» » বনবিভাগের বিট মার্শাল

বর্ণাকার

মলয় রায় চৌধুরী

ঔরস

বনবিভাগের বিট মার্শাল : সতের

রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যাবার বাসে ইতুকে তুলে দিয়ে অমিত বলে দিয়েছিল, বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকবি; সুশান্তজেঠুর দেয়া তোর মোবাইল থেকে একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি। তুই মিশনের গেটের কাছে পৌঁছে এই নম্বরে একটা মিস কল দিবি। নারায়ণপুরে নেটওয়র্ক তত ভালো কাজ করে না। ছেলেটা রেসপণ্ড করে ওর নাম বলবে বীরবল মাড়িয়া। হিরো হণ্ডার কালো রঙের স্পেলনডার মোটর সাইকেলে আসবে। ও তোকে নমস্তে ইতু দিদি বললে কোনো বাক্যব্যায় না করে পিলিয়নে বসে পড়িস। ও তোকে যেখানে পোঁছে দেবে, সেখানে তোর সঙ্গে আমার পরিচিতদের দেখা হবে, হয়তো তোর পরিচিতও থাকতে পারে কেউ। চিন্তা করিসনি না, মনে রাখিস, যেখানে ঢুকতে যাচ্ছিস সেটাকে প্রশাসনের লোকেরা বলে জংলি পাকিস্তান।

বাসডিপোয় ইতুর কান্না পায়নি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। কেঁদে ফেলেছিল অমিত, রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছিল যাত্রীদের চোখ এড়িয়ে। বলেছিল, আর দেখা হবে না, জানি, তোকে শেষবার দেখে নিচ্ছি। উত্তরে ইতু বলেছিল, আমি আমার অতীতকে কলকাতা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার সময় থেকে কাট-অফ করে দিয়েছি, তুইও তাই করে ফ্যাল। সবাইকে ভুলে গিয়ে যা করবার কর, বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাদের ভুলে যা। গেট রিড অফ অলল মেমরিজ।

ডেনিমের ট্রাউজার আর ঢিলেঢালা টপ পরেছিল ইতু, পায়ে জগিং করার কেডস, কাঁধে ওর ঝোলা। রায়পুরে দু’বোতল মিনারেল ওয়াটার আর বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিয়েছে।

যে-বাসটায় চেপেছিল সেটার নাম, ইতুর অবাক লাগল শুনে, নৌকরওয়ালা বাস। কন্ডাক্টার টিকিট দিল না কাউকে। স্কুলের অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার হাতে প্রত্যেক যাত্রির কাছে গিয়ে তাদের নামের সামনে ছককাটা ঘরে সই নিয়ে নিল। মাসের শেষে টাকা নেবে। প্যাসেঞ্জারদের পোস্টিং হয়েছে নতুন জেলা-সদর নারায়ণপুরে; তাদের পরিবারকে নিয়ে যায়নি, নারায়ণপুরে ভালো স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, মল, মাল্টিপ্লেক্স কিছুই গড়ে ওঠেনি এখনও। ইতুকে কন্ডাক্টার বলল, দিতে হবে না।

বাস থেকে নেমে হাতেটানা রিকশয় চেপে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে বীরবল মাড়িয়াকে মিসড কল দিয়ে অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইতু।

নমস্তে ইতু দিদি, শুনে, কালো মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে, ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবনগ্রন্হির ঝাপটের উগ্র গন্ধ নাকে এসে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল; উফ, ফেরোমোন। মুখে থলেটা চাপা দিয়ে সামলাল। কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আরেক হাতে মোটর সাইকেলের হ্যাণ্ডল, নয়তো সড়কের যা অবস্থা, নির্ঘাত ছিটকে পড়বে কোনো পাথরে চাকা পড়লেই। ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, ঠিক করে বসুন, রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়ণপুর জেলা তৈরি হয়েছে। ইতুর মনে পড়ল অমিত এভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে সুড়সুড়ি দিয়েছিল।

যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হবে, গায়ের রং মুখের গড়ন দেখে আদিবাসী বলেই মনে হল। ইতু জিগ্যেস করল, দান্তেশ্বরীর মন্দির পড়বে কি রাস্তায়।

—না দিদি, দান্তেশ্বরী হল বস্তারের দেবী। নারায়ণপুরে অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হল কাকসার। বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে। উত্তর শুনে যুবকটিকে কোনো পালটা প্রশ্ন করল না ইতু। নিজেকেই প্রশ্ন করল, মেঘনাদ, এ কোন মেঘনাদ, রামায়ণের মেঘনাদ, যে মেঘনাদকে নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্য লিখেছিলেন?

যুবকটি বলল, আমার নাম বীরবল মাড়িয়া নয়, আমার ট্রাইবের নাম ওটা। অবুঝমাড়ে দুজাতের গোঁড় থাকে, মাড়িয়া গোঁড় আর মুরিয়া গোঁড়। শহরের লোকেরা মনে করে অবুঝমাড় মানে যে জায়গাকে এখনও জানা হয়ে ওঠেনি। ঠিকই, অবুঝমাড়কে কেউ জানে না। কিন্তু তা অবুঝমাড়ের মানে নয়। মাড় একরকমের শেকড়।

—ও, বলল ইতু, ভাবল রোদ বাঁচাতে মাথায় গামছা চাপা দেবে কিনা। নাঃ, এখন থেকে তো রোদ বৃষ্টি ঝড় যা-ই হোক, কোনো কিছুর দ্বারা পরাস্ত হলে চলবে না। সহ্য করবে। সহ্য করবেই। সহ্য করতে হবে। ছেলেটিকে বলল, তুমি সামনে দিকে তাকিয়ে চালাও, যা রাস্তার অবস্থা।

এভাবে কখনও বাইরে-দূরে বেরোয়নি ও, ইতু। সঙ্গে টুথব্রাশ, চিরুনি, তোয়ালে, সাবান অবশ্যই নিত, বাবা-মার সঙ্গে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবার সময়। বটঠাকুমা বড়দাদু ইউরোপে বেড়াতে যাবার সময়, সেখানে টয়লেট পেপার ব্যবহার করতে হবে শুনে, সঙ্গে একটা প্লাসটিকের মগ নিয়েছিলেন। ও কী করবে, কোথায়ই বা করবে?

