» » স্বর্ণমৃগ

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

স্বর্ণমৃগ

দুই

থারটি সিক্স—টোয়েনটি টু—থারটি সিক্স। বয়স ছাব্বিশ।

লাস্যময়ী মহিলা। নাম জিনাত সুলতানা। লম্বা একহারা দেহে আঁটসাট করে পেঁচিয়ে পরা পাতলা নাইলন শাড়িটা পরা না পরা প্রায় সমান কথা। কাঁচের মত এই স্বচ্ছ আবরণ ভেদ করে পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টি অনেক কিছুই দেখতে পাবে, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে বুকের মধ্যে কামনার আগুন-এই বাসনাই কি মেয়েটিকে এমন উগ্র সজ্জায় উদ্বুদ্ধ করেছে?

অতুলনীয় রূপের বন্যায় সে কি ভাসিয়ে ডুবিয়ে একাকার করে দিতে চায় মুগ্ধ রূপগ্রাহীকে?

বোধহয় না। রানা ভাবছিল, তাই যদি হবে তা হলে কোনও পুরুষকে কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না কেন মেয়েটা? সারা অঙ্গে যেন আগুন জ্বালিয়ে নিয়েছে। কেউ স্পর্শ করলেই হাত পুড়ে যাবে। তাকেও হাতটা পুড়িয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। জীবনে এই প্রথম এমন প্রত্যাখ্যান পেল মাসুদ রানা। কিন্তু এই আগুন যদি কেবল আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত তা হলে এত আকর্ষণ বোধ করত না রানা। এত চিন্তাও করত না মেয়েটির জন্যে। কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারছে ও, এই আগুনেই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। নিজেকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করছে সে প্রতি পলে। বোধহয় জীবনের সবটা তার দেখা হয়ে গেছে। লোভীর মত সব রস পান করে ফেলেছে সে অল্প সময়ের মধ্যেই।

সাগরের নোনা হাওয়া থেকে সামনের মাজা-ঘষা চেহারাটা আড়াল করবার জন্য রাস্তার দিকে মুখ করে আর সাগরের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড সাততলা বিচ লাগজারি হোটেল। আধুনিকতম সব রকমের ব্যবস্থাই আছে। হোটেলের সামনে রাস্তার উপর দামি গাড়িগুলো তেরছা করে সার বেঁধে দাঁড়ানো। অল্প দূরেই একটা ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে সব সময় অন্তত চারটে ট্যাক্সি দাঁড়ানো থাকে। লোহার গেট দিয়ে ঢুকেই সরু রাস্তার দু’পাশে নানান রকম ফুলের চমৎকার বাগান আর সবুজ ঘাস। কয়েক কদম এগোলেই লাউঞ্জে উঠবার সিঁড়ি। বাম পাশে রিসেপশন কাউন্টার। লাউঞ্জের এখানে ওখানে সোফা সেট। ডান ধারে লিফট। পাশেই সিঁড়ি। প্রকাণ্ড লাউঞ্জ ছাড়িয়ে ঢুকতে হয় বেগুনী পর্দায় ঢাকা কারুকার্য খচিত বার-এ। বারের মধ্যে দুই পাশে দুই টবে লাগানো ‘মানিপ্ল্যান্ট’ লতিয়ে উঠেছে দেয়ালে। গোটা কতক অর্কিড ছাত থেকে সরু পিতলের চেইন দিয়ে ঝোলানো নক্সা আঁকা মাটির পাত্রে রাখা। নীলচে ফ্লোরেসেন্ট টিউবের আলো আসছে সিলিং-এর চারটে গোল গর্ত থেকে। দুই পাশে দেয়ালে চুঘতাইয়ের মস্ত দুটো অয়েল পেইন্টিং। মোগলাই দরবারের সুরা পানের দৃশ্য। বারে ঢুকে সোজা তাকালেই দেখা যায় সাগরের নীলিমা। প্রকাণ্ড সব পুরু বেলজিয়ান কাঁচ বসানো আছে ওদিকটায় দেয়ালের বদলে। ইচ্ছে করলেই কালো স্ক্রিন দিয়ে ঢেকে দেয়া যায় রোদ্রের প্রখরতা।

