স্বর্ণমৃগ
আট
খান মোহাম্মদ জানের ওখান থেকে কয়েক জায়গায় ফোন করল মাসুদ রানা। এক বিশেষ মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল একদল লোক এদিক ওদিক।
না খাইয়ে ছাড়ল না জিনাত। খাওয়ার টেবিলেই পরিচয় হলো একজন সুদর্শন যুবকের সঙ্গে। সাঈদ খান। মোহাম্মদ জানের ভাতিজা। রানার চেয়ে কিছু ছোট হবে বয়সে। মোহাম্মদ জানের পরে সে-ই হবে, এই প্রতাপশালী ট্রাইবের চিফ। সত্যি, সর্দারের মতই চেহারা। চমৎকার স্বাস্থ্য। লম্বা একহারা পেটা শরীর। রানা নিজে মিশুক প্রকৃতির মানুষ না হলেও প্রথম দর্শনেই পছন্দ করল ছেলেটিকে। গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নির্ভর করা যায় এ লোকের ওপর। কিন্তু রানা এটাও বুঝল যে প্রথম দর্শনেই তাকে অপছন্দ করেছে সাঈদ। কারণ কিছুটা আঁচ করল ও জিনাতের দিকে ওর চোরা চাহনি দেখে। বুঝল, মস্ত ক্ষত চেপে রেখেছে পরাজিত সাঈদ। ভেতর ভেতর গুমরে মরছে সে কতদিন ধরে কে জানে। বোধ হয় কাউকে, এমনকী জিনাতকেও, মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে কিছু। চেষ্টা করেও ওর সঙ্গে আলাপ জমাতে পারল না রানা। শেষে হাল ছেড়ে দিল মৃদু হেসে।
ট্রাক-হামলার সমস্ত ঘটনা আগাগোড়া মন দিয়ে শুনল মোহাম্মদ জান। কুঞ্চিত হয়ে উঠল ওর কপাল। বলল, বুঝতে পারছি, মস্ত শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে লেগেছ তুমি, রানা। এটা আমার মালাকান্দ নয়, হলে পিষে ফেলতে পারতাম যে-কোনও শত্রুকে। তুমি বরং এখানেই থেকে যাও রাত দশটা পর্যন্ত। এখান থেকেই বেরোনো যাবে তোমার স্বর্ণমৃগের সন্ধানে।’
‘তা হয় না। আমার কিছু কাজ আছে হোটেলে। আপনি বরং ওখানেই আসুন।’
‘বেশ। সাঈদ, তুমি মেজর রানার সঙ্গে গিয়ে চিনে আসো হোটেলটা।’
বেরোবার আগে রানাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল জিনাত। রানা কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে খাওয়া দাওয়ার শেষে পানি খাওয়ার আগে সোহেলের দেয়া যষ্টিমধু চুবিয়ে নিল জিনাত গ্লাসের মধ্যে। অত্যন্ত সিরিয়াস সে এ-সব ব্যাপারে।
‘আমার জন্যেই তোমার আজ এই বিপদ, রানা।’
‘তোমার জন্যে মানে?’
‘আমার জন্যেই তো। সাধুবাবা তোমাকে জুয়াড়ির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বলেছিল আমাকে। পোড়া মন! ভুলে গেলাম কী করে? আজ রাতে আমার ঘুম হবে না, রানা।’
‘ছিঃ। এসব চিন্তা করে মাথা গরম কোরো না, জিনাত। কাল না তোমার জন্মদিন? বাড়িতে বন্ধু-বান্ধব আসবে। খামোকা রাত জাগলে কাল দুপুর হলেই দাঁত কেলিয়ে পড়ে থাকবে—কেক কাটারও শক্তি থাকবে না আর বিকেল বেলা!
হাসল জিনাত। রানার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কাল আসছ তো?’
‘আসছ তো মানে? আজ রাতের কাজটা ভালোয় ভালোয় চুকে গেলে কাল তো আমাকে এখান থেকে নড়াতেই পারবে না।’
‘কী উপহার দেবে, বলো না?’ আব্দার ধরে জিনাত।
‘যখন দেব, তখন দেখো! অবাক করে দেব একেবারে।’
মিনিট দুয়েক আর একটি কথাও হলো না দুজনে—তারপর লিপস্টিক মাখা ঠোঁট নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল মাসুদ রানা।
সাঈদ জিজ্ঞেস করল, ‘ওয়ালী আহমেদের সাথে লাগতে গেলেন কেন? শত্রুতা হলো কিসে?’