—জানেন, এখানে কেউ আসে না, বেশ দূরে-দূরে প্রায় দুশো তিরিশটা গ্রাম আছে, চার হাজার একর জঙ্গলে ছড়িয়ে, তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ, বেশির ভাগই বীরবল মাড়িয়া আর গোঁড়, যাদের খোঁজখবর সরকার নেয় না, জানেই না সরকারি আফসররা। কেন বলুন তো? হোল ইনডিয়ায় শুধু এইটুকু এলাকার কোনো সার্ভে আজ পর্যন্ত হয়নি, সেনসাস হয়নি। রিপোর্টাররাও বস্তার যেতে চায়, নারায়ণপুরে আসতে চায় না, তাই আমার রোজগার তেমন হয় না। নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার, এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হল অবুঝমাড়। আপনাকে এ-সব বলছি কেন বলুন তো? যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন তিনি বলেছেন যে আপনাকে জায়গাটার ছবি বুঝিয়ে দিতে।

—ও, আচ্ছা। মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল বলে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল ইতু। তারপর নিজের মোবাইলটা বীরবল মাড়িয়ার হিপ পকেটে ঢুকিয়ে বলল, যিনি তোমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি বলেছিলেন মোবাইলটা তোমাকে দিয়ে দিতে।

—হ্যাঁ, আচ্ছা, ঠিক আছে। অবুঝমাড়কে ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল আর মাওওয়াদিরা। গ্রামের লোকেদের সঙ্গে মাওওয়াদিরা মেশার চেষ্টা করে। সিপাহি জওয়ানরা এড়িয়ে চলে। আপনাদের শহরের ভিখমাংগা বস্তির চেয়েও বদতর এখানকার জীবন। বিজলি নেই, খাবার জল নেই, স্কুল নেই, ডাক্তার-বইদ নেই, কারোর কিছু হলে চিকিৎসার কোনো উপায় নেই, তা সে আধামিলিট্রি জওয়ান হোক বা মাওওয়াদি জওয়ান, গ্রামের লোকেদের কথা তো ছেড়েই দিন, ওরা জানেই না কাকে ডাক্তার বলে, হাসপাতাল বলে। আফ্রিকাতেও এরকম গয়াগুজরা এলাকা পাবেন না। তবে, শ্বাস নিয়ে, বলল বীরবল মাড়িয়া, শহর মানেই তো চাপা দুর্গন্ধের ম্যানহোল; যতো বড়ো শহর, তত বেশি ম্যানহোল। এখানের আকাশে যেমন রাতের তারা, আপনাদের শহরে তেমন মাটিতে পাতা ম্যানহোল।

ইতু নিজেকে প্রশ্ন করল, এখানে কেন আসতে চাইলুম? বাড়িতে কী ভালো ছিলুম না? কত বাঙালি বাড়িতেই তো অবিবাহিতা মেয়েরা থাকে যারা সকলের অবহেলায় অবরে-সবরে মুখঝামটা খেয়ে তাদের মাঝে বসবাস করে ক্রমশ ন্যাড়ামাথা বুড়ি হয়ে যায়, স্বজনদের বাচ্চা হলে তাদের সঙ্গে খেলে, সময় কাটায়, বাড়িতে কোনো উৎসব হলে সে-ই খাটাখাটুনি করে, আর অতিথি অভ্যাগতদের সাবাশি পায়, অসুস্থ হয়ে সিঁড়ির তলায় চটে বা সতরঞ্চিতে শুয়ে মরে ভুত হয়ে যায়। নাঃ, একেবারে ভালো ছিলুম না, তার কারণ কোনো কাজই নিজের জন্য করছিলুম না, শুধু বেগার খাটছিলুম। এবার নিজের জন্য কিছু করব। যা হবার হোকগে, সিআরপিএফ-এর গুলি খেয়ে, না খেতে পেয়ে, মাওওয়াদিদের বিশ্বাস অর্জন করতে না পেরে, গ্রামবাসীদের সন্তুষ্ট করতে না পেরে, মরে যেতে হলে মরে যাবো, নিজের জন্য তো মরব। ছেলেটিকে বলল, তুমি চুপ করে গেলে কেন, বেশ ভালোই তো লাগছে শুনতে।