এই বারের পিছন দিকে সাগরের দিকে মুখ করে চুপচাপ একা বসে আছে রানা। আরেকটা ডাবল-স্কচ এনে রাখল বেয়ারা ওর টেবিলে।

কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা গেল আজও নির্দিষ্ট টেবিলে মুখোমুখি বসে জুয়া খেলছে মেয়েটি সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সঙ্গে। আরও ঘণ্টাখানেক খেলবে। সন্ধ্যে হয়ে গেলেই উঠে পড়বে ওরা। লোকটি কোনও দিকে না চেয়ে সোজা চলে যাবে, হোটেলের দোতলায় ওর নিজের কামরায়। মেয়েটি এসে ঢুকবে বারে। গ্লাসের পর গ্লাস মদ খাবে। পরিপূর্ণ মাতাল অবস্থায় টলতে টলতে চলে যাবে পাঁচতলায় নিজের কামরায় দুই হাতে দুটো বোতল নিয়ে।

বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঝিলমিল করছে আরব সাগর। হোটেলের পিছনে একটা সরু পিচ ঢালা রাস্তা সোজা চলে গেছে সমুদ্র তীরে। সেই রাস্তার ডান পাশে হোটেল থেকে গজ বিশেক দুরে সেইলরস ক্লাব। একতলা। পারটেক্সের ছাদ আর কাঁচের দেয়াল। সাগর থেকে আসা উদ্দাম হাওয়া রোধ করবার জন্য প্রচুর টাকা ব্যয় করে লোহার ফ্রেমে আঁটা কাঁচের দেয়াল দেয়া হয়েছে চারপাশে। ফলে সাগর দেখা যায় পরিষ্কার, কিন্তু বাতাসের ধাক্কায় কফির কাপ বা টেবিলে বাটা তাস উল্টে যাবার ভয় নেই। নানান রকম জুয়োর ব্যবস্থা আছে ক্লাবটায়। সন্ধ্যে হলেই কালো স্ক্রিন টেনে বাইরের জগৎ থেকে আলাদা করে দেয়া হয় ভিতরের জুয়াড়িদের। তারপর সেখানে চলে সবচাইতে উঁচু স্টেকে টাকা-ওয়ালাদের ভাগ্যের উত্থান-পতন। সেইসাথে আরও কত কী! একজন ‘সেইলর’ও পাত্তা পায় না সেইলরস্ ক্লাবে।

দিনের বেলায় স্ক্রিন সরিয়ে ফেলার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ভিতরের সবুজ ঘাসের গালিচা আর ফুলের কেয়ারিতে সূর্যের আলো ও উত্তাপ লাগানো। তা ছাড়া দিনের বেলা তেমন লোকজনও হয় না। মেয়েমানুষ তো প্রায় থাকেই না যে তাদের চক্ষু লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি দিতে হবে। এই নিরিবিলি ক্লাবের এক কোণের টেবিলে মুখোমুখি বসে ফ্ল্যাশ খেলছে জিনাত সুলতানা সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সঙ্গে। গত পাঁচদিন ধরে রোজই খেলছে।

দ্বিতীয়, গ্লাস উইস্কি সামনে নিয়ে চেয়ে রইল রানা ওদের দিকে। মনে হচ্ছে একটা প্রকাণ্ড অ্যাকুয়েরিয়ামের মধ্যে বসে আছে ওরা। হরেক রকমের মাছ আছে এতে। লালচে চুলের ওই প্রৌঢ় জুয়াড়িকে রানার মনে হচ্ছে যেন-গোল্ড ফিশ। মেয়েটি অ্যাঞ্জেল ফিশ। আর ও নিজে? একটু হেসে ভাবল, ঝগড়াটে আর হিংসুক সিয়ামিজ ফাইটার।

