» » দণ্ডকারণ্যে যাবো

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

দণ্ডকারণ্যে যাবো : তের

রাত নামতেই চারটে মেছো নৌকো আর একটা গাদাবোটে নম্বরপ্লেট-খোলা মোটরসাইকেল চাপিয়ে, বাবা সুশান্ত ঘোষকে না জানিয়ে, গংগোতা গ্যাঙের দলবল নিয়ে চুপচাপ মাধেপুরায় পৌঁছে গিয়েছিল অপু। সঙ্গে দশটা জেরিক্যানে পেট্রল। পটলের পাহাড়, তরমুজের ঢিবি, ভুট্টাগাছের কাটা আঁটির ডাঁই আর শুয়োর-ছাগলের খোঁয়াড়ে পেট্রল ঢেলে বোমা মেরে আগুন যখন দাউ-দাউ, অপু একে-সানতালিস চালিয়েছে ঝোপড়িগুলোকে লক্ষ্য করে।

মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে ঠেলে দিয়েছে উল্টো দিকে, আর নিজেরা চুপচাপ ফিরেছে নৌকোয় চেপে।

—আপ্পু, চল অব, ছোড় দে, সব মর গয়া হোগা। সঙ্গীদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে, থেমেছিল অপু। অন্ধকারে কোনো কিছু নড়তে দেখলেই গুলি চালিয়েছিল, বেরহম। সবুজ পটলের পাহাড় পেট্রলের আগুনে ঠিশ-ঠাশ লাফিয়েছে দিকবিদিক, পাকা পটলগুলো হলদে ছ্যাদলামাখা কালো দাঁত থেকে আগুনের ফিনকি বের করে অট্টহাসিতে গলা ফাটিয়েছে। কালচে তরমুজরা শ্মশানে চিতায় শোয়া খুলির মতন ফেটে লাল রঙের ঘিলু উড়িয়েছে অন্ধকারের মহোল্লাসে। ভুট্টার খোসার ভেতরে গচ্ছিত পাকা দানাগুলো হাতবোমায় ভরা ছররার ঢঙে ফরফরিয়েছে।

পরের দিনই স্থানীয় সংবাদপত্রের শিরোনামে তারিণী মণ্ডল ও তার স্ত্রীর হত্যা আর মাধেপুরায় নারীশিশু মিলিয়ে তেত্রিশজনের জ্বলেপুড়ে বা গুলি খেয়ে মরার খবর। তার পরের দিন সর্বভারতীয় মুদ্রিত আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, আতংকওয়াদি নেতা আপ্রাধি ঘোষের নেতৃত্বে অতর্কিত হামলায় শতাধিক নিহত। পুলিশের ডিজিকে ওপরতলা থেকে গোপন হুকুম দেয়া হয়েছে যে আতংকওয়াদিদের নেতাকে যদি ধরা যায়, তাহলে, যদি সে ধরা দিতে না চায়, তাহলে, দেখামাত্র তাকে, আপ জানতে হ্যাঁয় কেয়া করনা হ্যায়। একটা মুদ্রিত মাধ্যমে নামকরা সাংবাদিক উত্তরসম্পাদকীয়তে লিখেছে, বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে যে লোকটা প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল, আর ওর প্রকৃত নাম আপ্রাধী ঘোষ নয়।

অপু নিজেকে তারিণী মণ্ডলের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে, শুনে, খেপে গেলেন সুশান্ত ঘোষ। ভ্যাপসা অন্ধকারে বসে, মেঠোগন্ধা স্ত্রী বেবিকে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে, যেভাবে উনি কখনও আজ পর্যন্ত কথা বলেননি, বললেন, আমি নিজে কোনোদিন বন্দুক-পিস্তল চালাইনি, আমার লুঙ্গিতে এই অটোমেটিক পিসতলটা শুধু গোঁজাই থাকে, চালিয়ে মাঝে-সাঝে টেস্ট করার হলে রামশরণ করে, আমি ট্রিগারও ছুঁয়ে দেখিনি। আমি অপুকে কোনো অস্ত্র-শস্ত্রে হাত দিতে দিইনি, তোর মাথায় ছোটোবেলায় হাত রেখে ও শপথ করেছিল যে জীবনে কোনোদিন ও বোমাবারুদ গুলিগোলা বন্দুক রাইফেলে হাত দেবে না। এটা কী করে হল? কে শেখাল ওকে? নিশ্চই ওর দাদু কোনো ফাঁকা দিয়ারায় নিয়ে গিয়ে নিশানার অভ্যাস করিয়েছে; তুই আমায় জানতে দিসনি, তুইও চেয়েছিস যে তোর ছেলে আমার মতো নয়, তোর বাবার মতন খুনি কিডন্যাপার অপরাধী হোক। এখন কী করবি? তোর ছেলেকে খুন করার জন্য নিশ্চই বেরিয়ে পড়েছে শত্রুরা।

