সন্দেহ নাই। অতএব প্রচলিত নীতিশাস্ত্রানুসারে (সে নীতিশাস্ত্রের কিছুমাত্র দোষ দিতেছি না,) কৃষ্ণার্জুন উভয়েই অতিশয় নিন্দনীয় কার্য করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। লোকের চক্ষে ধূলা দিয়া কৃষ্ণকে বাড়ান যদি আমার উদ্দেশ্য হইত, তবে সুভদ্রাহরণপর্বাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত বলিয়া, কিম্বা এমনই একটা কিছু জুয়াচুরি করিয়া, এ কথাটা বাদ দিয়া যাইতাম। কিন্তু সে সকল পথ আমার অবলম্বনীয় নহে। সত্য ভিন্ন মিথ্যা প্রশংসায়, কাহারও মহিমা বাড়িতে পারে না এবং ধর্মের অবনতি ভিন্ন উন্নতি হয় না।
কিন্তু কথাটা একটু তলাইয়া বুঝিতে হইবে। কেহ কাহারও মেয়ে কাড়িয়া লইয়া গিয়া বিবাহ করিলে, সেটা দোষ বলিয়া গণিতে হয় কেন? তিন কারণে। প্রথমতঃ, অপহৃতা কন্যার উপর অত্যাচার হয়। দ্বিতীয়তঃ কন্যার পিতা মাতা ও বন্ধুবর্গের উপর অত্যাচার। তৃতীয়তঃ সমাজের উপর অত্যাচার। সমাজরক্ষার মূলসূত্র এই যে, কেহ কাহারও উপর অবৈধ বলপ্রয়োগ করিতে পারিবে না। কেহ কাহারও উপর অবৈধ বলপ্রয়োগ করিলেই সমাজের স্থিতির উপর আঘাত করা হইল। বিবাহার্থিকৃত কন্যাহরণকে নিন্দনীয় কার্য বিবেচনা করিবার এই তিনটি গুরুতর কারণ বটে, কিন্তু তদ্ভিন্ন আর চতুর্থ কারণ কিছু নাই।
এখন দেখা যাউক, কৃষ্ণের এই কাজে এই তিন জনের মধ্যে কে কতদূর অত্যাচার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। প্রথমতঃ, অপহৃতা কন্যার উপর কতদূর অত্যাচার হইয়াছিল দেখা যাক। কৃষ্ণ তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং বংশের শ্রেষ্ঠ। যাহাতে সুভদ্রার সর্বতোভাবে মঙ্গল হয়, তাহাই তাঁহার কর্তব্য— তাহাই তাঁহার ধর্ম—ঊনবিংশ শতাব্দীর ভাষায় তাহাই তাঁহার “Duty” এখন স্ত্রীলোকের পক্ষে প্রধান মঙ্গল— সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল বলিলেও হয়— সৎপাত্রস্থ হওয়া। অতএব সুভদ্রার প্রতি কৃষ্ণের প্রধান “ডিউটি”— তিনি যাহাতে সৎপাত্রস্থা হয়েন, তাহাই করা। এখন, অর্জুনের ন্যায় সৎপাত্র কৃষ্ণের পরিচিতি ব্যক্তিদিগের মধ্যে ছিল না, ইহা বোধ হয় মহাভারতের পাঠকদিগের নিকট কষ্ট পাইয়া প্রমাণ করিতে হইবে না। অতএব তিনি যাহাতে অর্জুনের পত্নী হইবেন, ইহাই সুভদ্রার মঙ্গলার্থ কৃষ্ণের করা কর্তব্য। তাঁহার যে উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতেই তিনি দেখাইয়াছেন, বলপূর্বক হরণ ভিন্ন অন্য কোন প্রকারে এই কর্তব্য সাধন হইতে পারিত কিনা, তাহা সন্দেহস্থল। যেখানে ভাবিফল চিরজীবনের মঙ্গল, সেখানে যে পথে সন্দেহ, সে পথে যাইতে নাই। যে পথে মঙ্গলসিদ্ধি নিশ্চিত, সেই পথেই যাইতে হয়। অতএব কৃষ্ণ, সুভদ্রার চিরজীবনের পরম শুভ সুনিশ্চিত করিয়া দিয়া, তাহার প্রতি পরম ধর্মানুমত কার্যই করিয়াছিলেন— তাহার প্রতি কোন অত্যাচার করেন নাই।
এ কথার প্রতি দুইটি আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে। প্রথম আপত্তি এই যে, আমার যে কাজে ইচ্ছা নাই, সে কাজ আমার পক্ষে মঙ্গলকর হইলেও, আমার উপর বলপ্রয়োগ করিয়া সে কার্যে প্রবৃত্ত করিবার কাহারও অধিকার নাই। পুরোহিত মহাশয় মনে করেন যে, আমি যদি আমার সর্বস্ব ব্রাহ্মণকে দান করি, তবে আমার পরম মঙ্গল হইবে। কিন্তু তাঁহার এমন কোন অধিকার নাই যে, আমাকে মারপিট করিয়া সর্বস্ব ব্রাহ্মণকে দান করান। শুভ উদ্দেশ্যের সাধন জন্য নিন্দনীয় উপায় অবলম্বন করাও নিন্দনীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর ভাষায় ইহার অনুবাদ এই যে, “The end does not sanctify the means.”