গত রাতে এতগুলো লোকের মধ্যে হঠাৎ যখন মেয়েটি মাত্রাতিরিক্ত সেবনের ফলে হিক্কা তুলে বমি করতে আরম্ভ করেছিল, ভদ্রলোকেরা ছিটকে সরে গিয়েছিল জামা কাপড় বাঁচাতে, তখন ছুটে গিয়ে ধরেছিল মাসুদ রানা। বেসিনে নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে মুখ ধুইয়ে দিয়েছিল, চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে মুছে দিয়েছিল ওর মুখ। তারপর? একটু সামলে নিয়েই ঠাস করে চড় বসিয়ে দিয়েছিল মেয়েটি ওর গালে। চিৎকার করে বলেছিল, ‘নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে, বদমাশ কাহিকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গিয়েছিল সোজা নিজের ঘরে।’ ঘর ভর্তি মহিলারা আন্তরিক দুঃখিত এবং পুরুষরা আনন্দিত হয়েছিল এই ঘটনায়। অপমানিত রানাকেও ‘বার’ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল মাথা নিচু করে।

কিন্তু আজ রানার দিকে চেয়ে মুচকে হাসল কেন মেয়েটি? কী অপূর্ব সেই হাসি!

কে এই মেয়েটি? রিসিপশনিস্টের কাছ থেকে কেবল নামটা জানা গেছে। আর সবকিছুই রহস্যময়। পাঁচ দিন আগে হঠাৎ এসে উঠেছে এই হোটেলে। রানা স্থির করল মেয়েটির সম্পর্কে সব তথ্য বের করতেই হবে–আগামী কালই। অদ্ভুত এক অমোঘ আকর্ষণে টানছে মেয়েটি ওকে।

রানা ভাবছে, সোনার চোরাচালান ধরতে পারছে না কাস্টমস, কিন্তু কেউ যদি এই মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের দেশে যায়, তা হলে ঠিক ধরে ফেলবে। এই মেয়েটি খাঁটি সোনা। অনেক কষ্টি পাথরে যাচাই করা। কারও চোখ এড়ানো সম্ভব নয়, ঠিক আটকে ফেলবে কাস্টমস্। কথাটা মনে উদয় হতে একটু হাসল রানা।

এক চুমুকে গ্লাসের দেড় ইঞ্চি অবশিষ্টটুকু গলাধঃকরণ করে রানা ভাবল, সাগর তীরে হাঁটবে কিছুক্ষণ। আরও খানিকটা নেমে এসেছে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে। আর অল্পক্ষণ পরেই মেঘেরা পরবে রঙীন সাজ। তারপর বসন্তের রাত্রি নামবে করাচি বন্দরে। মহানগরীর অলিতে গলিতে নেমে আসবে রাতের পাপ পঙ্কিল বিভীষিকা। গলিমুখে রূপজীবিনীর ভিড়, হোটেলে/বারে জুয়া-মদ মেয়েমানুষের ছড়াছড়ি। ভদ্রতার খোলস ছেড়ে মানুষের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে পশু। বাঈজীর কণ্ঠে বসন্তবাহারের সুর মাতাল করে তুলবে সঙ্গীত কক্ষের মদ্যপ শ্রোতাদেরকে।

উঠে পড়তে যাচ্ছিল রানা, এমন সময় চোখে পড়ল ঠিক দশ হাত দূরে জিনাত সুলতানা! অনাবৃত ক্ষীণ কটি। সারা দেহে হিল্লোল তুলে এগিয়ে আসছে ওর টেবিলের দিকে। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকল রানা ওর দিকে। গত রাত্রির দুর্ব্যবহারের জন্যে দুঃখিত হয়ে ক্ষমা চাইবে নাকি মেয়েটা? সন্ধ্যের আগেই আজ উঠে এল যে খেলা ছেড়ে? রানার চোখে চোখ পড়তেই বিচিত্র এক টুকরো হাসি খেলে গেল মেয়েটির ঠোঁটের কোণে।

‘বসতে পারি?’ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।

‘বসুন।’

ঠিক রানার পাশের চেয়ারে বসে পড়ল জিনাত। একটা উগ্র সেন্টের গন্ধ এল নাকে। মেয়েটিকে দেখলেই প্রখর রোদ আর সোডা ওয়াটারের ঝাঁঝের কথা মনে পড়ে যায়। কড়া সেন্টের গন্ধ বেমানান লাগে না একে মাখলে। প্রথমেই রেভলন নেইল পলিশ লাগানো নখ দিয়ে টেবিলের উপর রাখা রানার আনকোরা থ্রি-কাসলস প্যাকেটের ওপরকার সেলোফেন পেপার ছিঁড়ে ফেলল জিনাত। একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাতেই লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিল রানা সেটা।

