আলালের ঘরের দুলাল
২১. মতিলালের গদিপ্রাপ্তি ও বাবুয়ানা, মাতার প্রতি কুব্যবহার —মাতা ভগিনীর বাটী হইতে গমন ও ভ্রাতাকে বাটীতে আসিতে বারণ ও তাহার অন্য দেশে গমন।
বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধে লোকের বড় শ্রদ্ধা জন্মিল না, যেমন গর্জন হইয়াছিল তেমন বর্ষণ হয় নাই। অনেক তেলা মাথায় তেল পড়িল – কিন্তু শুকনা মাথা বিনা তৈলে ফেটে গেল। অধ্যাপকদিগের তর্ক করাই সার, ইয়ার গোছের বামুনদিগের চৌচাপটে জিত। অধ্যাপকদিগের নানা প্রকার কঠোর অভ্যাস থাকাতে এক্রোকা স্বভাব জন্মে – তাঁহারা আপন অভিপ্রায় অনুসারে চলেন – সাটে হাঁ-না বলেন না। ইয়ার গোচের ব্রাহ্মণেরা শহরঘেঁষা – বাবুদিগের মন যোগাইয়া কথাবার্তা কহেন – ঝোপ বুঝে কোপ মারেন, তাঁহারা সকল কর্মেই বাওয়াজিকে বাওয়াজি তরকারিকে তরকারী। অতএব তাঁহাদিগের যে সর্ব স্থানে উচ্চ বিদায় হয় তাহাতে আশ্চর্য কি? অধ্যক্ষেরা ভাল থলিয়া সিঞাইয়া বসিয়াছিলেন – ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও কাঙালী বিদায় বড় হউক বা না হউক তাহাদিগের নিজের বিদায়ে ভাল অনুরাগ হইল। যে কর্মটি সকলের চক্ষের উপর পড়িয়াছিল ও এড়াইবার নয় সেই কর্মটি রব করিয়া হইয়াছিল কিন্তু আগুপাছুতে সমান বিবেচনা হয় নাই। এমন অধ্যক্ষতা করা কেবল চিতেন কেটে বাহবা লওয়া।
শ্রাদ্ধের গোল ক্রমে মিটে গেল। বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালের বিজাতীয় খোসামোদ করিতে লাগিল। মতিলাল দুর্বল স্বভাব হেতু তাহাদিগের মিষ্ট কথায় ভিজিয়া গিয়া মনে করিল যে পৃথিবীতে তাহাদিগের তুল্য আত্মীয় আর নাই। মতিলালের মান বৃদ্ধির জন্য তাহারা একদিন বলিল – এক্ষণে আপনি কর্তা অতএব স্বর্গীয় কর্তার গদিতে বসা কর্তব্য, তাহা না হইলে তাঁহার পদ কি প্রকারে বজায় থাকিবে? – এই কথা শুনিয়া মতিলাল অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল – ছেলে বেলা তাহার রামায়ণ ও মহাভারত একটু একটু শুনা ছিল এই কারণে মনে হইতে লাগিল যেমন রামচন্দ্র ও যুধিষ্ঠির সমারোহপূর্বক সিংহাসনে অভিসিক্ত হইয়াছিলেন সেইরূপে আমাকেও গদিতে উপবেশন করিতে হইবেক। বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা দেখিল ঐ প্রস্তাবে মতিলালের মুখখানি আহ্লাদে চক্ চক্ করিতে লাগিল – তাহার পর দিবসেই দিন স্থির-করিয়া আত্মীয় স্বজনকে আহ্বানপূর্বক মতিলালকে তাহার পিতার গদির উপর বসাইল। গ্রামে ঢিঢিকার হইয়া গেল মতিলাল গদিপ্রাপ্ত হইলেন। এই কথা হাটে, বাজারে, ঘাটে-মাঠে হইতে লাগিল – একজন ঝাঁজওয়ালা বামুন শুনিয়া বলিল – গদিপ্রাপ্ত কি হে? এটা যে বড় লম্বা কথা! আর গদি বা কার? এ কি জগৎসেটের গদি না দেবীদাস বালমুকুন্দের গদি?
যে লোকের ভিতরে সার থাকে সে লোক উচ্চ পদ অথবা বিভব পাইলেও হেলে দোলে না, কিন্তু যাহাতে কিছু পদার্থ নাই তাহার অবস্থার উন্নতি হইলে বানের জলের ন্যায় টল্মল্ করিতে থাকে। মতিলালের মনের গতি সেইরূপ হইতে লাগিল। রাত দিন খেলাধুলা, গোলমাল, গাওনা-বাজনা, হো হা, হাসি-খুশি, আমোদ-প্রমোদ, মোয়াফেল, চোহেল, স্রোতের ন্যায় অবিশ্রান্ত চলিতে আরম্ভ হইল, সঙ্গীদিগের সংখ্যার হ্রাস নাই_ রোজ রোজ রক্তবীজের ন্যায় বৃদ্ধি হইতে লাগিল। ইহার আশ্চর্য কি? – ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নাই, আর গুড়ের গন্ধেই পিঁপড়ার পাল পিল পিল করিয়া আইসে। একদিন বক্রেশ্বরের সাইতের পন্থায় আসিয়া মতিলালের মনযোগানো কথা অনেক বলিল কিন্তু বক্রেশ্বরের ফন্দি মতিলাল বাল্যকালাবধি ভাল জানিত – এই জন্যে তাহাকে এই জবাব দেওয়া হইল – মহাশয়! আমার প্রতি যেরূপ তদারক করিয়াছিলেন তাহাতে আমার পরকালের দফা একেবারে খাইয়া দিয়াছেন – ছেলেবেলা আপনাকে দিতে থুতে আমি কসুর করি নাই – এখন আর যন্ত্রণা কেন দেন? বক্রেশ্বর অধোমুখে মেও মেও করিয়া প্রস্থান করিল। মতিলাল আপন সুখে মত্ত – বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা এক একবার আসিতেন কিন্তু তাহাদিগের সঙ্গে বড় দেখাশুনা হইত না – তাঁহারা মোক্তারনামার দ্বারা সকল আদায়-ওয়াশিল করিতেন ও মধ্যে মধ্যে বাবুকে হাততোলা রকমে কিছু কিছু দিতেন। আর ব্যয়ের কিছু নিকেশ প্রকাশ নাই – পরিবারেরও দেখাশুনা নাই – কে কোথায় থাকে – কে কোথায় খায় – কিছুই খোঁজ খবর নাই – এইরূপ হওয়াতে পরিবারদিগের ক্লেশ হইতে লাগিল কিন্তু মতিলাল বাবুয়ানায় এমতো বেহুঁশ যে এসব কথা শুনিয়েও শুনে না।
সাধ্বী স্ত্রীর পতিশোকের অপেক্ষা আর যন্ত্রণা নাই। যদ্যপি সৎ সন্তান থাকে তবে সে শোকের কিঞ্চাৎ শমতা হয়। কুসন্তান হইলে সেই শোকানলে যে ঘৃত পড়ে। মতিলালের কুব্যবহার জন্য তাহার মাতা ঘোরতর তাপিত হইতে লাগিলেন – কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করিতেন না, তিনি অনেক বিবেচনা করিয়া একদিন মতিলালের নিকট আসিয়া বলিলেন – বাবা! আমার কপালে যাহা ছিল তাহা হইয়াছে, এক্ষণ যে ক-দিন বাঁচি সে ক-দিন যেন তোমার কুকথা না শুনতে হয় – লোকগঞ্জনায় আমি কান পাতিতে পারি না, তোমার ছোট ভাইটির, বড় বোনটির ও বিমাতার একটু তত্ত্ব নিও – তারা সবদিন আধপেটাও খেতে পাইয় না – বাবা। আমি নিজের জন্যে কিছু বলি না, তোমাকে ভারও দিই না। মতিলাল এ কথা শুনিয়া দুই চক্ষু লাল করিয়া বলিল – কি তুমি একশ-বার ফেচ্ ফেচ্ করিয়া বক্তেছ? – তুমি জানো না আমি এখন যা মনে করি তাই করিতে পারি? আমার আবার কুকথা কি? এই বলিয়া মাতাকে ঠাস্ করিয়া এক চড় মারিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল। অনেকক্ষণ, পরে জননী উঠিয়া অঞ্চল দিয়া চক্ষের জল পুঁছিতে পুঁছিতে বলিলেন – বাবা! আমি কখন শুনি নাই যে সন্তানে মাকে মারে কিন্তু আমার কপাল হইতে তাহাও ঘটিল – আমার আর কিছু কথা নাই কেবল এইমাত্র বলি যে তুমি ভাল থাকো। মাতা পর দিবস আপন কন্যাকে লইয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া বাটী হইতে গমন করিলেন।
রামলাল পিতার মৃত্যুর পর ভ্রাতার সঙ্গে সদ্ভাব রাখিতে অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন কিন্তু নানা প্রকারে অপমানিত হন। মতিলাল সর্বদা এই ভাবিত বিষয়ের অর্ধেক অংশ দিতে গেলে বড়মানুষি করা হইবে না কিন্তু বড়মানুষি না করিলে বাঁচা মিথ্যা, এজন্য যাহাতে ভাই ফাঁকিতে পড়ে তাহাই করিতে হইবে। এই মতলব স্থির করিয়া বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার পরামর্শে মতিলাল রামলালকে বাটী ঢুকিতে বারণ করিয়া দিল। রামলাল ভদ্রাসনে প্রবেশকরণে নিবারিত হইয়া অনেক বিবেচনা করণান্তে মাতা বা ভাগিনী অথবা কাহারো সহিত না সাক্ষাৎ করিয়া দেশান্তর গমন করিলেন।