—কুরসুনার গ্রাম এসে গেল তো, তাই। যে অনজান দুনিয়ায় আপনি ঢুকতে চলেছেন, এই গ্রাম হল তার প্রবেশপথ। ভারত সরকার বলুন, ছত্তিশগড় সরকার বলুন, এখান পর্যন্তই তারা ছিল, অপারেশান হাক্কার পরে কিছুটা বদলালেও, মানুষের মনের ভেতরটা বদলাতে অনেক সময় লাগে। ওই যে স্কুল বিল্ডিং দেখছেন, ওখানে আগে আধামিলিট্রি জওয়ানরা থাকত, তাই স্কুলটা চলে গেছে, ওই যে, ওখানে যে চালাঘর দেখতে পাচ্ছেন, ওখানে। আসলে স্কুলটাকে টেনে নিয়ে গেছে মাড়িয়াদের আৎমা, পূর্ণিমার দিন যদি আসেন, তাহলে নিজের চোখে দেখতে পাবেন যে স্কুলটা একটু-একটু করে দক্ষিণে সরে যাচ্ছে। নতুন স্কুল বিল্ডিংটা পুরো তৈরি হয়নি, অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে। মাওওয়াদিরা নাকি ঠিকেদারকে এমন হুমকি দিয়েছিল যে সে প্রাণ বাঁচিয়ে ভাগলবা। তা নয়, আসলে মাড়িয়াদের আৎমা ঠিকেদারকে বলেছিল যে চলে যাও, নয়ত গুলি খেয়ে মরবে। তবে মাওওয়াদিরা ঠিকেদারের ট্র্যাক্টরটাও কেড়ে নিয়েছিল। ট্র্যাক্টর নিয়ে মাওওয়াদিরা কী করবে জানি না; এরপর তো ট্র্যাক্টর চালাবার মতন রাস্তা পাহাড় শুরু হবার আগে পর্যন্ত, তারপর ছাগল-গরু চরাবার সরু হাঁটা-পথ।

কিছুক্ষণ থেমে, শ্বাস নিয়ে, ছেলেটি বলা বজায় রাখল। অবুঝমাড় এমন ভুতাহা জায়গা যে মাওওয়াদিদের শরীরকেও অদৃশ্য ডাইনরা আক্রমণ করে, যতই বন্দুক-কামান থাক, কিছুদিনের মধ্যে খারাপ হয়ে যায়, ওদের কামচলাউ ডাক্তার আছে, আনপঢ়, সে কি আর ডাইনদের সঙ্গে পারে, বলুন। কুরুসনার আধামিলিট্রি ভুতাহা ক্যাম্প দেখলেন, ওখানে একবার হামলা চালিয়েছিল মাওওয়াদিরা; যারা চালিয়েছিল তারা আন্ধ্রার, এখানকার জঙ্গলে তাদের দুজনের শরীর এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তারা আন্ধ্রার আদিলাবাদে গিয়ে সারেনডার করেছিল, তাও লোকটার বয়স মোটে পঁয়ত্রিশ, নাম ছিল রায়সিদম জাওয়েন্দ্রা রাও উর্ফ লালচন্দ, মেয়েটার বয়স আরো কম, তিরিশ বছর, নাম ছিল কোনগাতি করুণা উর্ফ লতা। মাওওয়াদিরা নিজের বড়ো-বড়ো নাম বদলে নিয়ে ছোটো করে ফ্যালে, অন্য নাম নিয়ে নেয়, নিজের মা-বাপের আদর করে দেয়া নামকে কেন ওদের বন্দুকবাজির সঙ্গে জড়াবে, বলুন? অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা হালউই ভাষায় কথা বলে; ওরা ছত্তিশগড়িয়া, হিন্দি, তেলেগু কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না, বললে বুঝতেও পারে না।

—তুমি তো ভালই হিন্দি বলছ।

—আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়েছিলুম।

—ছেড়ে দিলে কেন?

—আধামিলিট্রিরা আমার মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল আমার মা নাকি মাওওয়াদিদের চর। মাওওয়াদিরাও ভেবেছিল আমার মা নিশ্চই সরকারের চর, নয়তো কেন্দ্রীয় রিজর্ভ পুলিশ বলের ক্যাম্পে কেন গেছে। একবার দু-পার্টির গুলিগোলা চলার সময় মায়ের গায়ে গুলি লাগে। সরকার বলেছিল মাওওয়াদিদের গুলিতে মরেছে। মাওওয়াদিরা বলেছিল, আধামিলিট্রির গুলিতে মরেছে। মা মরে যেতে আমি এক লাখ টাকা মুয়াবজা পেয়েছিলুম, সেই টাকা থেকেই তো এই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মোটর সাইকেলটা কিনেছি। আপনাদের মতন প্যাসেঞ্জারদের নানা জায়গায় নিয়ে যাই, নিয়ে আসি, তা থেকেই সংসার চলে যায়। আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না, আপনার ভাড়ার টাকা আমি কালকেই পেয়ে গেছি।

—তোমার বাড়িতে কে আছে?

—বাবা আছে, দিনভর মদ খেয়ে পড়ে থাকে, সালফি মদ, এতো নেশা হয় যে লোকে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়; ওরকম মদখোরকে কে-ই বা বিয়ে করবে, বলুন, লোকটা যদি সারাদিন আকাশে উড়তে থাকে তাহলে কোনো মেয়েই আসবে না, বৃষ্টি না পড়লে কী করেই বা আকাশ থেকে নামাবে, বলুন। বৃষ্টি শুরু হলে পেণ্ডা খেতি করবে, না নিজের আদমিকে আকাশ থেকে নামাতে ছুটবে। বাবা আমাকেই বলছিল বিয়ে করে নিতে। দুটো ছোটো-ছোটো বোন আছে, তাদের দেখাশোনা করব, বিয়ে দেব, তবে তো আমি বিয়ে করব, কি না?

