» » ভারতনাট্যম

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

ভারতনাট্যম

এক

৩০ আগস্ট, ১৯৬৫।

‘এবারে কথক নৃত্য পরিবেশন করছেন শ্রীমতী মিত্রা সেন।’

ঘোষকের মিষ্টি গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গেই গিজগিজে ঠাসা প্রকাণ্ড হলঘরের প্রচণ্ড কোলাহল মৃদু গুঞ্জনে পরিণত হলো। হল কাঁপিয়ে বেজে উঠল তবলার তেহাই।

তিক ধা ধিগি ধিগি থেই। তিক ধা ধিগি ধিগি থেই।

তিক ধা ধিগি ধিগি।

ধা ধিন ধিন ধা। ধা ধিন ধিন ধা। না তিন তিন না।

তেটে ধিন ধিন ধা।…

একটা একটা করে সব বাতি নিভে গেল হলের মধ্যকার। স্তব্ধ প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠল দর্শকবৃন্দ। নিশ্চুপ হয়ে গেল মস্ত হলঘরটা।

কালো স্ক্রিন সরে যেতেই প্রথমে লাল, পরে হালকা নীল আলো ঝিলমিল করতে থাকল ঢেউ খেলানো সিল্কের সাদা পর্দার উপর। তারপর সে পর্দাও দু’ফাঁক হয়ে সরে গেল ধীরে ধীরে। দেখা গেল নমস্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশনের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ, অতুলনীয়া সুন্দরী নর্তকী শ্রীমতী মিত্রা সেন। স্পট লাইটের স্বপ্নিল আলো একটা মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে মিত্রা সেনকে ঘিরে। উদ্ভিন্ন যৌবনা, ক্ষীণ কটি, কাজল-কালো হরিণ চোখ। এক শ্রেণীর দর্শকদের মধ্য থেকে একটা আধা-অশ্লীল উল্লাস ধ্বনি উঠেই মিলিয়ে গেল।

তা তে থেই তাত। আ তে থেই তাত। থেই আ থেই আ থেই।

থেই থেই তাত তাত থা। তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা আ।

তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা আ। তেরে কেটে গদি ঘেনে।

ধা ধিন ধিন ধা। ধা ধিন ধিন ধানা তিন তিন না।

তেটে ধিন ধিন ধা।…

আরম্ভ হলো নাচ। শতকরা নব্বই জন দর্শকই সেই মুহূর্তে মনে মনে স্থির করল, যে করে হোক আগামী দিনের টিকেট জোগাড় করতে হবে–ব্ল্যাকে দশগুণ দাম দিয়ে হলেও।

হলঘরের অসহ্য ভ্যাপসা গরমে ফটোগ্রাফারের জন্যে নির্দিষ্ট আসনে বসে ঘামছে মাসুদ রানা। আর মনে মনে পিণ্ডি চটকাচ্ছে ঢাকায় এয়ারকণ্ডিশণ্ড-রুমে সুখে নিদ্রামগ্ন পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল রাহাত খানের। যত সব রদ্দি পচা কাজের ভার বুড়ো বেছে বেছে ওর কাঁধে চাপায়। কেন? আর লোক নেই? ইণ্ডিয়ার নাম শুনলেই একেবারে যেন বাই চড়ে যায় বুড়োর মাথায়। ডন কুইকজোটের মত খেপে গিয়ে হাওয়ায় তলোয়ার ঘোরাতে আরম্ভ করে দেয় একেবারে।

আরে বাবা, একদল ন্যাকা মেয়েছেলে আর তাদের সঙ্গে মেয়েলী স্বভাবের মিনমিনে কতকগুলো ননীর পুতুল পুরুষ এসেছে কলকাতা থেকে গায়ক-গায়িকা নর্তক-নর্তকী সেজে। এদের মধ্যে তাকে ঢোকাল বুড়ো কোন আক্কেলে? তাও যদি জার্নালিস্ট বা অন্য কোনও পরিচয় হত তো এক কথা। তা নয়। তার কাজ কী?–না ফটোগ্রাফি। এখন যে গরম লাগছে, তার কী হবে? পচা গরমে ঘামতে ঘামতে হঠাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল রানার। সব রাগ গিয়ে পড়ল রাহাত খানের উপর। দু’মিনিটের চেষ্টায় অনেক কষ্টে জোর করে দূর করে দিল রানা মন থেকে সব বিক্ষোভ।

