» » বনবিভাগের বিট মার্শাল

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

বনবিভাগের বিট মার্শাল : উনিশ

অমিত বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথম বার যখন ইতুর সঙ্গে দেখা করতে ওর ক্লিনিকে এসেছিল, সে ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে ইতুর। অবুঝমাড়ের জঙ্গলে, মাটিতে শুকনো জঞ্জালের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, গুলির অধারাবাহিক শব্দ শেষ হবার পরও, বহুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থেকে, সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল ইতুর, হুবহু; পাতাগুলো বোধহয় বয়ে এনেছে অমিতের যৌবনগ্রন্হির নিঃসরনের বুনো গন্ধ।

অমিতের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না। হয়তো কেন, নিশ্চিত হবে না।

বছর আড়াই আগে,আনিসাবাদে, নিজের ক্লিনিকে রোগি আসার অপেক্ষায় হতাশ বসেছিল ইতু, ইতু ঘোষ; দেখল, ফুটপাতে, ওর ক্লিনিকের সামনেই চেককাটা শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে, ওপরে মুখ তুলে। দাড়ি-গোঁফ আর বাবরি চুলে মুখ প্রায় ঢাকা, ইতু বয়স আন্দাজ করল বাইশ-তেইশ হবে, রোগকে যেচে ডেকে আনার সবচেয়ে উদ্দীপক বয়স। উঠে দাঁড়িয়ে, সাদা গাউন পরেই ছিল, টেবিলে রাখা স্টেথোস্কোপটা গলায় ঝুলিয়ে, এগিয়ে গিয়ে ডাকল লোকটাকে, হিন্দিতে, আসুন না, আসুন, আপনাকে দেখেই তো বুঝতে পারছি আপনি বেশ ক্লান্ত, হয়ত কোনো রোগের কারণে।

সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল তুলে লোকটা বলল, ডাক্টর ইতু ঘোষ কা ক্লিনিক, য়ঁহা সভি রোগোঁকা ইলাজ কিয়া জাতা হ্যায়, তারপর ইতুর দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল, তুই ইতু ঘোষ, গর্দানিবাগের ঘোষবাড়ির মেয়ে, তাই না?

যুবকের মুখের দিকে না তাকিয়ে, পেছন ফিরে তাকে বলল, হ্যাঁ, আমি ঘোষবাড়ির মেয়ে ইতু, অনেকে ইতি বা ইতান বলেও ডাকে। আপনি ভেতরে আসুন না, শুনবো আপনার শারীরিক সমস্যার কথা, কোনো চিন্তা করবেন না, হেভি অ্যালোপ্যাথিক ডোজের ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসা আমি করি না, আসুন, ভেতরে আসুন।

লোকটা ভেতরে ঢুকে, ইতুর টেবিলের উল্টো দিকে, রোগির চেয়ারে বসলে, নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে, স্টেথোটা টেবিলে রেখে, টেবিলে ছড়ানো জিনিসগুলো, খোলা-সংবাদপত্র, সাজাতে-সাজাতে ইতু বলল, কি হয়েছে শুনবো, তার আগে আপনার ব্লাড প্রেশার আর পাল্স চেক করে নিই। রোগি তার সমস্যা বর্ণনা করার আগেই, ইতু বলল, দিন আপনার বাঁ হাতখানা এখানে রাখুন তো, বলে ব্লাড প্রেশার মাপার জন্য ফ্ল্যাপটা হাতে জড়িয়ে বলল, আপনি ওনাদের চেনেন?

—আমি তোকেও চিনি, বলল লোকটা, তুইও আমাকে চিনিস, মুখের পানে আগে তাকিয়ে দ্যাখ, ইডিয়ট। আমার গলার আওয়াজও এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি নাকি?

যুবকের কথা শুনে তার মুখের দিকে চেয়ে সঞ্চিত বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ইতু, আরে অমিত, চিনতেই পারিনি, দাড়ি গোঁফ রেখে এমন ভোল পাল্টে ফেলেছিস রাসকেল, গলার আওয়াজও বড়দের মতন হয়ে গেছে, সন্ন্যাসী হয়ে গেছিস নাকি? ফুঁপিয়ে ফেলেছিল, সামলে নিয়ে বলল, সেই যে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলি, আমাকে বলে যাবার প্রয়োজন বোধ করলি না।

—হ্যাঁ, সাধুই হয়ে গেছি প্রায়?

—বাড়িতে গিয়ে আমার ক্লিনিকের ঠিকানা পেলি? টিশ্যু পেপারে চোখ পুঁছে বলল ইতু।

— গিয়েছিলুম একটু আগে, ভেতরে ঢুকিনি, তাই আমাকে দেখে রোগীর মতন মনে হয়ে থাকবে, হাঁটছি তো অনেকক্ষণ যাবত। বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে চলে এলুম। তোদের প্রতিবেশী গোবর্ধন মিশ্রর কাছে খোঁজ করে তোর ক্লিনিকের ঠিকানা পেলুম। মন কেমন করছিল রে সবায়ের জন্য, কিন্তু ওই বাড়িতে আমি তো আনওয়ান্টেড কলঙ্ক। কিছুক্ষণ থেমে, মাথা নামিয়ে অমিত বলল, ওই বাড়িতে আমি একজন বেজন্মা।

—স্টপ ইট, ভাট প্যাঁদাসনি। কেউই তোকে বেজন্মা বলেননি।

—তা না হলে তোর সঙ্গে আমার সম্পর্কের স্বীকৃতি দিতে বাধা ছিল কোথায়? আমার বাবার চেয়ে আমার মা দশ বছরের বড়, আর আমার মা আমার বাবার স্ত্রী নন, অন্য আরেকজনের স্ত্রী, এই তো? এই কারণেই তো ওনাদের আপত্তি?

ইতু চিৎকার করে উঠল, না, না, না, না। ক্লিনিকে বসে অমনভাবে চেঁচিয়ে ফেলে, হুঁশ হল, যে, ফুটপাথ দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা ওর দিকে অবাক ঔৎসুক্যে তাকাচ্ছে, সম্ভবত ভাবছে যে এ কেমন ডাক্তারনি, রোগিকে বকুনি দিয়ে ভয় পাওয়াচ্ছে। উঠে গিয়ে শাটার নামিয়ে, অমিতের মুখের কাছে মুখ এনে ইতু বলল, ওনাদের বক্তব্য ছিল আমরা দুজনে ছোটোবেলা থেকে ভাইবোনের মতো বড়ো হয়েছি, আমরা বিয়ে করলে ভাইবোনের বিয়ে বলে মনে করবে পাড়াপড়শিরা, বলেছিলেন সকলে। আফটার অল রাঙাকাকু-রাঙাকাকিমা তোর দায়িত্ব নিয়েছিল, ছেলের মতন মানুষ করছিল, তাই। শুনে রাখ, তুই যদি আমার মায়ের পেটের ভাইও হতিস, ইনসেসচুয়াস হলেও, তোর সঙ্গেই রিলেশানশিপ করতুম, কিংবা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে তোর সঙ্গে লিভ ইন করতুম।

—তুইও জানিস, আমিও জানি ইতু, তোদের বাড়িতে কী ধরণের ট্রিটমেন্ট হতো আমার। তারপর যখন ওনারা জানতে পারলেন যে তুই আমাকে ভালোবাসিস তখন ওনারা ঘেন্না আর রাগ সামলাতে পারেননি।

অমিতের জামার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তাই তুই আমাকে ফেলে পালিয়ে গেলি; ইনফর্মটুকু করতে পারলি না? বেশ ককিয়ে কেঁদে ফেলল ইতু, ফিরে গিয়ে বসল নিজের চেয়ারে, টিশ্যু দিয়ে চোখ পুঁছল, মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, কাওয়ার্ড রেনিগেড।

অমিত : আমি আমার বাবা আর মায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলুম রে, বিশ্বাস কর, ওনাদের কাছ থেকে জবাবদিহি পাওয়া জরুরি ছিল। কেন ওনারা জাস্ট একজন বন্ধুর বাড়ি আমাকে ডাম্প করে চলে গেলেন, তাও সেই বন্ধু নিজেই কিডন্যাপ হয়ে গিয়েছিল বলে যে বাড়ি তার বউ-বাচ্চাকে স্বীকৃতি দেয়নি।

চেয়ার ছেড়ে অমিতের কাছে পৌঁছে, এবার ওর দীর্ঘ চুল দু’হাতে ধরে ইতু বলল, তাই বলে তুই আমাকে ডিচ করবি? আমি কি দোষ করেছিলুম? আমিই বা কোন রাজকন্যার মতন আছি ওই বাড়িতে?