—বিয়ে করলে আমায় ডেকো।

—হ্যাঁ, ডাকব, সে তো এখন অনেক দেরি, দেখুন আপনি কতদিন অবুঝমাড়ে টিকতে পারেন। টিকতে হলে সালফি খেতে হবে; নোংরা জলের চেয়ে সালফি খাওয়া ভালো, সকাল হবার আগেই খেয়ে নেবেন, সকালের সালফি খেলে আকাশ তাকে নেয় না। সকালের পর সালফি মেঘ হয়ে যায়।

—সালফি?

—হ্যাঁ, সালফি হল তাড়ির মতন দেখতে একরকম মদ। তালগাছ বা খেজুরগাছের মতন দেখতে হয় গাছগুলো, যেমন করে চেঁচে নিয়ে তালের বা খেজুরের রস বেরোয়, তেমন করে বের করে গ্রামের লোকেরা। তালের রস পচলে তাড়ি হয়, তেমনই সালফির রস চব্বিশ ঘণ্টার পর সাদা রঙের মেঘ হয়ে যায়। তবে মাওওয়াদিরা হুকুম জারি করে মাড় বাজারে গুটকা, গুড়াকু, বিড়ি, সিগারেট, সালফি বিক্রি বন্ধের কাগজ সেঁটেছে। ওরা যদি কাউকে খেতে দ্যাখে তাহলে তাকে একশো টাকা জরিমানা করে। জরিমানার টাকাটা মাওওয়াদিদের ওষুধ কেনার কাজে লাগায়। বাতের আর গা-হাতপা ব্যথার রোগ খুব হয় অবুঝমাড়ে। আমরা তাই বিয়ার বাহুতি পোকা থেকে তেল বের করে বাড়িতে রাখি। যাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তারা ওগুলো শুকিয়ে খায়। নারায়ণপুর বাজারে কিনতে পাবেন।

—কী পোকা? কী করকম দেখতে?

—বিয়ার বাহেতি, লাল টকটকে। সরকারি আফসাররা বলে রেড ভেলভেট মাইট।

—ওঃ, ট্রমবিডাইডা পোকা। হ্যাঁ, ওর তেলকে হিন্দিতে তিজ বলে, বাতে বা প্যারালিসিসে ব্যবহার করে আয়ুর্বেদিক ডাক্তাররা।

গাঁয়ের লোকেরা পোকাগুলো শুকিয়ে ইনডিয়ান ভায়াগ্রা হিসেবে খায়, তা জানে ইতু, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিনের কোর্সে। পুরুষ পাখিরাও বসন্তঋতুতে খায় পোকাগুলো, প্রজননের জন্য।

—এর পর আমাদের হাঁটতে হবে।

—এত ভারি মোটর সাইকেল ঠেলে হাঁটবে কী করে?

—না, কাছে আধামিলিট্রি চেকপোস্ট আছে; তারা আপনাকে আমার সঙ্গে দেখে ফেললে যেতে দেবে না। আপনি চুপচাপ এগিয়ে চলে যান, আমি মোটর সাইকেল একটু পরে স্টার্ট দিয়ে আসব।

পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেরুমাটির পথ আরম্ভ হল, গরুর গাড়ি বা ট্র্যাক্টর চলার মতন চওড়া কাঁচা রাস্তা। শুকিয়ে যাওয়া সরু নদী পেরোবার পর বীরবল মাড়িয়া মোটর সাইকেল চালিয়ে এলে ইতু বসে পড়ল পিলিয়নে। বীরবলের পেট আরও ঘেমেছে, কিন্তু উপায় নেই। দু’পাশে শালগাছের সারি, যাক, ছায়া পাওয়া গেল এতক্ষণে, জংলি জঙ্গলের জংলা ঝাউ। কই, ল্যাণ্ডমাইন, বোমাফাঁদ, মাওওয়াদি, আদিবাসী, কিছুরই তো দেখা নেই। গাছগাছালির রংছড়ানো সৌন্দর্য্যে বেশ খাপছাড়া, লেবুসবুজ পাতাগুলো বনের আশ মেটাতে পারছে না। কোনো গ্রামে পৌঁছোল ওরা, পাটনা শহরে গঙ্গায় যাবার ঘাটের দুধারের ভিকিরিদের ঝোপড়ির মতন কুঁড়েঘর, একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে-দূরে।

—ওগুলো কী? ঢিবিগুলো। রঙিন কাপড়ে উড়ছে? একটায় শার্টও ঝোলানো রয়েছে। ইতু জিগ্যেস করল বীরবল মাড়িয়াকে, কয়েকটা ঢিবির দিকে আঙুল দেখিয়ে।

আঙুল দেখাবেন না, আঙুল দেখাবেন না, আৎমার অপমান হবে। ওগুলো মাড়িয়াদের কবর। কোনো আত্মীয় আৎমার শান্তির জন্য কাপড়ের টুকরো বেঁধে গেছে, কাপড়গুলো অমাবসের রাকছসদের থেকে আৎমাদের রক্ষা করে। বলল বীরবল মাড়িয়া।

লোহার তোরণের মত দেখতে একটা জায়গায় থামল বীরবল। তোরণের ওপরের টিনে সবুজ রঙের ওপর সাদা রঙে হিন্দিতে লেখা রয়েছে, ভারতীয় সেনা ওয়াপস যাও, বস্তরওয়াসী বাহরি নহিঁ হ্যাঁয়। জঙ মত লড়ো। টিনের সাইনবোর্ডের পেছনে লেখা, বস্তরকে য়ুবায়োঁ, সরকার কে নাজায়জ জঙ কে খিলাফ জনয়ুধ মেঁ শামিল হো জাও।

মোটর সাইকেল থামিয়ে বাক্সে রাখা একটা কাঁধে ঝোলাবার ব্যাগ বের করে ইতুর দিকে এগিয়ে দিল বীরবল, ইতু বলল, আমার কাছে তো রয়েছে কাঁধে ঝোলাবার থলে।

বীরবল মাড়িয়া বলল, আপনার ঝোলাটা এই কাঁধব্যাগে ঢুকিয়ে নিন, এটায় ডাক্তারের ক্রস চিহ্ণ আঁকা আছে। আপনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে ডাক্তারের লাল ক্রস চিহ্ণ আঁকা ঝোলাটা দিই আপনাকে। নিজের ঝোলাটা বীরবলের দেয়া ঝোলায় পুরে নিল ইতু। থ্যাংকস জানিয়ে জিগ্যেস করল, ওই চালাঘরটার ছায়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসা যায় কি?

