স্বর্ণমৃগ
নয়
এতে কিছুই প্রমাণ হয় না। ভাবছে রানা।
পুলথ্রু দিয়ে পিস্তলটা পরিষ্কার করছে ও। শুধু পাথর ফেলা ছাড়া ওয়ালী আহমেদের সঙ্গে স্বর্ণমৃগের কোনও যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। দুইজন একই ব্যক্তি কি না তা এই সামান্য সূত্র ধরে হলফ করে বলা যায় না। দেখা যাক, আজ মোহাম্মদ জানের সঙ্গে গিয়ে যদি নতুন কোনও তথ্য আবিষ্কার করা যায় তখন বোঝা যাবে। গুণে গুণে আটটা গুলি ভরে নিল রানা ম্যাগাজিনে। স্লাইড টেনে চেম্বারে একটা গুলি ভরল। ম্যাগাজিনটা ঢুকিয়ে দিল যথাস্থানে। ক্লিক করে ক্যাচের সাথে আটকে গেল সেটা। সেফটি ক্যাচ অফ অবস্থায় যন্ত্রটা শোল্ডার হোলস্টারে ঢুকিয়ে দিল। দ্রুত কয়েকবার পিস্তল বের করা প্র্যাকটিস করল। ঠিক জায়গা মতই বারবার হাত পড়ছে দেখে নিশ্চিন্ত মনে বাইরের ঘরে গিয়ে বসল।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতেই এসে পড়ল মোহাম্মদ জান। একা। ম্যানেজারের সঙ্গে দুই-একটা জরুরি কথা বলেই বেরিয়ে এল রানা হোটেলের বাইরে। মোহাম্মদ জানের ওপেল রেকর্ড দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিল।
‘সাঈদের কাছে শুনলাম পাথর পড়ার কথা। পাথরটাও দেখলাম। এ দেখছি রীতিমত জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘এখন আমরা চলেছি কোথায়?’
‘সাদারে। কয়েকটা আড্ডায় যাব আমরা। আগেই খবর দিয়েছি, লোক থাকবে আমার। আমার মালাকান্দের লোক—কারাচিতে এখন স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। কিছু না কিছু খবর বেরোবেই, দেখো তুমি।’
রানা চুপ করে ভাবছে অনীতা গিলবার্টের কথা।
‘ওহ-হো! আসল কথাই তো ভুলে গেছি। আবার বলল মোহাম্মদ জান।’
‘তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, রানা। পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছ জিনার? দেখেছ, একদিনেই কেমন অন্য মানুষ হয়ে গেছে? জীবনে যে কাজ করেনি, দেখে এলাম সেই কাজ করছে। গুনগুন গান গাইছে আর ঘর-দোর গোছাচ্ছে। কাল যে জন্মদিন! তোমাকে কী বলব মেজর, আমার খুশি আমি চেপে রাখতে পারছি না কিছুতেই। বাঁচালে তুমি আমাকে। মনে হচ্ছে আমার বুকের ওপর থেকে মস্ত ওজনের একটা পাথর কেউ সরিয়ে দিয়েছে। আজ সাত বছর এমন স্বস্তির নিঃশ্বাস আর ফেলিনি। মারী পাঠাবার বোধহয় আর দরকারই হবে না। রানাকে নড়েচড়ে উঠতে দেখে চট করে যোগ করল, ‘অবশ্য, তবু পাঠাতে হবে। ভাল ডাক্তার দিয়ে থরো চেকাপ করাতেই হবে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমার আর ভয় নেই একফোঁটাও! খোদার কাছে হাজার শোকর, কোথা থেকে তোমাকে এনে হাজির করেছেন ঠিক সময় মত।’
উচ্ছ্বসিত আনন্দে বক বক করতে থাকল স্নেহান্ধ পিতা। বড় বড় রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি চলেছে এখন অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা ধরে। একটা সাইনবোর্ডে পড়ল রানা, এলফিন্সটন স্ট্রিট, তারপর পড়ল ওরা ভিক্টোরিয়া রোডে।