ভাদ্রের প্রায় মাঝামাঝি। শরৎকাল। কিন্তু এবারের শরৎ যেন গুমোট ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। প্রিয়ার আঁখির মত নীল আকাশ, পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘের অক্লেশে হাওয়ায় ভেসে যাওয়া, মাঝে মাঝে উত্তর থেকে অনেক স্মৃতি জাগিয়ে তোলা নীলুয়া বাতাস, সন্ধ্যেবেলায় পুজোর ঘণ্টা, শিউলির জমাট সুগন্ধ, আমেজ–সবই আছে। কিন্তু গরমটা যেন চেপে বসেছে গদির উপর; নড়বে না কিছুতেই।

তার উপর সিগারেটের ধোঁয়া আর এতগুলো লোকের আড়াই ঘণ্টা ধরে অবিরাম শ্বাস-প্রশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে রাজশাহী টাউন হলের বদ্ধ বাতাস। কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়? চোখ দুটো অল্প অল্প জ্বালা করছে রানার। সম্মোহিত দর্শকবৃন্দের দিকে একবার নির্লিপ্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে নিজেও একটা সিগারেট ধরাল।

রানার বাঁ কাঁধে ঝুলছে ব্রাউন হবি EL 300 ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাশ গান এবং বিভিন্ন ফোকাল লেংথের নিকর লেন্স, ফিল্টার, এক্সট্রা লেন্স-হুড, কেবল-রিলিজ, একটা মোটর ড্রাইভ এবং অন্যান্য হাবিজাবিতে ভর্তি একখানা গ্যাজেট ব্যাগ; আর ডান কাঁধে টু-পয়েন্ট এইট লেন্সের একটা রোলিফ্লেকস ক্যামেরা। গলায় ঝুলছে একখানা বিখ্যাত নাইকন-এফ ক্যামেরা। লেন্স-হুডটা লাগানোই ছিল তাতে। দ্রুত ফোকাস করবার জন্যে স্পিট ইমেজ রেঞ্জ ফাইণ্ডার স্ক্রিন ব্যবহার করছে ও আজ।

পাকা ফটোগ্রাফারের বেশে নিজেকে কেমন বিদঘুঁটে দেখাচ্ছে কল্পনা করে মুচকি হাসল রানা। তারপর ফ্ল্যাশ-গানটা ধীরে-সুস্থে ক্যামেরার উপর লাগিয়ে নিল। আড়চোখে একবার চেয়ে দেখল, সেই ছয়জন ইয়াং টাইগারস-এর মধ্যখানে বসে আছে সাংস্কৃতিক মিশনের দলপতি জয়দ্রথ মৈত্র। স্টেজের দিকে ওদের কারও চোখ নেই—চাপা গলায় কী যেন আলাপ করছে নিজেদের মধ্যে। নাইকন-এফ ক্যামেরায় অ্যাপারচার এফ এইট দিয়ে ডিসট্যান্স বিশ ফুটে সেট করে নিল রানা। এতে ডেপথ অভ ফোকাস ৯ ফুট থেকে ইনফিনিটি পাওয়া যাবে। আধ-খাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পিষে ফেলল ও জুতো দিয়ে। জমে উঠেছে নাচ।

ধিক তেই ধিগি তেই। ধিক তেই ধিগি তেই। ধিগি ধিগি থেই।

ধিগি ধিগি ধিক থেই। ধিগি ধিগি থেই। তা থেই তা থেই।

থেই তা থা। থেই তা থা। থেই তা। ধিক তেই ধিগি তেই।

ধিক তেই ধিগি তেই। ধিগি ধিগি থেই। ধিগি ধিগি ধিক থেই।

ধিগি ধিগি থেই। তা থেই তা থেই। থেই তা থা। থেই তা থা।

থেই তা।

ধা ধিন ধিন ধা। ধা ধিন ধিন ধা। না তিন তিন না।

তেটে ধিন ধিন ধা…

এবার এগিয়ে গেল রানা দর্শকদের বিরক্তি উৎপাদন করে স্টেজের মাঝ বরাবর। তারপর হঠাৎ ঘুরে, যেন দর্শকদের ছবি তুলছে এমনি ভাবে সেই ছোট্ট দলটির ছবি তুলে নিল। অপ্রস্তুত দলটি ফ্ল্যাশ লাইটের হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর জয়দ্রথ ছাড়া বাকি সবার হাত দ্রুত উঠে এসে নিজ নিজ চেহারা আড়াল করার চেষ্টা করল। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। মৃদু হাসল রানা।