অমিত : ডাক্তার হয়েছিস তো! কনভেন্ট এজুকেশান ঝাড়ার অভ্যাস ছাড়তে পারিসনি দেখছি।

ইতু : এটা ডাক্তারি? ভালো করে পড়েছিস বাইরে সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে, ইউ ফুল? বাবা-মা অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবার দরুণ এক বছর এম বি বি এস পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আমি যেটা করেছি সেটা অলটারনেটিভ মেডিসিন। রোগি আসে না, যাও দুচারটে আসে তারা দ্বিতীয়বার আসে না, কেননা আমি রাংতায় মোড়া অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ দিই না।

অমিত : মিশ্রাজির কাছে শুনেছি, তোর মা-বাবার অ্যাকসিডেন্টের কথা। হ্যাঁ, সাইনবোর্ড দেখেছি, তুই অলটারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তার। বাবা-মায়ের খোঁজে গিয়েছিলুম, অথচ সে বিষয়ে জানতে চাইছিস না? কেবল নিজের চিন্তা করছিস?

ইতু, মুঠো থেকে অমিতের চুল আলগা করে বলল, তুই ছাড়া আমার আপন বলতে কে আছে বলতো ওই ফাকিং একান্নবর্তী পরিবারে? আই অ্যাম সরি, এতদিনে তোকে পেয়ে ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে গিয়েছিলুম। তোর বাবা-মা কোথায় আছেন? খুঁজে পেয়েছিস ওনাদের? কী করে পেলি?

অমিত : আমাকে কথাই বলতে দিচ্ছিস না। বোস, গিয়ে নিজের চেয়ারে বোস। তোকে আমার দরকার।

অমিত : বাবা আর মা দুজনকেই খুঁজে পেয়েছি। মায়ের হাজবেন্ডকেও খুঁজে পেয়েছি।

অমিত : আমার মা এই বয়সেও সুন্দরী, পাকাচুল-সুন্দরী। শি ইজ সো সিরিন অ্যাণ্ড ডিগনিফায়েড, কী বলব তোকে, কিন্তু ডিসট্যান্ট, হ্যাঁ, এক্সট্রিমলি ডিসট্যান্ট। জানিস, আমি কলকাতায় নার্সিং হোমে জন্মেছিলুম। নার্সিং হোমের আর কলকাতা কর্পোরেশানের বার্থ সার্টিফিকেট আছে রাঙাবাবার কাছে, অথচ, কখনও সে কথা বলেনি আমাকে। বার্থ সার্টিফিকেটে আমার নাম অমিত বর্মণই লেখানো হয়েছিল।

ইতু : এই ডাফার, পা দোলাসনি, পা ব্যথা করছে তো চেয়ারে পা তুলে বোস।

অমিত : ওকে, ওকে, পা তুলেই বসছি। যেদিন সকালে তোদের বাড়ি ছাড়লুম, সোজা বাবার অফিসের কর্মীদের কাছে গিয়েছিলুম, বাবার কনটেমপোরারি একজন বললেন, যে উনি কোনো নকসল্লি ফ্যাকশানের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলেন। অফিসের এক ক্লাস ফোর স্টাফের কাছে রসিক পাসওয়ান নামে এক পিওনের নাম-ঠিকানা পেয়ে তার কোচাগাঁও গ্রামের দলিত টোলার বাড়িতে গিয়েছিলুম; সে ওই ফ্যাকশানে ছিল। গিয়ে শুনলুম যে রসিক পাসওয়ান পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আশঙ্কা করেছিলুম যে তাহলে বাবাও হয়ত মারা গিয়ে থাকবেন আর মাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া হয়ে থাকবে।

অমিত : ওয়ারিস আলি গঞ্জে স্টেশানে বসে ভাবছিলুম যে এর পর কী করব, কোথায় সুত্র পাবো, যাবোই বা কোথায়? গর্দানিবাগের বাড়িতে বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় নাকি বলে গিয়েছিলেন যে ওনার আর আমার মায়ের খোঁজখবর যেন কখনও করা না হয়। বাড়িতে কেউ কখনও আলোচনা করেনি; করল প্রথম যখন ওনারা তোর-আমার সম্পর্কের কথা জানতে পারল। আমার বাবার নাম অতনু চক্রবর্তী আর মায়ের নাম মানসী বর্মণ, ওনারাই সেদিন উত্তেজনার মুখে বলেছিলেন, মনে আছে তোর? আমি তোর রাঙাকাকুকে কতবার জিগ্যেস করতুম যে আমার পদবী বর্মণ কেন, উনি এড়িয়ে যেতেন, বলতেন কী করবি জেনে।

অমিত : স্টেশানে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল পরের ট্রেনের জন্য। ভাবছিলুম শালা যে ট্রেনই আসুক, যেখানেই যাক, চেপে যাব। হঠাৎ কাঁধে কেউ একজন হাত রাখতে, পেছন ফিরে দেখি, বুড়োটে কদমছাঁট বিহারি, মাথায় লাল গামছা বাঁধা, বলল যে তুমি রসিক পাসোয়ানকে খুঁজছ কেন? আমি বললুম, উনি আমার বাবাকে আর মাকে চেনেন, তাই, আমি ওনার কাছে জানবার জন্য এসেছিলুম যে আমার বাবা-মাকে কোথায় পাবো, তাঁরা বেঁচে আছেন কি না। উনি বললেন, তোমার মুখ অনেকটা তোমার বাবার মতনই। আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি কে, আমার বাবা-মাকে চেনেন?

অমিত : উনি বললেন ওনার নাম রসিক পাসওয়ান। ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেই একই দলিত টোলায়, সেই বাড়িতেই, যেখানে আমাকে বলা হয়েছিল যে রসিক পাসওয়ান মারা গেছে। রসিক পাসওয়ান নামে সত্যি একজন মারা গিয়েছিল পুলিশের সঙ্গে নকসল্লিদের লড়াইতে, কিন্তু সে অন্য রসিক পাসওয়ান।

ইতু : যাই হোক, বাবা মাকে কোথায় পেলি, কী করেই বা পেলি? ওনাদের বাড়িতেই ছিলি এতকাল? আমাকে নিয়ে চল, আমি তোর সঙ্গে ওনাদের বাড়িতেই থাকব।

ইতু : আমার আর এখানে একদম ভাল্লাগছে না। এখানে থাকতে হলে আমি মরেই যাবো।

অমিত : আবার তুই নিজের প্রসঙ্গে ফিরে এলি। বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা হল, সে কথা তো জানতেই চাইছিস না। রসিক পাসওয়ান বলল যে আমার বাড়িতে দুচারদিন থাকো, আমি খোঁজখবর নিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো ওনাদের কাছে। দশ দিন থেকে গেলুম।

ইতু : একজন অচেনা বিহারির বাড়ি দশ দিন থেকে গেলি? তোকে কিছু করেনি তো?

