» » সিভিলিয়ান হিট

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

সিভিলিয়ান হিট : দুই

আগুনের ঢেউ-তোলা আর ফিনকি-ওড়ানো কয়েকটা জ্বলন্ত খোড়ো চালাঘরের সোনালি আলোয়, চারিদিকে ছিৎরে ছড়ানো লাশের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল ক্রুদ্ধ অপু, পোশাকি নাম অশ্বমেধ ঘোষ, যার বাবা সুশান্ত ঘোষকে অনেককাল আগে কিডন্যাপ করে, দশ লাখ টাকা ফিরৌতি বা র‌্যানসাম না পেয়ে, নিজের চোদ্দ বছরের কচি শ্যামলিমা নিরক্ষর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন তারিণী মণ্ডল, মহানন্দে, ধুমধাম করে, যেভাবে অপরাধ-জগতের ছাতিঠোক অখণ্ডপ্রতাপ বাহুবলি বীরেরা ভাগলপুর আর মাধেপুরা জেলার গঙ্গার চরের দিয়ারায় করে থাকে, করে আসছে বহুকাল যাবত, আর তারিণী মণ্ডল তো অপরাধিদের জগতে ছিল মহাজ্যোতিষ্ক, যার কদমছাঁট হাফটেকো মাথা ঘিরে ভনভন করত দুপুর গঙ্গার ঢেউ-গনগনে চনমনে রোদ, তেল-চুকচুকে সোঁটার পেতলমাথায় ধরা থাকত অমাবস্যার নদী-ছলছলে অন্ধকার। সে সোঁটার অভিজ্ঞতা তারিণী মণ্ডলের চেয়ে পুরোনো, ব্যাপক আর গভীর, কেননা ওটা উনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে, লাঠিয়াল বাবার কাছ থেকে, যে তার বাবার, সে তার বাবার। তারিণী মণ্ডলের দুঃখ যে ওনার ছেলে নেই, জামাই যদিও ঘরজামাই, তিনি ওসব সোঁটাসুটির প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, আধুনিক পিস্তলও শুধু লুঙ্গির গেঁজেতে গুঁজে রাখেন, কখনও একটু-আধটু চালিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না। নাতি অপু বরং ওর বাবার চেয়ে আধুনিক, আজকালকার তেজিয়ান ছোকরা।

অপু জানতে পেয়েছিল, বেশ একটু দেরিতেই, আত্মীয়-স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টি দলচররা চেষ্টা করেছিল নানা-নানির অপঘাতে মৃত্যুর দুঃসংবাদটা ওর কানে যাতে দেরিতে পৌঁছোয়, যে, দাদু তারিণী মণ্ডল আর দিদিমা মন্হরা দেবী খুন হয়ে গেছে সকালবেলায়, একেবারে ছলনি। রোজকার মতন তেলমাখা লাঠি আর দুজন কালচে-কেঁদো খইনিঠোকা বন্দুকধারী দেহরক্ষীর গাঁট্টাগোট্টা পাহারায়, পটলের লোডিং তদারকি করতে বেরিয়েছিল, ট্রাকে পটলের পঞ্চাশটা বস্তা চালান হবার কথা ছিল ভোরবেলায়।

যে ট্রাক আসার কথা ছিল সেই নম্বরের ট্রাকই এসেছিল, বনেটে বজরংবলির গেরুয়া টুনিপতাকা উড়িয়ে, কিন্তু তা থেকে মুখে লাল গামছা বাঁধা চারজন লাফিয়ে নেমে তারিণী মণ্ডলকে লক্ষ করে একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস চালিয়ে চকাচৌঁধ ধুঁয়াধার অন্ধাধুন ব্রাশফায়ারে ছলনি করে, ট্রাক ফেলে রেখে, ট্রাকের পেছনে যে ছাইরঙা ইনোভা আসছিল, তাতে চেপে দক্ষিণের ভোররাতের গু-শোভিত আর মাটির সোঁদা দেয়ালে ঘুঁটেতে পাঁচ আঙুলের ছাপ-মারা গোবর-সুসজ্জিত কাঁচা রাস্তা ধরে আধাশীতেল অলস কুয়াশার সঙ্গে ধুলো মিশিয়ে উধাও।

মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দাদু, বাঁ-চোখের কোটর থেকে নকল সিনথেটিক মণি বেরিয়ে ছিটকে নর্দমায়, আর ডাকসাইটে দিদিমা ওপরমুখো চিৎ; দেহরক্ষীরা পিছু ধাওয়া করে কাঁধ থেকে একে সানতালিস নামাতে-নামাতেই বেতাহাশা গুলি খেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে তারা দুজনেও মোরাম-পথের ওপর ঠ্যাং ছড়িয়ে লালজবজবে-চিৎ, আকাশের দিকে হাঁমুখ, চোখ-খোলা। দিদিমা, মানে নানি, নানিকে নিয়ে বেরোত না নানা সচরাচর। নানির হাঁটুর ব্যাথা সারাবার জন্যে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে পায়চারি করে জাম হয়ে থাকা হাঁটুর চাকতি আলগা হয়।