[ গ ]

ক্রমেই আমার সোয়ামি বাড়াবাড়ি আরম্ভ করলে। সে আর প্রায়ই ঘরে আসত না! মুনিব-ঘরে খাটত, খেত, আর ওদের ঘরটাতেই গিয়ে শুয়ে থাকত! আমি, আমার ছেলে, পাড়ার সব ভাল লোক মিলে কত বুঝালুম তাকে। কিন্তু হায়, তাকে আর ফিরাতে পারলুম না, ছুঁড়ি যে ওকে যাদু করেছিল! একেবারে ভেড়া বানিয়ে দিয়েছিল! তখন বুঝলুম এতদিনে মিনসের ভীমরতি ধরেছে; ওকে ‘ঊনপঞ্চাশে’ পেয়েছে; তা নইলে কি এমন চোখের মাথা খেয়ে বসে লোকে! একদিন পায়ে ধরে জানালুম, সে কত বড়ো ভুল করতে যাচ্ছে। সে আমার মুখে লাথি মেরে চলে গেল। আমার সারা দেহ দিয়ে আগুনের মতো গরম কী একটা ঠিকরে বেরুতে লাগল। বুঝলুম সে এত বেশি এগিয়ে গিয়েছে নরকের দিকে যে, তাকে ফেরানো যায় না।

তার উপর রাস্তায়-ঘাটে ঐ বিশ্রী কথাটা নিয়ে আমায় গঞ্জনা—খোঁচা। আমি খেপার মতো হয়ে পেতিজ্ঞা করলুম, শোধ নেব, শোধ নেব। তবে আমার নাম বিন্দি!

আর একদিন মাঠ হতে এসে শুনলুম মিনসে নাকি আমার বাক্‌স ভেঙে জোর করে যা দু-চার পয়সা জমিয়েছিলুম সব ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, একটা কানাকড়িও থুয়ে যায় নাই। আরও শুনলুম, তার দু-দিন পরেই নাকি ঐ ছুঁড়ির সঙ্গে তার ‘স্যাঙ্গা’ হবে। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। সে নাকি ঐ সমস্ত নগদ টাকা নিয়ে গিয়ে তার হবু-শ্বশুরের ‘শীপাদপদ্দে’ ঢেলেছে।—হায়রে আমার রক্তের চেয়েও পিয়ারা টাকা! তার এই দশা হল শেষে? মানুষ এত নিচু দিকে যেতে পারে? তখন ভাববার ফুরসত ছিল না; ঐ দু-দিনের মধ্যেই যা করবার একটা করে নিতে হবে, তার পর আর সময় পাওয়া যাবে না। ভাবতে লাগলুম, কী করা যায়? একটা দেবতার মতো লোক সিধা নরকে নেমে যাচ্ছে এক-এক পা করে, আর বেশি দূর নাই, অথচ ফিরাবার কোনো উপায় নাই। তখন তাকে হত্যা করলে কি পাপ হয়? তা ছাড়া আমি তার ‘ইস্ত্রি’, আমারও তো একট কর্তব্য আছে, আমার সোয়ামি যদি বেপথে যায়, তো আমি না ফিরালে অন্য কে এসে ফিরাবে? আর সে এই রকম বেপথে গেলে ভগবানের কাছে ধর্মত আমিই তো দায়ী। ধর, আমি যদি তাকে এই সময়ে একেবারে শেষ করে ফেলি তাহলে তার তো আর কোনো পাপ থাকবে না। যত পাপ হবে আমার। তা হোক, সোয়ামির পাপ তার ‘ইস্ত্রি’ নেবে না তো কি নেবে এসে শেওড়াগাছের ভূত?

আমি মনকে শক্ত করে ফেললুম! হাঁ, হত্যেই করব যা থাকে কপালে!—ভগবান, তুমি সাক্ষী রইলে, আমি আমার দেবতাকে নরকে যাবার আগে তাঁর জানটা তোমার পায়ে জবা ফুলের মতো ‘উচ্ছুগু’ করব, তুমি তাঁর সব পাপ খণ্ডন করে আমাকে শুধু ‘দুখ্‌কু আর কষ্ট দাও! আমার তাই আনন্দ!

