» » আলালের ঘরের দুলাল

বর্ণাকার

আলালের ঘরের দুলাল

১৬. ঠকচাচার বাটীতে ঠকচাচীর নিকট পরিচয় দান ও তাহাদিগের কথোপকথন, তন্মধ্যে বাবুরামবাবুর ডাক ও তাঁহার সহিত বিষয় রক্ষার পরামর্শ।

ঠকচাচার বাড়িটি শহরের প্রান্তভাগে ছিল— দুই পার্শ্বে নানা পুষ্করিণী, সম্মুখে একটি পীরের আস্তানা। বাটীর ভিতরে ধানের গোলা, উঠানে হাঁস, মুরগী দিবারাত্রি চরিয়া বেড়াইত। প্রাতঃকাল না হইতে হইতে নানা প্রকার বদমায়েশ লোক ঐ স্থানে পিল পিল করিয়া আসিত। কর্ম লইবার জন্য ঠকচাচা বহুরূপী হইতেন—কখন নরম—কখন গরম—কখন হাসিতেন—কখন মুখ ভারি করিতেন—কখন ধর্ম দেখাইতেন—কখন বল জানাইতেন। কাজকর্ম শেষ হইলে গোসল ও খানা খাইয়া বিবির নিকট বসিয়া বিদ্‌রির গুড়গুড়িতে ভড়র ভড়র তাঁমাক টানিতেন। সেই সময়ে তাঁহাদের স্ত্রী-পুরুষের সকল দুঃখ-সুখের কথা হইত। ঠকচাচী পাড়ার মেয়ে মহলে বড় মান্যা ছিলেন—তাহাদিগের সংস্কার ছিল যে তিনি তন্ত্রমন্ত্র, গুণকরণ, বশীকরণ, মারণ-উচ্চাটন, তুকতাক, জাদু, ভেল্কি ও নানা প্রকার দৈব বিদ্যা ভাল জানেন, এই কারণ নানারকম স্ত্রীলোক আসিয়া সর্বদাই ফুস-ফাস করিত। যেমন দেবা তেমনী দেবী—ঠকচাচা ও ঠকচাচী দু-জনেই রাজযোটক—স্বামী বুদ্ধির জোরে রোজগার করে, স্ত্রী বিদ্যার বলে উপার্জন করে। যে স্ত্রীলোক স্বয়ং উপার্জন করে তাহার একটু একটু গুমর হয়, তাহার নিকট স্বামীর নির্জলা মান পাওয়া ভার, এই জন্যে ঠকচাচাকে মধ্যে মধ্যে দুই-একবার মুখঝাম্‌টা খাইতে হইত। ঠকচাচী মোড়ার উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন— তুমি হর রোজ এখানে ওখানে ফিরে বেড়াও —তাতে মোর আর লেড়কাবালার কি ফয়দা? তুমি হর ঘড়ি বলো যে বহুত কাম, এতনা বাতে কি মোদের পেটের জ্বালা যায়। মোর দেল বড় চায় যে জরি জর পিনে দশজন ভাল ভাল রেন্ডির বিচে ফিরি, লেকেন রোপেয়া কড়ি কছুই দেখি না, তুমি দেয়ানার মতো ফের—চুপচাপ মেরে হাবিলিতে বসেই রই। ঠকচাচা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া বলিলেন—আমি যে কোশেশ করি তা কি বলব, মোর কেত্‌না ফিকির-কেত্‌না ফন্দি—কেত্‌না প্যাঁচ—কেত্‌না শেস্ত তা জবানিতে বলা যায় না, শিকার দন্তে এল এল হয় আবার পেলিয়ে যায়। আলবত শিকার জল্‌দি এসবে এই কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে এক জনা বাঁদী আসিয়া বলিল—বাবুরামবাবুর বাটী হইতে একজন লোক ডাকতে আসিয়াছে। ঠকচাচা অমনি স্ত্রীর পানে চেয়ে বলিল—দেখ্‌চ মোকে বাবু হরঘড়ি ডাকে—মোর বাত না হলে কোনো কাম করে না। মুইও ওক্ত বুঝে হাত মারবো।

বাবুরামবাবুর বৈঠকখানা বসিয়া আছেন। নিকটে বাহির সিমলের বাঞ্ছারামবাবু, বালীর বেণীবাবু ও বৌবাজারের বেচারাম বাবু বসিয়া গল্প করিতেছেন। ঠকচাচা গিয়া পালের গোদা হইয়া বসিলেন।

বাবুরাম। ঠকচাচা! তুমি এলে ভাল হল—লেটা তো কোনো রকমে মিট্‌চে না —মকদ্দমা করে করে কেবল পালকে জোলকে জড়িয়ে পড়ছি—এক্ষণে বিষয়-আশয় রক্ষা করবার উপায় কি?

ঠকচাচা। মরদের কামই দরবার করা —মকদ্দমা জিত হলে আফদ দফা হবে। তুমি একটুতে ডর করো কেন?

বেচারাম। আ মরি! কী মন্ত্রণাই দিতেছ? তোমা হতেই বাবুরামের সর্বনাশ হবে তার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই—কেমন বেণী ভায়া কি বলো?

বেণী। আমার মতে খানকে দু-খানা বিষয় বিক্রয় করিয়া দেনা পরিশোধ করা ও ব্যয় অধিক না হয় এমন বন্দোবস্ত করা আবশ্যক আর মকদ্দমা বুঝে পরিষ্কার করা কর্তব্য কিন্তু আমাদিগের কেবল বাঁশবনে রোদন করা—ঠকচাচা যা বলবেন সেই কথাই কথা।

ঠকচাচা। মুই বুক ঠুকে বলছি যেত্‌না মামলা মোর মারফত হচ্ছে সে সব বেলকুল ফতে হবে —আফদ বেলকুল মুই কেটিয়ে দিব—মরদ হইলে লড়াই চাই—তাতে ডর কি?

বেচারাম। ঠকচাচা। তুমি বরাবর বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছ। নৌকাডুবির সময়ে তোমার কুদরৎ দেখা গিয়াছে। বিবাহের সময় তোমার জন্যেই আমাদিগের এত কর্মভোগ, বরদাবাবুর উপর মিথ্যা নালিশ করিয়াও বড় বাহাদুরি করিয়াছ আর বাবুরামের যে যে কর্মে হাত দিয়াছ সেই সেই কর্ম বিলক্ষণই প্রতুল হইয়াছে। তোমার খুরে দণ্ডবৎ। তোমার সংক্রান্ত সকল কথা স্মরণ করিলে রাগ উপস্থিত হয়—তোমাকে আর কি বলি? দূঁর দূঁর!! বেণী ভায়া উঠ এখানে আর বসিতে ইচ্ছা করে না।


আলালের ঘরের দুলাল

১৭. নাপিত ও নাপ্‌তিনীর কথোপকথন, বাবুরামবাবুর দ্বিতীয় বিবাহকরণের বিচার ও পরে গমন।