—ওটা র‌্যাশানের দোকান ছিল। যে লোকটা চালাত সে ছিল বস্তারের গোঁড়, মাওওয়াদিদের আৎমার ভয়ে দোকান তুলে দিয়ে, নারায়ণপুরে চলে গেছে, মরে গেলে মাওওয়াদিরা তাদের আৎমাকে এই জঙ্গলে ছেড়ে যায়। আগে র‌্যাশানের কাজ রামকৃষ্ণ মিশন করত। সরকার ওদের হাত থেকে নিয়ে দোকানদারদের হাতে দেবার পর চালাতে না পেরে আবার রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়েছে; মিশনের পাঁচটা সেন্টার আছে অবুঝমাড়ে। আসলে দোকানদাররা গড়বড়ি করে টাকা বানাতো র‌্যাশান থেকে, ভাবতো যে গোঁড়-মাড়িয়ারা তো জংলি, ওদের নিয়মমত র‌্যাশান না দিলে টের পাবে না, গোঁড়-মাড়িয়ারা তো আর জানে না যে কত র‌্যাশান ওরা পায়। কিন্তু মাওওয়াদিরা দোকানদারদের গড়বড়ি ধরে ফেলেছিল। হুমকি খেয়ে কেউই আর দোকান চালাবার সাহস করেনি। র‌্যাশান মানে পঁয়ত্রিশ কিলো চাল আর কেরোসিন তেল।

ছায়ায় আধঘণ্টা জিরিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খাবার পর, মোটর সাইকেলটা চালাঘরের কাছে রেখে বীরবল বলল চলুন, আরেকটু এগিয়ে দিই।

মিনিট পনেরো হাঁটার পর, দুটো নিচুছাদ চালাঘরের গ্রামের মতন একটা জায়গায় পোঁছোলো ইতু আর বীরবল মাড়িয়া। উলঙ্গ বাচ্চারা খেলা করছে, ছেলে-মেয়ে দুই-ই, রুক্ষ চুল, দেখেই বোঝা যায় বহুদিন, বা হয়ত কখনও, স্নান করেনি। শহরে এই বয়সের মেয়েরা কুঁচকি আর বুকঢাকা পোশাক পরে। কয়েকজন শিড়িঙ্গে শিথিল-দাবনা পুরুষ বসে আছে, তারাও প্রায় উলঙ্গ, কৌপিনগোছের ন্যাকড়ায় লিঙ্গ ঢাকা; বৃন্দাবনের বিধবাদের অনেকে এরকমই শিড়িঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন গিয়েছিল, তখন দেখেছিল ইতু। লোকগুলোর কোনো আগ্রহ হল না ওদের উপস্থিতিতে, সম্পূর্ণ উদাসীন, যেন সত্যিই আকাশে ভেসে রয়েছে। ওদের মধ্যে একজন যুবকও ছিল, তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বীরবল গোঁড় মাড়িয়া ভাষায় কথা বলল। ইতুর দিকে ফিরে বলল, এর পরের গ্রামে যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। ওরাও এ গ্রামের নয়, কুরুসনারে গিয়ে সালফি খেয়ে এখানে মৌতাত নিচ্ছে। এই অবস্থায় ওরা ভেতরে গেলে মাওওয়াদিরা ধরে ফেললে ফাইন করবে।

বড় ধাপ থেকে ছোটো হতে থাকা সিঁড়ির মতন ওঠা লাল আর সাদা কয়েকটা স্তুপের দিকে ইশারা করে বীরবল মাড়িয়া বলল, ওগুলো শহিদ-বেদি; যারা আধামিলিট্রির গুলিতে মারা গেছে তাদের ইয়াদগারে বানানো, বেশিরভাগ বেদি আসলে সমাধি, দেখছেন না বেদির ওপরে টিনের কাস্তে-হাতুড়ি। ইতু নিজেকে বলল, এখানে তার মানে ইঁট, বালি, সিমেন্ট এনে ঘর তোলা যায়; জায়গাটাকে দুর্ভেদ্য করে না রাখলে হয়ত গ্রামের লোকেরা পাকা আস্তানা তৈরি করতে পারত, যেমন অন্য প্রদেশের আদিবাসীদের বাড়িগুলো।

মায়ের বাবা-মা, মানে দাদু-দিদা, বেঁচে থাকতে, ছোটোবেলায়, একবার বাবার সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিল ইতু; সেখানে পাড়ার রাস্তায় ওইরকমই, কিন্তু ছোটো মাপের, কয়েকটা ক্ষয়ে-যাওয়া ইঁটদেঁতো বেদি দেখতে পেয়ে জানতে চাইলে, দাদু বলেছিলেন, ওগুলো শহিদ বেদি, যারা বসিয়েছে তারা নিজেদের, আর যে মারা গেছে তাকে, বোকা বানাবার স্মৃতিকে জিইয়ে রেখেছে। আজকে দাদুর বলা কথাটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারল ও, ইতু।

