» » দুই : ইহার বছর-চারেক পরে

দুই : ইহার বছর-চারেক পরে

ইহার বছর-চারেক পরে যেদিন খুব ঘটা করিয়া অমূল্যের হাতেখড়ি হইয়া গেল, তাহার পরদিন সকালে অন্নপূর্ণা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন, বাহির হইতে বিন্দুবাসিনী ডাকিয়া কহিল, দিদি, অমূল্যধন প্রণাম করতে এসেচে, একবারটি বাইরে এস।

অন্নপূর্ণা বাহিরে আসিয়া অমূল্যের সাজগোজ দেখিয়া অবাক হইয়া গেলেন। তাহার চোখে কাজল, কপালে টিপ, গলায় সোনার হার, মাথার উপর ঝুঁটি করিয়া চুল বাঁধা, পরনে একখানি হলদে রঙের ছোপান কাপড়, একহাতে দড়ি-বাঁধা মাটির দোয়াত, বগলে ক্ষুদ্র একখানি মাদুর-জড়ানো গুটিকয়েক তালপাতা।

বিন্দু বলিল, দিদিকে প্রণাম কর ত বাবা!

অমূল্য জননীকে প্রণাম করিল।

তাহার পায়ে জুতা নাই, মোজা নাই, পরনে নানাবিধ বিলাতী পোশাক নাই—অন্নপূর্ণা এই অপরূপ সাজ দেখিয়া হাসিয়া বলিলেন, এতও তোর আসে ছোটবৌ! ছেলে বুঝি পড়তে যাচ্চে?

বিন্দু হাসিমুখে বলিল, হাঁ, গঙ্গাপণ্ডিতের পাঠশালে পাঠিয়ে দিচ্চি। আশীর্বাদ কর দিদি, আজকের দিন যেন ওর জীবনে সার্থক হয়।

চাকরের দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, ভৈরব, পণ্ডিতমশাইকে আমার নাম করে বিশেষ করে বলে দিস, ছেলেকে আমার যেন কেউ মারধর না করে।

দিদি, এই পাঁচটা টাকা ধর, বেশ করে একখানি সিদে সাজিয়ে টাকা-ক’টি দিয়ে কদমের হাতে পাঠশালে পাঠিয়ে দাও। বলিয়া সে গভীর স্নেহে চুমা খাইয়া ছেলেকে কোলে তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল।

অন্নপূর্ণার দুই চোখে অশ্রু উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল; তিনি বামুনঠাকরুনকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, ছেলে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। তবু পেটে ধরেনি—তা হলে না জানি ও কি করত!

পাচিকা কহিল, সেজন্যই ভগবান বোধ করি দিলেন না, আঠার-উনিশ বছর বয়স হ’ল—

কথাটা শেষ হইতে পাইল না। ছোটবৌ একা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, দিদি, বঠ্‌ঠাকুরকে বলে আমাদের বাড়ির সামনে একটা পাঠশালা করে দেওয়া যায় না? আমি সমস্ত খরচ দেব।

অন্নপূর্ণা হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, এখনো সে দু-পা যায়নি ছোটবৌ, এর মধ্যেই তোর মতলব ঘুরে গেল? না হয়, তুইও যা না পাঠশালে গিয়ে বসে থাকবি।

বিন্দু অপ্রতিভ হইয়া হাসিয়া বলিল, মতলব ঘোরেনি, দিদি। কিন্তু ভাবচি আড়ালে থাকা এক, আর চোখের সামনে এক। পোড়োরা সব দুষ্ট ছেলে, ওকে ছোটটি পেয়ে যদি মারধর করে।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, করলেই বা। ছেলেরা মারামারি করেই। তা ছাড়া সকলের ছেলেই সমান ছোটবৌ, তাদের বাপ-মা প্রাণ ধরে যদি পাঠশালে দিতে পেরে থাকে, তুই পারবি নে কেন?