রানা ওর জোচ্চুরির কথা সাঈদকে খুলে বলল। কিভাবে শায়েস্তা করেছে আজ বিকেলে, বলল। ওয়ালী আহমেদের আসল মতলব শুনে কঠিন হয়ে গেল সাঈদের মুখ।
‘তা হলে জিনাতকে নিয়েই লেগেছে আপনাদের মধ্যে?’
‘অনেকটা তাই বলতে পারেন।’
‘যদি তাই হয়, অর্থাৎ যদি সে জিনাতকে কামনা করে থাকে, তা হলে জিনাতের কপালটা নেহায়েতই খারাপ বলতে হবে। ওয়ালী আহমেদ যা চায় তা সে করে ছাড়ে। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি চিনি ওকে। আজ পর্যন্ত কেউ ঠেকাতে পারেনি ওকে—আপনিও পারবেন না, আমিও না, চাচাজিও না। করাচি শহরে ওর ক্ষমতার কাছে আমরা কিছু না।’
‘ওকে আপনি চিনলেন কিভাবে?’
‘আমাদের একটা গোপন ব্যবসায়ে দুই দুইবার মার খেয়েছি আমরা ওর হাতে। তাও আবার মালাকালে বসে। চাচাজী জানে না। আমার ওপর ছিল ওই ব্যবসার ভার। অদ্ভুত ওর ক্ষমতা! আর করাচিতে তো দিন দুপুরে যদি সে খোলা রাস্তার ওপর আপনাকে গুলি করে মারে, কিচ্ছু হবে না ওর। কেউ কিছু করতে পারবে না। পাত্তাই পাবে না।’
‘আপনি দেখছি ভয় ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন আমার মনে।’
‘আমি আপনাকে সত্য উপলব্ধি করাবার চেষ্টা করছি মাত্র।’
‘আমার মনে হয় না সাধারণ একজন লোককে এত ভয় পাওয়ার কিছু আছে।’ আলোচনাটা ভাল লাগছে না রানার। গলার স্বরে সেটা টের পেল সাঈদ।
‘সাধারণ লোক!’ একটু হাসল সাঈদ। তারপর চুপ হয়ে গেল।
ছোট্ট লনটা পার হয়ে লাউঞ্জে উঠবার কয়েক ধাপ সিঁড়ি। হোটেলের বাইরে গাড়ি রেখে এগিয়ে আসছে সাঈদ আর রানা পাশাপাশি। রানার আপত্তি সত্ত্বেও ঘর-পর্যন্ত পৌঁছে দেবে বলে, সাথে আসছে সাঈদ। হঠাৎ রানার প্রবল এক ধাক্কায় ছিটকে রাস্তা থেকে লনের ঘাসে চলে গেল সাঈদ। টাল সামলাতে না পেরে গোটা কয়েক ডালিয়া ফুলের গাছসহ ভূমিসাৎ হলো সে। রানাও লাফিয়ে সরে গেছে পথ ছেড়ে অপর পাশের ঘাসে। এমনি সময়ে দড়াম করে পড়ল পাথরটা রাস্তার ওপর। প্রায় তিন মণ ওজনের প্রকাণ্ড একখানা পাথর পিচের রাস্তাটা আধহাত ডাবিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে লাগল লোহার গেটে। দুমড়ে বেঁকে গেল গেট। কয়েকটা শিক খুলে বেরিয়ে গেল নীচের খোপ থেকে। সাততলার ছাদ থেকে পড়েছে পাথর।
চোখের নিমেষে ঘটে গেল ব্যাপারটা। উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে এল সাঈদ রানার দিকে।
‘চোট তো নহি লাগি, মেজর?’
কোনও উত্তর না দিয়ে ওর হাত ধরে দ্রুত উঠে এল রানা লাউঞ্জে। এটা যে সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, কেউ ওদের খুন করবার জন্যে কাজটা করেছে, বুঝতে পেরেই এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটল সাঈদ ছাদের দিকে। এক এক লাফে তিন সিঁড়ি টপকাচ্ছে ও। ঠাণ্ডা মাথায় লিফটে করে পাঁচতলায় উঠে এল রানা। অল্পক্ষণ অপেক্ষা করতেই দেখল সাঈদ আসছে সিঁড়ি বেয়ে। হাতে রিভলভার। দ্রুত চিন্তা করছে রানা।
‘ছাতে গিয়ে কোনও লাভ নেই, মি, সাঈদ। এই দেখুন।’
দেখা গেল বাম পাশের লিফটটা নীচে নেমে আসছে। রানা বোতাম টিপল বার কয়েক। 6… 5… 4…নেমে যাচ্ছে লিফট—থামল না। হলুদ নম্বরগুলো কমে আসছে, 2…1…G, সোজা নেমে গেল লিফট গ্রাউণ্ড ফ্লোরে।
‘আপনি ওপরে না এসে নীচে থাকলেই ধরা যেত ওদের।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল সাঈদ।
‘আমার যতদূর বিশ্বাস, ওই লিফটে অপারেটার ছাড়া আর কেউ-ই নেই।’
‘কী করে বুঝলেন?’
‘এইটাই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে।’
‘তা হলে ছাতের ওপর নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে দুশমনদের।’ আবার রওনা হচ্ছিল সাঈদ, এক থাবা বসাল রানা ওর কাঁধে।
‘ছাতেও কিছু পাবেন না, মিস্টার সাঈদ। দুশমন যে-ই হোক না কেন, আমার-আপনার চেয়ে অনেক হুঁশিয়ার। যদি দেখতে চান তা হলে আসুন আমার সঙ্গে।’
সাঈদের উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। দেখল কাগজের টুকরোটা পড়ে আছে মাটিতে। অর্থাৎ, নিশ্চয়ই কেউ ঘরে ঢুকেছিল—কিংবা এখনও আছে।
‘রিলভারটা দিন তো। আমার পিস্তলের গুলি শেষ।’
অবাক হয়ে রানার মুখের দিকে চেয়ে এগিয়ে দিল সাঈদ ওর রিভলভার। নিঃশব্দে তালা খুলে ডান হাতে রিভলভারটা নিল রানা। তারপর বাঁ হাতের এক ধাক্কায় কপাট খুলেই লাফিয়ে ঢুকল ঘরের মধ্যে। না, ঘরের মধ্যে কেউ নেই। শূন্য ঘরটা যেন উপহাস করল রানার অতি-সতর্কতাকে। তবু বাতি জ্বালিয়ে। দুটো ঘর আর বাথরুমটা দেখে নিয়ে নিঃসন্দেহ হলো রানা। তারপর বাতি নিভিয়ে দিয়ে সাঈদকে নিয়ে এসে দাঁড়াল ব্যালকনিতে।
‘ওই যে!’ সাঈদেরই চোখে পড়ল আগে। রানাও চাইল সেদিকে। দেখল রশি বেয়ে নেমে যাচ্ছে একজন লোক ছাত থেকে হোটেলের পিছনে। আবছা অন্ধকারে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। মাটিতে পা ঠেকতেই দৌড় দিল লোকটা সাগরের দিকে। সেইলরস ক্লাবের কাছে গিয়ে রাস্তায় উঠতেই ল্যাম্প পোস্টের আলোয় লোকটার চেহারা দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল রানা এবং সাঈদ। মানুষের চেহারা যে এত প্রকাণ্ড আর এত সৃষ্টিছাড়া কুৎসিত হতে পারে, ধারণা ছিল না রানার। মিশমিশে কালো প্রায় সাত ফুট লম্বা, আর যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। একবার পেছন ফিরে দেখল কেউ আসছে কি না। দেখা গেল ওপরের ঠোঁট নেই। বিকট কালো মুখে ঝকঝক করছে হিংস্র সাদা দাঁত। বুলেটের বেগে চলে গেল বীভৎস মূর্তিটা সমুদ্রের দিকে।
‘গুংগা!’ কেঁপে উঠল সাঈদের কণ্ঠস্বর।
‘চেনেন আপনি ওকে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হ্যাঁ, চিনি। ওয়ালী আহমেদের দেহরক্ষী। লোকটা কালা ও বোবা। ভয়ঙ্কর শক্তি ওর গায়ে।’
‘তা চেহারা দেখেই মনে হলো ওই তিন-মণী পাথর তা হলে ওই ফেলেছিল।’
‘ওই পাথর ওর কাছে দশ ইঞ্চি ইটের মত। আপনি বড় ভয়ঙ্কর পাল্লায় পড়েছেন, মিস্টার মাসুদ রানা। আমি পরামর্শ দিচ্ছি, সম্ভব হলে আজই পালিয়ে যান আপনি করাচি ছেড়ে।’
এসব কথা শুনছে না, রানা। ওর মনে পড়ল, ঢাকায় হেড-অফিসে চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল শেখের একটা কথা। পিসিআই-এর একজনকে দিন দুপুরে খুন করা হয়েছিল ম্যাকলিওড রোডের ওপর। ছাতের ওপর থেকে মস্ত একটা পাথর ফেলে কেউ থেঁতলে মেরেছিল ওকে ফুটপাথের ওপর। আজকের ঘটনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। পিসিআই এজেন্টকে মারা হয়েছিল স্বর্ণমৃগের পিছনে লাগার জন্য, আর রানাকে খুন করবার চেষ্টা করা হলো ওয়ালী আহমেদের পিছনে লাগার জন্যে। দুই জায়গাতেই একই অস্ত্র-পাথর।
তা হলে? ওয়ালী আহমেদই কী স্বর্ণমৃগ? না এটা একটা দৈব-সংযোগ? কোইনসিডেন্স? এমনও হতে পারে যে ওয়ালী আহমেদের সঙ্গে ঝগড়াও হলো, আর স্বর্ণমৃগের কাছে ধরাও পড়ল একই সঙ্গে। স্বর্ণমৃগই আসলে আক্রমণ চালাচ্ছে, আর রানা খামোকা ওয়ালী আহমেদের সঙ্গে ঘটনাকে জড়িয়ে নিয়ে জগা-খিচুড়ি পাকাচ্ছে।
কিন্তু তা হলে গুংগা? সাঈদের কথা কতখানি নির্ভরযোগ্য?
