আলালের ঘরের দুলাল
২৬. ঠকচাচার বেনিগারদে নিদ্রাবস্থায় আপন কথা আপনি ব্যক্তকরণ, পুলিসে বাঞ্ছারাম ও বটলরের সহিত সাক্ষাৎ, মকদ্দমা বড় আদালতে চালান, ঠকচাচার জেলে কয়েদ, জেলেতে তাহার সহিত অন্যান্য কয়েদীর কথাবার্তা ও তাহার খাবার অপহরণ।
মনের মধ্যে ভয় ও ভাবনা প্রবেশ করিলে নিদ্রার আগমন হয় না। ঠকচাচা বেনিগারদে অতিশয় অস্থির হইলেন,একখানা কম্বলের উপর পড়িয়া এপাশ ওপাশ করিতে লাগিলেন। উঠিয়া এক একবার দেখেন রাত্রি কত আছে। গাড়ির শব্দ অথবা মনুষ্যের স্বর শুনিলে বোধ করেন এইবার বুঝি প্রভাত হইল। এক একবার ধড়মড়িয়া উঠিয়া সিপাইদিগকে জিজ্ঞাসা করেন – ”ভাই! ভাই! রাত কেত্না হুয়া? – তাহারা বিরক্ত হইয়া বলে, “আরে কামান দাগ্নেকো দো তিন ঘন্টা দের হেয় আব লৌট রহো, কাহে হর্ ঘড়ি দেক করতে হো?” ঠকচাচা ইহা শুনিয়া কম্বলের উপর গড়াগড়ি দেন। তাঁহার মনে নানা কথা – নানা ভাব – নানা উপায় উদয় হয়। কখন কখন ভাবেন – আমি চিরকালটা জুয়াচুরি ও ফেরেবি মতলবে কেন ফিরলাম – ইহাতে যে টাকাকড়ি রোজগার হইয়াছিল তাহা কোথায়? পাপের কড়ি হাতে থাকে না, লাভের মধ্যে এই দেখি যখন মন্দ কর্ম করিয়াছি তখন ধরা পড়িবার ভয়ে রাত্রে ঘুমাই নাই – সদাই আতঙ্কে থাকিতাম – গাছের পাতা নড়িলে বোধ হইত যেন কেহ ধরিতে আসিতেছে। আমার হামজোলফ খোদাবক্স আমাকে এ প্রকার ফেরেক্কায় চলিতে বার বার মানা করিতেন – তিনি বলিতেন, চাষবাস অথবা কোনো ব্যবসা বা চাকরি করিয়া গুজরান করা ভাল, সিদে পথে থাকিলে মার নাই – তাহাতে শরীর ও মন দুই ভাল থাকে। এইরূপ চলিয়াই খোদাবক্স সুখে আছেন। হায়! আমি তাহার কথা কেন শুনিলাম না। কখন কখন ভাবেন উপস্থিত বিপদ্ হইতে কি প্রকারে উদ্ধার পাইব? উকিল কৌনসুলি না ধরিলে নয় – প্রমাণ না হইলে আমার সাজা হইতে পারে না – জাল কোন্খানে হয় ও কে করে তাহা কেমন করিয়া প্রকাশ হইবে? এইরূপ নানা প্রকার কথার তোলপাড় করিতে করিতে ভোর হয় হয় এমতো সময়ে শ্রান্তিবশত ঠকচাচার নিদ্রা হইল, তাহাতে আপন দায় সংক্রান্ত স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে ঘুমের ঘোরে বকিতে লাগিলেন – ”বাহুল্য! তুলি, কলম ও কল কেহ যেন দেখিতে পায় না – শিয়ালদার বাড়ির তালায়ের ভিতর আছে – বেশ আছে – খবর্দার তুলিও না – তুমি জল্দি ফরিদপুরে পেলিয়ে যাও – মুই খালাস হয়্যে তোমার সাত মোলাকাত করবো।”
প্রভাত হইয়াছে – সূর্যের আভা ঝিলিমিলি দিয়া ঠকচাচার দাড়ির উপর পড়িয়াছে। বেনিগারদের জমাদার তাহার নিকট দাঁড়াইয়া ঐ সকল কথা শুনিয়া চীৎকার করিয়া বলিল – ”বদ্জাত! আবতলক শোয়া হেয় – উঠো, তোম আপ্না বাত আপ্ জাহের কিয়া।” ঠকচাচা অমনি ধড়মড়িয়ে উঠিয়া চকে, নাকে ও দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে তস্বি পড়িতে লাগলেন। জমাদারের প্রতি এক একবার মিটমিট করিয়া দেখেন – এক একবার চক্ষু মুদিত করেন। জমাদার ভ্রূকুটি করিয়া বলিল – তোম্ তো ধরম্কা ছালা লে করকে বয়টা হেয় আর শেয়ালদাকো তালায়সে কল-ওল নেকালনেসে তেরি ধরম আওরভি জাহের হোগা। ঠকচাচা এই কথা শুনিবামাত্রে কদলীবৃক্ষের ন্যায় ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন ও বলিলেন “বাবা! মেরি বাইকো বহুত জোর হুয়া। এস সবসে হাম নিদ জানেসে জুট মুট বক্তা হুঁ!” “ভালা ও বাত পিছু বোঝা জাওঙ্গি – আব তৈয়ার হো” এই বলিয়া জমাদার চলিয়া গেল।
এদিকে দশটা ঢং ঢং করিয়া বাজিল, অমনি পুলিসের লোকেরা ঠকচাচা ও অন্যান্য আসামীদিগকে লইয়া হাজির করিল। নয়টা না বাজিতে বাজিতে বাঞ্ছারামবাবু বটলর সাহেবকে লইয়া পুলিসে ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছিলেন ও মনে মনে ভাবিতেছিলেন – ঠকচাচাকে এ যাত্রা রক্ষা করিলে তাহার দ্বারা অনেক কর্ম পাওয়া যাইবে – লোকটা বলতে-কহিতে, লিখিতে-পড়তে, যেতে-আসতে, কাজে-কর্মে, মামলা-মকদ্দমায়, মতলব-মসলতে বড় উপযুক্ত। কিন্তু আমার হচ্ছে এ পেশা – টাকা না পাইলে কিছুই তদ্বির হইতে পারে না। ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াইতে পারি না, আর নাচতে বসেছি ঘোমটাই বা কেন? ঠকচাচাও তো অনেকের মাথা খেয়েছেন তবে ওঁর মাথা খেতে দোষ কি? কিন্তু কাকের মাংস খাইতে গেলে বড় কৌশল চাই। বটলর সাহেব বাঞ্ছারামকে অন্যমনস্ক দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল – বেন্সা! তোম্ কিয়া ভাবতা? বাঞ্ছারাম উত্তর করিলেন – বোসো সাহেব; হাম রূপেয়া যে সুরতনে ঘরমে ঢোকে ওই ভাবতা। বটলর সাহেব একটু অন্তরে গিয়া বলিলেন – ”আস্সা আস্সা – বহুত আস্সা।”
ঠকচাচাকে দেখিবামাত্র বাঞ্ছারাম দৌড়ে গিয়া তাহার হাত ধরিয়া চোক দু-টো পান্সে করিয়া বলিলেন – একি একি! কাল কুসংবাদ শুনিয়া সমস্ত রাত্রিটা বসিয়া কাটাইয়াছি, একবারও চক্ষু বুজি নাই – ভোর হতে না হতে পূজা-আহ্ণিক অমনি ফুলতোলা রকমে সেরে সাহেবকে লইয়া আসিতেছি। ভয় কি? এ কি ছেলের হাতের পিটে? পুরুষের দশ দশা, আর বড় গাছেই ঝড় লাগে। কিন্তু এক কিস্তি টাকা না হইলে তদ্বিরাদি কিছুই হইতে পারে না – সঙ্গে না থাকে তো ঠকচাচীর দুই-একখানা ভারি রকম গহনা আনাইলে কর্ম চলতে পারে। এক্ষণে তুমি তো বাঁচো তার পরে গহনা-টহনা সব হবে। বিপদে পড়িলে সুস্থির হইয়া বিবেচনা করা বড় কঠিন, ঠক-চাচা তৎক্ষণাৎ আপন পত্নীকে এক পত্র লিখিয়া দিলেন। ঐ পত্র লইয়া বাঞ্ছারাম বটলর সাহেবের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্বক চক্ষু টিপিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে একজন সরকারের হাতে দিলেন এবং বলিলেন – তুমি ধাঁ করিয়া বৈদ্যবাটী যাইয়া ঠকচাচীর নিকট হইতে কিছু ভারি রকম গহনা আনিয়া এখানে অথবা আপিসে দেখতে দেখতে আইস, দেখিও গহনা খুব সাবধান করিয়া আনিও, বিলম্ব না হয়, যাবে আর আসবে – যেন এইখানে আছো। সরকার রুষ্ট হইয়া বলিল – মহাশয়। মুখের কথা, অমনি বললেই হইল? কোথায় কলিকাতা – কোথায় বৈদ্যবাটী – আর ঠকচাচীই বা কোথা? আমাকে অন্ধকারে ঢেলা মারিয়া বেড়াইতে হইবে, এক মুঠা খাওয়া দূরে থাকুক এখনও এক ঘটি জল মাথায় দিই নাই – আজ ফিরে কেমন করিয়া আসতে পারি? বাঞ্ছারাম অমনি রেগেমেগে হুম্কে উঠিয়া বলিলেন,–ছোটলোক এক জাতই স্বতন্তর, এরা ভাল কথার কেউ নয়, নাতি-ঝেঁটা না হলে জব্দ হয় না। লোকে তল্লাশ করিয়া দিল্লী যাইতেছে, তুমি বৈদ্যবাটী গিয়া একটা কর্ম নিকেশ করিয়া আসতে পারো না? সাকুব হইলে ইশারায় কর্ম-বুঝে – তোর চোকে আঙুল দিয়া বললুম তাতেও হোঁশ হইল না? সরকার অধোমুখে না রাম না গঙ্গা কিছুই না বলিয়া বেটো ঘোড়ার ন্যায় ঢিকুতে ঢিকুতে চলিল ও আপনা আপনি বলিতে লাগিল – দুঃখী লোকের মানই বা কি আর অপমানই বা কি? পেটের জন্য সকলই সহিতে হয়। কিন্তু হেন দিন কবে হবে যে ইনি ঠকচাচার মতো ফাঁদে পড়বেন। আমার দেক্তা উনি অনেক লোকের গলায় ছুরি দিয়াছেন – অনেক লোকের ভিটে মাটি চাটি করিয়াছেন – অনেক লোকের ভিটায় ঘু ঘু চরাইয়াছেন। বাবা! অনেক উকিলের মুৎসুদ্দি দেখিয়াছি বটে কিন্তু ওর জুড়ি নাই। রকমটা – ভাজেন পটোল, বলেন ঝিঙ্গা, যেখানে ছুঁচ চলে না সেখানে বেটে চালান। এদিকে পূজা-আহ্ণিক, দোল-দুর্গোৎসব, ব্রাহ্মণভোজন ও ইষ্টনিষ্ঠাও আছে। এমন হিন্দুয়ানির মুখে ছাই – আগাগোড়া হারামজাদ্কি ও বদ্জাতি!