মানুষ যদি এরকমই থাকতে চায়, তাহলে তাতে পৃথিবীর ক্ষতি ছিল কোনো, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ইতু। এই লোকগুলো এখনও বিস্মিত হবার ক্ষমতা রাখে, এখনও এরা কলাকৌশলের ইঁদুরকলে আটকে পড়েনি, এখনও এরা ভড়ংশূন্য, সরল, স্বাভাবিক; প্রযুক্তির প্রগতিতে এসে যায় না কিছু। সভ্যতা যতো বুড়ো হয়েছে তত বিমূর্ত আর অবাস্তব হয়ে গেছে শহুরে মানুষ, শিকড় থেকে ওপড়ানো, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যেমন আমি নিজে। মেট্রপলিসের মানুষ আর জৈবিক হৃদয়ের প্রাণী রইল না, তার আবেগের স্বাভাবিকতা আর আন্তরিকতা উবে গেছে। বোধহয় এটা মানুষের নৃবৈজ্ঞানিক ভবিতব্য। সভ্যতা যত সভ্যতর হয়ে চলেছে ততই আমরা হয়ে চলেছি জটিল, খারাপ, অনৈতিক, ভয়াবহ। এই লোকগুলোর আনন্দের পরিভাষা তো এরাই তৈরি করবে, নাকি আমি বাইরে থেকে এসে তাকে বোঝাবো কিসে তাদের আনন্দ। সভ্যতা হয়তো মানুষের যৌবনকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে। মানুষ আসলে ভঙ্গুর, ঠুনকো, নশ্বর, তার শরীর অসুস্থ হবেই, ঋতুদের প্রকোপ সামলে চলতে হবে তাকে, সভ্য থাকার কাঁচামাল ফুরিয়ে যাচ্ছে, না-খেয়ে বা আধপেটা-খেয়ে থাকতে হচ্ছে, তার ওপর আবার সন্ত্রাসের আতঙ্ক। কে জানে, আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। দেখি কী হয়। অন্যদের সুখে-আনন্দে-সুস্থতায় যদি জীবন উৎসর্গ করতে পারি, তাহলেই যথেষ্ট।

ইতুর দোভাষীর কাজ চালিয়ে বীরবল বলল, যুবকটির নাম হরিয়া, ও বলছে যে ওর কোনো কিছুরই দরকার নেই, সবই আছে, রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসলে, পঁয়ত্রিশ কিলো চাল নিয়ে আসে। এক টাকা কিলো চাল কিনতে অসুবিধা হয়না, শুয়োরবাচ্চা, মুরগি, মুরগির ডিম, মহুয়ার ফুল বিক্রি করে যথেষ্ট টাকা হয়ে যায় মাসে। রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসার আগে খবর পাঠিয়ে দেয়।

গ্রামটার পর পথ ক্রমে ওপর দিকে ওঠা আরম্ভ হল। অঝোর বৃষ্টিতে খসে-পড়া পাথরকে সিঁড়ির মতন সাজিয়ে নেয়া হয়েছে। দুপাশে নানা রকমের চেনা-অচেনা গাছ, ছায়ায় হাঁটতে ভালো লাগছিল ইতুর। তখনই বীরবল বলল, দিদি, আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, বিকেল হয়ে গেছে। আপনি আগে যে গ্রাম পাবেন সেখানে অপেক্ষা করুন কিংবা এই সরু পাহাড়ি বনপথ ধরে এগিয়ে যান, আরেকটা বড় গ্রাম আসবে, আমার সেরকমটাই মনে আছে, কয়েক বছর আগে গিয়েছিলুম তো। অন্ধকার হয়ে গেলে কোনো গাছে হাত দেবেন না; সন্ধ্যার পরে গাছ আর গাছের ডালপালাগুলো সাপ হয়ে যায়, নানা রকমের সাপ, সবুজ, কালো, হলদে, মোটা, রোগা, চিত্তিদার; আপনাকে সাবধানে হাঁটতে হবে। টর্চ এনে থাকলে জ্বালাবেন না, সাপেরা আলোয় বিরক্ত হয়।

—সে কি, তুমি যাবে না? ইতু বুঝতে পারল যে ও এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করছিল এতক্ষণ, ওর কল্পকাহিনী খাচ্ছিল। এবার ওকে আত্মনির্ভর হয়ে নির্ণয় নিয়ে এগোতে হবে। কারোর ঘাড়ে চাপার জন্য তো ও বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি। কিছুক্ষণেই সূর্য অস্ত যাবে। একা-একা কী করব এখানে। চিনি না, জানি না কাউকে।

—না, আমি ফিরে যাই, এখানে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না। মাড়িয়া গোঁড়রা জানেই না কাকে ক্ষতি করা বলে। জঙ্গলের ভেতরে শহরের মানুষ পাবেন না। যদি পান তো নিজেকে দূরে-দূরে রাখবেন।

ইতু হাত তুলে ফির মিলুংগি জানিয়ে এগোলো বনের পথ ধরে। বীরবল চলে গেলে, জুতো আর জিন্স খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিল। অবিরাম হাঁটার দরুণ প্যাণ্টির ঘষা লাগছিল কুঁচকিতে। ওহ, কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি-বসানো ঘন-সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা হয়তো কোনো ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দু’হাত মেলে জন্মেছিল। টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল। সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস, বাইরে থেকে এসে সবচে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।

বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখল, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুন জ্বালা করছিল। একটা ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে, কুঁচকিতে আর বুকে, গোলাপি-জ্বালায় লাগিয়ে নিল।

বনের ভেতরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় ভালোলাগা পেয়ে বসল ইতুকে। দুহাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ইতুউউউউ…, আমি ইতান…, পৃথিবীর মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন…। দুদিকে দুহাত মেলে দিয়ে, আবার চেঁচালো, আমি ইতু…, আমি আদিমানবী…, আমি ইতু…আমি ইতু…আমি ইতুউউউউ…।

শুকনো পাতার ওপর থেকে পোশাক তুলতে গিয়ে ইতু দেখল, একটা কাঠবিড়ালি নতজানু হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইতু, নগ্ন, শুকনো পাতার ওপর বসে কাঠবিড়ালিটাকে বলল, সেতু বাঁধতে এসে থাকলে ভুল করছিস, সব সেতু ভেঙে চলে এসেছি। কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে গেলে, জুতো আর পোশাক পরে নিল, কাঁধে ঝোলা, এগোলো বনপথে। হালকা হয়ে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল না আর। এটা জঙ্গল, না বনানীর ধ্বংসাবশেষ, কেমন যেন ছড়ানো-ছেতরানো!

সোফানরম শুকনো-পচা পাতার ওপর হাঁটতে-হাঁটতে ইতুর মনে হল এই জায়গাটা তো ওর চেনা। ওই তো ডুমুর গাছে থোকা-থোকা পাকা ডুমুর হয়ে রয়েছে, পায়ের কাছে বনপথের পাশে-পাশে ঘৃতকুমারীর জঙ্গল, ঘৃতকুমারী, যা এখন কতো দাম দিয়ে কেনে পাবলিক, বহেড়া গাছ, অশোকফুল গোছা-গোছা, ভরাঙ্গিপাতা, ডেভিলস কটন বা উলটকম্বলের গাছ, ইগল উড বা অগরু গাছ, আরে, এলিফ্যাণ্ট ক্রিপার বা সমুদ্রাশোক, সুগন্ধমূল বা গ্রেটার গলাঙ্গল, উইনটার চেরি যাকে সিলেবাসে অশ্বগন্ধা বলা হতো, কত পরিচিত গাছ-গাছড়া, পাটনায় পেতুম শুকনো, কবে কোথা থেকে অশোক রাজপথের ইউনানি দোকানে আসত কে জানে। এখানে দিব্বি রয়েছে অবহেলার ঐশ্বর্যে ঝিলমিলিয়ে, শিশি-বোতল-বয়ামের বাইরে মাথা তুলে, হাতপা ছড়িয়ে।

ঘণ্টাখানেক চলার পর, সন্ধ্যা নেমে আসায়, অজানা এক গাছের গুঁড়ির কাছে, ছায়ায়, জুতো খুলে, বসে পড়েছিল ইতু, বুকের ভেতরে বাজানো ভীতির দামামা দূর থেকে কানের ভেতরে উঠে আসছিল। ওপর থেকে ঝরঝর করে কয়েকটা শুকনো ফুল ঝরে পড়তে চমকে উঠেছিল, তারপর টের পেল যে এটা মহুয়ার গাছ; তাইতো অমন গন্ধ বেরুচ্ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে যদি ভাল্লুক আসে, তাহলে? কোথায় যেতে হবে সুস্পষ্ট বলে দেয়নি অমিত। বলেছিল হাঁটতে থেকো যতটা পারো। পরিচিত কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবে। তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। গাছে ঠেসান দিয়ে ঢুলতে লাগল। সারাদিনের রোদের আমেজে বুঁদ গাছের পাতাগুলো অবসাদে ঝিমিয়ে।

ঘুম ভাঙতে, দেখল, অন্ধকার, আজকে বোধহয় চাঁদ ওঠার রাত নয়। জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে গাছে ডান হাত ঠেকতেই মনে হল সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে, নরম, মাংসল। দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। কী করবে? গাছগুলো রাতে সাপের আকার নিয়ে নিচ্ছে! কেউ এলে তাকে দেখতেও তো পাবো না জঙ্গলের অন্ধকারে। হয়তো বিভ্রম, মনে করে, বাঁহাত বাড়িয়ে গাছ অনুমান করে হাত বাড়াতে, সাপের গায়ে ঠেকল, ঠাণ্ডা। সাপের ভয়ে ইতুর বুকের ভেতরের ইঁদুরগুলো দাপাদাপি আরম্ভ করে দিয়েছিল। বুঝতে পারল যে যা ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তা আতঙ্ক, সাপের আকার পাওয়া গাছগাছালির আতঙ্ক।

হঠাৎ ওর মুখের ওপর সরু নিয়ন আলো পড়তে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কোনো ময়ালের চোখ?