মোড় ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়েই দাঁড়াল গাড়ি। রাস্তার ডানধারে ক্যাফে জর্জ। বেরিয়ে এল রানা ও মোহাম্মদ জান গাড়ি থেকে। মাটির নীচ দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার ব্যবস্থা। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার ভিড় কমে গেছে অনেক–তবু আণ্ডারগ্রাউণ্ড ক্রসিং দিয়ে ডান ধারে এসে দাঁড়াল ওরা ক্যাফে জর্জের সামনে। বাইরে থেকে দেখতে নোংরা অথচ ভিতরটা গমগম করছে লোকজনের কথাবার্তায়। বাইরেই একটা প্রকাণ্ড উনুনে সারি সারি শিক ঝলসানো হচ্ছে। সুগন্ধ এল নাকে। ঢুকে পড়ল ওরা কাঁচের দরজা ঠেলে। রানা লক্ষ্য করল এদিক-ওদিক থেকে কয়েকজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে সালাম করল মোহাম্মদ জানকে। সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেল মোহাম্মদ জান ঢোলা পাঞ্জাবী আর বিশ গজী পাজামায় খশখশ আওয়াজ তুলে।
কোণের টেবিলে একজন গুণ্ডা কিসিমের লোক বসে ছিল। ডান চোখের নীচ থেকে উপরের ঠোঁট পর্যন্ত একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। ঝাঁকড়া মাথার চুল। গলায় তাবিজ। মোহাম্মদ জানের সাথে চোখের ইঙ্গিতে কিছু ভাব আদান-প্রদান হলো—রানা সেটা খেয়াল না করার ভান করে সোজা ঢুকে গেল একটা কেবিনে মোহাম্মদ জানের পিছু পিছু। তিন শিক আর তিন চায়ের অর্ডার দিল সর্দার।
মিনিট কয়েক পরেই কেবিনের পেছনে একটা দরজা খুলে গেল। ঘরে প্রবেশ করল সেই গুণ্ডা। পরিষ্কার ডাকাতের চেহারা। মোহাম্মদ জানের পায়ে ধরে সালাম করল সে, তারপর বসল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে। মুখে ভয়ঙ্কর একটা নিঃশব্দ হাসি। কেবিনের পর্দাটা আগেই টেনে দিয়েছে মোহাম্মদ জান।
নিচু গলায় অনর্গল কথা বলল কিছুক্ষণ দুজনে পশতু ভাষায়। বারকয়েক মাথা ঝাঁকাল গুণ্ডাটা। রানার দিকে অবাক চোখে চাইল কয়েকবার। হঠাৎ রানার দিকে লক্ষ্য করতেই লজ্জিত হয়ে মোহাম্মদ জান বলল, ‘আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার এই বন্ধু একবিন্দুও বুঝতে পারছেন না আমাদের আলাপ। উর্দুতেই কথা বলা উচিত ছিল আমদের।’
কথার ভঙ্গিতে রানা বুঝল জেনে শুনেই পশতুতে কথা বলেছে মোহাম্মদ জান। তিন প্লেটে শিক কাবাব, সাথে তিনটে গরম নান-রুটি আর তিন পেয়ালা চা ঠক ঠক করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চলে গেল বেয়ারা। বাকি কথাবার্তা উর্দুতেই হলো।
‘তা তোমরা সোনা দাও কার কাছে?’ পোয়াটেক কাবাব মুখে ফেলে অবশিষ্ট ফাঁকটুকু দিয়ে জিজ্ঞেস করল মোহাম্মদ জান।
‘আমরা কারও কাছে দিই না, সার্দারজী। তারাই আমাদের খুঁজে বের করে নিয়ে যায় মাল। দেড় বছর আগে আমরা যাদের কাছে যেতাম তারা আর মার্কেটে নেই। তারাও এখন আমাদের মতন সাপ্লায়ার হয়ে গেছে। এখন, হঠাৎ কোথা থেকে এক একদিন একেকজন আসে, নগদ টাকা দিয়ে মাল নিয়ে যায়। যাবার সময় একটা সঙ্কেত বলে যায়–সেই সঙ্কেত দিলেই আমরা নতুন লোককে চিনতে পারি, নির্ভয়ে মাল দিই। আমাদের কাজ হলো শুধু মাল জমা করে রেডি রাখা। ব্যস। এর বেশি জানতে গেলেই সাফ করে দেয়। পর পর চার পাঁচজন খুন হয়ে যাবার পর আমরা আর সে চেষ্টা করি না।’
‘কিন্তু বছর দেড়েক ধরে যে নতুন লোকটা কারবার করছে, একটা লোকও তাকে চাক্ষুষ দেখেনি, এ কেমন কথা? তোমাদের কেউ কখনও দেখোনি ওদের লোক যায় কোথায়? পিছু নাওনি কখনও?’