অমিত : আমাকে আবার কী করবে? আমার কাছে পয়সাকড়িও ছিল না তেমন যে লুটপাট করে কেড়ে নেবে। বটঠাকুমা মাঝে-সাঝে যে হাতখরচ দিতেন সেটুকু জমানো টাকাই ছিল। রসিক পাসওয়ানের সঙ্গে দেখা না হলে ভিক্কে করতে হত।

ইতু : তা নয়। যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলি তখন খিচ্চা-কওলা-চিকনা-লালটু, ইনোসেন্ট-ইনোসেন্ট টাইপ, ছিলি। ওইসব এরিয়ায় ছেলেদের সঙ্গে জোর করে সেক্স করে শুনেছি। এই ক’বছরে অবশ্য রোদে পুড়ে কিছুটা চেবানো-চোয়াড়ে আর ছিবড়ে-মাসকুলার হয়ে গেছিস, যে জন্য দেখামাত্র চিনতে পারিনি।

অমিত : আমি সিরিয়াস আলোচনা করছি আর তুই তার মাঝে গল্পগাছা নিয়ে আসছিস। লোকটা আর ওর বউ অনেক ভালো। তোদের বাড়িতেও আমার অমন আদর-যত্ন হয়নি। দশদিন পরে, সকালে আমরা বাসে করে গেলুম গয়া। গয়া থেকে ট্রেনে করে লাতেহার, ওটা ঝাড়খণ্ডে পড়ে। দিনের বেলাটা তেতিয়া বিরহোর নামে একজন আদিবাসীর মাটির বাড়িতে কাটিয়ে বিকালে হাঁটা দিলুম তিনজনে। সারারাত উবড়-খাবড় রাস্তা ঠেঙিয়েছি, ভেবে দ্যাখ।

অমিত : পৌঁছোলুম কাতিয়া নামে একটা জঙ্গলে, রিয়্যাল ঘন-জঙ্গল, গাছের পর গাছ আর ঝোপঝাড়। তাতিয়া ফিরে গেল; আমাদের আরেকজন কম বয়সী আদিবাসীর জিম্মায় দিয়ে, তার নাম ঝুনাই। সেখান থেকে অনেকটা ওপর দিকে উঠে, অনেকটা, অনেকটা, জঙ্গলের আরও ভেতরে গিয়ে ঝুনাই ফিরে গেল। আরেকজন, তার নামও তেতিয়া, আমাদের নিয়ে গেল আরও ভেতরে খোলামতন একটা জায়গায়, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতন অমন একটা খোলা জায়গা রয়েছে, ন্যাচারাল জায়গা। কয়েকটা পলিথিনের তাঁবু দেখতে পেলুম, দু’জন লোক কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। কীরকম তাঁবু জানিস, তোর ক্লিনিকের একটু আগে ফুটপাথে চায়ের দোকান আর ভাতের দোকানে যেমন পলিথিনের তেরপল আছে, তেমন। একটা তাঁবুতে ঢুকে তেতিয়া আস্তে ডাক দিতে, একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন, তিনি বললেন, আবার ম্যালেরিয়া হল নাকি রে, সেরে তো গিয়েছিলি। তেতিয়ার পেছনে আমাদের দেখতে পেয়ে রসিককে বললেন, আচ্ছা, রসিক একজন নতুন ছাত্র এনেছে বলে মনে হচ্ছে। মাস্টারসাহেবকে খুঁজছ তো? উনি ওইদিকের ছাউনিটায় মিটিং করছেন। শুনেছ তো কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল-এর লোকেরা জওয়ানদের শব তোলার কাজে কয়েকজন গ্রামবাসীকে লাগিয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বোমা ফেটে মারা গেছে আর কয়েকজনের অঙ্গহানি হয়েছে।

ইতু : জঙ্গলে স্কুল-মাস্টার কী করেন রে?

অমিত : ধৈয্য ধর না, সবই তো বলছি। ওই মহিলা আমার মা আর মাস্টারসাহেব আমার বাবা।

ইতু : মাই গড! আমি যাবো ওখানে, তুই আমাকে আজই নিয়ে চল। আমি ওনাদের বলব যে আমি তোকে চাই বলে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিস, তোর কোনো দোষ নেই।

অমিত : মা আমাকে দেখে চিনতেই পারলেন না যে আমি ওনার ছেলে; শালা মাতৃত্ব নিয়ে লেকচারবাজি সবই ফালতু। আমার তক্ষুনি এত খারাপ লেগেছিল যে হয়ত কেঁদেই ফেলতুম। উনি হিন্দিতে বললেন, তোমাকে বেশ ডিপ্রেসড দেখাচ্ছে। অনেকটা হেঁটে এসেছ তো, ক্লান্ত হয়ে গেছ, ওই শেডটায় যাও, মাস্টারসাহেব আছেন, যাও দেখা করে নাও, ক্লান্তি জুড়িয়ে নাও। রসিক পাসওয়ান ওনাকে বললই না যে আমি ওনার ছেলে। পাশের তেরপলে ঢুকেছি, রসিক পাসওয়ান ওনাকে লাল সেলাম মাস্টারসাহেব বলতেই, উনিও একইভাবে প্রত্যুত্তর দিলেন, আর আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন, গভীরভাবে আমার মুখের পানে তাকিয়ে দেখে তক্ষুনি জড়িয়ে ধরলেন, বাংলাতেই বললেন, এখানে কেন এলে, যেখানে ছিলে ভালোই তো ছিলে। তুমি আমার ছেলে, ওনারা নিশ্চয় তোমাকে বলে থাকবেন, যে কারণে তুমি কমরেড রসিককে সন্ধান করে এখানে ছুটে এসেছ, দাঁড়াও তোমার মাকে ডাকছি, উনি প্রায়ই তোমার প্রসঙ্গ তোলেন আর বলেন যে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিলুম আমরা। আমি বললুম যে আমার নাম অমিত। ওনাকে ঘিরে যে আদিবাসীরা ছিল, জিগ্যেস করল, আপকা বেটা? বাবা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু হারিয়ে-যাওয়া ছেলেকে দেখে একজন বাবার যেমন রিঅ্যাকশান এক্সপেক্ট করেছিলুম, তেমন প্রতিক্রিয়া হল না দেখে, মনটা খারাপ হয়ে গেল, ডিফিটেড ফিল করলুম রে।

অমিত : উনি বলতে লাগলেন, আমি কিন্তু মনে করি কিছুই ভুল করিনি। দেখছ তো অঞ্চলটা? এখানে একজন শিশুকে লালন করা অসম্ভব। উনি তারপর মানসী মানসী বলে কয়েকবার ডাক দিতে আমার মা এলে, বাবা বললেন, একে চিনতে পারছ? তোমার ছেলে। মা আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, আমিও মায়ের দিকে। উনি কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, ব্যাস, জীবনে প্রথমবার নিজের গ্রোনআপ ছেলেকে দেখে, জড়িয়ে, কাঁদাবার কথা। উল্টে, আমারই কান্না পেয়ে গেল। মায়েরা জড়িয়ে ধরলে মগজের মধ্যে যে তুফান আরম্ভ হয় তা জানতে পারিনি কখনও। মা বললেন, তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ, জবাবদিহি চাইতে, না? আমার কাছে দেবার মতো ব্যাখ্যা নেই। আমি জবাবে বলেছিলুম, আপনি আমাকে এভাবে অনেকক্ষণ জড়িয়ে থাকুন, তাহলে আমার কান্না পাবে না। ওনার হৃৎস্পন্দন যে দ্রুত হয়ে চলেছে, তা টের পেয়ে মনে হচ্ছিল যে যাক, জবাবদিহি পাওয়া গেল। দূরত্ব কিন্তু থেকেই গেছে রে।

অমিত : বাবা বললেন, মানসী, ডাক্তারসাহেবের কাছে নিয়ে যাও ওকে, দেখাও তোমার ছেলে কত বড় হয়ে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, অমিত, তুমি এখানেই থাকবে, আমাদের সঙ্গে কাজ করবে, আর ফিরে যাবার দরকার নেই।

অমিত : মা আমাকে অন্য একটা পলিথিনের তেরপলে নিয়ে গেলেন। সেখানে রোগা, পাকাচুল, চশমাপরা, ফর্সা একজন বসে টেবিলে কিছু লিখছিলেন, তাঁর সামনে দুজন আদিবাসী বসেছিল। মা তাঁকে বললেন, একে চিনতে পারছ? এ আমার ছেলে। উনি এমনভাবে আমার ছেলে কথাটা বললেন যে বুঝতে পারলুম তার ভেতরে গোপন গর্ব লুকিয়ে আছে, আর কিছুটা ওই পাকাচুল লোকটার প্রতি অবজ্ঞা। লোকটা উঠে আমার মুখের কাছে মুখ এনে চশমা কপালে তুলে বলল, তুই কমরেড অতনুর ছেলে? কী নাম রেখেছে তোর, অমিতই আছে তো? ডাক্তারসাহেবের কথা শুনে আমার বেশ ভালো লাগল রে। বাবা-মা তুমি-তুমি করে কথা বলছিলেন, ইন ফ্যাক্ট আজও ওনারা আমার সঙ্গে তুমি-তুমি করে কথা বলেন, আর আমি ওনাদের আপনি-আপনি করে কথা বলি, কিছুতেই তুমি বেরোয় না মুখ থেকে। বুঝতে পারি যে ওনারা একটা অদৃশ্য পর্দা টাঙিয়ে আলাদা করে রেখেছেন আমাকে।

ইতু : আমি হলে দেখা হতেই বলতুম, মা, বাবা, তোমরা আমাকে অন্যের কোলে ফেলে দিয়ে আর কখনও ফিরে তাকাওনি কেন। তারপর কী হল? ঘ্যাঙাচ্ছিস কেন, শিট, তাড়াতাড়ি বল? তুই ওনাদের সঙ্গেই ছিলি এতকাল? কী করতিস? আমায় কবে নিয়ে যাবি?