বৃষ্টি খুব এক পশলা হইয়া গিয়াছে —পথঘাট পেঁচ পেঁচ সেঁত সেঁত করিতেছে —আকাশ নীল মেঘে ভরা —মধ্যে মধ্যে হড় মড় হড় মড় শব্দ হইতেছে, বেঙগুলা আশে-পাশে যাঁওকো যাঁওকো করিয়া ডাকিতেছে। দোকানী পসারীরা ঝাপ খুলিয়া তামাক খাইতেছে —বাদলার জন্যে লোকের গমনাগমন প্রায় বন্ধ —কেবল গাড়োয়ান চিৎকার করিয়া গাইতে গাইতে যাইতেছে ও দাসো কাঁদে ভার লইয়া “হ্যাংগো বিসখা সে যিবে মাথুরা” গানে মত্ত হইয়া চলিয়াছে। বৈদ্যবাটীর বাজারের পশ্চিমে কয়েক ঘর নাপিত বাস করিত। তাহাদিগের মধ্যে একজন বৃষ্টি জন্যে আপন দাওয়াতে বসিয়া আছে। এক একবার আকাশের দিকে দেখিতেছে ও এক একবার গুন গুন করিতেছে, তাহার স্ত্রী কোলের ছেলেটিকে আনিয়া বলিল —ঘর-কন্নার কর্ম কিছু থা পাইনে —হেদে! ছেলেটাকে একবার কাঁকে কর —এদিকে বাসন মাজা হয়নি, ওদিকে ঘর নিকোনো হয়নি, তার পর রাঁদা বাড়া আছে —আমি একলা মেয়েমানুষ এসব কি করে করব আর কোন্‌ দিগে যাব? —আমার কি চাট্টে হাত চাট্টে পা? নাপিত অমনি ক্ষুর ভাড় বগল দাবায় করিয়া উঠিয়া বলিল —এখন ছেলে কোলে করবার সময় নয় —কাল বাবুরামবাবুর বিয়ে, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। নাপ্‌তিনী চমকিয়া উঠিয়া বলিল —ও মা আমি কোজ্জাব? বুড়ো ঢোস্কা আবার বে করবে। আহা! ওমন গিন্নী —এমন সতী লক্ষ্মী —তার গলায় আবার একটা সতীন গেঁতে দেবে —মরণ আর কি! ও মা পুরুষ জাত সব করতে পারে! নাপিত আশাবায়ুতে মুগ্ধ হইয়াছে —ও সব কথা না শুনিয়া একটা টোকা মাথায় দিয়া সাঁ সাঁ করিয়া চলিয়া গেল।

সে দিবসটি ঘোর বাদলে গেল। পর দিবস প্রভাতে সূর্য প্রকাশ হইল —যেমন অন্ধকার ঘরে অগ্নি ঢাকা থাকিয়া হঠাৎ প্রকাশ হইলে আগুনের তেজ অধিক বোধ হয় তেমনি দিনকরের কিরণ প্রখর হইতে লাগিল —গাছপালা সকলই যেন পুনর্জীবন পাইল ও মাঠে-বাগানে পশু-পক্ষীর ধ্বনি প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। বৈদ্যবাটীর ঘাটে মেলা নৌকা ছিল। বাবুরামবাবু, ঠকচাচা, বক্রেশ্বর, বাঞ্ছারাম ও পাকসিক লোকজন লইয়া নৌকায় উঠিয়াছেন এমতো সময়ে বেণীবাবু ও বেচারাম বাবু আসিয়া উপস্থিত। ঠকচাচা তাহাদিগকে দেখেও দেখেন না —কেবল চিৎকার করিতেছেন —লা খোল দেও। মাঝিরা তকরার করিতেছে —আরে কর্তা অখন বাটা মরি নি গো —মোরা কি লগি ঠেলে, গুণ টেনে যাতি পারবো? বাবুরামবাবু উক্ত দুইজন আত্মীয়কে পাইয়া বলিলেন —তোমরা এলে হল ভাল, এসো সকলেই যাওয়া যাউক।

বেচারাম। বাবুরাম! এ বুড়ো বয়সে বে করতে তোমাকে কে পরামর্শ দিল?

বাবুরাম। বেচারাম দাদা। আমি এমন বুড়ো কি? তোমার চেয়ে আমি অনেক ছোট, তবে যদি বলো আমার চুল পেকেছে ও দাঁত পড়েছে —তা অনেকের অল্প বয়সেও হইয়া থাকে। সেটা বড় ধর্তব্য নয়। আমাকে এদিক্‌ ওদিক সব দিগেই দেখিতে হয়। দেখো একটা ছেলে বয়ে গিয়েছে আর একটা পাগল হয়েছে —একটি মেয়ে গত আর একটি প্রায় বিধবা। যদি এ পক্ষে দুই-একটি সন্তান হয় তো বংশটি রক্ষে হবে। আর বড় অনুরোধে পড়িয়াছি —আমি বে না করলে কনের বাপের জাত যায় —তাহাদিগের আর ঘর নাই।

বক্রেশ্বর। তা বটে তো —কর্তা কি সকল না বিবেচনা করে এ কর্মে প্রবর্ত হইয়াছেন। উঁহার চেয়ে বুদ্ধি ধরে কে?

বাঞ্ছারাম। আমরা কুলীন মানুষ —আমাদিগের প্রাণ দিয়ে কুল রক্ষা করিতে হয়, আর যে স্থলে অর্থের অনুরোধ সে স্থলে তো কোনো কথাই নাই।

বেচারাম। তোমার কুলের মুখেও ছাই —আর তোমার অর্থের মুখেও ছাই —জন কতক লোক মিলে একটা ঘরকে উচ্ছন্ন দিলে, দূঁর দূঁর! কেমন বেণী ভায়া কি বলো?

বেণী। আমি কি বলব? আমাদিগের কেবল অরণ্যে রোদন করা। ফলে এ বিষয়টিতে বড় দুঃখ হইতেছে। এক স্ত্রী সত্ত্বে অন্য স্ত্রীকে বিবাহ করা ঘোর পাপ। যে ব্যক্তি আপন ধর্ম বজায় রাখিতে চাহে সে এ কর্ম কখনই করিতে পারে না। যদ্যপি ইহার উল্টো কোনো শাস্ত্র থাকে সে শাস্ত্রমতে চলা কখনই কর্তব্য নহে। সে শাস্ত্র যে যথার্থ শাস্ত্র নহে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই, যদ্যপি এমন শাস্ত্রমতে চলা যায় তবে বিবাহের বন্ধন অতিশয় দুর্বল হইয়া পড়ে। স্ত্রীর মন পুরুষের প্রতি তাদৃশ থাকে না ও পুরুষের মন স্ত্রীর প্রতিও চল-বিচল হয়। এরূপ উৎপাত ঘটিলে সংসার সুধারা মতে চলিতে পারে না, এজন্য শাস্ত্রে বিধি থকলেও সে বিধি অগ্রাহ্য। সে যাহা হউক —বাবুরামবাবুর এমন স্ত্রী সত্ত্বে পুনরায় বিবাহ করা বড় কুকর্ম —আমি এ কথার বাষ্পও জানি না —এখন শুনিলাম।

ঠকচাচা। কেতাবীবাবু সব বাতেতেই ঠোকর মারেন। মালুম হয় এনার দুসরা কোই কাম-কাজ নাই। মোর ওমর বহুত হল —নূর বি পেকে গেল —মুই ছোকরাদের সাত হর ঘড়ি তকরার কি করব? কেতাবীবাবু কি জানেন এ শাদীতে কেতনা রোপেয়া ঘর ঢুকবে?

বেচারাম। আরে আবাগের বেটা ভূত! কেবল টাকাই চিনেছিস্‌ আর কি অন্য কোনো কথা নাই? তুই বড় পাপিষ্ঠ —তোকে আর কি বলবো —দূঁর দূঁর! বেণী ভায়া চলো আমরা যাই।

ঠকচাচা। বাতচিত পিচু হবে —মোরা আর সবুর করতে পারিনে। হাবলি যেতে হয় তো তোমরা জল্‌দি যাও।

বেচারাম বেণীবাবুর হাত ধরিয়া উঠিয়া বলিলেন —এমন বিবাহে আমরা প্রাণ থাকিতেও যাব না কিন্তু যদি ধর্ম থাকে তবে তুই যেন আস্তো ফিরে আসিস্‌নে। তোর মন্ত্রণায় সর্বনাশ হবে —বাবুরামের স্কন্ধে ভাল ভোগ করছিস্‌ —আর তোকে কি বলব? দূঁর দূঁর!!!