‘আপনি ঠিক জানেন যে ওই বিকট চেহারার লোকটা গুংগা? ওয়ালী আহমেদের দেহরক্ষী? চোখের ভুল হতে পারে?’
‘পাগল নাকি? যে একবার সামনে থেকে দেখেছে ওই চেহারা, জীবনে তার এ ব্যাপারে অন্তত চোখের ভুল হবে না। আপনিই বলুন, আপনি তো এক মুহূর্তের জন্যে দেখেছেন, ভুলতে পারবেন ওই চেহারা?’
কথাটা মনে মনে স্বীকার করতেই হলো রানাকে। সে চেহারা ভুলবার নয়। কয়েক রাত্রির ঘুম নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তা হলে? অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠল যে ব্যাপারটা। ওয়ালী আহমেদই যদি স্বর্ণমৃগ হয়ে থাকে তা হলে সে কি জেনে ফেলেছে রানার পরিচয়? নাকি পৌরুষে আঘাত লাগায় কেবল প্রতিশোধ নিতে চাইছে? ওর অনুপস্থিতিতে ঘর অনুসন্ধান করে কোনও তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে গেল শত্রুপক্ষ? সোহেলই বা ওয়ালী আহমেদ সম্পর্কে সাবধান করল কেন গান্ধী গার্ডেনে? সে কি জানতে পেরেছে কিছু?’
এমন সময় একটা স্পীড-বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ এল কানে। চলে গেল গুংগা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
সাঈদ চলে যেতেই দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজল রানা। ঘরের ভেতরটা টাইম বম্ব রেখে যেতে পারে হয়ত। সুটকেসের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে। এক আধটা কাগজ খোয়াও গিয়ে থাকতে পারে, ঠিক বোঝা গেল না, সারা ঘরে অস্বাভাবিক কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। ঘরে, আলমারি, আলমারির ছাদ, ওয়াল ক্লকের ভেতর, বিছানার তলা, এমনকী ভেন্টিলেটার পর্যন্ত দেখল রানা। নাহ! কোথাও কিছু রেখে যায়নি ওরা। হয়ত রানার সত্যিকার পরিচয় জানবার জন্য লোক পাঠিয়েছিল ওয়ালী আহমেদ, আর কিছু নয়। অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়ে কোটটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে জুতো পরেই শুয়ে পড়ল রানা বিছানায়। থ্রি-ক্যাসলস ধরাল একটা।
পাতলা একফালি নীলচে ধোঁয়া উঠছে ওর হাতে ধরা সিগারেট থেকে। কিছুদূর সোজা উঠে এঁকে বেঁকে যাচ্ছে, তারপর ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে, শেষে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। অন্যমনস্কভাবে সেদিকে চেয়ে গভীর চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল মাসুদ রানা।
খট খট খট। তিনটে টোকা পড়ল দরজায়। রানা ঘড়ি দেখল, সাড়ে নয়টা বাজে। মোহাম্মদ জান কি আগেই এসে গেল? সাঈদের মুখে সব কথা শুনে বোধহয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।
আবার টোকা পড়ল দরজায়। এবার চারটে। অর্থাৎ অসহিষ্ণু। দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেল রানা। দাঁড়িয়ে আছে অনীতা গিলবার্ট।
‘ভেতরে আসতে পারি?’ জিজ্ঞেস করে উত্তরের অপেক্ষা না করেই রানাকে ঠেলে ঢুকে এল অনীতা ঘরের ভিতর। দরজাটা বন্ধ করে দিন। জরুরি কথা আছে।’ মেঝেতে হাইহিলের খুট খুট আওয়াজ তুলে দরজা থেকে সবচাইতে দূরের সোফাটায় গিয়ে বসল অনীতা। চমৎকার একটা নীল-চকলেট-সাদা ছিটের স্কার্ট পরেছে সে। চিকন কটিতে কালো বেল্ট। মাথায় কালো নেটের স্কার্ফ—গলার কাছে গিট দেয়া। মুখে সযত্ন প্রসাধন, ঠোঁটে ঘন করে লিপস্টিক। বিকেলের সেই অর্ধ উলঙ্গ মেয়েটি বলে চেনাই যায় না আর। এই প্রথম রানা উপলব্ধি করল মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী।
দরজা বন্ধ করে বসল রানা মেয়েটির মুখোমুখি।
‘তারপর, হঠাৎ?’ জিজ্ঞেস করল রানা সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে।
‘হঠাৎ নয়। তোমার জন্যে সাড়ে ছ’টা থেকে অপেক্ষা করছি আমি। তোমার ওই কাউ-বয় বন্ধুটা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আসতে পারছিলাম না। আমার অনেক কথা আছে—সব শুনবার সময় হবে তোমার?’ পরিষ্কার বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল অনীতা।
‘না। মেয়েদের কথা কোনওদিন শেষ হয় না। আর অনেক কথা থাকলে তো সর্বনাশ—রীতিমত বিপজ্জনক!’ হাসল রানা। ‘তা ছাড়া আর আধঘণ্টার মধ্যেই বেরোতে হবে আমাকে। একজন ভদ্রলোক আসবেন।’
‘তা হলে খুব সংক্ষেপে সারতে হবে আমার সব কথা।’
রানা উঠে দুটো গ্লাসে উইস্কি ও সোডা ভর্তি করে একটা নিজে নিল আর একটা নামিয়ে রাখল অনীতা গিলবার্টের পাশে।
‘থ্যাঙ্ক ইয়ু,’ এক চুমুক খেয়ে নামিয়ে রাখল গ্লাসটা অনীতা।
‘তোমার প্রভু কোথায়? যীশুর কথা বলছি না, ওয়ালী আহমেদ। আমার ঘরে এসেছ জানতে পারলে…’
‘হ্যাঁ। খুন করে ফেলবে। কিন্তু আমি এখন আর তার চাকর নই। আজ সাড়ে ছয়টায় সে আমার পাওনা চুকিয়ে তার ওপর আরও পাঁচ হাজার টাকা বখশিশ দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে।’
‘তাই নাকি? জোচ্চুরি ছেড়ে দিয়েছে তা হলে তোমার প্রভু? সুখবর!’
‘তোমার জন্যে এটা সুখবর নয়, মি. রানা। সে নিজে ঢুকেছিল তোমার ঘরে, বিকেলে তোমরা বেরিয়ে যাওয়ার পর। তারপরের ঘটনাটুকু আমি জানি বলেই আমার জিনিসপত্র বোনের বাসায় রেখে ফিরে এসেছি আবার।’
আচ্ছা! তা হলে ওয়ালী আহমেদ নিজে এসেছিল তার ঘরে? পরের ঘটনাটুকু শুনবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল রানার মন। কিন্তু সে-ভাব প্রকাশ না করে সিগারেট ধরাল একটা। প্যাকেট এগিয়ে দিল অনীতার দিকে। সিগারেট না নিয়ে উইস্কিতে চুমুক দিল অনীতা।
‘তোমার এই ঘরে যে কী পেল ওয়ালী আহমেদ জানি না। কিন্তু অত্যন্ত উত্তেজিত দেখলাম ওকে। প্রথমেই ওয়্যারলেসে চারদিকে তোমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করল, গাড়ি নিয়ে তোমাকে ফলো করবার আদেশ দিল কাউকে। তারপর ওর অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্টের ম্যানেজারকে ডেকে তোমাকে আজকের মধ্যেই সুযোগ মত পিষে মারবার আদেশ দিল। পিআইএ বুকিং-এ ফোন করে আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে রাওয়ালপিণ্ডির একটা ফার্স্ট ক্লাস টিকেট রাখতে বলল—নিজের নামে। তারপর আমার টাকা-পয়সা চুকিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিল। জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে শুনতে পেলাম হোটেলের ম্যানেজারকে ফোন করে বলছে, আজ সন্ধ্যায় জরুরী কাজে পিণ্ডি যাচ্ছে সে—কাজেই সব বিল যেন তৈরি রাখে ছ’টার মধ্যে।’
এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে চুপ করল অনীতা। একটা সিগারেট ধরাল রানার প্যাকেট থেকে নিয়ে। গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে হাতেই ধরে রাখল সেটা। সিগারেটের সাদা কাগজের ওপর লাল লিপস্টিকের দাগ পড়েছে।
দ্রুত চিন্তা করছে রানা। কোনও কথা বলল না। চেয়ে রইল মেয়েটির দিকে।
