ভারতনাট্যম
আট
২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।
‘মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও, মাসুদ রানা!’ ঠিক চার ফুট সামনে থেকে ভেসে এল জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর।
এয়ারকুলারের একটা মৃদু গুঞ্জন এল কানে। সাউণ্ড প্রুফ ঘরটায় একজনকে গুলি করে হত্যা করা হলে পাশের ঘরের কেউ টের পাবে না। কিন্তু চমকে উঠল না রানা। ডান হাতটা দ্রুত চলে এল না কোটের নীচে বগলের কাছে লুকানো স্প্রিংলোডেড শোল্ডার হোলস্টারের কাছে। এক লাফে সরে গেল না, ও আততায়ীকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার জন্য। যেমন ছিল, তেমনি স্থির হয়ে বসে রইল। কোনও রকম চাঞ্চল্যই প্রকাশ পেল না রানার ব্যবহারে। কারণ, কথাটা উচ্চারিত হয়েছে পুরু কাঁচ ঢাকা দামি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে পিঠ-উঁচু চেয়ারটায় বসা মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খানের কণ্ঠ থেকে।
‘বড় বীভৎস মৃত্যু, স্যর! যাই হোক, আমি প্রস্তুত। কিন্তু ঘণ্টা তিনেক সময় দিতে হবে। মৃত্যুর পর তো আর হবে না—কয়েকটা কাজ সেরে নিতে চাই।’
‘আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় আছে।’ হাভানা ধরিয়ে নেবার জন্য থামলেন রাহাত খান, তারপর টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন, ‘আর এই চিঠিটা রেখে দাও। ইচ্ছে করলে আজই নাভানা ট্রের্ডাস থেকে ডেলিভারি নিতে পারো তোমার নতুন টয়োটা করোনা গাড়ি।’
করোনা পেয়ে রানার ভিতরে কী প্রতিক্রিয়া হবে ভালভাবেই জানা আছে রাহাত খানের। তাই আর রানার মুখের দিকে না চেয়ে একটা ফাইল নিয়ে পাতা ওল্টাতে আরম্ভ করলেন।
রানা তুলে নিল চিঠিটা। শেষ কালে ফিফটিন হান্ড্রেড সিসি ফ্যামিলি কার! ছি, ছি। ক্ষোভে, দুঃখে নিজের আঙুল কামড়াতে ইচ্ছে করল রানার। মনটা বিষিয়ে গেল বসের উপর। অনেক চেষ্টায় মুখের চেহারাটা ভদ্রোচিত রেখে বলল, ‘কিন্তু। অন্য কোনও বাজে গাড়ি নিয়ে গেলে হয় না, স্যর? আমার জাগুয়ারটা এভাবে ভেঙেচুরে…মানে ওটা আমার…’
‘যত প্রিয় গাড়িই হোক না কেন ওটাতেই তোমার অ্যাকসিডেন্ট করতে হবে। গাড়ির চেয়ে তোমার প্রাণের মূল্য অনেক বেশি। আমি চাই না ভবিষ্যতে তুমি একটা অসাধারণ গাড়ি চালিয়ে ফিল্ম স্টারের মত সবার মুখ-চেনা হয়ে যাও। ওই গাড়ি চালানো আজই শেষ। আরেকটা জিনিস, শত্রুপক্ষের ফাইলে তোমার অভ্যাস সম্পর্কে একটা স্পেশাল নোট আছে। সেটা হচ্ছে তোমার সিগারেটের ব্র্যাণ্ড–সিনিয়র সার্ভিস। ওটা ত্যাগ করে আমাদের দেশি কোনও ব্র্যাণ্ড বেছে নিতে হবে তোমাকে। চোখে পড়ার মত কোনও শখ বা অভ্যাস তোমার জীবনে হারাম।’
‘বুঝলাম, স্যর। কিন্তু হঠাৎ আমার মৃত্যু-সংবাদ ছাপছেন কেন কাগজে? চেনাজানা লোক জিজ্ঞেস করলে কী বলব?’ কাজের কথায় আসতে চেষ্টা করল রানা।
‘আগামী কয়েকদিন চেনাজানা লোকের সঙ্গে তোমার দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। আগামীকাল ভোর চারটের ফ্লাইটে তুমি যাচ্ছ রেঙ্গুন হয়ে ব্যাঙ্কক। তারপর থাইল্যাণ্ডের ব্যবসায়ী হিসাবে আসছ কলকাতায়—ওখান থেকে যাচ্ছ টিটাগড়। আমি চাই আইএসএস যেন তোমার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে। সহজে যেন তোমার ছদ্মবেশ ধরতে না পারে। ওরা খবরের কাগজ এবং গোপন ওয়ায়ারলেসের মাধ্যমে তোমার মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদ পাবে। কল্পনাও করতে পারবে না তোমার টিটাগড়ে উপস্থিতি। তারপর যখন কাজ উদ্ধার করে ফিরে আসবে এখানে… অবশ্য যদি ফেরা সম্ভব হয়, (মুচকে হাসলেন রাহাত খান) তখন ভুল সংশোধন করে ছোট্ট দু’তিন লাইন আবার ছাপা যাবে পত্রিকায়। সে সব তোমার ভাবতে হবে না।
‘টিটাগড় গিয়ে কী করতে হবে আমাকে?’
