» » ভারতনাট্যম

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

ভারতনাট্যম

ছয়

৩০ আগস্ট, ১৯৬৫

গ্রীনরুম থেকে বেরিয়ে সোজা ডাকবাংলোর পথে হাঁটা ধরল মাসুদ রানা। রাত এগারোটা।

টেপ-রেকর্ডারের স্পুলগুলো না পেয়ে জয়দ্রথ মৈত্রের চেহারাটা কেমন হবে ভেবে খুশি হয়ে উঠল রানার মনটা। মোলায়েম, চাঁদের আলোয় রানার সুঠাম দীর্ঘ দেহের ছায়া পড়েছে রাস্তায়। লম্বা জনবিরল রাস্তাটায় থেকে থেকে শিউলির তীব্র সুবাস আসছে নাকে, পরিবেশে থমথমে একটা শূন্য মঞ্চের রোমাঞ্চ। কাছেই ডাকবাংলো, আর বেশি দূর নেই—এগিয়ে চলল রানা দৃঢ় পদক্ষেপে।

রানা ভাবছে, কথা তো দিয়ে এল, সাহায্য করবে মিত্রাকে… কিন্তু কিসের সাহায্য? কী বিপদ? কেমন সে চক্রান্ত? কতখানি ভয়ঙ্কর ওদের মরণ-ফাঁদ?

আজ রাত্রিটা রানার জীবনে এক চরম পরীক্ষার রাত। কিন্তু সিলেবাস বা প্রশ্নপত্র সম্পর্কে তার কোনও ধারণাই নেই! এমনকী কোন সাবজেক্টে পরীক্ষা সেটাও জানবার উপায় নেই। ও কী উত্তীর্ণ হতে পারবে? থাক, অত ভেবে আর কী হবে— ‘কে সারা সারা,’ যা হবার তা হবে।

একটা গাড়ি চলে গেল ওর পাশ দিয়ে ডাকবাংলোর দিকে।

রানার রিপোর্ট এবং সোহেলের স্যাম্পল এতক্ষণে পৌঁছে গেছে হেড অফিসে। রাহাত খানের কাঁচা-পাকা ভুরু জোড়া হঠাৎ মনে পড়ল রানার। অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব। কতদিন কত ভয়ঙ্কর কাজে রানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, পিঠে হাত রেখে শক্তি সাহস জুগিয়েছেন পিতার মত। কিন্তু তবু যেন কত দূরে। এক আধটা কথায় স্নেহ ঝরে পড়েছে রানার প্রতি, আশীর্বাদের মত, সিক্ত হয়েছে ও কৃতজ্ঞতায়; তেমনি আবার ওর সামান্য ভুলে তার কঠোর শাসনের চাবুক। ক্ষতবিক্ষত করেছে রানার মন। সত্যিই অদ্ভুত মানুষটা।

দোতলার ওপর নিজের ঘরে ঢুকেই রানা টের পেল, ওর অনুপস্থিতিতে এ ঘরে লোক ঢুকেছিল। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল ও ঘরের। পাশের ঘরে মিত্রার চুড়ির রিনিঠিনি শোনা যাচ্ছে। কী করছে মিত্রা?

পাশাপাশি দুই ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। ওদিক থেকে ছিটকিনি দেওয়া। দুপুরে রানা লক্ষ্য করেছিল দরজার ফুটোটা। ভাবল দেখি তো কী করছে মেয়েটা। ফুটোয় চোখ রেখে অবাক হয়ে গেল রানা। এক ইঞ্চি দূরে আরেকটা চোখ! মৃদু হেসে সরে এল ও। একই ফুটোয় চোখ রেখে মিত্রাও দেখতে চেষ্টা করছে ওঁর কার্যকলাপ!

বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নিল রানা… এই নিয়ে তিনবার হলো। তারপর একটা অ্যাশ কালারের ফুলহাতা প্লে-বয় শার্ট এবং নেভি ব্লু রঙের ফুল প্যান্ট পরে নিল। টেবিলে ঢেকে রাখা পরোটা মাংস খেয়ে নিয়ে বাক্স থেকে উইস্কির বোতল এবং গ্লাস বের করে বিছানার পাশে টিপয়ের ওপর রাখল। এবার বিছানায় বসে হোলস্টার থেকে ওর জীবনের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী ডাবল অ্যাকশন সেমি অটোমেটিক পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলটা বের করল। বেশি বড় ক্যালিবার পছন্দ করে না রানা। ও মনে করে বড় ক্যালিবারের ভারী বুলেটের চেয়ে প্রয়োজনের সময় হাতের টিপটাই বেশি কাজের। দ্রুত আটবার স্লাইড টেনে আটটা বুলেট বিছানায় ফেলল রানা। ইজেক্টার ক্লিপটা পরীক্ষা করল, কারণ ঠিকমত কাজ না করলে বিপদের সময়ে এ মারণাস্ত্র খেলনা হয়ে যাবে। ম্যাগাজিন রিলিজ বাটন টিপে খালি ম্যাগাজিন বের করে সাতটা গুলি ভরল ও তাতে। স্লাইড টেনে চেম্বারে বাকি গুলিটা ঢুকিয়ে দিয়ে আস্তে হ্যামারটা নামিয়ে রাখল। এবার ম্যাগাজিনটা যথাস্থানে ঢুকিয়ে দিতেই ক্লিক করে ক্যাচের সঙ্গে আটকে গেল সেটা। গুলি ভরা দুটো এক্সট্রা ম্যাগাজিন পকেটে ফেলে পিস্তলটা আবার হোলস্টারে ভরে রাখল ও সন্তুষ্টচিত্তে। উজ্জ্বল আলোটা নিভিয়ে বেড সুইচ টিপে তিন ওয়াটের নীল বাতি জ্বেলে দিল রানা। তারপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায় জুতো মোজা পরা অবস্থাতেই। এক ঘণ্টা পর নীল আলোটাও গেল নিভে।

চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। এক ফুট দূর থেকেও নিজের হাত দেখা যায় না। এত অন্ধকার যে চোখ না বুজেও ঘুমানো যায়। চুপচাপ অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে আছে রানা। প্রতীক্ষা করছে। বাইরে ঝিঁঝি পোকার কোরাস ভরাট করে রেখেছে যেন অন্ধকারকে। কই, কিছু তো ঘটছে না।

এই বিনিদ্র অপেক্ষার কি শেষ নেই? খুট করে একটা শব্দ হলো পাশের ঘরে। সজাগ হয়ে উঠল রানা। ঘটুক, যা হয় একটা কিছু ঘটুক। এভাবে অনির্দিষ্টকাল প্রতীক্ষা করা যায় না। কয়েকজন লোকের সাবধানী পায়ের শব্দ। চটাশ করে একটা চপেটাঘাতের আওয়াজ। মৃদুস্বরে দুই একটা কথাবার্তা। রানা বুঝল সময় উপস্থিত।

হঠাৎ তীব্র ঝটকা খেয়ে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে এল রানা। কী হলো? এমন জোরে ইলেকট্রিক শক লাগল কেন? বুকের ভেতর জোরে হার্ট-বিট হচ্ছে। পেন্সিল টর্চটা জ্বেলে দেখল লোহার খাটের পায়ার সঙ্গে দুটো তার জড়ানো। তার দুটোর অন্য মাথা চলে গেছে পাশের ঘরে। রানা আগে টের পায়নি এ তারের অস্তিত্ব। আলতো করে খাটটা ছুঁয়ে দেখল কারেন্ট নেই এখন।

ব্যাপার কী? তাকে কি ইলেকট্রিক শক দিয়ে মারবার ফন্দি এঁটেছিল এরা? তা হলে এখন আর কারেন্ট নেই কেন? নাকি একটা বিশেষ মুহূর্তে যেন শক খেয়ে ওর ঘুম ভেঙে যায়, তারই জন্য এই ব্যবস্থা? রানা ঘুমিয়ে থাকলে এই শক লেগে তার ঘুম ভেঙে যেত, কিন্তু কিছুতেই ও বুঝতে পারত না হঠাৎ মাঝরাতে এমন ঘুম ভেঙে গেল কেন। কিন্তু তার ঘুম ভাঙাতেই বা চাইবে কেন জয়দ্রথ মৈত্র।

কাঠের সিঁড়িতে কয়েকটা পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা। একটু পরেই একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার শব্দ পাওয়া গেল।

মিত্রাকে নিয়ে যাচ্ছে না তো লোকগুলো? কথাটা মনে আসতেই এক লাফে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল রানা। দেখল মিত্রার ঘরের কপাট খোলা। একটা জীপ গাড়ি ডাকবাংলো থেকে বেরিয়েই ডান দিকে মোড় ঘুরল। পিছনে জ্বলছে দুটো লাল ব্যাক লাইট।