‘তোমার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে এসব কথা আমি তোমাকে বলছি কেন? সে কথায় পরে আসছি। আগে এখন এইসব ঘটনা থেকে আমার ডিডাকশনটা শোনো। যদিও তুমি বলেছিলে আইবি বা পুলিশের লোক তুমি নও, কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস তুমি এমন কোনও সরকারি বিভাগের লোক যাকে শেষ না করতে পারলে বিপদে পড়বে ওয়ালী আহমেদ। কারণ, তোমার ঘরে ঢুকবার আগে ওকে খুব খুশি দেখেছিলাম। আমাকে তোমার সম্পর্কে বলেছিল, ‘এতদিনে সত্যিকার একটা যোগ্য লোক পাওয়া গেল। মাসে বারো হাজার টাকা দিতে হলেও এই লোককে রাখব আমি সহকারী বানিয়ে। তোমার ঘর থেকে ঘুরে আসার পর ওর চেহারা দেখে চমকে উঠেছিলাম আমি। তারপরের ঘটনা তো বললামই। ট্রাক দিয়ে পিষে মারার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হইনি। স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক ইনটুইশনের বলে আমি জানতাম অত সহজে তোমাকে ঘায়েল করতে পারবে না ওরা।’
‘করে এনেছিল প্রায়,’ বলল রানা।
‘কিন্তু পারেনি।’ কথাটা ওখানেই থামিয়ে দিয়ে নিজের কথায় ফিরে গেল অনীতা। ‘আর ওয়ালী আহমেদ যাতে এসব ব্যাপারে জড়িয়ে না পড়ে, সেজন্যে আমার যতদূর বিশ্বাস ওর নাম নিয়ে ওর মত দেখতে কোনও লোক চলে গেছে রাওয়ালপিণ্ডি, আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে। কাগজে কলমে ওয়ালী আহমেদ এখন আর করাচিতে নেই।’
‘কিন্তু আসলে সে সশরীরে করাচিতেই আছে, এই তো বলতে চাও? এর পেছনে তোমার কী যুক্তি?’
তিন মাস ছিলাম আমি ওর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে। হাড়ে হাড়ে চিনি আমি ওকে। ও যে কী পরিমাণ ভয়ঙ্কর লোক তা ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। জিনাত সুলতানা ওর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছে—অবাধ্যতা করে অপমান করেছে ওকে। আজ পর্যন্ত কোনও স্ত্রীলোক ওর হাত থেকে নিস্তার পায়নি। জিনাতও পাবে না। ছলে-বলে কৌশলে সে ধূলিসাৎ করবে জিনাতের অহঙ্কার। আত্মসমর্পণ করতেই হবে তাকে ওয়ালী আহমেদের কুৎসিত ইচ্ছার কাছে। তার আগে সে এক পা-ও নড়বে না করাচি থেকে।’
এ ছাই ঝাড়ল অনীতা সিগারেটের। হালকা করে একটা টান দিল সেটাতে, তারপর ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে সোজা রানার চোখের দিকে চাইল এবার সে।
‘আমি তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি, রানা।’
‘কারণ কী, সুন্দরী? আমাকে হত্যা করা হলে তোমার তো কোনও ক্ষতি দেখি না।’
‘ক্ষতি আছে। তোমাকে আমি কিছুতেই মরতে দেব না।’ রানাকে অবাক হয়ে চাইতে দেখে আবার বলল, ‘তুমিই আমার একমাত্র ভরসা, রানা।’
‘প্রথম দর্শনেই প্রেম মনে হচ্ছে!’ কৌতুক বোধ করল রানা।
হেসে ফেলল অনীতা। সোনা বাঁধানো একটা দাঁত চক চক করে উঠল। এক ঢোক উইস্কি গিলে নিয়ে বলল, ‘শুনতে ওই রকমই লাগছে, তাই না? আমি দেখেছি, পুরুষ মানুষকে ঈশ্বর হ্যাণ্ডসাম করে বানালেও মাথায় পাঁঠার বুদ্ধি দিয়ে দেয়। সবক্ষেত্রেই তাই। তোমার বেলায় একটু অন্যরকম ভেবেছিলাম। আজ বিকেলে খানিকটা বুদ্ধির ঝিলিক দেখেছিলাম কিনা, তাই। শোনো হে, আকর্ষণীয় যুবক। তোমার প্রেমে আমি পড়িনি। নারীর প্রেম অত সহজ নয়। তোমাদের মত যেখানে সেখানে ধুপ-ধাপ প্রেমে আমরা পড়ি না। অবশ্য আজ বিকেলে আমার প্রস্তাবে তুমি রাজি হলে খুশি হতাম না তা বলছি না। রানার দিকে তেরছা করে চেয়ে মুচকি হাসল অনীতা! কিন্তু তা হলে আর তোমার কাছে সাহায্য চাইতে আসতাম না।’
‘সাহায্য?’