আলালের ঘরের দুলাল
২২. বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালকে সওদাগরি কর্ম করিতে পরামর্শ দেন, মতিলাল দিন দেখাইবার জন্য তর্কসিদ্ধান্তের নিকট মানগোবিন্দকে পাঠান, পর দিবস রাহি হয়েন ও ধনামালার সহিত গঙ্গাতে বকাবকি করেন।
মতিলাল দেখিলেন বাটী হইতে মা গেলেন, ভাই গেলেন, ভগিনী গেলেন। আপদের শান্তি! এতদিনের পর নিষ্কন্টক হইল —ফেচ্ফেচানি একেবারে বন্ধ —এক চোখ রাঙানিতে কর্ম কেয়াল হইয়া উঠিল আর “প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ” সে সব হল বটে কিন্তু শরার রুধির ফুরিয়ে এল —তার উপায় কি? বাবুয়ানার জোগাড় কিরূপে চলে? খুচরা মহাজন বেটাদের টাল্মাটাল আর করিতে পারা যায় না। উটনোওয়ালারাও উটনো বন্ধ করিয়াছে —এদিকে সামনে স্নানযাত্রা —বজরা ভাড়া করিতে আছে —খেমটাওয়ালীদের বায়না দিতে আছে —সন্দেশ মেঠাইয়ের ফরমাইশ দিতে আছে —চরস, গাঁজা ও মদও আনাইতে হইবে —তার আটখানার পাটখানাও হয় নাই। এই সকল চিন্তায় মতিলাল চিন্তিত আছেন এমতো সময়ে বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা আসিয়া উপস্থিত হইল। দুই-একটা কথার পরে তাহারা জিজ্ঞাসা করিল —বড়বাবু! কিছু বিমর্ষ কেন? তোমাকে ম্লান দেখিলে যে আমরা ম্লান হই —তোমার যে বয়েস তাতে সর্বদা হাসিখুশি করিবে। গালে হাত কেন? ছি! ভাল করিয়া বসো। মতিলাল এই মিষ্ট বাক্যে ভিজিয়া আপন মনের কথা সকল ব্যক্ত করিল। বাঞ্ছরাম বলিলেন —তার জন্যে এত ভাবনা কেন? আমরা কি ঘাস কাটছি? আজ একটা ভারি মতলব করিয়া আসিয়াছি —এক বৎসরের মধ্যে দেনা-টেনা সকল শোধ দিয়া পায়ের উপর পা দিয়া পুত্রপৌত্রক্রমে খুব বড়মানুষি করিতে পারিবে। শাস্ত্রে বলে “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” —সৌদাগরিতেই লোক ফেঁপে উঠে —আমার দেখ্তা কত বেটা টেপাগোঁজা, নড়েভোলা, টয়েবাঁধা, বালতিপোতা, কারবারে হেপায় আণ্ডিল হইয়া গেল —এ সব দেখে কেবল চোখ টাটায় বই তো না! আমরা কেবল একটি কর্ম লয়ে ঘষ্টিঘর্ষণা করিতেছি —এ কি খাটো দুঃখ! চন্ডীচরণ ঘুঁটে কুড়ায়, রামা চড়ে ঘোড়া।
মতিলাল। এ মতলব বড় ভাল —আমার অহরহ টাকার দরকার। সৌদাগরি কি বাজারে ফলে না আপিসে জন্মে? না মেঠাই-মণ্ডার দোকানে কিনিতে মেলে? একজন সাহেবের মুৎসুদ্দি না হইলে আমার কর্ম কাজ জমকাবে না।
বাঞ্ছরাম। বড়বাবু! তুমি কেবল গদিয়ান হইয়া থাকিবে, করাকর্মার ভার সব আমাদিগের উপর —আমাদিগের বটলর সাহেবের একজন দোস্ত জান সাহেব সম্প্রতি বিলাত হইতে আসিয়াছে —তাহাকেই খাড়া করিয়া তাহারই মৎসুদ্দি হইতে হইবে। সে লোকটি সৌদাগরি কর্মে ঘুন।
ঠকচাচা। মুইবি সাতে সাতে থাক্ব, মোকে আদালতে, মাল, ফৌজদারি, সৌদাগরি কোনো কাম ছাপা নাই। মোর শেনাবি এ সব ভাল সমজে। বাবু! আপসোস এই যে মোর কারদানি এ নাগাদ নিদ যেতেচে —লেফিয়ে লেফিয়ে জাহের হল না। মুই চুপ করে থাকবার আদমি নয় দোশমন পেলে তেনাকে জেপ্টে, কেমড়ে মেটিতে পেটিয়ে দি —সৌদাগরি কাম পেলে মুই রোস্তম জালের মাফিক চলব।
মতিলাল। ঠকচাচা —শেনা কে?
ঠকচাচা। শেনা তোমার ঠকচাচী —তেনার সেফত কি করব? তেনার সুরত জেলেখার মাফিক আর মালুম হয় ফেরেস্তার মাফিক বুজ-সমজ।
বাঞ্ছারাম। ও কথা এখন থাকুক। জান সাহেবকে দশ পনেরো হাজার টাকা সরবরাহ করিতে হইবে তাতে কিছুমাত্র জখম নাই। আমি স্থির করিয়াছি যে কোতলপুরের তালুকখানা বন্ধক দিলে ঐ টাকা পাওয়া যাইতে পারে— বন্ধকী লেখাপড়া আমাদিগের সাহেবের আপিসে করিয়া দিব —খরচ বড় হইবে না —আন্দাজ টাকা শ’চার-পাঁচের মধ্যে আর টাকা শ-পাঁচেক মহাজনের আমলা-ফামলাকে দিতে হইবে। সে বেটারা পুন্কে শত্রু —একটা খোঁচা দিলে কর্ম ভণ্ডুল করিতে পারে। সকল কর্মেরই অষ্টম-খষ্টম আগে মিটাইয়া নষ্ট কোষ্ঠী উদ্ধার করিতে হয়। আমি আর বড় বিলম্ব করিব না, ঠকচাচাকে লইয়া কলিকাতায় চলিলাম —আমার নানা বরাত —মাথায় আগুন জ্বল্ছে। বড়বাবু! তুমি তর্কসিদ্ধান্ত দাদার কাছে থেকে একটা ভাল দিন দেখে শীঘ্র দুর্গা দুর্গা বলিয়া যাত্রা করিয়া একেবারে আমার সোনাগাজির দরুন বাটীতে উঠিবে। কলিকাতায় কিছু দিন অবস্থিতি করিতে হইবে তার পর এই বৈদ্যবাটীর ঘাটেতে যখন চাঁদ সদাগরের মতন সাত জাঁহাজ ধন লইয়া ফিরিয়া আসিয়া দামামা বাজাইয়া উঠিবে তখন আবাল-বৃদ্ধ, যুবতী কুলকন্যা তোমার প্রত্যাগমনের কৌতুক দেখিয়া তোমাকে ধন্য ধন্য করিবে।
আহা! এমন দিন যেন শীঘ্র উদয় হয়! এই বলিয়া বাঞ্ছারাম ঠকচাচাকে লইয়া গমন করিলেন।
মতিলাল আপন সঙ্গীদিগকে উপরোক্ত সকল কথা আনুপূর্বিক বলিল। সঙ্গীরা শুনিয়া বগল বাজাইয়া নেচে উঠিল —তাহাদিগের রাতিব টানাটানির জন্য প্রায় বন্ধ। এক্ষণে সাবেক বরাদ্দ বহাল হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। তাড়াতাড়ি, হুড়াহুড়ি করিয়া মানগোবিন্দ এক চোঁচা দৌড়ে তর্কসিদ্ধান্তের টোলে উপস্থিত হইয়া হাঁপ ছাড়িতে লাগল। তর্কসিদ্ধান্ত বড় প্রাচীন, নস্য লইতেছেন —ফেঁচ্ ফেঁচ্ করিয়া হাঁচতেছেন —খক্ খক্ করিয়া কাশতেছেন —চারিদিকে শিষ্য —সম্মুখে কয়েকখানা তালপাতায় লেখা পুস্তক —চশমা নাকে দিয়ে এক একবার গ্রন্থ দেখিতেছেন, এক একবার ছাত্রদিগকে পাঠ বলিয়া দিতেছেন। বিচলির অভাবে গোরুর জাবনা দেওয়া হয় নাই —গোরু মধ্যে মধ্যে হাম্মা হাম্মা করিতেছে —ব্রাহ্মণী বাটীর ভিতর হইতে চিৎকার করিয়া বলিতেছেন —বুড়ো হইলেই বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ হয়, উনি রাতদিন পাঁজি-পুথি ঘাঁটবেন, ঘরকন্নার পানে একবার ফিরে দেখবেন না। এই কথা শিষ্যেরা শুনিয়া পরস্পর গা টেপাটেপি করিয়া চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। তর্কসিদ্ধান্ত বিরক্ত হইয়া ব্রাহ্মণীকে থমাইবার জন্য লাঠি ধরিয়া সুড় সুড় করিয়া উঠিতেছেন এমন সময়ে মানগোবিন্দ ধরে বসিল —ওগো তর্কসিদ্ধান্ত খুড়ো! আমরা সব সৌদাগরি করিতে যাব একটা ভাল দিন দেখে দেও।
তর্কসিদ্ধান্ত মুখ বিকটসিকট করিয়া গুমরে উঠিলেন —কচুপোড়া খাও —উঠছি আর অমনি পেচু ডাক্ছ আর কি সময় পাওনি? সৌদাগরি করতে যাবে! তোর বাপের ভিটে নাশ হউক —তোদের আবার দিনক্ষণ কি রে? বালাই বেরুলে সকলে হাঁপ ছেড়ে গঙ্গাস্নান করবে —যা বল্গে যা যে দিন তোরা এখান থেকে যাবি সেই দিনই শুভ।