এক, দুই করে নয় সেকেণ্ড পার হলো। জ্বলে উঠল ফ্ল্যাশ গানের পিছনে লাল বাতি। রি-চার্জিং সাইকল কমপ্লিট হয়েছে। এবার আরও কয়েকটি ছবি তুলল সে মিত্রা সেনের বিশেষ বিশেষ নৃত্য ভঙ্গিমার, বিভিন্ন দূরত্ব থেকে বিভিন্ন অ্যাপারচার দিয়ে। মাথার মধ্যে দ্রুত চিন্তা চলছে রানার। ঢাকার কুখ্যাত ইয়াং টাইগারস পিছু ছাড়েনি তা হলে! কিন্তু এদের সঙ্গে কলকাতার সাংস্কৃতিক মিশনের দলপতির এই দহরম-মহরম কেন? কুষ্টিয়ায় মিত্রা সেনকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল যারা, যাদের হাত থেকে রানা রক্ষা করেছিল মিত্রাকে কিন্তু প্রতিদানে পেয়েছিল কুৎসিত ব্যবহার, সব জেনে শুনেও তাদের সঙ্গে জয়দ্রথ মৈত্রের এই মৈত্রী কিসের? ঈশ্বরদী জংশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমেই প্রথম রানার চোখে পড়ে এদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছে জয়দ্রথ মৈত্র। কী মতলব আঁটছে সে এদের সঙ্গে? রাজশাহীতে পৌঁছে ডাকবাংলোতে মিত্রা সেনের ব্যবহারই বা এমন হঠাৎ পাল্টে গেল কেন? ঠিক তার পাশের ঘরটা বুক করল মিত্রা—দলপতি তাতে আপত্তি করল না। ট্রেনে তা হলে গুলিবর্ষণ করল কে? তা ছাড়া আজ সারাদিন মনে হচ্ছিল মিত্রা যেন কিছু বলতে চায় তাকে, কিন্তু বলি বলি করেও সুযোগ করে উঠতে পারছে না। কী সে কথা? নিশ্চয়ই কোনও ট্র্যাপ পেতেছে ওরা। সামনে বিপদের গন্ধ পেল রানা।

হঠাৎ রানার মনে হলো মিত্রা যেন তার দিকে চেয়ে আবছা একটা ইঙ্গিত করল। আশ্চর্য হয়ে গেল রানা। শেষবারের মত ক্লিক করে শাটার টিপে দিল সে। এক ঝলক তীব্র আলো ছুটে গিয়ে আলিঙ্গন করল মিত্রা সেনকে। শাটারের উপর আঙুলের চাপ পড়তেই এক মুহূর্তের জন্যে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল ভিউ ফাইণ্ডার। পরমুহূর্তেই ইনস্ট্যান্ট রিটার্ন মিরর যথাস্থানে ফিরে গিয়ে ভেসে উঠল আবার মিত্রার ছবি। নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়ল রানা। একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরাল। আগাগোড়া সবটা ব্যাপার ভেবে দেখা দরকার। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিল সে।

…ক্ৰেধা আধা তেটে তেটে। কৎ তেটে ক্ৰেধা তেটে। ক্ৰেধা তেটে ধা।

ক্ৰেধা তেটে ধা। ক্রেধা তেটে। ক্রেধা আধা তেটে তেটে।

কৎ তেটে ক্ৰেধা তেটে। ক্রে তেটে ধা।

ক্ৰেধা তেটে।

ধা ধিন ধিন ধা। ধা ধিন ধিন ধা। না তিন তিন না।

তেটে ধিন ধিন ধা।…

মুখে চক্রধর বোল বলছে তবল্‌চি। মিত্রা সেন এবার নাচের মুদ্রায় সে ছন্দকে মূর্ত করে তুলবে। চতুর্গুণ বেড়ে গেছে লয়। অত্যন্ত দ্রুত লয়ে চলছে নাচ।

হঠাৎ মনে হলো যেন মিত্রার পা আর মাটিতে নেই—সারাটা স্টেজময় যেন সে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। মুগ্ধ, চমৎকৃত দর্শকবৃন্দের করতালিতে হলের ছাদ উড়ে যাবার উপক্রম। রানাও অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল–প্রশংসা না করে পারল না মনে মনে। সত্যিকার শিল্প দেশ-জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে।