‘সেটা বলবার জন্যেই ডেকেছি আজ তোমাকে। আধঘণ্টার মধ্যেই আসছেন জুয়োলজিকাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডাইরেক্টর ডক্টর আলী আকবর। অনেক কথা জানতে পারবে তার কাছে। তার আগে এই পৃষ্ঠা দুটোতে একবার চোখ বুলিয়ে নাও। ‘B’ লেখা কাগজটা ভাল করে পড়; ওইটাই আসল।’
সাগ্রহে ফাইলটা নিল রানা। কিন্তু পরমুহূর্তেই চুপসে গেল ফাটা বেলুনের মত। হাফ-ফুলস্ক্যাপ কাগজের ওপর ইংরেজিতে টাইপ করা:
‘A’
LOCUST
Species:
- Locusta migratoria L.—widest range of distribution, universal between L. 20; N-60. S: five sub. species.
- (a) L. migratoria migratoria—South East Russia.
- (b) L. migratoria rossica—Central russia & Western Europe.
- (c) L. migratoria migratorioides—Africa & Western Asia.
- (d) L. migratoria capito—Madagascar.
- (e) L. migratoria manilensis—Malayasia, East Indies, Phillipines & China.
- Melanophis Spretus Walsch (M. mexicanus Sanss). Plains of America.
- Chortoicetes terminfera (walker) –Australian Plague Locust.
- Docistaurus maroccanus—Moroccan Locust—Countries of the Mediterranean, West & South Russia.
- S. Peranensis—South American Locust.
- Locustana pardalina—Brown Locust-South Africa.
- Nomadacris septemfasciata—Red Locust—South Africa.
- 8.Schistocera gregaria—Desert Locust—Whole of Africa and wes tern Indo-Pakistan.
- Patanga succincta—(Acridium succinctum)–Bombay Locust– Indo-Malayasia.
‘B’
Patanga succincta
(Bombay Locust)
- Breeding habit—desert or semi-desert areas.
- 150 to 200 eggs at a time in the sand by a single female.
- Humidity and temperature have great effect at all phases.
- Morphological diff.—Ph. Gregaria—6 eyestrips 26
antennal segments
ph. Solitaria—6-7 eye strips
27-28 antennal segments.
- Stages a) Egg) b) Pupa c) Larva (hopper) d) Adult.
- Swarm Movements—Down-wind direction.
- Wing Movement—17 cycles per second.
- Speed—2.5 miles to 3 miles per hour.
- Flight habit—Day time. Never fly at night or early morning.
- Locusticides. r-BHC and DNC are effective. But no locusticide can repulse a swarm at flight.
কাগজ দুটো শেষ করেই চোখ তুলল রানা। দেখল তার দিকে চেয়ে আছেন রাহাত খান। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি।
‘এ যে দেখছি পঙ্গপালের ইতিবৃত্ত! এর সঙ্গে টিটাগড়ের সম্পর্ক কী?’