ছুটে মিত্রার ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালল রানা। খাঁ খাঁ করছে খালি ঘর। তবে কি ও কথা রাখতে পারল না? কী মনে করবে মিত্রা? মনে করবে প্রাণভয়ে বিপদের সময় ঘর থেকে বেরোতে সাহস পায়নি ও।

তিনলাফে সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নেমে এল রানা। গাড়ি-বারান্দায় একটা লাল রঙের ওয়ান-ফিফটি হোণ্ডা মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে স্টার্ট দেয়া অবস্থায়। ডাবল একজস্ট পাইপ দিয়ে অল্প অল্প ধোয়া বেরোচ্ছে। নাম্বার প্লেটে বিদেশি নম্বর দেখে রানা বুঝল কোনও টুরিস্ট হবে। হ্যাণ্ডেলের সঙ্গে একটা ক্যানভাসব্যাগ আর ওয়াটার-বটল ঝোলানো। পেছনের ক্যারিয়ারে কিছু মালপত্র চামড়ার বেল্ট দিয়ে বাঁধা।

ফ্রস্টেড কাঁচের জানালা দিয়ে আবছা দেখল রানা একজন ফর্সা মত লম্বা লোক ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে। কাঁধে ঝোলানো, একটা ফ্লাস্ক। টুরিস্টই হবে।

একবার একটু দ্বিধা হলো রানার। কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কী? লাফিয়ে উঠে বসল ও মোটরসাইকেলের ওপর। হেড-লাইট অফ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল ডাকবাংলো থেকে। রাস্তায় পড়েই ডানদিকে মোড় নিল মোটরসাইকেল।

জীপ গাড়িটার কোনও চিহ্ন নেই। পাকা মসৃণ নির্জন রাস্তা দিয়ে ফুল স্পীডে এগিয়ে চলল রানা। উইণ্ডস্ক্রিন নেই। হু হু করে বাতাস লাগছে চোখে মুখে। বাতাসের বেগে দুই চোখের কোনা দিয়ে পানি বেরিয়ে কানের নীচ দিয়ে গিয়ে শার্টের কলার ভিজাচ্ছে।

হঠাৎ খটকা লাগল রানার মনে। সবগুলো ঘটনা অস্বাভাবিক নয়? ঠিক সময় মত ঘুম ভাঙাবার ব্যবস্থা, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, জীপ গাড়ি, চালু অবস্থায় রাখা হোণ্ডা মোটরসাইকেল। সব যেন সাজানো গোছানো ছিল রানার জন্যে! এমন তো হবার কথা নয়। ঠিক যেন মিল খাচ্ছে না। তা ছাড়া এত রাতে ম্যানেজারের তো কাউন্টারে থাকবারই কথা নয়! কার সঙ্গে কথা বলছিল টুরিস্ট? বুঝল রানা, ট্র্যাপে পা দিয়েছে সে। বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে।

দূরে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে জীপ গাড়ির লাল ব্যাকলাইট। স্পীড কমাল রানা।

রাজশাহী-নাটোর রোডে চলেছে ওরা।

এদিকে মিত্রার মনের মধ্যে চলছে তুমুল ঝড়।

জয়দ্রথ মৈত্রের ভয়ঙ্কর প্ল্যান শুনে চমকে উঠেছিল ও। বলেছিল, ‘আমাকে এভাবে ব্যবহার করবার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আমার মামাকে যদি বলি তখন আপনার কী অবস্থা হবে?’

হেসেছিল জয়দ্রথ। বলেছিল, ‘মামার ভয় আমাকে দেখিয়ো না, মিত্রা। তুমি ছেলেমানুষ, সব কথা বুঝবে না! আমার ক্ষমতা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই তোমার। আমার একটি মাত্র মুখের কথায় তোমার মামার মন্ত্রীত্বের পদ চিরতরে ঘুচে যেতে পারে। ও-ভয় আমাকে দেখিয়ো না। আমি যা বলছি তা-ই তোমাকে করতে হবে।’

‘আমি কি বেশ্যা?’ চোখের জল আর সামলাতে পারেনি অসহায় মিত্রা। রাগে, দুঃখে, অপমানে গলা বুজে এসেছিল ওর।