এখানে ঠকচাচা, বাঞ্ছারাম ও বটলর বসিয়া আছেন, মকদ্দমা আর ডাক হয় না। যত বিলম্ব হইতেছে তত ধরফড়ানি বৃদ্ধি হইতেছে। পাঁচটা বাজে বাজে এমন সময়ে ঠকচাচাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে লইয়া খাড়া করিয়া দিল। ঠকচাচা গিয়া সেখানে দেখেন যে শিয়ালদার পুষ্করিণী হইতে জাল করিবার কল ও তথাকার দুই-একজন গাওয়া আনিত হইয়াছে। মকদ্দমার তদারক হওনান্তর ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন যে, এ মামলা বড় আদালতে চালান হউক। আসামীর জামিন লওয়া যাইতে পারা যায় না সুতরাং তাহাকে বড় জেলে কয়েদ থাকিতে হইবে।
ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম হইবামাত্রে বাঞ্ছারাম তেড়ে আসিয়া হাত নাড়িয়া বলিলেন – ভয় কি? একি ছেলের হাতের পিটে? এ তো জানাই আছে যে,মকদ্দমা বড় আদালতে হবে – আমরাও তাই তো চাই। ঠকচাচা মুখখানি ভাবনায় একেবারে শুকিয়ে গেল। পেয়াদা হাত ধরিয়া হিড় হিড় করিয়া নীচে টানিয়া জেলে চালান করিয়া দিল। চাচা টংয়স্ টংয়স্ করিয়া চলিয়াছেন – মুখে বাক্য নাই – চক্ষু তুলিয়া দেখেন না, পাছে কাহারো সহিত দেখা হয় – পাছে কেহ পরিহাস করে। সন্ধ্যা হইয়াছে এমন সময় ঠকচাচা শ্রীঘরে পদার্পণ করিলেন। বড় জেলেতে যাহারা দেনার জন্য অথবা দেওয়ানি মকদ্দমা ঘটিত কয়েদ হয় তাহারা একদিকে ও যাহারা ফৌজদারী মামলা হেতু কয়েদ হয় তাহারা অন্য দিকে থাকে। ঐ সকল আসামির বিচার হইলে হয়তো তাহাদিগের ঐ স্থানে মিয়াদ খাটিতে নয়তো হরিং বাটীতে সুরকি কুটিতে হয় অথবা জিঞ্জির বা ফাঁসি হয়। ঠকচাচাকে ফৌজদারী জেলে থাকিতে হইল, তিনি ঐ স্থানে প্রবেশ করিলে যাবতীয় কয়েদী আসিয়া ঘেরিয়া বসিল। ঠকচাচা কটমট করিয়া সকলকে দেখিতে লাগিলেন – একজন আলাপীও দেখিতে পান না। কয়েদীরা বলিল, মুনশীজি!–দেখো কি? তোমারও যে দশা আমাদেরও সেই দশা, এখন আইস মিলে-জুলে থাকা যাউক। ঠকচাচা বলিলেন – হাঁ বাবা! মুই নাহক আপদে পড়েছি – মুই খাইনে, ছুঁইনে, মোর কেবল নসিবের ফের। দুই-একজন প্রাচীন কয়েদী বলিল – হাঁ তা বই কি! অনেকেই মিথ্যা দায়ে মজে যায়। একজন মুখফোড় কয়েদী বলিয়া উঠিল – তোমার দায় মিথ্যা আমাদের বুঝি সত্য? আঃ। বেটা কি সাওখোড় ও সরফরাজ? ওহে ভাইসকল সাবধান – এ দেড়ে বেটা বড় বিট্কেলে লোক। ঠকচাচা অমনি নরম হইয়া আপনাকে খাটো করিলেন কিন্তু তাহারা ঐ কথা লইয়া অনেকে ক্ষণেক কাল তর্ক-বিতর্ক করিতে ব্যস্ত হইল। লোকের স্বভাবই এই, কোনো কর্ম না থাকিলে একটু সূত্র ধরিয়া ফাল্তো কথা লইয়া গোলমাল করে।
জেলের চারিদিক বন্ধ হইল – কয়েদীরা আহার করিয়া শুইবার উদ্যোগ করিতেছে, ইত্যবসরে ঠকচাচা এক প্রান্তভাগে বসিয়া কাপড় বাঁধা মিঠাই খুলিয়া মুখে ফেলিতে যান অমনি পেছন দিকে থেকে দুই দুই বেটা মিশ কালো কয়েদী – গোঁপ, চুল ও ভুরু সাদা, চোক লাল – হাহা হাহা শব্দে বিকট হাস্য করত মিঠায়ের ঠোঙাটি সট্ করিয়া কাড়িয়া লইল এবং দেখাইয়া দেখাইয়া টপ টপ করিয়া খাইয়া ফেলিল। মধ্যে মধ্যে চর্বণকালীন ঠকচাচার মুখের নিকট মুখ আনিয়া হিহি হিহি করিয়া হাসিতে লাগিল। ঠকচাচা একেবারে অবাক – আস্তে আস্তে মাদুরির উপর গিয়া সুড় সুড় করিয়া শুইয়া পড়িলেন, যেন কিল খেয়ে কিল চুরি।
আলালের ঘরের দুলাল
২৭. বাদার প্রজার বিবরণ – বাহুল্যের বৃত্তান্ত ও গ্রেপ্তারি, গাড়ি-চাপা লোকের প্রতি বরদাবাবুর সততা,বড় আদালতে ফৌজদারী মকদ্দমা করণের ধারা,বাঞ্ছারামের দৌড়াদোড়ি,ঠকচাচা ও বাহুল্যের বিচার ও সাজা।
বাদাতে ধানকাটা আরম্ভ হইয়াছে, সালতি সাঁ সাঁ করিয়া চলিয়াছে – চারিদিক জলময় – মধ্যে মধ্যে চৌকি দিবার টং, কিন্তু প্রজার নিস্তার নাই – এদিকে মহাজন ওদিকে জমিদারের পাইক। যদি বিকি ভাল হয় তবে তাহদিগের দুই বেলা দুই মুঠা আহার চলিতে পারে নতুবা মাছটা, শাকটা ও জনখাটা ভরসা। ডেঙাতে কেবল হৈমন্তী বুনন হয় – আউস প্রায় বাদাতেই জন্মে। বঙ্গদেশে ধান্য অনায়াসে উৎপন্ন হয় বটে কিন্তু হাজা, শুকা, পোকা, কাঁকড়া ও কার্তিকে ঝড়ে ফসলের বিলক্ষণ ব্যাঘাত হয়; আর ধানের পাইটও আছে, তদারক না করিলে কলা ধরিতে পারে। বাহুল্য প্রাতঃকালে আপন জোতের জমি তদারক করিয়া আপন বাটীর দাওয়াতে বসিয়া তামাক খাইতেছেন; সম্মুখে একটা কাগজের দপ্তর, নিকটে দুই-চারিজন হারামজাদা প্রজা ও আদালতের লোক বসিয়ে আছে – হাকিমের আইনের ও মামলার কথাবার্তা হইতেছে ও কেহ কেহ নূতন দস্তাবেজ তৈয়ার ও সাক্ষী তালিম করিবার ইশারা করিতেছে – কেহ কেহ টাকা টেঁক থেকে খুলিয়া দিতেছে ও আপন আপন মতলব হাঁসিল জন্য নানা প্রকার স্তুতি করিতেছে। বাহুল্য কিছু যেন অন্যমনস্ক – এদিকে ওদিকে দেখিতেছেন – এক একবার আপন কৃষাণকে ফাল্তো ফরমাইশ করিতেছেন, “ওরে ঐ কদুর ডগাটা মাচার উপর তুলে দে, ঐ খেড়ের আঁটিটা বিছিয়ে ধুপে দে,” ও এক এক বার ছমছমে ভাবে চারিদিকে দেখিতেছেন। নিকটস্থ এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল – মৌলুবী সাহেব! ঠকচাচার কিছু মন্দ খবর শুনিতে পাই – কোনো পেঁচ নাই তো? বাহুল্য কথা ভাঙিতে চান না, দাড়ি নেড়ে – হাত তুলে অতি বিজ্ঞরূপে বলিতেছেন – মরদের উপর হরেক আপদ গেরে, তার ডর করলে চলবে কেন? অন্য একজন বলিতেছে – এ তো কথাই আছে কিন্তু সে ব্যক্তি বারেঁহা, আপন বুদ্ধির জোরে বিপদ থেকে উদ্ধার হইবে। সে যাহা হউক আপনার উপর কোনো দায় না পড়িলে আমরা বাঁচি – এই ডেঙা ভবানীপুরে আপনি বৈ আমাদের সহায় সম্পত্তি আর নাই – আমাদের বল বলুন, বুদ্ধি বলুন সকলই আপনি। আপনি না থাকলে আমাদের এখান হইতে বাস উঠাইতে হইত। ভাগ্যে আপনি আমাকে কয়েকখানা কবজ বানিয়ে দিয়েছিলেন তাই জমিদার বেটাকে জব্দ করিয়াছি, আমার উপর সেই অবধি কিছু দৌরাত্ম্য করে না – সে ভাল জানে যে আপনি আমার পাল্লায় আছেন। বাহুল্য আহ্লাদে গুড়গুড়িটা ভড় ভড় করিয়া চোক মুখ দিয়া ধুঁয়া নির্গত করত একটু মৃদু মৃদু হাস্য করিলেন। অন্য একজন বলিল – মফস্বলে জমি-জমা শিরে লইতে গেলে জমিদার ও নীলকরদের জব্দ করিবার জন্য দুই উপায় আছে – প্রথমত মৌলুবী সাহেবের মতন লোকের আশ্রয় লওয়া – দ্বিতীয়ত খ্রীষ্টিয়ান হওয়া। আমি দেখিয়াছি অনেক প্রজা পাদরীর দোহাই দিয়া গোকুলের ষাড়েঁর ন্যায় বেড়ায়! পাদরী সাহেব কড়িতে বলো – সহিতে বলো – সুপারিসে বলো “ভাই লোকদের” সর্বদা রক্ষা করেন। সকল প্রজা যে মনের সহিত খ্রীষ্টিয়ান হয় তা নয় কিন্তু যে পাদরীর মণ্ডলীতে যায় সে নানা উপকার পায়। মাল মকদ্দমায় পাদরীর চিঠি বড় কর্মে লাগে। বাহুল্য বলিলেন, সে সচ্ বটে – লেকেন আদমির আপনার দীন খোয়ানা বহুত বুরা। অমনি সকলে বলিল – তা বটে তো, তা বটে তো ; আমরা এই কারণে পাদরীর নিকটে যাই না। এইরূপ খোশ গল্প হইতেছে ইতিমধ্যে দারোগা, জন কয়েক জমাদার ও পুলিসের সার্জন হুড়মুড় করিয়া বাহুল্যের হাত ধরিয়া বলিল – তোম ঠকচাচা কো সাত জাল কিয়া – তোমার উপর গেরেপ্তারি হেয়। এই কথা শুনিবামাত্র নিকটস্থ লোক সকলে ভয় পাইয়া সট্ সট্ করিয়া প্রস্থান করিল। বাহুল্য দারোগা ও সার্জনকে ধন লোভ দেখাইল কিন্তু তাহারা পাছে চাকরি যায় এই ভয়ে ওকথা আমলে আনিল না, তাহার হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। ডেঙ্গা ভবানীপুরে এই কথা শুনিয়া লোকারণ্য হইল ও ভদ্র ভদ্র লোকে বলিতে লাগিল দুষ্কর্মের শাস্তি বিলম্বে বা শীঘ্রে অবশ্যি হইবে। যদি লোকে পাপ করিয়া সুখে কাটাইয়া যায় তবে সৃষ্টিই মিথ্যা হইবে, এমন কখনই হইতে পারে না। বাহুল্য ঘাড় হেঁট করিয়া চলিয়াছেন – অনেকের সহিত দেখা হইতেছে কিন্তু কাহাকে দেখেও দেখেন না। দুই-এক ব্যক্তি যাহারা কখন না কখন তাহার দ্বারা অপকৃত হইয়াছিল, তাহারা এই অবকাশে কিঞ্চিৎ ভরসা পাইয়া নিকটে আসিয়া বলিল – মৌলবী সাহেব! একি ব্রজের ভাব না-কি? আপনার কি কোনো ভারি বিষয় কর্ম হইয়াছে? না রাম না গঙ্গা কিছুই না বলিয়া বাহুল্য বংশদ্রোণীর ঘাট পার হইয়া শাগঞ্জে আসিয়া পড়িলেন। সেখানে দুই-একজন টেপুবংশীয় শাজাদা তাঁহাকে দেখিয়া বলিল – কেউঁ তু গেরেপ্তার হোয়া – আচ্ছা হুয়া – এয়সা বদ্জাত আদমিকো সাজা মিলনা বহুত বেহতর। এই সকল কথা বাহুল্যের প্রতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা লাগিতে লাগিল। ঘোরতর অপমানে অপমানিত হইয়া ভবানীপুরে পৌঁছিলেন – কিঞ্চিৎদূরে থেকে বোধ হইল রাস্তার বামদিকে কতকগুলি লোক দাঁড়াইয়া গোল করিতেছে, নিকটে আসিয়া সার্জন বাহুল্যকে লইয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখানে এত লোক কেন? পরে লোক ঠেলিয়া গোলের ভিতর যাইয়া দেখিল, একজন ভদ্রলোক এক আঘাতিত ব্যক্তিকে ক্রোড়ে করিয়া বসিয়া আছেন – আঘাতিত ব্যক্তির মস্তক দিয়া অবিশ্রান্ত রুধির নির্গত হইতেছে, ঐ রক্তে উক্ত ভদ্রলোকের বস্ত্র ভাসিয়া যাইতেছে; সার্জন জিজ্ঞসা করিল, আপনি কে ও এ লোকটি কি প্রকারে জখম হইল? ভদ্রলোক বলিলেন – আমার নাম বরদাপ্রসাদ বিশ্বাস – আমি এখানে কোনো কর্ম অনুরোধে আসিয়াছিলাম দৈবাৎ এই লোক গাড়ি চাপা পড়িয়া আঘাতিত হইয়াছে, এই জন্য আমি আগুলিয়া বসিয়া আছি – শীঘ্র হাসপাতালে লইয়া যাইব তাহার উদ্যোগ পাইতেছি – একখানা পালকি আনিতে পাঠাইয়াছিলাম কিন্তু বেহারা ইহাকে কোনো মতে লইয়া যাইতে চাহে না, কারণ এই ব্যক্তি জেতে হাড়ি। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে বটে কিন্তু এ ব্যক্তি গাড়িতে উঠিতে অক্ষম, পাল্কি কিংবা ডুলি পাইলে যত ভাড়া লাগে তাহা আমি দিতে প্রস্তুত আছি। সততার এমনি গুণ যে ইহাতে অধমেরও মন ভেজে। বরদাবাবুর এই ব্যবহার দেখিয়া বাহুল্যের আশ্চর্য জন্মিয়া আপন মনে ধিক্কার হইতে লাগিল! সার্জন বলিল – বাবু, বাঙালীরা হাড়িকে স্পর্শ করে না, বাঙালী হইয়া তোমার এত দূর করা বড় সহজ কথা নহে। বোধ হয় তুমি বড় অসাধারণ ব্যক্তি, এই বলিয়া আসামীকে পেয়াদার হাওয়ালে রাখিয়া সার্জন আপনি আড়ার নিকট যাইয়া ভয়মৈত্রতা প্রদর্শনপূর্বক পালকি আনিয়া বরদাবাবুর সহিত উক্ত হাড়িকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল।
