» » আলালের ঘরের দুলাল

বর্ণাকার

আলালের ঘরের দুলাল

৬. মতিলালের মাতার চিন্তা, ভগিনীদ্বয়ের কথোপকথন, বেণী ও বেচারাম বাবুর নীতি বিষয়ে কথোপকথন ও বরদাপ্রসাদবাবুর পরিচয়।

বৈদ্যবাটীর বাটিতে স্বস্ত্যয়নের ধুম লেগে গেল। সূর্য উদয় না হইতে হইতে শ্রীধর ভট্টাচার্য, রামগোপাল চূড়ামণি প্রভৃতি জপ করিতে বসিলেন। কেহ তুলসী দেন —কেহ বিল্বপত্র বাছেন —কেহ বববম্ বববম্ করিয়া গালবাদ্য করেন —কেহ বলেন যদি মঙ্গল না হয় তবে আমি বামুন নাহি —কেহ কহেন যদি মন্দ হয় তবে আমি পৈতে ওলাব। বাটীর সকলেই শশব্যস্ত —কাহারো মনে কিছু মাত্র সুখ নাই।

গৃহিণী জানালার নিকট বসিয়া কাতরে আপন ইষ্টদেবতাকে ডাকিতেছেন। কোলের ছেলেটি চুষি লইয়া চুষিতেছে —মধ্যে মধ্যে হাত পা নাড়িয়া খেলা করিতেছে। শিশুটির প্রতি এক একবার দৃষ্টিপাত করিয়া গৃহিণী মনে মনে বলিতেছেন —জাদু! তুমি আবার কেমন হবে বলতে পারি না। ছেলে না হবার এক জ্বালা —হবার শতেক জ্বালা —যদি ছেলের একটু রোগ হল, তো মার প্রাণ অমনি উড়ে গেল। ছেলে কিসে ভাল হবে এজন্য মা শরীর একেবারে ঢেলে দেয় —তখন খাওয়া বলো —শোয়া বলো, সব ঘুরে যায়। দিনকে দিন জ্ঞান হয় না, রাতকে রাত জ্ঞান হয় না। এত দুঃখের ছেলে বড় হয়ে যদি সুসন্তান হয় তবেই সব সার্থক —তা না হলে মার জীয়ন্তে মৃত্যু —সংসারে কিছুই ভাল লাগে না —পাড়াপড়শীর কাছে মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না —বড় মুখটি ছোট হয়ে যায় আর মনে হয় যে পৃথিবী দোফাঁক হও আমি তোমার ভিতরে সেঁদুই। মতিকে যে করে মানুষ করেছি তা গুরুদেবই জানেন —এখন বাছা উড়তে শিখে আমাকে ভাল সাজাই দিতেছেন। মতির কুকর্মের কথা শুনে অমি ভাজা ভাজা হয়েছি, দুঃখেতে ও ঘৃণাতে মরে রয়েছি। কর্তাকে সকল কথা বলি না, সকল কথা শুনিলে তিনি পাগল হতে পারেন। দূর হউক, আর ভাবতে পারি না। আমি মেয়েমানুষ, ভেবেই বা কি করিব—যা কপালে আছে তাই হবে।

দাসী আসিয়া খোকাকে লইয়া গেল। গৃহিণী আহ্নিক করিতে বসিলেন। মনের ধর্মই এই যখন এক বিষয়ে মগ্ন থাকে তখন সে বিষয়টি হঠাৎ ভুলিয়া আর একটি বিষয়ে প্রায় যায় না। এই কারণে গৃহিণী আহ্নিক করিতে বসিয়াও আহ্নিক করিতে পারিলেন না। এক একবার যত্ন করেন জপে মন দি, কিন্তু মন সেদিকে ধায় না। মতির কথা মনে উদয় হইতে লাগিল —সে যেন প্রবল স্রোত, কার সাধ্যি নিবারণ করে। কখন কখন বোধ হইতে লাগিল তাহার কয়েদ হুকুম হইয়াছে —তাহাকে বাঁধিয়া জেলে লইয়া যাইতেছে, তাহার পিতা নিকটে দাঁড়াইয়া আছেন, দুঃখেতে ঘার হেঁট করিয়া রোদন করিতেছেন। কখন বা জ্ঞান হইতেছে, পুত্র নিকটে আসিয়া বলিতেছেন, মা আমাকে ক্ষমা করো —আমি যা করিয়াছি তা করিয়াছি আর আমি কখন তোমার মনে বেদনা দিব না, আবার এক একবার বোধ হইতেছে যে মতির ঘোর বিপদ উপস্থিত, তাহাকে জন্মের মতো দেশান্তর যাইতে হইবেক। গৃহিণীর চটক ভাঙিয়া গেলে আপনাআপনি বলিতে লাগিলেন —এ দিনের বেলা আমি কি স্বপ্ন দেখিতেছি? না এ তো স্বপ্ন নয়, তবে কি খেয়াল দেখিলাম? কে জানে আমার মনটা আজ কেন এমন হচ্চে। এই বলিয়া চক্ষের জল ফেলতে ফেলতে ভূমিতে আস্তে আস্তে শয়ন করিলেন। দুই কন্যা মোক্ষদা ও প্রমদা ছাতের উপর বসিয়া মাথা শুকাইতেছিলেন।

মোক্ষদা। ওরে প্রমদা। চুলগুলো ভাল করে এলিয়ে দে না, তোর চুল গুলা যে বড় উষ্কখুষ্ক হয়েছে! না হবেই বা কেন? সাত জন্মের তো একটু তেল পড়ে না—মানুষের তেলে-জলেই শরীর, বারো মাস রুক্ষু নেয়ে নেয়ে কি একটা রোগনারা করবি? তুই এত ভাবিস্ কেন? ভেবে ভেবে যে দড়ি বেটে গেলি।

প্রমদা। দিদি। আমি কি সাধ করে ভাবি? মনে বুঝে না, কি করি? ছেলেবেলা বাপ একজন কুলীনের ছেলেকে ধরে এনে আমাকে বিবাহ দিয়েছিলেন —এ কথা বড় হয়ে শুনেছি। পতি কত শত স্থানে বিয়ে করেছেন, আর তাঁহার যেরূপ চরিত্র তাতে তাঁহার মুখ দেখতে ইচ্ছা হয় না। অমন স্বামী না থাকা ভাল।

মোক্ষদা। হাবি! অমন কথা বলিস নে —স্বামী মন্দ হউক ছন্দ হউক, মেয়েমানুষের এয়ত্ থাকা ভাল।

প্রমদা। তবে শুনবে? আর বৎসর যখন আমি পালা জ্বরে ভুগতেছিনু —দিবারাত্রি বিছানায় পড়ে থাকতুম —উঠিয়া দাঁড়াইবার শক্তি ছিল না, সে সময় স্বামী আসিয়া উপস্থিত হলেন। স্বামী কেমন, জ্ঞান হওয়া অবধি দেখি নাই, মেয়ে মানুষের স্বামীর ন্যায় ধন নাই। মনে করিলাম দুই দণ্ড কাচে বসে কথা কহিলে রোগের যন্ত্রণা কম হবে। দিদি বললে প্রত্যয় যাবে না —তিনি আমার কাছে দাঁড়াইয়াই অমনি বল্লেন —ষোল বৎসর হইল তোমাকে বিবাহ করে গিয়াছি —তুমি আমার এক স্ত্রী —টাকার দরকারে তোমার নিকটে আসিতেছি —শীঘ্র যাব —তোমার বাপকে বললাম। তিনি তো ফাঁকি দিলেন —তোমার হাতের গহনা খুলিয়া দাও। আমি বললাম —মাকে জিজ্ঞাসা করি —মা যা বলবেন তাই করবো। এই কথা শুনিবা মাত্র আমার হাতের বালাগাছটা জোর করে খুলে নিলেন। আমি একটু হাত বাগড়া বাগড়ি করেছিনু, আমাকে একটা লাথি মারিয়া চলিয়া গেলেন —তাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিনু, তারপর মা আসিয়া আমাকে অনেকক্ষণ বাতাস করাতে আমার চেতনা হয়।

মোক্ষদা। প্রমদা। তোর দুঃখের কথা শুনিয়া আমার চক্ষে জল আইসে, দেখ তোর তবু এয়ত্ আছে, আমার তাও নাই।

প্রমদা। দিদি। স্বামীর এই রকম। ভাগ্যে কিছুদিন মামার বাড়ি ছিলাম তাই একটু লেখাপড়া ও হুনুরি কর্ম শিখিয়াছি। সমস্ত দিন কর্ম-কাজ ও মধ্যে মধ্যে লেখাপড়া ও হুনুরি কর্ম করিয়া মনের দুঃখ ঢেকে বেড়াই। একলা বসে যদি একটু ভাবি তো মনটা অমনি জ্বলে উঠে।

মোক্ষদা। কি করবে? আর জন্মে কত পাপ করা গিয়েছিল তাই আমাদের এত ভোগ হইতেছে। খাটা খাটুনি করলে শরীরটা ভাল থাকে মনও ভাল থাকে। চুপ করিয়া বসে থাকিলে দুর্ভাবনা বলো, দুর্মতি বলো, রোগ বলো, সকলি আসিয়া ধরে। আমাকে এ কথা মামা বলে দেন —আমি এই করে বিধবা হওয়ার যন্ত্রণাকে অনেক খাটো করেছি, আর সর্বদা ভাবি যে সকলই পরমেশ্বরের হাত, তাঁর প্রতি মন থাকাই আসল কর্ম। বোন্! ভাবতে গেলে ভাবনার সমুদ্রে পড়তে হয়। তার কূল-কিনারা নাই। ভেবে কি করবি? দশটা ধর্ম -কর্ম কর্ —বাপ -মার সেবা কর —ভাই দুটির প্রতি যত্ন কর, আবার তাদের ছেলেপুলে হলে লালন —পালন করিস্ —তারাই আমাদের ছেলেপুলে।

প্রমদা। দিদি। যা বলতেছ তা সত্য বটে কিন্তু বড় ভাইটি তো একেবারে অধঃপাতে গিয়েছে। কেবল কুকথা কুকর্ম ও কুলোক লইয়া আছে। তার যেমন স্বভাব তেমনি বাপ-মার প্রতি ভক্তি —তেমনি আমাদের প্রতিও স্নেহ। বোনের স্নেহ ভায়ের প্রতি যতটা হয় ভায়ের স্নেহ তার শত অংশের এক অংশও হয় না। বোন ভাই-ভাই করে সারা হন কিন্তু ভাই সর্বদা মনে করেন বোন বিদায় হলেই বাঁচি। আমরা বড় বোন —মতি যদি কখন কখন কাছে এসে দু-একটা ভাল কথা বলে তাতেও মনটা ঠাণ্ডা হয় কিন্তু তার যেমন ব্যবহার তা তো জানো?

