স্বর্ণমৃগ
এক
পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতির পর দুটো মাস এক স্বপ্নের ঘোরে কেটেছিল মাসুদ রানার। এক মাস ছুটি নিয়ে কক্সবাজারের এক কটেজে কাটিয়েছিল ভারতীয় স্পাই মিত্রা সেনের সাথে। সামনে অথৈ সমুদ্র। শো শো একটানা শব্দে লুটিয়ে পড়ছে ঢেউ তীরে এসে। মিত্রার বুকে উদ্দাম প্রেম। একান্ত করে পেয়েছিল ওরা দুজন দুজনকে। কখনও জোয়ার-ভাটা দেখেছে বসে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে—কখনও হাত ধরাধরি করে নেমে গেছে সাগরের জলে। ছেলেমানুষের মত ঝিনুক, শঙ্খ কুড়িয়েছে ছুটোছুটি করে। পূর্ণিমার রাতে দাঁড়িয়েছে গিয়ে সাগর তীরে। হু-হুঁ হাওয়া। আঁচল উড়ে গেছে মিত্রার। খোলা চুল উড়ে এসে পেঁচিয়ে ধরেছে রানার গলা। কানে কানে মিত্রা বলেছে— ‘রানা, তুমি আমার।’ কান পেতে শুনেছে রানা এই মধুসম্ভাষণ। ভেবেছে, আমি সুখী!
রাতে নিবিড় হয়ে কাছে এসেছে মিত্রা। আপন করেছে রানাকে। রানার শক্তিশালী বাহুর বন্ধনে আবেশে বিভোর শরীর এলিয়ে দিয়েছে, সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করেছে দয়িতের প্রেম। বলেছে, ‘রানা এমনি করে চিরকাল ভালবাসবে আমায়? কথা দাও, রানা। যদি কোনদিন তোমার প্রেম হারাই, সেদিন যেন…’
কথাটা শেষ করতে দেয়নি রানা। চুম্বনে হারিয়ে গেছে মিত্রার শঙ্কা।
জীবন এত মধুর তা কী রানা জানত আগে!
কিন্তু তারপর? ভেঙে গেল খেলাঘর।
হঠাৎ করে যদি ভাঙত, দুঃখ পেত রানা। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটল একটু একটু করে, প্রায় একমাস ধরে। ফাঁকটা প্রথমেই ধরা পড়েছিল রানার চোখে। মৃদু হাসি হেসেছিল ও। ও জানত এমনি একটা ব্যাপার, ঘটাই স্বাভাবিক। বিশ্লেষকের মন নিয়ে ও দেখল মিত্রার পরিবর্তন। বুঝল অমৃত আর গরল মিশেই জীবন। দেবতা আর অসুর মিলেই মানুষ। ভিতর ভিতর প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিল ও আগেই। আনুষ্ঠানিক বিয়ের ব্যাপারে মিত্রার এড়িয়ে যাওয়ায় আরও স্থির নিশ্চিত হলো। সাবধান হয়ে গেল ও সব দিক থেকে।
কিন্তু সত্যি সত্যিই একদিন হতবাক হয়ে গেল ও যখন মিত্রার বালিশের নীচে পেল এক ডজন কন্ট্রাসেপটিভ পিল।
‘এগুলো কী, মিত্রা?’
‘বুঝতেই তো পারছ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বটিকা। ইহা সেবনে…’
‘ঠাট্টা রাখো, মিত্রা। এসব তোমার কাছে কেন? আলীপুর চিড়িয়াখানায় তুমি আমাকে যা বলেছিলে সে-সব কি তা হলে মিথ্যা? আমি তোমার সাথে পরিষ্কার ভাবে কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই।’
‘এখন নয়। বলব। আজ রাতে সব বলব তোমাকে।’ মিত্রা চলে গিয়েছিল বাথরুমে।
রানা বুঝল আজই তার জীবনের একটা স্মরণীয় রাত্রি আসবে। আজ তার বন্ধন মুক্তির দিন। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ায় অবাক হয়ে আত্মবিশ্লেষণে মন দিল ও। তার দিক থেকে কোনও ত্রুটি ছিল কি না খতিয়ে দেখার চেষ্টা করল সে তার সঙ্গে। আধঘণ্টা পর চা খেয়ে চলে গেল অফিসে।
রাতে অপরূপ সাজে সেজে কাছে এল মিত্রা। সামনের ছোট লনে টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে বসেছিল রানা আরাম করে। সিগারেটের মাথায় আগুনটা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না অমাবস্যার অন্ধকারে। আকাশ ছেয়ে ছিল তারার ঝালর। রানা চেয়ে দেখছিল কালপুরুষের কোমরবন্ধ। চুলের মধ্যে প্রবেশ করল মিত্রার নরম আঙুল।
‘রানা।’
‘বলো।’
‘কথাটা বলতে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু…’
‘তবু বলতেই হচ্ছে। তাই না?’
‘হ্যাঁ। আমি আমার দেশে ফিরে যেতে চাই, রানা।’
‘সব দিক ভেবে দেখেছ?’