পূর্বে বড় আদালতে ফৌজদারী মকদ্দমা বৎসরে তিন তিন মাস অন্তর হইত এক্ষণে কিছু ঘন ঘন হইয়া থাকে। ফৌজদারী মকদ্দমা নিষ্পত্তি করণার্থে তথায় দুই প্রকার জুরি মকরর হয়, প্রথমত গ্রাঞ্জুরি, যাহারা পুলিশ-চালানি ও অন্যান্য লোক যে ইণ্ডাইটমেণ্ড করে তাহা বিচারযোগ্য কি-না বিবেচনা করিয়া আদালতকে জানান – দ্বিতীয়ত পেটিজুরি, যাহারা গ্রাঞ্জুরি বিবেচনা অনুসারে বিচারযোগ্য মকদ্দমা জজের সহিত বিচার করিয়া আসামিদিগকে দোষী বা নির্দোষ করেন। এক এক সেশনে অর্থাৎ ফৌজদারী আদালতে ১৪ জন গ্রাঞ্জুরি মকরর হয়, যে সকল লোকের দুই লক্ষ টাকার বিষয় বা যাহারা সৌদাগরি করে তাহারাই গ্রাঞ্জুরি হইতে পারে। সেশনে পেটিজুরি প্রায় প্রতিদিন মকরর হয়, তাহাদিগের নাম ডাকিবার কালীন আসামী বা ফৈরাদি স্বেচ্ছানুসারে আপত্তি করিতে পারে অর্থাৎ যাহার প্রতি সন্দেহ হয় তাহাকে না লইয়া অন্য আর একজনকে নিযুক্ত করাইতে পারে কিন্তু বারোজন পেটিজুরি শপথ করিয়া বসিলে আর বদল হয় না। সেকশনের প্রথম দিবসে তিনজন জজ বসেন, যখন যাঁহার পালা তিনি গ্রাঞ্জুরি মকরর হইলে তাঁহাদিগাকে চার্জ অর্থাৎ সেশনীয় মকদ্দমার হালাৎ সকল বুঝাইয়া দেন। চার্জ দিলে পর অন্য দুইজন জজ যাঁহাদের পালা নয় তাঁহারা উঠিয়া যান ও গ্রাঞ্জুরিরা এক কামরার ভিতর যাইয়া প্রত্যেক ইণ্ডাইটমেণ্ডের উপর আপন বিবেচনানুসারে যথার্থ বা অযথার্থ লিখিয়া পাঠাইয়া দেন, তাহার পর বিচার আরম্ভ হয়।
রজনী প্রায় অবসান হয় – মন্দ মন্দ সমীরণ বহিতেছে, এই সুশীতল সময়ে ঠকচাচা মুখ হাঁ করিয়া বেতর নাক ডাকাইয়া নিদ্রা যাইতেছেন। অন্যান্য কয়েদীরা উঠিয়া তামাক খাইতেছে ও কেহ কেহ ঐ শব্দ শুনিয়া “মোস পোড়া খা, মোস পোড়া খা” বলিতেছে কিন্তু ঠকচাচা কুম্ভকর্ণের ন্যায় নিদ্রা যাইতেছেন – ”নাসা গর্জন শুনি পরান শিহরে”। কিয়ৎকাল পরে জেলরক্ষক সাহেব আসিয়া কয়েদীদের বলিলেন – তোমরা শীঘ্র প্রস্তুত হও, অদ্য সকলকে আদালতে যাইতে হইবে।
এদিকে সেশন খুলিবামাত্রে দশ ঘণ্টার অগ্রেই বড় আদালতের বারান্দা লোকে পরিপূর্ণ হইল – উকিল, কৌন্সুলি, ফৈরাদি, আসামী, সাক্ষী, উকিলের মুৎসুদ্দি, জুরি, সার্জন, জমদার, পেয়াদা – নানা প্রকার লোক থৈ থৈ করিতে লাগিল। বাঞ্ছারাম বটলর সাহেবকে লইয়া ফিরিতেছেন ও ধনী লোক দেখিলে তাঁহাকে জানুন না জানুন আপনার বামনাই ফলাইবার জন্য হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিতেছেন, কিন্তু যিনি তাঁহাকে ভাল জানেন তিনি তাঁহার শিষ্টাচারিতে ভুলেন না – তিনি এক লহমা কথা কহিয়াই একটা-না-একটা মিথ্যা বরাত অনুরোধে তাঁহার হাত হইতে উদ্ধার হইতেছেন। দেখতে দেখতে জেলখানার গাড়ি আসিল – আগু পিছু দুই দিকে সিপাই। গাড়ি খাড়া হইবামাত্রে সকলে বারান্দা থেকে দেখিতে লাগিল – গাড়ির ভিতর থেকে সকল কয়েদীকে লইয়া আদালতের নীচেকার ঘরের কাঠগড়ার ভিতর রাখিল। বাঞ্ছারাম হন হন করিয়া নীচে আসিয়া ঠকচাচা ও বাহুল্যের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন – তোমরা ভীমার্জুন – ভয় পেও না – এ কি ছেলের হাতের পিটে?
দুই প্রহর হইবামাত্রে বারান্দার মধ্যস্থল খালি হইল – লোক সকল দুইদিকে দাঁড়াইল – আদালতের পেয়াদা “চুপ্ চুপ্” করিতে লাগিল – জজেরা আসিতেছেন বলিয়া যাবতীয় লোক নিরীক্ষণ করিতেছে এমন সময়ে সার্জন পেয়াদা ও চোপদারেরা বল্লম, বর্শা, আশাসোঁটা, তলোয়ার ও বাদশাহ্র রৌপ্যময় মটুকাকৃতি সজ্জা হস্তে করিয়া দেখা দিল – তাহার পর সরিফ ও ডিপুটি সরিফ ছড়ি হাতে করিয়া দেখা দিল – তাহার পর তিনজন জজ লাল কোর্তা পরা গম্ভীরবদনে মৃদু মৃদু গতিতে বেঞ্চের উপর উঠিয়া কৌন্সুলিদের সেলাম করত উপবেশন করিলেন। কৌন্সুলিরা অমনি দাঁড়াইয়া সম্মানপূর্বক অভিবাদন করিল – চৌকির নাড়ানাড়ি ও লোকের বিজ্বিজিনি এবং ফুসফুসানি বৃদ্ধি হইতে লাগিল – পেয়াদারা মধ্যে মধ্যে “চুপ্ চুপ্ চুপ্” করিতেছে – সার্জনেরা “হিশ হিশ” করিতেছে – ক্রায়র “ওইস – ওইস” বলিয়া সেশন খুলিল। অনন্তর গ্রাঞ্জুরিদিগের নাম ডাকা হইয়া তাহারা মকরর হইল ও আপনাদিগের ফোরম্যান অর্থাৎ প্রধান গ্রাঞ্জুরি নিযুক্ত করিল। এবার রস্ল্ সাহেবের পালা, তিনি গ্রাঞ্জুরির প্রতি অবলোকন করিয়া বলিলেন – মকদ্দমার তালিকা দৃষ্টে বোধ হইতেছে যে, কলিকাতায় জাল করা বৃদ্ধি হইয়াছে কারণ ঐ কালেবের পাঁচ-ছয়টা মকদ্দমা দেখিতে পাই – তাহার মধ্যে ঠকচাচা ও বাহুল্যের প্রতি যে নালিশ তৎসম্পর্কীয় জবানবন্দিতে প্রকাশ পাইতেছে যে, তাহারা শিয়ালদাতে জাল কোম্পানির কাগজ তৈয়ার করিয়া কয়েক বৎসরাবধি এই শহরে বিক্রয় করিতেছে – এ মকদ্দমা বিচারযোগ্য কি-না তাহা আমাকে আগ্রে জানাইবেন – অন্যান্য মকদ্দমার দস্তাবেজ দেখিয়া যাহা কর্তব্য তাহা করিবেন তদ্বিষয়ে আমার কিছু বলা-বাহুল্য। এই চার্জ পাইয়া গ্রাঞ্জুরি কামরার ভিতর গমন করিল – বাঞ্ছারাম বিষন্ন ভাবে বটলর সাহেবের প্রতি দেখিতে লাগিলেন। দশ-পনের মিনিটের মধ্যে ঠকচাচা ও বাহুল্যের প্রতি ইণ্ডাইটমেণ্ড যথার্থ বলিয়া আদালতে প্রেরিত হইল। অমনি জেলের প্রহরী ঠকচাচা ও বাহুল্যকে আনিয়া জজের সম্মুখে কাঠরার ভিতর খাড়া করিয়া দিল ও পেটিজুরি নিযুক্ত হওন কালীন কোর্টের ইণ্টারপ্রিটার চিৎকার করিয়া বলিলেন – মোকাজান ওরফে ঠকচাচা ও বাহুল্য! তোমলোক্কা উপর জাল কোম্পানির কাগজ বানানেকা নালেশ হুয়া – তোমলোক এ কাম কিয়া কি নেহি? আসামীরা বলিল – জাল বি কাকে বলে আর কোম্পানির কাগজ বি কাকে বলে মোরা কিছুই জানি না, মোরা সেরেফ মাছ ধরবার জাল জানি। মোরা চাষবাস করি মোদের এ কাম নয় – এ কাম সাহেব সুভদের। ইণ্টারপ্রিটার ত্যক্ত হইয়া বলিল তোমলোক বহুত লম্বা লম্বা বাত কহতা হেয় – তোমলোক এ কাম কিয়া কি নেহি? আসামীরা বলিল – মোদের বাপ-দাদারাও কখন করে নাই। ইণ্টারপ্রিটার অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া মেজ চাপড়িয়া বলিল – হামারি বাতকো জবাব দেও – এ কাম কিয়া কি নেহি? নেহি নেহি এ হামলোক কাভি কিয়া নেহি – এই উত্তর আসামীরা অবশেষে দিল। উক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার তাৎপর্য এই যে আসামী যদি আপন দোষ স্বীকার করে তবে তাহার বিচার আর হয় না – একেবারে সাজা হয়। অনন্তর ইণ্টারপ্রিটার বলিলেন – শুন – এই বারো ভালা আদমি বয়েট করকে তোমলোক কো বিচার করেগা – কিসিকা উপর আগর ওজর রহে তব আবি কহ – ওন্কো উঠায় করকে দুসরা আদমিকো ওন্কো জাগেমে বটলা যায়েগি। আসামীরা এ কথার ভাল-মন্দ কিছু না বুঝিয়া চুপ করিয়া থাকিল। এদিকে বিচার আরম্ভ হইয়া ফৈরাদির ও সাক্ষীর জবানবন্দীর দ্বারা সরকারের তরফ কৌন্সুলি স্পষ্টরূপে জাল প্রমাণ করিল, পরে আসামিদের কৌন্সুলি আপন তরফ সাক্ষী না তুলিয়া জেরার মারপেছি কথা ও আইনের বিতণ্ডা করত পেটিজুরিকে ভুলাইয়া দিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাহার বত্তৃতা শেষ হইলে পর রস্ল্ সাহেব মকদ্দমা প্রমাণের খোলসা ও জালের লক্ষণ জুরিকে বুঝাইয়া বলিলেন – পেটিজুরি এই চার্জ পাইয়া পরামর্শ করিতে কামরার ভিতর গমন করিল – জুরিরা সকলে ঐক্য না হইলে আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতে পারে না। এই অবকাশে বাঞ্ছারাম আসামীদের নিকট আসিয়া ভরসা দিতে লাগিলেন, দুই-চারিটা ভাল-মন্দ কথা হইতেছে ইতিমধ্যে জুরিদের আগমনের গোল পড়ে গেল। তাহারা আসিয়া আপন আপন স্থানে বসিলে ফোরম্যান দাঁড়াইয়া খাড়া হইলেন – আদালত একেবারে নিস্তব্ধ – সকলেই ঘাড় বাড়াইয়া কান পেতে রহিল – কোর্টের ফৌজদারী মমলার প্রধান কর্মচারী ক্লার্ক অব্দি ক্রৌন জিজ্ঞাসা করিল, – জুরি মহাশয়েরা! ঠকচাচা ও বাহুল্য গিল্টি কি নাট গিল্টি? ফোরম্যান বলিলেন – গিল্টি – এই কথা শুনিবামাত্র আসামীদের একেবারে ধড় থেকে প্রাণ উড়ে গেল – বাঞ্ছারাম আস্তে-ব্যস্তে আসিয়া বলিলেন – আরে ও ফুল গিল্টি! এ কি ছেলের হাতের পিটে? এখুনি নিউ ট্রায়েল অর্থাৎ পুনর্বিচারের জন্য প্রার্থনা করিব। ঠকচাচা দাড়ি নাড়িয়া বলিলেন – মোশাই! মোদের নসিবে যা আছে তাই হবে মোরা আর টাকাকড়ি সরবরাহ করিতে পারিব না। বাঞ্ছারাম কিঞ্চিৎ চটে উঠিয়া বলিলেন – সুদু হাঁড়িতে পাত বাঁধিয়া কত করিব – এসব কর্মে কেবল কেঁদে কি মাটি ভিজানো যায়?