‘দেখো মিত্রা, দেশের প্রয়োজনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে নিতে হয়। মাসুদ রানা শত্রু, ওকে ধ্বংস করতে হবে; তাতে তোমার আপত্তি নেই। কিন্তু, এটা বুঝছ না কেন, পাকিস্তানে এসে আমরা যথেষ্ট করেছি, এরপরেও আবার নিজেরা খুন-খারাবির মধ্যে জড়িয়ে পড়লে আমাদের এতদিনকার মাস্টার প্ল্যান একদম ফেঁসে যাবে। আমরা ওসব কাজে হাত দেব না। কাঁটা দিয়ে কাটা তুলব। ইয়াং টাইগারস-এর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, মিত্রা সেনকে আমরা তাদের হাতে তুলে দেব—বিনিময়ে তারা মাসুদ রানাকে সরিয়ে দেবে এ পৃথিবী থেকে। এ কাজে যদি কোনও হাঙ্গামা হয়, টাকার জোরে সব সামলে নেবে ওরা, আমাদের মাথা ঘামাতে হবে না।’

একদিকের ঘা ভিজিয়ে নিয়ে আবার আরম্ভ করেছিল জয়দ্রথ মৈত্র, অনেক ভেবে এই প্ল্যান এঁটেছি আমি। তোমাকে ছেড়ে আমরা চলে যাচ্ছি ভারতে। তোমার প্রতি ইয়াং টাইগারদের আসক্তি অল্পদিনেই ফুরিয়ে যাবে। তারপর ওরা তোমাকে ব্যবহার করবে বড় বড় ব্যবসা ধরবার টোপ হিসেবে। অনেক বড় বড় অফিসার ওরা নিয়ে আসবে তোমার কাছে। তুমি তাদের আনন্দ দান করবে, বিনিময়ে তথ্য সগ্রহ করবে যা আমাদের প্রয়োজন। ঢাকায় আমাদের লোক তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখবে।’

শিউরে উঠেছিল মিত্রা।

‘আর, একটা কথা ভালমত জেনে রাখো। যদি বিশ্বাসঘাতকতা করো, নির্মম মৃত্যু ঘটবে তোমার। এখন থেকে তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কার্যকলাপ আমরা লক্ষ্য করব।’

‘আপনার পায়ে পড়ি, মৈত্র মশাই, আমাকে রেহাই দিন।’ সত্যিই পা ধরতে গিয়েছিল মিত্রা।

‘আমি দুঃখিত, সরে গিয়েছিল জয়দ্রথ। তুমি এখন যেতে পারো।’

‘আর আপনার প্ল্যান অনুযায়ী মাসুদ রানা যদি আমাকে রক্ষার জন্যে এগিয়ে না আসে? তা হলে? আমাকে ভাসিয়ে দিলেন, ওকেও হত্যা করতে পারলেন না।’

‘আসতেই হবে তাকে। ও যে ধাতুতে গড়া—কোনও নারীর অবমাননা সহ্য করবে না। সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেই। সে সব তোমার ভাবতে হবে না, নিখুঁত জাল পেতেছি আমি—শিকার তাতে পড়বেই।’ হেসে চলে গিয়েছিল জয়দ্রথ পাশের ঘরে।

এতখানি অসহায় অবস্থা মিত্রার জীবনে আর কখনও আসেনি। একী চক্রান্তে জড়িয়ে পড়ল সে? ভয়ানক রাগ হলো মাসুদ রানার ওপর। ওই… ওই শয়তানটার জন্যই আজ ওর এই অবস্থা। ওকে যদি খুন করতে না চাইত জয়দ্ৰথ, তবে তো মিত্রাকে ইয়াং টাইগারস-এর হাতে তুলে দেবার প্রশ্নই উঠত না। আবার ভাবল, বেচারা রানা জানবে কী করে যে ওকে হত্যা করার বিনিময়ে মিত্রাকে তুলে দিচ্ছে জয়দ্রথ একদল বদমাইশের হাতে। জয়দ্ৰথই আসলে পাপিষ্ঠ, নীচ, নরাধম। তারপর আবার ভাবল, জয়দ্রথ তো নিজের স্বার্থে কিছু করছে না, দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এঁটেছে এই ভয়ানক ষড়যন্ত্র। এ না করলে তো জয়দ্রথ কর্তব্যচ্যুত হত।

তবে? তবে দোষ কার? মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে যায় মিত্রার। দোষ মিত্রার ভাগ্যের। দোষ ওর রূপের, ওর যৌবনের। ও আত্মহত্যা করবে। আর তো কোনও পথ খোলা রইল না ওর জন্য!