‘অনেক ভেবেই স্থির করেছি আমি।’
‘আর আমার সন্তান?
‘ওহ, ওটা কিছু নয়। আমার ভুল হয়েছিল। ওটা আসলে সাধারণ মেনসট্রেশনের গোলমাল। আমি মনে করেছিলাম বুঝি প্রেগনেন্ট হয়ে পড়েছি। কক্সবাজারেই টের পেলাম প্রথম। সেই ছয় দিন অসুস্থতার ভান করে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম তোমাকে। তখন থেকেই নিয়মিত ওই পিল খাচ্ছি।’
‘এবং তখন থেকেই নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ করছ কিছু লোকের সঙ্গে।’
চমকে উঠল মিত্রা কথাটা শুনে।
‘তুমি জানতে?’
হেসে উঠল রানা।
‘তোমার প্লেনের টিকেটের নাম্বার পর্যন্ত বলে দিতে পারি। গত পনেরো দিন ধরে তুমি কোথায় কী করেছ, প্রতিটি পদক্ষেপ আমার মুখস্থ। কিন্তু সেসব কথা থাক। এইসব অভিনয়ের পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা জানতে চাই আমি।’
‘প্রথমে একটা কথার জবাব দাও। তোমরা কি বাধা দেবে আমাকে?’
‘না। নির্বিঘ্নে যেতে পারবে।’
‘অবশ্য বাধা দিয়েও কোনও লাভ হত না। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতাম, তবু সাপে-নেউলে বন্ধুত্বের অভিনয় করতে পারতাম না কিছুতে। যাক। ব্যাপারটা খোলাখুলিই বলি তোমাকে। রাজশাহীতে আমাদের মধ্যে যা ঘটেছিল, তা ঘটেছিল নিতান্ত ঝোঁকের বসে। আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্যে কৃতজ্ঞতায় আমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম তোমার কাছে, এক দুর্বল মুহূর্তে। কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকে তোমাকে, সেই সাথে নিজেকেও ঘৃণা করতে আরম্ভ করেছি আমি। তোমাকে বলেছিলাম, সে-ই আমার জীবনে প্রথম স্থলন। আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল আমি সন্তানের মা হতে চলেছি। কিছু কিছু লক্ষণও আশ্চর্যভাবে মিলে গিয়ে আমার ধারণাটাকে বদ্ধমূল করেছিল। এই ভুলটা যদি না হত তা হলে আজ এত বড় পাপের বোঝা বইতে হত না আমাকে। মনে করো না তোমার জন্যে আমি সাহায্য করেছিলাম তোমাকে টিটাগড় ধ্বংস করতে। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে করেছিলাম সেটা। এই এক চিন্তা মাথার মধ্যে শিকড় গেড়ে বসায় আমি আমার সমাজ-দেশ-জাতি-ধর্মের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম। কিন্তু যখন জানলাম আমার ভুল হয়েছিল, যখন জানলাম একটা মিথ্যে ধারণা নিয়ে…’
‘তখন আগের সেই ঘৃণাটা ফিরে এল, এই তো? তুমি আমার কথা ভাবলে না একটিবারও?’
‘সব কথা তোমাকে বোঝাতে পারব না, রানা। মেয়েমানুষের মনের কথা তুমি বুঝবে না। এ আমার পূর্ব জন্মের পাপ। নইলে এমন বিষময় হবে কেন, আমার জীবন? তোমাকে ছেড়ে যেতেও জ্বলে পুড়ে মরছি, মনে হচ্ছে নীচ, স্বার্থপরের মত শুধু নিজের দিকটা দেখছি, তোমার ভালবাসায় যে বিন্দুমাত্র খাদ ছিল না সেটাও বুঝতে পারছি; আবার থাকলেও প্রতি পলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি আত্মধিক্কারে। এ এক আশ্চর্য নির্যাতন।’
‘কলকাতায় ফিরে গেলেই তোমার সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে?’
‘যা হবার হবে। মনস্থির করে ফেলেছি—যেতে আমাকে হবেই।’
শিউলীর ভারী জমাট সুগন্ধ আর মিত্রার দেহ থেকে মিষ্টি সেন্টের সুবাস এসে মুহূর্তটিকে জীবন্ত করে রাখল রানার মনে চিরকালের জন্য। কালপুরুষের কোমরে ঝোলানো তলোয়ারটা আর দেখা যাচ্ছে না। খুঁজে পেল না সেটা রানা।
চলে গেল মিত্রা সেন।
এত কথা রাহাত খানকে বলবে কী করে? অথচ প্রশ্নটা করেই স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন রানার মুখের দিকে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল রাহাত খান। ধনুকের টান দেয়া ছিলার মত রাহাত খানের লম্বা ঋজু দেহ। ক্ষুরধার দুই চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পুরু বেলজিয়ান কাঁচে ঢাকা মস্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে পিঠ-উঁচু রিভলভিং চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন তিনি।
‘মাস খানেক আগে চলে গেছে কলকাতায়।’ সংক্ষেপে জবাব দিল রানা।
‘সে খবর আমার জানা আছে। কিন্তু ওর পরিণতির খবর পেয়েছ?’
