» » দণ্ডকারণ্যে যাবো

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

দণ্ডকারণ্যে যাবো : বার

পৃথিবীর উঠাপটক-জোড়তোড় সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর রাখেন অপুর বাবা, অখবার পড়েন, আংরেজি টিভি দ্যাখেন, স্কুলে আর কালেজে যা শেখানো হতো সেসব বাবা জানেন, পড়া বুঝিয়ে দিতেন। মারোয়াড়ি কলেজে পড়ার সময়ে অনেক সাহায্য করেছেন বাবা। সকলে শহরে কোচিং পড়তে অঢেল টাকা খরচ করে, ওকে, অপুকে, করতে হয়নি। দাদু কিছুই জানেন না, খেতের রোপনি, কাটাই, মাল বিক্রি, লেন-দেন, পহলওয়ান সাপলাই আর রংদারি ট্যাক্স ছাড়া। অপুকে কোনো কথা বোঝাতে হলে মায়ের মাধ্যমে বোঝান বাবা। মা যদি তা না বোঝেন তখনই বাবা নিজে বিষয়টা নিয়ে অপুর সঙ্গে কথা বলেন।

—আরে উ অব বচ্চা-বুতরু হ্যায় কাআআআআআ? করনে দিজিয়ে জো মন মেঁ আবে। কৌনো মৌগি কে সাথ নহিঁ না ফঁসা হ্যায়, না আপকে তরহ দিন-দহারে দারু কা নিসা করতা হ্যায়। কহিয়েএএএএএ।

—সসুরজি উসকো এতনা রুপয়া দে-দেকে খরাব কর রহে হ্যাঁয়।

—আরে রুপয়া হ্যায় কিস লিয়ে? আপ কোই সোনে কা মুরত হ্যাঁয় কি আপকা বেটা হীরা-জওহারাত কা মুরত হোগা? মগর ডরপোক নহিঁ হ্যায় আপকে তরহ। পহলওয়ান লেকে নহিঁ ঘুমতা হ্যায় মেরা বেটা। কা কহ রহেঁ হ্যাঁয় হম, সুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ? আপনার আর আমার বাবার চাপে পড়ে আমার ছেলের ঘাড়ে দুটো মাথা গজিয়েছে, বিষ্ণু ভগওয়ানের আর ভস্মলোচনের, ও নিজেই বুঝতে পারে না যে কোন মাথাটার নির্দেশ কখন শুনবে। মাথা দুটোর লড়াই একদিন ওকে ডোবাবে। দুটো মাথার একটাও আমার কথা শোনে না। যখনই ফোন করি ফোন কেটে দিয়ে বলে ব্যস্ত আছি, এখন বিরক্ত কোরো না। ছেলেটা দিল্লি গিয়ে একদম সরফিরা হয়ে গেছে।

—মেরে তরহ গোরাচিট্টা হ্যায় উ। বাল ভি মেরে তরহ ঘুংরালি। অন্য কাউকে বিয়ে করতিস তো কয়লার খাদান থেকে বেরোনো কুলির চেহারা নিয়ে জন্মাতো।

—কয়লা খাদানের মজা লুটবেন বলেই তো থেকে গেলেন। এমন কচি কয়লাখনি তো আর পেতেন না, যাতে ঢুকতে দু’ঘণ্টা ধরে গলদঘর্ম হয়েছিলেন। লেকিন লম্বাই-চওড়াই ওকর নানাকে তরহ হ্যায় নাআআআআআ?

—মজা? কেঁচোর মাটিখাওয়া আবার মজা নাকি!

—তবে না তো কী? প্রথম রাত আমি দাঁতে দাঁত দিয়ে, মুঠো শক্ত করে, চুপচাপ সহ্য করেছিলুম, আপনি কতক্ষণ চেষ্টা করে সফল হয়েছিলেন, ভুলে যাচ্ছেন কেন। আমি জানতুম যে আপনি সফল মানেই দিয়ারায় ঘরজামাই হয়ে থাকা আপনার পাক্কা। মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিলুম যে, গঙ্গায় শুশুক ভেসে উঠেছে মানে আপনাকে আমার চাই-ই চাই, চিরে রক্তারক্তি হলেও, একফোঁটা চোখের জল ফেলব না। আপনার সফলতা আমার সফলতার সঙ্গে মিশে গেল, ছোটোবেলা থেকে স্নান করে-করে গঙ্গার যতগুলো ঢেউ আমার গায়ে জমা হয়েছিল, সেগুলো সেদিন ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল।