পরের সঙ্গে তুলনা করাটা বিন্দু একেবারে পছন্দ করিত না। তাই বোধ করি মনে মনে অসন্তুষ্ট হইয়া বলিল—তোমার এক কথা দিদি! ধর, কেউ যদি ওর চোখে কলমের খোঁচাই দিয়ে দেয়—তা হলে?

অন্নপূর্ণা তাহার মনের ভাব বুঝিয়া হাসিয়া বলিলেন, তা হলে ডাক্তার দেখাবি। কিন্তু সত্যি বলচি তোকে, আমি ত সাত দিন সাত রাত বসে ভাবলেও খোঁচাখুঁচির কথা মনে করতে পারতুম না। এত ছেলে পড়ে, কে কার চোখে কলমের খোঁচা দেয় তাও ত শুনিনি।

বিন্দু কহিল, তুমি শোননি বলেই কি এমন কান্ড হতে পারে না? দৈবাতের কথা কে বলতে পারে? আচ্ছা, বেশ ত তুমি একবার বলেই দেখ না, তারপর যা হয় হবে।

অন্নপূর্ণা গম্ভীর হইয়া বলিলেন, যা হবে, তা দেখতেই পাচ্ছি। তুই একবার যখন ধরেচিস তখন কি আর না করে ছাড়বি? কিন্তু আমি অমন অনাছিষ্টি কথা মুখে আনতে পারব না। আর তুইও ত কথা ক’স—নিজেই বল গে না।

এবার বিন্দু রাগ করিল, বলিল, বলবই ত। এত দূরে রোজ রোজ আমি ছেলে পাঠাতে পারব না—এতে কারুর ভাল লাগুক, আর না লাগুক, আর এতে ওর বিদ্যে হোক আর নাই হোক। হাঁ কদম, তোকে না বললুম সিদে দিয়ে আসতে? হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে?

তাহার ক্রুদ্ধভাব লক্ষ্য করিয়া অন্নপূর্ণা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, সিদে দিচ্চি। একেবারে এত উতলা হোসনে ছোটবৌ! আচ্ছা, ছেলে কি তোর বড় হবে না? তুই কি চিরকাল তাকে আঁচল-চাপা দিয়ে রাখতে পারবি? এটা ভাবিস না কেন?

ছোটবৌ সে কথার জবাব না দিয়া বলিল, কদম, সিদে দিয়ে গুরুমশায়ের পায়ের ধূলো একটু তার মাথায় দিয়ে, ছেলে ফিরিয়ে আন গে। তাঁকেও একবার বিকেলবেলা আসতে বলিস।—যে বুঝবে না, তাকে আর বোঝাব কি করে? বলচি ছোটটি পেয়ে যদি কেউ মারধর করে,—না, চিরকাল কি তুই আঁচল-চাপা দিয়ে রাখতে পারবি? কি পারব, না পারব, সে পরামর্শ ত নিতে আসিনি।

বলিয়া সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করিয়া হনহন করিয়া চলিয়া গেল।

অন্নপূর্ণা অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

কদম বলিল, আর দাঁড়িয়ে থেকো না মা, হয়ত এখনি আবার এসে পড়বেন। উনি যা ধরেচেন, বিধাতা-পুরুষেরও সাধ্যি নেই যে তা রদ করেন।

সেইদিন সন্ধ্যার পর বড়কর্তা আফিং খাইয়া শয্যার উপর কাত হইয়া শুইয়া গুড়গুড়ির নল মুখে দিয়া নেশার পৃষ্ঠে চাবুক দিতেছিলেন, এমন সময় দরজার শিকলটা ঝনঝন করিয়া নড়িয়া উঠিল।

যাদব কষ্টে চোখ খুলিয়া বলিলেন, কে ও?

অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, ছোটবৌ কি বলতে এসেচে, শোন।

যাদব ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, ছোটমা? কেন মা?

ছোটবৌকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসিতেন। ছোটবৌ কথা কহিল না, তাহার হইয়া অন্নপূর্ণাই বলিয়া দিলেন,—ওর ছেলের চোখে পোড়োরা কলমের খোঁচা মারবে, তাই বাড়ির মধ্যে একটা পাঠশালা করে দিতে হবে।

যাদব হাতের নলটা ফেলিয়া দিয়া শঙ্কিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, কে চোখে খোঁচা মারলে? কৈ দেখি, কি-রকম হ’ল?