অমিত : হ্যাঁ, থেকে গেলুম। ডাক্তারসাহেব কী করেন জানিস? যে সব আদিবাসী ছেলেরা স্কুলে ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত পড়েছে, তাদের ডাক্তারির প্রথমপাঠ পড়ান, অ্যান্টিবায়টিক দেয়া, কখন অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ দিতে হবে, ইনজেকশান দেয়া, ওষুধের নাম, জখম হলে কী ভাবে পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে, এইসব। গরিবদের জন্য, বিশেষ করে আদিবাসীদের জন্য কিলোমিটার-কিলোমিটার তো ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাই হাতে-নাতে প্রাথমিক ডাক্তারি শিখে তারা গ্রামে-গ্রামে ডাক্তারি করে, বেয়ারফুট ডাক্তার।

ইতু : আর তোর বাবা-মা, ওনারা ওই জঙ্গলে কী করেন?

অমিত : বাবা ক্লাস নেন, আদিবাসী ছেলে-মেয়ে-জোয়ান সবায়ের। হিন্দি, ইংরেজি আর অঙ্ক শেখান। এছাড়া উনি রাজনীতি সম্পর্কে সহজ বিশ্লেষণ করে বোঝান কেন গরিবরা ষাট বছর পরও গরিব থেকে গেল; তা থেকে মুক্তি পেতে গেলে কী করতে হবে, এইসব তত্ত্বকথা। ওনারা কিন্তু একই জায়গায় থাকেন না; প্রায় রোজই পলিথিনের তাঁবু আর জিনিসপত্তর গুটিয়ে অন্য কোথাও তাঁবু খাটান। বন্দুকধারীরা পাহারা দ্যায়, কুচকাওয়াজ করে, বন্দুক চালাতে শেখে। অনেক লোক আছে, প্রথম দিন কোনো আইডিয়া হয়নি। একটু-একটু করে জানতে পারলুম।

ইতু : আর মা?

অমিত : মা যে ঠিক কী করেন জানি না। আমি তো বাবার তাঁবুতে শুই। মাঝে-মাঝে অলিভ রঙের পোশাকে বন্দুকধারী লোকজন আসে, তারা মায়ের সঙ্গে খুসুরফুসুর কথা বলে, তারপর চলে যায়। সাধারন পোশাকের বন্দুকধারীও দেখেছি আসতে। তখন ওনার ছাউনিতে ঢোকা নিষেধ। বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলুম যে লোকগুলো কারা, কেন আসে, উনি বলেছিলেন, সময় হলে জানতে পারবে, যদি বোধবুদ্ধি গড়ে ওঠে তাহলে তোমাকে ওই কাজগুলোই করতে হতে পারে যা তোমার মা এখন করছেন। আপাতত তুমি দেখতে থাকো আমি কী ভাবে পড়াই, কোন বই পড়ি; তুমি সেই বইগুলো পড়ো। মাঝে-মাঝে আমিও অঙ্কের ক্লাস নিই, বাবা উপস্থিত থাকেন, আমাকে গাইড করেন। ব্যাস ওইটুকুই, উনি বাবার মতন বিহেভ করেন না। তত্ত্বফত্ত্ব যতটা বুঝেছি, সব ফালতু।

ইতু : হাঃ, তুই ক্লাস নিস, পড়াশুনায় লো সেকেন্ড ক্লাস! যাকগে, পড়াচ্ছিস, পড়া। তুই তো বললি এই বয়সেও তোর মা অপরূপ সুন্দরী?

অমিত : হ্যাঁ, সত্যিই সুন্দরী; চুল পাকলেই বা। আমি ওনাকে একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলুম যে, আপনি তো ডাক্তারসাহেবকে ডিভোর্স দিয়ে বাবাকে বিয়ে করলেই পারতেন, তাহলে আমাকে জন্মের গঞ্জনা শুনতে হতো না। উনি কী বললেন জানিস?

ইতু : কী?

অমিত : বললেন, আমি অতনুর এত কাছে চলে গিয়েছিলুম, এত ভালোবেসে ফেলেছিলুম যে বিয়ের প্রয়োজন ছিল না; অতনুও বাড়ি-চাকরি সবকিছু ছেড়ে আমার খোঁজে বেরিয়ে চলে এসেছিল আমার আস্তানায়, তখন আমি আর ডাক্তারসাহেব নওয়াদায় থাকতুম। বললেন, তুমি আমাদের প্রেম থেকে জন্মেছ, গতানুগতিক দৈহিক সম্পর্ক থেকে নয়। তোমার ছোটোবেলায় যদি আমাদের সঙ্গে তোমাকে রেখে মানুষ করতুম তাহলে আমরাও গতানুগতিক সম্পর্কের রুটিনে জড়িয়ে পড়তুম। দেশের জন্য, মানুষের জন্য, যে স্বপ্ন দেখি, তা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠত।

ইতু : হোয়াট ডাজ শি মিন? উনি একটা পোয়েটিক অ্যালিবাই খাড়া করে তোকে বুঝিয়ে দিলেন, আর তুই বুঝে গেলি? রাবিশ। আমি তো তোর ফ্লেশকে আমার ফ্লেশ দিয়ে কারনিভোরের মতন ভালোবাসি। তুই যখন চলে গেলি তখন এমন হয়ে গিয়েছিল যে তোকে রাস্তায় পেলে সত্যি খুন করে ফেলতুম। একদম ভেঙে পড়েছিলুম।

অমিত : এখন সামলে নিয়েছিস তো? আমার বাবাকে তোর কথা বলেছিলুম। উনি বলেছেন, তুই যেহেতু আমার বিশ্বাসের পাত্রী, আমাদের হয়ে কাজ করতে পারবি।

ইতু : কাজ? না, না, আমি তোর সঙ্গে যেতে চাই, কাজ-ফাজ করার হয় ওখানে গিয়ে করব, তোর মাকে হেল্প করব, ডাক্তারি করব, আমি তো বেয়ারফুট ডাক্তারের চেয়ে বেশি কমপিট্যান্ট। আমি যে-কোনো অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি, তুই তা জানিস। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস মিনিংলেস লাইফ।

অমিত : মানুষের-সেবা, সমাজের-সেবা, গরিবদের সেবা, ওয়েলবিইং অফ ম্যানকাইন্ড, এইসব বক্তৃতা ঝাড়তিস, আর এখন শুধু আমার সঙ্গে যাবার বায়না করছিস। তুই যাবি, তবে এখনই নয়। এখন তুই বাবা-মার জন্য কিছু-কিছু কাজ করবি। সহজ, কিন্তু বিপজ্জনক কাজ। তোর ক্লিনিকে মাঝে-সাঝে একজন লোক সবুজ বা নীল টিশার্ট পরে খাম দিয়ে যাবে, তুই সেটা নিজের কাছে রাখবি, পরে ধূসর বা ছাইরঙের টিশার্ট পরা একজন লোক এসে ওটা কালেক্ট করে নেবে। এটা অত্যম্ত গোপন কাজ; এ-বিষয়ে তুই কখনও কারোর সঙ্গে আলোচনা করবি না। ভেবে নে, চিন্তা করে বল। আবার বলছি, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। যদি ওৎ-পাতা পুলিশ তোকে ওই খামসুদ্দু ধরে তো কী যে হবে তা জানিস তো, মেয়েদের ধরে লকাপে যা-যা হয়।

ইতু : তোর জন্য সবকিছু করতে পারি। ধরেবেঁধে রেপও যদি ওরা করতে চায়, তো করবে। কিন্তু, দাঁড়া, স্তোক দিয়ে তুই কেটে পড়ছিস না তো?