এ কথার দুইটি উত্তর আছে। প্রথম উত্তর এই যে, সুভদ্রার যে অর্জুনের প্রতি অনিচ্ছা বা বিরক্তি ছিল, এমত কিছুই প্রকাশ নাই। ইচ্ছা অনিচ্ছা কিছুই প্রকাশ নাই। প্রকাশ থাকিবার সম্ভাবনা বড় অল্প। হিন্দুর ঘরের কন্যা— কুমারী এবং বালিকা—পাত্রবিশেষের প্রতি ইচ্ছা বা অনিচ্ছা বড় প্রকাশ করে না। বাস্তবিক, তাহাদের মনেও বোধ হয়, পাত্রবিশেষের প্রতি ইচ্ছা অনিচ্ছা বড় জন্মেও না, তবে ধেড়ে মেয়ে ঘরে পুষিয়া রাখিলে জন্মিতে পারে। এখন, যদি কোন কাজে আমার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কিছুই নাই থাকে, যদি সেই কাজ আমার পক্ষে পরম মঙ্গলকর হয়, আর কেবল বিশেষ প্রবৃত্তির অভাবে বা লজ্জাবশতঃ বা উপায়াভাববশতঃ আমি সে কার্য স্বয়ং করিতেছি না, এমন হয়, আর যদি আমার উপর একটু বলপ্রয়োগের ভাণ করিলে সেই পরম মঙ্গলকর কার্য সুসিদ্ধ হয়, তবে সে বলপ্রয়োগ কি অধর্ম? মনে কর, একজন বড় ঘরের ছেলে দুরবস্থায় পড়িয়াছে, তোমার কাছে একটি চাকরি পাইলে খাইয়া বাঁচে, কিন্তু বড় ঘর বলিয়া তাহাতে তেমন ইচ্ছা নাই, কিন্তু তুমি তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া চাকরিতে বসাইয়া দিলে আপত্তি করিবে না, বরং সপরিবারে খাইয়া বাঁচিবে। সে স্থলে তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া দুটো ধমক দিয়া তাহাকে দফ্তরখানাতে বসাইয়া দেওয়া কি তোমার অধর্মাচরণ বা পীড়ন করা হইবে? সুভদ্রার অবস্থাও ঠিক তাই। হিন্দুর ঘরের কুমারী মেয়ে, বুঝাইয়া বলিলে, কি “এসো গো” বলিয়া ডাকিলে, বরের সঙ্গে যাইবে না। কাজেই ধরিয়া লইয়া যাওয়ার ভাণ ভিন্ন তাহার মঙ্গলসাধনের উপায়ান্তর ছিল না।
“আমার যে কাজে ইচ্ছা নাই, সে কাজ আমার পক্ষে পরম মঙ্গলকর হইলেও, আমার প্রতি বলপ্রয়োগ করিয়া সে কাজে প্রবৃত্ত করিবার কাহারও অধিকার নাই।” এই আপত্তির দুইটি উত্তর আছে, আমরা বলিয়াছি। প্রথম উত্তর, উপরে বুঝাইলাম। প্রথম উত্তরে আমরা ঐ আপত্তির কথাটা যথার্থ বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়া উত্তর দিয়াছি। দ্বিতীয় উত্তর এই যে, কথাটা