অন্নপূর্ণা তাঁহার হাতের নলটা তুলিয়া দিয়া হাসিয়া বলিলেন, এখনো কেউ মারেনি—যদির কথা হচ্ছে।

যাদব সুস্থির হইয়া বলিলেন, ওঃ, যদির কথা! আমি বলি বুঝি—

বিন্দু আড়ালে দাঁড়াইয়া হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়া গিয়া মৃদুস্বরে বলিল, দিদি, এই না তুমি বললে অনাছিষ্টি কথা মুখে আনতে পারবে না—আবার বলতে এলে কেন?

অন্নপূর্ণা নিজেও বুঝিয়াছিলেন, তাঁহার কথা বলিবার ধরনটা ভাল হয় নাই এবং ইহার ফলও মধুর হইবে না। এখন এই চাপা গলার নিগূঢ় অর্থ স্পষ্ট অনুভব করিয়া তিনি যথার্থই ভীত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার রাগটা পড়িল নিরীহ স্বামীর উপর; এবং তাঁহাকেই উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, আপিং-এর নেশায় মানুষের চোখই বুজে যায়, কানও কি বুজে যায়? বললুম কি, আর ও শুনলে কি! ‘কৈ দেখি কি-রকম হ’ল!’ আমি কি বলেচি তোমাকে, অমূল্যর চোখ কানা করে দিয়েচে? আমার হয়েচে যেন সবদিকে জ্বালা!

নির্বিরোধী যাদবের আফিং-এর মৌজ ছুটিয়া যাইবার উপক্রম হইল; তিনি হতবুদ্ধি হইয়া গিয়া বলিলেন, কেন, কি হ’ল গো?

অন্নপূর্ণা রাগিয়া বলিলেন, যা হ’ল তা ভালই। এমন মানুষের সঙ্গে কথা কইতে যাওয়া ঝকমারি—অধর্মের ভোগ। বলিয়া সক্রোধে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।

যাদব বলিলেন, কি হয়েচে মা, খুলে বল ত?

বিন্দু দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল, বাইরে গোলার ধারে একটি পাঠশালা হলে—

যাদব বলিলেন, এ আর বেশি কথা কি মা! কিন্তু পড়াবে কে?

বিন্দু কহিল, পন্ডিতমশাই এসেছিলেন, তিনি মাসে দশ টাকা করে পেলে পাঠশালা তুলে আনবেন। আমি বলি, আমার সুদের জমা টাকা থেকে যেন সব খরচ দেওয়া হয়।

যাদব সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, বেশ ত মা, কালই আমি লোক লাগিয়ে দেব, গঙ্গারাম এইখানেই যদি তার পাঠশালা তুলে আনে, সে ভাল কথাই।

ভাশুরের হুকুম পাইয়া বিন্দুর রাগ পড়িয়া গেল। সে হাসিমুখে রান্নাঘরে ঢুকিয়া দেখিল, অন্নপূর্ণা মুখ ভার করিয়া বসিয়া আছেন এবং কাছে বসিয়া কদম হাতমুখ নাড়িয়া কি যেন ব্যাখ্যা করিতেছে। বিন্দুকে ঢুকিতে দেখিয়াই সে পাংশুমুখে ‘ওমা এই যে’—বলিয়াই বক্তব্য শেষ করিয়া ফেলিল। বিন্দু বুঝিল তাহার কথাই হইতেছিল, সামনে আসিয়া বলিল, ও মা কি, তাই বল না?