‘সত্যিই কোনও সম্পর্ক আছে কি না আমরা কেউ-ই জানি না। সবই অনুমান। নিশ্চিত হবার জন্যেই তোমাকে পাঠানো হচ্ছে সেখানে। এখন শোনো, সবটা ব্যাপার খুলে বলি। তুমি যে সবুজ গোলাকার জিনিসটা পাঠিয়েছিলে ঈশ্বরদি থেকে, সেটা একটা বিচিত্র টাইমবম্ব। এর মধ্যে ঘড়ির মত কোনও ব্যবস্থা নেই। ছোট্ট একটা ছিদ্রবিশিষ্ট অ্যাসিডের ক্যাপসুল আছে। একটা প্লাস্টিকের ফিউজকে নির্দিষ্ট গতিতে জ্বালাতে জ্বালাতে এগোচ্ছে সে অ্যাসিড। যখনই পুরো পাস্টিকের ফিউজটা ক্ষয় হয়ে যাবে, অমনি ফাটবে বম্ব।’
এইবার কিছুটা উৎসাহ বোধ করল রানা। সোজা হয়ে বসল সে। ছাই ঝেড়ে নিয়ে আবার আরম্ভ করলেন রাহাত খান।
‘কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো? ওর ভেতর লোহা লক্কড়ের বদলে আছে পাতলা কয়েকটা কাঁচের গোলক। তেল জাতীয় একটা জিনিস ভরা সবগুলোর মধ্যে। বোমাটা ফাটলে পরে এগুলো ছিটকে অনেক দূরে গিয়ে পড়বে।’
‘কী জিনিস ভরা সেই কাঁচের বলে?’
‘Molasses scent—চিটাগুড়ের গন্ধ। আর কিছু না। বল ভাঙলেই দশ মিনিটের মধ্যে উড়ে যাচ্ছে বাতাসে ভেসে। ডক্টর আলী আকবর ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন একটা বল। ওঁর রিপোর্টে দেখছি প্রথম চিটাগুড় থেকে তেল জাতীয় এই গন্ধ এক্সট্রাক্ট করে নিয়ে তার মধ্যে হাইপ্রেশার দিয়ে হাইড্রোজেন মলিকিউল তুলে নিয়ে বয়লিং পয়েন্ট পনেরো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট করে দেয়া হয়েছে। একে ডিহাইড্রোজেনেশন বলে। বয়লিং পয়েন্ট যদি অতখানি নিচু করে দেয়া যায় তা হলে এ ধরনের যে কোনও জিনিস মিনিমাম অ্যাটমসফেরিক টেম্পারেচারেও এভাপোরেট করবে। বাতাসে উড়ে যাবে স্পিরিটের মত।’
‘কিন্তু তাতে লাভ কী হবে ভারতের?’
‘সেটাই তো প্রশ্ন। হিসেব করে দেখা গেছে, যে হারে প্লাস্টিক ফিউজটা ক্ষয় হচ্ছে, তাতে আগামী ৬ই সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে তিনটায় ফাটবে টাইম বম্ব। প্রত্যেকটা বোমাই একসঙ্গে ফাটবে বলে ধারণা করে নেয়া অসঙ্গত হবে না। এখন ওই বিশেষ দিনে যদি সারা পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা বরাবর এই সেন্ট বম্ব ফাটে, তা হলে কী এমন সুবিধা হতে পারে ভারতের? ডক্টর আকবর সমাধান দিচ্ছেন—পঙ্গপাল!’
‘পঙ্গপাল!’ রানার বুকের মধ্যে কলজে বরাবর কেউ যেন হাতুড়ির ঘা দিল একটা। একসঙ্গে দ্রুত অনেকগুলো চিন্তা খেলে গেল মাথার মধ্যে। একটা ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা উঁকি দিল মনের কোণে। হতেও তো পারে, ওদের দ্বারা অসম্ভব কী?’
