» » বনবিভাগের বিট মার্শাল

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

বনবিভাগের বিট মার্শাল : শেষ

মোবাইলে বড়জেঠিকে রিং দিয়ে সুশান্ত ঘোষ শুনতে পেলেন ওনার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর, সুশান্ত…সুশান্ত…কাল থেকে তোকে রিং দিচ্ছি…কতবার চেষ্টা করছি…সুইচ অফ আসছিল….তুই কোথায়…অপু কোথায়…কাগজে খবর পড়ে অব্দি ঘুমোতে পারিনি…খেতে বসে রুচি হল না…শুনছিস তো…সাড়া দিচ্ছিস না কেন…সুশান্ত… অপুকে পাঠিয়ে দে…আমি ওকে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখব…সুশান্ত শুনতে পাচ্ছিস…কথা বলছিস না কেন…আমার কথা শোন…তুই চলে আয়…বউকেও নিয়ে আয়…আবার সব আগের মতন ঠিক হয়ে যাবে…তিনজনেই চলে আয়…পুলিশ তোদের এখানে খুঁজবে না…পুলিশ জানে তুই ত্যাজ্যপুত্র…শুনতে পাচ্ছিস? উদ্বেগ উৎকন্ঠা ক্রমে ফোঁপানি এবং ফোঁপানি ক্রমে কান্নায় রূপান্তরিত হলে, সুশান্ত ঘোষ বললেন, এই নাও, শোনো।

লুঙ্গিতে গোঁজা সেমিঅটোমেটিক পিস্তলটা বের করে একটা গুলি ওপর দিকে চালিয়ে পরখ করলেন কাজ করছে কিনা। গুড, করছে।

শোকার্ত আতঙ্কিত বেবি, দড়ির খাটে, রাতের পর রাত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি-মাখা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, পাশ ফিরে শুয়ে, চাপা ফোঁপানি ছড়িয়ে দিচ্ছিল শরীর জুড়ে, খাটের শিয়র থেকে দীর্ঘ এলোচুল নামিয়ে, কী হল, কী হল, বলতে-বলতে খাট থেকে নেমে, ওনার, সুশান্ত ঘোষের দিকে ছুটে এলে, বেবিকে লক্ষ করে পর-পর দুটো গুলি চালালেন, বুকে আর মাথায়।

তারিণী মণ্ডলের মতনই, বেবির খুলি ফেটে দুধে-আলতা মগজ ছিৎরে পড়ল। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল বেবি, প্রতিদিন শাম্পু-করা সুগন্ধিত চুল উড়িয়ে।

দেহরক্ষীরা, যারা সুশান্ত ঘোষের পাহারায় চ্যাঁচারির বেড়ার বাইরে আর নৌকোয় বন্দুক হাতে বসেছিল, তারাও কী হল, কী হল, কারা ফায়ার করছে, বলতে-বলতে চালাঘরের দিকে দৌড়োল।

সেমিঅটোম্যাটিক পিস্তলের নল নিজের ডান কানের ওপর করোটিতে চেপে, তাকিয়ে দেখলেন বালির ওপড় পড়ে-থাকা তাঁর এত বছরের সঙ্গিনী, তারিণী মণ্ডলের মেয়ে বেবির মৃতদেহের দিকে, তারপর ট্রিগার টিপলেন সুশান্ত ঘোষ।

বালিতে ছিটকে পড়ে-যাওয়া মোবাইলে বড়জেঠির কান্না-মেশানো কন্ঠস্বর আতঙ্কিত আর্তনাদে বলে চলেছে, গুলির আওয়াজ কেন…কী হচ্ছে ওখানে…সাড়া দিচ্ছিস না কেন…সুশান্ত..শুনতে পাচ্ছিস…গুলিগোলা চলছে কেন…কথা বলছিস না কেন…ঠিক আছিস তো…তোর ছেলে কোথায়…সুশান্ত…সুশান্ত…বলছি তো অপুকে পাঠিয়ে দে…তোর বউকে নিয়ে চলে আয়…সুশান্ত…সুশান্ত…

মোবাইলটা উচ্চকন্ঠে কাঁদা আরম্ভ করল উড়ন্ত বালির সদালাপী হাওয়ায়, ঝিরি-ঝিরি রঙ্গপ্রিয় বালির অবাক হাসিখুশি দিয়ে হয়তো ক্রমে ঢাকা পড়ে যাবে আজ রাতের অমনোযোগী অন্ধকারে। বর্ষায় দিয়ারার সঙ্গেই হয়তো চলে যাবে জলের তলায় শেষ কান্নার বর্ষীয়ান স্মৃতি নিয়ে, তারপর একদিন চিকচিকে বসন্তে মাথাচাড়া দেয়া নতুন চরের পলিমাটির ওপর বোবা জেগে উঠবে কোথাও, খুরপি দিয়ে কেয়ারি-করা পলতালতা বা তরমুজলতার হলুদ ফুলের আড়ালে।