অমিত : না। বি সিরিয়াস। এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ইয়ার্কি হাসিঠাট্টার নয়।

ইতু : তাহলে বাড়ি চল। চান-টান করে খেয়ে-দেয়ে তারপর যাস। আমি স্কুটার কিনেছি, চল না একবার পুরো গান্ধি ময়দানের চক্কর মেরে গোলঘরের পেছন দিয়ে ঘুরে আসি; তুই জড়িয়ে বসে থাকবি, আর আমি হ্যাপি ফিলিং নেবো। চল, চল।

অমিত : কী যে বলিস, এমনিতেই আমি ক্লান্ত। ওই বাড়িতে আমি আর ঢুকতে চাই না রে।

ইতু : সুশান্তজেঠু অত অপমান সহ্য করে, হেনস্থা সহ্য করে, অবহেলা সহ্য করে আসেন। তোকে তো শুধু বলা হয়েছিল যে আমি তোর বোন, তুই যাদের ছেলে তারা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করেনি। তোর তো একটা স্পেস আছে বাড়িটায়। এত তাড়াতাড়ি হেরে যাবি কেন? বি পজেসিভ অ্যাণ্ড অ্যাগ্রেসিভ লাইক মি। বটঠাকুমা আর অন্নমা তো তোকে ভালোবাসেন। ওনারা দুজনে কাঁদছিলেন, যেদিন তুই বাড়ি ছেড়ে চুপচাপ কেটে পড়লি। চল, চল।

অমিত : ঠিক আছে, চল তাহলে, দেখি ওনাদের প্রতিক্রয়া, আমি তো জন্মেছি লাৎখোর হয়ে, অপমান-ফপমান সব মাথার ভেতর থেকে হাপিশ করে দিয়েছি।

ইতুর স্কুটারে বসে অমিত ওদের বাড়িতে পৌঁছলে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া তেমন হল না। বটঠাকুমা আর অন্নমা বুকে জড়িয়ে আদর করলেন অমিতকে। বললেন, যে যাই বলুক, যতদিন আমরা দুই বুড়ি বেঁচে আছি ততদিন তুই এই বাড়ির ছেলে। যা চান-টান করে আয়, ব্রেকফাস্ট করা হয়নি তো?

ইতু টয়লেটে টাওয়েল সাবান রেখে এসেছিল। সুশান্তজেঠুর মা টয়লেটে সুশান্তজেঠুর সযত্নে রাখা অতিপুরোনো পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি রেখে এলেন। স্নান করে আসার পর ডাইনিং টেবিলে অমিতকে ঘিরে বাড়িতে উপস্থিত সবাই ওর উধাও হয়ে যাবার গল্প শুনতে চাইছিলেন, হয়তো ওনাদের অভিনয়। রাঙামা লুচি ভেজে নিয়ে এলেন, সঙ্গে আগের দিন ইতুর রাঁধা আলু দিয়ে ডিমের ডালনা, আর আচার। অমিত ভাবল, একবার জিগ্যেস করে, ওর পোশাক-আশাক জামাকাপড়গুলো কী হল, যে সুশান্তজেঠুর কম বয়সের পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরতে হচ্ছে। আর কী-ই বা হবে, যাকগে, আমি তো আউটসাইডার, নিজেকে বলল।

—সত্যিই আমি ভবঘুরে সাংবাদিক হয়ে গেছি, ঘুরে বেড়াই, আজ এখানে, কাল সেখানে, কোনো নির্দিষ্ট জায়গা আর নেই। আমি কিন্তু আজকেই চলে যাব। অমিতের অভিনয়, সংলাপ।

—আজ আর যেতে হবে না, কত দিন পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলে বাড়ি ফিরল, বললেন বটঠাকুমা। এটা কি তোর বাড়ি নয় নাকি, বল, আমরা কি তোর পর? আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর ওনার ঘরটা তো পড়েই আছে, আমি আর ওই ঘরে শুতে পারি না, ইতু শোয়, বললেন সুশান্তজেঠুর মা।

—হ্যাঁ, আমি এই বাড়ির মিউজিকাল চেয়ার। একজনের বিয়ে হয়, তার জন্য ঘর ছাড়তে হয়, আবার আরেকজনের বিয়ে বা বাচ্চা হয়, বা কারোর পরীক্ষা, ব্যাস, নির্দেশ আসে, ইতু এবার বারান্দায় শো, দালানে শো, রান্নাঘরে শো, ডাইনিং টেবিলের পাশে শো, সিঁড়ির তলায় শো। রাঁধুনি না এলে, এটা রাঁধ, সেটা রাঁধ। জমিয়ে রাখা ক্ষোভ চারিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করল না ইতু।

—ওঃ, এই অবস্থায় আমি কেন আবার জমির লড়াইতে শরিক হই। অমিতের কথায় পরিবেশ ফিরল স্বাভাবিকতায়। বলল, বহুকাল বাড়িতে তৈরি লুচি আর ডিমের ডালনা খাইনি। দুপুরে আর লাঞ্চ করার দরকার হবে না। অমিতের অভিনয়, সংলাপ।

—বাড়ির রান্না খাসনি বলছিস, দুপুরে মাছের ঝোল আর ভাতও তো খেতে হবে তাহলে। বলল ইতু, তারপর অমিতকে বলল, চল মাছের বাজারে যাওয়া যাক, তোর পছন্দের মাছ কেনা যাবে। লুঙ্গি পরেই চল, লজ্জা পাসনি, নেতারা পর্যন্ত লুঙ্গি পরে গান্ধি ময়দানে ভাষণ দিচ্ছে, মিছিলে হাঁটছে, অমিতের হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বলল ইতু। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তুই এসেই যাই-যাই করছিস কেন বলতো?

সিঁড়ির পাশের স্লোপ দিয়ে স্কুটার নামাতে-নামাতে বাড়ির উল্টো দিকের গেটের দিকে মুখ তুলে ইতু বলল, মিশ্রাজির ছেলেটা অন্ধকার থাকতে সকাল পাঁচটা থেকে মারুতি গাড়ি রিভার্স করতে শেখে আর ঘুম ভাঙিয়ে দ্যায়, রিভার্স হর্নে ভোর থেকে একঘেয়ে সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা বাজায়।

একদিকে পা ঝুলিয়ে বসার কারণে ইতুর পেটে অমিতের জাপট কিছুটা নিকটতর হল। ইতু বলল, এই, নাভিতে সুড়সুড়ি দিসনি, ব্যালান্স গোলমাল হয়ে যাবে। অলরেডি তুই আমার জীবনের ব্যালান্স গোলমাল করে দিয়েছিস।

— মাছের বাজার এসে গেছে, নাম আর বল কোন মাছ খেতে চাস। তখন প্রস্তাব দিয়েছিলুম যে শহরটা এক পাক ঘুরে নিই, রাজি হলি না, ফর হোয়াটএভার রিজনস।

—বলব আবার কি, ইলিশ পাওয়া গেলে ইলিশ কেন, খেয়ে নিই, কে জানে আবার কখনও খাওয়া হবে কিনা, ইলিশ কেমন দেখতে তা-ই তো ভুলে গেছি।

ইলিশ কিনে, কাটিয়ে, স্কুটারে পা ঝুলিয়ে বসে, অমিত বলল ইতুকে, রাতটা থেকেই যাবো, বুঝলি। তোকে কিছু-কিছু দায়িত্ব দিয়ে যাবো।

—তোর নিজের দায়িত্বটাই দে না, এত ভিতু কেন তুই? অমিতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল ইতু। গান গাইতে শিখিনি, নয়তো মন খুলে একখানা পেলব-পেলব ঢিললা-হিললা টাইপ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতুম। কোন গান জানিস?