আলালের ঘরের দুলাল

১৮. মতিলালের দলবল সুদ্ধ বুড়ো মজুমদারের সহিত সাক্ষাৎ ও তাহার প্রমুখাৎ বাবুরামবাবুর দ্বিতীয় বিবহের বিবরণ ও তদ্বিষয়ে কবিতা।

সূর্য অস্ত হইতেছে — পশ্চিমদিকে আকাশ নানা রঙ্গে শোভিত। জলে-স্থলে দিবাকরের চঞ্চল আভা মৃদু মৃদু হাসিতেছে, — বায়ু মন্দ মন্দ বহিতেছে। এমতো সময়ে বাহিরে যাইতে কার না ইচ্ছা হয়? বৈদ্যবাটীর সরে রাস্তায় কয়েকজন বাবু ভেয়ে হো হো মার মার ধর ধর শব্দে চলিতেছে — কেহ কাহার ঘাড়ের উপর পড়িয়াছে — কেহ কাহার ঝাঁকা ফেলিয়া দিতেছে — কেহ কাহার খাদ্যদ্রব্য কাড়িয়া লইতেছে — কেহ বা লম্বা সুরে গান হাঁকিয়া দিতেছে — কেহ বা কুকুর ডাক ডাকিতেছে। রাস্তার দোধারি লোক পালাই পালাই ত্রাহি করিতেছে — সকলেই ভয়ে জড়সড় ও কেঁচো — মনে করিতেছে আজ বাঁচলে অনেকদিন বাঁচবো। যেমন ঝড় চারিদিগে তোল্‌পাড় করিয়া হু হু শব্দে বেগে বয়, নব বাবুদিগের দঙ্গল সেইমতো চলিয়াছে। এ গুণ পুরুষেরা কে? আর কে! এঁরা সেই সকল পুণ্যশ্লোক — এঁরা মতিলাল, হলধর, গদাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ, মানগোবিন্দ ও অন্যান্য দ্বিতীয় নলরাজা ও যুধিষ্ঠির। কোনো দিকে দৃক্‌পাত নেই — একেবারে ফুল্লারবিন্দ — মত্ততায় মাথা ভারি — গুমরে যেন গড়িয়া পড়েন। সকলে আপন মনেই চলিয়াছেন — এমন সময় গ্রামের বুড়ো মুজমদার, মাথায় শিক্কা ফর্‌ ফর্‌ করিয়া উড়িতেছে, একহাতে লাঠি ও আর একহাতে গোটা দুই বেগুন লইয়া ঠকর ঠকর করিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইল, অমনি সকলে তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া রং জুড়ে দিল। মজুমদার কিছু কানে খাটো — তাহারা জিজ্ঞাসা করিল — আরে কও তোমার স্ত্রী কেমন আছেন? মজুমদার উত্তর করিলেন — পুড়িয়ে খেতে হবে — অমনি তাহারা হাহা হাহা হো হো, লিক্‌ লিক্‌ ফিক্‌ ফিক্‌ হাসি ও গররায় ছেয়ে ফেলিল। মজুমদার মোহাড়া কাটাইয়া চম্পট দিতে চান কিন্তু তাঁহার ছাড়ান নাই। নব বাবুরা তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া গঙ্গার ঘাটের নিকট বসাইল। এক ছিলিম গুড়ুক খাওয়াইয়া বলিল — মজুমদার। কর্তার বের নাকালটা বিস্তারিত করিয়া বলো দেখি — তুমি কবি — তোমার মুখের কথা বড় মিষ্টি লাগে, না বল্‌লে ছেড়ে দিব না এবং তোমার স্ত্রীর কাছে এক্ষুণি গিয়া বলিব তোমার অপঘাত মৃত্যু হইয়াছে। মজুমদার দেখিল বিষম প্রমাদ, না বলিলে ছাড় নাই — লাচারে লাঠি ও বেগুন রাখিয়া কথা আরম্ভ করিল।

দুঃখের কথা আর কি বল্‌ব? কর্তার সঙ্গে গিয়ে ভাল আক্কেল পাইয়াছি। সন্ধ্যা হয় হয় এমতো সময়ে বলাগড়ের ঘাটে নৌকা লাগালো। কতোকগুলিন স্ত্রীলোক জল আনিতে আসিয়াছিল, কর্তাকে দেখিয়া তাহারা একটু ঘোমটা টানিয়া দিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো — আ মরি! কী চমৎকার বর! যার কপালে ইনি পড়বেন সে একেবারে এঁকে চাঁপা ফুল করে খোঁপাতে রাখবে। তাহাদিগরে মধ্যে একজন বলিল — বুড়ো হউক ছুড়ো হউক তবু একে মেয়েমানুষটা চক্ষে দেখতে পাবে তো? সেও তো অনেক ভাল। আমার যেমন পোড়া কপাল এমন যেনো আর কারো হয় না, ছয় বৎসরের সময় বে হয় কিন্তু স্বামী কেমন চক্ষে দেখনু না — শুনেছি তাঁর পঞ্চাশ-ষাটটি বিয়ে, বয়সে আশি বছরের উপর — থুরথুরে বুড়ো কিন্তু টাকা পেলে বে করতে আলেন না। বড় অধর্ম না হলে আর মেয়ে মানুষের কুলীনের ঘরে জন্ম হয় না। আর একজন বলিল — ওগো জল তোলা হয়ে থাকে তো চলে চল — ঘাটে এসে আর বাক্‌চাতুরীতে কাজ নাই — তোর তবু স্বামী বেঁচে আছে, আমার যার সঙ্গে বে হয় তাঁর তখন অন্তর্জলী হচ্ছিল। কুলীন বামুনদের কি ধর্ম আছে না কর্ম আছে — এ সব কথা বললে কি হবে? পেটের কথা পেটে রাখাই ভাল। মেয়েগুলার কথোপকথন শুনে আমার কিছু দুঃখ উপস্থিত হইল ও যাওন কালীন বেণীবাবুর কথা স্মরণ হইতে লাগিল। পরে বলাগড়ে উঠিয়া সাওয়ারির অনেক চেষ্টা করা গেল কিন্তু একজন কাহারও পাওয়া গেল না। লগ্ন ভ্রষ্ট হয় এজন্য সকলকে চলিয়া যাইতে হইল। কাদাতে হেঁকোচ হোঁকোচ করিয়া কন্যাকর্তার বাটিতে উপস্থিত হওয়া গেল। দঁকে পড়িয়া আমাদিগের কর্তার যে বেশ হইয়াছিল তাহা কি বল্‌ব? একটা এঁড়ে গোরুর উপর বসালেই সাক্ষাৎ মহাদেব হইতেন আর ঠকচাচা ও বক্রেশ্বরকে নন্দী ভৃঙ্গীর ন্যায় দেখাইত। শুনিয়াছিলাম যে দানসামগ্রী অনেক দিবে, দালানে উঠিয়া দেখিলাম সে গুড়ে বালি পড়িয়াছে। আশা ভগ্ন হওয়াতে ঠকচাচা এদিক ওদিক চান — গুম্‌রে গুম্‌র বেড়ান — আমি মুচকে মুচকে হাসি ও এক একবার ভাবি এস্থলে সাটে হেঁ হুঁ দেওয়া ভাল। বর স্ত্রীআচার করতে গেল, ছোট-বড় অনেক মেয়ে ঝুনুর ঝুনুর করিয়া চারিদিকে আসিয়া বর দেখিয়া আঁতকে পড়িল, যখন চারি চক্ষে চাওয়াচাওয়ি হয় তখন কর্তাকে চশমা নাকে দিতে হইয়াছিল — মেয়েগুলা খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া ঠাট্টা জুড়ে দিল — কর্তা ক্ষেপে উঠে ঠকচাচা ঠকচাচা বলিয়া ডাকেন — ঠকচাচা বাটীর ভিতর দৌড়ে যাইতে উদ্যত হন — অমনি কন্যাকর্তার লোকেরা তাহাকে আচ্ছা করে আল্‌গা আল্‌গা রকমে সেখানে শুইয়ে দেয় — বাঞ্ছারামবাবু তেরিয়া হইয়া উঠেন, তাঁরও উত্তম মাধ্যম হয়, বক্রেশ্বরও অর্ধচন্দ্রের দাপটে গলাফুলা পায়রা হন। এই সকল গোলযোগ দেখিয়া আমি বরযাত্রীদিগকে ছাড়িয়া কন্যাযাত্রীদিগের পালে মিশিয়া গেলুম, তারপরে কে কোথায় গেল তাহা কিছুই বলিতে পারি না কিন্তু ঠকচাচাকে ডুলি করিয়া আসিতে হইয়াছিল। — কথায় আছে লোভে পাপ — পাপে মৃত্যু। এক্ষণে যে কবিতা করিয়াছি তাহা শুন।—