মানগোবিন্দ মুখছোপ্পা খাইয়া আসিয়া বলিল যে কালই দিন ভাল, অমনি সাজ্ রে সাজ্ রে শব্দ হইতে লাগিল ও উদ্যোগ পর্বে ধুম বেধে গেল। কেহ সেতারার মেজ্রাপ হাতে দেয় —কেহ বাঁয়ার গাব আছে কি-না তাহা ধপ্ ধপ্ করিয়া পিটে দেখে —কেহ তবলায় চাঁটি দিয়া পরখ করে —কেহ কেহ ঢোলের কড়া টানে —কেহ বেহালায় রজন দিয়া ডাডা ডাডা করে —কেহ বোঁচকা-বুঁচকি বাঁধে —কেহ চরস-গাঁজা মায় ছুরি, কাঠ লইয়া পোঁটলা করে —কেহ ছর্রার গুলী চাটের সহিত সন্তর্পণে রাখে —কেহ পাকামালের ঘাট্তি তদারক করে। এইরূপে সারা দিন ও সারা রাত্রি ছট্ফটানি, ধড় ফড়ানি, আন, নিয়ে আয়, দেখ, শোন, ওরে, হেঁরে, সজ্জাগজ্জা, হোহাতে কেটে গেল।
গ্রামে ঢিঢিকার হইল বাবুরা সৌদাগরি করিতে চলিলেন। পর দিবস প্রভাতে যাবতীয় দোকানী, পসারী, ভিখিরী, কাঙালী ও অন্যান্য অনেকেই রাস্তায় চাহিয়ে আছে ইতিমধ্যে নববাবুরা মত্ত হস্তীর ন্যায় পৈয়িস্ পৈয়িস্ করত মস্ মস্ শব্দে ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আহ্ণিক করিতেছিলেন, গোলমাল শুনিয়া পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করিয়া একেবারে জড়সড় হইলেন। তাঁহাদিগকে ভীত দেখিয়া নববাবুরা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিতে হাসিতে গঙ্গামৃত্তিকা ঝামা ও থুৎকুড়ি গাত্রে বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণেরা ভগ্নাহ্ণিক হইয়া গোবিন্দ গোবিন্দ করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন। নববাবুরা নৌকায় উঠিয়া সকলে চিৎকার স্বরে এক সখীসম্বাদ ধরিলেন —নৌকা ভাঁটার জোরে সাঁ সাঁ করিয়া যাইতেছে কিন্তু বাবুরা কেহই স্থির নহেন —এ ছাতের উপর যায় ও হাইল ধরে টানে —এ দাঁড় বহে ও চকমকি নিয়ে আগুন করে। কঞ্চিৎ দূর যাইতে যাইতে ধনামালার সহিত দেখা হইল —ধনামালা বড় মুখর —জিজ্ঞাসা করিল গ্রামটাকে তো পুড়িয়ে খাক করলে আবার গঙ্গাকে জ্বালাচ্ছ কেন? নববাবুরা রেগে বলিল —চুপ শূয়ার —তুই জানিস নে যে আমরা সব সৌদাগরি করতে যাচ্ছি? ধনা উত্তর করিল —যদি তোরা সৌদাগর হস্ তো সৌদাগরি কর্ম গলায় দড়ি দিয়া মরুক!
আলালের ঘরের দুলাল
২৩. মতিলাল দলবল সমেত সোনাগাজিতে আসিয়া একজন গুরুমহাশয়কে তাড়ান, বাবুয়ানা বাড়াবাড়ি হয়, পরে সৌদাগরি করিয়া দেনার ভয়ে প্রস্থান করেন।
সোনাগাজির দরগায় কুনী বুনী বাসা করিয়াছিল —চারি দিক্ শেওলা ও বোনাজে পরিপূর্ণ —স্থানে স্থানে কাকের ও শালিকের বাসা – বাড়িতে আবার আনিয়া দিতেছে – পিলে চিঁ চিঁ করিতেছে – কোনোখানেই এক ফোঁটা চুন পড়ে নাই – রাত্রি হইলে কেবল শেয়াল-কুকুরের ডাক শোনা যাইত ও সকল স্থানে সন্ধ্যা দিত কি-না তাহা সন্দেহ। নিকটে একজন গুরুমহাশয় কতকগুলি ফরগল গলায় বাঁধা ছেলে লইয়া পড়াইতেন – ছেলেদিগের লেখাপড়া যত হউক বা না হউক, বেতের শব্দে ত্রাসে তাহাদিগের প্রাণ উড়িয়া যাইত – যদি কোনো ছেলে একবার ঘাড় তুলিত অথবা কোঁচড় থেকে এক গাল জলপান খাইত তবে তৎক্ষণাৎ তাহার পিঠে চট্ চট্ চাপড় পড়িত। মানব-স্বভাব এই যে কোনো বিষয়ে কর্তৃত্ব থাকিলে যে কর্তৃত্বটি নানারূপে প্রকাশ চাই তাহা না হইলে আপন গৌরবের লাঘব হয় – এই জন্য গুরুমহাশয় আপন প্রভুত্ব ব্যক্ত করণার্থ রাস্তার লোক জড়ো করিতেন ও লোক জড়ো হইলে তাঁহার সরদারি অশেষ বিশেষ রকমে বৃদ্ধি হইত, এ কারণ বালকদিগের যে লঘু পাপে গুরু দণ্ড হইত তাহার আশ্চার্য কি? গুরুমহাশয়ের পাঠশালাটি প্রায় যমালয়ের ন্যায় – সর্বদাই চটাপট্, পটাপট্, গেলুম রে, মলুম রে, ও ‘গুরুমহাশয়, গুরুমহাশয় তোমার পড়ো হাজির’ এই শব্দই হইত আর কাহার নাকখত – কাহার কানমলা – কেহ ইটেখাড়া – কাহার হাতছড়ি – কাহাকেও কপিকলে লট্কানো – কাহার জলবিচাটি, একটা না একটা প্রকার দণ্ড অনবরতই হইত। সোনাগাজির গুমর কেবল গুরুমহাশয়ের দ্বারাই রাখা হইয়াছিল। কিঞ্চিৎ প্রান্তভাগে দুই-একজন বাউল থাকিত —তাহারা সমস্ত দিন ভিক্ষা করিত। সন্ধ্যার পর পরিশ্রমে অক্লান্ত হইয়া শুয়ে শুয়ে মৃদুস্বরে গান করিত। সোনাগাজির এইরূপ অবস্থা ছিল। মতিলালের শুভাগমনাবধি সোনাগাজির কপাল ফিরিয়া গেল। একেবারে ‘ঘোড়ার চিঁ হিঁ, তবলার চাঁটি, লুচি পুরির খচাখচ’, উল্লাসের কড়াংধুম রাতদিন হইতে লাগিল আর মণ্ডা-মিঠাই, গোলাপ ফুলের আতর ও চরস, গাঁজা, মদের ছড়াছড়ি দেখিয়া অনেকেই গড়াগড়ি দিতে আরম্ভ করিল। কলিকাতার লোক চেনা ভার —অনেকেই বর্ণচোরা আঁব। তাহাদিগের প্রথম এক রকম মূর্তি দেখা যায় পরে আর এক মুর্তি প্রকাশ হয়। ইহার মূল টাকা – টাকার খাতিরেই অনেক ফেরফার হয়। মনুষ্যের দুর্বল স্বভাব হেতুই ধনকে অসাধারণরূপে পূজা করে। যদি লোকে শুনে যে অমুকের এত টাকা আছে তবে কি প্রকারে তাহার অনুগ্রহের পাত্র হইবে এই চেষ্টা কায়মনোবাক্যে করে ও তজ্জন্য যাহা বলিতে বা করিতে হয় তাহাতে কিছুমাত্র ক্রটি করে না। এই কারণে মতিলালের নিকট নানা রকম লোক আসিতে আরম্ভ করিল। কেহ কেহ উলার ব্রাহ্মণের ন্যায় মুখপোড়া রকমে আপনার অভিপ্রায় একেবারে ব্যক্ত করে – কেহ-বা কৃষ্ণনগরীয়দিগের ন্যায় ঝাড় বুটা কাটিয়া মুন্শিয়ানা খরচ করে – আসল কথা অনেক বিলম্বে অতি সূক্ষ্ণরূপে প্রকাশ হয় – কেহ বা পূর্বদেশীয় বঙ্গভায়াদিগের মতো কেনিয়ে কেনিয়ে চলেন – প্রথম প্রথম আপনাকে নিষ্প্রয়াস ও নির্লোভ দেখান – আসল মতলব তৎকালে দ্বৈপায়নহ্রদে ডুবাইয়া রাখেন – দীর্ঘকালে সময়বিশেষে প্রকাশ হইলে বোধ হয় তাহার গমনাগমনের তাৎপর্য কেবল “যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্য”।
মতিলালের নিকট যে ব্যক্তি আইসে সেই হাই তুলিলে তুড়ি দেয় – হাঁচিলে “জীব” বলে। ওরে বলিলেই “ওরে ওরে” করে চীৎকার করে ও ভালমন্দ সকল কথারই উত্তরে – ”আজ্ঞা আপনি যা বলেছেন তাই বটে” এই প্রকার বলে। প্রাতঃকালাবধি রাত্রি দুই প্রহর পর্যন্ত মতিলালের নিকট লোক গস্গস্ করিতে লাগিল – ক্ষণ নাই – মুহুর্ত নাই – নিমেষ নাই – সর্বদাই নানা প্রকার লোক আসিতেছে – বসিতেছে – যাইতেছে। তাহাদিগের জুতার ফটাং ফটাং শব্দে বৈঠকখানায় সিঁড়ি কম্পমান – তামাক মুহুর্মুহুঃ আসিতেছে – ধুঁয়া কলের জাহাজের ন্যায় নির্গত হইতেছে। চাকরেরা আর তামাক সাজিতে পারে না – পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। দিবারাত্রি নৃত্য, গীত, বাদ্য, হাসিখুশি, বড়ফট্টাই, ভাঁড়ামো, নকল, ঠাট্টা, বটকেরা, ভাবের গালাগালি, আমাদের ঠেলাঠেলি – চড়ুইভাতি, বনভোজন, নেশা একাদিক্রমে চলিতেছে। যেন রাতারাতি মতিলাল হঠাৎ বাবু হইয়া উঠিয়াছেন।