‘বললাম তো। আপনি সর্দার। আপনার সাথে ঝুট বললে খোদার কাছে ঠেকা থাকব। চার পাঁচজন চেষ্টা করেছিল। ওদের লাশ পাওয়া গেছে।’
‘ওরা চেষ্টা করতে গিয়েছিল কেন?’ রানা জিজ্ঞেস করল।
‘কৌতূহল।’
‘তা হলে দেখা যাচ্ছে, আসল লোকটা খুবই সাবধানে নিজেকে গোপন রাখতে চায়?’
‘খুব।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ আহার করল তিনজন। প্লেট খতম করে তস্তরির ওপর আধ কাপ চা ঢেলে নিয়ে ফড়ফড় করে টানছে ডাকাতটা। নীরবতা ভঙ্গ করল মোহাম্মদ জান।
‘আল্লারাখার কাছে কোনও খবর পাওয়া যাবে? করাচিতে আছে না এখন?’
‘জী, সর্দার। তবে ওর কাছ থেকেও কোনও খবর পাবেন বলে মনে হয়। এ এক সাঙ্ঘাতিক দল।’
‘তুমি পর্যন্ত এ ধরনের কথা বলছ, দিল্লির? তুমি না মালাকান্দের ছেলে? এখানে এসে বিড়ালের বাচ্চা বনে গেলে?’
চুপ করে বকা হজম করে নিল দিল্লির খান।
‘তা হলে দেখছি অন্যের কাছে যাওয়া বেকার। আমাকেই নামতে হবে ময়দানে। খবরটা আমার চাই-ই।’
‘আমরা থাকতে আপনি কেন ময়দানে নামবেন, সর্দারজি? আমরা খতম হয়ে গেলে তারপর নামবেন আপনি। তার আগে নয়। আপনি শুধু হুকুম করুন, সর্দার।’
‘দিন কয়েক অপেক্ষা করলে আসবে না ওদের লোক?’
‘আসবার সময় হয়ে গেছে, সর্দার। আজও আসতে পারে, কালও। কিন্তু আমি জানি, ওদের সাথে বেঈমানী করলে আর রক্ষা নেই। কবর থেকে খুঁড়ে তুলে মারবে। আপনি হুকুম করলে মৃত্যকে পরোয়া করব না, সর্দার।’
‘আমি হুকুম করছি। তোমার যাতে কোনও বিপদ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখব আমরা।’
হাসল দিল্লির ওর ভয়ঙ্কর নিঃশব্দ হাসি।
‘আপনার হুকুম আমার শিরোধার্য, সর্দারজি। আমি মালাকান্দের কুসন্তান। কিন্তু যত দূরেরই হোক, আপনার রক্ত আমার শরীরেও আছে।’ পা ছুঁয়ে কপালে ঠেকাল দিল্লির। তবে আমার বিপদের দিকে লক্ষ্য রাখার কোনও দরকার নেই—কোনও লাভ হবে না তাতে। আপনি আমার পরিবারের ভার গ্রহণ করলে নিশ্চিন্তে জান দিতে পারব আমি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে সর্দার, সেই লোক আপনাকেও ছাড়বে না।’
রানা ভাবল, কী আশ্চর্য ক্ষমতা এই ট্রাইবাল চিফদের। সাধারণ লোকের কাছে ঈশ্বরের নীচেই এদের স্থান। লোকটা স্থির নিশ্চিত যে কেউ ওর মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না—বেঈমানী করলে খুন হতেই হবে। তবু সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল!