এদিকে রস্ল্ সাহেব উল্টে-পাল্টে দেখিয়া আসামীদিগের প্রতি দৃষ্টি করত এই হুকুম দিলেন – “ঠকচাচা ও বাহুল্য! তোমাদের দোষ বিলক্ষণ সপ্রমাণ হইল – যে সকল লোক এমন দোষ করে তাহাদের গুরুতর দণ্ড হওয়া উচিৎ, এ কারণে তোমরা পুলিপালমে গিয়া যাবজ্জীবন থাক।” এই হুকুম হইবামাত্র আদালতের প্রহরীরা আসামীদের হাত ধরিয়া নীচে লইয়া গেল। বাঞ্ছারাম পিচ কাটিয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন – কেহ কেহ তাঁহাকে বলিল – এ কি – আপনার মকদ্দমাটা যে ফেঁসে গেল? তিনি উত্তর করিলেন – এ তো জানাই ছিল – আর এমন সব গলতি মামলায় আমি হাত দি না – আমি এমতো সকল মকদ্দমা কখনই ক্যার করি না।
আলালের ঘরের দুলাল
২৮. বেণী ও বেচারাম বাবুর নিকট বরদাবাবুর সততা ও কাতরতা প্রকাশ এবং ঠকচাচা ও বাহুল্যের কথোপকথন।
বৈদ্যবাটীর বাটী ক্রমে অন্ধকারময় হইল – রক্ষণাবেক্ষণ করে এমন অভিভাবক নাই – পরিজনেরা দুরবস্থায় পড়িল – দিন চলা ভার হইল, গ্রামের লোকে বলিতে লাগিল বালির বাঁধ কতক্ষণ থাকিতে পারে? ধর্মের সংসার হইলে প্রস্তরের গাঁথনি হইত। এদিকে মতিলাল নিরুদ্দেশ – দলবলও অন্তর্ধান – ধুম-ধাম কিছুই শুনা যায় না – প্রেমনারায়ণ মজুমদারের বড় আহ্লাদ – বেণীবাবুর বাড়ির দাওয়ায় বসিয়া তুড়ি দিয়া “বাবলার ফুল লো কানে লো দুলালি, মুড়িমুড়কির নাম রেখেছো রুপালী সোনালী” এই গান গাইতেছেন। ঘরের ভিতরে বেণীবাবু তানপুরায় মেও মেও করিয়া হামির রাগ ভাঁজিয়া “চামেলি ফুলি চম্পা” এই খেয়াল সুরৎ মূর্ছনা ও গমক প্রকাশপূর্বক গান করিতেছেন। ওদিকে বেচারাম বাবু “ভবে এসে প্রথমেতে পাইলাম আমি পঞ্জুড়ি” এই নরচন্দ্রী পদ ধরিয়া রাস্তায় যাবতীয় ছোঁড়াগুলাকে ঘাঁটাইয়া আসিতেছেন। ছোঁড়ারা হো হো করিয়া হাততালি দিতেছে। বেচারাম বাবু এক একবার বিরক্তি হইয়া “দূঁর দূঁর” করিতেছেন। যৎকালে নাদের শা দিল্লী আক্রমণ করেন তৎকালীন মহম্মদ শা সংগীত শ্রবণে মগ্ন ছিলেন – নাদের শা অস্ত্রধারী হইয়া সম্মুখে উপস্থিত হইলে মহম্মদ শা কিছুমাত্র না বলিয়া সংগীতসুধা পানে ক্ষণকালের জন্যেও ক্ষান্ত হয়েন নাই – পরে একটি কথাও না কহিয়া স্বয়ং আপন সিংহাসন ছাড়িয়া দেন। বেচারাম বাবুর আগমনে বেণীবাবু তদ্রূপ করিলেন না – তিনি অমনি তানপুরা রাখিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া সম্মানপূর্বক তাঁহাকে বসাইলেন। কিয়ৎক্ষণ শিষ্ট মিষ্ট আলাপ হইলে পর বেচারাম বাবু বলিলেন – বেণী ভায়া। এতদিনের পর মুষলপর্ব হইল – ঠকচাচা আপন কর্মদোষে অধঃপাতে গেলেন। তোমার মতিলালও আপন বুদ্ধিদোষে রূপস্ হইলেন। ভায়া! তুমি আমাকে সবর্দা বলিতে ছেলের বাল্যকালাবধি মাজা বুদ্ধি ও ধর্মজ্ঞান জন্য শিক্ষা না হইলে ঘোর বিপদ ঘটে, এ কথাটির উদাহরণ মতিলালেতেই পাওয়া গেল। দুঃখের কথা কি বলিব? এ সকল দোষ বাবুরামের – তাঁহার কেবল মোক্তারি বুদ্ধি ছিল – বুড়িতে চতুর কিন্তু কাহনে কানা, দূঁর দূঁর!!
বেণী। আর এ সকল কথা বলিয়া আক্ষেপ করিলে কি হইবে? এ সিদ্ধান্ত অনেকদিন পূর্বেই করা হয়েছিল – যখন মতির শিক্ষা বিষয়ে এত অমনোযোগ ও অসৎ সঙ্গ নিবারণের কোনো উপায় হয় নাই তখনই রাম না হতে রামায়ণ হইয়াছিল। যাহা হউক, বাঞ্ছারামেরই পহবারো – বক্রেশ্বরের কেবল আঁকুপাঁকু সার। মাস্টারি কর্ম করিয়া বড়মানুষের ছেলেদের খোশামোদ করিতে এমন আর কাহাকেও দেখা গেল না – ছেলেপুলেদের শিক্ষা দেওয়া তথৈবচ, কেবল রাত-দিন লব লব, অথচ বাহিরে দেখানো আছে আমি বড় কর্ম করিতেছি – যা হউক মতিলালের নিকট বাওয়াজির আশাবায়ু নিবৃত্তি হয় নাই – তিনি “জল দে, জল দে” বলিয়া গগিয়া আকাশ ফাটাইয়াছেন কিন্তু লাভের মেঘও কখন দেখিতে পান নাই – বর্ষণ কি প্রকারে দেখিবেন?
প্রেমনারায়ণ মজুমদার বলিল – মহাশয়দিগের আর কি কথা নাই? কবিকঙ্কণ গেল – বাল্মীক গেল – ব্যাস গেল – বিষয়কর্মের কথা গেল – একা বাবুরামি হাঙ্গামে পড়ে যে প্রাণ ওষ্ঠগত হইল – মতে ছোড়া যেমন অসৎ তেমনি তার দুর্গতি হইয়াছে, সে চুলায় যাউক, তাহার জন্য কিছু খেদ নাই।
হরি তামাক সাজিয়া হুঁকাটি বেণীবাবুর হাতে দিয়া বলিল – সেই বাঙালবাবু আসিতেছেন। বেণী বাবু উঠিয়া দেখিলেন বরদাপ্রসাদবাবু ছড়ি হাতে করিয়া ব্যস্ত হইয়া আসিতেছেন – অমনি বেণীবাবু ও বেচারাম বাবু উঠিয়া অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন – পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসা হইলে পর বরদাবাবু বলিলেন – এদিকে তো যা হবার তা হয়ে গেল সম্প্রতি আমার একটি নিবেদন আছে – বৈদ্যবাটীতে আমি বহুকালাবধি আছি – একারণ সাধ্যানুসারে সেখানকার লোকদিগের তত্ত্ব লওয়া আমার কর্তব্য – আমার অধিক ধন নাই বটে কিন্তু আমি যেমন মানুষ বিবেচনা করলে পরমেশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছে, আমি অধিক আশা করিলে কেবল তাঁহার সুবিচারের উপর দোষারোপ করা হয় – এ কর্ম মানবগণের উচিত নহে। যদিও প্রতিবেশীদের তত্ত্ব লওয়া আমার কর্তব্য কিন্তু আমার আলস্য ও দুরদৃষ্টবশত ঐ কর্ম আমা হইতে সম্যক্ রূপে নির্বাহ হয় নাই। এক্ষণে –
বেচারাম। এ কেমন কথা। বৈদ্যবাটীর যাবতীয় দুঃখী প্রাণী লোককে তুমি নানা প্রকারে সাহায্য করিয়াছ – কি খাদ্য দ্রব্যে – কি বস্ত্রে – কি অর্থে – কি ঔষধে – কি পুস্তকে – কি পরামর্শে – কি পরিশ্রমে, কোনো অংশ ক্রটি করো নাই। ভায়া! তোমার গুণকীর্তনে তাহাদিগের অশ্রুপাত হয় – আমি এ সব ভাল জানি – আমার নিকট ভাঁড়াও কেন?
বরদা। আজ্ঞে না ভাঁড়াই নাই – মহাশয়কে স্বরূপ বলিতেছি, আমা হইতে কাহারো যদি সাহায্য হইয়া থাকে তাহা এত অল্প যে স্মরণ করিলে মনের মধ্যে ধিক্কার জন্মে। সে যা হউক, এখন আমার নিবেদন এই মতিলালের ও ঠকচাচার পরিবারেরা অন্নাভাবে মারা যায় – শুনিতে পাই তাহাদের উপবাসে দিন যাইতেছে, এ কথা শুনিয়া বড় দুঃখ হইল, এজন্য আমার নিকট যে দুই শত টাকা ছিল তাহা আনিয়াছি। আপনারা আমার নাম না প্রকাশ করিয়া কোনো কৌশলে এই টাকা পাঠাইয়া দিলে আমি বড় আপ্যায়িত হইব।
এই কথা শুনিয়া বেণীবাবু নিস্তব্ধ হইয়া থাকিলেন। বেচারাম বাবু ক্ষণেক কাল পরে বরদাবাবুর দিকে দৃষ্টি করিয়া ভক্তিভাবে নয়নবারিতে পরিপূর্ণ হওত তাঁহার গলায় হাত দিয়া বলিলেন – ভাই হে! ধর্ম যে কি পদার্থ, তুমিই তাহা চিনেছ – আমাদের বৃথা কাল গেল – বেদে ও পুরাণে লেখে যাহার চিত্ত শুদ্ধ সে-ই পরমেশ্বরকে দেখিতে পায় – তোমার যেমন মন পরেমশ্বর তোমাকে তেমনি সুখে রাখুন। তবে রামলালের সংবাদ কিছু পাইয়াছ?
বরদা। কয়েক মাস হইল হরিদ্বার হইতে এক পত্র পাইয়াছি – তিনি ভাল আছেন – প্রত্যাগমনের কথা কিছুই লেখেন নাই।
বেচারাম। রামলাল ছেলেটি বড় ভাল – তাকে দেখলে চক্ষু জুড়ায় – অবশ্য তার ভাল হবে – তোমার সংসর্গের গুণে সে তরে গিয়েছে।
এখানে ঠকচাচা ও বাহুল্য জাহাজে চড়িয়া সাগর পার হইয়া চলিয়াছে। দুটিতে মানিকজোড়ের মতো, এক জায়গায় বসে – এক জায়গায় খায় – এক জায়গায় শোয়, সর্বদা পরস্পরের দুঃখের কথা বলাবলি করে। ঠকচাচা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলে – মোদের নসিব বড় বুরা – মোরা একেবারে মেটি হলুম – ফিকির কিছু বেরোয় না, মোর শির থেকে মতলব পেলিয়া গেছে – মোকান বি গেল – বিবি সাথে বি মোলাকাত হল না – মোর বড় ডর তেনা বি পেল্টে শাদি করে।
বাহুল্য বলিল – দোস্ত! ওসব বাত দেল থেকে তফাত করো – দুনিয়াদারি মুসাফিরি – সেরেফ আনা যানা – কোই কিসিকা নেহি – তোমার এক কবিলা, মোর চেট্টে – সব জাহানম্মে ডাল দাও, আবি মোদের কি ফিকিরে বেহতর হয় তার তদ্বির দেখো।
বাতাস হু হু বহিতেছে, জাহাজ একপেশে হইয়া চলিয়াছে, তুফান ভয়নক হইয়া উঠিল। ঠকচাচা ত্রাসে কম্পিতকলেবর হইয়া বলিতেছেন – দোস্ত! মোর বড় ডর মালুম হচ্ছে, আন্দাজ হয় মোর মৌত নজদিগ।
বাহুল্য বলিল – মোদের মৌতের বাকি কি? মোরা মেম্দো হয়ে আছি চলো মোরা নীচু গিয়া আল্লামির দেবাচা পড়ি – মোর বেলকুল নেকজাবান আছে যদি ডুবি তো পীরের নাম নিয়ে চেল্লাব।
আলালের ঘরের দুলাল
২৯. বৈদ্যবাটির বাটী দখল লওন – বাঞ্ছারামের কুব্যবহার – পরিবারদিগের দুঃখ ও বাটী হইতে বহিষ্কৃত হওন – বরদাবাবুর দয়া।