—হ্যাঁ, তোর ঢেউ তবু ফুরোয়নি। গঙ্গায় স্নান করিস আর নতুন-নতুন ঢেউ গায়ে করে তুলে আনিস।

—আপনি তো দেওয়ি-দেওতায় বিসওয়াস করেন না, গঙ্গায় স্নান করে দেখুন না একদিন, সব পাপ ধুয়ে যাবে।

—কোনো পাপই করিনি আমি যে পাপ ধোবার জন্য তোর গঙ্গায় স্নান করতে হবে। পাপ অন্যেরা করে, আমি তার পূণ্য ভোগ করি।

জামাইবাবা সুশান্ত ঘোষের মেয়েও হয়েছিল, অপুর জন্মের এগার বছর পর। ওনাকে বোঝানো হয়েছিল, দিয়ারায় মেয়ে-বাচ্চা অশুভ বলে তাকে একদিনের বেশি বাঁচতে দেয়নি তারিণী মণ্ডলের বউ, মানে জামাইবাবার শাশুড়ি। দিয়ারার খেত এত উর্বরা কেন, যুক্তি দিয়েছেন শাশুড়িমাইয়া; তার কারণ দিয়ারায়-দিয়ারায় পোঁতা আছে সীতামাইয়ার কন্যা-সন্তানরা, তারা মাটির তলায় নাল ফেলে-ফেলে জমিকে উর্বরা করে দ্যায়। জানতে পেরে, যদিও সুশান্ত ঘোষের গেঁয়ো বউয়ের ততটা মনখারাপ হয়নি, জামাইবাবার হয়েছিল। তারপর উনি নিজেকে স্তোক দিয়েছিলেন, যে, শহুরে মগজ নিয়ে দিয়ারার নৈতিকতা যাচাই করা অনুচিত; যেমন ভুঁইসমাজ তেমন তার আচার-বিচার, তেমন তার সত্য, তার নৈতিক নিয়মাবলী; কে বাঁচবে কে মরবে তার নির্ণয় নেবার অধিকার তো যে নিচ্ছে তার।

ওনার শশুর, তারিণী মণ্ডল, কাউকে উড়িয়ে দেবার হুকুম দিলে, যাকে ওড়ানো হচ্ছে তাতে তার কোনো নির্ণয় নেবার নৈতিক অধিকার থাকে না, কেননা সে এমন কাজই করেছে যে তাকে চলে যেতে হবে। তিনি কিডন্যাপ হলেন, তাতে তো তাঁর নিজের কিছু করার ছিল না। নির্ণয় নিয়েছিলেন হবু-শশুর।

মেয়ের মুখটুকু দেখা হল না বলে আপশোষ থেকে গেছে অপুর বাবার। যখনই মনে পড়ে, শরীর খারাপ হয়ে যায়। তরমুজের গুলাবি মদ নিয়ে বসেন।

আসল কারণটা অবশ্য সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা বউই ফাঁস করে দিয়েছিল, সারা গায়ে ডেওডেরেন্ট উড়িয়ে, যখন একদিন রাতে মরা মেয়ের শোকে তরমুজের চোলাই করা মদ খেয়ে একা-একা কাঁদছিলেন। বউ বলেছিল, কেঁদে আর কী হবে? ছেলে জারজ হলেও তার বিয়ের সমস্যা হয় না। কিন্তু জারজ মেয়েকে কে বিয়ে করত? আপনি তো এমন মানুষ যে মনের মতন পাত্র কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিতে পারতেন না; আজকালকার ছেলে, কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিলেও সে পালিয়ে যেত কিনা বলা যায় না। তারপর আবার কাজিয়া-খুনোখুনি, বিশ-পচিশ লাশ ইধর তো বিশ-পচিশ লাশ উধর।