‘আচ্ছা, এই গ্যাঙের শেষ মাথায় কী ধরনের লোক আছে বলে তোমার ধারণা?’ রানা জিজ্ঞেস করল।
‘ভদ্রলোক।’ ডান ভুরুটা উপরে উঠিয়ে রানার দিকে চাইল দিল্লির খান। ‘কানাঘুষোয় শুনেছি দারুণ এক বুদ্ধিমান লোক এসেছে এখন এই ব্যবসায়ে। পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে নাকি সারা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রিমিনালদের নিয়ে মস্ত শক্তিশালী একটা দল তৈরি করতে চায়। তাই লোক বাছাই করছে। পাঁচ হাজার থেকে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত মায়না দেবে মাসে মাসে, যোগ্যতা অনুযায়ী। সবই শোনা কথা। টুকরো টুকরো এর-ওর কাছ থেকে শোনা। আমাদের মধ্যে প্রবল একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এই নতুন লোককে ঘিরে।’
‘আচ্ছা, দিল্লির খান, দু’মিনিট ভেবে উত্তর দাও। তোমাদের মধ্যে কেউ কি ওদের আড্ডার কোনও উড়ো খবরও রাখে না? খালি একটা ঠিকানা পেলেই তোমাকে আর বিপদের মধ্যে টানব না আমরা। তোমার বালবাচ্চাকে এতিম করবার ইচ্ছে নেই আমাদের। শুধু একটা ঠিকানা।’
চট করে রানার মুখের দিকে চাইল একবার দিল্লির খান। কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে ভাবল। তারপর ধীরে ধীরে চিন্তান্বিত ভাবটা দূর হয়ে গেল মুখের উপর থেকে। মনের গভীরে হাতড়ে পেয়েছে সে এক টুকরো বাঁচবার অবলম্বন। উদগ্রীব হয়ে রইল রানা।
‘সেখানে গেলে কোনও লাভ হবে কি না বলতে পারি না। হয়ত সেখানে গিয়েছিল লোকটা অন্য কাজে। কিন্তু আমি একটা দোকানে ঢুকতে দেখেছি একজনকে। চোখের ভুলও হতে পারে। তবে আমার যতদূর বিশ্বাস এই লোকটাই দশ মাস আগে আমার কাছ থেকে সোনা নিয়েছিল পাঁচ শ’ আউন্স।’
‘কিসের দোকান?’ টেবিলের উপর দুইবাহু রেখে সামনে ঝুঁকে এল রানা।
‘মাছের!’ ফিসফিস করে বলল দিল্লির খান।
মাছের বাজার মনে করে হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠল রানার মুখে। তাই আবার বলল দিলির খান, ‘ওই মাছ না। ছোট ছোট রঙীন সব মাছ। কাঁচের বাক্সে রাখা। জ্যান্ত। যেদিন দেখলাম লোকটাকে ওই দোকানে ঢুকতে সেদিন থেকে ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটি না আমি।’
কাগজ বের করে ঠিকানাটা লিখে নিল রানা। কাছেই, ভিক্টোরিয়া রোডের উপরেই দোকানটা।
‘যদি এ ঠিকানায় কিছু পাওয়া না যায় তা হলে হয়ত তোমার সাহায্য আমাদের নিতেই হবে, দিল্লির খান,’ বলল রানা।
‘বেশক্। কিন্তু সাবধান! দুশমন বড় হুশিয়ার।’
চোখ পাকিয়ে কথাটা বলে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল দিল্লির খান। গেলাস ঠুকে বেয়ারাকে ডাকা হলো। বিল চুকিয়ে বেয়ারাকে মোটা বখশিশ দিয়ে আবার গাড়িতে চাপল ওরা। ড্রাইভারকে ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিল মোহাম্মদ জান। মাথা নেড়ে, ‘জী, সর্দার,’ বলেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটল ড্রাইভার নির্জন হয়ে আসা রাস্তা ধরে।
অনেক দোকান সারি সারি। বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কোনটা সামান্য একটু খোলা-ভেতরে হিসাব-কিতাব হচ্ছে সারাদিনের বিকিকিনির। গাড়ি এসে থামল ফুটপাথের ধারে। নীল নিয়নে সুন্দর করে ইংরেজিতে লেখা: ফিশ এমপোরিয়াম। নামটা চেনা চেনা লাগল। কোথায় দেখেছে?…মনে পড়ল রানার, এই নামটা দেখেছে চট্টগ্রামের ‘বিপণী বিতানে’। এদেরই ব্রাঞ্চ নাকি? নাকি এটাই ওদের ব্রাঞ্চ?