‘থ্যাঙ্ক ইয়ু।’

একগাল ধোঁয়া ছাড়ল জিনাত। চুপচাপ কিছুক্ষণ সিগারেট টানল। একটার পর একটা রিঙ তৈরি করতে থাকল ধোয়া দিয়ে। কয়েক টানেই অর্ধেকের কাছাকাছি চলে এল আগুনটা।

‘আমার পেছনে লেগেছ কেন তুমি? গত তিনদিন ধরে লক্ষ করছি। কী চাও তুমি আমার কাছে?’

কোনও উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল রানা। হাওয়া তা হলে এই দিকেই বইছে। টেবিলের উপর দুই কনুই রেখে হাতের তালুর উপর চিবুক রেখেছে জিনাত। চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে রানার চোখের উপর। রানার দৃষ্টিটা নেমে গিয়েছিল খানিকটা নীচে নিজের অজান্তেই। ক্ষুদ্র চোলিতে অর্ধাবৃত বুকের উপর লতিয়ে পড়ে আছে একটা সোনার লকেট। বড় সাইজের একটা হীরে বসানো আছে তাতে। হঠাৎ চোখ তুলেই বুঝল রানা গভীর মনোযোগের সাথে তাকে লক্ষ করছে জিনাত সুলতানা। লজ্জিত হলো ও একটু।

‘কী? উত্তর দিচ্ছ না যে? কেন আমার পিছনে লেগেছ তুমি?’

‘এটাই তো স্বাভাবিক। তুমি সুন্দর, তাই।’

জীবনে কতবার যে কথাটা বলেছে রানা। ভাবল এবারও বুঝি কাজে লাগবে। এ স্তুতি। কিন্তু না, ভুরু জোড়া কুঁচকে গিয়েই আবার সোজা হয়ে গেল জিনাতের। একটুও হাসল না সে। কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ লাগল রানার কাছে।

‘ভালবাস আমাকে?’

হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল জিনাত। অবাক হয়ে গেল রানা। পাগল নাকি?–এ কেমন ধারা প্রশ্ন? চেনা নেই, শোনা নেই, কিছু না; হঠাৎ ‘ভালবাস?’

‘সে সুযোগ তো দাওনি,’ বলল ও স্বাভাবিক কণ্ঠে।

‘পছন্দ করো?

‘নিশ্চয়ই। তোমাকে কে না পছন্দ করবে, বলো?’

হঠাৎ অ্যাশট্রের মধ্যে সিগারেটটা ঠেসে মুচড়ে নিভিয়ে দিল জিনাত। মনে হলো কোনও একটা ভয়ঙ্কর আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ হলো এইভাবে। চিবুক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আবার সোজা রানার চোখের উপর চোখ রাখল সে। অদ্ভুত এক মাদকতা সে চোখে।

‘ঠিক। সবাই পছন্দ করে। তার কারণও আমার অজানা নেই।’ বিদ্রুপের বাঁকা হাসি ফুটে উঠল ওর অধরে। তারপর বলল, ‘সবাই পছন্দ করে, পেতে চায়। খুব সহজেই পাওয়া যায় আমাকে। চাও তুমি?’

ধক্‌ করে উঠল রানার বুকের ভিতরটা। হঠাৎ কী হলো মেয়েটির? এসব কী বলছে ও?

‘এ কেমন ধারা প্রশ্ন, জিনাত? ঠাট্টা করছ?’

‘তুমি কি আমার ভগ্নিপতি, যে ঠাট্টা করব?’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল জিনাত। ‘যদি ইচ্ছে হয় তা হলে আজ রাতে আসতে পারো আমার ঘরে। কিন্তু বিনিময়ে টাকা দিতে হবে। এক্ষুনি।’

মনে মনে আশ্চর্য না হয়ে পারল না রানা। তা হলে এই ব্যাপার? টাকার বিনিময়ে দেহ? কিন্তু মেয়েটিকে তো ঠিক ও-রকম মনে হয় না। কোনও অসুবিধায় পড়ে এই কাজ করতে যাচ্ছে না তো?