সতত কলহাস্যময় বেবি এখন নিঃশব্দে, দুঃখ-মেশানো ক্রোধে, চোখের জল ফেলছিল; সম্ভবত বাবা-মার অপঘাতে মৃত্যুর কারণে। চোখ মুছে, দাঁতে দাঁত রেখে, বিরক্তির স্বাচ্ছন্দ্যে, বলল, আমিও জানতাম না যে ও বন্দুক চালানো শিখেছে; দিয়ারায় বাচ্চারা ছোটোবেলা থেকেই কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা চালাতে শেখে। ও-ও হয়তো সেভাবেই শিখেছে।

নৃশংস ঘটনার অতর্কিত বিহ্বলতায় বিচলিত ও বিমূঢ় সুশান্ত বসেছিলেন দাওয়ায় বাঁশের বেঞ্চে, ফলসা আর খিরনিগাছের তলায়। অপুকে কি ভাবে বাঁচানো যায় চিন্তা করছিলেন।

বেবির পরবর্তী কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সুশান্ত ঘোষ।

ঠোঁটের কোনে উত্তজনার দুঃসাহসী ফেনায় হতচেতন বেবি, ভয়ার্ত শ্রদ্ধায়, বলল, আপনি তো খুশিই হলেন আমার বাবা ওভাবে খুন হওয়ায়, রাস্তার মাঝখানে জানোয়ারের মতন, মুখ দেখে আর চেনার উপায় ছিল না যে ওই লোকটাই তারিণী মণ্ডল। আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করে আপনার জমিদারি বেদখলের বদলা নিতে লোক পাঠিয়েছিলেন। অন্য সবাইকে বোকা বানাতে পারেন, আমাকে নয়, আমি আপনার সঙ্গে প্রতিদিন-প্রতিরাত থাকি, জানি আপনকে, কখন কোন গান শুনছেন তা থেকে আপনার মনের অবস্থা বুঝে যাই, কেন বেশি মদ খাচ্ছেন তার আসল কারণ টের পেয়ে যাই। কী দরকার ছিল? বেশ ভালোই তো ছিলেন, দিয়ারার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে। আসলে আপনি জানতেন যে পিপারিয়াকে আক্রমণ করলে ওরা তারিণী মণ্ডলকে নির্ঘাত খুন করবে। আর আমার বাবা আপনাকে কিডন্যাপ করে আমার সঙ্গে যে জোর করে, চারিদিকে পাহারাদার বসিয়ে, বিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রতিশোধ নেয়া হবে। নয়কি? নিশ্চই আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করেছেন বিয়ের পর থেকেই, কী করে আপনার কিডন্যাপিঙের আর মুখ্যু কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ের বদলা নেবেন।

বেবির কথাগুলো ওনাকে, সুশান্ত ঘোষকে, অবাক করল। তিনি যাকে মেঠোগন্ধা বোকা মেয়ে ভাবছিলেন, সে তো তা নয়। সে ওনার গোপন ইচ্ছের কথা জানে! কখনও কি ঘুমের ঘোরে বা অত্যধিক মদ খেয়ে বলে ফেলেছেন মনের কথা? কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক যুবককে রাজধানীর ব্যাপক জীবন থেকে উপড়ে তুলে এনে ফালতু একটা জায়গায় পুঁতে বনসাই করে দেবার কাজের বিরুদ্ধে পুষে রাখা রোষের আগ্নেয়গিরির মুখকে খুলে ড্র্যাগনের আগুন-নিঃশ্বাস ছড়িয়ে সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেবার পরিকল্পনা?

বেবির মর্মপীড়া প্রতিবন্ধকহীন, বলতে থাকল, খুন-করার ঋণ খুনের মাধ্যমেই প্রতিশোধ হয়, জানি, ছোটোবেলা থেকে; বদলা যে নেয় তার মাথার দাম বদলা নেবার সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায়। আপনি তো আলাদা মানুষ ছিলেন, সাক্ষাৎ দেওতা, কী করলেন আপনি? বিষ খেতে-খেতে ভাবলেন যে আপনি বিষ খেলে যার কাছ থেকে বিষ কিনেছিলেন সেই দোকানদার মারা যাবে, আপনার কিছুই হবে না।

সুশান্ত, উদাসীন ক্ষোভে, বাকরুদ্ধ, শুনছিলেন, বেবির উদ্গীরণ, কে জানে কোথায় চাপা দেয়া ছিল, যাকে উনি মেঠোগন্ধা বোকা কথাকিপটে মেয়ে ভেবেছিলেন, তার অন্তরঙ্গ মিশুকে সংযমের আড়ালে ছিল আরেক বেবি।

বেবি বলল, আপনি আপনার ছেলেকে বসিয়ে বাংলা বলতে পড়তে লিখতে শেখালেন, আমাকে তো শেখালেন না, আমি তো হিন্দিতেও আনপঢ়, আপনি চাইলে আমাকে চোদ্দ বছর বয়স থেকে আপনার বাঙালি বউ করে তুলতে পারতেন। আমাকে আপনি আপনার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাননি। মিষ্টি কথা বলে-বলে আমায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, তা কি আমি বুঝতুম না? আজ আপনার কাছে অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।