হঠাৎ বিদ্রোহ করে বসল মন। কেন? কেন সে ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর খেলাকে নীরবে সহ্য করবে? এ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসবার কি কোনও পথই নেই? নিজেকে রক্ষা করবার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ও বাঁচতে চায়। বাঁচতে কে না চায়। দেশ, দলপতি, চক্রান্ত সব চুলোয় যাক। ও নিজেকে রক্ষা করবে। কিন্তু কী করে? এই বিদেশে কে আছে ওর আপনজন যে এগিয়ে এসে সাহায্য করবে? মাসুদ রানা?

অনেক ভেবে ও স্থির করেছিল সমস্ত চক্রান্তের কথা খুলে বলবে রানাকে। কিন্তু সুযোগ পেল কোথায়? চোখের ইঙ্গিতে ডেকে এনে গ্রীনরূমে যে দু’একটা কথা হলো, তাতে রানার কাছে কিছুই তো পরিষ্কার হলো না। কোনও কথা খুলে বলা হলো না, এসে পড়ল জয়দ্রথ মৈত্র। কী ধরনের বিপদ ওর জন্য অপেক্ষা করছে সে-সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই রানার। দলপতির বদ্ধমূল ধারণা, রানা যে চরিত্রের মানুষ কেউ বিপদে পড়লে সে ঝাঁপিয়ে পড়বেই। এবং তা হলেই নিশ্চিত মৃত্যু। আজ সাবধান করে দেয়ার ফলে সে যদি মিত্রার সাহায্য প্রার্থনাকে ফাঁদে ফেলবার জন্য মিথ্যা অভিনয় মনে করে? যদি এগিয়ে না আসে, তা হলে? তা হলে মিত্রার নিশ্চিত মৃত্যু। ও যদি আত্মহত্যা না-ও করে, জয়দ্রথ হত্যা করবে ওকে।

মাথাটা খারাপ হয়ে যাবি নাকি মিত্রার? রানা তো কথা দিয়েছেই। নিষ্ঠুর চেহারার লোক হলে কী হবে—নিশ্চয়ই সে তার কথা রাখবে। আশ্বাস খোঁজে মিত্রা এসব ভেবে।

উপায় নেই। তার খাটের তলায় ঘাপটি মেরে বসে আছে একজন। টেপ রেকর্ডারের স্পুল পুকুরে ফেলে দেয়ায় মিত্রার ওপর সন্দেহ হয়েছে জয়দ্রথ মৈত্রের—সে আর কোনও সুযোগ দেবে না মিত্রাকে। অথচ ওই টেপ-রেকর্ডারের কথা মিত্রার জানাই ছিল না। ভাগ্যিস, রানা ওগুলো ফেলে দিয়েছিল—নইলে ওর বিশ্বাসঘাতকতার কথা আর গোপন থাকত না হিংস্র জয়দ্রথের কাছে। কিন্তু বুঝল কী করে মানুষটা!

এমন সময় ঘরে এসে ঢুকল পাঁচজন ইয়াং টাইগার। একজন টর্চ ধরল মিত্রার দিকে, আর একজন তুলে নিল ওকে বিছানা থেকে পাঁজাকোলা করে। বাঁ হাতটা তার বেঁকে এসে মিত্রার স্তনের ওপর পড়ল। মুখে অশ্লীল হাসি। চুম্বন করবার জন্যে মুখ নামাচ্ছিল লোকটা—ঠাঁই করে এক চড় দিল মিত্রা তার গালে। বাঁ হাতটা যথাস্থানেই থাকল, কিন্তু পুনর্বার চুম্বনের চেষ্টা করল না লোকটা। দলের অন্যান্যদের কী একটা ইঙ্গিত করে বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে বাইরে। গাড়িতে এনে তোলা হলো মিত্রাকে। মিত্রা চেয়ে দেখল মোটরসাইকেলটা যথাস্থানেই আছে।

ছেড়ে দিল গাড়ি। মিত্রা এখন ওদের। যে যেখানে খুশি ওর দেহের ওপর হাত রাখছে অবাধে। অশ্লীল সব কথাবার্তা এবং রসিকতা চলেছে পরস্পরের মধ্যে।

চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল মিত্রার।

রানা কি কথা রাখবে? ও কি আসবে এই পিশাচদের হাত থেকে ওকে উদ্ধার করতে? কতদূর চলে এসেছে ওরা? রানা কি খোঁজ পাবে ওদের তাঁবুর? যদি দেরী হয়ে যায়? যদি সর্বনাশ ঘটে যায় রানা পৌঁছবার আগেই? শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল মিত্রা।