সেদিন সাঁঝে একটু ঝিমঝিম বিষ্টির পর মেঘটা বেশ পরিস্কার হয়ে এসেছে! এমন সময় দেখতে পেলুম, আমার সোয়ামি একা ঐ আবাগিদের বাড়ির পেছনের তেঁতুলগাছটার তলায় বসে খুব মন দিয়ে একটা খাটের খুরোয় র‍্যাদা বুলোচ্ছে!—কি করতে হবে ঝাঁ করে ভেবে নিলুম! চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম কেউ কোথাও নাই। আমি পাগলির মতো ছুটে এসে দা-টা বের করে নিলুম, সাঁঝের সূর্যটার লাল আলো দা-টার উপর পড়ে চকমক করে উঠল! ঐ ঝাপসা রোদে আবার বিষ্টি নেমে এল—ঝিম ঝিম ঝিম! বাড়ির পাশে তখন একপাল ন্যাংটা ছেলে জলে ভিজতে ভিজতে গাইছিল।

রোদে রোদে বিষ্টি হয়,

খ্যাঁকশিয়ালির বিয়ে হয়।

আমি আঁচলে দা-টা লুকিয়ে দৌড়ে বাঘিনীর মতো গিয়ে, ওঃ সে কী জোরে তার বুকে চেপে বসলুম! সে হাজার জোর করেও আমায় উলটিয়ে ফেলতে পারলে না! তার ঘাড়ে মস্ত একটা কোপ বসিয়ে দিতেই আমার হাতটা অবশ হয়ে এল। তখন সে দৌড়ে পাশের পাট খেতটায় গিয়ে চিৎকার করে পড়ল। আমি তখন রক্তমুখো হয়ে উঠেছি। আমি আবার গিয়ে দুটো কোপ বসাতেই তার ঘাড়ে হতেই মাথাটা আলাদা হয়ে গেল! তারপর খালি লাল আর লাল! আমার চারিদিকে শুধু রক্ত নেচে বেড়াতে লাগল! তারপর কী হয়েছিল আমার আর মনে নেই।

যেদিন আমার বেশ জ্ঞান হল সেদিন দেখলুম আমি একটা নতুন জায়গায় রয়েছি, আর তখন চারিদিকে সে কতই রংবেরং-এর লোক! আর সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছিলুম এই দেখে যে, আমিও তাদের মাঝে খুব জোরে জাঁতা পিষছি! এতদিনের পর সূর্যের আলো—ওঃ সে কত সুন্দর সাদা হয়ে দেখাল! এর আগে চোখের পাতায় শুধু একটা লাল রং ধুধু করত। জিজ্ঞাসা করে জানলুম, ওটা শিউড়ির জেলখানা। আমার সাত বছরের জেল হয়েছ! এই-মাত্তর তিনমাস গিয়েছে। আমি নাকি মাজিস্টর সাহেবের কাছে সব কথা নিজ মুখে স্বীকার করেছিলুম। তবে আমার শাস্তি অত হত না—দারোগাবাবু গাঁয়ে গিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করায় আমি নাকি তাকে খ্যাংরাপেটা করে বলেছিলুম, সে যেন জোরজুলুম না করে গাঁয়ে, সে-ই নাকি সাহেবকে বলে এত শাস্তি দিইয়ে দিয়েছে।