মোক্ষদা। সকল ভাই এরূপ করে না। এমন ভাইও আছে যে বড় বোনকে মার মতো দেখে, ছোট বোনকে মেয়ের মতো দেখে। সত্যি বল্‌চ এমন ভাই আছে যে ভাইকেও যেমন দেখে বোনকে তেমন দেখে। দু-দণ্ড বোনের সঙ্গে কথাবার্তা না কহিলে তৃপ্তি বোধ করে না ও বোনের আপদ্ পড়িলে প্রাণপণে সাহায্য করে।

প্রমদা। তা বটে কিন্তু আমাদিগের যেমন পোড়া কপাল তেমন ভাই পেয়েছি। হায়! পৃথিবীতে কোনো প্রকার সুখ হয় না।

দাসী আসিয়া বলিল —মা ঠাকুরুন কাঁদছেন —এই কথা শুনিবামাত্র দুই বোনে তাড়াতাড়ি করিয়া নীচে নামিয়ে গেলেন।

চাঁদনীর রাত্রি। গঙ্গার উপর চন্দ্রের আভা পড়িয়াছে—মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে—বনফুলের সৌগন্ধ মিশ্রিত হইয়া এক একবার যেন আমোদ করিতেছে—ঢেউগুলা নেচে উঠিতেছে। নিকটবর্তী ঝোপের পাখীসকল নানা রবে ডাকিতেছে। বালীর বেণীবাবু দেওনাগাজীর ঘাটে বসিয়া এদিক্ ওদিক্ দেখিতে দেখিতে কেদারা রাগিণীতে “শিখেহো” খেয়াল গাইতেছেন। গানেতে মগ্ন হইয়াছেন, মধ্যে মধ্যে তালও দিতেছেন। ইতিমধ্যে পেছন দিক্ থেকে “বেণী ভায়া, বেণী ভায়া, ও শিখেহো” বলিয়া একটা শব্দ হইতে লাগিল। বেণীবাবু ফিরিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারাম বাবু আসিয়া উপস্থিত। অমনি আস্তেব্যস্তে উঠিয়া সম্মানপূর্বক তাঁহাকে নিকটে আনিয়া বসাইলেন।

বেচারাম। বেণী ভায়া। তুমি আজ বাবুরামকে খুব ওয়াজিব কথা বলিয়াছ। তোমাদের গ্রামে নিমন্ত্রণে আসিয়াছিলাম —তোমার উপর আমি বড় তুষ্ট হইয়াছি —এজন্য ইচ্ছা হইল তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

বেণী। বেচারাম দাদা। আমরা নিজে দুঃখী প্রাণী লোক, মজুরী করে এনে দিনপাত করি। যেসব স্থানে জ্ঞানের অথবা ধর্মকথার চর্চা হয় সেই সব স্থানে যাই। বড়মানুষ কুটুম্ব ও আলাপী অনেক আছে বটে কিন্তু তাহাদিগের নিকট চক্ষুলজ্জা অথবা দায়ে পড়ে কিংবা নিজ প্রয়োজনেই কখন কখন যাই, সাধ করে বড় যাই না, আর গেলেও মনের প্রীতি হয় না কারণ বড়মানুষ বড়মানুষকেই খাতির করে, আমরা গেলে হদ্দ বল্‌বে—”আজো বড় গরমি—কেমন কাজকর্ম ভাল হচ্ছে—অরে এক ছিলিম তামাক দে।” যদি একবার হেসে কথা কহিলেন তবে বাপের সঙ্গে বত্তে গেলাম। এক্ষণে টাকার যত মান তত মান বিদ্যারও নাই ধর্মেরও নাই। আর বড়মানুষের খোসামোদ করাও বড় দায়। কথাই আছে “বড়র পিরীতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ” কিন্তু লোকে বুঝে না —টাকার এমন কুহক যে লোকে লাথিও খাচ্ছে এবং নিকট গিয়া যে আজ্ঞাও করছে। সে যাহা হউক, বড়মানুষের সঙ্গে থাকলে পরকাল রাখা ভার, আজকের যে ব্যাপারটি হইয়াছিল তাতে পরকালটি নিয়ে বিলক্ষণ টানাটানি!

বেচারাম। বাবুরামের রকম সকম দেখিয়া বোধ হয় যে তাহার গতিক ভাল নয়। আহা। কি মন্ত্রী পাইয়াছেন। এক বেটা নেড়ে তাহার নাম ঠকচাচা। সে বেটা জোয়াচোরের পাদশা। তার হাড়ে ভেল্‌কি হয়। বাঞ্ছারাম উকিলের বাটীর লোক! তিনি বর্ণচোরা আঁব —ভিজে বেড়ালের মতো আস্তে আস্তে সলিয়া কলিয়া লওয়ান্। তাঁহার জাদুতে যিনি পড়েন তাঁহার দফা একেবারে রফা হয়, আর বক্রেশ্বর মাস্টারগিরি করেন —নীতি শিখান অথচ জল উঁচু নীচু বলনের শিরোমণি। দূঁর দূঁর! যাহা হউক, তোমার এ ধর্মজ্ঞান কি ইংরাজী পড়িয়া হইয়াছে?

বেণী। আমার এমন কি ধর্মজ্ঞান আছে? এরূপ আমাকে বলা কেবল অনুগ্রহ প্রকাশ করা। যৎকিঞ্চিৎ যাহা হিতাহিত বোধ হইয়াছে তাহা বদরগঞ্জের বরদাবাবুর প্রসাদাৎ। সেই মহাশয়ের সহিত অনেক দিন সহবাস করিয়াছিলাম। তিনি দয়া করিয়া কিঞ্চিৎ উপদেশ দিয়াছেন।

বেচারাম। বরদাবাবু কে? তাহার বৃত্তান্ত বিস্তারিত করিয়া বলো দেখি। এমন কথা সকল শুনতে বড় ইচ্ছা হয়।

বেণী। বরদাবাবুর বাটী বঙ্গদেশে—পরগনে এটেকাগমারি। পিতার বিয়োগ হইলে কলিকাতায় আইসেন—অন্নবস্ত্রের ক্লেশ আত্যন্তিক ছিল —আজ খান এমতে যোত্র ছিল না। বাল্যাবস্থাবধি পরমার্থ প্রসঙ্গে সর্বদা রত থাকিতেন, এজন্য ক্লেশ পাইলেও ক্লেশ বোধ হইত না। একখানি সামান্য খোলার ঘরে বাস করিতেন—খুড়ার নিকট মাস মাস যে দুটি টাকা পাইতেন তাহাই কেবল ভরসা ছিল। দুই-একজন সৎলোকের সঙ্গে আলাপ ছিল —তদ্ভিন্ন কাহারও নিকট যাইতেন না, কাহার উপর কিছু ভার দিতেন না। দাসদাসী রাখিবার সঙ্গতি ছিল না—আপনার বাজার আপনি করিতেন—আপনার রান্না আপনি রাঁধিতেন, রাঁধিবার সময় পড়াশুনা অভ্যাস করিতেন, আর কি প্রাতে কি মধ্যাহ্নে কি রাত্রে একচিত্তে পরমেশ্বরকে ধ্যান করিতেন। স্কুলে ছেঁড়া ও মলিন বস্ত্রেই যাইতেন, বড়মানুষের ছেলেরা পরিহাস ও ব্যঙ্গ করিত। তিনি শুনিতেন না ও সকলকে ভাই দাদা ইত্যাদি মিষ্ট বাক্যের দ্বারা ক্ষান্ত করিতেন। ইংরাজী পড়িলে অনেকের মনে মাৎসর্য হয় —তাহারা পৃথিবীকে সরাখান্ দেখে। বরদাবাবুর মনে মাৎসর্য কোনো প্রকারে করিতে পারিত না। তাঁহার স্বভাব অতি শান্ত ও নম্র ছিল, বিদ্যা শিখিয়া স্কুল ত্যাগ করিলেন। স্কুল ত্যাগ করিবারমাত্র স্কুলে একটি ৩০ টাকার কর্ম হইল। তাহাতে আপনি ও মা ও স্ত্রী ও খুড়ার পুত্রকে বাসায় আনিয়া রাখিলেন এবং তাঁহারা কিরূপে ভাল থাকিবেন তাহাতেই অতিশয় যত্ন করিতে লাগিলেন। বাসার নিকট অনেক গরীব-দুঃখী লোক ছিল তাহাদিগেকে সর্বদা তত্ত্ব করিতেন —আপনার সাধ্যক্রমে দান করিতেন ও কাহারো পীড়া হইলে আপনি গিয়া দেখিতেন এবং ঔষধাদি আনিয়া দিতেন। ঐ সকল লোকের ছেলেরা অর্থাভাবে স্কুলে পড়িতে পারিত না এজন্য প্রাতে তিনি আপনি তাহাদিগকে পড়াইতেন। খুড়ার কাল হইলে খুড়াতুতো ভায়ের ঘোরতর ব্যামোহ হয়, তাহার নিকট দিনরাত বসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করাতে তিনি আরাম হন। বরদাবাবুর খুড়ীর প্রতি অসাধারণ ভক্তি ছিল, তাঁহাকে মায়ের মতো দেখিতেন। অনেকের পরমার্থ বিষয়ে শ্মশান বৈরাগ্য দেখা যায়। বন্ধু অথবা পরিবারের মধ্যে কাহারো বিয়োগ হইলে অথবা কেহ কোনো বিপদে পড়িলে জগৎ অসার ও পরমেশ্বরই সারাৎসার এই বোধ হয়। বরদাবাবুর মনে ঐ ভাব নিরন্তর আছে, তাঁহার সহিত আলাপ অথবা তাঁহার কর্ম দ্বারা তাহা জানা যায় কিন্তু তিনি একথা লইয়া অন্যের কাছে কখনই ভড়ং করেন না। তিনি চটুকে মানুষ নহেন —জাঁক ও চটকের জন্য কোনো কর্ম করেন না। সৎকর্ম যাহা করেন তাহা অতি গোপনে করিয়া থাকেন। অনেক লোকের উপকার করেন বটে কিন্তু যাহার উপকার করেন কেবল সেই ব্যক্তিই জানে, অন্য লোকে টের পাইলে অতিশয় কুণ্ঠিত হয়েন। তিনি নানা প্রকার বিদ্যা জানেন কিন্তু তাঁহার অভিমান কিছুমাত্র নাই। লোকে একটু শিখিয়া পুঁটি মাছের মতো ফর্ ফর্ করিয়া বেড়ায় ও মনে করে আমি বড় বুঝি —আমি যেমন লিখি এমন লিখিতে কেহ পারে না —আমার বিদ্যা যেমন, এমন বিদ্যা কাহারো নাই —আমি যাহা বলিব সেই কথাই কতা। বরদাবাবু অন্য প্রকার ব্যক্তি, তাঁহার বিদ্যাবুদ্ধি প্রগাঢ় তথাচ সামান্য লোকের কথাও অগ্রাহ্য করেন না এবং মতান্তরের কোন কথা শুনিলে কিছু মাত্র বিরক্তও হয়েন না বরং আহলাদপূর্বক শুনিয়া আপন মতের দোষগুণ পুনর্বার বিবেচনা করেন। ঐ মহাশয়ের নানা গুণ, সকল খুঁটিয়া বর্ণনা করা ভার —মোট এই বলা যাইতে পারে যে তাঁহার মতো নম্র ও ধর্মভীতু লোক কেহ কখন দেখে নাই —প্রাণ বিয়োগ হইলেও কখন অধর্মে তাঁহার মতি হয় না। এমতো লোকের সহবাসে যত সৎ উপদেশ পাওয়া যায় বহি পড়িলে তত হয় না।

বেচারাম। এমতো লোকের কথা শুনে কান জুড়ায়। রাত অনেক হইল, পারাপারের পথ, বাটী যাই। কাল যেন পুলিশে একবার দেখা হয়।


আলালের ঘরের দুলাল

৭. কলিকাতার আদিবৃত্তান্ত, জাস্টিস অব পিস নিয়োগ, পুলিশ বর্ণন, মতিলালের পুলিশে বিচার ও খালাস, বাবুরামবাবুর পুত্র লইয়া বৈদ্যবাটী গমন, ঝড়ের উত্থান ও নৌকা জলমগ্ন হওনের আশঙ্কা।

সংসারের গতি অদ্ভুত—মানববুদ্ধির অগম্য। কি কারণে কি হয় তাহা স্থির করা সুকঠিন। কলিকাতার আদি বৃত্তান্ত স্মরণ করিলে সকলেরই আশ্চার্য বোধ হইবে ও সেই কলিকাতা যে এই কলিকাতা হইবে ইহা কাহারো স্বপ্নেও বোধ হয় নাই।

কোম্পানীর কুঠি প্রথমে হুগলীতে ছিল, তাঁহাদিগের গোমস্তা জাব চার্নক সাহেব সেখানকার ফৌজদারের সহিত বিবাদ করেন, তখন কোম্পানীর এত জারিজুরি চলতো না সুতরাং গোমস্তাকে হুড়ো খেয়ে পালিয়ে আসিতে হইয়াছিল। জাব চার্নকের বারাকপুরে এক বাটী ও বাজার ছিল এই কারণে বারাকপুরের নাম অদ্যাবধি চার্নক বলিয়া খ্যাত আছে। জাব চার্নক একজন সতীকে চিতার নিকট হইতে ধরিয়া আনিয়া বিবাহ করিয়াছিলেন কিন্তু, ঐ বিবাহ পরস্পরের সুখজনক হইয়াছিল কি-না তাহা প্রকাশ হয় নাই। তিনি নূতন কুঠি করিবার জন্য উলুবেড়িয়ায় গমনাগমন করিয়াছিলেন ও তাঁহার ইচ্ছাও হয়েছিল যে সেখানে কুঠি হয় কিন্তু অনেক অনেক কর্ম হ পর্যন্ত হইয়া ক্ষ বাকি থাকিতেও ফিরিয়া যায়। জাব চার্নক বটুকখানা অঞ্চল দিয়া যাতায়াত করিতেন, তথায় একটা বৃহৎ বৃক্ষ ছিল তাহার তলায় বসিয়া মধ্যে মধ্যে আরাম করিতেন ও তামাকু খাইতেন, সেই স্থানে অনেক ব্যাপারীরাও জড়ো হইত। ঐ গাছের ছায়াতে তাঁহার এমনি মায়া হইল যে সেই স্থানেই কুঠি করিতে স্থির করিলেন। সূতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা এই তিন গ্রাম একেবারে খরিদ হইয়া আবাদ হইতে আরম্ভ হইল; পরে বাণিজ্য নিমিত্ত নানা জাতীয় লোক আসিয়া বসতি করিল ও কলিকাতা ক্রমে ক্রমে শহর হইয়া গুলজার হইতে লাগিল।

ইংরাজী ১৬৮৯ সালে কলিকাতা শহর হইতে আরম্ভ হয়। তাহার তিন বৎসর পরে জাব চার্নকের মৃত্যু হইল, তৎকালে গড়ের মাঠ ও চৌরঙ্গী জঙ্গল ছিল, এক্ষণে যে স্থানে পারমিট্ আছে পূর্বে তথায় গড় ছিল ও যে স্থানকে এক্ষণে ক্লাইব স্ট্রীট বলিয়া ডাকে সেই স্থানে সওদাগরি কর্ম হইত।

কলিকাতায় পূর্বে অতিশয় মারীভয় ছিল এজন্য যে— যে ইংরাজেরা তাহা হইতে পরিত্রাণ পাইত তাহারা প্রতি বৎসর নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে একত্র হইয়া আপন আপন মঙ্গলবার্তা বলাবলি করিত।

ইংরাজদিগের এক প্রধান গুণ এই যে, যে স্থানে বাস করে তাহা অতি পরিষ্কার রাখে। কলিকাতা ক্রমে ক্রমে সাফসুতরা হওয়াতে পীড়াও ক্রমে ক্রমে কমিয়া গেল কিন্তু বাঙালীরা ইহা বুঝিয়াও বুঝেন না। অদ্যাবধি লক্ষপতির বাটীর নিকটে এমন খানা আছে যে দুর্গন্ধে নিকট যাওয়া ভার।

কলিকাতার মাল, আদালত ও ফৌজদারী এই তিন কর্ম নির্বাহের ভার একজন সাহেবের উপর ছিল। তাঁহার অধীনে একজন বাঙালী কার্মচারী থাকিতেন ঐ সাহেবকে জমিদার বলিয়া ডাকিত। পরে অন্যান্য প্রকার আদালত ও ইংরাজদিগের দৌরাত্ম্য নিবারণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হইল, আর পুলিশের কর্ম স্বতন্ত্র হইয়া সুচারুরূপে চলিতে লাগিল। ইংরাজী ১৭৯৮ সালে স্যার জন রিচার্ডসন প্রভৃতি জাস্টিস অব পিস মোকরর হইলেন। তদনন্তর ১৮০০ সালে ব্লাকিয়র সাহেব প্রভৃতি ঐ কর্মে নিযুক্ত হন।

যাঁহারা জাস্টিস অব পিস হয়েন তাঁহাদিগের হুকুম এদেশের সর্বস্থানে জারি হয়। যাঁহারা কেবল ম্যাজিস্ট্রেট, জাস্টিস অব পিস নহেন, তাঁহদিগের আপন আপন সরহদ্দের বাহিরে হুকুম জারি করিতে গেলে তথাকার আদালতের মদৎ আবশ্যক হইত এজন্যে সম্প্রতি মফস্বলের অনেক ম্যাজিস্ট্রেট জাস্টিস অব পিস হইয়াছেন।

ব্লাকিয়র সাহেবের মৃত্যু প্রায় চারি বৎসর হইয়াছে। লোকে বলে ইংরাজের ঔরসে ও ব্রাহ্মণীর গর্ভে তাঁহার জন্ম হয়। তাঁহার প্রথম শিক্ষা এখানে হয়—পরে বিলাতে যাইয়া ভাল রূপ শিক্ষা করেন। পুলিশের ম্যাজিস্ট্রেসী কর্মপ্রাপ্ত হইলে তাঁহার দবদবায় কলিকাতা শহর কাঁপিয়া গিয়াছিল—সকলেই থরহরি কাঁপিত। কিছুকাল পরে সন্ধান-সুলুক করা ও ধরা-পাকড়ার কর্ম ত্যাগ করিয়া তিনি কেবল বিচার করিতেন। বিচারে সুপারগ ছিলেন, তাহার কারণ এই দেশের ভাষা ও রীতি-ব্যবহার ও ঘাঁত-ঘুঁত সকল ভাল বুঝিতেন—ফৌজদারী আইন তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল ও বহুকাল সুপ্রিম কোর্টের ইন্টারপ্রিটর থাকাতে মকদ্দমা কিরূপে করিতে হয় তদ্বিষয়ে তাঁহার উত্তম জ্ঞান জন্মিয়াছিল।

সময় জলের মতো যায়—দেখতে দেখতে সোমবার হইল—গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া দশটা বাজিল। সারজন্, সিপাই, দারোগা, নায়েব, ফাঁড়িদার, চৌকিদার ও নানা প্রকার লোকে পুলিশ পরিপূর্ণ হইল। কোথাও বা কতকগুলা বাড়িওয়ালী ও বেশ্যা বসিয়া পানের ছিবে ফেলছে –  কোথাও বা কতকগুলা লোক মারি খেয়ে রক্তের কাপড় সুদ্ধ দাঁড়িয়া আছে—কোথাও বা কতকগুলা চোর অধোমুখে এক পার্শ্বে বসিয়া ভাবছে—কোথাও বা দুই-একজন টয়ে বাঁধা ইংরেজীওয়ালা দরখাস্ত লিখছে—কোথাও বা ফৈরাদিরা নীচে উপরে টংঅস টংঅস করিয়া ফিরিতেছে— কোথাও বা সাক্ষী সকল পরস্পর ফুস ফুস করিতেছে—কোথাও বা পেশাদার জামিনেরা তীর্থের কাকের ন্যায় বসিয়া আছে—কোথাও বা উকিলদিগের দালাল ঘাপ্টি মেরে জাল ফেলিতেছে—কোথাও বা উকিলেরা সাক্ষীদিগের কানে মন্ত্র দিতেছে—কোথাও বা আমলারা চালানি মকদ্দমা টুক্‌ছে—কোথাও বা সারজনেরা বুকের ছাতি ফুলাইয়া মস্ মস্ করিয়া বেড়াচ্ছে—কোথাও বা সরদার সরদার কেরানীরা বলাবলি করচে—এ সাহেবটা গাধা, ও সাহেব পটু, এ সাহেব নরম, ও সাহেব কড়া— কালকের ও মকদ্দমাটার হুকুম ভাল হয় নাই। পুলিশ গস্ গস্ করিতেছে— সাক্ষাৎ যমালয়—কার কপালে কি হয়— সকলেই সশঙ্ক।

বাবুরামবাবু আপন উকিল, মন্ত্রী ও আত্মীয়গণ সহিত তাড়াতাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠকচাচার মাথায় মেন্তাই পাগড়ি, গায়ে পিরহান, পায়ে নাগোরা জুতা, হাতে ফটিকের মালা—বুজর্গ ও নবীর নাম নিয়া এক একবার দাড়ি নেড়ে তসবি পড়িতেছেন কিন্তু সে কেবল ভেক। ঠকচাচার মতো চালাক লোক পাওয়া ভার। পুলিশে আসিয়া চারিদিকে যেন লাটিমের মতো ঘুরিতে লাগিলেন। একবার এদিগে যান—একবার ওদিকে যান—একবার সাক্ষীদিগের কানে ফুস্ করেন—এক একবার বাবুরামবাবুর হাত ধরিয়া টেনে লইয়া যান—এক একবার বটলর সাহেবের সঙ্গে তর্ক করেন—এক একবার বাঞ্ছারামবাবুকে বুঝান। পুলিশের যাবতীয় লোক ঠকচাচাকে দেখিতে লাগিল। অনেকের বাপ পিতামহ চোর-ছেঁচড় হইলেও তাহাদিগের সন্তান-সন্ততিরা দুর্বল স্বভাব হেতু বোধ করে যে তাঁহারা অসাধারণ ও বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, এজন্য অন্যের নিকট আপন পরিচয় দিতে হইলে একেবারে বলিয়া বসে আমি অমুকের পুত্র অমুকের নাতি। ঠকচাচার নিকট যে আলাপ করিতে আসিতেছে, তাহাকে অমনি বলিতেছেন— মুই আবদুর রহমান গুলমোহাম্মদের লেড়কা ও আমপক্ আমপক্ গোলাম হোসেনের পোতা। একজন ঠোঁটকাটা সরকার উত্তর করিল, আরে তুমি কাজ-কর্ম কি করো তাই বলো— তোমার বাপ-পিতামহের নাম নেড়ে পাড়ার দুই-এক বেটা শোরখেকো জানতে পারে কলিকাতা শহরে কে জানবে? তারা কি সইসগিরি কর্ম করিত? এই কথা শুনিয়া ঠকচাচা দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিলেন— কি বল্‌ব এ পুলিশ, দুসরা জেগা হলে তোর উপরে লাফিয়ে পড়ে কেমড়ে ধরতুম। এই বলিয়া বাবুরামবাবুর হাত ধরিয়া দাঁড়াইলেন ও সরকারকে পাকতঃ দেখাইলেন যে আমার কত হুরমত—কত ইজ্জত।

ইতিমধ্যে পুলিশের সিঁড়ির নিকট একটা গোল উঠল, একখানা গাড়ী গড় গড় করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল—গাড়ীর দ্বার খুলিবামাত্র একজন জীর্ণশীর্ণ প্রাচীন সাহেব নামিলেন—সারজনেরা অমনি টুপি খুলিয়া কুরনিশ করিতে লাগিল ও সকলেই বলিয়া উঠিল ব্লাকিয়র সাহেব আসছেন। সাহেব বেঞ্চের উপর বসিয়া কয়েকটা মারপিটের মকদ্দমা ফয়সালা করিলেন পরে মতিলালের মকদ্দমা ডাক হইল। একদিকে কালে খাঁ ও ফতে খাঁ ফৈরাদি দাঁড়াইল আর একদিকে বৈদ্যাবাটীর বাবুরামবাবু, বালীর বেণীবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু, বৌবাজারের বেচারাম বাবু, বাহির সিমলার বাঞ্ছারামবাবু ও বৈঠকখানার বটলর সাহেব দাঁড়াইলেন। বাবুরামবাবুর গায়ে জোড়া, মাথায় খিড়কিদার পাগড়ি, নাকে তিলক, তার উপরে হোমের ফোঁটা—দুই হাত জোড়া করিয়া কাঁদো কাঁদো ভাবে সাহেবের প্রতি দেখিতে লাগিলেন—মনে করিতেছেন যে চক্ষের জল দেখিলে অবশ্যই সাহাবের দয়া উদয় হইবে। মতিলাল, হলধর, গদাধর ও অন্যান্য আসামীরা সাহেবের সম্মুখে আনীত হইল। মতিলাল লজ্জায় ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল, তাহার অনাহারে শুষ্ক বদন দেখিয়া বাবুরামবাবুর হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল। ফৈরাদিরা এজেহার করিল যে আসামীরা কুস্থানে যাইয়া জুয়া খেলিত, তাহাদিগকে ধরাতে বড় মারপিট করিয়া ছিনিয়ে পালায়—মারপিটের দাগ গায়ের কাপড় খুলিয়া দেখাইল। বটলর সাহেব ফৈরাদির ও ফৈরাদির সাক্ষীর উপর অনেক জেরা করিয়া মতিলালের সংক্রান্ত এজেহার কতক কাঁচিয়া ফেলিলেন। এমতো কাঁচানো আশ্চার্য নহে কারণ একে উকিলী ফন্দি, তাতে পূর্বে গড়াপেটা হইয়াছিল— টাকাতে কি-না হতে পারে? ‘কড়িতে বুড়ার বিয়ে হয়।’ পরে বটলর সাহেব আপন সাক্ষীসকলকে তুলিলেন। তাহারা বলিল, মারপিটের দিনে মতিলাল বৈদ্যবাটীর বাটিতে ছিল কিন্তু ব্লাকিয়র সাহাবের খুঁচনিতে এক এক বার ঘাবড়িয়া যাইতে লাগিল। ঠকচাচা দেখিলেন গতিক বড় ভাল নয়—পা পিছলে যাইতে পারে—মকদ্দমা করিতে গেলে প্রায় লোকের দিগ্‌বিদগ্ জ্ঞান থাকে না— সত্যের সহিত ফারখতাখতি করিয়া আদালতে ঢুকতে হয়— কি প্রকারে জয়ী হইব তাহাতেই কেবল একিদা থাকে, এই কারণে তিনি সম্মুখে আসিয়া স্বয়ং সাক্ষী দিলেন অমুক দিবস অমুক তারিখে অমুক সময়ে তিনি মতিলালকে বৈদ্যবাটীর বাটীতে ফার্সী পড়াইতেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট অনেক সওয়াল করিলেন কিন্তু ঠকচাচা হেল্‌বার-দোল্‌বার পাত্র নয়—মামলার বড় টঙ্ক, আপনার আসল কথা কোনো রকমেই কমপোক্ত হইল না। অমনি বটলর সাহেব বক্তৃতা করিতে লাগিলেন। পরে ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষণেক কাল ভাবিয়া হুকুম দিলেন মতিলাল খালাস ও অন্যান্য আসামীর এক এক মাস মেয়াদ এবং ত্রিশ ত্রিশ টাকা জরিমানা। হুকুম হইবামাত্র হরিবোলের শব্দ উঠিল ও বাবুরামবাবু চিৎকার করিয়া বলিলেন—ধর্মাবতার! বিচার সুক্ষ্ণ হইল, আপনি শীঘ্র গবর্ণর হউন।

পুলিশের উঠানে সকলে আসিলে হলধর ও গদাধর প্রেমনারায়ণ মজুমদারকে দেখিয়া তাহার খেপানের গান তাহার কানে কানে গাইতে লাগিল— ‘প্রেমনারায়ণ মজুমদার কলা খাও, কর্ম কাজ নাই কিছু বাড়ি চলে যাও। হেন করি অনুমান তুমি হও হনুমান, সমুদ্রের তীরে গিয়া স্বচ্ছন্দে লাফাও।’ প্রেমনারায়ণ বলিল—বটে রে বিটলেরা—বেহায়ার বালাই দূর—তোরা জেলে যাচ্ছিস্ তবুও দুষ্টুমি করিতে ক্ষান্ত নহিস্—এই বলতে বলতে তাহাদিগকে জেলে লইয়া গেল।

বেণীবাবু ধর্মভীতু লোক—ধর্মের পরাজয় অধর্মের জয় দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন— ঠকচাচা দাড়ি নেড়ে হাসিতে হাসিতে দম্ভ করিয়া বলিলেন—কেমন গো এখন কেতাবীবাবু কি বলেন, এনার মসলতে কাম করলে মোদের দফা রফা হইত। বাঞ্ছারাম তেড়ে আসিয়া ডান হাত নেড়ে বলিলেন—একি ছেলের হাতের পিটে? বক্রেশ্বর বলিলেন—সে তো ছেলে নয়, পরেশ পাথর। বেচারাম বাবু বলিলেন—দূঁর দূঁর! এমন অধর্মও করিতে চাই না—মকদ্দমা জিতও চাই না—দূঁর দূঁর! এই বলিয়া বেণীবাবুর হাত ধরিয়া ঠিকুরে বেরিয়ে গেলেন।

বাবুরামবাবু কালীঘাটে পূজা দিয়া নৌকায় উঠিলেন। বাঙালীরা জাতের গুমর সর্বদা করিয়া থাকেন, কিন্তু কর্ম পড়িলে যবনও বাপের ঠাকুর হইয়া উঠে। বাবুরামবাবু ঠকচাচাকে সাক্ষাৎ ভীষ্মদেব বোধ করিলেন ও তাহার গলায় হাত দিয়া মকদ্দমা জিতের কথাবার্তায় মগ্ন হইলেন—কোথায় বা পান পানির আয়েব— কোথায় বা আহ্নিক— কোথায় বা সন্ধ্যা? সবই ঘুরে গেল। এক একবার বলা হচ্ছে, বটলর সাহেব ও বাঞ্ছারামবাবুর তুল্য লোক নাই— এক একবার বলা হচ্ছে, বেচারাম ও বেণীর মতো বোকা আর দেখা যায় না। মতিলাল এদিক ওদিক দেখছে— এক একবার গোলুয়ে দাঁড়াচ্ছে—এক একবার দাঁড় ধরে টানছে—এক একবার ছতরির উপর বসছে— এক একবার হাইল ধরে ঝিঁকে মারছে। বাবুরামবাবু মধ্যে মধ্যে বলতেছেন— মতিলাল বাবা ও কি? স্থির হয়্যে বসো। কাশীজোড়ার শঙ্কুরে মালী তামাক সাজছে— বাবুর আহলাদ দেখে তাহারও মনে স্ফুতি হইয়াছে—জিজ্ঞাসা করছে—বাও মোশাই। এবাড় কি পূজাড় সময় বাকুলে বাওলাচ হবে? এটা কি তুড়ার কড়? সাড়ারা কত কড় করেছে?

প্রায় একভাবে কিছুই যায় না—যেমন মনেতে রাগ চাপা থাকিলে একবার না একবার অবশ্যই প্রকাশ পায় তেমনি বড় গ্রীষ্ম ও বাতাস বন্ধ হইলে প্রায় ঝড় হইয়া থাকে। সূর্য অস্ত যাইতেছে— সন্ধ্যার আগমন— দেখিতে দেখিতে পশ্চিমে একটা কালো মেঘ উঠিল— দুই-এক লহমার মধ্যেই চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া আসিল— হু-হু করিয়া ঝড় বহিতে লাগিল— কোলের মানুষ দেখা যায় না— সামাল সামাল ডাক পড়ে গেল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যু চম্‌কিতে আরম্ভ হইল ও মুহুর্মু হুঃ মুহুর্মুহুঃ বজ্রের ঝঞ্জন কড়মড় হড়মড় শব্দে সকলের ত্রাস হইতে লাগিল— বৃষ্টির ঝরঝর তড়তড়িতে কার সাধ্য বাহিরে দাঁড়ায়। ঢেউগুলা এক একবার বেগে উচ্চ হইয়া উঠে আবার নৌকার উপর ধপাস্ ধপাস্ করিয়া পড়ে। অল্পক্ষণের মধ্যে দুই-তিনখানা নৌকা মারা গেল। ইহা দেখিয়া অন্য নৌকার মাঝিরা কিনারায় ভিড়তে চেষ্টা করিল কিন্তু বাতাসের জোরে অন্য দিগে গিয়া পড়িল। ঠকচাচার বকুনি বন্ধ—দেখিয়া শুনিয়া জ্ঞাশূন্য— তখন এক একবার মালা লইয়া তসবি পড়েন— তখন আপনার মহম্মদ, আলী ও সত্যপীরের নাম লইতে লাগিলেন। বাবুরামবাবু অতিশয় ব্যাকুল হইলেন, দুষ্কর্মের সাজা এইখানেই অরম্ভ হয়! দুষ্কর্ম করিলে কাহার মন সুস্থির থাকে? অন্যের কাছে চাতুরীর দ্বারা দুষ্কর্ম ঢাকা হইতে পারে বটে কিন্তু কোনো কর্মই মনের অগোচর থাকে না। পাপী টের পান যেন তাঁহার মনে কেহ ছুঁচ বিঁধছে— সর্বদাই আতঙ্ক— সর্বদাই ভয়— সর্বদাই অসুখ—মধ্যে মধ্যে যে হাসিটুকু হাসেন সে কেবল দেঁতোর হাসি। বাবুরামবাবু ত্রাসে কাঁদিতে লাগিলেন ও বলিলেন—ঠকচাচা কি হইবে। দেখিতে পাই অপঘাত মৃত্যু হইল— বুঝি আমাদিগের পাপের এই দণ্ড। হায় হায় ছেলেকে খালাস করিয়া আনিলাম, ইহাকে গৃহিণীর নিকট নিয়ে যাইতে পারিলাম না— যদি মরি তো গৃহিণীও শোকে মরিয়া যাইবেন। এখন আমার বেণী ভায়ার কথা স্মরণ হয়— বোধ হয় ধর্মপথে থাকিলে ভাল ছিল। ঠকচাচারও ভয় হইয়াছে কিন্তু তিনি পুরানো পাপী— মুখে বড় দড়— বলিলেন— ডর কেন করো বাবু? লা ডুবি হইলে মুই তোমাকে কাঁধে করে সেঁতরে লি্য়ে যাব— আফদ তো মরদের হয়। ঝড় ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া উঠিল— নৌকা, টলমল করিয়া ডুবুডুবু হইল, সকলেই আঁকু পাঁকু ও ত্রাহি ত্রাহি করিতে লাগিল, ঠকচাচা মনে মনে কহেন “চাচা আপনা বাঁচ”।


আলালের ঘরের দুলাল

৮. উকিল বটলর সাহেবের আপিস—বৈদ্যবাটীর বাটীতে কর্তার জন্য ভাবনা, বাঞ্ছারামবাবুর তথায় গমন ও বিষাদ, বাবুরামবাবুর সংবাদ ও আগমন।

বটলর সাহেব আপিসে আসিয়াছেন। বর্তমান মাসে কত কর্ম হইল উল্টে পাল্টে দেখিতেছেন, নিকটে একটা কুকুর শুয়ে আছে, সাহেব এক একবার শিস্ দিতেছেন—এক একবার নাকে নস্য গুঁজে হাতের আঙুল চট্কাইতেছেন—এক একবার কেতাবের উপর নজর করিতেছেন—এক একবার দুই পা ফাঁক করিয়া দাঁড়াইতেছেন—এক একবার ভাবিতেছেন আদালতের কয়েক আপিসে খরচার দরুন অনেক টাকা দিতে হইবেক—টাকার জোট্পাট্ কিছুই হয় নাই অথচ টারম্ খোলবার আগে টাকা দাখিল না করিলে কর্ম বন্ধ হয়—ইতিমধ্যে হোয়র্ড উকিলের সরকার আসিয়া তাঁহার হাতে দুইখানা কাগজ দিল। কাগজ পাইবামাত্র সাহেবের মুখ আহলাদে চক্চক্ করিতে লাগিল, অমনি বলিতেছেন বেন্‌শারাম। জলদি হিঁয়া আও। বাঞ্ছারামবাবু চৌকির উপর চাদরখানা ফেলিয়া কানে একটা কলম গুঁজিয়া শীঘ্র উপস্থিত হইলেন।

বটলর। বেন্‌শারাম। হাম বড়া খোশ হুয়া। বাবুরামকা উপর দো নালিশ হুয়া—এক ইজেক্টমেন্ট আর এক একুটি, হামকো নটিশ ও সুপিনা হৌয়র্ড সাহেব আবি ভেজ দিয়া।

বাঞ্ছারাম শুনিবামাত্র বগল বাজিয়ে উঠিলেন ও বলিলেন— সাহেব দেখো আমি কেমন মুৎসুদ্দি—বাবুরামকে এখানে আনাতে একা দুদে কত ক্ষীর ছেনা ননী হইবেক। ঐ দু’খানা কাগজ আমাকে শীঘ্র দাও আমি স্বয়ং বৈদ্যবাটীতে যাই—অন্য লোকের কর্ম নয়। এক্ষণে অনেক দমবাজি ও ধড়িবাজির আবশ্যক। একবার গাছের উপর উঠাতে পারলেই টাকার বৃষ্টি করিব, আর এখন আমাদের তপ্ত খোলা—বড় খাঁই—একটা ছোবল মেরে আলাল হিসাবে কিছু আনিতে হইবে।

বৈদ্যবাটীর বাটীতে বোধন বসিয়াছে— নহবত ধাঁধাঁগুড়গুড় ধাঁধাঁগুড় করিয়া বাজিতেছে। মুর্শুদাবাদি রোশনচৌকি পেওঁ পেওঁ করিয়া ভোরের রাগ আলাপ করিতেছে। দালানে মতিলালের জন্য স্বস্ত্যয়ন আরম্ভ হইয়াছে। একদিগে চণ্ডীপাঠ হইতেছে— একদিগে শিবপূজার নিমিত্তে গঙ্গামৃত্তিকা ছানা হইতেছে। মধ্যস্থলে শালগ্রাম শিলা রাখিয়া তুলসী দেওয়া হইতেছে। ব্রাহ্মণেরা মাথায় হাত দিয়া ভাবিতেছে ও পরস্পর বলাবলি করিতেছে আমাদিগের দৈব ব্রাহ্মণ্য তো নগদই প্রকাশ হইল— মতিলালের খালাস হওয়া দূরে থাকুক এক্ষণে কর্তাও তাহার সঙ্গে গেলেন। কল্য যদি নৌকায় উঠিয়া থাকেন, সে নৌকা ঝড়ে অবশ্য মারা পড়িয়াছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই— যা হউক, সংসারটা একেবারে গেল— এখন ছ্যাং চেংড়ার কীর্তন হইবে— ছোটবাবু কি রকম হইয়া উঠেন বলা যায় না— বোধ হয় আমাদের প্রাপ্তির দফা একেবারে উঠে গেল। ঐ ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে একজন আস্তে আস্তে বলতে লাগিলেন— ওহে তোমরা ভাবছো কেন? আমাদের প্রাপ্তি কেহ ছাড়ায় না— আমরা শাঁকের করাত— যেতে কাটি আস্‌তে কাটি— যদি কর্তার পঞ্চত্ব হইয়া থাকে তবে তো একটা জাঁকাল শ্রাদ্ধ হইবে, কর্তার বয়েস হইয়াছে, মাগী টাকা লয়ে আতু-আতু পুতু-পুতু করিলে দশজনে মুখে কালি চুন দিবে। আর একজন বললেন, বসুধারার মতো ফোঁটা ফোঁটা পড়ে নিত্য পাই, নিত্য খাই—এক বর্ষণে কি চিরকালের তৃষ্ণা যাবে?

বাবুরামবাবুর স্ত্রী অতি সাধ্বী। স্বামীর গমনাবধি অন্নজল ত্যাগ করিয়া অস্থির হইয়াছিলেন। বাটীর জানালা থেকে গঙ্গা দর্শন হইত— সারারাত্রি জানালায় বসিয়া আছেন। এক একবার যখন প্রচণ্ড বায়ু বেগে বহে, তিনি অমনি আতঙ্কে শুখাইয়া যান। এক একবার তুফানের উপর দৃষ্টিপাত করেন কিন্তু দেখিবামাত্র হৃকম্পন উপস্থিত হয়। এক একবার বজ্রঘাতের শব্দ শুনেন, তাহাতে অস্থির হইয়া কাতরে পরমেশ্বরকে ডাকেন। এই প্রকারে কিছুকাল গেল, গঙ্গার উপর নৌকার গমনাগমন প্রায় বন্ধ। মধ্যে মধ্যে যখন একেকটা শব্দ শুনেন অমনি উঠিয়া দেখেন। এক একবার দূর হইতে এক একটা মিড়মিড়ে আলো দেখতে পান, তাহাতে বোধ করেন ঐ আলোটা কোনো নৌকার আলো হইবে— কিয়ৎক্ষণ পরেই একখানা নৌকা দৃষ্টিগোচর হয়, তাহাতে মনে করেন এ নৌকা বুঝি ঘাটে আসিয়া লাগিবে— যখন নৌকা ভেড়-ভেড় করিয়া ভেড়ে না— বরাবর চলে যায়, তখন নৈরাশ্যের বেদনা শেলস্বরূপ হইয়া হৃদয়ে লাগে। রাত্রি প্রায় শেষ হইল, ঝড় বৃষ্টি ক্রমে ক্রমে থামিয়া গেল। সৃষ্টির অস্থির অবস্থার পর স্থির অবস্থা অধিক শোভাকর হয়। আকাশে নক্ষত্র প্রকাশ হইল—চন্দ্রের আভা গঙ্গার উপর যেন নৃত্য করিতে লাগিল ও পৃথিবী এমতো নিঃশব্দ হইল যে, গাছের পাতাটি নড়িলেও স্পষ্টরূপ শুনা যায়। এইরূপ দর্শনে অনেকেরই মনে নানাভাবের উদয় হয়। গৃহিণী এক একবার চারিদিকে দেখিতেছেন ও অধৈর্য হইয়া আপনা আপনি বলিতেছেন —জগদীশ্বর! আমি জানত কাহার মন্দ করি নাই— কোনো পাপও করি নাই—এতকালের পর আমাকে কি বৈধব্য-যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে? আমার ধনে কাজ নেই, গহনার কাজ নাই— কাঙালিনী হইয়া থাকি সেও ভাল— সে দুঃখে দুঃখ বোধ হইবে না কিন্তু এই ভিক্ষা দেও যেন পতি-পুত্রের মুখ দেখতে দেখতে মরিতে পারি। এইরূপ ভাবনায় গৃহিণীর মন অতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিল। তিনি বড় বুদ্ধিমতী ও চাপা মেয়ে ছিলেন, আপনি রোদন করিলে পাছে কন্যারা কাতর হয়, এ কারণে ধৈর্য ধরিয়া রহিলেন। শেষ রাত্রে বাটীতে প্রভাতী নহবত বাজিতে লাগিল। ঐ বাদ্যে সাধারণের মন আকৃষ্ট হয় সত্য কিন্তু তাপিত মনে ঐরূপ বাদ্য দুঃখের মোহনা খুঁলিয়া দেয়, এ কারণ বাদ্য শ্রবণে গৃহিণীর মনের তাপ যেন উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। ইতিমধ্যে একজন জেলিয়া বৈদ্যবাটীর বাটিতে মাছ বেচতে আসিল। তাহার নিকট অনুসন্ধান করাতে সে বলিল ঝড়ের সময় বাঁশবেড়ের চড়ার নিকট একখানা নৌকা ডুবুডুবু হইয়াছিল, বোধ হয় সে নৌকাখানা ডুবিয়া গিয়াছে— তাতে একজন মোটা বাবু, একজন মুসলমান, একটি ছেলেবাবু ও আর আর অনেক লোক ছিল। এই সংবাদ একেবারে যেন বজ্রাঘাত তুল্য হইল। বাটীতে বাদ্যোদ্যম বন্ধ হইল ও পরিবারেরা চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

অনন্তর সন্ধ্যা হয় এমন সময় বাঞ্ছারামবাবু তড়বড় করিয়া বৈদ্যবাটীর বাটীর বৈঠকখানায় উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞসা করিলেন— কর্তা কোথায়? চাকরের নিকট সংবাদ প্রাপ্ত হওয়াতে একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন এবং বলিলেন— হায় হায় বড় লোকটাই গেল। অনেকক্ষণ খেদ বিষাদ করিয়া চাকরকে বললেন, এক ছিলিম তামাক আন্ তো। একজন তামাক আনিয়া দিলে খাইতে খাইতে ভাবিতেছেন— বাবুরামবাবু তো গেলেন এক্ষণে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে আমিও যে যাই। বড় আশা করিয়া আসিয়াছিলাম কিন্তু আশা আসা মাত্র হইল। বাটীতে পূজা-প্রতিমা ঠন্‌ঠনাচ্ছে— কোত্থেকে কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। দমসম দিয়া টাকাটা হাত করিতে পারিলে অনেক কর্মে আসিত— কতক সাহেবকে দিতাম— কতক আপনি লইতাম— তারপরে এর মুণ্ডু ওর ঘাড়ে দিয়া হর বর সর করিতাম। কে জানে যে আকাশ ভেঙে একেবারে মাথার উপর পড়বে? বাঞ্ছারামবাবু চাকরদিগকে দেখাইয়া লোক-দেখানো একটু কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন কিন্তু সে কান্না কেবল টাকার দরুন। তাঁহাকে দেখিয়া স্বস্ত্যয়নি ব্রাহ্মণেরা নিকটে আসিয়া বসিলেন। গলায়দড়ে জাত প্রায় বড় ধূর্ত—অন্ত পাওয়া ভার। কেহ কেহ বাবুরামবাবুর গুণ বর্ণন করতে লাগিলেন— কেহ কেহ বলিলেন, আমরা পিতৃহীন হইলাম— কেহ কেহ লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, এখন বিলাপের সময় নয় যাতে তাঁর পরকাল ভাল হয় এমনতো চেষ্টা করা কর্তব্য— তিনি তো কম লোক ছিলেন না? বাঞ্ছারামবাবু তামাক খাচ্ছেন ও হাঁ হাঁ বলছেন— ও কথায় বড় আদর করেন না— তিনি ভাল জানেন বেল পাকলে কাকের কি? আপিনি এমনি বুকভাঙা হইয়া পড়িয়াছেন যে উঠে যেতে পা এগোয় না— যা শুনেন তাতেই সাটে হেঁ হুঁ করেন— আপনি কি করিবেন— কার মাথা খাবেন— কিছুই মতলব বাহির করিতে পারিতেছেন না। এক একবার ভাবতেছেন তদ্বির না করিলে দুই একখানা ভাল বিষয় যাইতে পারে এ কথা পরিবারদিগকে জানালে এখনি টাকা বেরোয়— আবার এক একবার মনে করতেছেন এমতো টাট্কা শোকের সময় বললে কথা ভেসে যাবে। এইরূপ সাত-পাঁচ ভাবছেন, ইতিমধ্যে দরজায় গোল উঠিল— একজন ঠিকা চাকর আসিয়া একখানা চিঠি দিল— শিরোনামা বাবুরামবাবুর হাতের লেখা কিন্তু সে ব্যক্তি সরেওয়ার কিছুই বলিতে পারিল না, বাটীর ভিতরে চিঠি লইয়া যাওয়াতে গৃহিণী আস্তেব্যস্তে খুলিয়া পড়িলেন। সে চিঠি এই “কাল রাত্রে ঘোর বিপদে পড়িয়াছিলাম— নৌকা আঁদিতে এগিয়ে পড়ে, মাঝিরা কিছুই ঠাহর করিতে পারে নাই, এমনি ঝড়ের জোর যে নৌকা একবারে উল্টে যায়। নৌকা ডুবিবার সময় এক একবার বড় ত্রাস হয় ও এক একবার তোমাকে স্মরণ করি— তুমি যেন আমার কাছে দাঁড়াইয়া বলিতেছ— বিপদ কালে ভয় করিও না— কায়মনোচিত্তে পরমেশ্বেরকে ডাকো— তিনি দয়াময়, তোমাকে বিপদ থেকে অবশ্যই উদ্ধার করিবেন। আমিও সেইমতো করিয়াছিলাম। যখন নৌকা থেকে জলে পড়িলাম তখন দেখিলাম একটা চড়ার উপর পড়িয়াছি সেখানে হাঁটু জল। নৌকা তুফানের তোড়ে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। সমস্ত রাত্রি চড়ার উপর থাকিয়া প্রাতঃকালে বাঁশবেড়িয়াতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। মতিলাল অনেকক্ষণ জলে থাকাতে পীড়িত হইয়াছিল। তাকুত করাতে আরম হইয়াছে, বোধ করি রাততক বাঠীতে পৌঁছিব।”

চিঠি পড়িবামাত্র যেন অনলে জল পড়িল—গৃহিণী কিছু কাল ভাবিয়া বলিলেন, এ দুঃখিনীর কি এমন কপাল হবে? এই বলিতে বলিতে বাবুরামবাবু আপন পুত্র ও ঠকচাচা সহিত বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চারিদিকে মহাগোল পড়িয়া গেল। পরিবারের মন সন্তাপের মেঘে আচ্ছন্ন ছিল এক্ষণে আহ্লাদের সূর্য উদয় হইল। গৃহিণী দুই কন্যার হাত ধরিয়া স্বামী ও পুত্রের মুখ দেখিয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন, মনে করিয়াছিলেন মতিলালকে অনুযোগ করিবেন— এক্ষণে সে সব ভুলিয়া গেলেন। দুইটি কন্যা ভ্রাতার হাত ধরিয়া ও পিতার চরণে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। ছোট পুত্রটি পিতাকে দেখিয়া যেন অমূল্য ধন পাইল— অনেকক্ষণ গলা জড়াইয়া থাকিল— কোল থেকে নামিতে চায় না। আন্যান্য স্ত্রীলোকেরা দাঁড়াগোপান দিয়া মঙ্গলাচরণ করিতে লাগিল। বাবুরামবাবু মায়াতে মুগ্ধ হওয়াতে অনেকক্ষণ কথা কহিতে পারিলেন না। মতিলাল মনে মনে কহিতে লাগিল নৌকাডুবি হওয়াতে বাঁচলুম তা না হলে মায়ের কাছে মুখ খেতে খেতে প্রাণ যাইত।

বাহির বাটীতে স্বস্ত্যয়নি ব্রাহ্মণেরা কর্তাকে দেখিয়া আশীর্বাদ করণান্তর বলিলেন, “নচ দৈবাৎ পরং বলং” দৈব বল অপেক্ষা শ্রেষ্ট বল নাই— মহাশয় একে পুণ্যবান তাতে যে দৈব করা গিয়াছে আপনার কি বিপদ হইতে পারে? যদ্যপি তা হইল তবে আমরা অব্রাহ্মণ। এ কথায় ঠকচাচা চিড়চিড়িয়া উঠিয়া বলিলেন— যদি এনাদের কেরদানিতে সব আপদ দফা হল তবে কি মোর মেহনত ফেলতো, মুই তো তসবি পড়েছি? অমনি ব্রাহ্মণেরা নরম হইয়া সামঞ্জস্য করিয়া বলতে লাগিলেন— ওহে যেমন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথি ছিলেন তেমনিতুমি কর্তাবাবুর সারথিই— তোমার বুদ্ধিবলেই তো সব হইয়াছে— তুমি অবতার বিশেষ, যেখানে তুমি আছ— যেখানে আমরা আছি— সেখানে দায়-দফা ছুটে পালায়। বাঞ্ছারামবাবু মণিহারা ফণী হইয়া ছিলেন— বাবুরামকে দেখাইবার জন্য পানসে চক্ষে একটু একটু মায়কান্না কাঁদিতে লাগিলেন। তখন তাঁহার দশ হাত ছাতি হইয়াছে এবং দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে চার ফেললেই, মাছ পড়িবে। তিনি ব্রাহ্মণদিগের কথা শুনিয়া তেড়ে আসিয়া ডান হাত নেড়ে বল্‌তে লাগিলেন— এ কি ছেলের হাতের পিটে? যদি কর্তার আপদ হবে তবে আমি কলিকাতায় কি ঘাস কাটি?


আলালের ঘরের দুলাল

৯. শিশুশিক্ষা ও সুশিক্ষা না হওয়াতে মতিলালের ক্রমে ক্রমে মন্দ হওন ও অনেক সঙ্গী পাইয়া বাবু হইয়া উঠন এবং ভদ্র কন্যার প্রতি অত্যাচার করণ।

ছেলে একবার বিগ্‌ড়ে উঠলে আর সুযুত হওয়া ভার। শিশুকাল অবধি যাহাতে মনে সদ্ভাব জন্মে এমতো উপায় করা কর্তব্য, তাহা হইলে সেই সকল সদ্ভাব ক্রমে ক্রমে পেকে উঠতে পারে তখন কুকর্মে মন না গিয়া সৎকর্মের প্রতি ইচ্ছা প্রবল হয়, কিন্তু বাল্যকালে কুসঙ্গ অথবা অসদুপদেশ পাইলে বয়সের চঞ্চলতা হেতু সকলই উল্টে যাইবার সম্ভাবনা। অতএব যে পর্যন্ত ছেলেবুদ্ধি থাকিবে সে পর্যন্ত নানা প্রকার সৎ অভ্যাস করানো আবশ্যক। বালকদিগের এইরূপ শিক্ষা পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত হইলে তাহাদিগের মন্দ পথে যাইবার সম্ভাবনা থাকে না। তখন তাহাদিগের মন এমতো পবিত্র হয় যে কুকর্মের উল্লেখমাত্রেই রাগ ও ঘৃণা উপস্থিত হয়।

এতদ্দেশীয় শিশুদিগের এরূপ শিক্ষা হওয়া বড় কঠিন, প্রথমতঃ ভাল শিক্ষক নাই—দ্বিতীয়তঃ ভাল বহি নাই—এমতো এমতো বহি চাই যাহা পড়িলে মনে সদ্ভাব ও সুবিবেচনা জন্মিয়া ক্রমে ক্রমে দৃঢ়তর হয়। কিন্তু সাধারণের সংস্কার এই যে কেবল কতকগুলিন শব্দের অর্থ শিক্ষা হইলেই আসল শিক্ষ হইল। তৃতীয়তঃ কি কি উপায় দ্বারা মনের মধ্যে সদ্ভাব জন্মে তাহা অতি অল্প লোকের বোধ আছে। চতুর্থতঃ শিশুদিগের যে প্রকার সহবাস হইয়া থাকে তাহাতে তাহাদিগের সদ্ভাব জন্মানো ভার। হয় তো কাহারো বাপ জুয়াচোর বা মদখোর, নয় তো কাহারো খুড়া বা জেঠা ইন্দ্রিয়দোষে আসক্ত—হয় তো কাহারো মাতা লেখাপড়া কিছুই না জানাতে আপন সন্তানাদির শিক্ষাতে কিছু-মাত্র যত্ন করেন না ও পরিবারের অন্যান্য লোক এবং চাকরদাসীর দ্বারা নানা প্রকার কুশিক্ষা হয়—নয় তো পাড়াতে বা পাঠশালাতে যে সকল বালকের সহিত সহবাস হয়, তাহাদের কুসংসর্গ ও কুকর্ম শিক্ষা হইয়া একেবারে সর্বনাশোৎপত্তি হয়। যে স্থলে উপরোক্ত একটি কারণ থাকে, সে স্থলে শিশুদিগের সদুপদেশের গুরুতর ব্যাঘাত—সকল কারণ একত্র হইলে ভয়ঙ্কর হইয়া উঠে— সে যেমন খড়ে আগুন লাগা— যে দিক জ্বলে উঠে সেই দিকেই যেন কেহ ঘৃত ঢালিয়া দেয় ও অল্প সময়ের মধ্যেই অগ্নি ছড়িয়া পড়িয়া যাহা পায় তাহাই ভস্ম করিয়া ফেলে।

অনেকেরই বোধ হইয়াছিল পুলিশের ব্যাপার নিষ্পন্ন হওয়াতে মতিলাল সুযুত হইয়া আসিবে। কিন্তু যে ছেলের মনে কিছুমাত্র সৎসংস্কার জন্মে নাই ও মান বা অপমানের ভয় নাই তাহার কোন সাজাতেই মনের মধ্যে ঘৃণা হয় না। কুমতি ও সুমতি মন থেকে উৎপন্ন হয় সুতরাং মনের সহিত তাহাদিগের সম্বন্ধ—শারীরিক আঘাত অথবা ক্লেশ হইলেও মনের গতি কিরূপে বদল হইতে পারে? যখন সারজন মতিলালকে রাস্তায় হিঁচুড়িয়া টানিয়া লইয়া গিয়াছিল তখন তাহার একটু ক্লেশ ও অপমান বোধ হইয়াছিল বটে কিন্তু সে ক্ষণিক—বেনিগারদে যাওয়াতে তাহার কিছুমাত্র ভাবনা বা ভয় বা অপমানবোধ হয় নাই। সে সমস্ত রাত্রি ও পরদিবস গান গাইয়া ও শেয়াল-কুকুরের ডাক ডাকিয়া নিকটস্থ লোকদিগকে এমতো জ্বালাতন করিয়াছিল যে, তাহারা কানে হাত দিয়া রাম রাম ডাক ছাড়িয়া বলাবলি করিয়াছিল—কয়েদ হওয়া অপেক্ষা এ ছোঁড়ার কাছে থাকা ঘোর যন্ত্রণা। পরদিবস ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাঁড়াইবার সময় বাপকে দেখাইবার জন্য শিশু পরামানিকের ন্যায় একটুকু অধোবদন হইয়াছিল কিন্তু মনে মনে কিছুতেই দৃকপাত হয় নাই—জেলেই যাউক আর জিঞ্জিরেই যাউক কিছুতেই ভয় নাই।

যে সকল বালকদের ভয় নাই, ডর নাই, লজ্জা নাই কেবল কুকর্মেতেই রত—তাহাদিগের রোগ সামান্য রোগ নহে—সে রোগ মনের রোগ। তাহার উপর প্রকৃত ঔষধ পড়িলেই ক্রমে ক্রমে উপশম হইতে পারে। কিন্তু ঐ বিষয়ে বাবুরামবাবুর কিছুমাত্র বোঁধ-শোধ ছিল না। তঁহার দৃঢ় সংস্কার ছিল মতিলাল বড় ভাল ছেলে, তাহার নিন্দা শুনিলে প্রথম প্রথম রাগ করিয়া উঠিতেন—কিন্তু অন্যান্য লোকে বলিতে ছাড়িত না, তিনিও শুনিয়ে শুনিতেন না। পরে দেখিয়া শুনিয়া তাঁহার মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ সন্দেহ জন্মিল কিন্তু পাছে অন্যের কাছে খাটো হইতে হয় এজন্য মনে মনে গুমরে গুমরে থাকিতেন, কাহারো নিকট কিছুই ব্যক্ত করিতেন না, কেবল বাটীর দরওয়ানকে চুপি চুপি বলিয়া দিলেন মতিলাল যেন দরজার বাহির না হইতে পারে। তখন রোগ প্রবল হইয়াছিল সুতরাং উপযুক্ত ঔষধ হয় নাই, কেবল আটকে রাখতে অথবা নজরবন্দী করায় কি হইতে পারে? মন বিগড়ে গেলে লোহার বাড় দিলেও থামে না বরং তাহাতে ধূর্তমি আরও বেড়ে উঠে।

মতিলাল প্রথম প্রথম প্রাচীর টপকিয়া বাহিরে যাইতে লাগিল। হলধর, গদাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ ও মানগোবিন্দ খালাস হইয়া বৈদ্যবাটীতে আসিয়া আড্ডা গাড়িল ও পাড়ার কেবলরাম, বাঞ্ছারাম, ভজকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ এবং অন্যান্য শ্রীদাম, সুবল ক্রমে ক্রমে জুটে গেল। এই সকল বালকের সহিত সহবাস হওয়াতে মতিলাল একেবারে ভয়ভাঙা হইল— বাপকে পুসিদা করা ক্রমে ক্রমে ঘুচিয়া গেল। যে যে বালক বাল্যাবস্থা অবধি নির্দোষ খেলা অথবা সৎআমোদ করিতে না শিখে তাহারা ইতর আমোদেই রত হয়। ইংরাজদিগের ছেলেরা পিতা-মাতার উপদেশে শরীর ও মনকে ভাল রাখিবার জন্য নানা প্রকার নির্দোষ খেলা শিক্ষা করে, কেহ বা তসবির আঁকে— কাহারো বা ফুলের উপর সক হয়— কেহ বা সংগীত শিখে— কেহ বা শিকার করিতে অথবা মর্দানা কস্ত করিতে রত হয়— যাহার যেমন ইচ্ছা, সে সেই মতো এইরূপ নির্দোষ ক্রীড়া করে। এতদ্দেশীয় বালকেরা যেমন দেখে তেমনি করে— তাহাদিগের সর্বদা এই ইচ্ছা যে জরি-জহরত ও মুক্ত-প্রবাল পরিব—মোহসাহেব ও বেশ্যা লইয়া বাগানে যাইব এবং খুব ধুমধামে বাবুগিরি করিব। জাঁকজমক ও ধুমধামে থাকা যুবকালেরই ধর্ম, কিন্তু তাহাতে পূর্বে সাবধান না হইলে এইরূপ ইচ্ছা ক্রমে বেড়ে উঠে ও নানাপ্রকার দোষ উপস্থিত হয়—সেই সকল দোষে শরীর ও মন অবশেষে একেবারে অধঃপাতে যায়।

মতিলাল ক্রমে ক্রমে মেরোয়া হইয়া উঠিল, এমনি ধূর্ত হইল যে পিতার চক্ষে ধূলা দিয়া নানা অভদ্র ও অসৎকর্ম করিতে লাগিল। সর্বদাই সঙ্গীদিগের সহিত বলাবলি করিত বুড়া বেটা একবার চোখ বুজলেই মনের সাধে বাবুয়ানা করি। মতিলাল বাপ-মার নিকট টাকা চাহিলেই টাকা দিতে হইত— বিলম্ব হইলেই তাহাদিগকে বলে বসিত—আমি গলায় দড়ি দিব অথবা বিষ খাইয়া মরিব। বাপ-মা ভয় পাইয়া মনে করিতেন কপালে যাহা আছে তাই হবে এখন ছেলেটি প্রাণে বাঁচিয়া থাকিলে আমরা বাঁচি ও আমাদিগের শিবরাত্রির সলিতা বেঁচে থাকুক, তবু এক গণ্ডুষ জল পাব। মতিলাল ধুমধামে সর্বদাই ব্যস্ত—বাটীতে তিলার্ধ থাকে না। কখন বনভোজনে মত্ত—কখন যাত্রার দলে আকড়া দিতে আসক্ত—কখন পাঁচালির দল করিতেছে—কখন সকের কবিওয়ালদিগের সঙ্গে দেওরা দেওরা করিয়া চেঁচাইতেছে— কখন বারোয়ারী পূজার জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছে— কখন খেম্‌টার নাচ দেখিতে বসিয়া গিয়াছে— কখন অনর্থক মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামে উন্মত্ত আছে। নিকটে সিদ্ধি, চরস, গাঁজাগুলি, মদ অনবরত চলিতেছে—গুড়ুক্ পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। বাবুরা সকলেই সর্বদা ফিটফাট— মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দাঁতে মিসি, সিপাই পেড়ে ঢাকাই ধুতি পরা বুটোদার এক্‌লাই ও গাজের মেরজাই গায়ে, মাথায় জরির তাজ, হাতে আতরে ভুরভুরে রেশমের হাত রুমাল ও এক এক ছড়ি, পায়ে রূপার বগলসওয়ালা ইংরাজী জুতা। ভাত খাইবার অবকাশ নাই কিন্তু খাস্তার কচুরি, খাসা গোল্লা, বর্‌ফি, নিখুঁতি, মনোহরা ও গোলাবি খিলি সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে।

প্রথম প্রথম কুমতি দমন না হইলে ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠে। পরে একেবারে পশুবৎ হইয়া পড়ে—ভাল-মন্দ কিছুই বোধ থাকে না, আর যেমন আফিম খাইতে আরম্ভ করিলে ক্রমে ক্রমে মাত্রা অবশ্যই অধিক হইয়া উঠে তেমনি কূকর্মে রত হইলে অন্যান্য গুরুতর কূকর্ম করিবার ইচ্ছা আপনা আপনি আসয়া উপস্থিত হয়। মতিলাল ও তাঁহার সঙ্গী বাবুরা যে সকল আমোদে রত হইল ক্রমে তাহা অতি সামান্য আমোদ বোধ হইতে লাগিল— তাহাতে আর বিশেষ সন্তোষ হয় না, অতএব ভারি ভারি আমোদের উপায় দেখিতে লাগিল। সন্ধ্যার পর বাবুরা দঙ্গল বাঁধিয়া বাহির হন—হয় তো কাহারো বাড়িতে পড়িয়া লুটতরাজ করেন নয় তো কাহারো কানাচে আগুন লাগাইয়া দেন— হয় তো কোন বেশ্যার বাটীতে গিয়া শোর সরাবত করিয়া তাহার কেশ ধরিয়া টানেন বা মশারি পোড়ান কিংবা কাপড় ও গহনা চুরি করিয়া আনেন নয় তো কোনো কুলকামিনীর ধর্ম নষ্ট করিতে চেষ্টা পান। গ্রামস্থ সকল লোক অত্যন্ত ব্যস্ত, আঙুল মটকাইয়া সর্বদা বলে— তোরা ত্বরায় নিপাত হ।

এইরূপ কিছুকাল যায়—দুই-চারি দিবস হইল বাবুরামবাবু কোনো কর্মের অনুরোধে কলিকাতায় গিয়াছেন। একদিন সন্ধ্যার সময় বৈদ্যবাটীর নিকট দিয়া একখানা জানানা সোয়ারি যাইতেছিল। নববাবুরা ঐ সোয়ারি দেখিবামাত্র দৌড়ে গিয়ে চারিদিক ঘেরিয়া ফেলিল ও বেহারাদিগের উপর মারপিট আরম্ভ করিল, তাহাতে বেহারারা পাল্কি ফেলিয়া প্রাণভয়ে অন্তরে গেল। বাবুরা পাল্‌কি খুলিয়া দেখিল একটি পরমা সুন্দরী কন্যা তাহার ভেতরে অছেন— মতিলাল তেড়ে গিয়া কন্যার হাত ধরিয়া পাল্‌কি থেকে টানিয়া বাহির করিয়া আনিল। কন্যাটি ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন—চারিদিক শূন্যাকার দেখেন ও রোদন করিতে করিতে মনে মনে পরমেশ্বরকে ডাকেন— প্রভু! এই অবলা অনাথাকে, রক্ষা করো— আমার প্রাণ যায় সেও ভাল যেন ধর্ম নষ্ট না হয়। সকলে টানাটানি করাতে কন্যাটি ভূমিতে পড়িয়া গেলেন তবুও তাহারা হিঁচুড়ে জোরে বাটীর ভিতর লইয়া গেল। কন্যার ক্রন্দন মতিলালের মাতার কর্ণগোচর হওয়াতে তিনি আস্তে-আস্তে বাটীর বাহিরে আসিলেন, অমনি বাবুরা চারিদিকে পলায়ন করিল। গৃহিণীকে দেখিয়া কন্যা তাঁহার পায়ে পড়িয়া কাতরে বলিলেন—মা গো! আমার ধর্ম রক্ষা করো—তুমি বড় সাধ্বী। সাধ্বী স্ত্রী না হইলে সাধ্বী স্ত্রীর বিপদ অন্যে বুঝিতে পারে না। গৃহিণী কন্যাকে উঠাইয়া আপন অঞ্চল দিয়া তাঁহার চক্ষের জল পুঁছিয়া দিতে লাগিলেন ও বলিলেন— মা! কেঁদো না। ভয় নাই। তোমাকে আমি বুকের উপর রাখিব, তুমি আমার পেটের সন্তান— যে স্ত্রী পতিব্রতা তাহার ধর্ম পরমেশ্বর রক্ষা করেন। এই বলিয়া তিনি কন্যাকে অভয় দিয়া সান্তনা করণান্তর আপনি সঙ্গে করিয়া লইয়া তাঁহার পিতৃ আলয়ে রাখিয়া আসিলেন।


আলালের ঘরের দুলাল

১০. বৈদ্যবাটীর বাজার বর্ণন, বেচারাম বাবুর আগমন, বাবুরামবাবুর সভায় মতিলালের বিবাহের ঘোঁট ও বিবাহ করণার্থে মণিরামপুরে যাত্রা এবং তথায় গোলযোগ।

শেওড়াপুলির নিস্তারিণীর আরতি ডেডাং ডেডাং করিয়া হইতেছে। বেচারাম বাবু ঐ দেবীর আলয় দেখিয়া পদব্রজে চলিয়াছেন। রাস্তার দোধারি দোকান —কোনোখানে বন্দীপুর ও গোপাল পুরের আলু স্তূপাকার রহিয়াছে—কোনোখানে মুড়ি-মুড়কি ও চালডাল বিক্রয় হইতেছে —কোনোখানে কলু ভায়া ঘানিগাছের কাছে বসিয়া ভাষা রামায়ণ পড়িতেছেন —গোরু ঘুরিয়া যায় অমনি টিটকারি দেন, আবার আলে ফিরিয়া আইলে চিৎকার করিয়া উঠেন “ও রাম আমরা বানর, রাম আমরা বানর” —কোনোখানে জেলের মেয়ে মাছের ভাগা দিয়া নিকটে প্রদীপ রাখিয়া “মাছ নেবে গো, মাছ নেবে গো” বলিতেছে —কোনোখানে কাপুড়ে মহাজন বিরাট পর্ব লইয়া বেদব্যাসের শ্রাদ্ধ করিতেছে। এই সকল দেখিতে দেখিতে বেচারাম বাবু যাইতেছেন। একাকী বেড়াতে গেলে সর্বদা যে সব কথা তোলাপড়া হয় সেই সকল কথাই মনে উপস্থিত হয়। তৎকালে বেচারাম বাবু সদ্য সংকীর্তন লইয়া আমোদ করিতেন। বসতি ছাড়াইয়া নির্জন স্থান দিয়া যাইতে যাইতে মনোহরসাহী একটা তুক্ক তাঁহার স্মরণ হইল। রাত্রি অন্ধকার —পথে প্রায় লোকজনের গমনাগমন নাইে—কেবল দুই-একখানা গোরুর গাড়ী কেঁকোর কেঁকোর করিয়া ফিরিয়া যাইতেছে ও স্থানে স্থানে এক একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করিতেছে। বেচারাম বাবু তুক্কর সুর দেদার রকমে ভাঁজিতে লাগিলেন —তাঁহার খোনা আওয়াজ আশপাশের দুই-একজন পাড়াগেঁয়ে মেয়েমানুষ শুনিবামাত্রে আঁও মাঁও করিয়া উঠিল —পল্লীগ্রামের স্ত্রীলোকদিগের আজন্মকালাবধি এই সংস্কার আছে যে খোনা কেবল ভূতেতেই করিয়া থাকে। ঐ গোলযোগ শুনিয়া বেচারাম বাবু কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া দ্রুতগতি একেবারে বৈদ্যবাটীর বাটীতে উপস্থিত হইলেন।

বাবুরামবাবু ভারি মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন। বালীর বেণীবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু, বাহির সিমলার বাঞ্ছারামবাবু ও অন্যান্য অনেকে উপস্থিত। গদির নিকট ঠকচাচা একখানা চৌকির উপর বসিয়া আছেন। অনেকগুলি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শাস্ত্রালাপ করিতেছেন। কেহ কেহ ন্যায়শাস্ত্রের ফেঁক্‌ড়ি ধরিয়াছেন —কেহ কেহ তিথিতত্ত্ব, কেহ বা মলমাসতত্ত্বের কথা লইয়া তর্ক করিতে ব্যস্ত আছেন —কেহ কেহ দশম স্কন্ধের শ্লোক ব্যাখ্যা করিতেছেন —কেহ কেহ বহুব্রীহি ও দ্বন্দ্ব লইয়া মহা দ্বন্দ্ব করিতেছেন। কামাখ্যা-নিবাসী একজন ঢেঁকিয়াল ফুক্কন কর্তার নিকট বসিয়া হুকা টানিতে টানিতে বলিতেছেন —আপনি বড় বাগ্যমান পুরুষ —আপনার দুইটি লড়বড়ে ও দুইটি পেঁচা মুড়ি —এ বচ্চর একটু লেড়াং ভেড়াং আছে কিন্তু একটি যাগ করলে সব রাঙা ফুকনের মাচাং যাইতে পারবে ও তাহার বশীবুত অবে —ইতিমধ্যে বেচারাম বাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি আসিবামাত্র সকলেই উঠে দাড়াইয়া “আসতে আজ্ঞা হউক, আসতে আজ্ঞা হউক” বলিতে লাগিল। পুলিশের ব্যাপার অবধি বেচারাম বাবু চটিয়া রহিয়াছিলেন কিন্তু শিষ্টাচারে ও মিষ্টকথায় কে না ভোলে? ঘন ঘন “যে আজ্ঞা মহাশয়ে” তাহার মন একটু নরম হইল এবং তিনি সহাস্য বদনে বেণীবাবুর কাছে ঘেঁষে বসিলেন। বাবুরামবাবু বলিলেন —মহাশয়ের বসাটা ভাল হইল না —গদির উপর আসিয়া বসুন। মিল মাফিক লোক পাইলে মানিকজোড় হয়। বাবুরামবাবু অনেক অনুরোধ করিলেন বটে কিন্তু বেচারাম বাবু বেণীবাবুর কাছছাড়া হইলেন না। কিয়ৎক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর বেচারাম বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন মতিলালের বিবাহের সম্বন্ধ কোথায় হইল?