‘না তো!’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল রানা রাহাত খানের মুখের দিকে। ‘ধরা পড়েছে?’
‘হ্যাঁ। এবং খোলাখুলি সবকিছু স্বীকার করেছে সে কোর্টে দাঁড়িয়ে।’
‘অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড?’
এ-কথার জবাব দিলেন না রাহাত খান। হাভানার প্যাকেট থেকে একখানা সেলোফেন পেপার মোড়া চুরুট বের করলেন। সযত্নে কাগজ ছাড়িয়ে দাঁতে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করলেন তাতে। পাতলা সাদা একফালি ধোয়া চোখে যাওয়ায় চোখ দুটো পেঁচিয়ে উপর দিকে ঘুরিয়ে আঙুলের ফাঁকে নিলেন চুরুটটা।
‘আর একটা খেতাব ঝুলছে তোমার জন্যে, রানা। তিনটে হলো মোট।’
‘এবার কী ব্যাপারে, স্যর?’ খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘দ্বোয়ারকা।’
মুচকি হাসল রানা। দ্বারোকা নৌঘাটি ধ্বংসে তার যে ভূমিকা ছিল তা কোনওদিন পৌঁছবে না জনসাধারণের কানে। যতদিন না অবসর গ্রহণ করছে বা পটল তুলছে, ততদিন এইসব অতি সম্মানীয় খেতাবের কথাও জানতে পারবে না কেউ। প্রেসিডেন্ট গোপনে ওর বুকে এঁটে দেবেন মেডাল, পিঠ চাপড়ে দেবেন। মৃদু হাসি হেসে, দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করবেন। তারপর সব চাপা পড়ে যাবে কনফিডেনশিয়াল ফাইলের তলায়।
রাহাত খানের ইচ্ছে নয় রানাকে পপুলার হিরো তৈরি করে ওর মাথার উপর বিপদ ঘনিয়ে আনা। রানার ভালমন্দ সবকিছুর ব্যাপারে সদা-সতর্ক দৃষ্টি আছে তাঁর। এমন কী সিগারেটের ব্র্যাণ্ড, গাড়ির রঙ, হাতের ঘড়ি, পেন ইত্যাদি খুঁটিনাটি ব্যাপারও ওঁর নজর এড়ায় না—মাঝে মাঝেই বদলাবার আদেশ আসে উপর থেকে।
‘আর, দুই নম্বর কথা হলো, তোমার জন্যে একটা কঠিন কাজ তৈরি হচ্ছে। খুব সম্ভব হপ্তাখানেকের মধ্যেই তোমাকে করাচি যেতে হবে।’
‘করাচি?’
‘হ্যাঁ। গোল্ড স্মাগলিং।’
‘স্মাগলিং? কিন্তু এসব ব্যাপারে আমরা কেন? সি আই ডি-র কাজ না?’
‘সোনা আসছে মিডল-ঈস্ট থেকে। পুরো চ্যানেল ক্লোজ করতে হবে। কাজেই ব্যাপারটা কয়েক হাত ঘুরে আমাদের হাতে এসেছে। স্ম্যাশ করতে হবে এমন একজন লোকের নেটওয়ার্ক যে কর্তৃপক্ষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। একাজটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ঢাকা থেকে আমাদের একজনকে পাঠাতে হচ্ছে।’
‘লোকটাকে যদি চেনাই যায়, তা হলে…’
‘কেউ চেনে না তাকে। অদ্ভুত ধূর্ত এক কৌশলী এবং ক্ষমতাশালী লোক আছে এর পেছনে, যাকে কোনমতেই মুখোশ খুলে টেনে আনা যাচ্ছে না অন্ধকার থেকে আলোয়। এই ফাইলটা পড়লে সবটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পারবে।’
একটা মোটা ফাইলের মধ্যে লাল ট্যাগ আঁটা। তাতে ইংরেজিতে লেখা ‘টপ সিক্রেট’। ফাইলটা ধড়াস করে ফেললেন রাহাত খান, রানার সামনে টেবিলের উপর। প্রচুর ঘাটাঘাটির ফলে কাভারটা নরম হয়ে এসেছে। কিনারা ছিঁড়ে গেছে দু’এক জায়গায়।
‘এটা মন দিয়ে পড় গিয়ে। পরে ডাকব আবার আমি। আজ অনেক কাজ। কখন সময় পাব ঠিক বলতে পারছি না। যদি অফিস আওয়ার পার হয়ে যায় সিনক্রাফোনটা সাথে রেখো।’
‘আচ্ছা, স্যর।’
‘এখন আর কোনও কথা নেই। এসো তুমি।’
আস্তে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে নিজের কামরায় যাচ্ছিল রানা ফাইলটা তুলে নিয়ে। খোলা দরজা দিয়ে রানাকে দেখতে পেয়ে হৈ হৈ করে ডাকল চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল শেখ।
‘আরে এসো, এসো! অত ব্যস্ত হবার কী আছে?’ রানার হাতের ফালইটা দেখে বলল, ‘আমি জানতাম, তোমাকেই গছাবে এটা।’
‘বুড়োকে ভারী সিরিয়াস মনে হচ্ছে?’ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল রানা।
‘ভয়ানক। গত দশ দিন ধরে এ ছাড়া অন্য চিন্তা নেই মাথায়। অন্তত এক শ’ জন লোককে ডেকেছে নানান ডিপার্টমেন্ট থেকে। গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর কী করেছে আল্লা-মালুম। শেষে আজ আমাকে হুকুম করেছে তোমাকে তলব করবার জন্যে।’
‘সাধারণ একটা গোল্ড স্মাগলার…’
‘সাধারণ নয়!’ বাধা দিল কর্নেল শেখ। ‘সাধারণ ব্যাপার নিয়ে আমরা ডিল করি না। আমি যদ্দূর জানি, এবার যদি ভালোয় ভালোয় ফিরে আসতে পারো, জানবে মস্ত ফাড়া কাটল।’
কর্নেল শেখের বাড়িয়ে ধরা থ্রি কাসলসের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট তুলে নিল রানা। কারও অর্ডার ছাড়াই যখন দু কাপ কফি এসে হাজির হলো, তখন রানা বুঝল খামোকা গল্প করবার জন্যে তাকে ডাকেনি কর্নেল, ব্যাপারটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। মুখে কিছুই বলল না ও। কফিতে চুমুক দিয়ে চেয়ে থাকল শেখের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে।
‘সাধারণ হলে আর তোমাকে ঢাকা থেকে করাচি দৌড়াতে হত না। লোকটা এতই ক্ষমতাশালী যে আমাদের করাচির ব্রাঞ্চকে পর পর তিনজন অপারেটর হারাতে হয়েছে।’
‘খুন?’
‘তবে আর বলছি কি? দুই-এক কদম অগ্রসর হলেই খতম করে দিচ্ছে বিনা দ্বিধায়। তোমাকে পাঠাবার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে এই যে, তোমাকে চেনে না ওরা। বিচ লাগজারি হোটেলে ধনীর দুলাল সেজে উঠতে হবে তোমাকে। তাড়াহুড়ো করে কিছুই করা চলবে না। এমনকী বরাবরের মত একবারও রিপোর্ট করতে হবে না তোমাকে করাচি অফিসে। যেন কোনও ভাবেই টের না পায়, ওরা যে এই কাজে গিয়েছ তুমি।’
‘এত ঢাক ঢাক গুড় গুড় কেন? একটা লোক…’
‘চিনতে পারলে তো একটা লোক!’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল কর্নেল শেখ, ‘এখন সে একটা অদৃশ্য শক্তি। যে-কেউ যে মতলব নিয়েই লাগুক না কেন পিছনে, অদ্ভুত কোনও উপায়ে টের পেয়ে যাচ্ছে সে, আর বিনা দ্বিধায় নিষ্কণ্টক করে ফেলছে নিজের চলার পথ। এখানে বসে তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না। ওখানে গেলেই টের পাবে কতখানি শক্তিধর সে। রঙ্গমঞ্চে ওর ছায়াও দেখতে পাবে না–অথচ সে-ই হিরো।’
‘ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ কেন খামোকা? তোমাকেও দেখছি বুড়োর রোগে ধরেছে–কোনও কাজে পাঠানোর আগে চোদ্দবার বলবে, সাবধান! আমাকে কি কচি খোকা পেয়েছ যে জুজুর ভয় দেখাচ্ছ?’
‘বুঝতে পারছ না। অন্যান্যদের তুমি চিনবে না, রানা। কিন্তু একজনের নাম বললেই তুমি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারবে। তোমার সাথে দ্বোয়ারকা মিশনে ছিল সিন্ধি ছেলে…’
‘আলতাফ ব্রোহী!
‘হ্যাঁ। কেউ ছুরি দিয়ে ওর সারা শরীর কেটেছে মোরোব্বার মত। তিন দিন পর ফুলে ভেসে উঠেছে লাশ কেমাড়িতে। সাগরের ঢেউ এনে ফেলে গেছে মৃতদেহ তীরে। বীভৎস সে দৃশ্য। ছবি দেখতে পারো।’
একটা ছবি বের করে দিল কর্নেল শেখ ড্রয়ার থেকে। সত্যিই বীভৎস। চিনতে পারল রানা অনায়াসে— ওর গলার তাবিজ দেখে মনে পড়ল বিদ্যুৎগতি সেই সিন্ধি যুবকটির কথা। ছ’ফুট লম্বা, পেটা শরীর। একসাথে পাশাপাশি বুক ফুলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে ওরা বিপদের মুখোমুখি। রানা বুঝেছিল, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে তার সমকক্ষ যদি কেউ থেকে থাকে, সে এই আলতাফ। সেই বুদ্ধিমান করিৎকৰ্মা ছেলেটির এই দশা যে লোক করতে পারে সে নিশ্চয়ই অবহেলার পাত্র নয়। কঠিন হয়ে উঠল রানার মুখ, একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ ফুটে উঠল সে-মুখে স্পষ্ট। ধীরে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল ছবিটা।
‘আমি যাব করাচি।’
মৃদু হাসি কর্নেল শেখের ঠোঁটে। সিগারেটটা ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে।
‘এবার বুঝতে পারছ গুরুত্বটা?’
মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘শুধু এ নয়, আরও দুজন ছেলেকে হারিয়েছি আমরা। একজনকে খুন করা হয়েছে দিন-দুপুরে ম্যাকলিওড রোডের উপর। ছাতের ওপর থেকে কেউ মস্ত একটা পাথর ফেলে থেঁতলে মেরেছে ওকে ফুটপাথের ওপর। আর তৃতীয় জন…’
‘আচ্ছা, সেই অদৃশ্য লোকটি সম্পর্কে কোনও তথ্যই জানা যায়নি যাতে তাকে খুঁজে বের করার কাজে কিছুমাত্র সাহায্য হতে পারে?’
‘উঁহু। কিছু না। ভিট আয়ল্যাণ্ডের বাসিন্দা সাধারণ কোনও স্মাগলার সে নয়, এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়। অল্পদিন হলো নেমেছে সে এই লাইনে, এরই মধ্যে সবার মাথার ওপর উঠে গেছে। ছোটখাটো গোল্ড স্মাগলার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে এর চেলা হয়ে গেছে। হিউজ স্কেলে কারবার চলেছে এখন।’
‘আমাকে এগোতে হবে কোন সূত্র ধরে? ওদের দলে ঢোকার চেষ্টা করব?’
‘ওসব করে কোনও লাভ নেই। আপাতত কিছুদিন তুমি বিচ লাগজারি হোটেলে থাকবে নিষ্ক্রীয় ভাবে। আমরা যখন বুঝব যে তার চোখে পড়োনি তুমি, তখন এখান থেকে লাইন-অভ-অ্যাকশন জানিয়ে প্রসিড করতে বলা হবে। আর যদি দেখা যায় টের পেয়ে গেছে ওরা, তা হলে অ্যাবাউট টার্ন, কুইক মার্চ করবে। তখন অন্য পথে এগোব আমরা।’
কফি শেষ করে উঠে দাঁড়াল রানা।
‘থ্যাঙ্ক ইয়ু, শেখ।’
‘অলওয়েজ মেনশন।’
বেরিয়ে গেল রানা ঘর থেকে।
মোটা ফাইলটা বগলে চেপে ছ’তলায় নিজের কামরায় ঢুকেই অবাক হয়ে গেল রানা। সোহেল রানার চেয়ারে আরাম করে বসে জুতো সুদ্ধ দুই পা তুলে দিয়েছে ও টেবিলের উপর। ডান পা-টা প্রবল বেগে নাচাচ্ছিল; রানাকে দেখে নাচ বন্ধ করে সেটা দিয়ে একটা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল। গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে রাহাত খানের অনুকরণে বলল, ‘বোসো। তোমার জন্যে একটা অ্যাসাইনমেন্ট…’
হঠাৎ এতদিন পর সোহেলকে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে ছুটে গিয়ে ওর কান ধরল রানা। মুখে বলল, ‘এক লাৎ মেরে স্টেডিয়ামের মাঠে নামিয়ে দেব, শালা। উপর-অলার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি? দাঁড়াও, তোমার চাকরি খেয়ে দিচ্ছি আমি।’
সোহেলও কাঁক করে চিমটে ধরেছিল রানার পেটের চামড়া। বলল, ‘কান ছাড়, শালা উল্লুকে পাঠা। ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।’
‘তুই আগে পেট ছাড়!’
‘তুই আগে ধরেছিস। তুই আগে ছাড়বি। ছাড়লি?’
‘আগে পেট ছাড়।’
‘কান ছাড়।’
আরও কতক্ষণ চলত বলা যায় না। হঠাৎ দরজার সামনে রানার স্টোনো নাসরীন রেহানাকে ইউএনও-র মত অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দু’জনই লজ্জা পেয়ে গেল। বিনা বাক্যব্যয়ে যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করে বসে পড়ল। যেন তাসখন্দ বৈঠকে। রেহানার উপর হুকুম হলো দু’কাপ কফি সাপ্লাইয়ের।
‘তুই হঠাৎ কোত্থেকে, দোস্ত। ডাক-বাংলোর বেয়ারার কাজ ছেড়ে দিয়ে শুনলাম ক’দিন রেলে-ইস্টিমারে দাঁতের মাজন আর খুজলি-পাঁচড়ার মলম বিক্রি করছিলি। ছেড়ে দিলি নাকি সে বিজনেস?’
নিঃশব্দে হাসল সোহেল।
‘স্পেশাল মেসেজ দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে আমাকে হেডকোয়ার্টারে, তা জানিস? তোরা তো শালা এক একটা অকম্মার ধাড়ি, তাই আমাকে ছাড়া চলল না। এখন থেকে আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে তোদের, বুঝলি?’
‘এটা দেখেছিস?’ হাতের মোটা ফাইলটা টেবিলের উপর রাখল রানা।
‘সাঙ্ঘাতিক একটা অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছি। তুই তো সে তুলনায় নস্যি। তোকে বড়জোর ডেকে এনে একটা দোকানের সেলসম্যান বানিয়ে দিতে পারে। আর আমাকে পাঠাচ্ছে…’
‘করাচি।’
‘তুই জানলি কী করে?’
‘ওই তো মজা! যে ফাইল অত গর্ব করে দেখাচ্ছিস, জেনে রাখিস, শ্যালক প্রবর, ওতে তোর আগে আমার সই পড়েছে। এবং তোর আগে আমাকেই পাঠানো হচ্ছে সেখানে। বললাম না, আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করা ছাড়া তোদের আর গত্যন্তর নেই।’
‘কী আছে ফাইলে?’
‘ওই ফাইল পড়ে বিশেষ কিছু লাভ হবে না। ওতে যা আছে তা তিন লাইনে মুখেই বলে দিতে পারি আমি। তবু হুকুম যখন হয়েছে, পড়তেই হবে তোকে। কিন্তু দোস্ত, ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস। তোর ওই অপারেশন গুড উইলের চেয়েও। জেনে খুশি হবি, এই ‘স্বর্ণমৃগ’ অ্যাসাইনমেন্টটাও তোরই। আমাকে পাঠানো হচ্ছে তোর বস হিসেবে তোকে সাহায্য করবার জন্যে। আর খোদা চাহে তো যদি পটল তুলিস, সেজন্যে আমি থাকছি স্ট্যাণ্ড বাই।’
‘তুই রওনা হচ্ছিস কবে?’
‘কাল সকাল সাড়ে দশটার ফ্লাইটে।’
‘রাত্রিটা চল আমার ওখানে থাকবি আজ, গল্প করা যাবে।’
‘উঁহু। সেটা সম্ভব না। অফিসের বাইরে কারও সঙ্গে দেখা করা নিষেধ।’
‘তবে মরগে যা, শালা।’
‘তার আগে কফিটা খেয়ে নিলে হয় না?’
ধূমায়িত কফির কাপ নামিয়ে রাখল রেহানা টেবিলের উপর।
রেহানা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সেদিকে ইঙ্গিত করে সোহেল বলল, ‘সুখে আছ সখা আপন তালে। কেমন? এ-ক্লাস, না বি?’
‘জাহেদকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে। ওই শালা লেগেছে পিছনে। আমি ফুলের মত নিষ্পাপ।’
‘কসম?’
‘কসম।’
কফি খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। বেশির ভাগই পুরনো দিনের কথা। দুর্ঘটনায় একটা হাত খোয়া যাওয়ায় হেড অফিস থেকে সরিয়ে ব্রাঞ্চ ইনচার্জ করে দেয়া হয়েছে সোহেলকে। তাই সুযোগ পেলেই সে পুরনো দিনের গল্পে ফিরে গিয়ে স্মৃতি রোমন্থন-সুখ অনুভব করতে চায়। এককালের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সাথে সে-সব গল্প করে রানাও আনন্দ পায়। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রানার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল সোহেল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুই কাজ কর, আমি জাহেদকে খানিকটা ডিসটার্ব করে আসছি।’
ফাইলের মধ্যে ডুবে গেল রানা সোহেল বেরিয়ে যেতেই।
রাত্রি ঠিক পোনে আটটার সময় বেজে উঠল সিনক্রাফোন রানার পকেটে। রানা ছিল তখন গাড়িতে। এলিফ্যান্ট রোডের জামান ড্রাগ হাউজের সামনে থামাল ও লরেলগ্রীন মেটালিক কালারের নতুন টয়োটা করোনা সিডান। চেনা ডাক্তার। টেলিফোন তুলে নিল রানা কানে।
সিনক্রাফোন হচ্ছে ম্যাচ বাক্সের মত দেখতে প্লাস্টিকের ছোট একটা রেডিয়ো রিসিভার। এজেন্টদের বিশেষ কাজে দিনে রাতে যে কোনও সময় ডাকতে হতে পারে। সেজন্য নতুন এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন রাহাত খান অল্পদিন হলো। হেড অফিসের দশ মাইলের মধ্যে থাকলে এর সাহয্যে যে কোনও এজেন্টকে ডাকা যায়। পিপ্ পিপ্ করে শব্দ হয় এতে। এই শব্দ শোনা মাত্র যাকে ডাকা হচ্ছে তার কাজ হলো যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন। নিকটস্থ টেলিফোনে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
৮০০৮৩ ঘোরাতেই প্রথমে মিস্ নেলী, তারপর গোলাম সারওয়ার হয়ে রাহাত খানের কাছে পৌঁছল রানার উৎসুক কণ্ঠস্বর।