সকল সময়ে যথার্থ নয়। যে কার্যে আমার পরম মঙ্গল, সে কার্যে আমার অনিচ্ছা থাকিলেও বলপ্রয়োগ করিয়া আমাকে তাহাতে প্রবৃত্ত করিতে যে কাহারও অধিকার নাই, এ কথা সকল সময়ে খাটে না। যে রোগীর রোগপ্রভাবে প্রাণ যায়, কিন্তু ঔষধে রোগীর স্বভাবসুলভ বিরাগবশতঃ সে ঔষধ খাইবে না, তাহাকে বলপূর্বক ঔষধ খাওয়াইতে চিকিৎসকের এবং বন্ধুবর্গের অধিকার আছে। সাংঘাতিক বিস্ফোটক সে ইচ্ছাপূর্বক কাটাইবে না— জোর করিয়া কাটিবার ডাক্তারের অধিকার আছে। ছেলে লেখাপড়া শিখিবে না, জোর করিয়া লেখাপড়া শিখাইবার অধিকার শিক্ষক ও পিতা মাতা প্রভৃতির আছে। এই বিবাহের কথাতেই দেখ, অপ্রাপ্তবয়ঃ কুমার কি কুমারী যদি অনুচিত বিবাহে উদ্যত হয়, বলপূর্বক তাহাকে নিবৃত্ত করিতে কি পিতা মাতার অধিকার নাই? আজিও সভ্য ইউরোপীয় জাতিদিগের মধ্যে কন্যার বিবাহে জোর করিয়া সৎপাত্রে কন্যাদান করার প্রথা আছে। যদি পনের বৎসরের কোন হিন্দুর মেয়ে কোন সুপাত্রে আপত্তি উপস্থিত করে, তবে কোন্ পিতা মাতা জোর করিয়া তাহাকে সৎপাত্রস্থ করিতে আপত্তি করিবেন? জোর করিয়া বালিকা কন্যা সৎপাত্রস্থ করিলে তিনি কি নিন্দনীয় হইবেন? যদি না হন, তবে সুভদ্রাহরণে কৃষ্ণের অনুমতি নিন্দনীয় কেন?
এই গেল প্রথম আপত্তির দুই উত্তর। এখন দ্বিতীয় আপত্তির বিচারে প্রবৃত্ত হই।
দ্বিতীয় আপত্তি এই হইতে পারে যে, ভাল, স্বীকার করা গেল যে, কৃষ্ণ সুভদ্রার মঙ্গলকামনা করিয়াই, এই পরামর্শ দিয়াছিলেন— কিন্তু বলপূর্বক হরণ ভিন্ন কি তাঁহাকে অর্জুনমহিষী করিবার জন্য অন্য উপায় ছিল না? স্বয়াম্বরে যেন ভয় ছিল, যেন মূঢ়মতি বালিকা কেবল মুখ দেখিয়া ভুলিয়া গিয়া কোন অপাত্রে বরমাল্য দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু উপায়ান্তর কি ছিল না? কৃষ্ণ কি অর্জুন বাসুদেব প্রভৃতি কর্তৃপক্ষের কাছে কথা পাড়িয়া রীতিমত সম্বন্ধ স্থির করিয়া তাঁহাদিগকে বিবাহে সম্মত করিয়া কন্যা সম্প্রদান করাইতে পারিতেন। যাদবেরা কৃষ্ণের বশীভূত; কেহই তাঁহার কথায় অমত করিত না। এবং অর্জুন সুপাত্র, কেহই আপত্তি করিত না, তবে না হইল কেন?