চোখ খুলেই দেখতে পেল মিত্রা বহুদূরে আবছা মত কী একটা আসছে গাড়ির পিছন পিছন। মাসুদ রানা! আসছে সে! হঠাৎ কেন জানি অদ্ভুত মায়া লাগল তার ওই দুঃসাহসী লোকটার জন্যে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল মিত্রা শত্রুপক্ষের ওই দুর্দান্ত লোকটির জন্য। ইশ, কেন সে এই নিশ্চিত মৃত্যুর পথে টেনে আনল এমন একটা মানুষকে? যদি এখনও ওকে ফিরিয়ে দেয়ার উপায় থাকত কোনও। কিছু বুঝবার আগেই শেষ করে দেয়া হবে যে ওকে।

ইয়াং টাইগাররাও দেখল রানাকে। কিছু কথা হলো ওদের নিজেদের মধ্যে এক বিচিত্র ভাষায়। মিত্রা তার একবর্ণও বুঝল না।

বাম দিকের একটা সরু রাস্তায় ঢুকল এবার জীপ। কিছুদূর গিয়েই থামল জীপটা একবার। একটা বেরেটা অটোমেটিক সাব-মেশিনগান হাতে নেমে গেল একজন। মাইল খানেক গিয়ে হাতের ডাইনে মাঠের মধ্যে আলো দেখা গেল। পাশাপাশি তিনটে তাঁবু খাটানো। জীপ এসে থামল একটা তাঁবুর সামনে।

সাঙ্কেতিক কিচির-মিচির ভাষায় একমিনিট কথাবার্তা বলল ওরা। তারপর লটারি করল নিজেদের মধ্যে। চারজন রিভলভার হাতে ছড়িয়ে পড়ল তাবুর চারদিকের অন্ধকারে। আর লটারি বিজয়ী ধরল মিত্রা সেনের হাত।

‘হাত ছাড়ো!’ নখ-দাঁত ব্যবহার করে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল মিত্রা সেন।

‘ছোড় দেঙ্গে? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হা!’ আরও শক্ত হলো মুঠো।

এমনি সময় দূর থেকে দশ-বারো সেকেণ্ড মেশিনগানের একটানা বিশ্রী শব্দ ভেসে এল। এদিক-ওদিক প্রতিধ্বনি উঠল তার। কান পেতে শুনল সে শব্দ ওরা দুজন। দপ করে সব আশা ভরসা নিভে গেল মিত্রার। বুকের ভিতরটা দুর-দুর করে উঠল অজানা-এক আশঙ্কায়। হাত-পা অবশ হয়ে এল।

কুকুরের জিভ দিয়ে ঘাম ফেলার মত হ্যাঃ হ্যাঃ করে হাসল বিজয়ী। তারপর প্রায় ছেঁচড়ে টান দিয়ে মিত্রাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভিতর।

পরিপাটি করে খাঁটিয়ার ওপর বিছানা পাতা। ছোট একটা টেবিলের ওপর হ্যাঁজাক জ্বলছে। আর কোনও আসবাব নেই তাবুর মধ্যে। সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে বিছানায় এনে ফেলল সে মিত্রাকে। ধাক্কা দিয়েও সূরাতে পারল না ওকে মিত্রা। একটা ভেজা উত্তপ্ত ঠোঁট ঘৃণিত চুম্বন করল ওর ঠোঁটে। উত্তেজিত গরম নিঃশ্বাস পড়ছে ওর নাক-মুখে।

হঠাৎ লোকটা দাঁড়িয়ে উঠে কাপড় ছাড়তে আরম্ভ করল। এক হাতে ধরে থাকল মিত্রার হাত। উঠে আসতে চেষ্টা করলেই ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানার ওপর।

‘কিউ বেকার ল্যড়তি হো, পেয়ারী?’

নগ্ন লালসা ওর দৃষ্টিতে। অন্ধ কামোত্তেজনায় ফ্যাকাসে মুখের চেহারা। নাকটা ফুলে গেছে একটু। কাপড় ছাড়া দেখে ভয়ে ঘৃণায় চোখ বন্ধ করল মিত্রা। বিছানায় উঠে এল লোকটা। ঘৃণিত চুম্বন করল দ্বিতীয়বার।

হাতটা একটু আলগা পেয়ে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল মিত্রা। কিন্তু চট করে আঁচল ধরে ফেলল লোকটা। এক পাক ঘুরে থমকে দাঁড়িয়েই চোখ পড়ল মিত্রার একটা দীর্ঘ মূর্তির ওপর। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে ভরসা হচ্ছে না ওর।

তাঁবুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাসুদ রানা!