‘আমি বাসায় আছি। আজ রাতে আমার সাথে খাবে তুমি। আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে এসো। সোহেলকেও ডেকেছি।’
কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা নামিয়ে রেখে দিলেন রাহাত খান। রানা ভেবেছিল আজ আর ডাক পড়বে না। তাই অফিসের পর দু’একটা কাজ সেরে ক্লাবে স্কোয়াশ খেলতে যাচ্ছিল। এলিফ্যান্ট রোড থেকে সোজা বাড়ি ফিরে এল ও।
রাঙার মা-কে বলে দিল রাতে বাড়িতে খাবে না, ফিরতে দেরী হতে পারে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকল রাঙার মা। মিত্রার কথা ভুলতে পারে না ও। কী সুন্দর পুতুলের মত বৌ আসছিল ঘরে, কী হলো তাদের মদ্দি আল্লাই কতি পারে, থাকল না। ভেবেছিল তার হাতে সংসার তুলে দিয়ে দেশে ফিরে যাবে, কিন্তু তা আর হলো কই? এখন যদি রাতে বাড়িতে না খায়, দেরী করে ফিরতে চায়, তা হলে রানাকে দোষ দেয়া যায় না।
ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ঠিক লেকের পারে চমৎকার একখানা একতলা বাড়ি। সাদা উর্দি পরা বেয়ারা রানাকে নিয়ে বসাল ড্রইং-রুমে।
‘আমি এক্ষুণি সাহেবকে খবর দিচ্ছি। আপনি এক মিনিট বসুন, স্যর।’
প্রকাণ্ড একটা কালো হাউণ্ড ঢুকল ঘরে। রাহাত খানের শখের কুকুর। পিছন পিছন চেন হাতে ঢুকলেন মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খান। চেনা লোক, তাও একবার কটমট করে চাইল কুকুরটা রানার দিকে ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে। আপাদমস্তক সবুজ দৃষ্টি বুলাল সে। কোনও আগন্তুককেই পছন্দ করে না হাউণ্ডটাকার মনে কী আছে বলা যায় কিছু? মানুষ তো! কাজেই ওর চোখে স্পষ্ট শাসন-কোনও রকম চালাকির চেষ্টা কোরো না, বাছা, বিপদে পড়বে।
‘বোসো, রানা। সোহেল আসেনি? এখুনি এসে পড়বে। ডিনারও রেডি। খেতে খেতেই কাজের কথা সেরে নেয়া যাবে।’
‘আপনার দেহরক্ষীটাকে সামলান, স্যর। কেমন কটমট করে চাইছে আমার দিকে! মনে হচ্ছে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।’
একটু হেসে মাথায় দুটো থাবড়া দিয়ে আদর করলেন রাহাত খান ভয়াল কুকুরটাকে। তারপর বললেন, ‘যাও, অনেক দৌড়াদৌড়ি হয়েছে, তোমারও ডিনার রেডি। খাও গিয়ে।’ শিকলটা বেয়ারার হাতে দিয়ে রানাকে বললেন, ‘একটু ব্যায়াম করাচ্ছিলাম ওকে। যুদ্ধের পর থেকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে। বেচারার প্রতি অবিচার হয়ে যাচ্ছে। একেবারেই সঙ্গ পায় না আমার।’
হাফপ্যান্ট আর টাওয়েলের গেঞ্জি পরনে, পায়ে স্নিকার। এই বেশে আর ড্রইংরুমে বসলেন না রাহাত খান। রানাকে বসিয়ে কাপড় ছাড়তে গেলেন। টেবিলের উপর থেকে ডেভিড ওয়াইজ আর টমাস বি. রসের লেখা ‘দ্য ইনভিজিব্ল গভর্নমেন্ট’ তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকল রানা। পেপার-ব্যাক এডিশন। বইটার প্রতি পৃষ্ঠায় ‘সিআইএ’ শব্দটা পাওয়া গেল গড়ে দশটা করে। কয়েক পৃষ্ঠা পড়া হতেই দু’দিকের দুই দরজা দিয়ে একসঙ্গে ঘরে প্রবেশ করল সোহেল এবং রাহাত খান।
‘এই যে, সোহেলও এসে গেছ। চল একেবারে খাবার টেবিলে গিয়েই বসি।’
সুপ শেষ হতেই বাটিগুলো তুলে নিয়ে গেল বেয়ারা। মুখ খুললেন রাহাত খান।
‘স্মাগলিং যে এত সিরিয়াস একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে, ভাবিনি কোনদিন। ব্যাপারটা চিরকাল হয়ে এসেছে, বর্তমানেও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। আমাদের আসল সমস্যা এখন স্মাগলিং নয়—এর পিছনের প্রতিভাবান ব্যক্তিটিকে ধ্বংস করা। তোমরা দুজনেই তো ফাইলটা পড়েছ। কারও কোনও প্রশ্ন আছে?’