‘হ্যাঁ, সাহায্য। আমি জানি, কেউ যদি আমাকে সাহায্য করবার শক্তি, সাহস আর বুদ্ধি রাখে, সে হচ্ছ তুমি। আমি যখন অপমানের জ্বালায় তিলে তিলে দগ্ধে মরছি, কালনাগিনীর মত বিষাক্ত ছোবল তুলে প্রতিশোধ নেবার জন্যে সুযোগের প্রতীক্ষা করছি, ঠিক সেই সময় তুমি এসেছ আমার জীবনে প্রেরিত-পুরুষের মত। সাহায্য করবে আমাকে, রানা?’
কথাগুলো বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেল অনীতা গিলবার্ট। করুণ মিনতি ফুটে উঠল ওর চোখে। সমস্ত সত্তা একাগ্র হয়ে উঠেছে ওর রানার উত্তর শুনবার জন্যে।
‘কিসের প্রতিশোধ, অনীতা?’
রানা বুঝল এই মেয়েটির জীবনের কোনও দুর্বিষহ সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সে। নিতান্ত ঘটনাচক্রে হৃদয়ের মস্ত একটা সূত্র উন্মোচন করে দেখাবে মেয়েটি আজ তাকে। খামোকা এক কাজে এসে অন্য কাজে জড়িয়ে পড়বার আশঙ্কায় একটু উদ্বিগ্ন হলো ও মনে মনে। কিন্তু বড় আশা করে এসেছে, ওকে ফেরাবেই বা কী বলে?
‘অপমানের। স্ত্রীলোক প্রকৃতির মতই সর্বংসহা। পুরুষের অনেক অত্যাচার, অনাচার আর কঠিন আঘাত সহ্য করতে পারে সে হাসিমুখে। পুরুষের বুনো স্বভাবের জন্যে আরও বেশি করে ভালবাসে সে তাকে। এটা নারীর ধর্ম। পুরুষরা যখন নাটক নভেলে সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোকের ওপর হৃদয়হীন পুরুষের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনি বর্ণনা করে হা-হুতাশ করে তখন আমরা মনে মনে হাসি। আমরা যাকে মন দিই, তার কোনও অত্যাচারই আর অত্যাচার মনে হয় না আমাদের কাছে। কিন্তু একটা জিনিস নারী কোনদিন সহ্য করতে পারে না, কোনদিন ক্ষমা করে না—সে হচ্ছে অপমান। এসব কথা শুনতে রানার অস্বস্তি লাগছে বুঝতে পেরে আবার বলল, ‘ঘটনাটা খুলে বলছি।’
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল অনীতা। তারপর বলল, ‘তিন মাস আগে আমি এয়ার হোস্টেস ছিলাম। কায়রো থেকে করাচি ফিরছিলাম। সেই প্লেনেই পরিচয় হয় ওয়ালী আহমেদের সাথে। ও প্রস্তাব দিল ওর সাথে ডিনার খাওয়ার। আমার নৈতিক চরিত্রের বালাই কোনদিনই ছিল না, এখনও নেই। তা ছাড়া নিয়মিত কন্ট্রাসেপটিভ পিল ব্যবহার করতাম তখন আমি। কাজেই নির্ভয়ে রাজি হয়ে গেলাম। ক্যাপ্টেনের কাছে অনুমতি চাইতেই আমার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে মৃদু হেসে অনুমতি দিয়ে দিল সে।’
‘সেই রাতেই প্রথম এলাম আমি এই হোটেলে ওয়ালী আহমেদের কামরায়। ডিনার শেষ হতেই একটিও কথা নেই বার্তা নেই আমার জামা কাপড় খুলতে আরম্ভ করল ওয়ালী আহমেদ। আমি আপত্তি করলাম। কিন্তু এইমাত্র ওর পয়সায় তৃপ্তির সঙ্গে জীবনের শ্রেষ্ঠ ডিনার খেয়ে উঠে তেমন জোর করে কিছু বলতেও পারলাম না। তা ছাড়া, একজন পুরুষের সঙ্গে মেয়েমানুষ গায়ের জোরে পারবে কেন?’ লাল হয়ে উঠল অনীতার মুখ। নীচের ঠোঁটটা কাঁপছে। কামড়ে ধরে সেটাকে সংযত করবার চেষ্টা করল সে। অপলক চোখে চেয়ে শুনছে রানা একটি নারীর চরম লজ্জার কথা।
‘ধস্তাধস্তি করলাম। কিন্তু পারলাম না। লণ্ডন থেকে কেনা আমার দামি স্কার্টটা একটানে চড়চড় করে ছিঁড়ে ফেলল ওয়ালী আহমেদ। প্রায় নগ্ন অবস্থায় ছুটোছুটি করতে থাকলাম ঘরের মধ্যে ওর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। ধরে ফেলল ও। তারপর পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল বিছানায়। নীল বাতিটা ছাড়া সব বাতি নিভিয়ে দিল। বলল, ‘ওই কাপড়ের জন্যে দুঃখ কোরো না অ্যানিটা, ও রকম একশ’টা কাপড় কিনে দেব আমি কাল তোমাকে। শুধু আজকের রাতটা উপভোগ করতে দাও আমাকে। বাধা দিয়ো না। আমিও ভেবে দেখলাম, একটা কাপড় ছিঁড়ে ফেলা এমন কিছু দোষের নয়, কামুক লোক উন্মত্ত হয়ে উঠলে এর চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর কাজ করতে পারে। চুপচাপ পড়ে থাকলাম।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে অস্বাভাবিক উত্তেজিত হয়ে উঠল অনীতা। নিজেকে শান্ত করবার জন্য একটা সিগারেট ধরাল। রানা দেখল থর থর করে কাঁপছে ওর হাত।