বাঞ্ছারামবাবুর ক্ষুধা কিছুতেই নিবৃত হয় নয়া – সর্বক্ষণ কেবল দাঁও মারিবার ফিকির দেখেন এবং কিরূপ পাকচক্র করিলে আপনার ইষ্ট সিদ্ধ হইতে পারে তাহাই সর্বদা মনের মধ্যে তোলপাড় করেন। এইরূপ করাতে তাঁহার ধূর্ত বুদ্ধি ক্রমে প্রখর হইয়া উঠিল। বাবুরাম ঘটিত ব্যাপারে সকল উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে হঠাৎ এক সুন্দর উপায় বাহির হইল। তিনি তাকিয়া ঠেসান দিয়া বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে অনেকক্ষণ পরে আপনার উরুর উপর করাঘাত করিয়া আপনা আপনি বলিলেন – এই তো দিব্য রোজগারের পথ দেখিতেছি – বাবুরামের চীনেবাজারের জায়গা ও ভদ্রাসান বাটী বন্ধক আছে, তাহার মেয়াদ শেষ হইয়াছে – হেরম্ববাবুকে বলিয়া আদালতে একটা নালিশ উপস্থিত করাই, তাহা হইলেই কিছুদিনের জন্যে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হইতে পারিবে, এই বলিয়া চাদরখানা কাঁধে দিলেন এবং গঙ্গা দর্শন করিয়া আসি বলিয়া জুতা ফটাস্ ফটাস্ করিয়া মন্ত্রের সাধন কি শরীর পতন, এইরূপ স্থির ভাবে হেরম্ববাবুর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দ্বারে প্রবেশ করিয়াই চাকরকে জিজ্ঞাসা করিলেন – কর্তা কোথা রে? বাঞ্ছারামের স্বর শুনিয়া হেরম্ববাবু অমনি নামিয়া আসিলেন – হেরম্ববাবু সাদাসিধে লোক – সকল কথাতেই “হ্যাঁ” বলিয়া উত্তর দেন। বাঞ্ছারাম তাঁহার হাত ধরিয়া অতিশয় প্রণয়ভাবে বলিলেন – চৌধুরী মহাশয়! বাবুরামকে আপনি আমার কথায় টাকা কর্জ দেন – তাহার সংসার ও বিষয়-আশয় ছারখার হইয়া গেল – মান-সম্ভ্রমও তাহার সঙ্গে গিয়াছে – বড় ছেলেটা বানর ছোটটা পাগল, দু-টোই নিরুদ্দেশ হইয়াছে, এক্ষণে দেনা অনেক – অন্যান্য পাওনাওয়ালারা নালিশ করিতে উদ্যত – পরে নানা উৎপাত বাধিতে পারে অতএব আপনাকে আর আমি চুপ করিয়া থাকিতে বলিতে পারি না – আপনি মারগেজি কাগজগুলা দিউন – কালিই আমাদের আপিসে নালিশটি দাগিয়া দিতে হইবেক – আপনি কেবল একখানা ওকালতনামা সহি করিয়া দিবেন। পাছে টাকা ডুবে এই ভয় – এ অবস্থায় সকলেরই হইয়া থাকে – হেরম্ববাবু খল-কপট নহেন, সুতরাং বাঞ্ছারামের উক্ত কথা তাঁহার মনে একেবারে চৌচাপটে লেগে গেল, অমনি “হ্যাঁ” বলিয়া কাগজপত্র তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। হনুমান যেমন রাবণের মৃত্যুবাণ পাইয়া আহ্লাদে লঙ্কা হইতে মহাবেগে আসিয়াছিল, বাঞ্ছারামও ঐ সকল কাগজপত্র ইষ্ট কবজের ন্যায় বগলে করিয়া সেইরূপ ত্বরায় সহর্ষে বাটী আসিলেন।
প্রায় সম্বৎসর হয় – বৈদ্যবাটীর সদর দরওয়াজা বন্ধ – ছাত দেওয়াল ও প্রাচীর শেওলায় মলিন হইল – চারিদিকে অসংখ্য বন – কাঁটানটে ও শেয়ালকাঁটায় ভরিয়া গেল। বাটির ভিতরে মতিলালের বিমাতা ও স্ত্রী এই দুইটি অবলামাত্র বাস করেন, তাঁহারা আবশ্যকমতে খিড়কি দিয়া বাহির হয়েন। অতি কষ্টে তাঁহাদের দিনপাত হয় – অঙ্গে মলিন বস্ত্র – মাসের মধ্যে পনের দিন অনাহারে যায় – বেণীবাবুর দ্বারা যে টাকা পাইয়াছিলেন তাহা দেনা পরিশোধ ও কয়েক মাসের খরচেই ফুরাইয়া গিয়াছে সুতরাং এক্ষণে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইতেছেন ও নিরুপায় হইয়া ভাবিতেছেন।
মতিলালের স্ত্রী বলিতেছেন – ঠাক্রুন! আমরা আর জন্মে কতই পাপ করেছিলাম তাহা বলিতে পারি না – বিবাহ হইয়াছে বটে কিন্তু স্বামীর মুখ কখনও দেখিলাম না – স্বামী একবারও ফিরে দেখেন না – বেঁচে আছি কি মরেছি তাহাও একবার জিজ্ঞাসা করেন না – স্বামী মন্দ হইলেও তাঁহার নিন্দা করা স্ত্রীলোকের কর্তব্য নহে – আমি স্বামীর নিন্দা করি না – আমার কপাল পোড়া, তাঁহার দোষ কি? কেবল এইমাত্র বলি এক্ষণে যে ক্লেশ পাইতেছি স্বামী নিকটে থাকিলে এ ক্লেশ ক্লেশ বোধ হইত না। মতিলালের বিমাতা বলিলেন – মা! আমাদের মতো দুঃখিনী আর নাই – দুঃখের কথা বলতে গেলে বুক ফেটে যায় – দীন-হীনদের দীননাথ বিনা আর গতি নাই।
লোকের যাবৎ অর্থ থাকে তাবৎ চাকর দাসী নিকটে থাকে, ঐ দুই অবলার ঐরূপ অবস্থা হইলে সকলেই চলিয়া গিয়াছিল, মমতাবশত একজন প্রাচীনা দাসী নিকটে থাকিত – সে আপনি ভিক্ষাশিক্ষা করিয়া দিনপাত করিত। শাশুড়ী বৌয়ে ঐরূপ কথাবার্তা হইতেছে এমতো সময়ে ঐ দাসী থর্ থর্ করে কাঁপতে কাঁপতে আসিয়া বলিল – অগো মাঠাকরুনরা! জানালা দিয়া দেখো – বাঞ্ছারামবাবু সার্জন ও পেয়াদা সঙ্গে করিয়া বাড়ি ঘিরে ফেলেছেন – আমাকে দেখে বললেন – মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বল্। আমি বললুম – মোশাই! তাঁরা কোথায় যাবেন? অমনি চোক লাল করে আমার উপর হুমকে বল্লেন – তারা জানে না এ বাড়ি বন্ধক আছে – পাওনাওয়ালা কি আপনার টাকা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে? ভাল চায় তো এই বেলা বেরুক তা না হলে গলাটিপি দিয়া বার করে দিব। এই কথা শুনিবা মাত্র শাশুড়ী-বৌয়ে ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। এদিকে সদর দরওয়াজা ভাঙ্গিবার শব্দে বাড়ি পরিপূর্ণ হইল, রাস্তায় লোকারণ্য, বাঞ্ছারাম আস্ফালন করিয়া “ভাং ডাল ভাং ডাল” হুকুম দিতেছেন ও হাত নেড়ে বলতেছেন – কার সাধ্য দখল লওয়া বন্ধ করিতে পারে – এ কি ছেলের হাতের পিটে? কোর্টের হুকুম এখনি বাড়ি ভেঙ্গে দখল লব – ভাল মানুষ টাকা কর্জ দিয়া কি চোর? এ কি অন্যায়? পরিবারেরা এখনি বেরিয়ে যাউক। অনেক লোক জমা হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে দুই ব্যক্তি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিল – ওরে বাঞ্ছারাম! তোর বাড়া নরাধম আর নাই – তোর মন্ত্রণায় এ ঘরটা গেল – চিরকালটা জুয়াচুরি করে এ সংসার থেকে রাশ রাশ টাকা লয়েছিস – এক্ষণে পরিবারগুলোকে আবার পথে বসাইতে বসেছিস – তোর মুখ দেখলেও চান্দ্রায়ণ করিতে হয় – তোর নরকেও ঠাঁই হবে না। বাঞ্ছারাম এ সব কথায় কান না দিয়া দরওয়াজা ভাঙ্গিয়া সার্জন সহিত বাড়ির ভিতর হুরমুড় করিয়া প্রবেশ করত অন্তঃপুরে গমন করেন – এমন সময়ে মতিলালের বিমাতা ও স্ত্রী দুইজনে ঐ প্রাচীনা দাসীর দুই হাত ধরিয়া হে পরমেশ্বর! অবলা দুঃখিনী নারীদের রক্ষা করো, এই বলিতে বলিতে চক্ষের জল পুঁছিতে পুঁছিতে খিড়কি দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। মতিলালের স্ত্রী বলিলেন – মাগো! আমরা কুলের কামিনী – কিছুই জানি না – কোথায় যাইব? পিতা সবংশে গিয়াছেন – ভাই নাই – বোন নাই – কুটুম্ব নাই – আমাদের কে রক্ষা করিবে? হে পরমেশ্বর! এখন আমাদের ধর্ম ও জীবন তোমার হাতে – অনাহারে মরি সেও ভাল, যেন ধর্ম নষ্ট হয় না। অনন্তর পাঁচ-সাত পা গিয়া একটি বৃক্ষের তলায় দাঁড়াইয়া ভাবিতেছেন, ইতিমধ্যে একখানা ডুলি সঙ্গে বরদাপ্রসাদবাবু ঘাড় নত করিয়া ম্লানবদনে সম্মুখে আসিয়া বলিলেন – ওগো! তোমরা কাতর হইও না, আমাকে সন্তানস্বরূপ দেখো – তোমাদের নিকট আমার ভিক্ষা যে ত্বরায় এই ডুলিতে উঠিয়া আমার বাটীতে চলো – তোমাদিগের নিমিত্তে আমি স্বতন্ত্র ঘর প্রস্তত করিয়াছি – সেখানে কিছুদিন অবস্থিতি করো, পরে উপায় করা যাইবে। বরদাবাবুর এই কথা শুনিয়া মতিলালের স্ত্রী ও বিমাতা যেন সমুদ্রে পড়িয়া কূল পাইলেন। কৃতজ্ঞতায় মগ্ন হইয়া বলিলেন, – বাবা! আমাদিগের ইচ্ছা হয় তোমার পদতলে পড়িয়া থাকি – এ সময় এমতো কথা কে বলে? বোধ হয় তুমি আর জন্মে আমাদিগের পিতা ছিলে। বরদাবাবু তাঁহাদিগকে ত্বরায় সোয়ারিতে উঠাইয়া আপন গৃহে পাঠাইয়া দিলেন। অন্যের সহিত দেখা হইলে তাহারা পাছে একথা জিজ্ঞসা করে এজন্য গলি-ঘুঁজি দিয়া আপনি শীঘ্র বাটী আইলেন।
আলালের ঘরের দুলাল
৩০. মতিলালের বারাণসী গমন ও সৎসঙ্গ লাভে চিত্তশোধন। তাহার মাতা ও ভগনীর দুঃখ, রামলাল ও বারদাবাবুর সহিত সাক্ষাৎ—পরে তাহাদের মতিলালের সঙ্গে দেখা, পথে ভয় ও বৈদ্যবাটীতে প্রত্যাগমন।
সদুপদেশ ও সৎসঙ্গে সুমতি জন্মে, কাহারো অল্প বয়সে হয় – কাহারো অধিক বয়সে হইয়া থাকে। অল্প বয়সে সুমতি না হইলে বড় প্রমাদ ঘটে – যেমন বনে অগ্নি লাগিলে হু হু করিয়া দিগদাহ করে অথবা প্রবল বায়ু উঠিলে একেবারে বেগে গমন করত বৃক্ষ অট্টালিকাদি ছিন্নানি করিয়া ফেলে সেইরূপ শৈশবাবস্থায় দুর্মতি জন্মিলে ক্রমশ রক্তের তেজে সতেজ হওয়াতে ভয়ানক হইয়া উঠে। এ বিষয়ের ভুরি ভুরি নিদর্শন সদাই দেখা যায়। কিন্তু কোনো কোনো ব্যক্তি কিয়াৎকাল দুর্মতি ও অসৎ কর্মে রত থাকিয়া অধিক বয়সে হঠাৎ ধার্মিক হইয়া উঠে, ইহাও দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপ পরিবর্তনের মূল সদুপদেশ বা সৎসঙ্গ। পরন্তু কাহারো দৈবাৎ কাহারো বা কোনো ঘটনায় কাহারো বা একটি কথাতেই কখন কখন হঠাৎ চেতনা হইয়া থাকে – এরূপ পরিবর্তন অতি অসাধারণ।