সুশান্ত বেবির কথাগুলোর উত্তর দিলেন না, কেবল বললেন, কোথায় অপু, ওর এখানে থাকা চলবে না, এখানে ও হয়তো আজকেই খুন হয়ে যাবে। ওকে একটা মিডিয়া আতংকওয়াদি, আরেকটা মিডিয়া মাওওয়াদি বানিয়ে দিয়েছে।

অপু এলে সুশান্ত ঘোষ বললেন, গেট রেডি টু গেট লস্ট। গো ফ্রম দিস প্লেস। যেখানে কেউ তোকে খুঁজে পাবে না এমন জায়গায় চলে যা।

অপু কিছু বলতে চাইছিল। ওর নিরক্ষর মা, ইংরেজির একটিও শব্দ না জানা সত্ত্বেও, সুশান্তর মনোভাব আঁচ করে, অবিচলিত কন্ঠে বলল, তোর বাবা যা বলছেন, তা-ই কর। তোর এখানে থাকা চলবে না। তোর দাদুর মতন তুইও রাস্তায় গাড়ি চাপা শুয়োরের মতন মরে পড়ে থাক তা দেখার আগে আমি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নেবো।

ডেস্কটপের মনিটারে গুগল ম্যাপ খুলে, বাবা সুশান্ত ঘোষ অপুকে বোঝালেন, তুই পালা, এই দ্যাখ, ইতুদিদি আর অমিত বর্মণ নামের লোকটা যে জঙ্গলে গেছে তার ম্যাপ, জায়গাটার নাম অবুঝমাড়, কেউ যায় না আদিবাসীদের ওই অঞ্চলে, গুগল সার্চ করে দেখেছি, ইমপ্রেগনেবল ফরেস্ট। প্রথমে দণ্ডকারণ্যের নারায়ণপুরে যাবি, সেখান থেকে হদিশ নিয়ে অবুঝমাড়।

সুশান্ত ঘোষ অনুমান করেছিলেন যে পুলিশ এসে ওনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করবে। ছেলেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে বেবিকে সঙ্গে নিয়ে নিজেও পালালেন দিয়ারার চরে, যেখানে পলিমাটির প্রলেপ-দেয়া চ্যাঁচারির বেড়ায় ঘেরা ঢেউতোলা অ্যাসবেসটসের চালাঘরে দাগি অপরাধীরা, পুলিশ-প্রশাসনকে এড়াবার জন্য, এসে লুকোয়। তারা এসে লুকোলে শহর থেকে নাচানিয়াওয়ালি আনিয়ে তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করত তারিণী মণ্ডল।

সুশান্ত ঘোষ ভেবে দেখলেন যে, যতদিনে পুলিশ ওনাকে ধরবে ততদিনে অপু পৌঁছে যেতে পারবে নাগালের বাইরে। অবুঝমাড়ে পালিয়ে গেছে শুনলে পুলিশের আর কিছু করার থাকবে না।

দিয়ারায় বানানো গঙ্গামাটি-লেপা বাঁশের কাঠামোর ওপর বেছানো অ্যাসবেসটসে পাতা খড়ের ছাদের তলায় ফেরারি অপরাধীদের কুকর্মশালায় আশ্রয় নিলেন সুশান্ত ঘোষ। ডিজেল জেনারেটারে চালানো কুলারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে ছিলেন চেয়ারে। ওনার চালাঘর ঘিরে, আর নৌকোয় বসে, কুড়ি-পঁচিশজন বন্দুকধারী পাহারাদার, তারা পুলিশের আর শত্রু গ্যাঙদের আক্রমণ প্রতিহত করবে যতক্ষণ পারবে। বেবি আর ওনার মাঝে কথা বলার বিষয় হতে পারত ওনাদের ছেলে অপুর সুরক্ষিত থাকা, নির্ধারিত জায়গায় পোঁছানো। কিন্তু বিবাহ নামের কর্মকাণ্ডের দ্বারা দুজনের যোগাযোগের যে মাধ্যমটি ছিল, যা কিডন্যাপিঙের সূত্রে জোর করে তৈরি সম্পর্কে গড়ে উঠেছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে তারিণী মণ্ডলের মৃত্যুতে। বেবির নিঃশর্ত ভালোবাসা তাঁর সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। দেখনপ্রেম হোক বা মাংসঘর্ষণ ভালোবাসা, সেসবের প্রলেপ লাগিয়ে কোনো ঘা শুকোয় না। শশুরের মৃত্যুতে তিনি যেমন গোপন আহ্লাদে মাতোয়ারা, তেমনই ছেলে অপুর অবধারিত গ্রেপ্তার, বিচার ও কারাদণ্ডের, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের, দুশ্চিন্তার চাপা আতঙ্কে বিপর্যস্ত। পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্যার সমাধান এই ভাবেই করতে হল, বোঝাচ্ছেন নিজেকে, এ ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু সে সমস্যার সমাধান হতে দিল না তাঁরই ছেলে। ছোঁ-মারা কিডন্যাপিঙের সময় যেমন আলাদা ছিলেন, এতকাল একসঙ্গে ঘর করে সেই আলাদাই রয়ে গেছেন, মাংসাশী জানোয়ারের হাইবারনেশানে, রেকলুজ, কাস্টঅ্যাওয়ে।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার