» » আলালের ঘরের দুলাল

বর্ণাকার

আলালের ঘরের দুলাল

১১. মতিলালের বিবাহ উপলক্ষে কবিতা ও আগরপাড়ার অধ্যাপকদিগের বাদানুবাদ।

আগরপাড়ার অধ্যাপকেরা বৈকালে গাছের তলায় বিছানা করিয়া বসিয়া আছেন। কেহ কেহ নস্য লইতেছেন —কেহ বা তামাক খাইতেছেন —কেহ বা খক্‌ খক্‌ করিয়া কাশিতেছেন —কেহ বা দুই-একটি খোশ-গল্প ও হাসি-মস্‌করার কথা কহিতেছেন। তাঁহাদিগর মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন —বিদ্যারত্ন কেমন আছেন? ব্রাহ্মণ পেটের জ্বালায় মণিরামপুরে নিমন্ত্রণে গিয়া পা ভাঙিয়া বসিয়াছে —আহা কাল যে করে লাঠি ধরিয়া স্নান করিতে যাইতেছিলেন তাহাকে দেখিয়া আমার দুঃখ হইল।

বিদ্যাভূষণ। বিদ্যারত্ন ভাল আছেন, চুন হলুদ ও সেঁকতাপ দেওয়াতে বেদনা অনেক কমিয়া গিয়াছে। মণিরামপুরের নিমন্ত্রণ উপলক্ষে কবিকঙ্কণ দাদা যে কবিতা রচনা করিয়াছেন, তাহাতে রং আছে —বলি শুনুন :

ডিমিকি ডিমিকি, তাথিয়ে থিয়ে বোলে নহবত বাজে।

মাধব ভবন। দেবেন্দ্রসদন। জিনি ভুবন বিরাজে।

অদ্‌ভুত সভা। আলোকের আভা। ঝাড়ের প্রভা মাজে মাজে।

চারিদিকে নানা ফুল। ছড়াছড়ি দুই কুল। বাদ্যের কুল কুল ঝাঁজে।

খোপে খোপে গাঁদা মালা। রাঙা কাপড় রুপার বালা। এতক্ষণে বিয়ের শালা সাজে।

সামেয়ানা ফর্‌ ফর্‌। তালি তাতে বহুতর। জল পড়ে ঝর্‌ ঝর্‌ হাজে।

লেঠিয়াল মজবুত। দরওয়ান রজপুত। নিনাদ অদ্ভুত গাজে।

লুচি চিনি মনোহরা। ভাঁড়ারেতে খুব ভরা। আল্পনার ডোরা ডোরা সাজে।

ভাট বন্দী কত কত। শ্লোক পড়ে শত শত। ছন্দ নানামতো ভাঁজে।

আগরপাড়া কবিবর। বিরচয়ে ওঁহিপর। ঝুপ করে এল বর সমাজে।

হলধর গদাধর উসু খুসু করে।

ছট্‌ ফট্‌ ছট্‌ ফট্‌ করে তারা মরে।

ঠকচাচা হন কাঁচা শুনে বাজে কথা।

হলধর গদাধর খাইতেছে মাথা।

পড়াপড়্‌ পড়াপড়্‌ ফাঁড়িবার শব্দ।

গুপাগুপ্‌ গুপাগুপ্‌ কিলে করে জব্দ।

ঠনাঠন্‌ ঠনাঠন্‌ ঝাড়ে ঝাড়ে লাগে।

সট্‌ সট্‌ সট্‌ সট্‌ করে সবে ভাগে।

মতিলাল দেখে কাল বসে বসে দোলে।

সুতাসার কি আমার আছয়ে কপালে।

বক্রেশ্বর বোকেশ্বর খোশামদে পাক্কা।

চলে যান কিল খান খান গলা ধাক্কা।

‌ বাঞ্ছারাম অবিরাম ফিকিরেতে টন্‌ক।

চড় খেয়ে আচাড় খেয়ে হইলেন বঙ্ক।

বেচারাম সব বাম দেখে যান টেরে।

দূঁর দূঁর দূঁর দূঁর বলে অনিবারে।

বেণীবাবু খান খাবু নাই গতি গঙ্গা।

হুপ্‌ হাপ্‌ গুপ্‌ গাপ্‌ বেড়ে উঠে দাঙ্গা।

বাবুরাম ধরে থাম থাম থাম করে।

ঠক ঠক ঠক ঠক কেঁপে মরে ডরে।

ঠকচাচা মোরে বাঁচা বলে তাড়াতাড়ি।

মুসলমান বেঈমান আছে মুড়ি ঝুড়ি।

যায় সরে ধীরে ধীরে মুখে কাপড় মোড়া।

সবে বলে এই বেটা যত কুয়ের গোড়া।

রেওভাট করে সাট ধরে তাকে পড়ে।

চড়্‌ চড়্‌ চড়্‌ চড়্‌ দাড়ি তার ছেঁড়ে।

সেখের পো ওহো ওহো বলে তোবা তোবা।

জান যায় হায় হায় মাফ করো বাবা।

খুব করি হাত ধরি মোরে দাও ছেড়ে।

ভালা বুরা নেহি জান্তা জেতে মুই নেড়ে।

এ মোকামে কোই কামে আনা ঝকমারি।

হয়রান পেরেসান বেইজ্জতে মরি।

না বুজিয়া না সুজিয়া হেন্দুদের সাতে।

এসেছি বসিয়া আছি সেরফ্‌ দোস্‌তিতে।

এ সাদিতে না থাকিতে বার বার নানা।

চাচি মোর ফুপা মোর সবে করে মানা।

না শুনিয়া না রাখিয়া তেনাদের কথা।

জান যায় দাড়ি যায় যায় মোর মাথা।

মহা ঘোর ঝাপে লাঠিয়াল সাজিছে।

কড়্‌ মড়্‌ হড়্‌ মড়্‌ করে তারা আসিছে।

সপাসপ্‌ লপালপ্‌ বেত পিঠে পড়িছে।

গেলুম্‌রে মলুম্‌রে বলে সবে ডাকিছে।

বরযাত্রী কন্যাযাত্রী কে কোথা ভাগিছে।

মার মার ধর ধর এই শব্দ বাড়িছে।

বর লয়্যে মাধববাবু অন্তঃপুরে যাইছে।

সভা ভেঙে ছারখার একেবারে হইছে।

সবে বলে ঠক মুখে খুলে কাপড় বেড়।

দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড়।

বাবুরাম নির্‌ নাম হইয়ে চলিল।

রেসালা দোশালা সব কোথায় রহিল।

কাপড় চোপড় ছিঁড়ে পড়ে খুলে।

বাতাসে অবশে ওড়ে দুলে দুলে।

চাদর ফাদর নাহি কিছু গায়ে।

হোঁচট মোচট খান সুদু পায়ে।

চলিছে ধলিছে বড় অধোমুখে।

পড়েছি ডুবেছি আমি ঘোর দুঃখে।

ক্ষুধাতে তৃষ্ণাতে মোর ছাতি ফাটে।

মিঠাই না পাই নাহি মুড়কি জোটে।

রজনী অমনি হইতেছে ঘোর

বাতাস নিশ্বাস মধ্যে হল জোর।

বহে ঝড় হড়্‌ মড়্‌ চারিদিগে।

পবন শমন যেন এল বেগে।

কি করি একাকী না লোক না জন।

নিকট বিকট হইবে মরণ।

চলিতে বলিতে মন নাহি লাগে।

বিধাতা শত্রুতা করিলে কি হবে।

না জানি গৃহিণী মোর মৃত্যু শুনে।

দুঃখেতে খেদেতে মরিবেন প্রাণে।

বিবাহ নির্বাহ হল কি না হল।

ঠ্যাঙাতে লাঠিতে কিন্তু প্রাণ গেল।

সম্বন্ধ নির্বন্ধ কেন করিলাম।

মানেতে প্রাণেতে আমি মজিলাম।

আসিতে আসিতে দোকান দেখিল।

অবাধা তাগাদা যাইয়া ঢুকিল।

পার্শ্বেতে দর্মাতে শুয়ে আছে পড়ে।

অস্থির দুস্থির বুরো ঠক নেড়ে।

কেমনে এখানে বাবুরাম বলে।

একালা আমাকে ফেলিয়া আইলে।

এ কর্ম কি কর্ম সখার উচিত।

বিপদে আপদে প্রকাশে পিরিত।

ঠক কয় মহাশয় চুপ কর।

দোকানী না জানি তেনাদের চর।

পেলিয়ে যাইলে সব বাত হবে।

বাঁচিলে জানেতে মহবত রবে।

প্রভাতে দোঁহাতে করিল গমন

রচিয়ে তোটকে শ্রীকবিকঙ্কণ।

তর্কবাগীশ বাবুরামবাবুর বড় গোঁড়া কবিতা শুনিবামাত্র জ্বলিয়া উঠে বলিলেন —আ মরি! কিবা কবিতা —সাক্ষাৎ সরস্বতী মূর্তিমান —কিংবা কালিদাস মরিয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন —কবিকঙ্কণের ভারি বিদ্যা —এমন ছেলে বাঁচা ভার। পয়ারও চমৎকার! মেজের মাটি —পাথর বাটি —শীতল পাটি —নারকেল কাটি! ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হইয়া বড়মানুষের সর্বদা প্রশংসা করিবে গ্লানি করা তো ভদ্র কর্ম নয় —এই বলিয়া তিনি রাগ করিয়া সে স্থান হইতে উঠিয়া চলিয়া যান। সকলে হাঁ —হাঁ —দাঁড়ান গো বলিয়া তাঁহাকে জোর করিয়া বসাইলেন।

অন্য আর একজন অধ্যাপকও কথা চাপা দিয়া অন্যান্য কথা ফেলিয়া সলিয়ে-কলিয়ে বাবুরামবাবু ও মাধববাবুর তারিফ করিতে আরম্ভ করিলেন। বামুনে বুলি প্রায় বড় মোটা —সকল সময় সবকথা তলিয়ে বুঝিতে পারে না —ন্যায়শাস্ত্রে ফেঁকড়ি পড়িয়া কেবল ন্যায়শাস্ত্রীয় বুদ্ধি হয় সাংসারিক বুদ্ধির চালনা হয় না। তর্কবাগীশ অমনি গলিয়া গিয়া উপস্থিত কথায় আমোদ করিতে লাগিলেন।


আলালের ঘরের দুলাল

১২. বেচারাম বাবুর নিকট বেণীবাবুর গমন, মতিলালের ভ্রাতা রামলালের উত্তম চরিত্র হওনের কারণ, বারদাপ্রসাদবাবুর প্রসঙ্গ— মন শোধনের উপায়।

বৌবাজারের বেচারাম বাবু বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। নিকটে দুই-একজন লোক কীর্তন-অঙ্গ গাইতেছেন। বাবু গোষ্ঠ, দান, মান, মাথুর খণ্ডিতা, উৎকণ্ঠিতা কলহান্তরিতা ক্রমে ক্রমে ফরমাইশ করিতেছেন। কীর্তনিয়ারা মনোহরসাহী রেনিটি ও নানা প্রকার সুরে কীর্তন করিতেছে, সে সকল শুনিয়া কেহ কেহ দশা পাইয়া একেবারে গড়াগড়ি দিতেছে। বেচারাম বাবু চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছেন এমতো সময়ে বালীর বেণীবাবু গিয়া উপস্থিত।

বেচারাম বাবু অমনি কীর্তন বন্ধ করাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আরে কত্তা বেণীভায়া। বেঁচে আছো কি? বাবুরাম নেকড়ার আগুন —ছেড়েও ছাড়ে না অথচ আমরা তাঁহার যে কর্মে যাই সেই কর্মে লণ্ডভণ্ড হইয়া আসিতে হয়। মনিরামপুরের ব্যাপারেতে ভাল আক্কেল পাইয়াছি —কথাই আছে, যে হয় ঘরের শত্রু সেই যায় বর যাত্রী।

বেণী। বাবুরামবাবুর কথা আর বলবেন না —দেক্‌সেক্‌ হওয়া গিয়াছে —ইচ্ছা হয় বালীর ঘর-দ্বার ছাড়িয়া প্রস্থান করি। “অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি” —আর বা কপালে কি আছে।

বেচারাম। ভাল, বাবুরামের তো এই গতিক —আপনি যেমন —মন্ত্রী যেমন —সঙ্গীরা যেমন —পুত্র যেমন —সকল কর্ম-কারখানা তেমন। তাহার ছোট ছেলেটি ভাল হইতেছে এর কারণ কি? সে যে গোবর কুঁড়ে পদ্ম ফুল।

বেণী। আপনি এ কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। — এ কথাটি অসম্ভব বটে কিন্তু ইহার বিশেষ কারণ আছে। পূর্বে আমি বরদাপ্রসাদ বিশ্বাসবাবুর পরিচয় দিয়াছি তাহা আপনার স্মরণ থাকিতে পারে। কিয়ৎকালাবধি ঐ মহাশয় বৈদ্যবাটীতে অবস্থিতি করিয়া আছেন। আমি মনের মধ্যে বিবেচনা করিয়া দেখিলাম বাবুরামবাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রামলাল যদ্যপি মতিলালের মতো হয় তবে বাবুরামের বংশ ত্বরায় নির্বংশ হইবে কিন্তু ঐ ছেলেটি ভাল হইতে পারে, তাহার উত্তম সুযোগ হইয়াছে। এই সকল বিবেচনা করিয়া রামলালকে সঙ্গে করিয়া উক্ত বিশ্বাসবাবুর নিকট গিয়াছিলাম। ছেলেটির সেই পর্যন্ত বিশ্বাসবাবুর প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি হওয়াতে তাঁহার নিকটেই সর্বদা পড়িয়া আছে, আপন বাটীতে বড় থাকে না। তাঁহাকে পিতার তুল্য দেখে।

বেচারাম। পূর্বে ঐ বিশ্বাসবাবুরই গুণ বর্ণনা করিয়াছিলে বটে —যাহা হউক একাধারে এত গুণ কখনও শুনি নাই, এক্ষণে তাঁহার ভাল পদ হইয়াছে —মনে গর্মি না জন্মিয়া এত নম্রতা কি প্রকারে হইল?

বেণী। যে ব্যক্তি বাল্যকালাবধি সম্পত্তি প্রাপ্ত হয় ও কখন বিপদে না পড়িয়া কেবল সম্পদেই বাড়িতে থাকে তাহার নম্রতা প্রায় হওয়া ভার —সে ব্যক্তি অন্যের মনের গতি বুঝিতে পারে না অর্থাৎ কি বা পরের প্রিয়, কি বা পরের অপ্রিয়, তাহা তাহার কিছুমাত্র বোধ হয় না, কেবল আপন সুখে সর্বদা মত্ত থাকে —আপনাকে বড় দেখে ও তাহার আত্মীয়বর্গ প্রায় তাহার সম্পদেরই খাতির করিয়া থাকে। এমতো অবস্থায় মনের গর্মি বড় ভয়ানক হইয়া উঠে —এমতো স্থলে নম্রতা ও দয়া কখনই স্থায়ী হইতে পারে না। এই কারণে কলিকাতার বড়মানুষের ছেলেরা প্রায় ভাল হয় না। একে বাপের বিষয়, তাতে ভারি পদ সুতরাং সকলের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়া বেড়ায়। চোট না খাইলে —বিপদে না পড়িলে মন স্থির হয় না। মনুষ্যের নম্রতা অগ্রেই আবশ্যক। নম্র না হইলে লোকে ধর্মে বাড়িতেও পারে না।

বেচারাম। বরদাবাবু এত ভাল কি প্রকারের হইলেন?

বেণী। বরদাবাবু বাল্যাবস্থা অবধি ক্লেশে পড়িয়াছিলেন। ক্লেশে পড়িয়া পরমেশ্বরকে অনবরত ধ্যান করিতেন —এইমতো অনবরত ধ্যান করাতে তাঁহার মনে দৃঢ় সংস্কার হইয়াছে যে, যে-কর্ম পরমেশ্বরের প্রিয় তাহাই করা কর্তব্য। যে-যে কর্ম তাঁহার অপ্রিয় তাহা প্রাণ গেলেও করা কর্তব্য নহে। ঐ সংস্কার অনুসারে তিনি চলিয়া থাকেন।

বেচারাম। পরমেশ্বরের প্রিয় অপ্রিয় কর্ম তিনি কি প্রকারে স্থির করিয়াছেন।

বেণী। ঐ বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত হইবার দুই উপায়ে আছে। প্রথমতঃ, মনঃসংযম করিতে হয়। মনের সংযম নিষিদ্ধ স্থির হইয়া ধ্যান ও মনের সম্ভাব বৃদ্ধি করা অবশ্যক। স্থিরতর চিত্তে ধ্যানের দ্বারা মনকে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে হিতাহিত বিবেচনা শক্তি চালনা হইতে থাকে, ঐ শক্তি যেমন প্রবল হইয়া উঠে তেমনি লোকে ঈশ্বরের অপ্রিয় কর্মে বিরত হইয়া প্রিয় কর্মেতে রত হইতে থাকে। দ্বিতীয়তঃ সাধুলোকে যাহা লিখিয়াছেন তাহা পাঠ ও আন্দোলন করিলে ঐ শক্তি ক্রমশঃ অভ্যাস হয়। বরদাবাবু আপনাকে ভাল করিবার জন্য কোনো অংশ কসুর করেন নাই। অদ্যাবধি তিনি সাধারণ লোকের ন্যায় কেবল হো হো করিয়া বেড়ান না। প্রাতঃকালে উঠিয়া নিয়ত পরমেশ্বরের উপাসনা করিয়া থাকেন —তৎকালীন তাঁহার মনে যে ভাব উদয় হয় তাহা তাঁহার নয়নের জল দ্বারাই প্রকাশ পায়। তাহার পরে তিনি আপনি কি মন্দ ও কি ভাল কর্ম করিয়াছেন তাহা সুস্থির হইয়া উল্টে পাল্টে দেখেন —তিনি আপন গুণ কখনই গ্রহণ করেন না —কোন অংশে কিঞ্চিৎমাত্র দোষ দেখিলেই অতিশয় সন্তাপিত হন কিন্তু অন্যের গুণ শ্রবণে আমোদ করেন, দোষ জানিতে পারিলে ভ্রাতৃভাবে কেবল কিছু দুঃখ প্রকাশ করেন। এইরূপ অভ্যাসের দ্বারা তাঁহার চিত্ত নির্মল ও শান্ত হইয়াছে। যে ব্যক্তি মনকে এরূপ সংযত করে সে যে ধর্মেতে বাড়িবে তাহাতে আশ্চর্য কি?

বেচারাম। বেণী ভায়া। বরদাবাবুর কথা শুনিয়া কর্ণ জুড়াইল, এমতো লোকের সহিত একবার দেখা করিতে হইবে, দিবসে তিনি কি করিয়া থাকেন?

বেণীবাবু। তিনি দিবসে বিষয় কর্ম করিয়া থাকেন বটে কিন্তু অন্যান্য লোকের মতো নহে। অনেকেই বিষয় কর্মে প্রবৃত্ত হইয়া কেবল পদ ও অর্থের বিষয় ভাবেন, কিন্তু তিনি তাহা বড় ভাবেন না। তাঁহার ভাল জানা আছে যে পদ ও অর্থ জলবিম্বের ন্যায় দেখিতে ভাল —শুনিতে ভাল —কিন্তু মরিলে সঙ্গে যায় না বরং সাবধানপূর্বক না চলিলে ঐ উভয় দ্বারা কুমতি জন্মিয়া থাকে, তাঁহার বিষয় কর্ম করিবার প্রাধান তাৎপর্য এই যে তদ্দ্বারা আপন ধর্মের চালনা ও পরীক্ষা করিবেন। বিষয়কর্ম করিতে গেলে লোভ, রাগ, হিংসা, অবিচার ইত্যাদি প্রবল হইয়া উঠে ও ঐ সকল রিপুর দাপটে অনেকেই মারা যায়, তাহাতে যে সামলিয়া যায় সে-ই প্রকৃত ধার্মিক। ধর্ম মুখে বলা সহজ কিন্তু কর্মের দ্বারা না দেখাইলে মুখে বলা কেবল ভণ্ডামি; বরদাবাবু সর্বদা বলিয়া থাকেন সংসার পাঠশালার স্বরূপ, বিষয় কর্মের দ্বারা মনের সদভ্যাস হইলে ধর্ম অটুট হয়।

বেচারাম। তবে কি বরদাবাবু অর্থকে অগ্রাহ্য করেন?

বেণী। না না —অর্থকে হেয় বোধ করেন না —কিন্তু তাঁহার বিবেচনাতে ধর্ম অগ্রে অর্থ তাহার পরে, অর্থাৎ ধর্মকে বজায় রাখিয়া অর্থ উপার্জন করিতে হইবেক।

বেচারাম। বরদাবাবু রাত্রে বাড়িতে কি করেন?

বেণী। সন্ধ্যার পর পরিবারের সহিত সদালাপ ও পড়াশুনা করিয়া থাকেন। তাঁহার সচ্চরিত্র দেখিয়া পরিবারের সকলে তাঁহার মতো হইতে চেষ্টা করে, পরিবারের প্রতি তাঁহার এমতো স্নেহ যে স্ত্রী মনে করেন এমন স্বামী যেন জন্মে জন্মে পাই, সন্তানেরা তাঁহাকে এক দণ্ড না দেখিলে ছটফট করে। বরদাবাবুর পুত্রগুলি যেমন ভাল, কন্যাগুলিও তেমনি ভাল। অনেকের বাটীতে ভায়ে-বোনে সর্বদা কচ্‌কচি-কলহ করিয়া থাকে। বারদাবাবুর সন্তানেরা কেহ কাহাকেও উচ্চ কথা কহে না, কি লেখার সময়, কি পড়ার সময়, কি খাবার সময়, সকল সময়ই তাহারা পরস্পর স্নেহ পূর্বক কথাবার্তা কহিয়া থাকে —বাপ-মা ভাল না হইলে সন্তান ভাল হয় না।

বেচারাম। আমি শুনিয়াছি বরদাবাবু সর্বদা পাড়ায় ঘুরিয়া বেড়ান।

বেণী। এ কথা সত্য বটে —তিনি অন্যের ক্লেশ, বিপদ অথবা পীড়া শুনিলে বাটীতে স্থির হইয়া থাকিতে পারেন না। নিকটস্থ অনেক লোকের নানা প্রকারে উপকার করিয়া থাকেন কিন্তু ঐ কথা ঘুণাক্ষরে কাহাকেও বলেন না ও অন্যের উপকার করিলে আপনাকে উপকৃত বোধ করেন।

বেচারাম। বেণী ভায়া। এমন প্রকার লোক চক্ষে দেখা দূরে থাকুক কোনো কালে কখন কানেও শুনি নাই —এমতো লোকের নিকটে বুড়ো থাকিলেও ভাল হয় —ছেলে তো ভাল হবেই। আহা। বাবুরামের ছোট ছেলেটি ভাল হইলেই বড় সুখজনক হইবে।


আলালের ঘরের দুলাল

১৩. বরদাপ্রসাদবাবুর উপদেশ দেওন – তাঁহার বিজ্ঞতা ও ধর্মনিষ্ঠা এবং সুশিক্ষার প্রণালী। তাঁহার নিকট রামলালের উপদেশ, তজ্জন্য তাঁহার পিতার ভাবনা ও ঠকচাচার সহিত পরামর্শ। রামলালের গুণ বিষয়ে মনান্তর ও তাঁহার বড় ভগিনীর পীড়া ও বিয়োগ।

বরদাপ্রসাদবাবুর বিদ্যাশিক্ষা বিষয় বিজাতীয় বিচক্ষণতা ছিল। তিনি মানব স্বভাব ভাল জানিতেন। মনের কি কি শক্তি কি কি ভাব এবং কি কি প্রকারে ঐ সকল শক্তি ও ভাবের চালনা হইলে মনুষ্য বুদ্ধিমান ও ধার্মিক হইতে পারে তদ্বিষয়ে তাঁহার বিশেষ বিজ্ঞতা ছিল। শিক্ষকের কর্মটি বড় সহজ নহে। অনেকে যৎকিঞ্চিৎ ফুলতোলা রকম শিখিয়া অন্য কর্ম-কাজ না জুটিলে শিক্ষক হইয়া বলেন – এমতো সকল লোকের দ্বারা ভাল শিক্ষা হইতে পারে না। প্রকৃত শিক্ষক হইতে গেলে মনের গতি ও ভাব সকলকে ভাল রূপে জানিতে হয় এবং কি প্রকারে শিক্ষা দিলে কর্মে আসিতে পারে তাহা সুস্থির হইয়া দেখিতে হয় ও শুনিতে হয় ও শিখিতে হয়। এ সকল না করিয়া তাড়াহুড়া রকমে শিক্ষা দিলে কেবল পাথরে কোপ মারা হয় – একশত বার কোদাল পড়িলেও এক মুঠা মাটি কাটা হয় না, বরদাপ্রসাদ বাবু বহুদর্শী ছিলেন – অনেক কালাবধি শিক্ষার বিষয়ে মনোযোগী থাকাতে শিক্ষা দেওয়ার প্রণালী ভাল জানিতেন, তিনি যে প্রকারে শিক্ষা করাইতেন তাহাতে সার শিক্ষা হইত। এক্ষণে সরকারী বিদ্যালয়ে যে প্রকার শিক্ষা হয় তাহাতে শিক্ষার আসল অভিপ্রায় সিদ্ধ হয় না, কারণ মনের শক্তি ও মনের ভাবাদির সুন্দর রূপ চালনা হয় না, ছাত্রেরা কেবল মুখস্থ করিতে শিখে। তাতে কেবল স্মরণশক্তি জাগরিত – বিবেচনাশক্তি প্রায় নিদ্রিত থাকে, মনের ভাবাদির চলনার তো কথাই নাই। শিক্ষার প্রধান তাৎপর্য এই যে ছাত্রদিগের বয়ঃক্রম অনুসারে মনের শক্তি ও ভাব সকল সমানরূপে চালিত হইবেক। এক শক্তির অধিক চালনা ও অন্য শক্তির অল্প চালনা করা কর্তব্য হয় না। যেমন শরীরের সকল অঙ্গকে মজবুত করিলে শরীরটি নিরেট হয় তেমনি মনের সকল শক্তিকে সমানরূপে চালনা করিলে আসল বুদ্ধি হয়। মনে সদ্ভাবাদিরও চালনা সমানরূপে করা আবশ্যক। একটি সদ্ভাবের চালনা করিলেই সকল সদ্ভাবের চালনা হয় না। সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মিলেও দয়ার লেশ না থাকিতে পারে – দয়ার ভাগ অধিক থাকিয়া দেনা-পাওনা বিষয়ে কাণ্ডজ্ঞান না থাকা অসম্ভব নহে – দেনা-পাওনা বিষয়ে খাড়া থাকিয়াও পিতা-মাতা স্ত্রী-পুত্রের উপর অযত্ন ও নিস্নেহ হইবার সম্ভাবনা – পিতা-মাতা-স্ত্রী-পুত্রের প্রতি স্নেহ থাকিতে পারে অথচ সরলতা কিছু মাত্র না থাকা অসম্ভব নহে। ফলেও বরদাপ্রসাদ বাবু ভাল জানিতেন যে মনের ভাবাদির চালনার মূল পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি – ঐ ভক্তির যেমন বৃদ্ধি হইবে তেমনি মনের সকল ভাবের চালনা হইতে থাকিবে, তাহা না হইলে ঐ কর্মটি জলের উপরে আঁক কাটার প্রায় হইয়া পড়ে।

রামলাল ভাগ্যক্রমে বরদাবাবুর শিষ্য হইয়াছিল। রামলালের মনের সকল শক্তি ও ভাবের চালনা সুন্দররূপে হইতে লাগিল। মনের ভাবের চালনা সৎ লোকের সহবাসে যেমন হয়, তেমন শিক্ষা দ্বারা হয় না। যেমন কলমের দ্বারা জাম গাছের ডাল আঁব গাছের ডাল হয়, তেমন সহবাসের দ্বারা এক রকম মন অন্য আর এক রকম হইয়া পড়ে। সৎমনের এমন মহাত্ম্য যে – তাহার ছায়া অধম মনের উপর পড়িলে, অধম রূপ ক্রমে ক্রমে সেই ছায়ার স্বরূপ হইয়া বসে।

বরদাবাবুর সহবাসে রামলালের মনের ঢাঁচা প্রায় তাহার মনের মতো হইয়া উঠিল। রামলাল প্রাতঃকালে উঠিয়া শরীরকে বলিষ্ঠ করিবার জন্য ফর্দা জায়গায় ভ্রমণ ও বায়ু সেবন করেন – তাঁর দৃঢ় সংস্কার হইল যে, শরীরে জোর না হইলে মনের জোর হয় না। তাহার পরে বাটীতে আসিয়া উপাসনা ও আত্মবিচার করেন এবং যে সকল বহি পড়িলে ও যে-যে লোকের সহিত আলাপ করিলে বুদ্ধি ও মনের সদ্ভাব বৃদ্ধি হয় কেবল সেই সকল বহি পড়েন ও সেই সকল লোকের সাহিত আলাপ করেন। সৎ লোকের নাম শুনিলেই তাঁহার নিকট গমনাগমন করেন – তাঁহার জাতি অথবা অবস্থার বিষয় কিছুমাত্র অনুসন্ধান করেন না। রামলালের বোধশোধ এমতো পরিষ্কার হইল যে, যাহার সঙ্গে আলাপ করেন তাহার সহিত কেবল কেজো কথাই কহেন – ফাল্‌তো কথা কিছুই কহেন না, অন্য লোক ফাল্‌তো কথা কহিলে আপন বুদ্ধির জোরে কুরুনির ন্যায় সার সার কথা বাহির করিয়া লয়েন। তিনি মনের মধ্যে সর্বদাই ভাবেন পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি, নীতিজ্ঞান ও সদ্‌বুদ্ধি যাহাতে বাড়ে তাহাই করা কর্তব্য। এই মতে চলাতে তাঁহার স্বভাব-চরিত্র ও কর্মসকল উত্তর উত্তর প্রশাংসনীয় হইতে লাগিল।

সততা কখনই চাপা থাকে না – পাড়ার সকল লোকে বলাবলি করে – রামলাল দৈত্যকূলের প্রহ্লাদ। তাহাদিগের বিপদ-আপদে রামলাল আগে বুক দিয়া পড়ে। কি পরিশ্রম দ্বারা, কি অর্থ দ্বারা, কি বুদ্ধি দ্বারা, যাহার যাতে উপকার হয় তাহাই করে। কি প্রাচীন, কি যুবা, কি শিশু, সকলেই রামলালের অনুগত ও আত্মীয় হইল – রামলালের নিন্দা শুনিলে তাহাদিগের কর্ণে শেল সম লাগিত – প্রশংসা শুনিলে মহা আনন্দ হইত। পাড়ার প্রাচীন স্ত্রীলোকেরা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল – আমাদিগের এমন একটি ছেলে হলে বাছাকে কাছছাড়া হতে দিতুম না – আহা! ওর মা কত পূণ্য করেছিল যে এমন ছেলে পেয়েছে। যুবতী স্ত্রীলোকেরা রামলালের রূপ গুণ দেখিয়া শুনিয়া মনে মনে কহিত, এমনি পুরুষ যেন স্বামী হয়।

রামলালের সৎ স্বভাব ও সৎ চরিত্র ক্রমে ক্রমে ঘরে-বাহিরে নানা প্রকারে পাইতে লাগিল, তাঁহার পরিবার মধ্যে কাহারও প্রতি কোনো অংশে কর্তব্য কর্মের ত্রুটি হইত না।

রামলালের পিতা তাঁহাকে দেখিয়া এক একবার মনে করিতেন, ছোট পুত্রটি হিন্দুয়ানী বিষয় আল্‌গা আল্‌গা রকম – তিলক সেবা করে না – কোশা-কোশী লইয়া পূজা করে না। হরিনামের মালাও জপে না, অথচ আপন মত অনুসারে উপাসনা করে ও কোনো অধর্মে রত নহে – আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা কহি – ছেলেটি সত্য বৈ অন্য কথা জানে না – বাপ-মার প্রতি বিশেষ ভক্তিও আছে, অধিকন্তু আমাদের অনুরোধে কোনো অন্যায় কর্ম করিতে কখনই স্বীকার করে না – আমার বিষয়-আশয়ে অনেক জোর আছে – সত্য মিথ্যা দুই-ই-চাই। অপর বাটীতে দোল দুর্গোৎসব ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপ হইয়া থাকে – এ সকল কি প্রকারে রক্ষা হইবে? মতিলাল মন্দ বটে কিন্তু সে ছেলেটির হিন্দুয়ানী আছে – বোধ হয় দোষে-গুণে বড় মন্দ নয় – বয়েসকালে ভারিত্ব হইলে সব সেরে যাবে। রামলালের মাতা ও ভগিনীরা তাঁহার গুণে দিন দিন আর্দ্র হইতে লাগিলেন। ঘোর অন্ধকারের পর আলোক দর্শনে যেমন আহলাদ জন্মে তেমনি তাঁহাদিগের মনে আনন্দ হইল, মতিলালের অসদ্ব্যবহারে তাঁহারা ম্রিয়মাণ ছিলেন, মনে কিছুমাত্র সুখ ছিল না, – লোক গঞ্জনায় অধোমুখ হইয়া থাকিতেন, এক্ষণে রামলালের সদ্‌গুণে মনে সুখ ও মুখ উজ্জ্বল হইল। দাসদাসীরা পূর্বে মতিলালের নিকট কেবল গালাগালি ও মার খাইয়া পালাই পালাই ডাক ছাড়িত – এক্ষণে রামলালের মিষ্ট বাক্যে ও অনুগ্রহে ভিজিয়া আপন আপন কর্মে অধিক মনোযোগী হইল। মতিলাল, হলধর ও গদাধর রামলালের কাণ্ড-কারখানা দেখিয়া পরস্পর বলাবলি করিত, ছোঁড়া পাগল হল – বোধ হয় মাথায় দোষ জন্মিয়াছে। কর্তাকে বলিয়া ওকে পাগলা গারদে পাঠান যাউক – একরত্তি ছোঁড়া, দিবারাত্রি ধর্ম ধর্ম বলে – ছেলে মুখে বুড়ো কথা ভাল লাগে না। মানগোবিন্দ, রামগোবিন্দ ও দোলগোবিন্দ মধ্যে মধ্যে বলে – মতিবাবু! তুমি কপালে পুরুষ – রামলালের গতিক ভাল নয় – ওটা ধর্ম ধর্ম করিয়া নিকেশ হবে, তারপর তুমিই সমস্ত বিষয়টা লইয়া পায়ের উপর পা দিয়া নিছক মজা মারো। আর ওটা যদিও বাঁচে তবু কেবল জড়ভরতের মতো হবে। আ মরি! যেমন গুরু তেমন চেলা – পৃথিবীতে আর শিক্ষক পাইলেন না! একটা বাঙালের কাছে গুরুমন্ত্র পাইয়া সকলের নিকট ধর্ম ধর্ম করিয়া বেড়ান। বড় বাড়াবাড়ি করলে ওকে আর ওর গুরুকে একেবারে বিসর্জন দিব। আ মরি! টগরে ছোঁড়া বলে বেড়ায়, দাদা কুসঙ্গ ছাড়লে বড় সুখের বিষয় হবে – আবার বলে বরদাবাবুর নিকট গমনাগমন করিলে ভাল হয়। বরদাবাবু বুদ্ধির ঢেঁকি। গুণবানের জেঠা। খবরদার মতিবাবু, তুমি যেন দমে পড়ে সেটার কাছে যেও না। আমরা আবার শিখব কি? তার ইচ্ছা হয় তো সে আমাদের কাছে এসে শিখে যাউক। আমরা এক্ষণে রং চাই – মজা চাই – আয়েস চাই।

ঠকচাচা সর্বদাই রামলালের গুণাগুণ শুনেন ও বসিয়া বসিয়া ভাবেন। ঠকের আঁচ সময় পাইলেই বাবুরামের বিষয়ের উপর দুই-এক ছোবল মারিবেন। এই পর্যন্ত অনেক মামলা গোলমালে গিয়াছে – ছোবল মারিবার সময় হয় নাই কিন্তু চারের উপর চার দিয়া ছিপ ফেলার কসুর হয় নাই। রামলাল যে প্রকার হইয়া উঠিল তাহাতে যে মাছ পড়ে এমন বোধ হইল না – পেঁচ পড়িলেই সে পেঁচের ভিতর যাইতে বাপকে মানা করিবে। অতএব ঠকচাচা ভারি ব্যাঘাত উপস্থিত দেখিল এবং ভাবিল আশার চাঁদ বুঝি নৈরাশ্যের মেঘে ডুবে গেল, আর প্রকাশ বা না পায়। তিনি মনোমধ্যে অনেক বিবেচনা করিয়া একদিন বাবুরামকে বলিলেন, বাবু সাহেব। তোমার ছোট লাড়কার ডৌল নেকা করে মোর বড় গর্মি হচ্ছে। মোর মালুম হয় ওনা দেওয়ানা হয়েছে – তেনা মোর উপর বড় খাপ্পা, দশ আদমির নজদিগে বলে মুই তোমাকে খারাপ করলাম – এ বাতশুনে মোর দেলে বড় চোট লেগেছে। বাবু সাহেব! এ বহুত বুরাবাত – এজ এস মাফিক মোরে বললে – কেল তোমাকেও শক্ত শক্ত বলতে পারে। লেড়কা ভাল হবে – নরম হবে – বেতমিজ ও বজ্জাত হল, এলাজ দেয়া মোনাসেব। আর যে রবক সবক পড়ে তাতে যে জমিদারি থাকে এতনা মোর এক্কেলে মালুম হয় না।

যে ব্যক্তির ঘটে বড় বুদ্ধি নাই সে পরের কথায় অস্থির হইয়া পড়ে। যেমন কাঁচা মাঝির হাতে তুফানে নৌকা পড়িলে টল্‌মল্‌ করিতে থাকে – কুল-কিনারা পেয়েও পায় না – সেই মতো ঐ ব্যক্তি চারিদিকে অন্ধকার দেখে –  ভাল-মন্দ কিছুই স্থির করিতে পারে না। একে বাবুরামবাবুর মাজা বুদ্ধি নহে তাতে ঠকচাচার করা ব্রহ্মজ্ঞান, এই জন্য ভেবাচেকা লেগে তিনি ভদ্রজংলার মতো ফেল্‌ফেল্‌ করিয়া চাহিয়া রহিলেন ও ক্ষণেক কাল পরে জিজ্ঞাসা করিলেন – উপায় কি! ঠকচাচা বলিলেন – মোশার লেড়কা বুরা নহে, বারদাবাবুই সব বদের জড় – ওনাকে তফাত করিলে লেড়কা ভাল হবে – বাবু সাহেব। হেন্দুর লেড়কা হবে হেন্দু মাফিক পাল-পর্বণ করা মোনাসেব, আর দুনিয়াদারি করিতে গেলে ভালা-বুরা দুই-ই চাই – দুনিয়া সাচ্চা নয় – মুই একা সাচ্চা হয়ে কি করবো?

যাহার যেরূপ সংস্কার সেইমতো কথা শুনিলে ঐ কথা বড় মনের মতো হয়। হিন্দুয়ানী ও বিষয় রক্ষা সংক্রান্ত কথাতেই লক্ষ্য সিদ্ধ হইবে, তাহা ঠকচাচা ভাল জানিতেন ও ঐ কথাতেই কর্ম কেয়াল হইল। বাবুরামবাবু উক্ত পরামর্শ শুনিয়া তা বটে তো তা বটে তো বলিয়া কহিলেন – যদি তোমার এই মত তো শীঘ্র কর্ম নিকেশ করো – টাকাকড়ি যাহা আবশ্যক হবে আমি তাহা দিব কিন্তু কল-কৌশল তোমার।

রামলালের সংক্রান্ত ঘষ্টি ঘর্ষণা এইরূপ হইতে লাগিল। নানা মুনির নানা মত – কেহ বলে ছেলেটি এ অংশে ভাল – কেহ বলে ও অংশে ভাল নহে – কেহ বলে এই মুখ্য গুণটি না থাকাতে এক কলসী দুগ্ধে এক ফোঁটা গোবর পড়িয়াছে – কেহ বলে ছেলেটি সর্ব বিষয়ে গুণান্বিত, এইরূপ কিছুকাল যায় – দৈবাৎ বাবুরামবাবুর বড় কন্যার সাংঘাতিক পীড়া উপস্থিত হইল। পিতা-মাতা কন্যাকে ভারি ভারি বৈদ্য আনাইয়া দেখাইতে লাগিলেন। মতিলাল ভগিনীকে একবারও দেখিতে আইল না। – পরম্পরায় বলিয়া বেড়াইতে লাগিল ভদ্র লোকের ঘরে বিধবা হইয়া থাকা অপেক্ষা শীঘ্র মরা ভাল, এবং ঐ সময়ে তাহার আমোদ আহ্লাদ বাড়িয়া উঠিল – কিন্তু রামলাল আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া ভগিনীর সেবা-শুশ্রূষা করিতে লাগলেন ও ভগিনীর আরোগ্যের জন্য অতিশয় চিন্তান্বিত ও যত্নবান হইলেন। ভগিনী পীড়া হইতে রক্ষা পাইলেন না – মৃত্যুকালীন ছোট ভ্রাতার মস্তকে হাত দিয়া বলিলেন – রাম! যদি মরে আবার মেয়ে জন্ম হয় তবে যেন তোমার মতো ভাই পাই – তুমি আমার যা করেছ তাহা আমি মুখে বলিতে পারিনে – তোমার যেমন মন তেমনি পরমেশ্বর তোমাকে সুখে রাখিবেন – এই বলিয়া ভগিনী প্রাণ ত্যাগ করিলেন।.


আলালের ঘরের দুলাল

১৪. মতিলাল ও তাহার দলবল একজন কবিরাজ লইয়া তামাশা-ফষ্টি করণ, রামলালের সহিত বরদাপ্রসাদবাবুর দেশ ভ্রমণের ফলের কথা, হুগলী হইতে গুমখুনির পরওয়ানা ও বরদাবাবু প্রভৃতির তথায় গমন।

বেলেল্লা ছোঁড়াদের আয়েসে আশ মেটে না, প্রতিদিন তাহাদের নূতন নূতন টাটকা টাটকা রং চাই। বাহিরে কোনো রকম আমোদের সূত্র না পাইলে ঘরে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বসে। যদি প্রাচীন খুড়া জেঠা থাকে তবেই বাঁচোয়া, কারণ বেসম্পর্ক ঠাট্টা চলে অথবা জো সো করে তাঁহাদিগের গঙ্গাযাত্রার ফিকিরও হইতে পারে, নতুবা বিষম সংকট – একেবারে চারিদিকে সরিষাফুল দেখে।

মতিলাল ও তাহার সঙ্গীরা নানা রঙ্গের রঙ্গী হইয়া অনেক প্রকার লীলা করিতে লাগিল কিন্তু কোন্‌ লীলা যে শেষ লীলা হইবে, তাহা বলা বড় কঠিন। তাহাদিগের আমোদ-প্রমোদের তৃষ্ণা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। এক এক রকমের আমোদ দুই-একদিন ভাল লাগে – তাহার পরেই বাসী হইয়া পড়ে, আবার অন্য কোনো রং না হইলে ছট্‌ফটানি উপস্থিত হয়। এইরূপে মতিলাল দলবল লইয়া কাল কাটায়। পালাক্রমে এক একজনকে এক একটা নূতন নূতন আমোদের ফোয়ারা খুলিয়া দিতে হইত, এজন্য একদিন হলধর দোলগোবিন্দের গায়ে লেপমুড়ি দিয়া ভাইলেক সকলকে শিখাইয়া পড়াইয়া ব্রজনাথ কবিরাজের বাটীতে গমন করিল। কবিরাজের বাটীতে ঔষধ প্রস্তুতের ধুম লেগে গিয়াছে –  কোনোখানে রসাসিন্ধু মাড়া যাইতেছে – কোনোখানে মধ্যম নারায়ণ তৈলের জ্বাল হইতেছে – কোনোখানে সোনা ভস্ম হইতেছে। কবিরাজ মহাশয় এক হাতে ঔষধের ডিপে ও আর এক হাতে এক বোতল গুড়ুচ্যাদি তৈল লইয়া বাহিরে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে হলধর উপস্থিত হইয়া বলিল, রায় মহাশয়! অনুগ্রহ করিয়া শীঘ্র আসুন – জমিদারবাবুর বাটিতে একটি বালকের ঘোরতর জ্বরবিকার হইয়াছে বোধ হয় রোগীর এখন তখন হইয়াছে তবে তাহার আয়ু ও আপনার হাতযশ – অনুমান হয় মাতব্বর মাতব্বর ঔষধ পড়িলে আরাম হইলেও হইতে পারে। যদি আপনি ভাল করিতে পারেন যথাযোগ্য পুরস্কার পাইবেন। এই কথা শুনিয়া কবিরাজ তাড়াতাড়ি করিয়া রোগীর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যতগুলিন নববাবু নিকটে ছিল তাহারা বলিয়া উঠিল – আসতে আজ্ঞা হউক, আসতে আজ্ঞা হউক কবিরাজ মহাশয়! আমাদিগকে বাঁচাউন – দোলগোবিন্দ দশ-পনের দিন পর্যন্ত জ্বরবিকারে বিছানায় পড়িয়া আছে – দাহ পিপাসা অতিশয় – রাত্রে নিদ্রা নাই – কেবল ছট্‌ফট করিতেছে, – মহাশয় এক ছিলিম তামাক খাইয়া ভাল করিয়া হাত দেখুন। ব্রজনাথ রায় প্রাচীন, পড়াশুনা বড় নাই – আপন ব্যবসায়ে ধামাধরা গোছ – দাদা যা বলেন তাইতেই মত – সুতরাং স্বয়ংসিদ্ধ নহেন, আপনি কেটে ছিঁড়ে কিছুই করিতে পারে না। রায় মহাশয়ের শরীর ক্ষীণ, দন্ত নাই, কথা জড়িয়া পড়ে, কিন্তু মুখের মধ্যে যথেষ্ট গোঁপ –  গোঁপও পেকে গিয়াছে কিন্তু স্নেহপ্রযুক্ত কখনই ফেলিতেন না। রোগীর হাত দেখিয়া নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিলেন। হলধর জিজ্ঞাসা করিলেন –  কবিরাজ মহাশয় যে চুপ করিয়া থাকিলেন? কবিরাজ উত্তর না দিয়া রোগীর প্রতি দৃষ্টি করিতে লাগিলেন, রোগীও এক একবার ফেল্‌ ফেল্‌ করিয়া চায় –  এক একবার জিহ্বা বাহির করে – এক একবার দন্ত কড়মড় করে – এক একবার শ্বাসের টান দেখায় – এক একবার কবিরাজের গোঁপ ধরিয়া টানে। রায় মহাশয় সরে সরে বসেন, রোগী গড়িয়া গড়িয়া গিয়া তাহার তেলের বোতল লইয়া টানাটানি করে। ছোঁড়ারা জিজ্ঞাসা করিল – রায় মহাশয়! এ কি? তিনি বলিলেন – এ পীড়াটি ভয়ানক – বোধ হয় জ্বরবিকার ও উল্বণ হইয়াছে। পূর্বে সংবাদ পাইলে আরাম করিতে পারিতাম, এক্ষণে শিবের অসাধ্য। এই বলিতে বলিতে রোগী তেলের বোতল টানিয়া লইয়া এক গণ্ডুষ তৈল মাখিয়া ফেলিল। কবিরাজ দেখিলেন যে ছ-বুড়ির ফলে অমিত্তি হারাইতে হয়, এজন্য তাড়াতাড়ি বোতল লইয়া ভাল করিয়া ছিপি আঁটিয়া দিয়া উঠিলেন। সকলে বলিল – মহাশয় যান কোথায়? কবিরাজ কহিলেন – উল্বণ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি হইতেছে বোধ হয়, এক্ষণে রোগীকে এ স্থানে রাখা আর কর্তব্য নহে – যাহাতে তাহার পরকাল ভাল হয় এমতো চেষ্টা করা উচিত। রোগী এই কথা শুনিয়া ধড়মড়িয়া উঠিল – কবিরাজ এই দেখিয়া চোঁ চোঁ করিয়া পিট্টান দিলেন – বৈদ্যবাটীর অবতারেরা সকলেই পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়ে যাইতে লাগিল – কবিরাজ কিছুদূর যাইয়া হতভোম্বা হইয়া থ্‌মকিয়া দাঁড়াইলেন – নববাবুরা কবিরাজকে গলাধাক্কা দিয়া ফেলিয়া ঘাড়ে করিয়া লইয়া হরিবোল শব্দ করিতে করিতে গঙ্গাতীরে আনিল। দোলগোবিন্দ নিকটে আসিয়া কহিল – কবিরাজ মামা! আমাকে গঙ্গায় পাঠাইতে বিধি দিয়াছিলে – এক্ষণে রোজার ঘারে বোঝা – এসো বাবা! এক্ষণে তোমাকে অন্তর্জলি করিয়া চিতায় ফেলি। খামখেয়ালী লোকের দণ্ডে দণ্ডে মত ফেরে, আবার কিছুকাল পরে বলিল – আর আমাকে গঙ্গায় পাঠাইবে? যাও বাবা! ঘরের ছেলে ঘরে যাও, কিন্তু তেলের বোতলটা দিয়ে যাও। এই বলিয়া তেলের বোতল লইয়া সকলে রগরগে করিয়া তেল মাখিয়া ঝুপঝাপ করিয়া গঙ্গায় পড়িল। কবিরাজ এই সকল দেখিয়া শুনিয়া হতজ্ঞান হইলেন! এক্ষণে পালাইতে পারিলেই বাঁচি, এই ভাবিয়া পা বাড়াইতেছেন – ইতিমধ্যে হলধর সাঁতার দিতে দিতে চিৎকার করিয়া বলিল – ওগো কবরেজ মামা! বড় পিত্ত বৃদ্ধি হইয়াছে, পান দুই রসাসিন্ধু দিতে হবে – পালিও না। বাবা! যদি পালাও তো মামীকে হাতের লোহা খুলিতে হবে। কবিরাজ ঔষধের ডিপেটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া বাপ বাপ করিতে করিতে বাসায় প্রস্থান করিলেন।

ফাল্গুন মাসে গাছপালা গজিয়ে উঠে ও ফুলের সৌগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বরদাবাবুর বাসাবাটী গঙ্গার ধারে – সম্মুখে একখানি আটচালা ও চতুষ্পার্শে বাগান। বরদাবাবু প্রতিদিন বৈকালে ঐ আটচালায় বসিয়া বায়ু সেবন করিতেন এবং নানা বিষয় ভাবিতেন ও আত্মীয় লোক উপস্থিত থাকিলে তাহাদিগের সহিত আলাপ করিতেন। রামলাল সর্বদা নিকটে থাকিত, তাহার সহিত বরদাবাবুর মনের কথা হইত। রামলাল এই প্রকারে অনেক উপদেশ পায় – সুযোগ পাইলেই কি কি উপায়ে পরমার্থ জ্ঞান ও চিত্তশোধন হইতে পারে তদ্বিষয়ে গুরুকে খুঁচিয়া খুঁচিয়া জিজ্ঞাসা করিত। একদিন রামলাল বলিল – মহাশয়! আমার দেশ ভ্রমণ করিতে বড় ইচ্ছা যায় – বাটীতে থাকিয়া দাদার কুকথা ও ঠকচাচার কুমন্ত্রণা শুনিয়া তাক্ত হইয়াছি কিন্তু মা-বাপের ও ভগিনীর স্নেহপ্রযুক্ত বাড়ি ছেড়ে যাইতে পা বাধুবাধু করে কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারি না।

বরদা। দেশ ভ্রমণে অনেক উপকার। দেশ ভ্রমণ না করিলে লোকের বহুদর্শিত্ব জন্মে না, নানা প্রকার দেশ নানা প্রকার লোক দেখিতে দেখিতে মন দরাজ হয়। ভিন্ন ভিন্ন স্থানের লোকদিগের কি প্রকার রীতি-নীতি, কিরূপ ব্যবহার ও কি কারণে তাহাদিগের ভাল অথবা মন্দ অবস্থা হইয়াছে তাহা খুঁটিয়া অনুসন্ধান করিলে অনেক উপদেশ পাওয়া যায়; আর নানা জাতীয় ব্যক্তির সহিত সহবাস হওয়াতে মনের দ্বেষভাব দূরে যাইয়া সদ্ভাব বাড়িতে থাকে। ঘরে বসিয়া পড়াশুনা করিলে কেতাবী বুদ্ধি হয় – পড়াশুনাও চাই – সৎলোকের সহবাসও চাই – বিষয়কর্মও চাই – নানা প্রকার লোকের সহিত আলাপও চাই। এই কয়েকটি কর্মের দ্বারা বুদ্ধি পরিষ্কার এবং সদ্ভাব বৃদ্ধিশীল হয় কিন্তু ভ্রমণ করিতে গিয়া কি কি বিষয়ে ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিতে হইবে তাহা অগ্রে জানা আবশ্যক, তাহা না জানিয়া ভ্রমণ করা বলদের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়ানো মাত্র। আমি এমন কথা বলি না যে এরূপ ভ্রমণ করাতে কিছুমাত্র উপকার নাই – আমার সে অভিপ্রায় নহে, ভ্রমণ করিলে কিছু না কিছু উপকার অবশ্যই আছে কিন্তু যে ব্যক্তি ভ্রমণকালে কি কি অনুসন্ধান করিতে হয় তাহা না জানে ও সেই সকল অনুসন্ধান করিতে না পারে তাহার ভ্রমণের পরিশ্রম সর্বাংশে সফল হয় না। বাঙালীদিগের মধ্যে অনেকে এ দেশ হইতে ও দেশে গিয়া থাকেন কিন্তু ঐ সকল দেশ সংক্রান্ত আসল কথা জিজ্ঞাসা করিলে কয়জন উত্তমরূপে উত্তর করিতে পারে? এ দোষটি বড় তাহাদিগের নহে – এটি তাহাদিগের শিক্ষার দোষ। দেখাশুনা, অন্বেষণ ও বিবেচনা করিতে না শিখিলে একবারে আকাশ থেকে ভাল বুদ্ধি পাওয়া যায় না। শিশুদিগকে এমতো তরিবত দিতে হইবে যে তাহারা প্রথমে নানা বস্তুর নক্সা দেখিতে পায় – সকল তসবির দেখিতে দেখিতে একটার সহিত আর একটার তুলনা করিবে অর্থাৎ এর হাত আছে, ওর পা নাই, এর মুখ এমন, ওর লেজ নাই, এইরূপ তুলনা করিলে দর্শনশক্তি ও বিবেচনাশক্তি দুয়েরই চালনা হইতে থাকিবে। কিছুকাল পরে এইরূপ তুলনা করা আপনা-আপনি সহজ বোধ হইবে তখন নানা বস্তু কি কারণে পরস্পর ভিন্ন হইয়াছে তাহা বিবেচনা করিতে পারিবে, তাহার পরে কোন্‌ কোন্‌ শ্রেণীতে আসিতে পারে তাহা অনায়াসে বোধগম্য হইবে। এই প্রকার উপদেশ দিতে দিতে অনুসন্ধান করণের অভ্যাস ও বিবেচনাশক্তির চালনা হয়। কিন্তু এরূপ শিক্ষা এদেশে প্রায় হয় না এজন্য আমাদিগের বুদ্ধি গোলমেলে ও ভাসা ভাসা হইয়া পড়ে – কোনো প্রস্তাব উপস্থিত হইলে কোন্‌ কথাটা বা সার ও কোন্‌ কথাটা বা অসার তাহা শীঘ্র বোধগম্য হয় না ও কিরূপ অনুসন্ধান করিলে প্রস্তাবের বিবেচনা হইয়া ভাল মীমাংসা হইতে পারে তাহাও অনেকের বুদ্ধিতে আসে না অতএব অনেকের ভ্রমণ যে মিথ্যা ভ্রমণ হয় এ কথা অলীক নহে কিন্তু তোমার যে প্রকার শিক্ষা হইয়াছে তাহাতে বোধ হয় ভ্রমণ করিলে তোমার অনেক উপকার দর্শিবে।

রামলাল। যদি বিদেশে যাই তবে যে স্থানে বসতি আছে সেই সেই স্থানে কিছুকাল অবস্থিতি করিতে হইবে কিন্তু আমি কোন্‌ জাতীয় ও কি প্রকার লোকের সহিত অধিক সহবাস করিব?

বরদা। এ কথাটি বড় সহজ নহে – ঠাওরিয়া উত্তর দিতে হবে। সকল জাতিতেই ভাল-মন্দ লোক আছে–ভাল লোক পাইলেই তাহার সহিত সহবাস করিবে। ভাল লোকের লক্ষণ তুমি বেশ জানো, পুনরায় বলা অনাবশ্যক। ইংরেজদিগের নিকটে থাকিলে লোকে সাহসী হয় – তাহারা সাহসকে পূজা করে – যে ইংরাজ অসাহসিক কর্ম করে সে ভদ্রসমাজে যাইতে পারে না কিন্তু সাহসী হইলে যে সর্বপ্রকারে ধার্মিক হয় এমতো নহে – সাহস সকলের বড় আবশ্যক বটে কিন্তু যে সাহস ধর্ম জ্ঞান হইতে উৎপন্ন হয় সেই সাহসই সাহস – তোমাকে পূর্বেই বলিয়াছি ও এখনও বলিতেছি সর্বদা পরমার্থ চর্চা করিবে নতুবা যাহা দেখিবে – যাহা শুনিবে – যাহা শিখিবে তাহাতেই অহংকার বৃদ্ধি হইবে। আর মনুষ্য যাহা দেখে তাহাই করিতে ইচ্ছা হয়, বিশেষতঃ বাঙালীরা সাহেবদিগের সহবাসে অনেক ফাল্‌তো সাহেবানি শিখিয়া অভিমানে ভরে যায় ও যে-কিছু কর্ম করে তাহা অহংকার হইতেই করিয়া থাকে – এ কথাটিও স্মরণ থাকিলে ক্ষতি নাই।

এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে বাগানের পশ্চিম দিক থেকে জনকয়েক পিয়াদা হন্‌ হন্‌ করিয়া আসিয়া বরদাবাবুকে ঘিরিয়া ফেলিল – বরদাবাবু তাহাদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন – তোমরা কে? তাহারা উত্তর করিল – আমরা পুলিশের লোক – আপনার নামে গোমখুনির নালিশ হইয়াছে – আপনাকে হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আদালতে যাইয়া জবাব দিতে হইবে আর আমরা এখানে গোমতল্লাশ করিব। এই কথা শুনিবামাত্রে রামলাল দাঁড়াইয়া উঠিল ও পরওয়ানা পড়িয়া মিথ্যা নালিশ জন্য রাগে কাঁপিতে লাগিল। বরদাবাবু তাহার হাতে ধরিয়া বসাইলেন এবং বলিলেন – ব্যস্ত হইও না, বিষয়টা তলিয়ে দেখা যাউক – পৃথিবীতে নানাপ্রকার উৎপাত ঘটিয়া থাকে। আপদ্‌ উপস্থিত হইলে কোনোমতে অস্থির হওয়া কর্তব্য নহে–বিপদকালে চঞ্চল হওয়া নির্বুদ্ধির কর্ম, আর আমার উপর যে দোষ হইয়াছে তাহা মনে বেশ জানি যে আমি করি নাই – তবে আমার ভয় কি? কিন্তু আদালতের হুকুম অবশ্য মানিতে হইবে এজন্য সেখানে শীঘ্র হাজির হইব। এক্ষণে পেয়াদারা আমার বাটী তল্লাশ করুক ও দেখুক যে আমি কাহাকেও লুকাইয়ে রাখি নাই। আদেশ পাইয়া পেয়াদারা চারিদিকে তল্লাশ করিল কিন্তু গুমি পাইল না।

অনন্তর বরদাবাবু নৌকা আনাইয়া হুগলী যাইবার উদ্‌যোগ করিতে লাগিলেন, ইতিমধ্যে বালীর বেণীবাবু দৈবাৎ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে ও রামলালকে সঙ্গে করিয়া বরদাবাবু হুগলীতে গমন করিলেন। বেণীবাবু ও রামলাল কিঞ্চিৎ চিন্তাযুক্ত হইয়া থাকিলেন কিন্তু বরদাবাবু সহাস্যবদনে নানা-প্রকার কথাবার্তায় তাহদিগকে সুস্থির করিতে লাগিলেন।


আলালের ঘরের দুলাল

১৫. হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি বর্ণন, বারদাবাবু, রামলাল ও বেণীবাবুর সহিত ঠকচাচার সাক্ষাৎ, সাহেবের আগমন ও তজবিজ আরম্ভ এবং বরদাবাবুর খালাস।

হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি বড় সরগরম। আসামী, ফৈরাদি, সাক্ষী, কয়েদী, উকল ও আমলা সকলেই উপস্থিত আছে, সাহেব কখন আসিবে —সাহেব কখন আসিবে বলিয়া অনেকে টো টো করিয়া ফিরিতেছে, কিন্তু সাহেবের দেখা নাই। বরদাবাবু বেণীবাবু ও রামলালকে লইয়া একটি গাছের নীচে কম্বল পাতিয়া বসিয়া আছেন। তাঁহার নিকট দুই একজন আমলা-ফয়লা আসিয়া ঠারে ঠোরে চুক্তির কথা কহিতেছে, কিন্তু বরদাবাবু তাহাতে ঘাড় পাতেন। তাঁহাকে ভয় দেখাইবার জন্য তাহারা বলিতেছে —সাহেবের হুকুম বড় কড়া —কর্মকাজ সকলই আমাদিগের হাতের ভিতর —আমরা যা মনে করি তাহাই করিতে পারি —জবানবন্দি করানো আমাদিগের কর্ম —কলমের মারপেঁচে সকলই উলটে দিতে পারি, কিন্তু রুধির চাই —তদ্‌বির করতে হয় তো এই সময় করা কর্তব্য, একটা হুকুম হইয়া গেলে আমাদিগের ভাল করা অসাধ্য হইবে। এই সকল কথা শুনিয়া রামলালের এক একবার ভয় হইতেছে কিন্তু বরদাবাবু অকুতোভয়ে বলিতেছেন—আপনাদিগের যাহা কর্তব্য তাহাই করিবেন, আমি কখনই ঘুষ দিব না, আমি নির্দোষ —আমার কিছুই ভয় নাই। আমলারা বিরক্ত হইয়া আপন আপন স্থানে চলিয়া গেল। দুই একজন উকিল বরদাবাবুর নিকটে আসিয়া বলিল —দেখিতেছি মহাশয় অতি ভদ্রলোক —অবশ্য কোনো দায়ে পড়িয়াছেন, কিন্তু মকদ্দমাটি যেন বেতদ্‌বিরে যায় না —যদি সাক্ষীর যোগাড় করিতে চাহেন এখান হইতে করিয়া দিতে পারি, কিঞ্চিৎ ব্যয় করিলেই সকল সুযোগ হইতে পারে। সাহেব এল এল হইয়াছে, যাহা করিতে হয় এই বেলা করুন। বরদাবাবু উত্তর করিলেন —আপনাদিগের বিস্তর অনুগ্রহ কিন্তু আমাকে বেড়ি পরিতে হয় তাহাও পরিব—তাহাতে আমার ক্লেশ হইবে না —অপমান হইবে বটে, সে অপমান স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি —কিন্তু প্রাণ গেলেও মিথ্যা পথে যাইব না। ঈস্‌! মহাশয় যে সত্য যুগের মানুষ —বোধ হয় রাজা যুধিষ্ঠির মরিয়া জন্মিয়াছেন —না? এইরূপ ব্যঙ্গ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে তাহারা চলিয়া গেল।