মতিলাল যশোহর হইতে নিরাশ হইয়া আসিয়া সঙ্গীদিগকে বলিলেন – আমার কপালে ধন অন্বেষণ করা বৃথা, এক্ষণে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কিছু দিনের জন্য ভ্রমণ করিয়া আসি – তোমরা কেহ আমার সঙ্গে যাবে? সকলেই লক্ষ্মীর বরযাত্রী – অর্থ হাতে থাকিলে কাহাকেও ডাকিতে হয় না – অনেকে আপনা আপনি আসিয়া জুটে যায় কিন্তু অর্থাভাব হইলে সঙ্গী পাওয়া ভার। মতিলালের নিকট যাহারা থাকিত, তাহারা আমোদ-প্রমোদ ও অর্থের অনুরোধে আত্মীয়তা দেখাত – বস্তুত মতিলালের প্রতি তাহাদের কিছুমাত্র আন্তরিক স্নেহ ছিল না। তাহারা যখন দেখিল যে তাহার কোনো যোত্র নাই – চতুর্দিকে দেনা, বাবুয়ানা করা দূরে থাকুক আহারাদিও চলা ভার, তখন মনে করিল উহার সঙ্গে প্রণয় রাখার কি ফল? এক্ষণে ছট্কে পড়া শ্রেয়। মতিলাল ঐ প্রকার প্রশ্ন করিয়া দেখিলেন কেহই কোনো উত্তর দেয় না। সকলেই ঢোঁক গিলিয়া এঁ ওঁ করিয়া নানা ওজর ও অন্যান্য বরাতের কথা ফেলে। তাহাদিগের ব্যবহারে মতিলাল বিরক্ত হইয়া বলিলেন – বিপদেই বন্ধু টের পাওয়া যায়, এতদিনের পর আমি তোমাদিগকে চিনলাম – যাহা হউক এক্ষণে তোমরা আপন আপন বাটী যাও, আমি দেশ ভ্রমণে চলিলাম। সঙ্গীরা বলিল – বড়বাবু! রাগ করিও না – আপনি বরং আগু হউন আমরা আপন আপন বরাত মিটাইয়া পশ্চাৎ জুট্ব। মতিলাল তাহাদের কথায় আর কান না দিয়া পদব্রজে চলিলেন এবং স্থানে স্থানে অতিথি হইয়া ও ভিক্ষা মাঙিয়া তিন মাসের পর বারাণসীতে উত্তরিলেন। এই প্রকার দুরবস্থায় পড়িয়া ক্রমাগত একাকী চিন্তা করাতে তাঁহার মনের গতি বিভিন্ন হইতে লাগিল। বহু ব্যয়ে নির্মিত মন্দির, ঘাট ও অট্টালিকা ভগ্ন হইয়া যাবার উপক্রম হইতেছে – বহু বহু শাখায় বিস্তীর্ণ তেজস্বী প্রাচীন বৃক্ষের জীর্ণাবস্থা দৃষ্ট হইল – নদ-নদী, গিরি-গুহার অবস্থা চিরকাল সমান থাকে না – ফলত কালেতে সকলেরই পরিবর্তন ও ক্ষয় হইয়া থাকে – সকলই অনিত্য – সকলই অসার। মানবগণও রোগ, জরা, বিয়োগ, শোক ও নানা দুঃখে অভিভূত ও সংসারে মদ মাৎসর্য ও আমোদ সকলই জলবিম্ববৎ। মতিলাল ঐ সকল ধ্যান করিয়া প্রতিদিন বারাণসী ধামের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করত বৈকালে গঙ্গাতীরস্থ এক নির্জন স্থানে বসিয়া দেহের অসারত্ব, আত্মার সারত্ব, এবং আপন চরিত্র ও কর্মাদি পুনঃ পুনঃ চিন্তা করিতে লাগিলেন। এইরূপ চিন্তা করাতে তাঁহার তমঃ খর্ব হইতে লাগিল সুতরাং আপনার পূর্ব কর্মাদি ও উপস্থিত দুর্মতি প্রভৃতি জাগরূক হইয়া উঠিল। মনের এবম্প্রকার গতি হওয়াতে তাঁহার আপনার প্রতি ধিক্কার জন্মিল এবং ঐ ধিক্কারে অত্যন্ত সন্তাপ হইতে লাগিল। তখন আপনাকে সর্বদা এই জিজ্ঞাসা করিতেন – আমার পরিত্রাণ কিরূপে হইতে পারে – আমি যে কুকর্ম করিয়াছি তাহা স্মরণ করিলে এখনও হৃদয় দাবানলের ন্যায় জ্বালিয়া উঠে। এইরূপ ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন – আহারাদি ও পরিধেয় বস্ত্রাদির প্রতি দৃক্পাতও নাই – ক্ষিপ্তপ্রায় ভ্রমণ করিয়া বেড়ান। কিছুকাল এই প্রকারে ক্ষেপণ হইলে দৈবাৎ এক দিবস দেখিলেন একজন প্রাচীন পুরুষ তরুতলে বসিয়া মনঃসংযোগ পূর্বক এক একবার একখানি গ্রন্থ দেখিতেছেন ও এক একবার চক্ষু মুদিত করিয়া ধ্যান করিতেছেন। ঐ ব্যক্তিকে দেখিলে হঠাৎ বোধ হয় সে বহুদর্শী – জ্ঞানের সারাংশ গ্রহণ এবং মনঃসংযম বিলক্ষণ হইয়াছে। তাঁহার মুখ দর্শন করিলে তৎক্ষণাৎ ভক্তির উদয় হয়। মতিলাল তাঁহাকে দেখিবামাত্রে নিকটে যাইয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলেন। কিয়ৎকাল পরে ঐ প্রাচীন পুরুষ মতিলালের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন – বাবা! তোমার আকার প্রকারে বোধ হয় তুমি ভদ্র সন্তান – কিন্তু এমতো সন্তাপিত হইয়াছ কেন? এই মিষ্ট কথায় উৎসাহ পাইয়া, মতিলাল অকপটে আনুপূর্বিক আপন পরিচয় দিয়া কহিলেন – মহাশয়! আপনাকে অতি বিজ্ঞ দেখিতেছি – আমি আপনার দাস হইলাম – আমাকে কিঞ্চিৎ সদুপদেশ দিউন। সেই প্রাচীন পুরুষ মতিলালের সরল চিত্ত দেখিয়া তুষ্ট হইলেন। মানব স্বভাব এই যে পরস্পরের প্রতি সন্তোষ না জন্মিলে মন খোলাখুলি হয় না, প্রথম আলাপেই যদি এমতো তুষ্টি জন্মে তাহা হইলে পরস্পরের মনের কথা শীঘ্রই ব্যক্ত হয়, আর একজন সারল্য প্রকাশ করিলে অন্য ব্যক্তি অতিশয় কপট না হইলে কখনই কপটতা প্রকাশ করিতে পারে না। ঐ প্রাচীন পুরুষ অতি ধার্মিক, মতিলালের সরলতায় তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতে লাগিলেন। অনন্তর পারমার্থিক বিষয়ে তাঁহার যে অভিপ্রায় ছিল তাহা ক্রমশঃ ব্যক্ত করিলেন। তিনি বারম্বার বলিলেন – বাবা! সকল ধর্মের তাৎপর্য এই কায়মনোচিত্তে ভক্তি-স্নেহ ও প্রেম প্রকাশপূর্বক পরমেশ্বরের উপসনা করা, এই কথাটি সর্বদা ধ্যান করো ও মন, বাক্য ও কর্ম দ্বারা অভ্যাস করো। এই উপদেশটি তোমার মনে দৃঢ়রূপে বদ্ধমূল হইলেই মনের গতি একেবারে ফিরিয়া যাবে, তখন অন্যান্য ধর্ম অনুষ্ঠান আপনা আপনি হইবে কিন্তু পরমেশ্বরের প্রেমার্থ মনের দ্বারা, বাক্যের দ্বারা ও কর্মের দ্বারা সদা একরূপ থাকা অতি কঠিন – সংসারে রাগ, দ্বেষ, লোভ, মোহ ইত্যাদি রিপু সকল বিজাতীয় ব্যাঘাত করে এজন্য একাগ্রতা ও দৃঢ়তার অত্যন্ত আবশ্যক। মতিলাল উক্ত উপদেশ গ্রহণপূর্বক মনের সহিত প্রতিদিন পরমেশ্বরের ধ্যান ও উপাসনায় রত এবং আত্মদোষানুসন্ধানে ও শোধনে সযত্ন হইলেন। কিছুকাল এইরূপ করাতে তাঁহার মনোমধ্যে জগদীশ্বরের প্রতি ভক্তির উদয় হইল। সাধুসঙ্গের কী অনির্বচনীয় মাহাত্ম্য। যিনি মতিলালের উপদেশক, তিনি ধার্মিক চূড়ামণি, তাঁহার সহবাসে মতিলালের যে এমন মতি হইবে ইহা কোন্ বিচিত্র।
পরমেশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি হওয়াতে যাবতীয় মনুষ্যের প্রতি মতিলালের মনে ভ্রাতৃবৎ ভাব জন্মিল – তখন পিতা-মাতা ও পরিবারের প্রতি স্নেহ, পরদুঃখ মোচন ও পরহিতার্থ বাসনা উত্তরোত্তর প্রবল হইতে লাগিল। সত্য ও সরলতার বিপরীত দর্শন অথবা শ্রবণ হইলেই বিজাতীয় অসুখ হইত। মতিলাল আপন মনের ভাব ও পূর্ব কথা সর্বদাই ঐ প্রচীন পুরুষের নিকট বলিতেন ও মধ্যে মধ্যে খেদ করিয়া কহিতেন – গুরো! আমি অতি দুরাত্মা, পিতা, মাতা, ভাই, ভগিনী ও অন্যান্য লোকের প্রতি যে প্রকার ব্যবহার করিয়াছি তাহাতে নরকেও যে আমার স্থান হয় এমন বোধ হয় না। ঐ প্রাচীন পুরুষ সান্ত্বনা করিয়া বলিতেন – বাবা! তুমি প্রাণপণে সদভ্যাসে রত থাকো – মনুষ্য মাত্রেই মনোজ, বাক্যজ ও কর্মজ পাপ করিয়া থাকে, পরিত্রাণের ভরসা কেবল সেই দয়াময়ের দয়া – যে ব্যক্তি আপন পাপ জন্য অন্তঃকরণের সহিত সন্তাপিত হইয়া আত্মশোধনার্থ প্রকৃতরূপে যত্নশীল হয় তাহার কদাপি মার নাই। মতিলাল এ সকল শুনেন ও অধোবদন হইয়া ভাবেন এবং সময়ে সময়ে বলেন আমার মা, বিমাতা, ভগিনী, ভ্রাতা, স্ত্রী – ইঁহারা কোথায় গেলেন? ইঁহাদের জন্য মন উচাটন হইতেছে।
শরতের আবির্ভাব – ত্রিযামা অবসান – বৃন্দাবনের কিবা শোভা! চারিদিকে তাল, তমাল, শাল, পিয়াল, বকুল আদি নানাজাতি বৃক্ষ – তদুপরি সহস্র সহস্র পক্ষী নানা রবে গান করিতেছে – বায়ু মন্দ মন্দ বহিতেছে – যমুনার তরঙ্গ যেন রঙ্গচ্ছলে পুলিনের একাঙ্গ হইতেছে – ব্রজবালক ও ব্রজবালিকারা কুঞ্জে কুঞ্জে পথে পথে বীণা বাজাইয়া ভজন গাইতেছে। নিশাবসানে দেবালয় সকলে মঙ্গলারতির সময় সহস্র সহস্র শঙ্খ-ঘণ্টার ধ্বনি হইতেছে। কেশী ঘাটে কচ্ছপ সকল কিল্বিল্ করিতেছে – বৃক্ষাদির উপরে লক্ষ লক্ষ বানর উল্লম্ফন প্রোল্লম্ফন করিতেছে – কখন লাঙ্গুল জড়ায় – কখন প্রসারণ করে – কখন বিকট বদন প্রদর্শনপূর্বক ঝুপ করিয়া পড়িয়া লোকের খাদ্য সামগ্রী কাড়িয়া লয়।
নানা বনে শত শত তীর্থযাত্রী পরিক্রমণ করিতেছে – নানা স্থান দর্শন করিয়া শ্রীকৃষ্ণের নানা লীলার কথা কহিতেছে। এদিকে প্রখর রবি – মৃত্তিকা উত্তপ্ত – পদব্রাজে যাওয়া অতি কঠিন, এ কারণ অনেক যাত্রী স্থানে স্থানে বৃক্ষতলে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে। মতিলালের মাতা কন্যার হাত ধরিয়া ভ্রমণ করিতেছিলেন, অত্যন্ত শ্রান্তিযুক্ত হওয়াতে একটি নির্জন স্থানে বসিয়া কন্যার ক্রোড়ে মস্তক রাখিয়া শয়ন করিলেন। কন্যা আপন অঞ্চল দিয়া আক্লান্ত মাতার ঘর্ম মুছিয়া বাতাস করিতে লাগিল। মাতা কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধ হইয়া বলিলেন – প্রমদা! বাছা তুই একটু বিশ্রাম কর – আমি উঠে বসি। কন্যা উত্তর করিল – মা! তোমার শ্রান্তি দূর হওয়াতেই আমার শ্রান্তি গিয়াছে – তুমি শুয়ে থাকো আমি তোমার দু-টি পায়ে হাত বুলাই। কন্যার এইরূপ সস্নেহ বাক্য শুনিয়া মাতা সজল নয়নে বলিলেন – বাছা! তোর মুখ দেখেই বেঁচে আছি – জন্মান্তরে কত পাপ করেছিলাম, তা না হলে এত দুঃখ কেন হবে? আপনি অনাহারে মরি তাতে খেদ নাই, তোকে এক মুটা খাওয়াই এমন সঙ্গতি নাই – এই আমার বড় দুঃখ! এ দুঃখ রাখবার কি ঠাঁই আছে? আমার দু-টি পুত্র কোথায়? বৌটি বা কেমন আছে? কেনই বা রাগ করে এলাম? মতি আমাকে মেরেছিল – মেরেই ছিল, ছেলেতে আবদার করে কি-না বলে – কি-না করে? এখন তার আর রামের জন্যে আমার প্রাণ সর্বদাই ধড়ফড় করে। কন্যা মাতার চক্ষের জল মুছাইয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে মাতার একটু তন্দ্রা হইল। কন্যা মাতাকে নিদ্রিত দেখিয়া সুস্থির হইয়া বসিয়া একটু একটু বাতাস দিতে আরম্ভ করিল। দুহিতার শরীরে মশা ও ডাঁশ বসিয়া কামড়াইতে লাগিল কিন্তু পাছে মায়ের নিদ্রা ভঙ্গ হয় এজন্য তিনি স্থির হইয়া থাকিলেন। স্ত্রীলোকেদের স্নেহ ও সহিষ্ণুতা আশ্চর্য! বোধ হয় পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোক এ বিষয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ। মাতা নিদ্রাবস্থায় স্বপ্ন দেখিতেছেন যেন একটি পীতবসন নবকিশোর তাঁহার নিকটে আসিয়া বলিতেছেন – ”মা! তুই আর কাঁদিস্ না – তুই বড় পুণ্যবতী – অনেক দুঃখী-কাঙালীর দুঃখ নিবারণ করিয়াছিস – তুই কাহারো ভাল বই কখন মন্দ করিস নাই। – তোর শীঘ্র ভাল হবে – তুই দুই পুত্র পাইয়া সুখী হইবি।” দুঃখিনী মাতা চমকিয়া উঠিয়া চক্ষুউন্মীলন করিয়া দেখেন কেবল কন্যা নিকটে আছে আর কেহই নাই। পরে কন্যাকে কিছু না বলিয়া তাহার হস্ত ধারণপূর্বক বহু ক্লেশে আপনাদের কুঞ্জে প্রত্যাগমন করিলেন।