এখনকার দিনকাল হইলে, এ কাজ সহজে হইত। কিন্তু ভদ্রার্জুনের বিবাহ চারি হাজার বৎসর পূর্বে ঘটিয়াছিল, তখনকার বিবাহপ্রথা এখনকার বিবাহপ্রথার মত ছিল না, সেই বিবাহপ্রথা না বুঝিলে কৃষ্ণের আদর্শ বুদ্ধি ও আদর্শ প্রীতি আমরা সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিব না।
মনুতে আছে, বিবাহ অষ্টবিধ, (১) ব্রাহ্ম, (২) দৈব, (৩) আর্য, (৪) প্রাজাপত্য, (৫) আসুর, (৬) গান্ধর্ব, (৭) রাক্ষস ও (৮) পৈশাচ। এই ক্রমান্বয়টা পাঠক মনে রাখিবেন।
এই অষ্টপ্রকার বিবাহে সকল বর্ণের অধিকার নাই। ক্ষত্রিয়ের কোন্ কোন্ বিবাহে অধিকার, দেখা যাউক। তৃতীয় অধ্যায়ের ২৩ শ্লোকে কথিত হইয়াছে,
ষড়ানুপূর্ব্যা বিপ্রস্য ক্ষত্রস্য চতুরোহ বরান্।
ইহার টীকায় কুল্লূটভট্ট লেখেন, “ক্ষত্রিয়স্য অবরানুপরিতনানাসুরাদীংশ্চতুরঃ।” তবেই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে, কেবল আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস, ও পৈশাচ, এই চারি প্রকার বিবাহ বৈধ। আর সকল অবৈধ।
কিন্তু ২৫ শ্লোকে আছে—
পৈশাচশ্চাসুরশ্চৈব ন কর্তব্যৌ কদাচন||
পৈশাচ ও আসুর বিবাহ সকলেরই অকর্তব্য। অতএব ক্ষত্রিয় পক্ষে কেবল গান্ধর্ব ও রাক্ষস, এই দ্বিবিধ বিবাহই বিহিত রহিল।
তন্মধ্যে, বরকন্যার উভয়ে পরস্পর অনুরাগ সহকারে যে বিবাহ হয়, তাহাই গান্ধর্ব বিবাহ। এখানে সুভদ্রার অনুরাগ অভাবে সে বিবাহ অসম্ভব, এবং সেই বিবাহ “কামসম্ভব”, সুতরাং পরম নীতিজ্ঞ কৃষ্ণার্জুনের তাহা কখনও অনুমোদিত হইতে পারে না। অতএব রাক্ষস বিবাহ ভিন্ন অন্য কোন প্রকার বিবাহ শাস্ত্রানুসারে ধর্ম্য নহে ও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রশস্ত নহে; অন্য প্রকার বিবাহেরও সম্ভাবনা এখানে ছিল না। বলপূর্বক কন্যাকে হরণ করিয়া বিবাহ করাকে রাক্ষস বিবাহ বলে। বস্তুতঃ শাস্ত্রানুসারে এই রাক্ষস বিবাহই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে একমাত্র প্রশস্ত বিবাহ। মনুর ৩ অ, ২৪ শ্লোকে আছে—
চতুরো ব্রাহ্মণস্যাদ্যান্ প্রশস্তান্ কবয়ো বিদুঃ।
রাক্ষসং ক্ষত্রিয়স্যৈকমাসুরং বৈশ্যশূদ্রয়োঃ||
যে বিবাহ ধর্ম্য ও প্রশস্ত, আপনার ভগিনীর ও ভগিনীপতির গৌরবার্থ নিজকুলের গৌরবার্থ, কৃষ্ণ সেই বিবাহের পরামর্শ দিতে বাধ্য ছিলেন। অতএব কৃষ্ণ অর্জুনকে যে পরামর্শ দিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার পরম শাস্ত্রজ্ঞতা, নীতিজ্ঞতা, অভ্রান্তবুদ্ধি এবং সর্বপক্ষের মানসম্ভ্রম রক্ষার অভিপ্রায় ও হিতেচ্ছাই দেখা যায়।