মাগো মা! সে কী খাটুনি জেলে। তবু দিদি, যতদিন মনে ছিল না, কিছু, ততদিন যে বেশ ভাল ছিলুম। জ্ঞান হয়ে সে কী জ্বালা! তখন কাজের অকাজের মাঝে চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই ফিং-দিয়ে-ওঠা-হলকা রক্ত! ওঃ কত সে রক্তের তেজ! বাপরে বাপ! সে মনে পড়লে আমি এখনও বেহুঁশ হয়ে পড়ি! মাথাটা যখন কাটা গেল, তখন ঐ আলাদা ধড়টা, কাতলা মাছকে ডেঙায় তুললে যেমন করে, ঠিক তেমনি করে কাতরে কাতরে উঠছিল! এত রক্তও থাকে গো একটা এতটুকু মানুষের দেহে! আমি একটুকুও আঁধারে থাকতে পারতুম না ভয়ে! কেননা তখন স্পষ্ট এসে দেখা দিত সেই মাথাছাড়া দেহটা আর দেহছাড়া মাথাটা!—ওঃ—

তারপর দিদি, কোন্ জজ নাকি সাত-সমুদ্দর তেরো নদী পার হয়ে এসে দিল্লির বাদশাহি তকতে বসলেন, আর সব কয়েদিরা খালাস পেলে! আমিও তাদের সাথে ছাড়া পেলুম।

দেখলি দিদি, ভগবান আছেন! তিনি তো জানেন, আমি ন্যায় ছাড়া অন্যায় কিছু করি নাই। নিজের সোয়ামি-দেবতাকে নরকে যাবার আগেই ও-পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছি। পুরুষেরা ওতে যাই বলুক, আমি আর ভগবান এই দুই জনাতেই জানতুম, এ একটা মস্ত সোজাসুজি সত্যিকার বিচার! আর পুরুষেরা ওরকম চেঁচাবেই,—কারণ তারা দেখে আসছে যে, সেই মান্ধাতার আমল থেকে শুধু মেয়েরাই কাটা পড়েছে তাদের দোষের জন্যে। মেয়েরা পেথম পেথম এই পুরুষদের মতোই চেঁচিয়ে উঠেছিল কী না এই অবিচারে, তা আমি জানি না। তবে ক্রমে তাদের ধাতে যে এ খুবই সয়ে গিয়েছে এ নিশ্চয়। আমি যদি ঐরকম একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসতুম আর যদি আমার সোয়ামি ঐ জন্যে আমাকে কেটে ফেলত, তাহলে পুরুষেরা একটি কথাও বলত না। তাদের সঙ্গে মেয়েরাও বলত, ‘হাঁ, ওরকম খারাপ মেয়েমানুষের ঐ রকমেই মরা উচিত। কারণ তারাও বরাবর দেখে আসছে, পুরুষদের সাত খুন মাফ।

তা ছাড়া, আমি মানুষের দেওয়ার চেয়ে অনেক বড়ো শাস্তি পেয়েছিলুম নিজের মনের মাঝে। আমার জ্বালাটা যে সদা-সর্বদা কী রকম মোচড়ে মোচড়ে উঠত, তা কে বুঝত বল দেখি, বুন? নিজের হাতে কাটলেও সে তো ছিল আমার নিজেরই সোয়ামি। কোন্ জজ নাকি তার নিজের ছেলের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন, তাহলেও—অত শক্ত হলেও—তাঁর বুকে কি একটুকুও লাগে নাই ঐ হুকুমটা দিবার সময়?—আহা, যখন তার বুকে বসে একটা পেরকাণ্ড রাক্ষুসীর মতোই তার গলায় দাটা চেপে ধরলুম, তখন আঃ, কি মিনতি-ভরা গোঙানিই তার গলা থেকে বেরোচ্ছিল। চোখে কী সে একটা ভীত চাউনি আমার ক্ষমা চাইছিল।—আঃ! আঃ!

