স্বর্ণমৃগ
বার
গুংগা!
চমকে উঠল রানা। একটানে বের করল রিভলভার।
পঁচিশ গজ দূরে মেইন গেটটা খুলে গেছে। সেই গেট দিয়ে ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছে দানবসদৃশ গুংগা। রানা বুঝতে পারল রিভলভার দিয়ে ঠেকানো যাবে না ওকে। রাইফেলটা তুলে নিতে যাবে, এমন সময় বোঁ করে দশ ইঞ্চি ইটের সমান একটা পাথর এসে লাগল দেয়ালে খাড়া করে রাখা রাইফেলের বাটের ওপর। ছিটকে চলে গেল রাইফেলটা বারো চোদ্দ হাত দূরে।
আরেকটা পাথর আসছিল ছুটে। চট করে মাথা নিচু করল রানা। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল পিছনের বিষাক্ত মাছের অ্যাকুয়েরিয়াম। লাফিয়ে সরে গেল রানা বামদিকে। আবার গর্জন শোনা গেল। অনেকখানি এগিয়ে এসেছে গুংগা ততক্ষণে। কোমরের সাথে ঝোলানো একটা পাথরভর্তি বড় থলে। তার একমাত্র অমোঘ অস্ত্র। আজ সে বাগে পেয়েছে রানাকে।
গুলি করল রানা। অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে একপাশে সরে গেল গুংগা। দূরের একটা ট্যাঙ্কের মধ্যে ঠুস করে ঢুকল রানার গুলি। মেঝের ওপর পানি পড়ার শব্দ পাওয়া গেল।
দমে গেল। সম্পূর্ণ দমে গেল রানার মনটা। আশ্চর্য! মানুষ না পিশাচ? এতখানি ক্ষিপ্রতা একমাত্র পিশাচেই সম্ভব! কোন এক ইংরেজি বইয়ে পড়েছিল, আফ্রিকার জঙ্গলে অন্ধকার রাতে একটা ষাঁড় মেরে খেতে খেতে রাইফেলের শব্দ শুনেই লাফিয়ে সরে গিয়েছিল এক সিংহ। মনে করেছিল, হয় গাঁজা মারছে, নয় হাত কেঁপে গিয়েছিল শিকারীর। কিন্তু আজ নিজের চোখে সেই রকম ক্ষিপ্রতা দেখে ভয়ে এবং বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল ও। আবার গুলি করল রানা। এবারও সরে গেল গুংগা। শব্দ তো শুনতে পারছে না, রানার আঙুলের নড়া দেখেই টের পাচ্ছে সে। ছুটে একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে আবার একটা পাথর ছুড়ল সে রানার দিকে।
টুপ করে বসে পড়ল রানা টেবিলের তলায়। পাথর লাগল এসে অ্যাঞ্জেল ফিশের ট্যাঙ্কে। ঝুপ ঝুপ করে সব পানি পড়ল রানার মাথায়। কলারের মধ্যে দিয়ে শার্টের ভেতর ঢুকল একটা মাছ। ফড় ফড় করে লেজ ও পাখা দিয়ে অস্বস্তিকর বাড়ি মারছে সে রানার ঘাড়ে।
চোখটা মুছে নিয়ে টেবিলের তলা দিয়ে গুংগার পা লক্ষ্য করে গুলি করল রানা। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কয়েক পা এগিয়ে এসেছে গুংগা।
এমন সময় গর্জে উঠল আরেকটা রিভলভার। রানা চেয়ে দেখল কাটা কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সাঈদকে। একহাতে রিভলভার। অর্ধেকটা ঢুকে পড়েছে সে ঘরের মধ্যে।
উঠে দাঁড়িয়ে দেখল রানা গুংগার বাম বাহুতে একটা সরু রক্তের ধারা দেখা যাচ্ছে। ট্যাঙ্কের আড়ালে আড়ালে বেশ খানিকটা সরে গেল রানা। হাতে ব্যথা পেয়ে হুঙ্কার ছেড়ে পাথর তুলল গুংগা একটা।
এমন সময় ‘উহ্!’ করে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শুনেই ফিরে চাইল রানা। দেখল ঈল মাছের ট্যাঙ্কসহ হুড়মুড় করে পড়ল সাঈদ মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। হয়ত ট্যাঙ্কের মধ্যেই নেমে পড়েছিল।