মায়ে-ঝিয়ে সর্বদা কথোপকথন হয় – মা বলেন, বাছা! মন বড় চঞ্চল হইতেছে, বাড়ি যাব সর্বদা এই ভাবতেছি। কন্যা কিছুই উপায় না দেখিয়া বলিল – মা! আমাদিগের সম্বলের মধ্যে দুই-একখানি কাপড় ও জল খাবার ঘটিটি আছে – ইহা বিক্রয় করিলে কি হতে পারবে? কিছু দিন স্থির হও আমি রাঁধুনী অথবা দাসীর কর্ম করিয়া কিছু সঞ্চয় করি তাহা হইলেই আমাদের পথ খরচের সংস্থান হইবে। মা এ কথা শুনিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া নিস্তব্ধ থাকিলেন, চক্ষের জল আর রাখিতে পারিলেন না। মাতাকে কাতর দেখিয়া কন্যাও কাতর হইল। নিকটে একজন ব্রজবাসিনী থাকিতেন, তিনি সর্বদা তাহাদিগের তত্ত্ব লইতেন, দৈবাৎ ঐ সময়ে আসিয়া তাহাদিগকে দুঃখিত দেখিয়া সান্ত্বনা করণানন্তর সকল বৃত্তান্ত শুনিলেন। তাহাদিগের দুঃখে দুঃখিত হইয়া সেই ব্রজবাসিনী বলিলেন – মায়ী! কি বলব আমার হাতে কড়ি নাই – আমার ইচ্ছা হয় সর্বস্ব দিয়া তোমাদের দুঃখ মোচন করি, এখন একটি উপায় বলে দি তোমরা তাই করো। শুনিতে পাই এক বাঙালী বাবু চাকরি ও তেজারতের দ্বারা কিছু বিষয় করিয়া মথুরায় আসিয়া বাস করিতেছেন – তিনি বড় দয়ালু ও দাতা, তোমরা তাঁর কাছে গিয়া পথ খরচ চাহিলে অবশ্যই পাইবে। দুঃখিনী মাতা ও কন্যা অন্য কোনো উপায় না দেখাতে প্রস্তাবিত উপায়ই অবলম্বন করিতে বাধ্য হইলেন। তাঁহারা ব্রজবাসিনীর নিকট বিদায় লইয়া দুই দিনের মধ্যে মথুরায় উপস্থিত হইলেন। সেখানে এক সরোবরের নিকটে যাইয়া দেখেন কতকগুলিন আতুর, অন্ধ, ভগ্নাঙ্গ, দুঃখী, দরিদ্র লোক একত্র বসিয়া রোদন করিতেছে। মাতা তাহাদিগের মধ্যে একজন প্রাচীনা স্ত্রীলোককে জিজ্ঞাসা করিলেন – বাছা! তোমরা কাঁদিতেছ কেন? ঐ স্ত্রীলোক বলিল – মা! এখানে এক বাবু আছেন তাঁহার গুণের কথা কি বলিব? তিনি গরীব দুঃখীর বাড়ি বাড়ি ফিরিয়া তাহাদের খাওয়া-পরা দিয়া সর্বদা তত্ত্ব লয়েন আর কাহারো ব্যারাম হইলে আপনি তার শেওরে বসিয়া সারারাত্রি জাগিয়া ঔষধ-পথ্য দেন। তিনি আমাদের সকলের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী। সেই বাবুর গুণ মনে করতে গেলে চক্ষে জল আইসে – যে মেয়ে এমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করিয়াছেন তিনিই ধন্য – তাঁহার অবশ্যই স্বর্গ ভোগ হইবে – এমন লোক যেখানে বাস করেন সে স্থান পুণ্য স্থান। আমাদিগের পোড়া কপাল যে ঐ বাবু এখন এ দেশ হইতে চলিলেন – এর পর আমাদের দশা কি হবে তাই ভাবিয়া কাঁদছি। মাতা ও কন্যা এই কথা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিলেন – বোধ হয় আমাদিগের আশা নিষ্ফল হইল – কপালে দুঃখ আছে, ললাটের লিপি কে ঘুচাইবে? উক্ত প্রাচীনা তাহাদিগের বিষণ্ণ ভাব দেখিয়া বলিল, – আমার অনুমান হয় তোমারা ভদ্র ঘরের মেয়ে – ক্লেশে পড়িয়াছ। যদি কিছু টাকাকড়ি চাহ তবে এই বেলা আমার সঙ্গে ঐ বাবুর নিকটে যাবে চলো, তিনি গরীব-দুঃখী ছাড়া অনেক ভদ্রলোকেরও সাহায্য করেন। মাতা ও কন্যা তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন এবং সেই বৃদ্ধার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া আপনারা বাটীর বাহিরে থাকিলেন, বুড়ী ভিতরে গেল।
দিবা অবসান – সূর্য অস্ত হইতেছে – দিনকরের কিরণে বৃক্ষাদির ও সরোবরের বর্ণ সুবর্ণ হইতেছে। যেখানে মাতা ও কন্যা দাঁড়াইয়াছিলেন সেখানে একখানি ছোট উদ্যান ছিল। স্থানে স্থানে মেরাপে নানা প্রকার লতা, চারিদিকে কেয়ারি ও মধ্যে এক এক চবুতারা। ঐ বাগানের ভিতরে দুইজন ভদ্রলোক হাত ধরাধরি করিয়া কৃষ্ণার্জুনের ন্যায় বেড়াইতেছিল। দৈবাৎ ঐ দুই স্ত্রীলোকের প্রতি দৃষ্টিপাত হওয়াতে তাঁহারা ব্যস্তসমস্ত হইয়া বাগান হইতে বাহির হইয়া তাঁহাদিগের নিকট আসিলেন। মাতা ও কন্যা তাঁহাদিগকে দেখিয়া সঙ্কুচিত হইয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিয়া একটু অন্তরে দাঁড়াইলেন। ঐ দুইজন ভদ্রলোকের মধ্যে যাহার কম বয়েস তিনি কোমল বাক্যে বলিলেন – আপনারা আমাদিগকে সন্তানস্বরূপ বোধ করিবেন – লজ্জা করিবেন না – আপনারা কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন, আমাদিগের নিকট বিশেষ করিয়া বলুন, যদি আমাদিগের দ্বারা কোনো সাহায্য হইতে পারে আমরা তাহাতে কোনো প্রকার ক্রটি করিব না। এই কথা শুনিয়া মাতা কন্যার হাত ধরিয়া কিঞ্চিৎ অগ্রবর্তিনী হইয়া আপন অবস্থা সংক্ষেপে ব্যক্ত করিলেন। তাঁহার কথা সমাপ্ত হইতে না হইতে ঐ দুইজন ভদ্রলোক পরস্পর মুখাবলোকন করিয়া তাহাদিগের মধ্যে যাহার কম বয়েস তিনি একেবারে মায়াতে মুগ্ধ হইয়া মা মা বলিয়া ভূমিতে পড়িয়া গেলেন, অন্য আর একজন অধিকবয়স্ক ব্যক্তি দুঃখিনী মাতার চরণে প্রণাম করিয়া করজোড়ে বলিলেন – মা গো! দেখো কি? যে ভূমিতে পড়িয়াছে সে তোমার অঞ্চলের ধন – সে তোমার রাম, আমার নাম বরদাপ্রসাদ বিশ্বাস। মাতা এই কথা শুনিবামাত্রে মুখের কাপড় খুলিয়া বলিলেন – বাবা! তুমি কি বলিলে? এ অভাগিনীর কি এমন কপাল হবে? রামলাল চৈতন্য পাইয়া চরণে মস্তক দিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন, জননী পুত্রের মস্তক ক্রোড়ে রাখিয়া অশ্রুপাত করিতে করিতে তাহার মুখাবলোকন করিয়া আপন তাপিত মনে সান্তুনাবারি সেচন করিতে লাগিলেন ও ভগিনী আপন অঞ্চল দিয়া ভ্রাতার চক্ষের জল ও গায়ের ধূলা পুঁছাইয়া দিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। এদিকে ঐ বুড়ী বাটীর মধ্যে বাবুকে না পাইয়া তাড়াতাড়ি বাগানে আসিয়া দেখে যে বাবু তাহার সমভিব্যাহারিণী প্রাচীনা স্ত্রীলোকের কোলে মস্তক দিয়া ভূমে শয়ন করিয়া আছেন – ও মা এ কি গো! ওগো বাবুর কি ব্যারাম হয়েছে? আমি কি কবিরাজ ডেকে আনব? বুড়ী এই বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। বরদাপ্রসাদবাবু বলিলেন, স্থির হও – বাবুর পীড়া হয় নাই, এই যে দুইটি স্ত্রীলোক – এঁরা বাবুর মা ও ভগিনী। বুড়ী উত্তর করিল – বাবু! দুঃখী বলে কি ঠাট্টা করতে হয়? বাবু হলেন লক্ষপতি, আর এঁরা হল পথের কাঙালিনী – আমার সঙ্গে এসে কেও হলেন মা, কেও হলেন বোন। বোধ হয় এরা কামিখ্যার মেয়ে – ভেল্কিতে ভুলিয়েছে বাবা। এমন মেয়েমানুষ কখন দেখি না – এদের জাদুকে গড় করি মা! বুড়ী এইরূপ বকতে বকতে ত্যক্ত হইয়া চলিয়া গেল।
এখানে সকলে সুস্থির হইয়া বাটী আগমন করিলেন, তথায় পুত্রবধুকে ও সপত্নীকে দেখিয়া মাতার পরম সন্তোষ হইল, পরে আপনার আর আর পরিবারের কথা অবগত হইয়া বলিলেন, বাবা রাম! চলো, বাটী যাই – আমার মতি কোথায় – তার জন্য মন বড় অস্থির হইতেছে। রামলাল পূর্বেই বাটী যাওনের উদ্যোগ করিয়াছিলেন – নৌকাদি ঘাটে প্রস্তুত ছিল। মাতার আজ্ঞানুসারে উত্তম দিন দেখিয়া সকলকে লইয়া যাত্রা করিলেন – যাত্রাকালীন মথুরার যাবতীয় লোক ভেঙে পড়িল – সহস্র সহস্র চক্ষু বারিতে পরিপূর্ণ হইল – সহস্র সহস্র কর তাঁহার আশীর্বাদার্থ উত্থিত হইল। যে বুড়ী বিরক্ত হইয়াছিল সে জোড়হাত করিয়া রামলালের মাতার নিকট আসিয়া কাঁদিতে লাগিল, নৌকা যে পর্যন্ত দৃষ্টিপথ অতিক্রম না করিল সে পর্যন্ত সকলে যমুনার তীরে যেন প্রাণশূন্য দেহে দাঁড়াইয়া রহিল।
এদিকে একটানা – দক্ষিণে বায়ুর সঞ্চার নাই – নৌকা স্রোতের জোরে বেগে চলিয়া অল্প দিনের মধ্যেই বারাণসীতে আসিয়া উত্তীর্ণ হইল। বারাণসীর মধ্যে প্রাতঃকালীন কিবা শোভা। কত কত দোবেদী, চৌবেদী, রামাৎ, নেমাৎ, শৈব, শাক্ত, গাণপত্য, পরমহংস ও ব্রহ্মচারী স্তোত্র পাঠ করিতেছেন – কত কত সামবেদী কঠ কৌথুমাদির মন্ত্র ও অগ্নি বায়ুর সূক্ত উচ্চারণ করিতেছেন – কত কত সুরাষ্ট্র, মহারাষ্ট্র, বঙ্গ ও মগধস্থ নানাবর্ণ পট্টবস্ত্র পরিধারিণী নারীরা স্নাত হইয়া মন্দির প্রদক্ষিণ করিতেছে – কত কত দেবালয় ধূপ, ধূনা, পুষ্প, চন্দনের সৌগন্ধে আমোদিত হইতেছে – কত কত ভক্ত “হর হর বিশ্বেশ্বর” শব্দ করতঃ গাল ও কক্ষবাদ্য করিয়া উন্মত্ত হইয়া চলিয়াছে – কত কত রক্তবসনা ত্রিশূলধারিণী ভৈরবী অট্ট অট্ট হাস্য করত ভৈরবালয়ে ভৈরবভাবিনী ভাবে ভ্রমণ করিতেছে – কত কত সন্ন্যাসী, উদাসীন ও উর্দ্ধবাহু জটাজুট সংযুক্ত ও ভস্ম বিভূতি আবৃত হইয়া শরীর ও ইন্দ্রিয়াদি নিগ্রহে সযত্ন আছেন – কত কত যোগী নিজ নিজ বিরল স্থানে সমাধি জন্য রেচক, পূরক ও কুম্ভক করিতেছেন – কত কত কলায়ত, ধাড়ি ও আতাই বীণা, মৃদঙ্গ, রবাব ও তানপুরা লইয়া ধ্রুপদ, ধরু, খেয়াল প্রবন্ধ, ছন্দ, সোরবন্ধ, তেরানা, সারগম, চতুরং ও নক্সগুলে মশগুল হইয়া আছে। রামলাল ও অন্যান্য সকলে মণিকর্ণিকার ঘাটে স্নানাদি করিয়া কাশীতে চারি দিবস অবস্থিতি করিলেন। রামলাল মায়ের ও ভগিনীর নিকট সর্বদা থাকিতেন, বৈকালে বরদাবাবুকে লইয়া ইতস্তত ভ্রমণ করিতেন। এক দিন পর্যটন করিতে করিতে দেখিলেন সম্মুখে একটি মনোরম আশ্রম, সেখানে এক প্রাচীন ব্যক্তি বসিয়া ভাগীরথীর শোভা দেখিতেছেন নদী বেগবতী – বারি তর তর শব্দের চলিয়াছে – আপনার নির্মলত্ব হেতুক বৈকালিক বিচিত্র আকাশকে যেন ক্রোড়ে লইয়া যাইতেছে। রামলাল ঐ ব্যক্তির নিকট যাইবামাত্রে তিনি পূর্বপরিচিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন – কেমন শুকোপনিষৎ পাঠে তোমার কি বোধ হইল? রামলাল তাঁহার মুখবলোকন করণানন্তর প্রণাম করিলেন। সেই প্রাচীন কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন – বাবা! আমার ভ্রম হইয়াছে – আমার একজন শিষ্য আছে তাহার মুখ ঠিক তোমার মতো, আমি তাহাকেই বোধ করিয়া তোমাকে সম্বোধন করিয়াছিলাম। পরে রামলাল ও বরদাবাবু তাঁহার নিকট বসিয়া নানা প্রকার শাস্ত্রীয় আলাপ করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে চিন্তাযুক্ত এক ব্যক্তি অধোবদনে নিকটে আসিয়া বসিলেন। বরদাবাবু তাঁহাকে নিরীক্ষণ করত বলিলেন – রাম! দেখো কি?