ইন্টারকমে গোলাম সারওয়ারের গলা শোনা গেল।
‘ডক্টর আলী আকবর, স্যর।’
‘ভেতরে পাঠিয়ে দাও। আর নাসরীনকে বলো, যেন নিজ হাতে তিন কাপ কফি বানিয়ে পাঠিয়ে দেয় আমার কামরায়।’
চট করে একবার রাহাত খানের দিকে চেয়ে নিয়ে মনে মনে হাসল রানা। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন ঘরে। উঠে দাঁড়িয়ে সাদরে ডেকে বসালেন তাকে রাহাত খান। ফর্সা গায়ের রঙ, খয়েরি চোখের মণি। ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিলেতি ছাঁটের নীল সুট। প্রশস্ত কপালে প্রতিভার ছাপ। রানার পাশের চেয়ারটা ছেড়ে বসলেন ডক্টর আলী আকবর। হাতের অ্যাটাচি কেসটা রাখলেন খালি চেয়ারের উপর। পরিচয় দিলেন রাহাত খান।
‘আমি রানাকে সমস্ত ব্যাপার মোটামুটি বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম। ও যাচ্ছে আমাদের তরফ থেকে টিটাগড়ে। রানা আমাকে জিজ্ঞেস করছিল ওই সেন্ট থেকে আপনি পঙ্গপালের কথা মনে করলেন কেন? আপনিই বরং বুঝিয়ে দিন।’
‘এটা খুব সাধারণ কথা। এই গন্ধ লোকাস্ট-কে আকর্ষণ করে, এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় রিসার্চ সেন্টারে পঙ্গপাল ধ্বংস করবার জন্যে লোকাস্টিসাইড তৈরি হচ্ছে এবং এই সেন্ট-এর সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই গন্ধের সঙ্গে পঙ্গপাল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।’
‘কিন্তু,’ রাহাত খান সূত্রটা ধরলেন কথার, ‘দেখা যাচ্ছে লোকাস্টিসাইডের কোনও চিহ্নও নেই, শুধু গন্ধটাই ছড়াতে চাইছে ওরা আমাদের আকাশে-বাতাসে। তার মানে কী হতে পারে? একটাই অর্থ আপাতত মনে হচ্ছে : ওরা সীমান্ত থেকে পঙ্গপাল ছাড়বে ওই দিন। বিনা যুদ্ধেই আমাদের এই কৃষিপ্রধান দেশ ধ্বংস করে দেবে। তাই না?’
‘সত্যিকার কোনও ক্ষতি করবার মত অত পঙ্গপাল পাবে কোথায় ওরা, স্যর?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আমার কাছেও ব্যাপারটা খুবই অবাস্তব বলে মনে হয়েছে, মি. খান।’ বললেন ডক্টর আলী আকবর। যদিও আমি একে সম্ভব বলে বিশ্বাস করি না, তবু সারাদিন ছটফট করেছি দুশ্চিন্তায়, এবং শেষ পর্যন্ত কাল সারা রাত পরিশ্রম করে একটা সলিউশন তৈরি করেছি। স্প্রে-গানে ভরে এনেছি সেটা। যদি সত্যিই ওখানে গিয়ে দেখেন পঙ্গপালের কারবার, তা হলে এই সলিউশনটা স্প্রে করে আসবেন। অ্যাটাচি কেস থেকে একটা কৌটো বের করে সযত্নে টেবিলের ওপর রাখলেন তিনি।
‘কী আছে এতে?’