‘দেখলাম, শুধু গত বছরেই আনুমানিক দু-শ’ কোটি টাকার সোনা এসে পৌচেছে এখানে। এটা যখন অনুমান করা সম্ভব হয়েছে, কিভাবে কোন পথে এই চোরাচালান আসছে সেটা আন্দাজ করা যায়নি?’ রানা জিজ্ঞেস করল।
‘তা ছাড়া সিআইডি এটাকে সিরিয়াসলি টেক-আপ করছে না কেন?’ সোহেল যোগ করল। ‘কাউকে খুঁজে বের করবার কাজে ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ।’
একটা মুরগির রানে কামড় বসিয়েছিলেন রাহাত খান। ওটাকে বাগে আনবার আগেই রানাকে আরেকটা প্রশ্ন করতে উদ্যত দেখে হাত তুলে থামার ইঙ্গিত করলেন। এক এক করে প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।
‘না। অভিনব কোনও পদ্ধতিতে সোনা চালান হচ্ছে, এটুকু টের পাওয়া গেলেও পদ্ধতিটা জানা যায়নি। পথ হচ্ছে: জল স্থল বা আকাশ; অথবা তিনটেই। আর এর মূল উৎস হচ্ছে মিডলঈস্ট। সিআইডি-র জুরিসডিকশনের বাইরে। আমরা যখন এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে রাজি হলাম তখন সবটা দায়িত্ব আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে ওরা হাত গুটিয়ে নিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। আমাদের মত ওরাও কয়েকজন যোগ্য লোক হারিয়েছে। কাজেই বিপক্ষকে আণ্ডার এস্টিমেট করবার ধৃষ্টতা আমাদের থাকা উচিত নয়। তুমি ঠিকই ধরেছ, রানা। যদি ওদের সোনা পাচার করবার পদ্ধতি আমাদের জানা থাকত তা হলে ব্যাক ক্যালকুলেশন করে আজ হোক কাল হোক মূল উৎসে পৌঁছানো অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সোনা একটা অদ্ভুত জিনিস। এর কোনও.. নির্দিষ্ট আকার নেই। গলিয়ে ফেললেই এর গায়ের সব চিহ্ন মুছে ফেলা যায়, অথচ দাম কমে না এক পয়সাও। তারপর যে কোনও ছাঁচে ফেলে যে কোনও আকার দেয়া যায় সেটাকে। কাজেই ধরা খুব মুশকিল।’
এতক্ষণ কথা বলায় যেটুকু সময় নষ্ট হয়েছিল তা পূরণ করে নিলেন রাহাত খান কিছুক্ষণ চুপচাপ একমনে আহার করে। ওঁর বক্তব্য শেষ হয়নি তাই এই সুযোগে নতুন কোনও প্রশ্ন করল না কেউ।
‘এমনকী, ইচ্ছে করলে এক রকম খয়েরি রঙের পাউডারেও পরিণত করা যায় সোনাকে। হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রণের মধ্যে ফেললেই গলে তরল হয়ে যায় সোনা। তারপর সালফার ডাইঅক্সাইড বা অকজালিক অ্যাসিড দিলে খয়েরি পাউডার হয়ে যাবে সেটা। ইচ্ছে করলেই হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড উত্তাপ দিয়ে আবার সেটাকে সোনার টুকরো বানিয়ে নেয়া যায়। ক্লোরিন গ্যাসটা একটু খেয়াল রাখতে হয়, তা ছাড়া পন্থাটা খুবই সহজ। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কঠিন বা তরল, এমন কী পাউডার হয়েও আসতে পারে এ জিনিস জল, স্থল কিংবা আকাশ পথে। আমরা এখানে এই সবগুলোর দিকেই তীক্ষ্ণ নজর রাখছি, কোনও রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলে তোমাদের জানানো হবে।’
‘আমাদের দুজনকে আলাদা ভাবে পাঠাচ্ছেন কেন?’ রানা জিজ্ঞেস করল।
‘তোমাদের যে কোনও একজন বিপদে পড়লে অপরজন তড়িৎবেগে সাহায্য করতে পারবে, এই ভরসায়। দুজন সম্পূর্ণ আলাদা শ্রেণীর লোক সেজে যাচ্ছ। দুজনকে একসাথে সন্দেহ করতে পারবে না ওরা। যদি করে, তা হলে তোমাদের কপাল খারাপ বলতে হবে।’
খাওয়া হয়ে গেলে ড্রইংরুমে গিয়ে বসল তিনজন। বিস্তারিত আলোচনা হলো কেসটা নিয়ে। সোহেল যাচ্ছে হিংলাজ দর্শনপ্রার্থী বাঙালি সাধু হয়ে, আর রানা যাবে করাচিতে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু মালের হোল সেল মার্কেট তৈরি করতে। যখন নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হবে তখন কিভাবে কোন্ পথে এগোবে তা নিয়েও বিশদ আলাপ হলো।
সিগারেটের পিপাসা লেগেছে রানার অসম্ভব রকমের। বুকের ভিতরটা খালি হয়ে এসেছে ধোয়ার অভাবে। ওর অবস্থা অনুমান করে বেশিক্ষণ আর আটকে রাখলেন না ওকে রাহাত খান।
চারদিন পর সন্ধ্যার ফ্লাইটে রওনা হলো রানা করাচির উদ্দেশে।