‘টাকার তো তোমার অভাব আছে বলে মনে হয় না,’ বলল রানা। ‘কিন্তু সে কথা থাক। কত টাকা চাই?’

‘দশ হাজার। আমাকে যা-ই মনে করো না কেন? টাকা আমার দরকার। এখন আমি সর্বস্বান্ত।’

‘কী করবে টাকা দিয়ে?’

‘সেটা তোমাকে বলতে আমি বাধ্য নই। তবু বলছি। ফ্ল্যাশ খেলব।’

‘এই পাঁচ দিন খুব ফ্ল্যাশ খেলছ বুঝি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কত টাকা হারলে?’

‘দেড় লাখ।’

‘দেড় লাখ টাকা! অথচ এখনও নেশা কাটেনি তোমার?’

‘এত কথা শুনতে চাই না। টাকা দেবে কি না বলে দাও পরিষ্কার।’

‘ওই জোচ্চোরের সাথে ফ্ল্যাশ খেলে হারবার জন্যে তোমাকে এক পয়সাও দিতে পারব না আমি। কেন তুমি এভাবে নিজেকে…’

‘উপদেশ খয়রাত করবার কোনও প্রয়োজন নেই, মি. মাসুদ রানা। ভাল মন্দ বুঝবার বয়েস আমার হয়েছে। মনে কোরো না তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছি আমি। তুমি ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই, ভুলেও এ ধারণা কোরো না। এটা তোমার প্রতি একটা বিশেষ অনুগ্রহ ছিল বলেই জেনো। ওয়ালী আহমেদ প্রস্তাব দিয়েছে শুধু একটি দিন অনুগ্রহ করলেই আমার সব টাকা ও ফিরিয়ে দেবে। আমি রাজি হইনি। ওর কাছ থেকে যদি না-ও নিই, এখানকার যে কোনও লোকের কাছে এই প্রস্তাব দিলেই টাকা নিয়ে কুকুরের মত ছুটবে আমার পিছন পিছন। কাজেই উপদেশ খয়রাত করতে এসো না। তোমাকেই প্রথম সুযোগ দেব মনে করেছিলাম। যাক, তুমি যখন রাজি নও তখন, সো লঙ।’

উঠে পড়েছিল জিনাত। রানা ধরে ফেলল ওর হাত। বসে পড়ল সে আবার।

‘তোমাকে যত দেখছি ততই তোমার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছি আমি, জিনাত। আমিই দিচ্ছি টাকাটা। বিনিময়ে কিছু দিতে হবে না। তোমাকে আমি …’

‘মহত্ত্ব দেখানো হচ্ছে, না?’ খেপে উঠল জিনাত। তোমার কৃপা চাই না আমি। আমার কথায় রাজি থাকলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওই টেবিলে পৌঁছে দেবে টাকাটা। উঠে দাঁড়াল সে। ঘড়িটা দেখল একবার। মনে রেখো, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম।

চলে গেল জিনাত সেইলরস ক্লাবের দিকে। রানা চেয়ে দেখল নিবিষ্ট চিত্তে খবরের কাগজ পড়ছে ওয়ালী আহমেদ। গত রাতে ডলফিন ক্লাবে বাকারাত খেলে চল্লিশ হাজার টাকা উপার্জন করেছিল রানা। তার থেকে দশ হাজার খরচ করা ওর জন্য কিছুই না। স্থির করল ও টাকাটা দেবে। কিন্তু কোনও কিছুর লোভে নয়। মেয়েটির নিশ্চয়ই মাথায় গোলমাল আছে। সেই সুযোগে তার দেহ ভোগ করবার কথা চিন্তাও করতে পারে না রানা। তীব্র কোনও বেদনা লুকিয়ে আছে মেয়েটির মনের মধ্যে, অহরহ ছিন্নভিন্ন করছে তাকে। অদ্ভুত একটা মমত্ববোধ জাগল রানার ওর প্রতি। টাকাটা দিলেই যে তার ঘরে যেতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই। টাকা না দিলে মেয়েটি যাচ্ছে-তাই করে বসতে পারে, সেজন্যে দেবে।