ঠকচাচা মহাশয়, 

সদা করি মহাশয়,

বাবুরামে দেন কানে মন্ত্র।

বাবুরাম অঘা অতি,

হইয়াছে ভীমরথী,

ঠকবাক্য শ্রুতি স্মৃতি তন্ত্র ॥

ধনাশায়ে সদোন্মত্ত,

ধর্মাধর্ম নাহি তত্ত্ব

অর্থ কিসে থাকিবে বাড়িবে।

সদা এই আন্দোলন,

সৎকর্মে নাহি মন,

মন হইল করিবেন বিয়ে॥

সবে বলে ছিছি ছিছি,

এ বয়সে মিছামিছি,

নালা কেটে কেন আনো জল!

জাজ্বল্য যে পরিবার,

পৌত্র হইবে আবার,

অভাব তোমার কিসে বল॥

কোনো কথা নাহি শোনে,

স্থির করে মনে মনে,

ভারি দাঁও মারিব বিয়েতে।

করিলেন নৌকা ভাড়া,

চলিলেন খাড়া খাড়া,

স্বজন ও লোকজন সাতে ॥

বেণীবাবু মানা করে,

কে তাঁহার কথা ধরে,

ঘরে গিয়া ভাত তিনি খান।

বেচারাম সদা চটা,

ঠকে বলে ঠেঁটা বেটা,

দূঁর দূঁর করে তিনি যান॥

গণ্ডগ্রাম বলাগোড়,

রামা সবে পেতে গড়,

ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে করে ঠাট্টা।

বাবুরাম ছট্‌ ফট্‌

দেখে বড় সুসংকট।

ভয় পান পাছে লাগে বাঁট্টা॥

দর্পণ সম্মুখে লয়ে,

মুখ দেখে ভয়ে ভয়ে,

রামা সবে কেন দেয় বাধা।

চুলগুলি ঘন বাঁধে

হাত দিয়া ঠক কাঁধে

হৃষ্ট মনে চলয়ে তাগাদা॥

পিছলেতে লণ্ডভণ্ড,

গড়ায় কেন কুষ্মাণ্ড,

উৎসাহে আহ্লাদে মন ভরা।

পরিজন লোকজন,

দেখে শমনভবন,

কাদা চেহলায় আদমরা॥

যেমন ধর পৌঁছিল,

হাড়কাটে গলা দিল,

ঠক আশা আসা হল সার।

কোথায় বা রুপা সোনা,

সোনা মাত্র হল শোনা,

কোথায় বা মুক্‌তার হার॥

ঠক করে তেরি মেরি,

দ্বন্দ্বোজ বাধায় ভারি,

মনে রাগ মনে সবে মারে।

স্ত্রীআচারে বর যায়,

ঝুনুঝুনু রামা ধায়,

বর দেখে হাঁক থুতে সারে॥

ছি ছি ছি, এই ঢোস্কা কি ঐ মেয়েটির বর লো।

পেটা লেও ফোগ্লারাম, টিক আহ্লাদে বুড়ো গো।

চুলিগুলি কিবা কালো, মুখখানি তোবড়া ভাল নাকেতে

চশমা দিয়া, সাজলো জুজুবুড়ো গো।

মেয়ে সোনার লতা, হায় কি হল বিধাতা, কুলীনের

কর্মকাণ্ড, ধিক্‌ ধিক্‌ ধিক লো।

বুড়ো বর জ্বরজ্বর, থর্‌ থর্‌ কাঁপিছে।

চক্ষু কট্‌ মট্‌ সট্‌ মট্‌ করিছে।

নাহি কথা ঊর্ধ্ব মাথা পেয়ে ব্যথা ডাকিছে।

ঠকচাচা এ কি ঢাঁচা মোকে বাঁচা বলিছে।

লম্ফঝম্ফ ভূমিকম্প ঠক লম্ফ দিতেছে।

দরোয়ান হান্‌ হান্‌ সান্‌ সান্‌ ধরিছে।

ভূমে পড়ি গড়াগড়ি গোঁপ দাড়ি ঢাকিছে।

নাথি কিল যেন শিল পিল্‌পিল্‌ পড়িছে।

এই পর্ব দেখে সর্ব হয়ে খর্ব ভাগিছে।

নমস্কার এ ব্যাপার বাঁচা ভার হইছে।

মজুমদার দেখে দ্বার আত্মসার করিছে।

মার্‌ মার্‌ ঘের্‌ ঘার্‌ ধর্‌ ধর্‌ বাড়িছে।


আলালের ঘরের দুলাল

১৯. বেণীবাবুর আলয়ে বেচারাম বাবুর গমন, বাবু রামবাবুর পীড়া ও গঙ্গাযাত্রা, বরদাবাবুর সহিত কথোপকথনান্তর তাঁহার মৃত্যু।