জেলে রাত্তিরদিন কাজের মধ্যে ব্যস্ত থেকে কোনো কিছু ভাববার সময় পেতুম না। মনটাকে ভাববারই সময় দিতুম না। কাজের উপর কাজ চাপিয়ে তাকে এত বেশি জড়িয়ে রাখতুম যে, শেষে যে ঘুম এসে আমাকে অবশ করে দিয়ে যেত, তা বুঝতেই পারতুম না। এখন, যেদিন ছাড়া পেলুম, সেদিন আমার সমস্ত বুকটা কীসের কান্নায় হা হা করে চেঁচিয়ে উঠল। এতদিন যে বেশ ছিলুম এই জেলের মাঝে! এতদিন আমার মনটা যে খুব শান্ত ছিল। এখন এই ছাড়া পেয়ে আমি যাই কোথা? ওঃ ছাড়া পাওয়ার সে কী বিষের মতোন জ্বালা!

ঘরেই এলুম!—দেখলুম আমার ছেলে বে করেছে। বেশ টুকটুকে বেণিপরা বউটি। আমি ফিরে এসেছি শুনে গাঁয়ের লোকে ‘হাঁ হাঁ’ করে ছুটে এল; বললে ‘গাঁয়ে এবার মড়কচণ্ডি হবে। বাপরে, সাক্ষাৎ তাড়কা রাক্ষসী এবার গাঁয়ে ফিরে এসেছে, এবার আর রক্ষা নাই—নিঘঘাত যমালয়!—পেথম পেথম আমি তাদের কথায় কান দিতুম না। মনে করলুম ‘কান করেছি ঢোল, কত বলবি বল।’ শেষে কিন্তু আর কান না দিয়েও যে আর পারলুম না। তাদের বলার মাঝে যে একটুও থামা ছিল না! যেন কিছুই হয় নাই এই ভেবে আমি আমার বউ-বেটা নিয়ে ঘর-সংসার নতুন করে পাতলুম, লোকে তা লন্ডভন্ড করে দিলে। মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলুম, কেউ বিয়ে করলে না, বললে, ‘রাক্ষসীর মেয়ে রাক্ষসী হবে’ এ ডাহা সত্যি কথা! এতদিন যে বেথাটা আমি দুহাত দিয়ে চাপা দিতে চাইছিলুম, সেইটাই দেশের লোক উসকে উসকে বের করে চোখের সামনে ধরতে লাগল! সোনার চাঁদ ছেলে আমার একটি কথাও শুনলে না—আমার যে কেমন করে কী হল তা ভুলেও কোনো কথার মাঝে জিজ্ঞেস করলে না, খুশি হয়েই আমাকে সংসারের সব ভার ছেড়ে দিলে; কেননা সে বুঝেছিল যা গিয়েছে তার খেসারতের জন্যে আর একজনকে হারাব কেন! আর এই কড়ুইরাঁড়ি আঁটকুড়িরা যারা আমার সাত পুরুষের গিয়াতকুটুম নয়, তারা কিনা রাত্তিরদিন খেয়ে না খেয়ে লেগে গেল আমার পেছনে। দেবতাদের শাপের মতো এসে আমাদের সব সুখশান্তি নষ্ট করে দিলে!—আমার ছেলেকে তার একঘরে পতিত করলে, তাতেও সাধ মিটল না। নানান পেকারে—নানান ছুতায় এই দুটো বছর ধরে কী না কষ্টই দিয়েছে এই গাঁয়ের লোকে! দিদি, পথের কুকুরকেও এত ঘেন্না হেনস্থা করে না! এতে যে ভাল মানুষেরই মাথা বিগড়ে যায়, আমার মতো শতেক-খুয়ারি ডাইনি রাক্ষুসীর তো কথাই নাই। তাও দিদি খুবই সয়ে থাকি, নিতান্ত বিরক্ত না করে তুললে ওদের গালমন্দ দিই না। বত্রিশ নাড়ি পাক দিলে তবে কখনও লোকের মুখ দিয়ে ‘শাপমন্যি’ বেরোয়!

এখন তো তুই সব শুনলি দিদি, এখন বল, দোষ কার? আর তুই ঐ হাতের মালসাটা আমার মাথায় ভেঙে আমার মাথাটা চৌচির করে দে—সব পাপের শাস্তি হোক!—ওঃ ভগবান!।