লিফটে করে সোজা পাঁচতলায় উঠে ঘর থেকে টাকাগুলো নিল রানা। ঘরের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। জোরালো হাওয়া আসছে সাগর থেকে। ঢেউ ভেঙে পড়ছে এসে বালুকা বেলায়। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। একটা ফাণ্টার বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছে জিনাত ক্লাবের দরজার সামনে। রানার উপর চোখ পড়ল ওর। রানা হাত নাড়ল। ক্লাবের ভিতর চলে গেল জিনাত। একতলার লাউঞ্জ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় রানা লক্ষ্য করল সেই তিনজন লোক ঠিকই বসে আছে কোণের টেবিলে। রানার দিকে নির্বিকার মুখে তাকাল একজন। পাশের লোকটিকে কিছু বলল। সে-ও চাইল রানার দিকে। মতলব কী ব্যাটাদের? এরা নজর রাখছে কেন তার ওপর? ধরা পড়ে গেল নাকি ও? সাবধান হতে হবে। গত তিন দিন থেকে এখানে আড্ডা গেড়েছে লোকগুলো। বেরিয়ে গেল রানা লাউঞ্জ থেকে চিন্তিত মুখে।

কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা, তবু খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলল না ওয়ালী আহমেদ। পরিচয় করিয়ে দেবে বলে জিনাত ডাকল, এই যে, ‘শুনছেন?’ কোনও সাড়া নেই। গলা নিচু করে জিনাত রানাকে বলল, ‘কানে কম শোনে।’ তারপর জোরে আবার ডাক দিল, ‘কই সাহেব, শুনছেন?’

‘অ্যাঁ!’ বলে চমকে উঠল ওয়ালী আহমেদ। কাগজটা চোখ থেকে নামিয়ে রানাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল।

‘ইনি মিস্টার ওয়ালী আহমেদ, আর ইনি মিস্টার মাসুদ রানা,’ বলল জিনাত।

‘গ্ল্যাড টু মিট ইয়ু, মিস্টার মাসুক নানা।’ উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাণ্ড শেক করল ওয়ালী আহমেদ। নরম তুলতুলে হাতটা যেন কাদা দিয়ে তৈরি, কিম্বা অর্ধেক বাতাস ভরা বেলুনের গ্লাভস। গা-টা ঘিন ঘিন করে উঠল রানার। লম্বা চওড়া মেদবহুল দেহ লোকটার। চুলগুলো লালচে। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। ঠোঁটের ওপর পাতলা লালচে গোঁফ। সারাটা মুখে বুটি বুটি বসন্তের দাগ। অস্বাভাবিক সবজেটে চোখ। একটু খেয়াল করতেই রানা বুঝল চশমার বদলে কন্ট্যাক্ট লেন্স লাগিয়ে নিয়েছে চোখে। স্থির দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে থাকল ওয়ালী আহমেদ কয়েক মুহূর্ত। তারপর অমায়িক হাসি হেসে বলল, ‘বসুন, মিস্টার নানা।’

হাসির সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল দাঁতগুলো। ঠিক যেন তরমুজের বিচি। এতক্ষণে রানার চোখে পড়ল টেবিলের একপাশে রাখা একটা রুপোর কৌটা ভর্তি পান। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর একটা করে পান মুখে দিচ্ছে সে। ফলে দাঁতগুলো আর দর্শনযোগ্য নেই।

‘আমার নাম মাসুদ রানা। মাশুক নানা নয়,’ একটা চেয়ারে বসে বলল রানা।

‘ও আচ্ছা, আচ্ছা। মাসুদ নানা। মাসুদ নানা।’ মুখস্থ করবার মত করে বলল ওয়ালী আহমেদ। তারপর বুক পকেট থেকে হিয়ারিং এইডটা বের করে কানে লাগাল। মৃদু হেসে বলল, ‘আপনিও খেলবেন নাকি, মিস্টার নানা?’

‘জী, না।’

টাকা ভর্তি এনভেলপটা জিনাতের হাতে দিল রানা ওয়ালী আহমেদকে আড়াল করে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না ওয়ালী আহমেদ। জিনাতকে জিজ্ঞেস করল, ‘তা হলে? খেলা কি আজকের মত শেষ?’