‘ম্যাটারিজিয়াম।’
কফি এল। চুপচাপ কফি খেলেন, তারপর হঠাৎ ঘড়ির দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর আকবর।
‘এটা দিতেই এসেছিলাম। পরে আরও আলাপ হবে, এক্ষুণি আমার একটা ক্লাস আছে, আজ আসি।’
‘আপনি কি ইউনিভারসিটিতে এখনও আছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান।
‘তা ঠিক নেই, পুরনো অভ্যেস, বুঝলেন না? সুপারনিউমারারি করে রেখেছে, এক-আধটা ক্লাস নিই। আচ্ছা আসি।’
ব্যস্ত-সমস্ত প্রফেসর বেরিয়ে গেলেন। ওঁর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন রাহাত খান। বললেন, ‘অদ্ভুত মানুষ! জীবনে ছুটি কাকে বলে জানেন না। এই রকম আরও কিছু লোক থাকা দরকার ছিল আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেগুলোতে।’
আবদুল কাপ নিতে এল। এক চুমুকে অবশিষ্ট কফি শেষ করে আবার কাজের কথায় ফিরে গেলেন রাহাত খান।
‘তা হলে দাঁড়াল এই, আমাদের দেশে ভারতীয় গুপ্তচরদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে; কিন্তু আসল উদ্দেশ্য সঠিক জানা যাচ্ছে না। অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সবটুকু। কাজেই তোমাকে যেতে হচ্ছে টিটাগড়। দুই বর্গ মাইল জায়গা জোড়া ওদের সেই নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকতে হবে তোমার। প্রথম কাজ ওদের হাতে ধরা না পড়া। কারণ, তা হলে নিশ্চিত মৃত্যু। দ্বিতীয় কাজ, সত্যিসত্যিই ওরা কী করছে ওখানে, কী ওদের ভবিষ্যৎ প্ল্যান ইত্যাদি জেনে আসা। কিছুতেই একা কিছু করবার চেষ্টা কোরো না। একটা গোটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একা তোমার কিছুই করবার নেই। ক্ষতিকর কিছু দেখলে আমরা অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
‘আর যদি ধরা পড়ে যাই, তবে?’
‘বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণত্যাগ করো।’
‘কোনও রকম সাহায্যের ব্যবস্থা থাকবে না?’
‘না। আপাতত সম্ভব হচ্ছে না।’
‘কিন্তু ওদের আড্ডার ভেতর আমি ঢুকব কেমন করে?’
‘সেটা এখানে বসে আমি কী করে বলি, বলো? অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তুমি নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা মত। ওই যে, ওদের একটা মেয়ে স্পাই…কী যেন নাম…ও, মিত্রা সেন। যার জন্য এতগুলো ক্ষমতাশালী লোককে পুত্রহারা করলে তুমি—তার সঙ্গে তো তোমার খুব, মানে (বাম হাতের মধ্যমা দিয়ে ডান চোখের নীচটা একটু চুলকে নিলেন রাহাত খান), বেশ খানিকটা অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। তার কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্যের আশা আছে?’
‘না, স্যর। ও একটু অন্য ধরনের মেয়ে। মানে…’
‘আচ্ছা, আচ্ছা। ও কেমন মেয়ে আমার না জানলেও চলবে। এদিকে ইয়াং টাইগারসের পিতৃদেবরা আমার মাথা চিবিয়ে খাবার চেষ্টা করছে। উঁচু মহলটা তোলপাড় করে ফেলেছে একেবারে। মহা ঝামেলায় পড়েছি। যাক, সেইদিন যদি শুভেচ্ছা মিশনের দলটাকে ধরতে পারতে, তবে আর এত ঝামেলা পোহাতে হত না।’
‘ভোরে উঠে দেখছি ডাকবাংলো সাফ। নদীপথে পার হয়ে গেছে।’
‘তোমার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।’ অসমর্থন-সূচক মাথা নাড়লেন রাহাত খান।
এরপর অপারেশন গুডউইল সম্পর্কে আলোচনা হলো। কয়েকটা ম্যাপ এঁকে রাহাত খান কী কী সব বোঝালেন রানাকে। সবরকম সম্ভাবনাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হলো। তারপর একসময় আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে এল রানা সে ঘর থেকে।