এই গোলে গুরুমহাশয়ের গুরুত্ব একেবারে লঘু হইয়া গেল – তিনি পূর্বে বৃহৎ পক্ষী ছিলেন এক্ষণে দুর্গা-টুনটুনি হইয়া পড়িলেন। মধ্যে মধ্যে ছেলেদের ঘোষাইবার একটু একটু গোল হইত – তাহা শুনিয়া মতিলাল বলিলেন, এ বেটা এখানে কেন মেও মেও করে – গুরুমশায়ের যন্ত্রণা হইতে আমি বালকাকালেই মুক্ত হইয়াছি আবার গুরুমহাশয় নিকটে কেন? – ওটাকে ‘রায় বিসর্জন দাও। এই কথা শুনিবামাত্র নববাবুরা দুই-এক দিনের মধ্যেই ইট পাটকেলের দ্বারা গুরুমহশয়কে অন্তর্ধান করাইলেন সুতরাং পাঠশালা ভাঙ্গিয়া গেল। বালকেরা বাঁচলুম বলিয়া তাড়ি পাত তুলিয়া গুরুমহশয়কে ভেংচুতে ভেংচুতে ও কলা দেখাইতে দেখাইতে চোঁচা দৌড়ে ঘরে গেল।
এদিকে জান সাহেব হৌস খুলিলেন – নাম হৈল জান কোম্পানি। মতিলাল মুৎসুদ্দি, বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা কর্মকর্তা। সাহেব টাকার খাতিরে মুৎসুদ্দিকে তোয়াজ করেন ও মুৎসুদ্দি আপন সঙ্গীদিগকে লইয়া দুই প্রহর তিনটা চারিটার সময় পান চিবুতে চিবুতে রাঙা চকে এক একবার কুঠি যাইয়া দাঁদুড়ে বেড়াইয়া ঘরে আইসেন। সাহেবের এক পয়সার সঙ্গতি ছিল না – বটলর সাহেবের অন্নদাস হইয়া থাকিতেন এক্ষণে চৌরুঙ্গিতে এক বাটী ভাড়া করিয়া নানা প্রকার আসবাব ও তসবির খরিদ করিয়া বাটী সাজাইলেন ও ভাল ভাল গাড়ি, ঘোড়া ও কুকুর ধারে কিনিয়া আনিলেন এবং ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া তৈয়ার করিয়া বাজির খেলা খেলিতে লাগিলেন। কিছু দিন পরে সাহেবের বিবাহ হইল, সোনার ওয়াচগার্ড পরিয়া ও হীরার আঙ্গুটি হাতে দিয়া সাহেব ভদ্র সমাজে ফিরিতে লাগিলেন। এই সকল ভড়ং দেখিয়া অনেকেরই সংস্কার হইল জান সাহেব ধনী হইয়াছেন, এই জন্য তাঁহার সহিত লেনদেন করণে অনেকে কিছুমাত্র সন্দেহ করিল না কিন্তু দুই-একজন বুদ্ধিমান লোক তাঁহার নিগূঢ় তত্ত্ব জানিয়া আল্গা আল্গা রকমে থাকিতে – কখনই মাখামাখি করিতে না।
কলিকাতার অনেক সৌদাগর আড়তদারিতেই অর্থ উপার্জন করে – হয়তো জাহাজের ভাড়া বিলি করে অথবা কোম্পানির কাগজ কিংবা জিনিসপত্র খরিদ বা বিক্রয় করে ও তাহার উপর ফি শতকরায় কতক টাকা আড়তদারি খরচা লয়। অন্যান্য অনেকে আপন আপন টাকায় এখানকার ও অন্য স্থানের বাজার বুঝিয়া সৌদাগরি করে কিন্তু যাহারা ঐ কর্ম করে তাহাদিগকে অগ্রে সৌদাগরি কর্ম শিখিতে হয় তা না হইলে কর্ম ভাল হইতে পারে না।
জান সাহেবের কিছুমাত্র বোধশোধ ছিল না, জিনিস খরিদ করিয়া পাঠাইলেই মুনাফা হইবে এই তাঁহার সংস্কার ছিল, ফলতঃ আসল মতলব এই পরের স্কন্ধে ভোগ করিয়া রাতারাতি বড়মানুষ হইব। তিনি এই ভাবিতেন যে সৌদাগরি সেস্ত করিয়া – দশটা গুলী মারিতে মারিতে কোনোটা না কোনোটা গুলীতে অবশ্যই শিকার পাওয়া যাইবে। যেমন সাহেব ততোধিক তাহার মুৎসুদ্দি – তিনি গণ্ডমূর্খ – না তাঁহার লেখাপড়াই বোধশোধ আছে – না বিষয়কর্মই বুঝিতে-শুঝিতে পারেন সুতরাং তাহাকে দিয়া কোনো কর্ম করানো কেবল গো-বধ করা মাত্র। মহাজন, দালাল ও সরকারেরা সর্বদাই তাঁহার নিকট জিনিসপত্রের নমুনা লইয়া আসিত ও দর-দামের ঘাটতি-বাড়তি এবং বাজারের খবর বলিত। তিনি বিষয়কর্মের কথার সময়ে ঘোর বিপদে পড়িয়া ফেল্ ফেল্ করিয়া চাহিয়া থাকিতেন – সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন না – কি জানি কথা কহিলে পাছে নিজের বিদ্যা প্রকাশ হয়, কেবল এইমাত্র বলিতেন যে, বাঞ্ছারাম বাবু ও ঠকচাচার নিকট যাও।
আপিসে দুই-একজন কেরানী ছিল, তাহারা ইংরেজীতে সকল হিসাব রাখিত। একদিন মতিলালের ইচ্ছা হইল যে ইংরাজী ক্যাশবহি বোঝা ভাল, এজন্য কেরানীর নিকট হইতে চাহিয়া আনাইয়া একবার এদিক-ওদিক দেখিয়া বহিখানি এক পাশে রাখিয়া দিলেন। মতিলাল আপীসের নীচের ঘরে বসিতেন – ঘরটি কিছু সেতঁসেতেঁ – ক্যাশবহি সেখানে মাসাবধি থাকাতে সর্দিতে খারাব হইয়া গেল ও নববাবুরা তাহা হইতে কাগজ চিরিয়া লইয়া সলতের ন্যায় পাকাইয়া প্রতিদিন কান চুলকাইতে আরম্ভ করিলেন – অল্প দিনের মধ্যেই বহির যাবতীয় কাগজ ফুরাইয়া গেল কেবল মিলাটটি পড়িয়া রহিল। অনন্তর ক্যাশবহির অন্বেষণ হওয়াতে দৃষ্ট হইল যে, তাহার ঠাটখানা আছে, অস্থি ও চর্ম পরহিতার্থে প্রদত্ত হইয়াছে। জান সাহেব হা ক্যাশবহি জো ক্যাশবহি বলিয়া বিলাপ করত মনের খেদ মনেই রাখিলেন।
জান সাহেব বেধড়ক ও দুচকোব্রত জিনিসপত্র খরিদ করিয়া বিলাতে ও অন্যান্য দেশে পাঠাইতে আরম্ভ করিলেন – জিনিসের কি পরতা হইল ও কাটতি কি রূপ হইবে তাহার কিছুমাত্র খোঁজ-খবর করিতেন না। এই সুযোগ পাইয়া বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা চিলের ন্যায় ছোবল মারিতে লাগিলেন, তাহাতে তাহাদিগের পেট মোটা হইল – অল্পে তৃষ্ণা মেটে না – রাতদিন খাই-খাই শব্দ ও আজ হাতীশালার হাতী খাব, কাল ঘোড়াশালার ঘোড়া খাব, দুইজনে নির্জনে বসিয়া কেবল এই মতলব করিতেন। তাঁহারা ভাল জানিতেন যে তাঁহাদিগের এমন দিন আর হইবে না – লাভের বসন্ত অস্ত হইয়া অলাভের হেমন্ত শীঘ্রই উদয় হইবে অতএব নে থোরই সময় এই।
দুই-এক বৎসরের মধ্যেই জিনিসপত্রের বিক্রির বড় মন্দ খবর আইল – সকল জিনিসেতেই লোকসান বই লাভ নাই। জান সাহেব দেখিলেন যে লোকসান প্রায় লক্ষ টাকা হইবে – এই সংবাদে বুকদাবা পাইয়া তাঁহার একেবারে চক্ষুস্থির হইয়া গেল আর তিনি মাসে মাসে প্রায় এক হাজার টাকা করিয়া খরচ করিয়াছেন, তদ্ব্যতিরেকে বেঙ্কে ও মহাজনের নিকটও অনেক দেনা – আপিস কয়েক মাসাবধি তলগড় ও ঢালসুমরে চলিতেছিল এক্ষণে বাহিরে সম্ভ্রমের নৌকা একেবারে ধুপুস্ করিয়া ডুবে গেল, প্রচার হইল যে জান কোম্পানী ফেল হইল। সাহেব বিবি লইয়া চন্দননগরে প্রস্তান করিলেন। ঐ শহর ফরাসীদিগের অধীন – অদ্যাবধি দেনাদার ফৌজদারি মামলার আসামীরা কয়েদের ভয়ে ঐ স্থানে যাইয়া পলাইয়া থাকে।
এদিকে মহাজন ও অন্যান্য পাওনাওয়ালারা আসিয়া মতিলালকে ঘেরিয়া বসিল। মতিলাল চারিদিক শূন্য দেখিতে লাগিলেন – এক পয়সাও হাতে নাই – উট্নাওয়ালাদিগের নিকট হইতে উট্না লইয়া তাঁহার খাওয়া-দাওয়া চলিতেছিল এক্ষণে কি বলবেন ও কি করিবেন কিছুই ঠাওরাইয়া পান না, মধ্যে মধ্যে ঘাড় উঁচু করিয়া দেখেন বাঞ্ছারামবাবু ও ঠকচাচা আইলেন কি-না, কিন্তু দাদার ভরসায় বাঁইয়ে ছুরি, ঐ দুই অবতার তুলতামালের অগ্রেই চম্পট দিয়াছেন। তাহাদিগের নাম উল্লেখ হইলে পাওনাওয়ালারা বলিল যে চিঠিপত্র মতিবাবুর নামে, তাহাদিগের সহিত আমাদিগের কোনো এলেকা নাই, তাহারা কেবল কারপরদাজ বই তো নয়।
এইরূপ গোলযোগ হওয়াতে মতিলাল দলবল সহিত ছদ্মবেশে রাত্রিযোগে বৈদ্যবাটীতে পালাইয়া গেলেন। সেখানকার যাবতীয় লোক তাঁহার বিষয়কর্মের সাত কাণ্ড শুনিয়া খুব হয়েছে খুব হয়েছে বলিয়া হাততালি দিতে লাগিল ও বলিল – আজও রাতদিন হচ্ছে – যে ব্যক্তি এমতো অসৎ – যে আপনার মাকে ভাইকে ভগিনীকে বঞ্চনা করিয়াছে – পাপকর্মে কখনই বিরত হয় নাই, তাহার যদি এরূপ না হবে তবে আর ধর্মাধর্ম কি?