এই প্রকারে দুটো বাজিয়া গেল —সাহেবের দেখা নাই, সকলেই তীর্থের কাকের ন্যায় চাহিয়া আছে। কেহ কেহ একজন আচার্য ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিতেছে—অহে! গণে বলো দেখি সাহেব আসিবেন কি-না? অমনি আচার্য বলিতেছেন —একটা ফুলের নাম করো দেখি? কেহ বলে জবা —আচার্য আঙুলে গনিয়া বলিতেছেন —না, আজ সাহেব আসিবেন না —বাটীতে কর্ম আছে। আচার্যের কথায় বিশ্বাস করিয়া সকলে দপ্তর বাঁধিতে উদ্যত হইল ও বলিয়া উঠিল —রাম বাঁচলুম। বাসায় গিয়া চদ্দপ্যে হওয়া যাউক। ঠকচাচা ভিড়ের ভিতর বসিয়াছিল, জন চারেক লোক সঙ্গে —বগলে একটা কাগজের পোঁটলা —মুখে কাপড়, —চোখ দুটি মিট মিট করিতেছে। দাড়িটি ঝুলিয়া পরিয়াছে, ঘাড় হেঁট করিয়া চলিয়া যাইতেছে। এমতো সময় তাহার উপর রামলালের নজর পড়িল। রামলাল অমনি বরদা ও বেণীবাবুকে বলিল —দেখুন দেখুন ঠকচাচা এখানে আসিয়াছে —বোধ হয় ও এই মকদ্দমার জড় —না হলে আমাকে দেখিয়া মুখ ফেরায় কেন? বরদাবাবু মুখ তুলিয়া দেখিয়া উত্তর করিলেন —এ কথাটি আমারও মনে লাগে —আমাদিগের দিকে আড়ে আড়ে চায় আবার চোখের উপর চোখ পরিলে ঘাড় ফিরিয়া অন্যের সহিত কথা কয় —বোধ হয় ঠকচাচাই সরষের ভিতর ভূত। বেণীবাবুর সদা হাস্য বদন —রহস্য দ্বারা অনেক অনুসন্ধান করেন। চুপ করিয়া না থাকিতে পারিয়া ঠকচাচা ঠকচাচা বলিয়া চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন। পাঁচ-সাত ডাক তো ফাওয়ে গেল —ঠকচাচা বগল থেকে কাগজ খুলিয়া দেখিতেছে —বড় ব্যস্ত —শুনেও শুনে না —ঘাড়ও তোলে না। বেণীবাবু তাহার নিকটে আসিয়া হাত ঠেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন —ব্যাপারটা কি? তুমি এখানে কেন? ঠকচাচা কথাই কন না, কাগজ উল্টে-পাল্টে দেখিতেছেন —এদিকে যমলজ্জা উপস্থিত —কিন্তু বেণীবাবুকেও টেলে দিতে হইবে, তাঁহার কথায় উত্তর না দিয়ে বলিল —বাবু! দরিয়ার বড় মৌজ হইয়াছে —এজ তোমরা কি সুরতে যাবে? ভাল, তা যা হউক তুমি এখানে কেন? আরে ঐ বাতই মোকে বার বার পুচ করো কেন? মোর বহুত কাম, থোড়া ঘড়ি বাদ মুই তোমার সাতে বাত করব —আমি জেরা ফিরে এসি, এই বলিয়া ঠকচাচা ধাঁ করিয়া সরিয়া গিয়া একজন লোকের সঙ্গে ফাল্‌ত কথায় ব্যস্ত হইল।

তিনটা বাজিয়া গেল —সকল লোকে ঘুরে-ফিরে ত্যক্ত হইল, মফস্বলে কর্মের নিকাশ নাই —আদালতে হেঁটে হেঁটে লোকের প্রাণ যায়। কাছারি ভাঙো ভাঙো হইয়াছে এমতো সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ীর গড় গড় শব্দ হইতে লাগিল, অমনি সকলে চিৎকার করিয়া উঠিল —সাহেব আস্‌ছেন আস্‌ছেন। আচার্যের মুখ শুকাইয়া গেল —দুই-একজন লোক বলিল —মহাশয়ের চমৎকার গণনা —আচার্য কহিলেন, আজ কিঞ্চিৎ রুক্ষ সামগ্রী খাইয়াছিলাম এই জন্য গণনায় ব্যতিক্রম হইয়াছে। আমলা-ফয়লারা স্ব স্ব স্থানে দাঁড়াইল। সাহেব কাছারি প্রবেশ করিবামাত্রেই সকলে জমি পর্যন্ত ঘাড় হেঁট করিয়া সেলাম বাজাইল। সাহেব শিস্‌ দিতে দিতে বেঞ্চের উপর বসিলেন —হুক্কাবরদার আলবলা আনিয়া দিল —তিনি মেজের উপর দুই পা তুলিয়া চৌকিতে শুইয়া পড়িয়া আলবলা টনিতেছেন ও লেবগুব ওয়াটার মাখানো হাতরুমাল বাহির করিয়া মুখ পুঁচিতেছেন। নাজিরদপ্তর লোকে ভারিয়া গেল —জবানবন্দিনবিস্‌ হন্‌ হন্‌ করিয়া জবানবন্দি লিখিতেছে কিন্তু যাহার কড়ি তাহার জয় —সেরেস্তাদার জোড়া গায়ে, খিরকিদার পাগড়ি মাথায়, রাশি রাশি মিছিল লইয়া সাহেবের নিকট গায়েনের সুরে পড়িতেছে, সাহেব খবরের কাগজ দেখিতেছেন ও আপনার দরকারি চিঠিও লিখিতেছেন, এক একটা মিছিল পড়া হলেই জিজ্ঞাসা করেন —ওয়েল কেয়া হোয়া? সেরেস্তাদারের যেমন ইচ্ছা তেমনি করিয়া বুঝান ও সেরেস্তাদারের যে রায় সাহেবেরও সেই রায়।

বরদাবাবু বেণীবাবু ও রামলালকে লইয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। যেরূপ বিচার হইতেছে তাহা দেখিয়া তাঁহার জ্ঞান হত হইল। জবানবন্দিনবিসের নিকট তাঁহার মকদ্দমার যেরূপ জবানবন্দি হইয়াছে তাহাতে তাঁহার কিছুমাত্র মঙ্গল হইবার সম্ভাবনা নাই —সেরেস্তাদার যে আনুকূল্য করে তাহাও অসম্ভব, এক্ষণে অনাথার দৈব সখা। এই সকল মনোমধ্যে ভাবিতেছেন ইতিমধ্যে তাঁহার মকদ্দমা ডাক হইল। ঠকচাচা অন্তরে বসিয়াছিল, অমনি বুক ফুলাইয়া সাক্ষীদিগকে সঙ্গে করিয়া সাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল। মিছিলের কাগজাত পড়া হইলে সেরেস্তাদার বলিল, খোদাওয়ান্দ! গোমখুনি সাফ সাবুদ হুয়া —ঠকচাচা অমনি গোঁপে চাড়া দিয়া বরদাবাবুর প্রতি কট্‌মট্‌ করিয়া দেখিতে লাগিল, মনে করিতেছে এতক্ষণের পর কর্ম কেয়াল হইল। মিছিল পড়া হইলে অন্যান্য মকদ্দমায় আসামীদের কিছুই জিজ্ঞাসা হয় না —তাহাদিগের প্রায় ছাগল বলিদানের ব্যাপারই হইয়া থাকে, কিন্তু হুকুম দেখার অগ্রে দৈবাৎ বরদাবাবুর উপর সাহেবের দৃষ্টিপাত হওয়াতে তিনি সম্মানপূর্বক মকদ্দমার সমস্ত সরেওয়ার সাহেবকে ইংরেজীতে বুঝাইয়া দিলেন ও বলিলেন যে-ব্যক্তিকে গোমখুনি সাজান হইয়াছে তাহাকে আমি কখনই দেখি নাই ও যৎকালীন হুজুরি পেয়াদারা আমার বাটী তল্লাশ করে তখন তাহারা ঐ লোককে পায় নাই, সেই সময় বেণীবাবু ও রামলাল ছিলেন, যদ্যপি ইহাদিগের সাক্ষ্য অনুগ্রহ করিয়া লয়েন তবে আমি যাহা এজেহার করিতেছি তাহা প্রমাণ হইবে। বরদাবাবুর ভদ্র চেহারায় ও সৎ বিবেচনার কথাবার্তায় সাহেবের অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা হইল —ঠকচাচা সেরেস্তাদারের সহিত অনেক ইশারা করিতেছে কিন্তু সেরেস্তাদার ভজকট দেখিয়া ভাবিতেছে পাছে টাকা উগরিয়া দিতে হয়, অতএব সাহেবের নিকটে ভয় ত্যাগ করিয়া বলিল —হুজুর এ মকদ্দমা আয়ৌর শুন্নেকা জরুর নেহি। সাহেব সেরেস্তাদারের কথায় পেছিয়া পড়িয়া দাঁত দিয়া হাতের নখ কাটিতেছেন ও ভাবিতেছেন—এই অবসরে বরদাবাবু আপন মকদ্দমার আসল কথা আস্তে আস্তে একটি একটি করিয়া পুর্নবার বুঝাইয়া দিলেন, সাহেব তাহা শুনিবামাত্রেই বেণীবাবুর ও রামলালের সাক্ষ্য লইলেন ও তাহাদিগের জবানবন্দিতে নালিশ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রকাশ হইয়া ডিস্‌মিস্‌ হইল। হুকুম না হইতে হইতে ঠকচাচা চোঁ করিয়া এক দৌড় মারিল। বরদাবাবু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে সেলাম করিয়া আদালতের বাহিরে আসিলেন। কাছারি বরখাস্ত হইলে যাবতীয় লোক তাঁহাকে প্রশাংসা করিতে লাগিল, তিনি সে সব কথায় কান না দিয়া ও মকদ্দমা জিতের দরুন পুলকিত না হইয়া বেণীবাবু ও রামলালের হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে নৌকায় উঠিলেন।