রাহাত খানের ঘর থেকে বেরিয়েই একটা সিগারেট ধরাল রানা, তারপর প্যাকেট সুদ্ধ বাকি পনেরোটা সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে। নিজের কামরায় গিয়ে বসল রানা চিন্তান্বিত মুখে। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে ভবিষ্যৎ কাজগুলো।
‘কী ব্যাপার? বড় সাহেব মেরেছে নাকি?’ নাসরীন রেহানা সামনে এসে দাঁড়াল।
‘মেরেছে মানে? একেবারে খুন করে ফেলেছে। কাল খবরের কাগজে দেখবে।’
‘বুঝলাম না।’
‘এখন বুঝে কাজ নেই। কাল কাগজ হাতে নিয়েই বুঝতে পারবে। এখন এই চিঠিটা নিয়ে নাভানা ট্রেডার্সে চলে যাও তো সোজা। ওদের শো-রুম থেকে যে রঙটা তোমার পছন্দ হয় সে রঙের একটা করোনা নিয়ে চলে এসো। আর আবদুলকে বলে যেয়ো, এক প্যাকেট ক্যাপস্ট্যান সিগারেট নিয়ে আসবে আমার জন্যে। এই যে টাকা।’
‘ক্যাপস্ট্যান?’ দুই চোখ কপালে তুলল রেহানা।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ক্যাপেস্ট্যান। কানে কম শোনো নাকি? যাও ভাগো। আমার মেজাজ এখন তিন-চাররকম হয়ে আছে। ঘাটিয়ো না আমাকে।’
‘ওরেব্বাপস!’ কেটে পড়ল রেহানা।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল মাসুদ রানা।
গ্রীন রোডের একটা ছোট্ট মোটর ওয়ার্কশপের সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে থামল লরেল গ্রীন মেটালিক কালারের একখানা আনকোরা টয়োটা করোনা। সামনে পিছনে ON TEST লাগানো।
‘আরে, আসুন, আসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম। বাঁচবেন অনেক দিন।’ রানাকে দেখেই হৈ হৈ করে এগিয়ে এল দেওয়ান মটর ওয়ার্কসের এনামুল হক; পাতলা-সাতলা ছিমছাম চেহারা। কপালটা ক্রমেই বড় হয়ে যাচ্ছে—মাঝখানে কিছু চুল রেখে মাথার দুই পাশ দিয়ে এগোচ্ছে টাক। ডান গালে চোয়ালের কাছে। কোনও হাতুড়ে ডাক্তারের অপারেশনের দাগ, গর্ত হয়ে আছে। বাড়ি মুর্শিদাবাদ। রানার গাড়ির একমাত্র অভিভাবক।
‘এ যে দেখছি নতুন গাড়ি। কোনও বন্ধুর বুঝি?’ করোনাটার দিকে একবার চেয়েই ঔৎসুক্য হারিয়ে ফেলল এনামুল হকের পাকা চোখ। অন্য কথায় চলে গেল।
‘আপনার জাগুয়ারের পিস্টন রিং চেঞ্জ করে দিয়েছি, আর ধোঁয়া নেই। ট্যাপেট আর ডিসট্রিবিউটার এবার ঠিকমত অ্যাডজাস্ট হয়েছে, খেয়াল করেছেন?’
জাগুয়ারের কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল রানার। ঘণ্টা দেড়েক পর নিজ হাতে ধ্বংস করতে হবে ওকে একান্ত প্রিয় গাড়িটা। খবরটা জানতে পারলে রানার মতই অন্তরে আঘাত পেত এনামুল হক।
‘গাড়িটা বন্ধুর নয়। আমার। এখন থেকে ওটাই চালাতে হবে আমাকে। জাগুয়ার বাদ।’
‘জাগুয়ার বাদ? জাগুয়ার ছেড়ে এই গাড়ি চালাবেন আপনি?’ তাজ্জব হয়ে গেল হক সাহেব।
‘হ্যাঁ। ওপরওয়ালার হুকুম। তাই আপনার কাছে ওটা নিয়ে এলাম। একটু মানুষ করে দিতে হবে।’
‘তা করা যাবে, কিন্তু জাগুয়ারটা—ছি ছি ছি। আচ্ছা যাই হোক, কী আর করা।’ গলাটা হঠাৎ উঁচু করে হাঁক ছাড়ল হক সাহেব, ‘ওই পিচ্চি, দিলু মিঞাকে বল্ মাসুদ সাহেব এসেছেন, ফাস কেলাস করে ডালপুরি আর চা। তাড়াতাড়ি করতে বলিস, বাবা।’
একটা চেয়ার হক সাহেবের খুব কাছে টেনে নিয়ে বসল রানা। তারপর ঘাড়ের ওপর দিয়ে বুড়ো আঙুলে করোনাটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘এগুলো বোধহয় ঘণ্টায় আশি-পঁচাশি করে। না?’