‘শেষ হবে কেন, ডিল করুন না। টাকা জোগাড় হয়ে গেছে।’

রানার দিকে আরেকবার চাইল ওয়ালী আহমেদ চট করে। তারপর একটা পান মুখে ফেলে নতুন এক প্যাকেট তাস সর্ট করতে আরম্ভ করল। রানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আছেন কোথায়, মি. নানা?’

‘এই হোটেলেই।’ আঙুল দিয়ে দেখাল রানা হোটেলের দিকে।

‘না মানে, কী করছেন?’

‘ব্যবসা।’

‘কিসের ব্যবসা?’ কার্ড ডিল করে জিজ্ঞেস করল আবার ওয়ালী আহমেদ।

‘আমাদের ঈস্ট পাকিস্তানের কয়েকটা প্রোডাক্টের জন্যে করাচিতে হোলসেল মার্কেট তৈরির চেষ্টায় এসেছি আমি।’

‘কেমন রেসপন্স পাচ্ছেন?’ এক শ’ টাকার নোট খেলল ওয়ালী আহমেদ।

‘মন্দ না।’

দুই এক দান খেলেই শো করতে বলল জিনাত। জ্যাক টপেই দান জিতে নিয়ে গেল ওয়ালী আহমেদ।

‘তা ক’দিন থাকবেন?’

‘আর সপ্তাহ খানেক।’

রানার ইচ্ছে, আরও কয়েক দান খেলা দেখবে। রহস্যটা ভেদ করতেই হবে। বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে চুরি করছে ওয়ালী আহমেদ কোনও উপায়ে। কিন্তু ভাবছে, এতবড় ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট—যে একটা ব্যাঙ্কের ম্যানিজিং ডিরেক্টর, যে একটা মোটর অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট, তিনটে কটন মিল, একটা জুট মিল এবং গোটাকয়েক নামজাদা হোটেলের মালিক, এবং আরও বহু কোম্পানির ডিরেক্টর, সেই ওয়ালী আহমেদ একটা সাধারণ সোসাইটি গার্লের কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা জোচ্চুরি করে ছিনিয়ে নিতে যাবে কেন? অথচ চুরি যে করছে তাতে কোনও ভুল নেই। নইলে দুই হাতের ফ্ল্যাশ খেলায় পাঁচ দিনে দেড়লক্ষ টাকা জেতা এক কথায় অসম্ভব। যত উঁচু স্টেকই হোক না কেন।

আবার পঞ্চাশ টাকা বোর্ড ফি রাখল দুজন। তিনটে-তিনটে ছ’টা কার্ড বেঁটে দিল জিনাত ওয়ালী আহমেদের কাটা হয়ে গেলে পর। এবারও হারল জিনাত। রানা লক্ষ্য করল কার্ড বাটার মধ্যে কোনও রকম চাতুরীর আভাস নেই। আঙুলে আংটি কিংবা সার্জিক্যাল টেপ নেই যে চিহ্ন দিয়ে রাখবে তাসে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন খেলা ওয়ালী আহমেদের। অথচ ছ’ মিনিটের মধ্যেই দুই হাজার টাকা হেরে গেল জিনাত। জিনাতের হাতে ভাল কার্ড পড়লেই কিভাবে যেন টের পেয়ে যাচ্ছে ওয়ালী আহমেদ। ফেলে দিচ্ছে হাতের তাস। শুধু বোর্ড ফি-টা পাচ্ছে জিনাত। কিন্তু নিজের হাতে যদি বেশি ভাল কার্ড থাকে তা হলে অনেকদূর পর্যন্ত এগোচ্ছে খেলা—জিনাত শো’ না দিলে খেলেই চলেছে। কোনও রকম ব্লাফেই বিচলিত করতে পারছে না জিনাত ওকে। রানা স্থির নিশ্চিত হলো, চুরি করছে ওয়ালী আহমেদ। কিন্তু কী উপায়ে?