কর্মক্রমে প্রেমনারায়ণ মজুমদার পরদিন বৈদ্যবাটীর ঘাটে স্নান করিতেছিল – তর্কসিদ্ধান্তকে দেখিয়া বলিল – মহাশয় শুনেছেন – বিট্কেলরা সর্বস্ব খুয়াইয়া ওয়ারিণের ভয়ে আবার এখানে পালিয়ে আসিয়াছে – কালামুখ দেখাইতে লজ্জা হয় না! বাবুরাম ভাল মুষলং কুলনাশনং রাখিয়া গিয়াছেন। তর্কসিদ্ধান্ত কহিলেন – ছোড়াদের না থাকতে গ্রামটা জুড়িয়ে ছিল – আবার ফিরে এল? আহা! মা গঙ্গা একটু কৃপা করলে যে আমরা বেঁচে যাইতাম। অন্যান্য অনেক ব্রাহ্মণ স্নান করিতেছিলেন – নববাবুদিগের প্রত্যাগমনের সংবাদ শুনিয়া তাঁহাদিগের দাঁতে দাঁতে লেগে গেল, ভাবিতে লাগিলেন যে আমাদিগের স্নান-আহ্ণিক বুঝি অদ্যাবধি শ্রীকৃষ্ণায় অর্পণ করিতে হইবে। দোকানী পসারীরা ঘাটের দিকে দেখিয়া বলিল – কই গো। আমরা শুনিয়াছিলাম যে মতিবাবু সাত সুলুক ধন লইয়া দামামা বাজিয়ে উঠিবেন – এমন সুলুক দূরে যাউক একখানা জেলে ডিঙিও যে দেখতে পাই না। প্রেমনারায়ণ বলিল – তোমরা ব্যস্ত হইও না – মতিবাবু কমলে কামিনীর মুশকিলের দরুন দক্ষিণ মশান প্রাপ্ত হইয়াছেন – বাবু অতি ধর্মশীল – ভগবতীর বরপুত্র – ডিঙে সুলুক ও জাহাজ ত্বরায় দেখা দিবে আর তোমরা মুড়ি কড়াই ভাজিতে ভাজিতেই দামামার শব্দ শুনিবে!
আলালের ঘরের দুলাল
২৪. শুদ্ধ চিত্তের কথা, ঠকচাচার জালকরণ জন্য গেরেপ্তারি – বরদাবাবুর দুঃখ, মতিলালের ভয়; বেচারাম ও বাঞ্ছারাম উভয়ের সাক্ষাৎ ও কথোপকথন।
প্রাতঃকালে মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে, – চম্পক, শেফালিকা ও মল্লিকার সৌগন্ধ ছুটিয়াছে। পক্ষিসকল চকুবুহ চকুবুহ করিতেছে – ঘটকের দরুনবাটীতে বেণীবাবু বরদাবাবুকে লইয়া কথাবার্তা কহিতেছেন। দক্ষিণ দিক থেকে কতকগুলো কুকুর ডাকিয়া উঠিল ও রাস্তার ছোঁড়ারা হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল – গোল একটু নরম হইলে “দূঁর দূঁর” ও “গোপীদের বাড়ি যেও না করি রে মানা” এই খোনা স্বরের আনন্দলহরী কর্ণগোচর হইতে লাগিল। বেণীবাবু ও বরদাবাবু উঠিয়া দেখেন যে বহুবাজারের বেচারাম বাবু আসিতেছেন – গানে মত্ত, ক্রমাগত তুড়ি দিতেছেন। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করিতেছে – ছোঁড়ারা হো হো করিতেছে, বহুবাজারনিবাসী বিরক্ত হইয়া দূঁর দূঁর করিতেছেন। নিকটে আসিলে বেণীবাবু ও বারদাবাবু উঠিয়া সম্মানপূর্বক অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন। পরস্পর কুশলবার্তা জিজ্ঞাসানন্তর বেচারাম বাবু বারদাবাবুর গায়ে হাত দিয়া বলিলেন – ভাই হে। বাল্যাবধি অনেক প্রকার লোক দেখিলাম – অনেকেরই অনেক গুণ আছে বটে কিন্তু তাহাদিগকে দোষে-গুণে ভাল বালি – সে যাহা হউক, নম্রতা, সরলতা, ধর্ম বিষয়ে সাহস ও পর সম্পর্কীয় শুদ্ধচিত্ত তোমার যেমন আছে এমন কাহারও দেখিতে পাই না। আমি নিজে নম্রভাবে বলি বটে কিন্তু সময়বিশেষ অন্যের অহংকার দেখিলে আমার অহংকার উদয় হয় – অহংকার উদয় হইলেই রাগ উপস্থিত হয়, রাগে অহংকার বেড়ে উঠে। আমি কাহাকেও রেয়াত করি না – যখন যাহা মনে উদয় হয় তখন তাহাই মুখে বলি কিন্তু আমার নিজের দোষে তত সরলতা থাকে না – আপনি কোনো মন্দ কর্ম করিলে সেটি স্পষ্ট স্বীকার করিতে ইচ্ছা হয় না, তখন এই মনে হয় এ কথাটি ব্যক্ত করিলে অন্যের নিকট আপনাকে খাটো হইতে হইবে। ধর্ম বিষয়ে আমার সাহস অতি অল্প – মনে ভাল জানি অমুক কর্ম করা কর্তব্য কিন্তু আপন সংস্কার অনুসারে সর্বদা চলাতে সাহসের অভাব হয়। অন্য সম্বন্ধে শুদ্ধচিত্ত রাখা বড় কঠিন – আমি জানি বটে যে মনুষ্যদেহ ধারণ করিলে মনুষ্যের ভাল বই মন্দ কখনই চেষ্টা পাওয়া উচিত নহে কিন্তু এটি কর্মেতে দেখানো বড় দুষ্কর। যদি কেহ একটু কটু কথা বলে তবে তাহার প্রতি আর মন থাকে না – তাহাকে একেবারে মন্দ মনুষ্য বোধ হয় – তোমার কেহ অপকার করিলেও তাহার প্রতি তোমার মন শুদ্ধ থাকে – অর্থাৎ তাহার উপকার ভিন্ন অপকার করণে তোমার মন যায় না এবং যদি অন্যে তোমার নিন্দা করে তাহাতেও তুমি বিরক্ত হও না – এ কি কম গুণ?