এই এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতাটুকু কাজে লাগাল গুংগা। দড়াম করে একটা পাথর, এসে পড়ল রানার ডান কব্জির ওপর। ছিটকে কয়েক হাত দূরের একটা মুখ খোলা অ্যাকুয়েরিয়ামের মধ্যে গিয়ে পড়ল রিভলভার। জয়ের উল্লাসে আরেকটা হুঙ্কার ছাড়ল গুংগা।
অসহ্য যন্ত্রণায় একটা গোঙানি বেরিয়ে এল রানার মুখ দিয়ে। কব্জিটা ভেঙেই গেছে বোধহয়। বাম হাতে চেপে ধরল ও ডান হাতের কব্জি।
নিরস্ত্র ও। ছুটে এগিয়ে আসছে পিশাচটা। সাঈদের কাছাকাছি যেতে পারলেও হত। ওর রিভলভারটা কাজে লাগানো যেত। কিন্তু সে উপায় নেই। তাড়া খাওয়া মুরগির বাচ্চার মত মাছের জারের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে বেড়াতে থাকল ও। বোঁ করে কানের পাশ দিয়ে গিয়ে দেয়ালে লাগল একটা পাথর।
নিজের নিরুপায় অবস্থা ভালমত উপলব্ধি করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। কারণ গুংগা যদি ওকে ওয়ালী আহমেদের কাছে ধরে নিয়ে যাবার জন্যে এসে থাকে তা হলে আত্মসমর্পণ করলে এক্ষুণি হত্যা করবে না। কিন্তু এখন ওকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে ঠিক মেরে ফেলবে ও। হত্যার নেশা দেখতে পেয়েছে ও গুংগার চোখে।
বেরিয়ে এল রানা মাঝের প্রশস্ত পথটায়। এগিয়ে আসছিল গুংগা তুফানের মত। দুই হাত মাথার ওপর তুলে দাঁড়াল রানা।
থমকে দাঁড়িয়ে গেল গুংগাও। বিস্মিত ওর চোখ-মুখ। বহুদিন পর একজন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে আন্তরিক খুশি হয়েছিল সে। কিন্তু এত সহজে হাল ছেড়ে দিল? আক্রমণের আনন্দটা আর থাকল কোথায়? কিন্তু…সতর্ক হলো গুংগা। এই লোকটি তত সহজে কাবু হবার বান্দা নয়! নিশ্চয়ই কোনও কুমতলব আছে। সাবধানে এগোল সে সামনে। রানা মাথার ওপর হাত তুলে পিছিয়ে যাচ্ছে এক পা এক পা করে। পাঁচ হাত দূরেই গুংগা। গুংগার চোখ পড়ল পিছনে মাটিতে পড়ে থাকা সাঈদের ওপর। এতক্ষণ দেখতে পায়নি সে ওকে। রানাকে পিছিয়ে ওদিকে যেতে দেখে একটা হুঙ্কার ছেড়ে হাতের ইশারায় থামতে বলল সে। কোঁচড় থেকে পাথর বের করল একটা।
হঠাৎ রানার মনে পড়ল বুক পকেটের বলপয়েন্ট পেনসিলটার কথা। একটানে বের করেই টিপে দিল গুংগার মুখ লক্ষ্য করে। এ অস্ত্র আর কোনদিন প্রয়োগ করেনি ও। দেখল কনসেনট্রেটেড নাইট্রিক অ্যাসিড ছুটে গিয়ে চোখে মুখে পড়তেই টগবগ করে ফুটতে লাগল গুংগার মুখের মাংস। বড় বড় ফোস্কা ও ঘায়ে বীভৎস আকার ধারণ করল মুখের চেহারা তিন সেকেণ্ডে।
যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল গুংগা। ছিটকে পড়ে গেল পাথরটা হাত থেকে। ভয়ঙ্কর মুখটা দুইহাতে ঢাকল সে। একটা চোখ সম্পূর্ণ গলে গেছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে আরেকটা ভীত চোখ চেয়ে আছে রানার দিকে।
ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুটল রানা রাইফেলটার দিকে। কিন্তু দুই পা এগিয়েই হঠাৎ একটা লোহার হুকে পা বেঁধে পড়ে গেল মাটিতে। হুকটা সরে গেল একপাশে। প্রাণভয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা আবার।
কিন্তু কোথায় গুংগা? গুলি খাওয়া চিতাবাঘের মত লাফিয়ে উঠেছিল গুংগা ব্যাপার বুঝতে পেরে। কিন্তু তখন দেরী হয়ে গেছে। একটা আতঙ্কিত তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। অবাক হয়ে দেখল রানা চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল গুংগা ভোজবাজির মত।
কাছে গিয়ে দেখল একটা আট ফুট বাই আট ফুট চারকোণা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে মেঝেতে। নীচে অন্ধকার। পরমুহূর্তেই চোখে পড়ল গর্তের একটা কিনারায় গুংগার আঙুল দেখা যাচ্ছে। পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে কিনারাটা ধরে ফেলেছে সে। কিন্তু উঠতে পারছে না উপরে। কেউ সাহায্য না করলে পারবেও না।
এতক্ষণ পর দুই কোমরে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করল রানা। কপালের ঘাম মুছে নিল রুমালে। অর্ধেক অ্যাসিড খরচ হয়েছে, বাকি অর্ধেক আছে—পেনটা পকেটে পুরল আবার। তারপর পকেট থেকে টর্চ বের করে ধরল গুংগার মুখের ওপর। স্থির নিষ্পলক বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানার মুখের দিকে একটা চোখ।
কী আছে নীচে? গুংগার হাতের পাথরটা ফসকে পড়ে গিয়েছিল এক ধারে। পা দিয়ে ঠেলে এনে ফেলল রানা সেটাকে গর্তের মধ্যে। ‘টুম’ করে শব্দ হলো। তারপরই ছলাত করে ওপরে ছিটকে এল পানি।
নিশ্চয়ই পিরানহা! এরই মধ্যে ফেলে হত্যা করা হয়েছে মোহাম্মদ জানকে। আঙুলের মাথায় খানিকটা পানি নিয়ে জিভে ঠেকাতেই সন্দেহ রইল না আর। নোনতা! সাগরের সাথে যোগ আছে এই ট্যাঙ্কের মাটির তলা দিয়ে।
গুংগার আঙুলগুলো সাদা দেখাচ্ছে, নখগুলো রক্তশূন্য। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে সে মৃত্যু-গহ্বরের মুখে। আবার টর্চ ধরল রানা ওর মুখের ওপর। করুণ মিনতি ওর এক চোখে। একটা গোঙানি বেরিয়ে এল মুখ থেকে। থর থর করে কাঁপছে ওর হাতের পেশিগুলো।
রানার চোখের সামনে ভেসে উঠল মৃত মোহাম্মদ জানের মুখ। স্বপ্নের সেই দৃশ্যটা পরিষ্কার দেখতে পেল ও আবার। অনীতার মুখটাও ভেসে উঠল মনের পর্দায়। অনীতা, জিনাতের আর্তনাদ—গুংগার পৈশাচিক কামোন্মত্ত উল্লাস…
আগুন ধরে গেল মাথার মধ্যে।
ছোট্ট দুটো লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল ও আটটা আঙুল।
একটা প্রলম্বিত চিৎকার, হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল মাথাটা পানির তলায় চলে যেতেই। রানা মনে মনে ভাবল, এক নম্বর গেল। এবার ওয়ালী আহমেদ। ডান হাতটা টন টন করে উঠতেই চেয়ে দেখল গুংগার কব্জির মত ডবল-সাইজ দেখাচ্ছে সেটা। উত্তেজনার মাথায় ভুলেই গিয়েছিল ও ব্যথার কথা।
ততক্ষণে জ্ঞান ফিরে উঠে দাঁড়িয়েছে সাঈদ। রানা গিয়ে দাঁড়াল পাশে। দূরে কয়েকটা বুটের শব্দ শোনা গেল। রাইফেলটা তুলে নিল রানা মাটি থেকে। তারপর এগিয়ে গেল ওরা খোলা গেটের দিকে।
‘গুংগা কোথায়?