প্রাতঃকালে বেড়িয়া আসিয়া বেণীবাবু আপন বাগানের আটচালায় বসিয়া আছেন, এদিক ওদিক দেখিতে দেখিতে রাম প্রসাদী পদ ধরিয়াছেন —”এবার বাজি ভোর হল” —পশ্চিম দিকে তরুলতার মেরাপ ছিল তাহার মধ্যে থেকে একটা শব্দ হইতে লাগিল —বেণীভায়া বেণীভায়া —বাজি ভোরই হল বটে। বেণীবাবু চমকিয়া উঠিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারাম বাবু বড় ত্রস্ত আসিতেছেন, অগ্রবর্তী হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন —বেচারাম দাদা! ব্যাপারটা কি? বেচারাম বাবু বলিলেন —চাদরখানা কাঁধে দেও, শীঘ্র আইস— বাবুরামের বড় ব্যারাম—একবার দেখা আবশ্যক। বেণীবাবু ও বেচারাম শীঘ্র বৈদ্যবাটীতে আসিয়া দেখেন যে বাবুরামের ভারি জ্বর বিকার —দাহ পিপাসা আত্যন্তিক – বিছানায় ছট্‌ ফট্‌ করিতেছেন – সম্মুখে শসা কাটা ও গোলাপের নেকড়া কিন্তু উকি উদ্‌গার মুহুর্মুহু হইতেছে। গ্রামের যাবতীয় লোক চারিদিগে ভেঙে পড়িয়াছে, পীড়ার কথা লইয়া সকলে গোল করিতেছে। কেহ বলে – আমাদের শাকমাছখেকো নাড়ি – জোঁক, জোলাপ, বেলেস্তারা হিতে বিপরীত হইতে পারে, আমাদিগের পক্ষে বৈদ্যের চিকিৎসাই ভাল, তাতে যদি উপশম না হয় তবে তৎকালে ডাক্তার ডাকা যাইবে। কেহ কেহ বলে হাকিমী মত বড় ভাল, তাহারা রোগীকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া আরাম করে ও তাহাদের ঔষধপত্র সকল মোহনভোগের মতো খেতে লাগে। কেহ কেহ বলে যা বলো কহ এসব ব্যারাম ডাক্তারে যেন মন্ত্রের চোটে আরাম করে – ডাক্তারি চিকিৎসা না হলে বিশেষ হওয়া সুকঠিন। রোগী এক একবার জল দাও জল দাও বলিতেছে, ব্রজনাথ রায় কবিরাজ নিকটে বসিয়া কহিতেছেন, দারুণ স্যন্নিপাত – মুহুর্মুহু জল দেওয়া ভাল নহে, বিল্বপত্রের রস ছেঁচিয়া একটু একটু দিতে হইবেক, আমরা তো উহার শত্রু নয় যে এ সময়ে যত জল চাবেন তত দিব। রোগীর নিকটে এইরূপ গোলযোগ হইতেছে, পার্শ্বের ঘর গ্রামের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতে ভরিয়া গিয়াছে তাহাদিগের মত যে শিবস্বস্ত্যয়ন, সূর্য অর্ঘ, কালিঘাটে লক্ষ জবা দেওয়া ইত্যাদি দৈবক্রিয়া করা সর্বাগ্রে কর্তব্য। বেণীবাবু দাঁড়িয়ে সকল শুনিতেছেন কিন্তু কে কাহাকে বলে ও কে কাহার কথাই বা শুনে – নানা মুনির নানা মত, সকলেরই আপনার কথা ধ্রুবজ্ঞান, তিনি দুই-একবার আপন বক্তব্য প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিলেন – কিন্তু মঙ্গলাচরণ হইতে না হইতে একেবারে তাঁহার কথা ফেঁসে গেল। কোনো রকমে থা না পাইয়া বেচারাম বাবুকে লইয়া বাহির বাটীতে আইলেন ইতিমধ্যে ঠকচাচা নেংচে নেংচে আসিয়া তাঁহাদিগের সম্মুখে পৌঁছিল। বাবুরামের পীড়ার জন্য ঠকচাচা উদ্বিগ্ন – সর্বদাই মনে করিতেছে সব দাঁও বুঝি ফস্‌কে গেল। তাহাকে দেখিয়া বেণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন – ঠকচাচা! পায়ে কি ব্যথা হইয়াছে? অমনি বেচারাম বলিয়া উঠিলেন – ভায়া! তুমি কি বলাগড়ের ব্যাপার শুন নাই – ঐ বেদনা উহার কুমন্ত্রণার শাস্তি, আমি নৌকায় যাহা বলিয়াছিলাম তাহা কি ভুলিয়া গেলে? এই কথা শুনিয়া ঠকচাচা পেঁচ কাটাইবার চেষ্টা করিল। বেণীবাবু তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন – সে যাহা হউক, এক্ষণে কর্তার ব্যারামের জন্য কি তদ্‌বির হইতেছে? বাটীর ভিতর তো ভারি গোল। ঠকচাচা বলিল – বোখার শুরু হলে এক্রামদ্দি হাকিমকে মুই সাতে করে এনি – তেনারি বহুত জোলাব ও দাওয়াই দিয়ে বোখারকে দফা করে খেচ্‌রি খেলান, লেখেন ঐ রোজেতেই বোখার আবার পেল্টে এসে, সে নাগাদ ব্রজনাথ কবিরাজ দেখছে, বেরাম রোজ জেয়াদা মালুম হচ্ছে – মুই বি ভাল বুরা কুচ ঠেওরে উঠতে পারি না। বেণীবাবু বলিলেন – ঠকচাচা রাগ করো না – এ সম্বাদটি আমাদিগের কাছে পাঠানো কর্তব্য ছিল – ভাল, যাহা হইয়াছে তাহার চারা নাই এক্ষণে একজন বিচক্ষণ ইংরেজ ডাক্তার শীঘ্র আনা আবশ্যক। এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে রামলাল ও বরদাপ্রসাদবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাত্রি জাগরণ, সেবা করণের পরিশ্রম ও ব্যাকুলতার জন্য রামলালের মুখ ম্লান হইয়াছে – পিতাকে কি প্রকারে ভাল রাখিবেন ও আরাম করিবেন এই তাঁহার অহরহ চিন্তা। বেণীবাবুকে দেখিয়া বলিলেন – মহশয়! ঘোর বিপদে পড়িয়াছি, বাটীতে বড় গোল কিন্তু সৎপরামর্শ কাহার নিকট পাওয়া যায় না। বরদাবাবু প্রাতে ও বৈকালে আসিয়া তত্ত্ব লয়েন কিন্তু তিনি যাহা বলেন সে অনুসারে আমাকে সকলে চলিতে দেন না – আপনি আসিয়াছেন ভাল হইয়াছে এক্ষণে যাহা কর্তব্য তাহা করুন। বেচারাম বাবু বরদাবাবুর প্রতি কিঞ্চিৎকাল নিরীক্ষণ করিয়া অশ্রুপাত করিতে করিতে তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন – বরদাবাবু। তোমার এত গুণ না হলে সকলে তোমাকে কেন পূজা করিবে। এই ঠকচাচা বাবুরামকে মন্ত্রণা দিয়া তোমার নামে গোমখুনি নালিশ করায় ও বাবুরাম ঘটিত অকারণে তোমার উপর নানা প্রকার জুলুম ও বদিয়ত হইয়াছে কিন্তু ঠকচাচা পীড়িত হইলে তুমি তাহাকে আপনি ঔষধ দিয়া ও দেখিয়া শুনিয়া আরাম করিয়াছ, এক্ষণেও বাবুরাম পীড়িত হওয়াতে সৎপরামর্শ দিতে ও তত্ত্ব লইতে কসুর করিতেছ না – কেহ যদি কাহাকে একটা কটুবাক্য কহে তবে তাহাদিগের মধ্যে একেবারে চটাচটি হয়ে শত্রুতা জন্মে, হাজার ঘাট মানামানি হলেও আপন মনভার যায় না কিন্তু তুমি ঘোর অপমানিত ও অপকৃত হইলেও আপন অপমান ও অপকার সহজে ভুলে যাও – অন্যের প্রতি তোমার মনে ভ্রাতৃভাব ব্যতিরেকে আর অন্য কোনো ভাব উদয় হয় না – বারদাবাবু। অনেকে ধর্ম ধর্ম বলে বটে কিন্তু যেমন তোমার ধর্ম এমন ধর্ম আর কাহারো দেখিতে পাই না —মনুষ্য পামর তোমার গুণের বিচার কি করবে কিন্তু যদি দিনরাত সত্য হয় তবে এ গুণের বিচার উপরে হইবে। বেচারাম বাবুর কথা শুনিয়া বরদাবাবু কুণ্ঠিত হইয়া ঘাড় হেঁট করিয়া থাকিলেন পরে বিনয়পূর্বক বলিলেন – মহাশয়। আমাকে এত বলিবেন না – আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি – আমার জ্ঞান বা কি আর ধর্মই বা কি। বেণীবাবু বলিলেন – মহশয়েরা ক্ষান্ত হউন এ সকল কথা পরে হইবেক এক্ষণে কর্তার পীড়ার জন্য কি বিধি তাহা বলুন। বরদাবাবু কহিলেন – আপনাদিগের মত হইলে আমি কলিকাতায় যাইয়া বৈকাল নাগাদ ডাক্তার আনিতে পারি, আমার বিবেচনায় ব্রজনাথ রায়ের ভরসায় থাকা আর কর্তব্য নহে। প্রেমনারায়ণ মজুমদার নিকটে দাঁড়াইয়া ছিলেন – তিনি বলিলেন – ডাক্তারেরা নাড়ির বিষয় ভাল বুঝে না,তাহারা মানুষকে ঘরে মারে, আর কবিরাজকে একেবারে বিদায় করা উচিত নহে বরং একটা রোগ ডাক্তার দেখুক – একটা রোগ কবিরাজ দেখুক। বেণীবাবু বলিলেন – সে বিবেচনা পরে হইবে এক্ষণে বরদাবাবু ডাক্তারকে আনতে যাউন। বরদাবাবু স্নান আহার না করিয়া কলিকাতায় গমন করিলেন, সকলে বলিল বেলাটা অনেক হইয়াছে মহাশয় এক মুটা খেয়ে যাউন – তিনি উত্তর করিলেন – তাহা হইলে বিলম্ব হইবে, সকল কর্ম ভণ্ডুল হইতে পারে।