বরদা। যে যাহাকে ভালবাসে সে তাহার সব ভাল দেখে আর যে যাহাকে দেখিতে পারে না সে তাহার চলনও বাঁকা দেখে। আপনি যাহা বলিলেন সে সকল অনুগ্রহের কথা – সে সকল আপনার ভালবাসার দরুন – আমার নিজ গুণের দরুন নহে। সকল সময়ে – সকল বিষয়ে – সকল লোকের প্রতি মন শুদ্ধ রাখা মনুষ্যের প্রায় অসাধ্য। আমাদিগের মনে রাগ, দ্বেষ, হিংসা ও অহংকারে ভরা – এ সকল সংযম কি সহজে হয়? চিত্তকে শুদ্ধ করিতে গেলে অগ্রে নম্রতা আবশ্যক – কাহার কাহার কপট নম্রতা দেখা যায় – কেহ কেহ ভয়প্রযুক্ত নম্র হয় – কেহ কেহ ক্লেশ অথবা বিপদে পড়িলে নম্র হইয়া থাকে – সে প্রকার নম্রতা ক্ষণিক, নম্রতার স্থায়িত্বের জন্য আমাদিগের মনে এই দৃঢ় সংস্কার হওয়া উচিত যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনিই মহৎ -তিনিই জ্ঞানময় – তিনিই নিষ্কলঙ্ক ও নির্মল, আমরা আজ আছি – কাল নাই, আমাদিগের বলই বা কি, আর বুদ্ধিই বা কি – আমাদিগের ভ্রম, কুমতি ও কুকর্ম দণ্ডে দণ্ডে হইতেছে তবে অহংকারের কারণ কি? এরূপ নম্রতা মনে জন্মিলে রাগ, দ্বেষ, হিংসা ও অহংকারের খর্বতা হইয়া আসে, তখন অন্য সমন্ধে শুদ্ধচিত্ত হয় – তখন আপন বিদ্যা, বুদ্ধি, ঐশ্বর্য ও পদের অহংকার প্রকাশ করত পরকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা যায় না – তখন পরের সম্পদ দেখিয়া হিংসা হয় না – তখন পরনিন্দা করিতে ও অন্যকে মন্দ ভাবিতে ইচ্ছা হয় না – তখন অন্যদ্বারা অপকৃত হইলেও তাহার প্রতি রাগ বা দ্বেষ উপস্থিত হয় না – তখন কেবল আপন চিত্ত শোধনে ও পরহিত সাধনে মন রত হয়, কিন্তু এরূপ হওয়া ভারি অভ্যাস ভিন্ন হয় না – এক্ষণে অল্প জ্ঞানযোগ হইলেই বিজাতীয় মাৎসর্য জন্মে – আমি যা বলি – আমি যা করি কেবল তাহাই সর্বোত্তম – অন্যে যা বলে বা করে তাহা অগ্রাহ্য।
বেচারাম। ভাই হে! কথাগুলা শুনে প্রাণ জুড়ায় – আমার সতত ইচ্ছা তোমার সহিত কথোপকথন করি।
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে প্রেমানারায়ণ মজুমদার তাড়াতারি করিয়া আসিয়া সম্বাদ দিল কলিকাতার পুলিসের লোকেরা এক জাল তহমতের মামলার দরুন ঠকচাচাকে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া যাইতেছে। বেচারাম বাবু এই কথা শুনিয়া খুব হয়েছে খুব হয়েছে বলিয়া হর্ষিত হইয়া উঠিলেন। বরদাবাবু স্তব্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিলেন।
বেচারাম। আবার যে ভাবছ? – অমন অসৎ লোক পুলিপলান গেলা দেশটা জুড়ায়।
বরদা। দুঃখ এই যে লোকটা আজন্মকাল অসৎ কর্ম বই সৎ কর্ম করিল না – এক্ষণে যদি জিঞ্জির যায় তাহার পরিবারগুলা অনাহারে মারা যাবে।
বেচারাম। ভাই হে! তোমার এত গুণ না হইলে লোকে তোমাকে কেন পূজা করে। তোমার প্রতিহিংসা ও অপকার করিতে ঠকচাচা কসুর করে নাই – অনবরত নিন্দা ও গ্লানি করিতে – তোমার উপর গুমখুনি নালিশ করিয়াছিল – ও জাল হপ্তম করিবার বিশেষ চেষ্টা পাইয়াছিল – তাহাতেও তোমার মনে তাহার প্রতি কিছুমাত্র রাগ অথবা দ্বেষ নাই ও প্রত্যুপকার কাহাকে বলে তুমি জানো না – তুমি এই প্রত্যুপকার করিতে যে, সে ব্যক্তি ও তাহার পরিবার পীড়ত হইলে ঔষধ দিয়া ও আনাগোনা করিয়া আরোগ্য করিত। এক্ষণেও তাহার পরিবারের ভাবনা ভাবিতেছ – ভাই হে! তুমি জেতে কায়স্থ বটে কিন্তু ইচ্ছা করে যে এমন কায়স্থের পায়ের ধুলা লইয়া মাথায় দিই।
বরদা। মহাশয়! আমাকে এত বলিবেন না – জনগণের মধ্যে আমি অতি হেয় ও অকিঞ্চন। আমি আপনার প্রশাংসার যোগ্য নহি – মহাশয় এরূপ পুনঃ পুনঃ বলিলে আমার অহংকার ক্রমে বৃদ্ধি হইতে পারে।
এদিকে বৈদ্যবাটীতে পুলিসের সারজন্, পেয়াদা ও দারোগা ঠকচাচাকে পিচ্মোড়া করিয়া বাঁধিয়া চল্ বলিয়া হিড় হিড় করিয়া লইয়া আসিতেছে। রাস্তায় লোকারণ্য – কেহ বলে, যেমন কর্ম তেমনি ফল – কেহ বলে, বেটা জাহাজে না উঠলে বিশ্বাস নাই – কেহ বলে, আমার এই ভয় পাছে ঢোঁড়া হয়। ঠকচাচা অধোবদনে চলিতেছে – দাড়ি বাতাসে ফুর ফুর করিয়া উড়িতেছে – দুটি চক্ষু কট্মট্ করিতেছে – বাঁধন খুলিবার জন্য সারজন্কে একটা আদুলি আস্তে আস্তে দিতেছে, সারজনের বড় পেট, এমনি আদুলি ঠিকুরে ফেলিয়া দিতেছে। ঠকচাচা বলে – মোকে একবার মতিবাবুর নজদিগে লিয়ে চলো – তেনার জামিন লিয়ে মোকে এজ খালস দেও – মুই কেল হাজির হব। সারজন্ বলছে – তোম বহুৎ বক্তা – ফের বাত কহেগা তো এক থাপ্পড় দেগা। তখন ঠকচাচা সারজনের নিকট হাতজোড় করিয়া কাকুতি মিনতি করিতে লাগিল। সারজন কোনো কথায় কান না দিয়ে ঠকচাচাকে নৌকায় উঠাইয়া বেলা দুই প্রহর চারি ঘণ্টার সময় পুলিসে আনিয়া হাজির করিল – পুলিসের সাহেবেরা উঠিয়া গিয়াছে সুতরাং ঠকচাচাকে রাত্রিতে বেনিগারদে বিহার করিতে হইল।
ওদিকে ঠকচাচার দুর্গতি শুনিয়া মতিলালের ভেবা-চাকা লেগে গেল। তাহার এই আশঙ্কা হইল এ বজ্রাঘাত পাছে এ পর্যন্ত পড়ে – যখন ঠক বাঁধা গেল তখন আমিও বাঁধা পড়িব তাহাতে সন্দেহ নাই – বোধ হয় এ ব্যাপার জান কোম্পানির ঘটিত, সে যাহা হউক, সাবধান হওয়া উচিত, এই স্থির করিয়া মতিলাল বাটীর সদর দরওয়াজা খুব কষে বন্ধ করিল। রামগোবিন্দ বলিল – বড়বাবু! ঠকচাচা জাল এত্তাহামে গেরেপ্তার হইয়াছে – তোমার উপর, গেরেপ্তারি থাকিলে বাটীঘর অনেকক্ষণ ঘেরা হইত, তুমি মিছে মিছে কেন ভয় পাও? মতিলাল বলিল – তোমরা বুঝ না হে! দুঃসময়ে পোড়া শোল মাছটাও হাত থেকে পালিয়ে যায়। আজকের দিনটা যো সো করিয়া কাটাইতে পারিলে কাল প্রাতে যশোহরের তালুকে প্রস্থান করি। বাটীতে আর তিষ্ঠনো ভার – নানা উৎপাত – নানা ব্যাঘাত – নানা আশঙ্কা – নানা উপদ্রব, আর এদিকে হাত খাঁকতি হইয়াছে। এই কথা শেষ হইবামাত্রেই দ্বারে টিপ্ টিপ্ করিয়া ঘা পড়িতে লাগিল – ”দ্বার খোলো গো – কে আছে গো” এই শব্দ হইতে লাগিল। মতিলাল আস্তে আস্তে বলিল – চুপ করো – যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহাই ঘটিল। মানগোবিন্দ উপর থেকে উঁকি মারিয়া দেখিল একজন পেয়াদা দ্বার ঠেলিতেছে – অমনি টিপেটিপে আসিয়া বলিল – বড়বাবু! এই বেলা প্রস্থান করো, বোধ হয় ঠকচাচা দরুন বাসী গেরেপ্তারি উপস্থিত – আগুনের ফিনকি শেষ হয় নাই। যদি নির্জন স্থান না পাও তবে খিড়কির পানা পুষ্করিণীতে দুর্যোধনের ন্যায় জলস্তম্ভ করে থাকো। দোলগোবিন্দ বলিল – তোমরা ঢেউ দেখে লা ডুবাও কেন? আগে বিষয়টা তলিয়ে বুঝ, বোসো আমি জিজ্ঞাসা করি – কেমন হে পেয়াদাবাবু তুমি কোন্ আদালত হইতে আসিয়াছ? পেয়াদা বলিল – এজ্ঞে মুই জান সাহেবের চিঠি লিয়ে এসেছি – চিঠি এই লেও – বলিয়া ধাঁ করিয়া উপরে ফেলিয়া দিল। রাম বাঁচলুম! এতক্ষণে ধরে প্রাণ এল – সকলে বলিয়া উঠিল। অমনি পেছন দিক থেকে হলধর ও গদাধর “ভবে ত্রাণ করো” ধরিয়া উঠিল, নববাবুদের শরতের মেঘের ন্যায় – এই বৃষ্টি – এই রৌদ্র – এই গর্মি – এই খুশি। মতিলাল বলিল, একটু থামো – চিঠিখানা পড়িতে দেও – বোধ করি কর্মকাজের আবার সুযোগ হইবে। মতিলাল চিঠি খুলিলে পরে নববাবুরা সকলে হুমড়ি খাইয়া পড়িল – অনেকগুলো মাথা জড়ো হইল বটে কিন্তু কাহারো পেটে কালির অক্ষর নাই, চিঠি পড়া ভারি বিপত্তি হইল। অনেকক্ষণ পরে নিকটস্থ দে-দের বাটীর একজনকে ডাকাইয়া চিঠির মর্ম এই জানা হইল যে, জান সাহেবের প্রায় অনাহারে দিন যাইতেছে – তাহার টাকার বড় দরকার। মানগোবিন্দ বলিল – বেটা বড় বেহায়া – তাহার জন্যে এত টাকা গর্ভস্রাবে গেল তবু ছিড়েন নাই, আবার কোন মুখে টাকা চায়? দোলগোবিন্দ বলিল – ইংরাজকে হাতে রাখা ভাল – ওদের পাতা চাপা কপাল – সময় বিশেষে মাটি মুটটা ধরিলে সোনা মুটটা হইয়া পড়ে। মতিলাল বলিল – তোমরা বকাবকি কেন করো আমাকে কাটিলেও রক্ত নাই – কুটিলেও মাংস নাই।
এখানে বালি হইতে বেচারাম বাবু পার হইয়া বৈকালে ছক্ড়া গাড়িতে ছড়র ছড়র শব্দে “সেই যে ভস্মমাখা জটে – যত দেখো ঘটে পটে সকল জটের মুটে” এই গান গাইতে গাইতে উত্তরমুখো চলিয়াছেন – দক্ষিণ দিক থেকে বাঞ্ছারাম বগি হাঁকাইয়া আসিতেছেন – দুইজনে নেক্টা-নেক্টি হওয়াতে ইনি ওঁকে ও উনি একে হুমড়ি খাইয়া দেখিলেন – বাঞ্ছারাম বেচারামের আবছায়া দেখিবা মাত্রেই ঘোড়াকে সপাসপ্ চাবুক কষিয়া দিলেন – বেচারাম অমনি তাড়াতাড়ি আপন গাড়ির ডল্কা দ্বার হাত দিয়া কষে ধরিয়া ও মাথা বাহির করিয়া “ওহে বাঞ্ছারাম! ওহে বাঞ্ছারাম!” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিলেন। এই ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকিতে বগি খাড়া হইল ও ছক্ড়া ছননন্ ছননন্ করিয়া নিকটে গেল। বেচারাম বাবু বলিলেন – বাঞ্ছারাম! কপালে পুরুষ – তোমার লাভের খুলি রাবণের চুলির মতো জ্বলছে – এক দফা তো সৌদাগরি কর্ম চৌচাপটে করলে – এক্ষণে তোমার ঠকচাচা যায় – বোধ হয় তাহাতেও আবার একটা মুড়ি পট্তে পারে – কেবল উকিলি ফন্দিতে অধঃপাতে গেলে – মরিতে যে হবে – সেটা একবারও ভাবলে না?