বাইরে থেকে দেখা গেল কাঁচের শো-রুমে সুন্দর করে সাজানো আছে কয়েকটা অ্যাকুয়েরিয়াম। কয়েকটা শেলফে সাজানো বিচিত্র বর্ণ ও আকারের ঝিনুক ও শঙ্খ। পেছনে কালো পর্দা টাঙানো আছে বলে দোকানের ভিতরের চেহারাটা বাইরে থেকে বোঝা গেল না। একদিকের শাটার টেনে নামানো হয়েছে। আরেকটাও নামানোর উদ্যোগ হচ্ছে। বন্ধ করছে দোকান।
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রানা একবার ভাবল আজ ফিরে যাবে কি না। কাল এলেই বোধহয় ভাল হয়। কিন্তু খরিদ্দার দেখেই উৎসাহিত কণ্ঠে ভিতর থেকে ডাক দিল একজন। ঢুকে পড়ল ওরা দোকানের ভিতর।
চারপাশে কেবল মাছ আর মাছ। মাঝের সরু একটা প্যাসেজ দিয়ে কিছুদূর গেলে অফিস ঘর। দোকানে পা দিতেই সজাগ হয়ে উঠল রানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, সাবধান! সামনে বিপদ! অদ্ভুত এক ক্ষমতার বলে কী করে জানি আগে থেকেই টের পায় ও বিপদ। এবার বড় দেরী হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে পড়েছিল রানা, কিন্তু মোহাম্মদ জান সোজা ঢুকে গেছে ভিতরে, তাই ও-ও চলল পিছন পিছন। বাম বাহু দিয়ে চেপে একবার অনুভব করল স্প্রিং লোডেড শোল্ডার হোলস্টারটা। দ্রুত পা ফেলল ও মোহাম্মদ জানের কাছাকাছি থাকার জন্যে।
হরেক সাইজের অ্যাকুয়েরিয়াম। ছোট, বড়, মাঝারি। তার মধ্যে সুন্দর সুন্দর, রঙীন সব মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকটি জারের ওপর লালচে আলোর ব্যবস্থা আছে। তাতে লাল মাছ আরও লাল দেখায়। নানান রকম গাছ, শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ লাগানো আছে কাঁকর ও বালিতে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুদ্বুদ উঠছে সুন্দর সব স্টোন থেকে। সুন্দর সুন্দর ঝিনুক, শঙ্খ রুচিসম্মতভাবে ছড়ানো বালির উপর।
‘আসুন স্যর, আসুন। এক্ষুণি সেল ক্লোজ করতে যাচ্ছিলাম। কী মাছ লাগবে আপনার? বার্থডে প্রেজেন্টেশান?’