হাততালি থেমে যেতেই হলের মাঝামাঝি জায়গায় বসে এক ফাজিল ছোকরা ‘ম্যা…এ্যাঁ…’ করে জোরে ছাগলের ডাক ডেকে উঠল। চাপা হাসির গুঞ্জন উঠল। দু’একটা ধমক-ধামকের আওয়াজও এল।

নাইকন-এফ-এর লেন্সটা খুলে ফেলল রানা। খুলে ২০০ মি.মি. আঁটো নিকর এফ ২.৫ টেলিফটো লেন্সটা লাগিয়ে নিল। বেয়োনেট মাউন্টের উপর ক্লিক করে বসে গেল লেন্স। এবার ক্যামেরাটা চোখে তুলে ফোকাস অ্যাডযাস্ট করতে চেষ্টা করল সে। টেলিফটো লেন্সের ছোট অ্যাঙ্গেলের মধ্যে মিত্রা সেনকে ধরতে কয়েক সেকেণ্ড লেগে গেল। নাইকন-এর উজ্জ্বল ভিউ-ফাইণ্ডারে পর্দায় পৃথিবীর অদ্বিতীয় নিকর লেন্সের মাধ্যমে পরিষ্কার ভেসে উঠল এবার মিত্রার সুন্দর মুখচ্ছবি। প্রতিটি রেখা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রানা। উপলব্ধি করল ও, এ মুখটাও পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। কপালে চাঁদির টিপ আলো পড়ে মাঝে মাঝে ঝিক করে উঠছে, দু’চোখে টেনে কাজল পরা, সুপুষ্ট লোভনীয় অধর লিপস্টিকে লাল।

সোজা তার দিকে চেয়ে আবার ইঙ্গিত করল মেয়েটি। না, চোখের ভুল নয়। দূর হলো রানার সন্দেহ।

প্রবল করতালি এবং শেয়ালের ডাকের মধ্যে নাচ শেষ হলো। কালো পর্দাটা ধীরে ধীরে নেমে এসে আড়াল করল মিত্রাকে হাজার দুয়েক লুব্ধ চোখের দৃষ্টি থেকে।

সবাই একসঙ্গে বেরোতে চাইছে হল থেকে। গেটের কাছে দারুণ ভিড় ঠেলে রানা এগোল গ্রীনরুমের দিকে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ হাত ঢোকালো রানার প্যান্টের পকেটে। ধরতে পারল না রানা হাতটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল একটা লোমশ হাত সরে গেল পিছনের ভিড়ে।

পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট্ট কাগজ পেল রানা। ভাবল, বার্তা হবে কিছু।

চারকোণা ছোট কাগজের উপর ইংরেজিতে টাইপ করা:

BEWARE GENTLEMAN, DANGER AHEAD!

প্রথমেই রানা ভাবল, টাইপ করা যখন, এটা তাকে দেবে বলে কেউ আগে থেকেই মনস্থ করে এসেছে, হঠাৎ করে তার মাথায় আসেনি এই সাবধান বাণী—অর্থাৎ, পূর্ব পরিকিল্পিত। কিন্তু কে তাকে সাবধান করতে চায়, শত্ৰু না মিত্র? এবং কেন? কিসের বিপদ সামনে? ঘাই হরিণীর মত কি মিত্রা ডাকছে তাকে মৃত্যুর পথে? নাকি কেউ ভয় দেখিয়ে দূরে সরাতে চাইছে ওকে?

দুই হাত মাথার উপর তুলে চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ল রানা—যেন ওর উপরে যে বা যারা লক্ষ্য রাখছে, তারা স্পষ্ট দেখতে পায় ওর কার্যকলাপ। তারপর উপর দিকে টুকরোগুলো ছুঁড়ে ফুঁ দিয়ে ছিটিয়ে দিল চারদিকে। আশপাশে সবার মাথায় ঝরে পড়ল সেগুলো পুষ্পবৃষ্টির মত।

ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে স্টেজের পিছন দিকে চলে এল রানা। গেটের কাছে দাঁড়ানো নীল ব্যাজ বুকে আঁটা ভলান্টিয়ার রানাকে দেখে পথ ছেড়ে দিল। ভিতরে ঢুকে এদিক-ওদিক চাইতেই একটা ছোট ঘরের আধ-ভেজানো দরজা দিয়ে মিত্রা সেনকে দেখতে পেল রানা। দ্রুত কাপড় ছাড়ছে সে। স্টেজের পিছনে। অনাদর অবহেলায় পড়ে থাকা গোটা কতক ক্যানভাসের উইং, এলোমেলো করে ফেলে রাখা কয়েকটা বাঁশ আর কিছু নারকেলের রশি টপকে ড্রেসিংরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা।

‘ভেতরে আসুন!’ মিত্রার চাপা কণ্ঠস্বর।

ঢুকতে গিয়ে আবার পিছিয়ে এল রানা। মিত্রার পরনে ব্রেসিয়ার এবং পেটিকোট ছাড়া কিছু নেই। এতক্ষণ একটানা নাচের পর হাঁপাচ্ছে সে। সেই সঙ্গে ওঠা-নামা করছে বুকের সঙ্গে ঘামে সেঁটে থাকা একখানা দামি লকেট। সারা শরীরে স্বেদ বিন্দু। নাচের ঝলমলে পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে একটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা। আয়না-ভাঙা ড্রেসিং টেবিলটা ষোড়শ শতাব্দী মডেলের।

রানা ভাবল: থারটি-সিক্স-টোয়েন্টি-টু-থারটি-সিক্স! আইডিয়াল!

চঞ্চল হয়ে ওঠা মনটাকে সংযত করল রানা।

‘কই, দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন।’

এবার রানার টনক নড়ল। সেটির চাপা খসখসে অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে ধৈর্যচ্যুতির আভাস পাওয়া গেল। এ যেন অনুরোধ নয়, আদেশ। ঢুকে পড়ল রানা ঘরের ভিতর।

‘ছিটকিনি লাগিয়ে দিন দরজার। লজ্জা করার সময় এটা নয়। জরুরি কথা আছে। দোহাই আপনার, বোকার মত দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি করুন—সময় নেই মোটেও। এক্ষুণি ওরা সব এসে পড়বে।’

মেয়েটির কণ্ঠস্বরে এমন একটা উত্তেজিত জরুরি ভাব প্রকাশ পেল যে প্রায় চমকে উঠল মাসুদ রানা। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল তার। অদ্ভুত কিছু শুনবার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করে নিল ও একমুহূর্তে।

নড়বড়ে বল্টুটা লাগানো না লাগানো সমান কথা। তবু সেটা লাগিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রানা। স্থির দৃষ্টিতে আপাদমস্তক একবার দেখল মিত্রাকে। ভাবল, হঠাৎ আজ এই মুহূর্তে নিজের দলটা ‘ওরা’ হয়ে গেল কেন এই মেয়েটির কাছে? কুষ্টিয়ার অনুষ্ঠানে তার প্রতি স্পষ্ট ঘৃণা দেখতে পেয়েছে রানা মিত্রার চোখে। আজ সে-ই আপন লোক হয়ে গেল, অন্যেরা পর—কেমন করে হয়! এর মধ্যে গোলমাল আছে কিছু। সাধু, সাবধান!

রানার স্থির দৃষ্টির সামনে এবার একটু লজ্জা পেল মিত্রা সেন।

চট করে ঘুরে ব্লাউজ টেনে নিয়ে একটা হাত ঢুকিয়ে দিল। মুখে বলল, ‘আপনাকে এখানে ঢুকতে দেখেছে কেউ?’

‘বোধহয় না,’ উত্তর দিল রানা নিরাসক্ত কণ্ঠে।

কুঁচি দেয়া পেটিকোটে ঢাকা একখানা চমৎকার সুডৌল নিতম্বের উপর চোখ পড়ল রানার মিত্রা ঘুরে দাঁড়াতেই। এঁটে বাঁধা ব্রেসিয়ারের ফিতেগুলো পিঠের নরম-মাংসের উপর চেপে বসে আছে।

মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে গ্যাজেট ব্যাগ আর ফ্ল্যাশ গানটা নামিয়ে রাখল রানা একটা চেয়ারের উপর। বলল, কুষ্টিয়ার সেই গুণ্ডাদের নিন্দে করে লাভ কী, দোষ তো তাদের নয়, দোষ আপনার। আমার মাথাটাও আজ খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে, মিস মিত্রা। পৃথিবীর সব রূপ…’