‘হ্যাঁ, তা ওই রকমই। এর বেশি আর কি আশা করেন?’
‘কমপক্ষে একশো তিরিশ। পারবেন?’
‘পারব না কেন? একটু সময় লাগবে। নতুন গাড়ি, মাত্র শো-রুম থেকে বের করেছেন, ক’দিন চালান, তারপর এক সময়…’
‘নতুন গাড়ির মোহ আমার নেই, হক সাহেব, আপনি ভাল করেই জানেন। তা ছাড়া আগামী কয়েকদিন আমি ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। এটা আমি এখনই এখানে ছেড়ে ট্যাক্সিতে ফিরব বাসায়। ফিরে এসে কমপ্লিট চাই। কী কী বদলাতে হবে?’
‘সে অনেক কিছু। প্রথমে তো চেসিস আর বডির ওজন কমাতে হবে; ইঞ্জিনের রোটেটিং আর রেসিপ্রোকেটিং পার্টসের ওজন কমাতে হবে। সিলিণ্ডার হেড মেশিনিং করে কম্প্রেশন রেশিও বাড়াতে হবে; ইনলেট পার্টসগুলোকে হাই পলিশ লাগাতে হবে—যাতে ভাল ফ্লো পাওয়া যায়, কাস্ট আয়রন থাকলে ফ্লো অত সুবিধের হয় না; সাইলেন্সর বক্স উড়িয়ে দিয়ে ডাইরেক্ট একজস্ট পাইপ দিতে হবে; টুইন ডাউনড্রাফট কারবুরেটর লাগাতে হবে; (রানার বাড়ানো প্যাকেট থেকে ক্যাপস্ট্যান না নিয়ে নিজের কিংস্টর্ক বের করল এনামুল হক) তা ছাড়া কম্বাসচন। চেম্বারের ডিজাইন বদলে ফেলতে হবে; আরও শক্তিশালী ভ্যালভ স্প্রিং দিতে হবে; স্পেশাল ক্যামশ্যাফট ফিট করতে হবে; ট্যাপেট-ক্লিয়ারেন্স বাড়িয়ে দিতে হবে; ইনডাকশন র্যামিং এফেক্টের জন্যে সুপার চার্জার লাগাতে হবে। তার ওপর একখানা ওভার ড্রাইভ ইউনিট ফিট করে দেব ইঞ্জিন স্পিড হুইল স্পিডের সমান হয়ে যাবে, পেট্রোলও খাবে অপেক্ষাকৃত কম। সাধারণ গাড়িতে ইঞ্জিন স্পিড হুইল স্পিডের ডবল থাকে—সমান করে দিলে, বুঝতে পারছেন না, কত বেশি স্পিড পাচ্ছেন? এ ছাড়া আরও দু’একটা টুকিটাকি জিনিস আছে। যেমন, কুলিং সিস্টেমটা ইমপ্রুভ করতে হবে, কারণ বুঝতেই পারছেন…’
‘কিছু বুঝতে পারছি না, হক সাহেব,’ আর সহ্য করতে পারল না রানা। ‘এবং বুঝবার কিছুমাত্র আগ্রহও নেই। এসব আপনি বুঝলেই চলবে। স্পিড কত পাচ্ছি শুধু সেটাই বলেন, সাহেব।’
‘তা, কমপক্ষে হানড্রেড টোয়েনটি তো বটেই। ঠিক কত পাবেন বলা মুশকিল। বেশিও হতে পারে।’
‘ব্যস, তা হলেই খুশি। কিন্তু হবে তো?’