বাবুরামবাবু বিছানায় পড়িয়া মতি কোথা মতি কোথা বলিয়া অনবরত জিজ্ঞাসা করিতেছেন কিন্তু মতিলালের চুলের টিকি দেখা ভার, তিনি আপন দলবল লইয়া বাগানে বনভোজনে মত্ত আছেন, বাপের পীড়ার সন্বাদ শুনেও শুনেন না। বেণীবাবু এই ব্যবহার দেখিয়া বাগানে তাহার নিকট লোক পাঠাইলেন কিন্তু মতিলাল মিছামছি বলিয়া পাঠাইলেন যে, আমার অতিশয় মাথা ধরিয়াছে কিছুকাল পরে বাটীতে যাইব।

দুই প্রহর দুইটার সময় বাবুরামবাবুর জ্বর বিচ্ছেদকালীন নাড়ি ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। কবিরাজ হাত দেখিয়া বলিল – কর্তাকে স্থানান্তর করা কর্তব্য – উনি প্রবীণ, প্রাচীন ও মহামান্য, অবশ্য যাহাতে উঁহার পরকাল ভাল হয়, তাহা করা উচিত। এই কথা শুনিবামাত্রে পরিবার সকলে রোদন করিতে লাগিল ও আত্মীয় এবং গ্রামবাসীরা সকলে ধরাধরি করিয়া বাবুরামবাবুকে বাটীর দালানে আনিল। এমতো সময়ে বরদাবাবু ডাক্তার সঙ্গে করিয়া উপস্থিত হইলেন, ডাক্তার নাড়ি দেখিয়া বলিলেন – তোমরা শেষাবস্থায় আমাকে ডাকিয়াছ – রোগীকে গঙ্গাতীরে পাঠাবার অগ্রে ডাক্তারকে ডাকিলে ডাক্তার কি করিতে পারে? এই বলিয়া ডাক্তার গমন করিলেন। বৈদ্যবাটীর যাবতীয় লোক বাবুরামবাবুকে ঘিরিয়া একে একে জিজ্ঞাস করিতে লাগিলে – মহাশয় আমাকে চিনিতে পারেন – আমিকে বলুন দেখি? বেণীবাবু বলিলেন – রোগীকে আপনারা এত ক্লেশ দিবেন না – এরূপ জিজ্ঞাসাতে কি ফল? স্বস্ত্যয়নী ব্রাহ্মণেরা স্বস্ত্যয়ন সাঙ্গ করিয়া আশীর্বাদী ফুল লইয়া আসিয়া দেখেন যে তাঁহাদিগের দৈব ক্রিয়ায় কিছুমাত্র ফল হইল না। বাবুরামবাবুর শ্বাসবৃদ্ধি দেখিয়া সকলে তাঁহাকে বৈদ্যবাটীর ঘাটে লইয়া গেল, তথায় আসিয়া গঙ্গাজল পানে ও স্নিগ্ধ বায়ু সেবনে তাঁহার কিঞ্চিৎ চৈতন্য হইল। লোকের ভিড় ক্রমে ক্রমে কিঞ্চিৎ কমিয়া গেল – রামলাল পিতার নিকট বসিয়া আছেন – বরদাপ্রসাদবাবু বাবুরামবাবুর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন ও কিয়ৎকাল পরে আস্তে আস্তে বলিলেন মহাশয়! এক্ষণে একবার মনের সহিত পরাৎপর পরমেশ্বরকে ধ্যান করুন – তাঁহার কৃপা বিনা আমাদের গতি নাই। এ কথা শুনিবামাত্রেই বাবুরামবাবু বরদাপ্রসাদবাবুর প্রতি দুই-তিন লহমা চাহিয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। রামলাল চোখের জল মুছিয়া দিয়া দুই-এক কুশী দুগ্ধ দিলেন – কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া বাবুরামবাবু মৃদু স্বরে বলিলেন – ভাই বরদাপ্রসাদ! আমি এক্ষণে জানলুম যে তোমার বাড়া জগতে আমার আর বন্ধু নাই – আমি লোকের কুমন্ত্রণায় ভারি ভারি কুকর্ম করিয়াছি, সেই সকল আমার এক একবার স্মরণ হয় আর প্রাণটা যেন আগুনে জ্বলিয়া উঠে – আমি ঘোর নারকী – আমি কি জবাব দিব? আর তুমি কি আমাকে ক্ষমা করিবে? এই বলিয়া বরদাবাবুর হাত ধরিয়া বাবুরামবাবু আপন চক্ষু মুদিত করিলেন। নিকটে বন্ধু-বান্ধবেরা ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিতে লাগিল ও বাবুরামবাবুর সজ্ঞানে লোকান্তর হইল।


আলালের ঘরের দুলাল

২০. মতিলালের যুক্তি, বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধের ঘোঁট, বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার অধ্যক্ষতা, শ্রাদ্ধে পণ্ডিতদের বাদানুবাদ ও গোলযোগ।

পিতার মৃত্যু হইলে মতিলাল বাটীতে গদিয়ান হইয়া বসিল। সঙ্গী সকল এক লহমাও তাহার সঙ্গছাড়া নয়। এখন চার পো বুক হইল – মনে করিতে লাগিল, এতদিনের পর ধুমধাম দেদার রকমে চলিবে। বাপের জন্য মতিলালের কিঞ্চিৎ শোক উপস্থিত হইল – সঙ্গীরা বলিল, বড়বাবু! ভাবো কেন? বাপ-মা লইয়া চিরকাল কে ঘর করিয়া থাকে? এখন তো তুমি রাজেশ্বর হইলে। মুঢ়ের শোক নামমাত্র – যে ব্যক্তি পরমপদার্থ পিতামাতাকে কখন সুখ দেয় নাই – নানাপ্রকার যন্ত্রণা দিত, তাহার মনে পিতার শোক কিরূপে লাগিবে? যদি লাগে তবে তাহা ছায়ার ন্যায় ক্ষণেক স্থায়ী, তাহাতে তাহার পিতাকে কখন ভক্তিপূর্বক স্মরণ করা হয় না ও স্মরণার্থে কোনো কর্ম করিতে মনও চায় না। মতিলালের বাপের শোক শীঘ্র ঢাকা পড়িয়া বিষয়-আশয় কি আছে কি না আছে তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রবল হইল। সঙ্গীদিগের বুদ্ধিতে ঘর-দ্বার সিন্দুক-পেটারার ডবল্‌ ডবল্‌ তালা দিয়া স্থির হইয়া বসিল। সর্বদা মনের মধ্যে এই ভয়, পাছে মায়ের কি বিমাতার কি ভাইয়ের বা ভগনীর হাতে কোনো রকমে টাকাকড়ি পড়ে তাহা হইলে সে টাকা একেবারে গাপ হইবে। সঙ্গীরা সর্বদা বলে – বড়বাবু! টাকা বড় চিজ – টাকাতে বাপকেও বিশ্বাস নাই। ছোটবাবু ধর্মের ছালা বেঁধে সত্য সত্য বলিয়ে বেড়ান বটে কিন্তু পতনে পেলে তাঁহার গুরুও কাহাকে রেয়াত করেন না – ও সকল ভণ্ডামী আমরা অনেক দেখিয়াছি – সে যাহা হউক, বরদাবাবুটা অবশ্য কোনো ভেল্‌কি জানে – বোধ হয় ওটা কামাখ্যাতে দিনকতক ছিল, তা না হলে কর্তার মৃত্যুকালে তাঁহার এত পেশ কি প্রকারে হইল।