ভয়ে কদমের গলা কাঠ হইয়া গিয়াছিল; সে ঢোক গিলিয়া বলিল, না দিদি, এই কি না—বড়মা বললেন কি না—এই ধর না, কেন—

বিন্দু রুক্ষস্বরে বলিল, ধরেচি—তুই কাজ কর গে যা।

কদম দ্বিরুক্তি না করিয়া উঠিয়া গিয়া বাঁচিল।

তখন বিন্দু অন্নপূর্ণাকে কহিল, বড়গিন্নীর পরামর্শদাতাগুলি বেশ! বঠ্‌ঠাকুরকে বলে ওদের মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।

বিন্দু খুশী থাকিলে অন্নপূর্ণাকে দিদি বলিত, রাগিলে বড়গিন্নী বলিত।

অন্নপূর্ণা জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, যা না বল গে না—বঠ্‌ঠাকুর আমার মাথাটা কেটে নেবে। আর বঠ্‌ঠাকুরও তেমনি! সে তক্ষুণি শুরু করবে, কি মা! কি বলচ মা, ঠিক কথা মা! ঢের ঢের বরাত দেখেচি ছোটবৌ, কিন্তু তোর মত দেখিনি। কি কপাল নিয়েই জন্মেছিলি, মাইরি, বাড়িসুদ্ধ সবাই যেন ভয়ে জড়সড়।

বিন্দুর রাগ হইয়াছিল বটে, অন্নপূর্ণার কথার ভঙ্গীতে সে হাসিয়া ফেলিল। বলিল, কৈ, তুমি ত ভয় কর না!

অন্নপূর্ণা বলিলেন, করিনে আবার! তোমার রণচণ্ডী মূর্তি দেখলে যার বুকের রক্ত জল হয়ে না যায় সে এখনো মায়ের পেটে আছে! কিন্তু অত রাগ ভাল নয় ছোটবৌ! এখনো কি ছোটটি আছিস? ছেলে হলে যে এতদিন চার-পাঁচ ছেলের মা হতিস। আর তোকেই বা দোষ দেব কি, ঐ বুড়ো মিনসেই আদর দিয়ে তোর মাথাটা খেলে।

বিন্দু বলিল, কপাল নিয়ে যে জন্মেছিলুম দিদি, সে কথা তোমার মানি; ধন-দৌলত, আদর-আহ্লাদ অনেকেই পায়, সেটা বেশী কথা নয়, কিন্তু এমন দেবতার মত ভাশুর পেতে অনেক জন্ম-জন্মান্তরের তপস্যার ফল থাকা চাই। আমার অদৃষ্ট দিদি, তুমি হিংসে করে কি করবে? কিন্তু আদর দিয়ে তিনি ত মাথা খাননি, আদর দিয়ে যদি কেউ মাথা খেয়ে থাকে ত, সে তুমি।

অন্নপূর্ণা হাত নাড়িয়া বলিলেন, আমি? সে কথা কারো বলবার জো নেই। আমার শাসন বড় কড়া শাসন—কিন্তু কি করব, আমার কপাল মন্দ, কেউ আমাকে ভয় করে না—দাসী-চাকরগুলো পর্যন্ত মুখের সামনে দাঁড়িয়ে সমানে ঝগড়া করে, যেন তারাই মনিব, আর আমি দাসী-বাঁদী! আমি তাই সয়ে থাকি, অন্য কেউ হলে—

তাঁহার এই উলটা-পালটা কথায় বিন্দু খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল। বলিল, দিদি, তুমি সত্যযুগের মানুষ। কেন মরতে একালে এসে জন্মেছিলে? কৈ, আমার সঙ্গে ত কেউ ঝগড়া করে না? বলিয়া সহসা সুমুখে আসিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দুই বাহু দিয়া অন্নপূর্ণার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, একটা গল্প বল না, দিদি!

অন্নপূর্ণা রাগিয়া বলিলেন, যা, সরে যা।

কদম ছুটিয়া আসিয়া বলিল, দিদি, অমূল্যধন জাঁতিতে হাত কেটে ফেলে কাঁদচে।

বিন্দু তৎক্ষণাৎ গলা ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জাঁতি পেলে কোথায়? তোরা কি কচ্ছিলি?