কালো গর্তটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লোহার বল্টুটা উল্টো দিকে ফেরাল রানা জুতো দিয়ে। খটাং করে বন্ধ হয়ে গেল গর্তমুখ। বুটের শব্দ কাছে এসে পড়েছে। দৌড় দিল রানা ও সাঈদ। দরজা দিয়ে মুখ বের করেই দেখতে পেল ওরা জনা আষ্টেক লোক পাশের দোতলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে এদিকে। প্রত্যেকের হাতেই রিভলভার। গুলি গালাচের শব্দ শুনতে পেয়েছে ওরা।
দরজার আড়াল থেকে একসাথে গর্জে উঠল রানার রাইফেল আর সাঈদের রিভলভার। দুজন আছড়ে পড়ল মাটিতে। থমকে দাঁড়াল বাকি সবাই। সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভড়কে গেল। রানার রাইফেলের বোল্ট টানার অবসরে আর একটা গুলি করল সাঈদ। একজনের পায়ে গিয়ে লাগল সাঈদের দ্বিতীয় গুলি। বসে পড়ল সে-ও। বাকি পাঁচজন ঘুরে দাঁড়িয়ে জোরে দৌড় দিল ছত্রভঙ্গ হয়ে।
এমন সময় তীক্ষ্ণ একটা নারী কণ্ঠের চিৎকারে চমকে উঠল রানা ও সাঈদ। বাঁ দিক থেকে আসছে। এই স্টোর রুমের পাশের কোনও একটা ঘর থেকে।
জিনাত!
ছুটে গেল রানা ও সাঈদ সেদিকে। কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা গেল একটা স্ত্রীলোকের চেহারা। কী একটা জিনিস ঘুরাচ্ছে সে দেয়ালের গায়ে। রাইফেলের বাটের প্রচণ্ড আঘাতে কড়াসুদ্ধ ছুটে এল দরজার তালা। ঘরে ঢুকতেই হা-হা-হা হা করে হেসে উঠল স্ত্রীলোকটি। এ কে? প্রথমে চিনতেই পারেনি রানা। এই চেহারা হয়েছে জিনাতের? উদভ্রান্ত দুই চোখ টকটকে লাল, চোখের কোণে কালি। পরনে পেটিকোট ছাড়া কিছুই নেই। চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে তাতে। সমস্ত দেহে ধারাল নখের চিহ্ন। মাথার চুল উসকোখুসকো।
ওদের দেখেই হা-হা করে হেসে উঠল জিনাত আবার। মট মট করে একগোছা চুল ছিঁড়ে শুন্যে ছুঁড়ে দিল। তারপর খেলা দেয়াল-আলমারির মধ্যে বসানো একটা চাকার হাতল ধরে ঘোরাতে থাকল। মাথা খারাপ হয়ে গেছে জিনাতের।
‘জিনাত!’ ডাকল রানা।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? একবার চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল জিনাত। চিনতেই পারল না রানাকে।
ছুটে গিয়ে সাঈদ ধরল জিনাতের হাত।
‘জিনা! জিনা ব্যাহেন!’
অবাক হয়ে সাঈদের দিকে চাইল জিনাত। চিনতে পারল ধীরে ধীরে।
‘সাঈদ ভাইয়া, উও কওন হ্যায়।‘ রানার দিকে ভীত চকিত দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল জিনাত। তারপর চিৎকার করে উঠল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে, ‘ভাগো, সাঈদ ভাইয়া।’
জিনাতকে সাঈদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ছুটল রানা ওয়ালী আহমেদের উদ্দেশ্যে। ওই বাড়িতে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে ওকে।
ফিশস্টোরের দরজার সামনে এসে পৌচেছে রানা, এমন সময় একটা সরু দড়ির ফাঁশ এসে পড়ল ওর গলায়। দুজন চেপে ধরল দুই হাত। হেঁচড়ে টেনে আবার নিয়ে এল ওকে স্টোরের ভিতর।