—না, কী করে জানবো? স্কুলের বন্ধুরা তো সব ছিল হিন্দি গান আর হিন্দি সিনেমার কীট। রাঙামা হিন্দি টিভি সিরিয়ালের পোকা। নবনীতাবৌদি গিটারে হিন্দি ফিলমের সুর বাজাতো।

—হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে…

—শুনতে পাবে পাবলিক। মাছের বাজার মানেই বাঙালির জমায়েত; অনেকে তোকে-আমাকে ভালোই চেনে; হয়ত আমাদের রিলেশানশিপের খবরও ছড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে।

—বুলশিট, তুই এখনও আমাকে নেগলেক্ট করার ডিজাইন বজায় রেখেছিস কেন বল তো? তোর দায়িত্ব চাইছি বলে ভয় পেয়ে গেলি নাকি, কাওয়ার্ড?

—ক্লাস টেন থেকেই তো কত ছেলে তোকে লাইন মারত, নিজেই ঢিল দিসনি, নয়তো দায়িত্ব পেয়ে যেতিস এতদিনে। স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর লাইনে ভোর রাত থেকে দাঁড়িয়ে থাকতিস।

—স্টপ ইওর জিবারিশ। যত্তোসব ফালতু ছোকরার দল। তোর তো ক্লাস টেনেই গোঁফের রেখা আবছা বেরিয়ে এসেছিল, তবু তুই লাইন মারার সাহসটুকু দেখাতে পারিসনি। আমি না এগোলে তুই বোধহয় চেপেই রাখতিস নিজেকে।

—তখন বেশ ক্যাবলা ছিলুম রে, তোকে দেখলেই তোর বুকের দিকে চোখ চলে যেত, আড়ষ্ট ফিল করতুম, কথা বলতে পারতুম না, ভাবতুম কোন বিষয়ে কথা বলব। তাছাড়া, মগজে ঢুকে গিয়েছিল যে আমি তোদের বাড়ির চাকরের স্তরের। মালিকের মেয়েকে প্রণয়-প্রস্তাব কোন চাকরেই বা দ্যায়? ওসব নাটক-নভেলে হয়।

—শাট আপ, ইউ সাকার…, গালাগাল এসে যাচ্ছে মুখে।

—কেমন বোকা-বোকা কথা বলছি না আমরা?

—হ্যাঁ, বর-বউ হতে পারত কিন্তু হল না, এরকম একজোড়া বোকা-বোকির গল্প।

রাতে, খাওয়া-দাওয়ার পর, ইতুকে বলল অমিত, ও একটা মিটিঙে, বিহারশরিফে, এসেছিল, বাবার সঙ্গে।

—হোলি শিট, তোর বাবাও এসেছিলেন?

—হ্যাঁ। উনি তো মেশেন না কারোর সঙ্গে।

—দায়িত্বটা কী তা বললি না তো? বিছানায় বসে জিগ্যেস করল ইতি।

—এতো ঘেঁষে বসিস না, আবার গোলমাল হবে শেষকালে? ভাববেন, ছাড় দেয়া হয়েছে, ব্যাস, মাখামাখি করছে রাতদুপুরে।

—কারোর অমন মাথাব্যথা নেই; ওসব নিয়ে চিন্তা করিসনি। বরং তোর ঘাড়ে চেপে যদি কেটে পড়ি তো ওনারা বেঁচে যান। হয়তো ওনারা আমাকে এই স্পেসটা সেকারণেই ছেড়ে দিলেন। এখন দেখার যে তুই কীভাবে রেসপণ্ড করিস।

—এই তো সবে এতদিন পর দেখা হল, তুই বেশ ফ্রিলি গল্প করতে পারছিস, মনের কথা খুলে বলতে পারছিস। আগেই বলেছি, আমি যে কাজটা দেবো সেটা বেশ সিম্পল কিন্তু বিপজ্জনক। ভেবে উত্তর দিস। কাল সকালে আমার যাওয়া পর্যন্ত তোর হাতে সময় থাকবে।

—কী কাজ, শুনি, ঘোড়ার ডিম বিপজ্জনক। কাউকে বোমা মারতে বা গুলি মারতে বলবি নাকি? কিংবা সোনার বিস্কুট এখান-ওখান। তা আমি পারব না, আগেই বলে রাখলুম।

—বলেছি তো, মনে করে রাখ। তোর ক্লিনিকে বা বাড়িতে সবুজ বা নীল শার্ট বা টিশার্ট পরা একজন একটা চিঠি দিয়ে যাবে, হয়ত স্মার্ট নয়, বিহারি বা বাঙালি না-ও হতে পারে সে, ইংরেজিতে একটা-দুটো কথা বলে চিঠিটা দিয়ে চলে যাবে। তুই তা নিজের কাছে রেখে দিবি। পরে, দু-এক সপ্তাহের ভেতর বা মাসখানেক পরেও হতে পারে, ওই খামটা আরেকজন নিতে আসবে, তার গায়ে ছাইরঙা বা ধূসর শার্ট বা টিশার্ট থাকবে।

—ওঃ, ডাকবাক্সের কাজ, পারব না কেন? স্মাগলিং-টাগলিং নয়তো? যেরকম দাড়ি-গোঁফ বাবরিচুল চেহারা করেছিস, দেখে তো স্মাগলার বলেই মনে করবে লোকে। লুঙ্গি পরে তোকে মানিয়েও গেছে।

—না, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের কাজ।

—তুই আসবি না? তুইও তো আসবি, দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে, হলুদ টিশার্ট আর জিন্স পরে, স্মার্টলি। ফর মি?

—সিরিয়াস ইশ্যু।

—ওকে, টেকন। কিন্তু আমি কেবল তোর ওই প্রক্সিদের নিয়ে ডিল কোরবো নাকি? তুই যদি না আসিস তাহলে কেন বেগার খাটতে যাবো উটকো লোকেদের জন্য?

—তা-ই কর কিছুদিন। কিন্তু আবার বলছি, অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। ওই খামসুদ্দু তুই ধরা পড়লে যে ধরণের ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বি তা মোটেই সুখকর নয়।

ইতু নিঃশব্দে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলল, অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে। তারপর অমিতের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, দায়িত্ব নিলুম, কিন্তু এক শর্তে, ন’মাসে-ছ’মাসে তোকেও আসতে হবে। ইউ মাস্ট, আদারওয়াইজ দি ডিল ইজ ক্যানসেল্ড।

অমিত আবার এসেছিল, প্রায় এক বছর পরে, ক্লিনিকে, বিনা দাড়ি-গোঁফে, হলুদ টিশার্ট আর জিনস পরে, চোখে রোদ চশমা। তার মাঝে নীল-টিশার্ট ধূসর-টিশার্ট যুবকেরা ক্লিনিকে খাম দিয়ে গেছে আর নিয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার। ইতুর কি খাম খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়নি কী আছে ভেতরে? হয়েছে। কিন্তু সেলোটেপে মোড়া চিঠি খোলেনি। নিজেকে বুঝিয়েছে যে অমিতকে জানতে হলে ওর মুখোমুখি বসেই জানতে হবে, গোপন কাজকর্ম, তা যাই হোক, স্মাগলিং বা লুকিয়ে বেড়ানো বিপ্লব, না সিক্রেটিভ কোনো ধার্মিক কাল্ট, কথা বলে জেনে নিতে হবে।

অমিতের চেহারা বেশ রোদঝামা হয়ে গেছে, স্মার্ট পোশাক সত্বেও, আঁচ করল, ইতির মগজের ডাক্তার। অমিত ক্লিনিকে ঢুকে চেয়ারে বসে স্মিত হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলে, ইতি বলল, প্রায় শিশুর আদুরেপনা মিশিয়ে, তোর একটা খাম পড়ে আছে, কেউ নিতে আসেনি তো?