আমি ও-ঘরে বিছানা করছিলুম দিদি, জানিও নে কখন ও বড়মার ঘরে ঢুকে—

আচ্ছা হয়েচে—হয়েচে—যা, বলিয়া বিন্দু ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। খানিক পরে অমূল্যের আঙুলের ডগায় ভিজা ন্যাকড়ার পটি বাঁধিয়া কোলে করিয়া আসিয়া বলিল, আচ্ছা দিদি, কতদিন বলেচি তোমাকে, ছেলেপুলের ঘরে জাঁতি-টাঁতিগুলো একটু সাবধান করে রেখো—তা—

অন্নপূর্ণা আরো রাগিয়া গিয়া বলিলেন, কি কথা যে তুই বলিস ছোটবৌ, তার মাথা-মুণ্ডু নেই। কখন তোর ছেলে ঘরে ঢুকে হাত কাটবে বলে কি জাঁতি নোয়ার সিন্দুকে বন্ধ করে রাখবো?

বিন্দু বলিল, না, কাল থেকে ওকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবো, তা হলে আর ঢুকবে না, বলিয়া বাহির হইয়া গেল।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, শুনলি কদম, ওর জবরদস্তির কথাগুলো! জাঁতি কি মানুষ সিন্দুকে তুলে রাখে!

কদম কি একটা বলিতে গিয়া হাঁ করিয়া থামিয়া গেল।

বিন্দু ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ফের যদি তুমি দাসী-চাকরকে মধ্যস্থ মানবে ত, সত্যি বলচি তোমাকে, ছেলে নিয়ে আমি বাপের বাড়ি চলে যাব।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, যা না যা। কিন্তু মাথা খুঁড়ে মলেও আর ফিরিয়ে আনবার নামটি করবো না। সে কথা মনে রাখিস।

আমি আসতেও চাইনে, বলিয়া বিন্দু মুখ ভার করিয়া চলিয়া গেল।

ঘন্টা-দুই পরে অন্নপূর্ণা দুমদুম করিয়া পা ফেলিয়া ছোটবৌয়ের ঘরে আসিয়া ঢুকিলেন। ঘরের একধারে একটি ছোট টেবিলের উপর মাধবচন্দ্র মকদ্দমার কাগজপত্র দেখিতেছিলেন এবং বিন্দু অমূল্যকে লইয়া খাটের উপর শুইয়া আস্তে আস্তে গল্প বলিতেছিল। অন্নপূর্ণা বলিলেন, খাবি আয়।

বিন্দু বলিল, আমার খিদে নেই।

অমূল্য তাড়াতাড়ি খুড়ীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, ছোটমা খাবে না, তুমি যাও।

অন্নপূর্ণা ধমক দিয়া বলিলেন, তুই চুপ কর। এই ছেলেটিই হচ্ছে সকল নষ্টের গোড়া। কি আদুরে ছেলেই কচ্চিস ছৌটবৌ! শেষে টের পাবি। তখন কাঁদবি আর বলবি, হ্যাঁ, দিদি বলেছিল বটে!

বিন্দু ফিসফিস করিয়া অমূল্যকে শিখাইয়া দিল, অমূল্য চেঁচাইয়া বলিল, তুমি যাও না দিদি—ছোটমা রূপকথা বলচে।

অন্নপূর্ণা ধমকাইয়া বলিলেন, ভাল চাস ত উঠে আয়, ছোটবৌ! না হলে কাল তোদের দুজনকে না বিদেয় করি ত আমার নামই অন্নপূর্ণা নয়, বলিয়া যেমন করিয়া আসিয়াছিলেন, তেমনি করিয়া পা ফেলিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

মাধব জিজ্ঞাসা করিল, আজ আবার তোমাদের হ’ল কি?

বিন্দু বলিল, দিদি রাগলে যা হয় তাই। আজ অপরাধের মধ্যে বলেছিলুম, ছেলেপুলের ঘর, জাঁতি-টাঁতিগুলো একটু সাবধান করে রেখো—তাই এত কান্ড হচ্ছে।

মাধব বলিল, আর গোলমাল ক’রো না, যাও। বৌঠান যেমন করে পা ফেলে বেড়াচ্ছেন, দাদা এখনি উঠে পড়বেন।

বিন্দু অমূল্যকে কোলে তুলিয়া লইয়া হাসিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।