–নিকটে যে তোমার দাদা! রামলাল এই কথা শুনিবামাত্রে লোমাঞ্চিত হইয়া মতিলালের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন, মতিলাল রামলালকে অবলোকনপূর্বক চমকিয়া উঠিয়া আলিঙ্গন করিলেন। ক্ষণেক কাল নিস্তব্ধ থাকিয়া – ”ভাই হে! আমাকে কি ক্ষমা করিবে” – মতিলাল এই কথা বলিয়া অনুজের গলায় হাত জড়াইয়া স্কন্ধদেশ নয়নবারিতে অভিষিক্ত করিলেন। দুইজনেই কিয়াৎক্ষণ মৌন ভাবে থাকিলেন – মুখ হইতে কথা নিঃসরণ হয় না – ভাই যে কি পদার্থ তাহা উভয়েরই ঐ সময়ে বিলক্ষণ বোধ হইল। পরে বরদাবাবুর চরণধূলা লইয়া মতিলাল জোড় হাতে বলিলেন – মহাশয়! আপনি যে কি বস্তু তাহা আমি এত দিনের পর জানিলাম – এ নরাধমকে ক্ষমা করুন। বরদাবাবু দুই ভ্রাতার হাত ধরিয়া উক্ত প্রাচীন ব্যক্তির নিকট হইতে বিদায় লইয়া পথিমধ্যে তাহাদিগের পরস্পরের যাবতীয় পূর্ব কথা শুনিতে শুনিতে ও বলিতে বলিতে চলিলেন এবং আলাপ দ্বারা মতিলালের চিত্তের বিভিন্নতা দেখিয়া অসীম আহ্লাদ প্রকাশ করিলেন। পরিবারেরা যে স্থানে ছিলেন, তথায় আসিলে মতিলাল কিঞ্চিৎ দূর থেকে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন – ”কই মা কোথায়? – মা! তোমার সেই কুসন্তান আবার এল – সে আজো বেঁচে আছে – মরে নাই – আমি যে ব্যবহার করিয়াছি তার পর যে তোমার নিকট মুখ দেখাই এমন ইচ্ছা করে না – এক্ষণে আমার বাসনা এই যে একবার তোমার চরণ দর্শন করিয়া প্রাণ ত্যাগ করি। মাতা এই কথা শুনিবামাত্রে প্রফুল্লচিত্তে অশ্রুযুক্ত নয়নে নিকটে আসিয়া জ্যেষ্ঠ পুত্রের মুখাবলোকনে অমূল্য ধন প্রাপ্ত হইলেন। মতিলাল মাতাকে দেখিবামাত্রেই তাঁহার চরণে মস্তক দিয়া পড়িয়া থাকিলেন। ক্ষণেক কাল পরে মাতা হাত ধরিয়া উঠাইয়া আপন অঞ্চল দিয়া তাহার চক্ষের জল পুঁছাইয়া দিতে লাগিলেন ও বলিলেন – মতি! তোমার বিমাতা, ভগিনী ও স্ত্রী আছেন তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করো। মতিলাল ভগিনী ও বিমাতাকে প্রণাম করিয়া আপন পত্নীকে দেখিয়া পূর্বকথা স্মরণ হওয়াতে রোদন করিয়া বলিলেন – মা! আমি যেমন কুপুত্র, কুভ্রাতা, তেমনি কুস্বামী – এমন সৎস্ত্রীর যোগ্য আমি কোনো প্রকারেই নহি! স্ত্রী-পুরুষ বিবাহকালীন পরমেশ্বরের নিকট এক প্রকার শপথ করে যে তাহার যাব্জজীবন পরস্পর প্রেম করিবে, মহাক্লেশে পড়িলেও ছাড়াছাড়ি হইবে না – স্ত্রী অন্য পুরুষের প্রতি মন কখন হইবে না এবং পুরুষেরও অন্য স্ত্রীর প্রতি মন কদাপি যাইবে না – ঐরূপ মননে ঘোর পাপ। এই শপথের বিপরীত কর্ম আমা হইতে অনেক হইয়াছে তবে স্ত্রী কর্তৃক আমি পরিত্যক্ত কেন না হই? আর আমার এমন যে ভাই ও ভগিনী তাহাদিগের প্রতি যৎপরোনাস্তি নিগ্রহ করিয়াছি – তুমি যে মা – যার বাড়া পৃথিবীতে অমূল্য বস্তু আর নাই – তোমাকে অসীম ক্লেশ দিয়াছি – পুত্র হইয়া তোমাকে প্রহার করিয়াছি। মা! এ সকল পাপের কি প্রায়শ্চিত্ত আছে? এক্ষণে আমার শীঘ্র মৃত্যু হইলে মনে যে দাবানাল জ্বলিতেছে তাহা হইতে নিষ্কৃতি পাই, কিন্তু বোধ করি মৃত্যুর মৃত্যু হইয়াছে কারণ তাহার দূতস্বরূপ রোগের কিছু চিহ্ণ দেখি না – যাহা হউক তোমরা সকলে বাটী যাও – আমি এই ধামে গুরুর নিকট থাকিয়া কঠোর অভ্যাসে প্রাণ ত্যাগ করিব।
অনন্তর বরদাবাবু, রামলাল ও তাহার মাতা মতিলালের গুরুকে আনাইয়া বিস্তর বুঝাইয়া মতিলালকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন। মুঙ্গেরের নিকট রজনীযোগে নৌকা চাপা হইলে চৌয়াড়ের মতো আকৃতি একজন লোক ঘনিয়া ঘনিয়া কাছে আসিয়া “আগুন আছে – আগুন আছে” বলিয়া উঁচু হইয়া দেখিতে লাগিল। তাহার রকম-সকম দেখিয়া বরদাবাবু বলিলেন – সকলে সতর্ক হও, তদনন্তর নৌকার ছাতের উপর উঠিয়া দেখিলেন একটা ঝোপের ভিতরে প্রায় বিশ – ত্রিশজন অস্ত্রধারী লোক ঘাপ্টি মারিয়া বসিয়া আছে – ঐ ব্যক্তি সংকেত করিলে চড়াও হইবে। অমনি রামলাল ও বরদাবাবু বাহির হইয়া বন্দুক লইয়া আওয়াজ করিতে লাগিলেন, বন্দুকের আওয়াজে ডাকাইতেরা বনের ভিতর প্রবেশ করিল। বরদাবাবু ও রামলালের মানস যে তলওয়ার হাতে লইয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া দুই – একজনকে ধরিয়া আনিয়া নিকটস্থ দারোগার জিম্মা করিয়া দেন কিন্তু পরিবারেরা সকলে নিষেধ করিল। মতিলাল এই ব্যাপার দেখিয়া বলিল – আমার বাল্যাবস্থা অবধি সর্ব প্রকারেই কুশিক্ষা হইয়াছে – আমার বাবুয়ানাতেই সর্বনাশ হইয়াছে। রামলাল কসরৎ করিত তাহাতে আমি পরিহাস করিতাম – কিন্তু আজ জানিলাম যে বালককালাবধি মর্দনা কসরৎ না করিলে সাহস হয় না। সম্প্রতি আমার অতিশয় ভয় হইয়াছিল, যদ্যপি রামলাল ও বারদাবাবু না থাকিতেন তবে আমরা সকলেই কাটা যাইতাম।
অল্পকালের মধ্যে সকলে বৈদ্যবাটীতে পৌঁহুছিয়া বরদাবাবুর বাটীতে উঠিলেন। বরদাবাবু ও রামলালের প্রত্যাগমনের সংবাদ শুনিয়া গ্রামস্থ যাবতীয় লোক চতুর্দিকে থেকে দেখা করিতে আসিল – সকলেরই মনে আনন্দের উদয় হইল – সকলেরই বদন আহ্লাদে দেদীপ্যমান হইল – সকলেই মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইয়া প্রার্থনা ও আশীর্বাদের পুষ্প বৃষ্টি করিতে লাগিল।
হেরম্বচন্দ্র চৌধুরীবাবু পর দিবস আসিয়া বলিলেন – রামবাবু! আমি বুঝিতে পারি নাই – বাঞ্ছারামের পরামর্শে তোমাদিগের ভদ্রাসন দখল করিয়া লইয়াছি – আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি যে তোমাদিগের পরিবারকে বাহির করিয়া বাটী দখল লইয়াছি। তোমার অসাধারণ গুণ – এক্ষণে আমি বাটী অমনি ফিরিয়া দিতেছি, আপনারা স্বচ্ছন্দে সেখানে গিয়া বাস করুন। রামলাল বলিলেন – আপনার নিকট আমি বড় উপকৃত হইলাম, যদ্যপি আপনার বাটী ফিরিয়া দিবার মানষ হয় তবে আপনার যাহা যথার্থ পাওনা আছে গ্রহণ করিলে আমরা বাধিত হইব। হেরম্ববাবু এই প্রস্তাবে সম্মত হইলে রামলাল তৎক্ষণাৎ নিজে হইতে টাকা দিয়া দুই ভায়ের নামে কওয়ালা লিখিয়া লইয়া পরিবারের সহিত পৈতৃক ভদ্রাসনে গেলেন এবং উর্দ্ধদৃষ্টি করত কৃতজ্ঞচিত্তে মনে মনে বলিলেন – ”জগদীশ্বর! তোমা হইতে কি-না হইতে পারে!”
অনন্তর রামলালের বিবাহ হইল ও দুই ভাইয়ে অতিশয় সম্প্রীতিতে মায়েরও অন্যান্য পরিবারের সুখবর্ধক হইয়া পরম সুখে কাল যাপন করিতে লাগিলেন। বরদাবাবু বরদাপ্রসাদাৎ বদরগঞ্জে বিষয়কর্মার্থ গমন করিলেন – বেচারাম বাবু বিষয়-বিভব বিক্রয় করিয়া প্রকৃত বেচারাম হইয়া বারাণসীতে বাস করিলেন – বেণীবাবু কিছু দিন বিনা শিক্ষায় শৌখিন হইয়া আইন ব্যবসাতে মনোযোগ করিলেন – বাঞ্ছারাম বহুত ফন্দি ও ফেরেক্কা করিয়া বজ্রাঘাতে মরিয়া গেলেন – বক্রেশ্বর খোশামোদ ও বরামদ করিয়া ফ্যা ফ্যা করতঃ বেড়াইতে লাগিলেন – ঠকচাচা ও বাহুল্য পুলিপালমে গিয়া জাল করাতে সেখানে তাহাদিগের বাজিঞ্জির মাটি কাটিতে হয় এবং কিছুদিন পরে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইয়া তাহাদের মৃত্যু হইল – ঠকচাচী কোনো উপায় না দেখিয়া চুড়িওয়ালী হইয়া ভেটিয়ারি গান “চুড়িয়ালের চুড়িয়া” গাইতে গাইতে গলি গলি ফিরিতে লাগিল – হলধর, গদাধর ও আর আর ব্রজবালক মতিলালের স্বভাব ভিন্ন দেখিয়া অন্যান্য কাপ্তেনবাবুর অন্বেষণ করিতে উদ্যত হইল – জান সাহেব ইনসালবেন্ট লইয়া দালালি কর্ম আরম্ভ করিলেন – প্রেমনারায়ণ মজুমদার ভেক লইয়া “মহাদেবের মনের কথা রে অরে ভক্ত বই আর কে জানে” এই বলিয়া চীৎকার করিয়া নবদ্বীপে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন – প্রমদার স্বামী অনেক স্থানে পাণিগ্রহণ করিয়া ছিলেন, এক্ষণে শূন্যপাণি হওয়াতে বৈদ্যবাটীতে আসিয়া শ্যালকদিগের স্কন্ধে ভোগ করত কেবল কলাইকন্দ, ঘেয়ারূ, তাজফেনি, বেদানা, সেও ও জলগোজা খাইয়া টপ্পা মারিতে আরম্ভ করিলেন – তাহার পরে যে সকল ঘটনা হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিতে বাকী রহিল – “আমার কথাটি ফুরাল, নটে গাছটি মুড়াল”।