—খাম, কই দেখা, বিস্ময়ে বলল অমিত।

—এই যে, দ্যাখ, পড়ে আছে সেই কবে থেকে।

— কই দে তো, দেখি।

টেবিলের ওপর চারভাঁজ করা প্রেসকিপশানের কাগজে, দেখল অমিত, লেখা রয়েছে, ‘যদি বিপদ শেয়ার করি, তাহলে বেডশিট শেয়ার করব না কেন’? ইতি বলল, তারিখ দেখেছিস, ছয় মাস আগের। কত এক্সপেক্ট করেছি তোকে। ইন ফ্যাক্ট আমার এই ক্লিনিক চলে না, রোগি আসে মাসে হয়ত দুজন, কখনও আসেই না, তবু খুলে রেখেছি, স্রেফ তুই একদিন হঠাৎ আসবি বলে। আজ থেকে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেল। চল, বাড়ি চল, বাড়িতেও সবাই বলে যে কেন মাছি মারছিস বসে-বসে, ভাড়া গুনছিস, বাবার দেয়া জমানো টাকা নষ্ট করছিস। তারপর, প্রায় কান্নামাখা কন্ঠস্বরে বলল, কী করে ওনাদের বলতুম যে আমি তোর অপেক্ষায় বোকার মতন হাঁ করে বসে থাকি।

অমিত থ। অনুমান করতে পারেনি যে রহস্যময় খামগুলোর মাধ্যমে নৈকট্যকে বিপজ্জনক করে ফেলেছে। কাগজের লেখাটার দিকে তাকিয়ে, চুপ করে রইল। বলল, যে ভালোবাসার কথা বলছিস, তা আমি যে জীবন কাটাই, তাতে কতটা প্রযোজ্য, তা যারা এই জীবন যাপন করে কেবল তারাই বুঝতে পারবে। আমি তো ভবঘুরে, বলেইছিলুম তোকে। তোকে তো বলেছি কী ধরণের লাইফ লিড করছি। বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাঁদের সঙ্গে নেই, তাঁরা আমার কেউ নন। এখন মনে হয় আত্মপরিচয়ের সন্ধানে তাঁদের খোঁজে বেরোনোটাই ছিল ব্লাণ্ডার।

ইতি ক্লিনিকের চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলল, চল, চল, যেতে যেতে কথা বলা যাবে। ক্লিনিক আমি বন্ধ করে দিচ্ছি আজ থেকে, তোর এই মোবাইল ডাকবাক্সে বার্তা ফেলতে হলে মেসেঞ্জারদের আমার বাড়ি আসতে হবে। ইতুর কব্জি শক্ত করে ধরে অমিত বলল, তোর নির্দেশমতো যে পোশাক পরে এলুম সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলি না।

—তুই তাহলে শুনতে পাসনি; চোখ দিয়ে করা মন্তব্য শোনার মতন ইন্দ্রিয় হারিয়ে ফেলেছিস। বোতাম খুলে তোর বুকের চুলও দেখাচ্ছিস, তোর বুকে যে চুল গজিয়েছে কী করে জানব। তা জানার জন্যও তো করাঘাতের অধিকার দরকার, নয়কি, বিপদ শেয়ার করার অধিকার থেকে সামান্য পৃথক অধিকার?

—তোদের বাড়িতে চড়ুইপাখির বাসা আছে, মনে আছে, দালানের কড়িকাঠের ফাঁকে? কখনও লক্ষ করেছিস কি যে মাদি চড়ুইপাখিকে ইমপ্রেস করার জন্য পুরুষ চড়ুইপাখিরা তাদের কালো বুক দেখাবার প্রতিযোগীতা করে?

ক্লিনিকের শাটার নামিয়ে, তালা দিয়ে, ফুটপাতে নেমে, অমিতের দিকে তাকিয়ে ইতু বলেছিল, ঠিক কী বলতে চাইছিস বুঝতে পারলুম না। তুই কি বলতে চাইছিস যে তোর হৃদয় উনিশ শতকের গৌরবগাথায় বর্ণিত মসীলিপ্ত ভিলেনের মতন হয়ে গেছে? নাকি বলতে চাইছিস যে তুই মাদি চড়ুইপাখিটাকে জয় করতে এসেছিস? ভুলে যাচ্ছিস কেন যে মাদি চড়ুইপাখিটাই তোকে জয় করার জন্য যুদ্ধ করেছিল। ওহ, ইনটলারেবল, জাস্ট ইনটলারেবল।

—না সত্যিই অনুমান করতে পারিনি। না, অনুভব করতে পারিনি বললে যুৎসই হয়।

—বাঃ, আমার কথামতন পোশাক পরে এক বছর পর উদয় হলি, আর অনুভব করতে পারিসনি, ইউ সেল্ফসার্ভিং জোকার? নিজেকে ভুল বুঝিয়েই কি তুই তোর রহস্যময় জীবনকে মিনিংফুল করে তুলতে চাইছিস?

তারপর যোগ করল, স্কুটারটা বেচে দিয়েছি। ভাড়া গোনার জন্য টাকার দরকার ছিল। বলল ইতু, ফুটপাতে পড়ে-থাকা শালপাতার দিকে তাকিয়ে।

একটা রিকশাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলল অমিত। ইতু বলল, রিকশা ডাকছিস কেন, হাঁট না পাশাপাশি। চল গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি, কতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাইনি। গিয়ে বসি কিছুক্ষণ। কিছু কথা স্পষ্ট করে নে্য়া দরকার, বাড়িতে গেলে দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করতে হবে। প্রিভেসি নেই।

—বিশ্ববিদ্যালয়? গঙ্গার ধারের কথা ভাবছিস? কিন্তু গঙ্গা তো দূরে সরে গেছে, সরকার ভাবছে গঙ্গার ধার দিয়ে মেরিন ড্রাইভের মতন পথ বানাবে। তুই তোর শহরে থেকেও জানিস না, দ্যাখ, আমি বাইরে-বাইরে থাকি, থাকি বলা ভুল হল, অ্যাকচুয়ালি থাকিই না কোথাও, তবু জানি শহরের কথা।

—ও, তুই তাহলে শহরে আসিস, আর দেখা না করে কেটে পড়িস? আর ইউ চিটিং অন মি?

—না, শহরে আজকেই এলুম, সেদিনকার পর, এবারেও বাবার সঙ্গে নালান্দাতেই এসেছিলুম, এর-তার মুখে শহরের পরিবর্তনের কথা শুনতে পাই। তোর সঙ্গে দেখা করব বলেই এলুম পাটনায়। এত কাছে এসে ফিরে যেতে পারলুম না। মনের ভেতরের ব্ল্যাংক স্পেসটায় তুই ক্রমশ জায়গা করে নিয়েছিস, বাবা-মায়ের সঙ্গে তো এখনও আপনি থেকে তুমিতে যেতে পারিনি; ওনারাও তুমি থেকে তুইতে আসতে চাননি। শুধু তুই-ই একমাত্র যে আমার কাছে একই সঙ্গে তুমি আর তুই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমিত বলল, চল ওই অমলতাস গাছটার তলায় বসি, রাস্তার দিকে পেছন ফিরে বসা যাবে।

—কেন? আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে?

—তুই আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে, তোর সঙ্গে আমি নয়।

অমলতাসের হলুদ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো চারিদিকে। সিটের ওপর পাখিতে হেগে রেখেছে। তার ওপরই বসল দুজনে। অমিত জিগ্যেস করল, কী বলবি বল?