‘চুপ করুন, আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করবার জন্যে আপনাকে ডাকিনি। আপনার, আমার দুজনের সামনেই ভয়ানক বিপদ এখন।’

মিত্রাকে শাড়ি পরে নেবার সুযোগ দিয়ে গ্রীনরুমের পিছন দিকের খোলা জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ঠাণ্ডা এক ঝলক মুক্ত বাতাস এল জানালা দিয়ে। বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করল সে। তারপর চামড়া মোড়া দামি সিগারেট কেস থেকে একটা সিনিয়র সার্ভিস বের করে অগ্নি সংযোগ করল। বাইরে প্রায় জানালার সঙ্গে লাগানো একটা কচুরিপানা ভর্তি পুকুর। কানায় কানায় টইটম্বুর। মোলায়েম জ্যোৎস্নায় পুকুর পাড়ের নারকেল গাছ দুটোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দেখতে। রানা ভাবল, ‘সুন্দর’ আর ‘বিপদ’ এই দুটো জিনিসে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ জিনিস যা সুন্দর, রানা দেখেছে তার আশপাশেই ওত পেতে থাকে বিপদ। মিত্রার চারপাশে বিপদ ঘনিয়ে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

পাশে এসে দাঁড়াল মিত্রা।

‘একটা ভয়ঙ্কর চক্রান্তের জাল পাতা হয়েছে আপনার জন্যে, মি…’

‘আমি নগণ্য এক ফটোগ্রাফার—তরিকুল ইসলাম। আমাকে আপনি এসব কী ভয়ঙ্কর কথা শোনাচ্ছেন?’ সত্যি সত্যিই বিস্মিত হবার ভান করল রানা।

বাজে কথায় সময় নষ্ট করবেন না, মি. মাসুদ রানা। মিত্রার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট তিরস্কার। সেই প্রথম দিন থেকেই আমি কেন, সাংস্কৃতিক মিশনের প্রত্যেকটি লোকই জানে আপনার আসল নাম, আসল পরিচয়। হাতে সময় নেই, এক্ষুণি ওরা এসে পড়বে, দয়া করে আমার কথাগুলো বলতে দিন। কপাল থেকে একগুচ্ছ অবাধ্য চুল নিয়ে গুঁজে দিল মিত্রা কানের পাশে। তারপর আবার বলল, ‘আজ রাতে আপনাকে হত্যা করা হবে, মি. রানা!’

মিত্রার মুখে নিজের নাম শুনে অবাক হলো না রানা। মনে মনে ভাবল, ‘আমাকে হত্যা করা হলে তোমার কী ক্ষতি, সুন্দরী?’ মুখে বলল, ‘কেন? আমার অপরাধ?’

‘দলপতির বিশ্বাস আপনি আমাদের বিরুদ্ধে এমন কিছু তথ্য জানতে পেরেছেন যা আমাদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। কাজেই আর কোনও পথ নেই; সরিয়ে দিতে হবে আপনাকে এই পৃথিবী থেকে। আর আপনাকে এই নিশ্চিত মৃত্যুর ফাঁদে ফেলবার জন্যে আমাকে ওরা ব্যবহার করছে টোপ হিসেবে। খুব দ্রুত কথাগুলো বলে গেল মিত্রা। ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ ও উত্তেজনা।

‘চক্রান্ত, ফাঁদ, মৃত্যু, এইসব কথা শুনে মন খারাপ করছে, কিন্তু টোপটা আমার ভারি পছন্দ হয়েছে। আমি এই টোপ গিলতে রাজি আছি। যা থাকে কপালে!’ হাসল রানা।

‘আপনি হাসছেন? উহ, এর গুরুত্ব যদি আপনাকে বোঝাতে পারতাম!’ তর্জনী ভাঁজ করে কামড়ে ধরল অসহিষ্ণু মিত্রা সেন। ওই যে ওরা সব এসে পড়েছে।’

বাইরে কয়েকটা পায়ের শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে আসছে কারা কাঠের মেঝের উপর মচমচ শব্দ তুলে। আর সময় নেই। রানা চেয়ে দেখল উত্তেজনা, ভয় আর হতাশায় রক্তশূন্য হয়ে গেছে মিত্রার মুখ। বুঝল এটা অভিনয় হতে পারে না।

হঠাৎ রানার বাঁ হাতটা তুলে নিল মিত্রা তার হাতে। চাপা গলায় বলল, ‘আমাকেও জড়িয়েছে ওরা। এই নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র যদি সফল হয় তবে আত্মহত্যা ছাড়া আর পথ নেই আমার। আমি বাঁচতে চাই, মি. রানা! এই বিদেশে আপন কেউ নেই আমার। মৈত্র মশাই নিজেই এই চক্রান্তের উদ্যোক্তা। আমাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে এরা বানের জলে। রক্ষা করবে আমাকে, রানা? তোমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছি আমি। বলো, বাঁচাবে আমাকে?’