কেহ কেহ বলিতে পারেন, এখানে মনুর দোহাই দিলে চলিবে না। মহাভারতের যুদ্ধের সময়ে মনুসংহিতা ছিল, ইহার প্রমাণ কি? কথা ন্যায্য বটে, তত প্রাচীনকালে মনুসংহিতা সঙ্কলিত হইয়াছিল কি না, সে বিষয়ে বাদ প্রতিবাদ হইতে পারে। তবে মনুসংহিতা পূর্বপ্রচলিত রীতি-নীতির সঙ্কলন মাত্র, ইহা পণ্ডিতদিগের মত। যদি তাহা হয়, তবে যুধিষ্ঠিরের রাজত্বকালে ঐরূপ বিবাহপদ্ধতি প্রচলিত ছিল, ইহা বিবেচনা করা যাইতে পারে। নাই পারুক—মহাভারতেই এ বিষয়ে কি আছে, তাহাই দেখা যাউক। এই সুভদ্রাহরণ-পর্বাধ্যায়েই সে বিষয়ে কি প্রমাণ পাওয়া যায়, দেখা যাউক। বড় বেশী খুঁজিত হইবে না। আমরা পাঠকদিগের নিকট যে উত্তর দিতেছি, কৃষ্ণ নিজেই সেই উত্তর বলদেবকে দিয়াছিলেন। অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, শুনিয়া যাদবেরা ক্রুদ্ধ হইয়া রণসজ্জা করিতেছিলেন। বলদেব বলিলেন, অত গণ্ডগোল করিবার আগে, কৃষ্ণ কি বলেন শুনা যাউক। তিনি চুপ করিয়া আছেন। তখন বলদেব কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া, অর্জুন তাঁহাদের বংশের অপমান করিয়াছে বলিয়া রাগ প্রকাশ করিলেন, এবং কৃষ্ণের অভিপ্রায় কি, জিজ্ঞাসা করিলেন। কৃষ্ণ উত্তর করিলেন—
“অর্জুন আমাদিগের কুলের অবমাননা করেন নাই, বরং সমধিক সম্মান রক্ষাই করিয়াছেন। তিনি তোমাদিগকে অর্থলুব্ধ মনে করেন না বলিয়া অর্থদ্বারা সুভদ্রাকে গ্রহণ করিতে চেষ্টাও করেন নাই। স্বয়ংবরে কন্যা লাভ করা অতীব দুরূহ ব্যাপার, এই জন্যই তাহাতে সম্মত হন নাই, এবং পিতা মাতার অনুমতি গ্রহণপূর্বক প্রদত্তা কন্যার পাণিগ্রহণ করা তেজস্বী ক্ষত্রিয়ের প্রশংসনীয় নহে। অতএব আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, কুন্তীপুত্র ধনঞ্জয় উক্ত দোষ সমস্ত পর্যালোচনা করিয়া বলপূর্বক সুভদ্রাকে হরণ করিয়াছেন। এই সম্বন্ধ আমাদের কুলোচিত হইয়াছে, এবং কুলশীল বিদ্যা ও বুদ্ধিসম্পন্ন পার্থ বলপূর্বক হরণ করিয়াছেন বলিয়া সুভদ্রাও যশস্বিনী হইবেন, সন্দেহ নাই।”
এখানে কৃষ্ণ ক্ষত্রিয়ের চারি প্রকার বিবাহের কথা বলিয়াছেন;—
১। অর্থ (বা শুল্ক) দিয়া বিবাহ করা যায় (আসুর)।
২। স্বয়ংবর
৩। পিতা মাতা কর্তৃক প্রদত্তা কন্যার সহিত বিবাহ (প্রাজাপত্য)।
৪। বলপূর্বক হরণ (রাক্ষস)।
ইহার মধ্যে প্রথমটিতে কন্যাকুলের অকীর্তি ও অযশ, ইহা সর্ববাদিসম্মত। দ্বিতীয়ের ফল অনিশ্চিত। তৃতীয়ে, বরের অগৌরব। কাজেই চতুর্থই এখানে একমাত্র বিহিত বিবাহ। ইহা কৃষ্ণোক্তিতেই প্রকাশ আছে।[3]
ভরসা করি, এমন নির্বোধ কেহই নাই যে, সিদ্ধান্ত করেন যে, আমি রাক্ষস বিবাহের পক্ষ সমর্থন করিতেছি। রাক্ষস বিবাহ অতি নিন্দনীয়, সে কথা বলিয়া স্থান নষ্ট করা নিষ্প্রয়োজন। তবে সে কালে যে ক্ষত্রিয়দিগের মধ্যে ইহা প্রশংসিত ছিল, কৃষ্ণ তাহার দায়ী নহেন। আমাদিগের মধ্যে অনেকের বিশ্বাস যে, “রিফর্মরই” আদর্শ মনুষ্য, এবং কৃষ্ণ যদি আদর্শ মনুষ্য, তবে মালাবারি ধরনের রিফর্মর্ হওয়াই তাঁহার উচিত ছিল, এবং এই কুপ্রথার প্রশ্রয় না দিয়া দমন করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা মালাবারি ঢংটাকে আদর্শ মনুষ্যের গুণের মধ্যে গণি না, সুতরাং এ কথার কোন উত্তর দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করি না।
