কৃষ্ণ উপপ্লব্য নগরে ফিরিয়া আসিলে যুধিষ্ঠিরাদি জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি হস্তিনাপুরে কি করিয়াছিলে বল।
কৃষ্ণ, নিজে যাহা বলিয়াছিলেন, এবং অন্যে যাহা বলিয়াছিল, তাই বলিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই সকল বক্তৃতার পূর্ব পূর্ব অধ্যায়ে যেরূপ বর্ণনা দেখিয়াছি, এখানে তাহার সহিত মিল নাই। কিছুর সঙ্গে কিছু মিলে না। মিলিলে দীর্ঘ পুনরুক্তি ঘটিত। তাহা হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য কোন মহাপুরুষ কিছু নূতন রকম বসাইয়া দিয়াছেন বোধ হয়।
এইখানে ভগবদ্‌যান-পর্বাধ্যায় সমাপ্ত। তারপর সৈন্যনির্যাণ-পর্বাধ্যায়। ইহাতে বিশেষ কথা কিছু নাই। কতকগুলা মৌলিক কথা আছে; কতকগুলা কথা অমৌলিক বলিয়া বোধ হয়; কৃষ্ণসম্বন্ধীয় কথা বড় অল্প। কৃষ্ণের ও অর্জুনের পরামর্শানুসারে, পাণ্ডবেরা ধৃষ্টদ্যুম্নকে সেনাপতি নিযুক্ত করিলেন, এবং বলরাম মদ খাইয়া আসিয়া, কৃষ্ণকে কিছু মিষ্ট ভর্ৎসনা করিলেন, কেন না, তিনি কুরুপাণ্ডবকে সমান জ্ঞান করেন না। কুরুসভায় যাহা ঘটিয়াছিল, সে কথাও কিছু হইল। ইহা ভিন্ন আর কিছু নাই।
তাহার পর উলূকদূতাগমন-পর্বাধ্যায়। এটি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। ইহাতে আর কিছুই নাই, কেবল উভয় পক্ষের গালিগালাজ। দুর্যোধন, শকুনি প্রভৃতির পরামর্শে উলূককে পাণ্ডবদিগের নিকট পাঠাইলেন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নহে, কেবল পাণ্ডবদিগকে ও কৃষ্ণকে খুব গালিগালাজ করা। উলূক আসিয়া ছয় জনকেই খুব গালিগালাজ করিল। পাণ্ডবেরা উত্তরে খুবই গালিগালাজ করিলেন। কৃষ্ণ বড় কিছু বলিলেন না, তাঁহার ন্যায় রোষামর্ষশূন্য ব্যক্তি গালাগালাজ করে না, বরং একটা রাগারাগি বাড়াবাড়ি যাহাতে না হয়, এই অভিপ্রায়ে পাণ্ডবেরা উত্তর করিবার আগেই তিনি উলূককে বিদায় করিবার চেষ্টা করিলেন। বলিলেন, “তুমি শীঘ্র গমন করিয়া দুর্যোধনকে কহিবে—পাণ্ডবেরা তোমার বাক্য শ্রবণ ও তাহার যথার্থ অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন। এক্ষণে তোমার যেরূপ অভিপ্রায় তাহাই হইবে।” অথচ গালিগালাজটা কৃষ্ণার্জুনের ভাগেই বেশী বেশী রকম হইয়াছিল।
কিন্তু উলূকের দুর্বুদ্ধি, উলূক ছাড়ে না। আবার গালিগালাজ আরম্ভ করিল। না হইবে কেন? ইনি দুর্যোধনের সহোদর। তখন পাণ্ডবেরা একে একে উলূকের উত্তর দিলেন। উলূককে সুদ সমেত আসল ফিরাইয়া দিলেন। কৃষ্ণও একটা কথা বলিলেন, “আমি অর্জুনের সারথ্য স্বীকার করিয়াছি বলিয়া যুদ্ধ করিব না, ইহা মনে স্থির করিয়া ভীত হইতেছ না; কিন্তু যেমন হুতাশনে তৃণ সকল ভস্মসাৎ করে, তদ্রূপ আমিও চরম কালে ক্রোধভরে সমস্ত পার্থিবগণকে সংহার করিব সন্দেহ নাই।”
উলূকদূতাগমন-পর্বাধ্যায়ে মহাভারতের কার্যের পক্ষে কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। ইহাতে রচনার নৈপুণ্য বা কবিত্ব নাই। এবং কোন কোন স্থানে মহাভারতের অন্যান্যাংশের সহিত বিরুদ্ধভাবাপন্ন; অনুক্রমণিকাধ্যায়ে সঞ্জয় এবং কৃষ্ণের দৌত্যের কথা আছে, কিন্তু উলূকদূতের কথা নাই। এই সকল কারণে ইহাকে আদিমস্তরান্তর্গত বিবেচনা করি না।
ইহার পর রথাতিরথসংখ্যান্, এবং তৎপরে অম্বোপাখ্যান-পর্বাধ্যায়। এ সকলে কৃষ্ণবৃত্তান্ত কিছুই নাই। এইখানে উদ্যোপর্ব সমাপ্ত।

Leave a Reply