একবার জিনাত পেল ফ্ল্যাশ। ফেলে দিল ওয়ালী আহমেদ ওর হাতের কার্ড ‘অফ’ বলে। চট করে কার্ডগুলো তুলে রানা দেখল কিং-এর পেয়ার ছিল ওর হাতে। কিন্তু এক দানও না খেলে নামিয়ে রেখেছে হাতের কার্ড ওয়ালী আহমেদ।

‘অদ্ভুত আপনার আন্দাজ তো!’ টিটকারি মারল রানা।

‘জী, হাঁ। আমি মুখ দেখলেই বুঝতে পারি কার হাতে কী আছে। এই চোখে কিছুই এড়ায় না।’ বলে একটা পাই পয়সা দিয়ে দুটো টোকা দিল দুই চোখে। ঠুন ঠুন করে শব্দ হলো।

‘মিস জিনাত কি বরাবরই হারছেন আপনার কাছে?’

‘বরাবর। ওঁকে নিষেধ করেছি। তবু উনি খেলবেন।’

‘আমি দেখেছি জায়গা বদলালে অনেক সময় ভাগ্য ফিরে যায়। আপনারা জায়গা বদলে নিলেই পারেন,’ বলল রানা।

‘সেটা সম্ভব নয়, গম্ভীর মুখে বলল ওয়ালী আহমেদ। সেটা আমি প্রথম দিনই মিস সুলতানাকে বলে নিয়েছি। ওদিকে বসলে সাগর চোখে পড়ে। অ্যাগোরাফোবিয়া রোগ আছে আমার। চোখের সামনে খোলা বিস্তৃতি সহ্য করতে পারি না। তাই হোটেলের দিকে মুখ করে বসি সব সময়। উল্টো দিকে বসলে খেলতে পারব না আমি।’

ক্লসট্রোফোবিয়ার নাম শুনেছি, কিন্তু অ্যাগোরাফোবিয়া তো শুনিনি কোনওদিন?’

‘হ্যাঁ। বেশ অসাধারণ রোগ।’

মুখে পান ফেলল ওয়ালী আহমেদ। রানার অনেকখানি বোঝা হয়ে গেছে।

‘আপনিও বোধহয় এই হোটেলেই আছেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হ্যাঁ।’

‘ওই যে খোলা দেখা যাচ্ছে, এটা আপনার সুইট না? দোতলাতেই আছেন বোধহয়?’

‘জী, হাঁ।’ স্থির দৃষ্টিতে রানার দিকে চেয়ে বলল ওয়ালী আহমেদ।

‘অনেকগুলো দরজাই খোলা দেখা যাচ্ছে। ওগুলোর মধ্যে একটা আমার। আগামী তিন বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছি ওটা আমি।’

উঠে জিনাতের পিছনে দাঁড়াল রানা কিছুক্ষণ। দেখা গেল জিততে আরম্ভ করেছে জিনাত। মৃদু হেসে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল রানা ক্লাব থেকে। হোটেলের দিকে যেতে যেতে পাশ ফিরে একবার দেখল রানা ওদের। ইতিমধ্যে সাত হাজার টাকা হেরে গেছে জিনাত। ওয়ালী আহমেদ, হোটেলের দিকে মুখ করে বসতে চায়, নাকি জিনাতকে হোটেলের দিকে পিঠ দিয়ে বসাতে চায়? কারণটা কী?

ওয়ালী আহমেদের সুইট-এর দিকে চাইল রানা। কিছু নেই। বিকেলের পড়ন্ত রোদ ব্যালকনিতে। খোলা দরজা দিয়ে ঘরটা অন্ধকার দেখাচ্ছে।

ফিরে গেল রানা ‘বারে’। আবার চোখ পড়ল তার সেই তিনজন লোকের ওপর। কী চায় এরা? জোর করে দূর করে দিল মন থেকে এদের চিন্তা। একটা বড় পেগ আর সোডা অর্ডার দিয়ে আগের সেই চেয়ারটায় গিয়ে বসল ও আবার। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে জুয়াড়িদের। বুঝতে পেরেছে রানা ওয়ালী আহমেদের অবিচ্ছিন্ন জয়ের রহস্যটা। কিন্তু ওকে ধরিয়ে দেয়ার আগ্রহ বোধ করল না ও মোটেই। কী হবে একজন ক্ষমতাশালী লোককে অকারণে ঘাটিয়ে? ওয়ালী আহমেদ চুরি করলে ওর কী? শত্রু বাড়িয়ে লাভ আছে?

কিন্তু অদ্ভুত বুদ্ধিমান তো এই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বড়লোকটি! আশ্চর্য!