দুই-এক দিবস পরেই মতিলাল আত্মীয়-কুটুম্বদিগের নিকট লৌকিকতা রাখিতে যাইতে আরম্ভ করিল। যে সকল লোক দলঘাঁটা, সাল্‌কে মধ্যস্থ করিতে সর্বদা উদ্যত হয়, জিলাপির ফেরে চলে, তাহারা ঘুরিয়া ফিরিয়া নানা কথা বলে – সে সকল কথা আসমানে উড়ে উড়ে বেড়ায়, জমিতে ছোঁয় ছোঁয় করিয়া ছোঁয় না সুতরাং উল্টে-পাল্টে লইলে তাহার দুই রকম অর্থ হইতে পারে। কেহ কেহ বলে কর্তা সরেশ মানুষ ছিলেন – এমন সকল ছেলে রেখে-ঢেকে যাওয়া বড় পূণ্য না হইলে হয় না – তিনি যেমন লোক তেমনি তাঁহার আশ্চর্য মৃত্যুও হইয়াছে বাবু। এতদিন তুমি পর্বতের আড়ালে ছিলে এখন বুঝে-সুঝে চলতে হবে – সংসারটি ঘাড়ে পড়িল – ক্রিয়া-কলাপ আছে – বাপ পিতামহের নাম বজায় রাখিতে হইবে, এ সওয়ায় দায়-দফা আছে। আপনার বিষয় বুঝে শ্রাদ্ধ করিবে, দশ জনার কথা শুনিয়া নেচে উঠবার আবশ্যক নাই। নিজে রামচন্দ্র বালির পিণ্ড দিয়াছিলেন, এ বিষয় আক্ষেপ করা বৃথা, কিন্তু নিতান্ত কিছু না করা সেও তো বড় ভাল নয়। বাবু জানো তো কর্তার ঢাক্টাপানা নামটা – তাঁহার নামে আজো বাঘে গোরুতে জল খায়। তাহাতে কি সুদ্ধ তিলকাঞ্চনি রকমে চল্‌বে?-গেরেপ্তার হয়েও লোকের মুখ থেকে তর্‌তে হবে। মতিলাল এ সকল কথায় মারপেঁচ কিছুই বুঝিতে পারে না। আত্মীয়রা আত্মীয়তাপূর্বক দরদ প্রকাশ করে কিন্তু যাহাতে একটা ধুমধাম বেধে যায় ও তাহারা কর্তৃত্ব ফলিয়ে বেড়াতে পারে তাহাই তাহাদিগের মানস অথচ স্পষ্টরূপে জিজ্ঞাসা করিলে এঁ ওঁ করিয়া সেরে দেয়। কেহ বলে ছয়টি রুপার ষোড়শ না করিলে ভাল হয় না – কেহ বলে একটা দান সাগর না করিলে মান থাকা ভার – কেহ বলে একটা দম্পতি বরণ না করিলে সামান্য শ্রাদ্ধ হবে – কেহ বলে কতকগুলিন অধ্যাপক নিমন্ত্রণ ও কাঙালী বিদায় না করিলে মহা অপযশ হইবে। এইরূপে ভারি গোলযোগ হইতে লাগিল – কে বা বিধি চায়? কে বা তর্ক করিতে বলে? – কে বা সিদ্ধান্ত শুনে?– সকলেই গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল – সকলেই স্ব স্ব প্রধান, সকলেরই আপনার কথা পাঁচ কাহন।

তিনদিন পরে বেণীবাবু, বেচারাম বাবু, বাঞ্ছারামবাবু ও বক্রেশ্বরবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মতিলালের নিকট ঠকচাচা মণিহারা ফণীর ন্যায় বসিয়া আছেন – হাতে মালা – ঠোঁট দু’টি কাঁপাইয়া তসবি পড়িতেছেন, অন্যান্য অনেক কথা হইতেছে কিন্তু সে সব কথায় তাঁহার কিছুতেই মন নাই – দুই চক্ষু দেওয়ালের উপর লক্ষ্য করিয়া ভেল্‌ ভেল্‌ করিয়া ঘুরাইতেছেন – তাক্‌-বাগ কিছুই স্থির করিতে পারেন নাই – বেণীবাবু প্রভৃতিকে দেখিয়া ধড়মড়িয়া উঠিয়া সেলাম করিতে লাগিলেন। ঠকচাচার এত নম্রতা কখনই দেখা যায় নাই। ঢোঁড়া হইয়া পড়িলেই জাঁক যায়। বেণীবাবু ঠকচাচার হাত ধরিয়া বলিলেন – আরে। করো কি? তুমি প্রাচীন মুরুব্বী লোকটা – আমাদিগকে দেখে এত কেন? বাঞ্ছারামবাবু বলিলেন – অন্য কথা যাউক – এদিকে দিন অতি সংক্ষেপ – উদ্‌যোগ কিছুই হয় নাই – কর্তব্য কি বলুন?

বেচারাম। বাবুরামের বিষয়-আশায় অনেক জোড়া – কতক বিষয় বিক্রিসিক্রি করিয়া দেনা পরিশোধ করা কর্তব্য – দেনা করিয়া ধুমধাম শ্রাদ্ধ করা উচিত নহে।

বাঞ্ছারাম। সে কি কথা! আগে লোকের মুখ থেকে তর্‌তে হবে, পশ্চাৎ বিষয়-আশয় রক্ষা হইবে। মান-সম্ভ্রম কি বানের জলে ভেসে যাবে?

বেচারাম। এ পরামর্শ কুপরামর্শ – এমন পরামর্শ কখনই দিব না – কেমন বেণী ভায়া! কি হলো?

বেণী। যে স্থলে দেনা অনেক, বিষয়-আশায় বিক্রি করিয়া দিলেও পরিশোধ হয় কি-না সন্দেহ, সে স্থলে পুনরায় দেনা করা একপ্রকার অপহরণ করা, কারণ সে দেনা পরিশোধ কিরূপে হইবে?

বাঞ্ছারাম। ও সকল ইংরেজী মত – বড়মানুষদিগের ঢাল সুমরেই চলে – তাহারা এক দিচ্ছে এক নিচ্ছে, একটা সৎকর্মে বাগড়া দিয়ে ভাঙা মঙ্গলচণ্ডী হওয়া ভদ্রলোকের কর্তব্য নয়। আমার নিজের দান করিবার সঙ্গতি নাই, অন্য এক ব্যক্তি দশজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে দান করিতে উদ্যত তাহাতে আমার খোঁচা দিবার আবশ্যক কি? আর সকলেরই নিকট অনুগত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আছে, তাহারাও পত্রটত্র পাইতে ইচ্ছা করে – তাহাদেরও তো চলা চাই।

বক্রেশ্বর। আপনি ভাল বলেছেন – কথাই আছে যাউক প্রাণ থাকুক মান।

বেচারাম। বাবুরামের পরিবার বেড়া আগুনে পড়িয়াছে – দেখিতেছি ‘রায় নিকেশ হইবে। যাহা করিলে আখেরে ভাল হয় তাহাই আমাদিগের বলা কর্তব্য – দেনা করিয়া মান কেনার মুখে ছাই – আমি এমন অনুগত বামুন রাখি না যে তাহাদিগের পেট পুরাইবার জন্য অন্যের গলায় ছুরি দিবে। এ সব কি কারখানা। দূঁর দূঁর। চলো বেণী ভায়া। আমরা যাই – এই বলিয়া তিনি বেণীবাবুর হাত ধরিয়া উঠিলেন।

বেণীবাবু ও বেচারাম বাবু গমন করিলে বাঞ্ছারাম বলিলেন – আপদের শান্তি। এ দু-টা কিছুই বোঝে-সোঝে না, কেবল গোল করে। সমজদার মানুষের সঙ্গে কথা কইলে প্রাণ ঠাণ্ডা হয়। ঠকচাচা নিকটে আইস – তোমার বিবেচনায় কি হয়?

ঠকচাচা। মুই বি তোমার সাতে বাতচিত করতে বহুত খোস – তেনারা খাপ্‌কান – তেনাদের নজদিকে এস্তে মোর ডর লাগে। যে সব বাত তুমি জাহের করলে সে সব সাচ্চা বাত। আদমির হুরমত ও কুদরৎ গেলে জিন্দিগি ফেল্‌তো। মামলা-মকদ্দমা নেগাবানি তুমি ও মুই করে বেলকুল বখেড়া কেটিয়ে দিব – তাতে ডর কি?

