[ খ ]

তু তো বরাবরই জানতিস দিদি, আমাদের পাঁচুর বাপ ছিল বরাবরকার সিদেসাদা মানুষ, সে হের-ফের বা কথার প্যাঁচ বুঝত না। নাকটা সোজাসুজি না দেখিয়ে হাতটা পিঠের দিক দিয়ে বাঁকিয়ে এনে দেখানোটা তার মগজে আদৌ ঢুকত না। কত আঁটকুড়ো নদী-ভরাই যে ওকে দিয়ে বিনি পয়সার বেগার খাটিয়ে নেত, হাত হতে পয়সা ভুলিয়ে নেত, তার আর সংখ্যা নাই! ঐ নিয়ে বেচারাকে আমি কতদিন গালমন্দ দিয়েছি, কত বুদ্ধি দিতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই। কথায় বলে, ‘স্বভাব যায় না মলে’—ওর আর একটা বদ-অভ্যেস ছিল, ও বড্ড মদ খেত। কতদিন বলেছি, ‘তুমি মদ খাও ক্ষতি নাই, দেখো তোমায় মদে যেন না খায়!’ কিন্তু সে তা শুনত না; একটু ফাঁক পেলেই যা রোজগার করত তা সব শুঁড়ির পায়ে ঢেলে আসত। যাক, ওরকম দু-চারটে বদ অভ্যাস পুরুষ মানুষের থাকেই থাকে—ওতে তেমন আসত যেত না, কিন্তু অমন শিবের মতো সোয়ামি আমার শেষে এমন কাজ করে ফেললে, যা বুন তুই কেন—আমারও এখন বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মতো অমন সোজা লোক পেয়ে কে কী খাইয়ে দিয়ে তাকে যে অমন করে দিয়েছিল, তা আমি নিজেই বুঝতে পারি নাই।

জানিস ওপাড়ার রঘো বাগদীর দু-তিনটে ‘স্যাঙ্গা-করা’ কড়ুই রাঁড়ি’ মেয়েটা কিরকম পাড়া মাথায় করে তুলেছিল। ছুঁড়ি কখনও সোয়ামির ঘর তো করেই নাই, মাঝ থেকে পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের কাঁচা বুকে ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছিল। আর তার বাপ মাকেই বা কী বলব,—ছি, আমারই মনে হত যে, বিষ খেয়ে মরি! মাগো মা, বাগদী জাতটার উপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে!—

‘তু তো জানিস মাখন-দি, ঝুটমুট আমদের গাঁয়ের লোকের আর আমাদের বাগদীগুলোর বিশ্বাস ছিল যে, আমাদের হাতে অনেক টাকা আছে। আবার সে কত পুতখাগীর বেটিরা লোকের ঘরে ঘরে রটিয়ে এসেছিল, আমরা নাকি যক্ষির টাকা পেয়েছি। বল তো বুন এতে হাসি পায় না?

‘হেঁ,—আমাদের ঐ টাকার লোভেই ঐ ‘রাঁড় হয়ে ষাঁড় হওয়া’ ছুড়িটা ঐ শিবের মতোন সোজা ভোলানাথ সোয়ামিকে আমার পেয়ে বসল। আর সত্যি বলতে কি মিনসের চেহারাও তো আর নেহাত মন্দ ছিল না! ধুতি-চাদর পরিয়ে দিলে মনে হত একটি খাসা ‘ভদ্দরনুক’।

‘ওরে যেদিন আমি পেত্থম এই কথাটি শুনলুম, তখন আমার মনটা যে কেমন হয়ে গেল, তা বুন তোকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। মাথায় বাজ পড়লেও বোধ হয় লোকে এত বেথা পায় না। আমি সেদিন তাকে রাতে খুব ঝাঁটাপেটা করলুম! অ বুন!—যে অমন মাটির মানুষ, সাত চড়ে যার রা বেরোত না, সেও কিনা সেদিন আমার এই ঝুঁটি ধরে একটা চেলাকাঠে করে উঃ সে কী মার মারলে! কাঠটার চেয়েও বেশি ফেটে ফেটে আমার পিঠ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তখনকার এত যে বাইরের বেথা, তাতো আমি বুঝতে পারছিলুম না, কেননা আমার বুকটা তখন আরও বেশি ফেটে গিয়েছিল! আমি যে সেদিন স্পষ্ট বুঝলুম, আমার নিজের সোয়ামি আজ পর হল! আমি দেখতে পেলুম, আমার কপাল পুড়েছে। তখন ঠিক যেন কেউ তপ্ত লোহা দিয়ে আমার বুকের ভিতরটায় ছ্যাঁকা দিচ্ছিল—আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলুম!

সেই সঙ্গে আমার যত রাগ হল সেই হারামজাদি বেটির উপর। মনে হতে লাগল, এখন যদি তাকে পাই, তো নখে করে ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু কোনোদিনও তার নাগাল পাই নাই। সে আমাকে দেখলেই সরে পড়ত।