‘তারপর?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘তারপর আমার সর্বাঙ্গে আদর করতে আরম্ভ করল সে। হাজার হোক রক্ত মাংসে তৈরি আমি। ধীরে ধীরে ভাবান্তর এল। এখন ভাবতে ঘৃণা হয়, কামাতুরা আমি চুম্বন করলাম ওর ঠোঁটে। আধঘণ্টা ধরে ক্রমাগত আদর করেই চলেছে সে। অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। আমার অস্থিরতা দেখে এক মিনিটেই আসছি বলে বাথরুমে ঢুকল ওয়ালী আহমেদ। অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি। তিন মিনিট পর সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক।’
‘একজন লোক? ওয়ালী আহমেদ না?’
‘না!’ শিউরে উঠল অনীতা একবার। বিকট দর্শন ভয়ঙ্কর চেহারার একটা পিশাচ। নীল আলোয় দেখলাম মিশমিশে কালো প্রকাণ্ড এক দৈত্য এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে। জ্বল জ্বল করছে চোখ দুটো। উপরের ঠোঁট কাটা। দাঁত আর মাড়ি বেরিয়ে আছে। আঁতকে উঠে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমেই ছুটলাম দরজার দিকে। বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে এল পিশাচটা। চুলের মুঠি ধরে শূন্যে তুলে ফেলল। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। আবার বিছানায় এনে ফেলল সে। তারপর…’
দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল অনীতা। ফুলে ফুলে উঠতে থাকল ওর সর্বশরীর। একটু সামলে নিয়ে ভাঙা গলায় বলল, তারপরের কথা আর বলতে পারব না আমি। সে একটা দুঃস্বপ্ন। তীব্র বেদনায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে পিশাচটা। বিছানার চাদর ভেসে গেছে তাজা রক্তে।’
চেহারা বিকৃত হয়ে গেল অনীতার। মুখটা হাঁ করে চোখ বন্ধ করল ও—গাল দুটো কুঁচকে ওপরদিকে ওঠানো। রানা বুঝল, সেই ব্যথার স্মৃতিটা ভুলতে পারছে না অনীতা, স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে আবার এখন। আবার দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।
উঠে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখল রানা। রানার মনের সমস্ত দ্বিধা আর সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। বলল, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করব, অনীতা। তোমার এ অপমানের কথা আমি ভুলব না। আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এর প্রতিশোধ নেব আমি!’
কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল অনীতার চোখ-মুখ। যেন এই একটি কথায় হালকা হয়ে গেল ওর মনের বোঝা। বলল, ‘সেই থেকে অপেক্ষা করছি আমি সুযোগের। সাগ্রহে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম ওর প্রাইভেট সেক্রেটারি হবার প্রস্তাবে। প্রতিশোধ আমি নিতাম। কিন্তু আজ আমাকে বিদায় করে দিয়ে পালিয়ে গেছে সে আমার নাগালের বাইরে। তাই এসেছি তোমার কাছে। ধন্যবাদ, রানা। কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম তোমার কাছে। ধন্যবাদ।’
চোখ মুছে ভ্যানিটিব্যাগ খুলে ছোট্ট একটা আয়না বের করে আবার মেক আপ নিল অনীতা। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে সন্ত্রস্ত পায়ে।