বাঞ্ছারাম বিরক্ত হইয়া মুখখানা গোঁজ করিলে পর গোঁপ জোড়াটা ফর ফর করিয়া ঘোড়ার পিটের উপর আপনার গায়ের জ্বালা প্রকাশ করিতে করিতে গড়্ গড়্ করিয়া চলিয়া গেলেন।
আলালের ঘরের দুলাল
২৫. মতিলালের যশোহর জমিদারিতে দলবল সহিত গমন – জমিদারী কর্মকরণের বিবরণ; নীলকরের সঙ্গে দাঙ্গা ও বিচারে নীলকরের খালাস।
বাবুরামবাবুর সকল বিষয় অপেক্ষা যশোহরের তালুকখানি লাভের বিষয় ছিল। দশসালা বন্দোবস্তের সময়ে ঐ তালুকে অনেক পতিত জমি থাকে – তাহার জমা ডৌলে মুসমা ছিল পরে ঐ সকল জমি হাঁসিল হইয়া মাঠ-হারে বিলি হয় ও ক্রমেই জমির এত গুমর হইয়াছিল যে, প্রায় এক কাঠাও খামার বা পতিত ছিল না, প্রজালোকও কিছুদিন চাষাবাদ করিয়া হরবিরূ ফসলের দ্বারা বিলক্ষণ যোত্র করিয়াছিল কিন্তু ঠকচাচার পরামর্শে অনেকের উপর পীড়ন হওয়াতে প্রজারা সিকস্ত হইয়া পড়িল – অনেকে লাখেরাজদারের জমি বাজেয়াপ্ত হওয়াতে ও তাহাদিগের সনন্দ না থাকাতে
তাহারা কেবল আনাগোনা করিয়া ও নজর সেলামী দিয়া ক্রমে ক্রমে প্রস্থান করিল ও অনেক গাঁতিদারও জাল ও জুলুমে ভাজাভাজা হইয়া বিনি মূল্যে আপন আপন জমির স্বত্ব ত্যাগ করত অন্য অন্য অধিকারে পলায়ন করিল। এই কারণে তালুকের আয় দুই-এক বৎসর বৃদ্ধি হওয়াতে ঠকচাচা গোঁপে চাড়া দিয়া হাত ঘুরাইয়া বাবুরামবাবুর নিকট বলিতেন – ”মোর কেমন কারদানি দেখো” কিন্তু “ধর্মস্য সূক্ষ্মা গতিঃ” – অল্পদিনের মধ্যেই অনেক প্রজা ভয়ক্রমে হেলে গোরু ও বীজধান লইয়া প্রস্থান করিল। তাহাদিগের জমি বিলি করা ভার হইল, সকলেরই মনে এই ভয় হইতে লাগিল আমরা প্রাণপণ পরিশ্রমে চাষাবাস করিব দু-টাকা দু-সিকি লাভ করিয়া যে একটু শাঁসালো হবে তাহাকেই জমিদার বল বা ছলক্রমে গ্রাস করবেন – তবে আমাদিগের এ অধিকার থাকার কি প্রয়োজন? তালুকের নায়েব বাপু-বাছা বলিয়াও প্রজালোককে থামাইতে পারিল না। অনেক জমি গরবিলি থাকিল – ঠিকে হারে বিলি হওয়া দূরে থাকুক কম দস্তুরেও কেহ লইতে চাহে না ও নিজ আবাদে খরচ খরচা বাদে খাজনা উঠানো ভার হইল। নায়েব সর্বদাই জমিদারকে এত্তেলা দিতেন, জমিদার সুদামতো পাঠ লিখিতেন – ”গোগেস্তা সুরত খাজনা আদায় না হইলে তোমার রুটি যাইবে – তোমার কোনো ওজর শুনা যাইবে না।” সময়বিশেষ বিষয় বুঝিয়া ধমক দিলে কর্মে লাগে। যে স্থলে উৎপাত ধমকের অধিন নহে সে স্থলে ধমক কি কর্মে আসিতে পারে? নায়েব ফাঁপরে পড়িয়া গয়ং গচ্ছরূপে আমতা আমতা করিয়া চলিতে লাগিল – এদিকে মহল দুই-তিন বৎসর বাকি পড়াতে লাটবন্দী হইল সুতরাং বিষয় রক্ষার্থে গিরিবি লিখিয়া দিয়া বাবুরামবাবু দেনা করিয়া সরকারের মালগুজারি দাখিল করিতেন।
এক্ষণে মতিলাল দলবল সহিত মহলে আসিয়া অবস্থিতি করিল। তাহার মানস এই যে, তালুক থেকে কষে টাকা আদায় করিয়া দেনা-টেনা পরিশোধ করিয়া সাবেক ঠাট বজায় রাখিবে। বাবু জমিদারী কাগজ কখন দৃষ্টি করেন নাই, কাহাকে বলে চিঠা, কাহাকে বলে গোসোয়ারা, কাহাকে বলে জমাওয়াসিল বাকি কিছুই বোধ নাই। নায়েব বলে – হুজুর! একবার লতাগুলান দেখুন – বাবু কাগজের লতার উপর দৃষ্টি না করিয়া কাছারিবাটীর তরুলতার দিকে ফেল্ ফেল্ করিয়া দেখে! নায়েব বলে, মহশয়! এক্ষণে গাঁতি অর্থাৎ খোদকস্তা প্রজা এত ও পাইকস্তা এত। বাবু বলেন― আমি খোদকস্তা, পাইকস্তা শুনতে চাই না – আমি সব এককস্তা করিব। বড়বাবু ডিহির কাছারিতে আসিয়াছেন এই সংবাদ শুনিয়া যাবতীয় প্রজা একেবারে ধেয়ে আইল ও মনে করিল বদ্জাত নেড়ে বেটা গিয়েছে, বুঝি এত দিনের পর আমাদিগের কপাল ফিরিল। এই কারণে আহ্লাদিতচিত্তে ও সহাস্যবদনে রুক্ষচুলো, শুখনোপেটা ও তলাখাঁক্তি প্রজারা নিকটে আসিয়া সেলামী দিয়া “রবধান” ও “স্যালাম” করিতে লাগিল। মতিলাল ঝনাঝন্ শব্দে স্তুব্ধ হইয়া লিক্ লিক্ করিয়া হাসিতেছেন। বাবুকে খুশি দেখিয়া প্রজারা দাদ্খাই করিতে আরম্ভ করিল। কেহ বলে, অমুক আমার জমির আল ভাঙিয়া লাঙ্গল চষিয়াছে – কেহ বলে, অমুক আমার খেজুরগাছে ভাঁড় বাঁধিয়া রস চুরি করিয়াছে – কেহ বলে, অমুক আমার বাগানে গোরু ছাড়িয়া দিয়া তচ্নচ্ করিয়াছে – কেহ বলে, অমুকের হাঁস আমার ধান খাইয়াছে – কেহ বলে, আমি আজ তিন বৎসর কবজ পাই না – কেহ বলে, আমি খতের টাকা আদায় করিয়াছি, আমার খত ফেরত দাও – কেহ বলে – আমি বাবলা গাছটি কেটে বিক্রি করিয়া ঘরখানি সারাইব – আমাকে চৌট মাফ করিতে হুকুম হউক – কেহ বলে, আমার জমির খারিজ দাখিল হয় নাই আমি তার সেলামি দিতে পারিব না – কেহ বলে, আমার জোতের জমি হাল জরিপে কম হইয়াছে – আমার খজনা মুসমা দেও, তা না হয় তো পরতাল করে দেখো – মতিলাল এ সকল কথার বিন্দু বিসর্গ না বুঝিয়া চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় বসিয়া থাকিলেন। সঙ্গী বাবুরা দুই-একটা অন্খা শব্দ লইয়া রঙ্গ করত খিল্ খিল্ হাসিয়া কাছারিবাটী ছেয়ে দিতে লাগিল ও মধ্যে মধ্যে “উড়ে যায় পাখী তার পাখা গুণি” গান করিতে লাগিল। নায়েব একেবারে কাষ্ঠ, প্রজারা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।
যেখানে মনিব চৌকস, সেখানে চাকরের কারিকুরি বড় চলে না। নায়েব মতিলালকে গোমুর্খ দেখিয়া নিজমূর্তি ক্রমে ক্রমে প্রকাশ করিতে লাগিল। অনেক মামলা উপস্থিত হইল, বাবু তাহার ভিতর কিছুই প্রবেশ করিতে পারিলেন না, নায়েব তাঁহার চক্ষে ধুলা দিয়া আপন ইষ্ট সিদ্ধ করিতে লাগিল আর প্রজারাও জানিল যে, বাবুর সহিত দেখা করা কেবল অরণ্যে রোদন করা – নায়েবই সর্বময় কর্তা।