আমরা বলিয়াছি যে, বলপূর্বক হরণ করিয়া যে বিবাহ, তাহা তিন কারণে নিন্দনীয়; (১) কন্যার প্রতি অত্যাচার, (২) তাহার পিতৃকুলের প্রতি অত্যাচার, (৩) সমাজের প্রতি অত্যাচার। কন্যার প্রতি যে কোন অত্যাচার হয় নাই, বরং তাহার পরম মঙ্গলই সাধিত হইয়াছিল, তাহা দেখাইয়াছি। এক্ষণে তাহার পিতৃকুলের প্রতি কোন অত্যাচার হইয়াছে কিনা, দেখা যাউক। কিন্তু আর স্থান নাই, সংক্ষেপে কথা শেষ করিতে হইবে। যাহা বলিয়াছি, তাহাতে সকল কথাই শেষ হইয়া আসিয়াছে।
কন্যাহরণে তৎপিতৃকুলের উপর দুই কারণে অত্যাচার ঘটে। (১) তাঁহাদিগের কন্যা অপাত্রে বা অনভিপ্রেত পাত্রে হস্তগত হয়। কিন্তু এখানে তাহা ঘটে নাই। অর্জুন অপাত্রও নহে, অনভিপ্রেত পাত্রও নহে। (২) তাঁহাদিগের নিজের অপমান। কিন্তু পূর্বে যাহা উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহার দ্বারা প্রমাণীকৃত হইয়াছে যে, ইহাতে যাদবেরা অপমানিত হইয়াছেন বিবেচনা করিবার কোন কারণ ছিল না। এ কথা যাদবশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণই প্রতিপন্ন করিয়াছেন, এবং তাঁহার সেকথা ন্যায়সঙ্গত বিবেচনা করিয়া অপর যাদবেরা অর্জুনকে ফিরাইয়া আনিয়া সমারোহপূর্বক তাঁহার বিবাহকার্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহাদের প্রতি অত্যাচার হইয়াছিল, ইহা বলিবার আমাদের আর আবশ্যকতা নাই।
(৩) সমাজের প্রতি অত্যাচার। যে বলকে সমাজ অবৈধ বল বিবেচনা করে, সমাজমধ্যে কাহারও প্রতি সেই বল প্রযুক্ত হইলেই সমাজের প্রতি অত্যাচার হইল, কিন্তু যখন তাৎকালিক আর্যসমাজ ক্ষত্রিয়কৃত এই বলপ্রয়োগকে প্রশস্ত ও বিহিত বলিত, তখন সমাজের আর বলিবার অধিকার নাই যে, আমার প্রতি অত্যাচার হইল। যাহা সমাজসম্মত, তদ্দ্বারা সমাজের উপর কোন অত্যাচার হয় নাই।
আমরা এই তত্ত্ব এত সবিস্তারে লিখিলাম, তাহার কারণ আছে। সুভদ্রাহরণের জন্য কৃষ্ণদ্বেষীরা কৃষ্ণকে কখনও গালি দেন নাই। তজ্জন্য কৃষ্ণপক্ষ সমর্থনের কোন আবশ্যকতা ছিল না। আমার দেখাইবার উদ্দেশ্য এই যে, বিলাত হইতে যে ছোট মাপকাটিটি আমরা ধার করিয়া আনিয়াছি, সে মাপকাটিতে মাপিলে, আমাদিগের পূর্বপুরুষাগত অতুল সম্পত্তি অধিকাংশই বাজেয়াপ্ত হইয়া যাইবে। আমাদিগের সেই একব্বরি গজ বাহির করা চাই।
——————–
1 শ্রীযুক্ত সত্যব্রত সামশ্রয়ী কৃত অনুবাদ।
2 যথা- প্রমীলা, মৃণালিনী ইত্যাদি।
3 মহাভারতের অনুশাসন-পর্বে যে বিবাহতত্ত্ব আছে, তাহার আমরা কোন উল্লেখ করিলাম না, কেন না, উহা প্রক্ষিপ্ত। সেখানে রাক্ষস বিবাহ ভীষ্ম কর্তৃক নিন্দিত ও নিষিদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু ভীষ্ম স্বয়ং কর্তব্যাকর্তব্য বিবেচনা স্থির করিয়া, কাশিরাজের তিনটি কন্যা হরণ করিয়া আনিয়াছিলেন। সুতরাং ভীষ্মের রাক্ষস বিবাহকে নিন্দিত ও নিষিদ্ধ বলা সম্ভব নহে। ভীষ্মের চরিত্র এই যে, যাহা নিষিদ্ধ ও নিন্দিত, তাহা তিনি প্রাণান্তেও করিতেন না। যে কবি তাঁহার চরিত্র সৃষ্ট করিয়াছেন, সে কবি কখনই তাঁহার মুখ দিয়া এ কথা বাহির করেন নাই।