মতিলালের ধুমধেমে স্বভাব – আয়ব্যয় বোধাবোধ নাই – বিষয় কর্ম কাহাকে বলে জানে না – বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার উপর বড় বিশ্বাস, কারণ তাহারা আদালত ঘাঁটা লোক আর তাহারা যেরূপ মন যুগিয়ে ও সলিয়ে কলিয়ে লওয়াইতে লাগিল তাহাতে মতিলাল একেবারে বলিল – এ কর্মে আপনারা অধ্যক্ষ হইয়া যাহাতে নির্বাহ হয় তাহা করুন, আমাকে সহি সনদ করিতে যাহা বলিবেন আমি তৎক্ষণাৎ করিব। বাঞ্ছারামবাবু বলিলেন – কর্তার উইল বাহির করিয়া আমাকে দাও – উইল কেবল তুমি অছি আছ – তোমার ভাইটে পাগল এই জন্য তাহার নাম বাদ দেওয়া গিয়াছিল, সেই উইল লইয়া আদালতে পেশ করিলে তুমি অছি মরকর হইবে, তাহার পরে তোমার সহি সনদে বিষয় বন্ধক বা বিক্রি হইতে পারিবে। মতিলাল বাক্স খুলিয়া উইল বাহির করিয়া দিল। পরে বাঞ্ছারাম আদালতের কর্ম শেষ করিয়া একজন মহাজন খাড়া করিয়া লেখাপড়া ও টাকা সমেত বৈদ্যবাটীর বাটীতে উপস্থিত হইলেন। মতিলাল টাকার মুখ দেখিয়া তৎক্ষণাৎ কাগজাদ সহি করিয়া দিল। টাকার থলিতে হাত দিয়া বাক্সের ভিতর রাখিতে যায় এমন সময় বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা বলিল – বাবুজি! টাকা তোমার হাতে থাকিলে বেলকুল খরচ হইয়া যাইবে, আমাদিগের হাতে তহবিল থাকিলে বোধ হয় টাকা বাঁচিতে পারিবে, আর তোমার স্বভাব বড় ভাল, চক্ষুলজ্জা অধিক, কেহ চাহিলে মুখ মুড়িতে পারিবে না, আমরা লোক বুঝে টেলে দিতে পারব। মতিলাল মনে করিল এ কথা বড় ভাল শ্রাদ্ধের পর আমিই বা খরচের টাকা কিরূপে পাই এখন তো বাবা নাই যে চাহিলেই পাব এ কারণে উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হইল।

বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধের ধুম লেগে গেল। ষোড়শ গড়িবার শব্দ – ভেয়ানের গন্ধ – বোল্‌তা মাছির ভন্‌ভনানি, ভিজে কাঠের ধুঁয়া, জিনিস পত্রের আমদানি লোকের কোলাহলে বাড়ি ছেয়ে ফেলিল। যাবতীয় পূজারী, দোকানী ও বাজার সরকারে বামুন এক এক তসর জোড় পরিয়া ও গঙ্গামৃত্তিকার ফোঁটা করিয়া পত্রের জন্য গমনাগমন করিতে লাগল, আর তর্কবাগীশ, বিদ্যারত্ন, ন্যায়ালঙ্কার, বাচস্পতি ও বিদ্যাসাগরের তো শেষ নাই, দিন-রাত্রি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও অধ্যাপকের আগমন যেন গো-মড়কে মুচির পার্বণ।

শ্রাদ্ধের দিবস উপস্থিত – সভায় নানা দিগ্‌দেশীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সমাগম হইয়াছে ও যাবতীয় আত্মকুটুম্ব, স্বজন, সুহৃদ্‌ বসিয়াছেন – সম্মুখে রুপার দানসাগর – ঘোড়া, পালকি, পিতলের বাসন, বনাত, তৈজসপত্র ও নগদ টাকা – পার্শ্বে কীর্তন হইতেছে – মধ্যে বেচারাম বাবু ভাবুক হইয়া ভাব গ্রহণ করিতেছেন। বাটীর বাহিরে অগ্রদানী, রেও ভাট, নাগা, তষ্টিরাম ও কাঙালীতে পরিপূর্ণ – ঠকচাচা কেনিয়ে কেনিয়ে বেড়াচ্ছেন – সভায় বসিতে তাঁহার ভরসা হয় না। অধ্যাপকেরা নস্য লইতেছেন ও শাস্ত্রীয় কথা লইয়া পরস্পরে আলাপ করিতেছেন – তাহাদিগের গুণ এই যে একত্র হইলে ঠাণ্ডা রুপে কথোপকথন করা ভার – একটা না একটা উৎপাত অনায়াসে উপস্থিত হয়। একজন অধ্যাপক ন্যায়শাস্ত্রের একটা ফেঁড়কা উপস্থিত করিলেন –  “ঘটত্বাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাভাব বহ্ণিভাবে ধূমা, ধূমাভাবে বহ্ণি”। উৎকলনিবাসী একজন পণ্ডিত কহিলেন – যৌটি ঘটিয়া বাচ্ছিন্তি ভাব প্রতিযোগা সৌটি পর্বত বহ্ণি নামেধিয়া। কাশীজোড়া-নিবাসী পণ্ডিত বলিলেন – কেমন কথা গো? বাক্যটি প্রিণিধান করো নাই – যে ও ঘটকে পট করে পর্বতকে বহ্ণিমান ধূম – শিরোমণি যে মেকটি মেরে দিচ্ছেন। বঙ্গদেশীয় পণ্ডিত বলিলেন – গটিয়াবচ্ছিন্ন বাব প্রতিযোগা দুমাধামে অগ্নি অগ্নিবাবে দুমা – অগ্নি না হলে দুমা কেম্‌মে লাগে। এইরূপ তর্ক বির্তক হইতেছে – মুখামুখি হইতে হইতে হাতাহাতি হইবার উপক্রম – ঠকচাচা ভাবেন পাছে প্রমাদ ঘটে এই বেলা মিটিয়া দেওয়া ভাল – আস্তে আস্তে নিকটে আসিয়া বলিলেন – মুই বলি একটা বদনা ও চেরাগের বাত লিয়ে তোমরা কেন কেজিয়ে করো – মুই তোমাদের দু-টা দু-টা বদনা দিব। অধ্যাপকের মধ্যে একজন চটপটে ব্রাহ্মণ উঠিয়া বলিলেন – তুই বেটা কে রে? হিন্দুর শ্রাদ্ধে যবন কেন? এ কি? পেতনীর শ্রাদ্ধে আলেয়া অধ্যক্ষ না কি? এই বলিতে বলিতে গালাগালি হাতাহাতি হইতে হইতে ঠেলাঠেলি, বেতাবেতি আরম্ভ হইল। বাঞ্ছারামবাবু তেড়ে আসিয়া বলিলেন – গোলমাল করিয়া শ্রাদ্ধ ভণ্ডুল করিলে পরে বুঝব – একেবারে বড় আদালতে এক শমন আনব – একি ছেলের হাতের পিটে? বক্রেশ্বর বলেন, তা বইকি আর যিনি শ্রাদ্ধ করিবেন তিনি তো সামান্য ছেলে নন, তিনি পরেশ পাথর। বেচারাম বলিলেন – এ তো জানাই আছে যেখানে ঠক ও বাঞ্ছারাম অধ্যক্ষ সেখানে কর্ম সুপ্রতুল হইবে না – দূঁর দূঁর! গোল কোনক্রমে থামে না – রেও ভাট প্রভৃতি ঝেঁকে আসিতেছে, এক একবার বেত খাইতেছে ও চিৎকার করিয়া বলিতেছে – ”ভাল শ্রাদ্ধ কর্‌লি রে।” অবশেষে সভার ভদ্রলোক সকলে এই ব্যাপার দেখিয়া কহিতে লাগিল “কার শ্রাদ্ধ কে করে খোলা কেটে বামুন মরে” এই বেলা সরে পড়া শ্রেয় – ছুবড়ি ফেলে অমিত্তি কেন হারানো যাবে?