ভাগলপুরের দিয়ারা অঞ্চলে সুশান্ত ঘোষ নিজে একাই এসেছিলেন, বাড়ির কাউকে না জানিয়ে, তারিণী মণ্ডলের খুংখার ক্রিমিনাল দলের সাহায্য নিয়ে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় বেদখল হয়ে-যাওয়া জমিজমার পুনর্দখল নেবার মতলব নিয়ে। সুশান্ত ঘোষ অফিসের বিহারি সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে ভাগলপুরের নাথনগর, আর বিহপুর থানার কসমাবাদ, দুধলা, বৈকুন্ঠপুর, তেতিস, অমরি, নকরটিয়া, অজমেরিপুর, ভগবতীপুর, দিলদারপুর, রত্তিপুর, ওদেদিয়া, কাহেওয়ারা, গিরিপুর, চোওহদ্দি, রাঘোপুর, গঙ্গাপুর, রসতপুর আর শাহপুরের গ্রামগুলোতে রাজত্ব করে একদল খুনি, তারিণী মণ্ডল, মলহারিয়া মণ্ডল, লালে মণ্ডল, ডুব্বা মণ্ডল আর সন্তান মণ্ডলের পহলওয়ানরা — আধুনিক সমাজের বাইরে মারকাট অঞ্চল।

ইংরেজদের সময় থেকে কোনো তারতম্য হয়নি এই দিয়ারার মানুষদের জীবনধারায়, সংঘর্ষে, দারিদ্র্যে, শোষণে। যার যত পেশিশক্তি তার তত জমিন আর জলপ্রবাহ, গঙ্গার ধারের জমিন, গঙ্গার মাঝে জেগে ওঠা জমিন, আর গঙ্গার জলপ্রবাহ। ১৯৫৯ থেকে ভাগলপুরে গঙ্গানদীর তীরে একশো আটত্রিশটা গ্রামে ভূমিসংস্কারের চেষ্টা বারবার ভেঙে গেছে। কাগজে-কলমে যে-ই মালিক হোক না কেন, খুংখার খুনি গিরোহদের সমর্থনে দখলে রাখতে হয় ছুঁচের ডগার সমান জমি আর তর্জনী-বুড়ো আঙুলে ছেটানোর সমান জল। সুশান্ত ঘোষ ব্রিফকেস ভরে লাখ দেড়েক টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের সাহায্যে নিজেদের পিপারিয়ার জমিদারির জমিজমা ফেরত পাবার ষড় কষতে।

জমিজমার দখল নিতে গিয়ে নিজেই জবরদখল হয়ে গিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ। সেই কাঁচা যৌবনে, তখনই, তাঁর চেহারার খোলতাই ছিল অবাঙালি, প্রায় মারোয়াড়ি। পাঁচ ফুটের ফর্সা গালফোলা ঘাড়ে-গর্দান কোঁকড়াচুল চনমনে। অথচ বাঙালি বলে, মুঙ্গেরের পিপারিয়া গ্রামে, যেখানে ওঁদের জমিজমা, সেখানে যাওয়া, ফসল তোলা, এতোয়ারি হাটের খাজনা আদায় সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওনার বাবার ঠাকুর্দা, মানে ঠাকুর্দার বাবা, হাইকোর্টে, তখন কলকাতায় মামলা লড়তে হতো, ভূমিহার রাজনাথ সিংকে ফৌজদারি মামলায় জিতিয়ে দেয়ায়, মুঙ্গেরের রোমহর্ষক দিয়ারায়, দুশো একর জমি আর সাত একর আনাজ বাগান, আর এতোয়ারি হাট ওনার ঠাকুর্দার নামে করে দিয়েছিল।

সুশান্ত ঘোষ আগে যাননি কখনও পিপারিয়া। ছোটোবেলায় চাল মুসুর অড়র ভুট্টা সর্ষে পটল কচু আম রাঙা-আলু গাওয়া-ঘি আর হাটের টাকা আসত। তারপর ওখানে কৈলু যাদব, কজ্জল ধানুকদের দলের অপহরণকারী অপরাধীরা এমন জ্বালাতন আরম্ভ করলে যে সুশান্তদের বাড়ির কেউই ওমুখো হবার সাহস যোগাতে পারেননি। কাদের হাতে যে সেই বিশাল সবুজ খেতখামার তা কেবল কানাঘুষোয় শুনতে পাওয়া যেত। বাংগালি-তাংগালি বলে সুশান্ত ঘোষের জ্যাঠা-কাকা-বাবা সেখানে পাত্তা পেতেন না।