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল রানা। ভাবল, হঠাৎ জন্মদিনের কথা মনে হলো কেন ব্যাটার? বড়লোকেরা বোধহয় বার্থ ডে-তে এসব উপহার দেয়। নইলে চলবে কী করে এসব দোকান? লোকটার মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি রাখল রানা। গোলগাল মুখটা, হাসি খুশি। যেন দুঃখ কাকে বলে জানে না। অমায়িক হাসি লেগে আছে সব সময় ঠোঁটের কোণে।
‘তা হলে, স্যর, অ্যাঞ্জেল ফিশ নিন। চমৎকার একজোড়া ব্ল্যাক অ্যাঞ্জেল আছে। মাদাগাস্কার থেকে ধরা। মাত্র পাঁচশো টাকা। দেখবেন? আসুন আমার সঙ্গে।’
এ পিছন ফিরে লোকটা হাঁটতে আরম্ভ করবে এমন সময় রানা বলে বসল, ‘আমরা চাইছি গোল্ড ফিশ। ভাল কোনও ভ্যারাইটি আছে?’ ভেতরের দিকে যেতে চাইছে না রানা।
‘কী যে বলেন, স্যর। নেই? কত রকম ভ্যারাইটি চান? চোখ ধাঁধিয়ে যাবে আপনার। আসুন আমার সঙ্গে।…’ এবার আর কোনও কথাতেই কান না দিয়ে পিছন ফিরে হাঁটতে থাকল লোকটা।
কয়েক পা এগিয়েই মোহাম্মদ জানেরও বোধহয় রানার সেই অনুভূতিটা হলো। থেমে পড়েই পেছন ফিরল সে। রানার পেছনে তিনজন যণ্ডামার্কা লোক দেখতে পেল সে। ঘড় ঘড় করে নেমে গেল শাটারটা। ফ্যাকাসে হয়ে গেল মোহাম্মদ জানের মুখ। বুঝল, হঠাৎ বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়েছে। বেরোবার উপায় নেই। রানা চোখ টিপল একবার। মৃদু হাসির চেষ্টা করল মোহাম্মদ জান, কিন্তু সেটা মুখ বিকৃতির মত লাগল দেখতে। বোঝা গেল দমে গেছে সর্দার। দিল্লির খানের কথা মনে পড়ল। বেশি জানতে চাইলেই সাফ করে দেয়… কয়েকজন চেষ্টা করেছিল। ওদের লাশ পাওয়া গেছে।
একটা বড় অ্যাকুয়েরিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। পানির মধ্যে বালি আর পাথরের কুচির উপর একটা পাত্রের মধ্যে সহস্র বাহু ওপরে তুলে কিলবিল করছে একদলা টিউবিফেক্স ওঅর্ম। ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে ওগুলোকে গোটা কয়েক গোল্ড ফিশ। রানার সাথে মোহাম্মদ জানের চোখে চোখে কিছু ইঙ্গিত বিনিময় হয়ে গেল। মাছগুলো সম্পর্কে বক্তৃতা আরম্ভ করতে যাচ্ছিল ‘ম্যানেজার, হঠাৎ ধাই করে এক লাথি লাগাল মোহাম্মদ জান ম্যানেজারের কাঁকালে। ছিঁটকে গিয়ে পড়ল লোকটা অ্যাকুয়েরিয়ামের উপর। কনুইয়ের ধাক্কা লেগে ভেঙে গেল কাঁচ। হাতটাও কেটে গেল খানিকটা। ঝর ঝর করে পানি পড়ে ভেসে গেল মেঝে। ছোট ছোট রঙিন মাছগুলো তড়াক তড়াক করে লাফাতে থাকল মোজাইক করা মেঝের উপর। এবার একটা প্রচণ্ড ঘুসি খেয়ে সটান শুয়ে পড়ল ম্যানেজার মাটিতে। মাটিতে পড়ে মাছগুলোর মতই লাফাতে থাকল লাথি থেকে বাঁচবার জন্য।