‘হবে না কেন, বিদেশে হরদম হচ্ছে। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, যে রকম স্পিড আর পিক-আপ চাইছেন, তাতে পেট্রোল কনজাম্পশন বেড়ে যাবে অনেক।’
‘তা হোক। এই পাঁচ হাজার টাকার চেক রেখে যাচ্ছি—আরও যা লাগে লাগিয়ে দেবেন। এক হপ্তার মধ্যে আসছি আমি।’
‘আরে সে-সব আমাকে বলতে হবে না। চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, নিন আরম্ভ করুন।’
রানার প্রিয় ডালপুরি—দিলুর নিজ হাতে তৈরি—আর চা শেষ করে সিগারেট ধরাল দুজন। ঠিক এমনি সময় ঢুকল এসে ইদু মিঞা।
‘ওস্তাদ, আমার গাড়িটা আবোর ফির টেরাবোল দিতাছে! ইকজিরিসা দেইখা দিবার লাগব।’ হঠাৎ রানার দিকে চোখ পড়তেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল ইদু মিঞা। ‘আরে আপনে এইখানে, হুজুর! ওস্তাদের লগে জানপয়চান আছে বুজি?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, জান পয়চান আছে। আয় দেখি তোর গাড়ির কী হয়েছে!’ ধমকের সুরে বলল হক। তারপর তিনজন এসে দাঁড়াল ট্যাক্সির সামনে। ‘দে, স্টার্ট দে দেখি!’
ইদু মিঞা স্টার্ট দিল কিন্তু কোনও ট্রাবল পাওয়া গেল না। রানা একটু অবাক হলো।
‘ব্যাটা শয়তান, এই রাস্তা দিয়ে যখনই যাবে, নেমে এসে এরকম বিরক্ত করবে। কিছু না, ঠিক আছে গাড়ি।’ রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘এটা ওর একটা বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই পথে যেতে একবার থামা চাই।’
‘আরে না না, ওস্তাদ। আপনেরে দেখলেই হালায় টেরাবল যায় গা।’
হাঁসে ইদু মিঞা। ‘আহেন, হুজুর, কোন দিকে যাইবেন?’ রানাকে ডাকল এবার সে।
‘তোমার গাড়িতে উঠব না।’
‘কেলেগা, হুজুর, ব্যাদ্দবি অইছে কোনও?’
‘না। ভাড়া না নিলে তোমার গাড়িতে আর ওঠা যাবে না।’
‘কী কন, হুজুর। বারার লগে কী? দিলে দিবেন, না দিলে না দিবেন। মাগার বেইনসাফ দিবার পারবেন না। পুরানা পল্টন থেইকা এয়ারপোর্ট-ঘ্যাচ কইরা বিশটা টাকা বাইর কইরা দিলেন। পাঁচ ট্যাকা বি কেরায়া অহে না। বেইমান পাইছেন আমারে?’
‘আর এদিক-ওদিক যে ঘুরলে?’ গাড়িতে উঠে বসে বলল রানা।
‘গুরলাম তো বেহুদা, হুজুর। আপনে বি চুপ থাকলেন। আইবি লাগছে মনে কইরা খামাখা লৌর পারলাম।’ গাড়ি ছেড়ে দিল ইদু মিঞা। রানা হাত নাড়ল এনামুল হকের দিকে।
‘মতিঝিল। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশন।’
কথার খেই ধরে আবার আরম্ভ করল ইদু মিঞা।
‘উই হালার পিছে লাগছিলাম আমি এয়ারপোর্ট থেইকা, দেখি হালায় যায় কই। আইবি না আইবি-র … উইটা। ভাগতে ভাগতে এক্কেরে রমনা পার্ক। গাড়ি ফালায়া গেল গা …মারানি। আমি…’
‘আজ রাত তিনটের সময় আমার বাসায় আসতে পারবে?’
‘পারুম না কেলেগা, স্যর? মাহাজনের গাড়ি তো না, আপনা গাড়ি।’
‘বেশ, এসো তা হলে।’
ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা সাততলা বাড়িটার মধ্যে। ভাবল ভোর রাতে ইদু মিঞাকে বলে দেবে যেন আগামী কাল একবার এনামুল হকের সঙ্গে দেখা করে দুপুরের দিকে। নিশ্চয়ই এনামুল হক ওকে রানার মৃত্যু-সংবাদ দেবে—তারপর অবাক হয়ে শুনবে ভোর রাতে রানার ঢাকা ত্যাগের কথা। ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়ে চেপে যাবে হক সাহেব। কাজ বন্ধ করবে না করোনার। কদিন পর ঢাকায় ফিরে তৈরি গাড়ি পাবে রানা।