অতনুর হাত নিজের কোলে নিয়ে ইতু বলল, আমি সেল্ফ ডেসট্রয় করার জন্য ডেসপারেট হয়ে গেছি। জীবন সম্পর্কে তিতিবিরক্ত। জানি না কী করব। এনজিও জয়েন করার কথা ভাবি। কোনো পারপাস নেই জীবনে। এর চেয়ে কমার্স পড়লে টাকাকড়ির গুণ ভাগ যোগ বিয়োগ নিয়ে থাকতে পারতুম। বাবা-মা মারা যাবার পর আমি রাডারলেস হয়ে গেছি, কোনো নোঙর নেই। ওনাদের ইনশিওরেন্সের টাকাটা এখনও পেলুম না।

অমিতের হাত নিজের ঠোঁটের ওপর চেপে ধরেছিল ইতু, ছাড়িয়ে অমিত বলল, চল, তোর ক্লিনিক আরেকবার খুলতে হবে। পাটনা শহরের পথে, অমলতাস গাছের তলায়, এভাবে কাছ-ঘেঁষটে বসে থাকার চেয়ে তোর ক্লিনিকের নিভৃতি ভালো।

—হ্যাঁ, আমাদের বাড়ির দোতলার বারান্দার চেয়ে তো অবশ্যই ভালো। আসলে আমার কথাগুলো কী ভাবে তোকে বলব, কোথায় গিয়ে বলব, তোকে দেখামাত্র যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তাতে শাটার নামিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলুম। চল, ক্লিনিকেই যাই।

রিকশা থেকে নেমে, ক্লিনিকের তালা খুলে শাটার ওঠাতে সাহায্য করল অতনু, বলল, বেশ ভারি তো, রোজই এভাবে খুলিস আর বন্ধ করিস, বলে, শাটারটা নামিয়ে দিল অমিত। নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে ইতু বলল, এবার বল, যা জানতে চাইছি তা বল, কেউ নেই এখানে, কেউ তোর পেছু নেয়নি, রাস্তা একেবারে ফাঁকা ছিল।

—আমি রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি করি। তোকে তাতে ব্যবহার করি।

—তাতে কী হয়েছে! রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি তো আজকাল সবাই করছে, কে করছে না শুনি? রাষ্ট্রবিরোধী-ফিরোধি বলে কিছু হয় না। দুশ্চিন্তার কী আছে? সরকার যারা চালায় তাদের কুকর্ম দেখে, আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের স্ক্যাম প্রতিদিন কাগজে পড়ে, সব পাবলিকই মনে-মনে রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে পড়েছে। ধর্ষক, খুনি, ডাকাত সকলেই তো দিল্লির তখত-এ-তাউসে পৌঁছোচ্ছে। এই তো সেদিন মহাত্মা গান্ধির নাতি গোপালকৃষ্ণ গান্ধি দিল্লিতে ওনার বক্তৃতায় বলেছেন যে রিলায়েন্স কোম্পানি এত বেশি ক্ষমতা রাখে যে ভারতে তারা একটা সমান্তরাল রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে? তুই ভাবছিস বোধহয় আমি কোনো খবরই রাখি না। সারাদিন ক্লিনিকে বসে কী করি? পাশের কাপড়ের দোকানটা থেকে হিন্দি আর ইংরেজি কাগজ তিনটে এনে সারাদিন পড়ি।

—বাবা-মা যে রাজনীতি করেন, তা-ই করি।

—জানি, অতটা বোঝার মতো জ্ঞান আছে আমার। প্রশ্ন হল, আমি কি এখানে একা পড়ে থাকব, তোর ডাকবাক্স হয়ে?

—আমি তো কোনো নির্ণয় নিতে পারি না, আই অ্যাম জাস্ট এ ওয়ার্কার, ওনারা যে নির্ণয় নিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তুই ভালোই কাজ করছিস। তাছাড়া, কোনো বিষয়ে কথা বলার কোনো ক্ষমতাই নেই আমার। নেতারা কয়েকজন মিলে নির্ণয় নেন, তাঁরা যে কারা তাও আমি জানি না। তবে, শুনেছি, তাঁদের দুজন তোকে যাচাই করে গেছেন। তুই আমার জন্য নয়, তাঁদের জন্য ডাকবাক্সের কাজ করছিলিস। রোগি সেজে তোর অলটারনেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিকও তাঁরা দেখে গেছেন; তোর মতন ডাক্তারই ওনাদের প্রয়োজন, কেননা তুই আসেপাশে যা পাওয়া যায় তাই প্রয়োগ করে উপশম ঘটাবার চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত করেছিস, এম বি বি এসও এক বছর পড়েছিলি।

—তাহলে কবে তুই আমাকে তোদের সঙ্গে নিবি, আই ওয়ান্ট এ ক্লিয়ার আনসার, নো মোর ডিলিড্যালিং? ক্লিনিকটা আমাকে বন্ধ করতেই হবে, কেননা বাড়ি থেকে কোনো সাহায্য পাই না, ভাড়া দিই বাবা যে টাকা আমার ভাগ্যে বরাদ্দ করে গেছেন তা থেকে, ফিক্সড ডিপোজিট ফুরিয়ে গেছে, তাই স্কুটারটা বিক্রি করতে হল। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, আই ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস রাট, আমার বডি একটু-একটু করে শবের আদল পাচ্ছে।

রিভলভিং চেয়ারের কাছে গিয়ে মুখ নামিয়ে ইতুর চোখে চোখ রেখে, অমিত বলল, আমি কি তোকে চুমু খাবো?

ইতু কেঁদে ফেলেছিল, বলল, চড়ুইপাখি তো কালো বুক দেখিয়ে জিতে গেছে। অমিতের অনুমতির অপেক্ষা না করে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে অতনুর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল ইতু, কয়েক সেকেন্ড পর তুলে নিয়ে, রিভলভিং চেয়ারে বসে, ফুঁপিয়ে কাঁদা আরম্ভ করল। বলল, কেঁদে নিই, অনেক দিনের কান্না জমে আছে। কান্না থামার পর সামলে নিয়ে বলল, চল বাড়ি যাই, অন্নমা, মানে সুশান্তজেঠুর মা, তোকে দেখে খুশি হবেন। সুশান্তজেঠু ওনার ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন, তারপর থেকে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন।

—তাহলে না যাওয়াই ভালো। সুশান্তজেঠুর অভাব আমাকে দিয়ে মিটবে না। বরং ঘায়ে খোঁচা লেগে আঘাত বেড়ে যাবে। তোদের বাড়ির সবাই শুরুতেই মানিয়ে নিলে অবস্থা এতটা নিরাশাজনক হতো না। সুশান্তজেঠু আর ওনার বউ-ছেলেকে অ্যাকসেপ্ট না করার তো কারণ ছিল না। তোর বাড়ির লোকেরা তো আর ক্রিমিনাল গ্যাঙটাকে নেমন্তন্ন করে আনছিল না।

—না, সুশান্তজেঠু নাকি ওদের ক্রিমিনাল দলের ডন হয়ে গিয়েছেন, ওনার শশুর নিজের নেতৃত্ব সুশান্তজেঠুর হাতে দিয়ে দিয়েছে।

—হ্যাঃ, ওসব তো তোরা এর-তার মুখে শুনেছিস। তোদের বাড়ি থেকে কেউ কি গিয়েছিল একবার? গিয়ে দেখতে কে বারণ করেছিল? ওরা তো তোদের বাড়ির কাউকে খুন বা কিডন্যাপ করত না। যা করার তা তো করেই ফেলেছিল ওরা, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে ওদের গ্যাঙ লিডারের মেয়ের বিয়ে দিয়ে। সম্বন্ধটা শুধরে নিলে সকলেরই মঙ্গল হতো।

—কত রেসপনসিবলি কথা বলছিস রে, ইউ হ্যাভ রিয়্যালি গ্রোন আপ উইথ ইওর চেস্ট হেয়ার। চল না সুশান্তজেঠুর আস্তানায় ট্রিপ মারি।

—যাবো। সময় হলে যাবো। এবার আমি যাই।

—এক্ষুনি?

—হ্যাঁ, আবার তো আসব।

—ক্লিনিক কিন্তু বন্ধ করে দিচ্ছি। তোর মেসেঞ্জাররা কি আমাদের বাড়ি চিনে নিতে পারবে? আমাকে চিনতে পারবে? কয়েকবার তো নতুন মেসেঞ্জার দেখেছি।

—তারা সব কিছুই পারে।

—তাহলে পুরোটা কেঁদে নিতে দে, বলে, সান্নিধ্যের সঙ্কোচ কাটিয়ে, অমিতকে জড়িয়ে ধরেছিল ইতু। কান্না শেষ হলে চোখ পুঁছে বলেছিল, চড়ুইপাখিরা বসন্তঋতুতে একশকুড়িবার প্রেম করে, তা জানিস?

—না, জানা ছিল না; তবে, সিংহের কেশর কখন বাদামি থেকে কালো হয়ে ওঠে তা জানি।

—হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস। পরের বার যখন আসবি তখন কাঁধের ওপর অদৃশ্য কালো কেশর নিয়ে আসিস, মনে থাকে যেন। জাস্ট টু রিমাইণ্ড ইউ, সিংহিগন্ধের ঋতুতে সিংহরা দিনভর পনেরো মিনিট অন্তর প্রেম করে।