সত্তরে পৌঁছে বাঁচোখ কানা তারিণী মণ্ডল পাকাপাকিভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন জামাইবাবার হাতে।

তারিণী মণ্ডলের সিংহাসনে বসার দিনকতক পর, একদিন রাতে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় তাঁর দলের বাছাই পালোয়ানদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ, বাপ-ঠাকুর্দার জমিজমা দখলের জন্য নয়, সেই জমিজমা যারা দখল করে ওনাদের বেদখল করে দিয়েছে, তাদের সাফায়া করে প্রতিশোধ নেবার জন্য। সাফায়া করার পর তাদেরই তিনটে লাশ আর বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র বোমাবারুদ ফেলে এসেছিল মাধেপুরার আরেকটা দলের অঞ্চলে, যাতে তাদের পারস্পরিক খুনোখুনিটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চেহারা নিতে পারে। নিয়েও ছিল। সেই থেকে মুঙ্গেরের আর মাধেপুরার অপরাধীরা লড়ে মরে জামাইবাবাকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছিল। মারকাট এড়াবার জন্যে শলা করতে বসে ওরা জানতে পারে যে ওদের মধ্যে লড়াইটা বাধিয়েছিল তারিণী মণ্ডলের জামাই।

ভোঁসড়িকে ক্যা বাংগালি দিমাগ, হমনিলোগকে চালিস আদমি মর গেলই আপস মেঁ লড়ঝগড়কে। প্রকৃত ব্যাপার জেনে ফেলার পর, পিপারিয়া গিরোহ লোক পাঠিয়েছিল তারিণী মণ্ডল আর তার বাংগালি জামাইকে খুন করার জন্য। সাতসকালে ট্রাক চালিয়ে এসে, সামনেই তারিণী মণ্ডল আর মন্হরা দেবীকে পেয়ে যাওয়ায় শশুর আর তার বউকে সাফায়া করার লোভ সামলাতে পারেনি তারা।

বালিয়াড়িতে দুই চিতার ওপর সাজানো দাদু-দিদিমার শব দেখে পর্যন্ত অপু নিজেকে বুঝিয়েছিল যে বদলা নিতে হলে আজকেই নিতে হবে। শোক-ফোকে ডুবে থাকলে চলবে না। দাদু তো শিখিয়ে গেছেন যে পৃথিবীতে ভয় নামে কোনো ব্যাপার নেই। মনের ভেতরে পোষা অজানা আতঙ্ক ছাড়া বাইরের কোনো কিছুকে ভয় করতে নেই। বুলেটই হল চিরসত্য।

একবার নিজের মাথার ওপর খেত থেকে সদ্য তোলা পটল রেখে, তখন ওর বারো বছর বয়স, দাদুকে বলেছিল, চালান গুলি, দেখি কে ভয় পায়, আপনি না আমি। উত্তরে তারিণী মণ্ডল বলেছিল, আমার বাঁচোখ নেই, ডান চোখ এখন খারাপ হয়ে গেছে, জোয়ান বয়স হলে চালাতুম গুলি, দেখিয়ে দিতুম তোকে, চশমা পরে তো আর এক-নল্লা চালানো যায় না। অপু বলেছিল, ডরপোক কহিঁকা।

—আমি আর ডরপোক? আমার নাম শুনলে সরকারি অফিসাররাও হেগে ফ্যালে, জানিস তো, আমি হলুম মূর্তিমান ত্রাস। আচ্ছা, আমি রাখছি পটলটা মাথার ওপর, তুই চালা।

—আমার তো আর এখন অত টিপ হয়নি। পাঁচদশ বছর যাক তখন দেখবেন, দেয়ালের পিঁপড়েকেও একশ মিটার দূর থেকে গুলি চালিয়ে মেরে দেখাবো। পিস্তল-বন্দুক চালাতে শেখাচ্ছেন তো আপনিই; দেবো গুরুদকছিণা, চিন্তা করবেন না।

—তোর বাপকে আর মাকে বলিসনি যেন যে তুই পিস্তল-বন্দুক চালাতে শিখছিস। শসার শাঁষ দিয়ে হাত পুঁছে নে, নয়তো তোর মা হাত শুঁকলে বারুদের গন্ধ পেয়ে যাবে।

—জানি।