আওয়াজ আর কন্ঠস্বর শুনে সন্দিগ্ধ ভয়ে সিঁটিয়ে উঠল ইতু। ভাল্লুক? আরও তিনটে টর্চ জ্বলতে, আঁচ করল ওর চারপাশে জলপাই রঙের উর্দিতে চারজন যুবক আর একজন যুবতী। প্রত্যেকের কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল, কে জানে কী, জওয়ানদের কাঁধে ঝুলতে দেখেছে অমন অস্ত্র। আধামিলিট্রি জওয়ান নয়তো? একজন যুবতী রয়েছে যখন তার মানে এরা সি আর পি এফ জওয়ান নয় বলেই মনে হচ্ছে। যুবতী তো খোঁপাও বেঁধেছে, চুলে তেল দেয় নিশ্চয়ই, চকচক করছে। এখানে জঙ্গলে মাথায় দেবার তেলও পাওয়া যায় নাকি! চুলটা কেটে ফেললুম, না কাটলেও বোধহয় চলত।

একজন যুবক এগিয়ে এলো, যাকে দেখে চিনতে পারল ইতু, আরে, এই ছেলেটা তো ওর ক্লিনিকে একবার খাম দিতে আর ওর বাড়িতে একবার খাম নিতে এসেছিল। যাক এরা তাহলে অমিতের পরিচিত। অমিতও এরকম কাঁধে বন্দুক ঝোলায় নাকি? আমাকেও বন্দুক ঝোলাতে হবে নাকি? তা তো চাইনি।

—ডক্টর ঘোষ, ওয়েলকাম, বলল ছেলেটি।

ইতুর মুখ দিয়ে বেরোল, থ্যাংকস, ম্যায় বহুত ডরি হুই থি, কোই দিখাই নহিঁ দে রহা থা, কাফি অন্ধেরা ভি হো চলা হ্যায়।

—জানতি হুঁ, আপ সো গয়ে থে দেখকর হম লোগোঁনে নিন্দ সে নহিঁ জাগায়া আপকো। আপ জব অপনা নাম লেকর চিল্লায়েঁ, তভি সে হমলোগ আপকে সাথ হ্যাঁয়। আপ হম লোগোঁ কে সাথ আইয়ে, বলল ওদের সঙ্গের যুবতী। সে-ই বোধহয় এদের নেতা। পিঠের ব্যাগ থেকে দুশো এম এল জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, লাইফ ইজ টাফ ফর অল ইন দিস প্লেস, অ্যান্ড ভেরি ডেঞ্জারাস টু, ইউ হ্যাভ টু গ্র্যাজুয়ালি অ্যাডজাস্ট।

জল খেয়ে তৃপ্ত বোধ করল ইতু। ওর উলঙ্গ চিৎকার এরা দেখেছে তাহলে। দেখুকগে, কীই বা এসে যায়। এতক্ষণ পর মানুষ দেখতে পেয়ে অসুরক্ষিত থাকার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত লাগল নিজেকে।

মেয়েটি বলল, আপনি হাঁটার সময়ে মাঝখানে থাকবেন, আমি আপনার দেহরক্ষী, আমার নাম সোনারি। ওদের সঙ্গে হাঁটা আরম্ভ করল, ওর সামনে তিন জন, পেছনে দুজন। গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশে তারা দেখতে পেয়ে দেহরক্ষীদের চেয়ে তাদের টিমটিমে আলোদের বেশি আপন মনে হল ইতুর। সেই সকাল থেকে বেরিয়েছে, রোদের জন্য দ্বিতীয়বার আর পেচ্ছাপ পায়নি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর কতক্ষণ হাটঁতে হবে কে জানে, কয়েকটা বিস্কিট আগেই খেয়ে নিলে ভালো হতো। এরা কেউ কথাবার্তাও বলছে না। নিজে থেকে কোন প্রসঙ্গেই বা কথা বলবে, নানা ভাবনা মগজে ঘুরছিল ইতুর। দেহের আলো জ্বালিয়ে পুরুষ জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে মাদি-জোনাকিদের আকৃষ্ট করার জন্য। বনের পাতারা গন্ধ বিলোচ্ছে। নয়নাভিরাম নির্বাক অন্ধকার। বনপথের সহযাত্রীদের পাহারায় হয়ত আরও দেড় ঘন্টা হেঁটেছিল ইতু।

তখনই, অন্ধকারকে হুশিয়ারি দিয়ে কয়েকবার হুইসিল বেজে থেমে গেল।

আচমকা গুলিচলার শব্দ আরম্ভ হতে, ইতুর ওপর ঝাঁপিয়ে একজন সঙ্গী যুবক ওকে জঙ্গলের শুকনো পাতার ওপরে উপুড় করে শুইয়ে দিল, ইতুকে বাঁচাবার জন্য দুদিক থেকে ওর দেহকে নিজেদের শরীর দিয়ে ঢেকে নিল বাকি দুজন যুবক। মেয়েটি শুকনো পাতার ওপর উপুড় হয়ে কোনো অচেনা শত্রুর দিকে তাক করে বন্দুক উঁচিয়ে শুয়ে পড়ল ইতুর মাথার কাছে।

অবিশ্বাস্য। এরা আমার কেউ নয়, তবু আমাকে বাঁচাবার জন্য নিজেদের শরীরকে আমার দেহের বর্মে পালটে ফেলল! মানুষ না রোবোট এরা!

ইতু অনুমান করল দুদিক থেকে গুলি চলছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, গুলির আগুন-ফিনকিও দেখতে পাচ্ছে না। ওর মুখ মাটির দিকে, জিভেতে ভয়ার্ত আহ্লাদের স্বাদ। নিজেকে নিঃশব্দে বলল, বোধহয় নতুন জীবন আরম্ভ হল, কিংবা জীবন হয়তো কিছুক্ষণেই শেষ হয়ে যাবে। আর আশ্চর্য, এক্ষুনি হয়তো মরে যাবো, এই ভেবেও ভেতরে-ভেতরে আনন্দ খেলছে।

শুকনো পাতার ছোঁয়াচে গন্ধে, বাড়ি থেকে পালাবার পর প্রথম যখন অমিত ওর ক্লিনিকে এসেছিল সেই দিনকার ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগল ইতুর, হুবহু।