যশোহরে নীলকরের জুলুম অতিশয় বৃদ্ধি হইয়াছে। প্রজারা নীল বুনিতে ইচ্ছুক নহে কারণ ধান্যাদি বোনাতে অধিক লাভ, আর যিনি নীলকরের কুঠিতে যাইয়া একবার দাদন লইয়াছেন, তাহার দফা একেবারে রফা হয়। প্রজারা প্রাণপণে নীল আবাদ করিয়া দাদনের টাকা পরিশোধ করে বটে কিন্তু হিসাবের লাঙ্গুল বৎসর বৃদ্ধি হয় ও কুঠেলের গোমস্তা ও অন্যান্য কারপরদাজের পেট অল্পে পুরে না। এইজন্য যে প্রজা একবার নীলকরের দাদনের সুধামৃত পান করিয়াছে সে আর প্রাণান্তে কুঠির মুখো হইতে চায় না কিন্তু নীলকরের নীল না তৈয়ার হইলে ভারি বিপত্তি। সম্বৎসর কলিকাতার কোনো না কোনো সৌদাগরের কুঠি হইতে টাকা কর্জ লওয়া হইয়াছে এক্ষণে যদ্যপি নীল তৈয়ার না হয় তবে কর্জ বৃদ্ধি হইবে ও পরে কুঠি উঠিয়া গেলেও যাইতে পারিবে। অপর যে সকল ইংরাজ কুঠির কর্ম কাজ দেখে তাহারা বিলাতে অতি সামান্য লোক কিন্তু কুঠিতে শাজাদার চেলে চলে – কুঠির কর্মের ব্যাঘাত হইলে তাহদিগের এই ভয় যে, পাছে তাহাদিগের আবার ইঁদুর হইতে হয়। এই কারণে নীল তৈয়ার করণার্থ তাহারা সর্বপ্রকারে, সর্বতোভাবে, সবসময়ে যত্নবান হয়।
মতিলাল সঙ্গীগণকে লইয়া হো হো করিতেছেন – নায়েব নাকে চশমা দিয়া দপ্তর খুলিয়া লিখিতেছে ও চুনো বুলাইতেছে, এমতো সময়ে কয়েকজন প্রজা দৌড়ে আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিল – মোশাই গো! কুঠেল বেটা মোদের সর্বনাশ করলে – বেটা সরে জমিতে আপনি এসে মোদের বুননি জমির উপর লাঙ্গল দিতেছে ও হাল-গরু সব ছিনিয়ে নিয়েছে – মোশাই গো! বেটা কি বুননি নষ্ট করলে। শালা মোদের পাকা ধানে মই দিলে। নায়েব অমনি শতাবধি পাক-সিক জড়ো করিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া দেখে কুঠেল এক শোলার টুপি মাথায় – মুখে চুরুট – হাতে বন্দুক – খাড়া হইয়া হাঁকাহাঁকি করতেছে। নায়েব নিকটে যাইয়া মেঁও মেঁও করিয়া দুই-একটা কথা বলিল, কুঠেল হাঁকায় দেও হাঁকায় দেও, মার মার হুকুম দিল। অমনি দুই পক্ষের লোক লাঠি চালাইতে লাগিল – কুঠেল আপনি তেড়ে এসে গুলী ছুঁড়িবার উপক্রম করিল – নায়েব সরে গিয়া একটা রাংচিত্রের বেড়ার পার্শ্বে লুকাইল। ক্ষণেক কাল মারামারি লাঠালাঠি হইলে পর জমিদারের লোক ভেগে গেল ও কয়েক জন ঘায়েল হইল। কুঠেল আপন বল প্রকাশ করিয়া ডেংডেং করিয়া কুঠিতে চলে গেল ও দাদখায়ী প্রজারা বাটিতে আসিয়া “কি সর্বনাশ” “কি সর্বনাশ” বলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
নীলকরসাহেব দাঙ্গা করিয়া কুঠিতে যাইয়া বিলাতি পানি ফটাস্ করিয়া ব্রান্ডি দিয়া খাইয়া শিস দিতে দিতে “তাজা বতাজা” গান করিতে লাগিলেন – কুকুরটা সম্মুখে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করিতেছে। তিনি মনে জানেন তাহাকে কাবু করা বড় কঠিন, ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ্ তাঁহার ঘরে সর্বদা আসিয়া খানা খান ও তাঁহাদিগের সহিত সহবাস করাতে পুলিসের ও আদালতের লোক তাঁহাকে যম দেখে আর যদিও তদারক হয় তবু খুন অথবা অন্য প্রকার গুরুতর দোষ করিলে মফস্বল আদালতে তাহাদিগের সদ্য বিচার হইয়া সাজা হয় – গোরা লোক ঐ সকল দোষ করিলে সুপ্রিম কোর্টে চালান হয় তাহাতে সাক্ষী অথবা ফৈরাদিরা ব্যয়, ক্লেশ ও কর্মক্ষতি জন্য নাচার হইয়া অস্পষ্ট হয় সুতরাং বড় আদালতে উক্ত ব্যক্তিদের মকদ্দমা বিচার হইলেও ফেঁসে যায়।
নীলকর যা মনে করিয়াছেন, তাহাই ঘটিল। পরদিন প্রাতে দারোগা আসিয়া জমিদারের কাছারি ঘিরিয়া ফেলিল। দুর্বল হওয়া বড় আপদ্ – সবল ব্যক্তির নিকট কেহই এগুতে পারে না। মতিলাল এই ব্যাপার দেখিয়া ঘরের ভিতর যাইয়া দ্বার বন্ধ করিল। নায়েব সম্মুখে আসিয়া মোটমাট চুক্তি করিয়া অনেকের বাঁধন খুলিয়া দেওয়াইল। দারোগা বড়ই সোরসারাবত করিতেছিল – টাকা পাইবামাত্র যেন আগুনে জল পড়িল। পরে তদারক করিয়া দারোগা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দু-দিক বাঁচাইয়া রিপোর্ট করিল – এদিকে লোভ ওদিকে ভয়। নীলকর অমনি নানা প্রকার জোগাড়ে ব্যস্ত হইল ও ম্যাজিস্ট্রেটের মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইতে লাগিল যে, নীলকর ইংরাজ খ্রীষ্টিয়ান – মন্দ কর্ম কখনই করিবে না – কেবল কালা লোক যাবতীয় দুষ্কর্ম করে। এই অবকাশে সেরেস্তাদার ও পেস্কার নিলকরের নিকট হইতে জেয়াদা ঘুষ লইয়া তাহার বিপক্ষে জবানবন্দী চাপিয়া স্বপক্ষীয় কথা সকল পড়িতে আরম্ভ করিল ও ক্রমশ ছুঁচ চালাইতে চালাইতে বেটে চালাইতে লাগিল। এই অবকাশে নীলকর বক্তৃতা করিল – আমি এ স্থানে আসিয়া বাঙালীদিগের নানা প্রকার উপকার করিতেছি – আমি তাহাদিগের লেখাপড়া ও ঔষধপত্রের জন্য বিশেষ ব্যয় করিতেছি – আবার আমার উপর এই তহমত? বাঙালীরা বড় বেঈমান ও দাঙ্গাবাজ। ম্যাজিস্ট্রেট এই সকল কথা শুনিয়া টিফিন করিতে গেলেন। টিফিনের পর খুব চুর্চুরে মধুপান করিয়া চুরুট খাইতে খাইতে আদালতে আইলেন – মকদ্দমা পেশ হইলে সাহেব কাগজ পত্রকে বাঘ দেখিয়া সেরেস্তাদারকে একেবারে বলিলেন – ”এ মামলা ডিসমিস করো” এই হুকুমে নীলকরের মুখটা একেবারে ফুলিয়া উঠিল, নায়েবের প্রতি তিনি কট্মট্ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। নায়েব অধোবদনে ঢিকুতে ঢিকুতে – ভুঁড়ি নাড়িতে নাড়িতে বলিতে বলিতে চলিলেন – বাঙালীদের জমিদারী রাখা ভার হইল – নীলকর বেটাদের জুলুমে মুলুক খাক হইয়া গেল – প্রজারা ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে। হাকিমরা স্বজাতির অনুরোধে তাহাদিগের বশ্য হইয়া পড়ে আর আইনের যেরূপ গতিক তাহাতে নীলকরদের পালাইবার পথও বিলক্ষণ আছে। লোকে বলে জমিদারের দৌরাত্ন্যে প্রজার প্রাণ গেল–এটি বড় ভুল। জমিদারেরা জুলুম করে বটে কিন্তু প্রজাকে যতনে বজায় রেখে করে, প্রজা জমিদারের বেগুনক্ষেত। নীলকর সে রকমে চলে না – প্রজা মরুক বা বাঁচুক তাহাতে তাহার বড় এসে যায় না – নীলের চাষ বেড়ে গেলেই সব হইল – প্রজা নীলকরের প্রকৃত মূলার ক্ষেত।