আকুল মিনতি মিত্রার চোখে। রানা বুঝল, ও এমন একটা ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে। স্থির দৃষ্টিতে মিত্রার চোখের দিকে চেয়ে ও বুঝল এই কাতর মিনতি অবহেলা করবার সাধ্য ওর নেই। কিন্তু কী সেই চক্রান্ত যাকে মিত্রার এত ভয়? লোকগুলো দরজার কাছে এসে গেছে। আর সময় নেই সব কথা শুনবার।

‘চেষ্টা করব,’ বলল রানা।

মিত্রার কাছে এই আশ্বাসটুকুর অনেক দাম। কৃতজ্ঞতায় দু’ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে। রানার বাঁ হাতের উল্টোপিঠে আলতো করে চুম্বন করল সে, তারপর নরম গালের উপর একবার চেপে ধরেই ছেড়ে দিল। খানিকটা চোখের জল লেগে গেল রানার হাতে।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।

‘নিজেকে বড় স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে। নিজেকে বিপদমুক্ত করার জন্যে জেনে শুনে তোমাকে মৃত্যু-ফাঁদে পা দিতে অনুরোধ করছি। কিন্তু আমি বড় অসহায়। তুমি জানো না কত ভয়ঙ্কর লোক ওরা।’ শিউরে উঠল মিত্রা। আরেকটা শেষ কথা— যদি দ্বিধা হয়, যদি মৃত্যুর ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে, তবে বাঁচার পথও বলে দিচ্ছি—আজ রাতে কিছুতেই ঘর থেকে বেরিয়ো না। কোনও অবস্থাতেই না। আমার যা হবার হোক…।’

মিত্রার খসখসে কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে প্রবল বেগে আবার কড়া নাড়ার শব্দ হলো।

‘তুমি লুকিয়ে পড়ো কোথাও।’

‘না।’ গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিয়ে রানা দেয়ালে বসানো চার বাই তিন ফুট আলমারিটার ছোট্ট তালা এক ঝটকায় ভেঙে ফেলল। যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। ডালাটা খুলতেই দেখা গেল একখানা জাপানী ট্রানজিস্টার টেপ-রেকর্ডার নিশ্চিন্ত মনে ঘুরছে ভিতরে বসে। ওদের কথাবার্তা সব রেকর্ড হয়ে গেছে।

ক্ষুদ্রাকৃতি স্কুল দুটো তুলে নিল রানা টেপ-রেকর্ডার থেকে। তারপর গ্রীনরুমের পেছনের খোলা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল পানা ভর্তি পুকুরে।

‘তুমি জানতে?’ আলমারির ডালাটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল রানা।

‘না।’

এবার প্রবল এক ধাক্কায় ছিটকিনি ভেঙে দু’ফাঁক হয়ে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল জয়দ্রথ মৈত্র। পিছনে আরও কয়েকজন লোক।

হলুদ দৃষ্টি মেলে দুজনকে দেখল জয়দ্রথ মৈত্র। তারপর বলল, ‘সরি ফর দ্য ইন্টারাপশন।’ পরিষ্কার বিরক্তির ভাব প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে।

‘দ্যাটস অল রাইট,’ উত্তর দিল রানা। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে মৈত্রকে পাশ কাটিয়ে চেয়ার থেকে গ্যাজেট ব্যাগ আর ফ্ল্যাশ-গানটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেতে যেতে মিত্রার কৈফিয়ত কানে গেল তার।

‘উনি একটা ক্লোজ-আপ ছবি নিতে…’

‘দরজা বন্ধ করে নিয়েছিল কেন?’

‘আমি, মানে, উনি…’

মৃদু হেসে রাস্তায় গিয়ে পড়ল মাসুদ রানা।