বাবুরাম। সম্বন্ধ অনেক আসিয়াছিল। গুপ্তিপাড়ার হরিদাসবাবু, নাকাসী পাড়ার শ্যামাচরণবাবু, কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু ও অন্যান্য অনেক স্থানের অনেক ব্যক্তি সম্বন্ধের কথা উপস্থিত করিয়াছিল। সে সব ত্যাগ করিয়া এক্ষণে মণিরামপুরের মাধববাবুর কন্যার সহিত বিবাহ ধার্য করা গিয়াছে। মাধববাবু যোত্রাপন্ন লোক আর আমাদিগের দশ টাকা পাওয়া-থোয়া হইতে পারিবে।

বেচারাম। বেণী ভায়া! এ বিষয়ে তোমার কি মত? কথাগুলো খুলে বলো দেখি।

বেণী। বেচারাম দাদা। খুলে খেলে কথা বলা বড় দায় — বোবার শত্রু নাই আর কর্ম যখন ধার্য হইয়াছে তখন আন্দোলনে কি ফল?

বেচারাম। আরে তোমাকে বলতেই হবে —আমি সব বিষয়ের নিগূড় তত্ত্ব জানিতে চাই।

বেণী। তবে শুনুন— মনিরামপুরের মাধববাবু দাঙ্গাবাজ লোক —ভদ্র চালচুলা নাই, কেবল গোরু কেটে জুতাদানি ধার্মিকতা আছে —বিবাহেতে জিনিসপত্র টাকাকড়ি দিতে পারেন কিন্তু বিবাহ দিতে গেলে কেবল কি টাকাকড়ির উপর দৃষ্টি করা কর্তব্য? অগ্রে ভদ্রঘর খোঁজা উচিত, তারপর ভাল মেয়ে খোঁজা কর্তব্য, তারপর পাওনা-থোওনা হয় বড় ভাল — না হয় —নাই। কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু অতি সুমানুষ —তিনি পরিশ্রম দ্বারা যাহা উপায় করেন তাহাতেই সানন্দচিত্তে কাল যাপন করেন —পরের বিষয়ের উপর কখন চেয়েও দেখেন না —তাঁহার অবস্থা বড় ভাল নয় বটে কিন্তু তিনি আপন সন্তানাদির সদুপদেশে সর্বদা যত্নবান ও পরিবারেরা কি প্রকারে ভাল থাকিবে ও কি প্রকারে তাহাদিগের সুমতি হইবে সর্বদা কেবল এই চিন্তা করিয়া থাকেন। এমন লোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা হইলে তো সর্বাংশে সুখজনক হইত।

বেচারাম। বাবুরামবাবু! তুমি কাহার বুদ্ধিতে এ সম্বন্ধ করিয়াছ? টাকার লোভেই গেলে যে! তোমাকে কি বল্‌ব? এ আমাদিগের জেতের দোষ। বিবাহের কথা উপস্থিত হইলে লোকে অমনি বলে বসে —কেমন গো রূপোর ঘড়া দেবে তো? মুক্তোর মালা দেবে তো? আরে আবাগের বেটা কুটুম্ব ভদ্র কি অভদ্র তা আগে দেখ্‌—মেয়ে ভাল কি মন্দ তার অন্বেষণ কর্‌? সে সব ছোট কথা —কেবল দশ টাকা লাভ হইলেই সব হইল —দূঁর দূঁর!

বাঞ্ছারাম। কুলও চাই —রূপও চাই —ধনও চাই! টাকাটা একেবারে অগ্রাহ্য করলে সংসার কিরূপে চলবে?

বক্রেশ্বর। তা বই কি —ধনের খাতির অবশ্য রাখতে হয়। নির্ধন লোকের সহিত আলাপে ফল কি? সে আলাপে কি পেট ভরে?

ঠকচাচা চৌকির উপর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়িয়া বললেন, মোর উপর এতনা টিটকারি দিয়া বাত হচ্ছে কেন? মুই তো এ শাদি করতে বলি —একটা নামজাদা লোকের বেটি না আন্‌লে আদমির কাছে বহুত শরমের বাত, মুই রাতদিন ঠেওরে ঠেওরে দেখেছি যে, মণিরামপুরের মাধববাবু আচ্ছা আদমি —তেনার নামে বাগে গোরুতে জল খায় —দাঙ্গা-হাঙ্গামের ওক্তে লেঠেল মেংলে লেঠেল মিল্‌বে —আদালতের বেলকুল আদমি তেনার দস্তের বিচ —আপদ পড়লে হাজারো সুরতে মদত্‌ মিলবে। কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু সেকস্ত আদ্‌মি —ঘেসাট-ঘোসাট করে প্যাট-টালে —তেনার সাথে খেসি কামে কি ফায়দা?

বেচারাম। বাবুরাম! ভাল মন্ত্রী পাইয়াছ! এমন মন্ত্রীর কথা শুনিলে তোমাকে সশরীর স্বর্গে যাইতে হইবে —আর কিবা ছে্লেই পেয়েছ! —তাহার আবার বিয়ে? বেণী ভায়া তোমার মত কি?

বেণী। আমার মত এই যে —পিতা প্রথমে ছেলেকে ভাল রূপে শিক্ষা দিবেন ও ছেলে যাহাতে সর্বপ্রকারের সৎ হয় এমতো চেষ্টা সম্যক্‌রূপে পাইবেন —ছেলের যখন বিবাহ করিবার বয়েস হইবে তখন তিনি বিশেষরূপে সাহায্য করিবেন। অসময় বিবাহ দিলে ছেলের নানাপ্রকার হানি করা হয়।

এই সকল কথা শুনিয়া বাবুরামবাবু ধড়মরিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি বাটীর ভিতর গেলেন। গৃহিণী পাড়ার স্ত্রীলোকদিগের সহিত বিবাহ সংক্রান্ত কথাবার্তা কহিতেছিলেন। কর্তা নিকটে গিয়া বাহির বাটীর সকল কথা শুনাইয়া থতমত খাইয়া দাঁড়াইলেন ও বলিলেন —তবে কি মতিলালের বিবাহ কিছু দিন স্থগিত থাকিবে? গৃহিণী উত্তর করিলেন —তুমি কেমন কথা বলো —শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ষেটের কোলে মতিলালের বয়েস ষোল বৎসর হইল —আর কি বিবাহ না দেওয়া ভাল দেখায়? এ কথা লইয়া এখন গোলমাল করিলে লগ্ন বয়ে যাবে, কি করছো—একজন ভাল মানুষের কি জাত যাবে? —বড় লয়ে শীঘ্র যাও। গৃহিণীর উপদেশে কর্তার মনের চাঞ্চল্য দূর হইল —বাটীর বাহিরে আসিয়া রোশনাই জ্বালিতে হুকুম দিলেন; অমনি ঢোল, রোশনচৌকি, ইংরাজী বাজনা বাজিয়া উঠিল ও বরকে তক্তনামার উপর উঠাইয়া বাবুরামবাবু ঠকচাচার হাত ধরিয়া আপন বন্ধু-বান্ধব কুটুম্ব-সজ্জন সঙ্গে লইয়া হেল্‌তে দুল্‌তে চলিলেন। ছাতের উপর থেকে গৃহিণী ছেলের মুখখানি দেখিতে লাগিলেন। অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা বলিয়া উঠিল —ও মতির মা! আহা বাছার কী রূপই বেরিয়েছে। বরের সব ইয়ার-বক্সি চলিয়াছে, পেছনে রংমশাল লইয়া কাহারো গা পোড়াইয়া দিতেছে, কাহারো ঘরের নিকট পটকা ছুঁড়িতেছে, কাহারো কাছে তুবরিতে আগুন দিতেছে। গরীব-দুঃখী লোকসকল দেক্‌সেক হইল কিন্তু কাহারো কিছু বলিতে সাহস হইল না।

কিয়ৎক্ষণ পরে বর মণীরামপুরে গিয়া উত্তীর্ণ হইল —বর দেখতে রাস্তার দোধারি লোক ভেঙে পড়িল —স্ত্রীলোকেরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগিল —ছেলেটির শ্রী আছে বটে কিন্তু নাকটি একটু টেকালো হলে ভাল হইত —কেহ বলতে লাগিল রংটি কিছু ফিকে একটু মাজা হলে আরও খুলতো। বিবাহ ভারি লগ্নে হবে কিন্তু রাত্রি দশটা না বাজতে বাজতে মাধববাবু দরওয়ান ও লন্ঠন সঙ্গে করিয়া বরযাত্রীদিগের আগ্‌বাড়ান লইতে আইলেন —রাস্তায় বৈবাহিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াতে প্রায় অর্ধঘন্টা শিষ্টাচারেতেই গেল —ইনি বলেন মহাশয় আগে চলুন, উনি বলেন মহাশয় আগে চলুন। বালীর বেণীবাবু এগিয়ে আসিয়া বলিলেন —আপনারা দু’জনের মধ্যে যিনি হউন একজন এগিয়ে পড়ুন আর রাস্তায় দাঁড়াইয়া হিম খাইতে পারি না। এইরূপ মীমাংসা হওয়াতে সকলে কন্যাকর্তার বাটীর নিকট আসিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে লাগিলেন ও বর যাইয়া মজলিসে বসিল। ভাট, রেও ও বারওয়ারীওয়ালা চারিদিকে ঘেরিয়া দাঁড়াইল —গ্রামভাটি ও নানা প্রকার ভাবের কথা উপস্থিত হইতে লাগিল —ঠকচাচা দাঁড়াইয়া রফা করিতেছেন —অনেক দম-সম দেন কিন্তু ফলের দফায় নামমাত্র —রেওদিগের মধ্যে একটা ষণ্ডা তেড়ে এসে বলিল, এ নেড়ে বেটা কেরে? বেরো বেটা এখান থেকে —হিন্দুর কর্মে মুসলমান কেন? ঠকচাচা অমনি রাগ উপস্থিত হইল। তিনি দাড়ি নেড়ে চোখ রাঙাইয়া গালি দিতে লাগিলেন। হলধর, গদাধর ও অন্যান্য নব বাবুরা একে চায় আরে পায়। তাহারা দেখিল যে প্রকার মেঘ করিয়া আসিতেছে —ঝড় হইতে পারে —অতএব ফরাস ছেড়ে, কেহ সেজ নেবায় —কেহ ঝাড়ে ঝাড়ে টক্কর লাগাইয়া দেয় —কেহ এর ওর মাথার উপর ফেলিয়া দেয়, কন্যাকর্তার তরফের দুইজন লোক এই সকল গোলযোগ দেখিয়া দুই-একটি শক্ত কথা বলাতে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল —মতিলাল বিবাদ দেখিয়া মনে মনে ভাবে, বুঝি আমার কপালে বিয়ে নাই —হয় তো সুতা হাতে সার হইয়া বাটী ফিরিয়া যাইতে হবে।