রানাও একই সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে পিছনের লোকগুলোর ওপর। দড়াম করে নাকের ওপর রানার একটা অতর্কিত ঘুসি খেয়ে ছিটকে সাত হাত দূরে গিয়ে পড়ল প্রথম জন। দ্বিতীয় জনের উদ্দেশ্যে চালাল লাথি। তৃতীয় জন একটু দূরে ছিল—হঠাৎ সে পুকুরে ডাইভ দেয়ার মত সোজা ঝাঁপ দিল রানার পেট লক্ষ্য করে। মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত প্রচণ্ড জোরে এসে পড়ল রানার পেটের ওপর। ধাক্কা সামলাতে না পেরে কয়েক পা পিছিয়ে গেল রানা। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে ওর মুখ। পিস্তলটা বের করল ও তারই মধ্যে। কিন্তু ঠিক সেই সময় পায়ের তলায় পড়ল একটা গোল্ড ফিশ। সড়াৎ করে পা পিছলে গেল রানার। সাথে সাথেই প্রচণ্ড একটা ঘুসি লাগল ওর বাঁ কানের উপর। পড়ে গেল রানা। হাঁটুতে লাগল খুব, এবং চোখটা আঁধার হয়ে গেল শক্ত মেঝেতে নাক ঠুকে যাওয়ায়। পিস্তলটা হাত থেকে খসে চলে গেল একটা অ্যাকুয়েরিয়াম বসানো টেবিলের নীচে। নাক থেকে রক্ত বেরিয়ে ভেজা মেঝে লাল হয়ে গেল বেশ খানিকটা জায়গা। চোখ দুটো আঁধার হয়ে গেছে। বো বো করে ঘুরছে মাথা। তবুও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল ও।
ততক্ষণে আরও কয়েকজন লোক এসে হাজির হয়েছে। মোহাম্মদ জানকে কাবু করে ফেলে হাত দুটো বাঁধা হয়েছে পেছনে। বাঘের বাচ্চার মত গজরাচ্ছে। আর ছটফট করছে মোহাম্মদ জান বাঁধন খুলবার ব্যর্থ চেষ্টায়। রানাকেও বেঁধে ফেলা হলো।
কয়েকবার মিটমিট করে চোখের পাতা থেকে পানি সরিয়ে চারদিকে চাইল রানা। বুকের কাছে শার্টের ওপর রক্ত পড়ছে এখনও নাক থেকে টপ টপ। তিন দিক থেকে তিনটে রিভলভার ধরা ওর দিকে। ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে একটু বাঁকা হয়ে। এক হাতে ঘষছে লাথি খাওয়া জায়গাটা।
‘আগে বাঢ়ো।’
হুকুম করল একজন পিছন থেকে। এগোল ওরা পিছনের ধাক্কায়। কিছুদূর গিয়েই ছোট একটা কামরায় ঢুকল ওদের নিয়ে সব ক’জন। ঘরটা আট ফুট বাই আট ফুট হবে। সাতও হতে পারে। স্টোর রুম মনে হলো। দেয়ালের গায়ে বসানো কয়েকটা বড় সাইজের কাঁচের আলমারি—ভেতরে নানান আকারের, বিচিত্র কারুকার্য খচিত সামুদ্রিক ঝিনুক আর শঙ্খ। চার কোণে চারটে অ্যাকুয়েরিয়াম—গায়ে ইংরেজিতে লেখা সাবধান! বিষাক্ত মাছ। একটা জারে বিষাক্ত স্করপিয়ন ও লায়ন ফিশ দেখে চিনতে পারল রানা। ফ্লুরেসেন্ট টিউব জ্বলছে ঘরের মধ্যে।
একটা বিষাক্ত মাছের অ্যাকুয়েরিয়ামের আড়ালে গোপন করা সুইচ টিপল একজন। নামতে আরম্ভ করল ওরা নীচে। রানা বুঝল এটা একটা লিফট। মাটির তলায় নিশ্চয়ই আরও ব্যাপার-স্যাপার আছে। স্টোর রুম দেখে কেউ ভাবতেও পারবে না যে এটাই মাটির তলায় গোপন আড্ডায় যাওয়ার পথ।
নীচে এসে থামল লিফট। বেরিয়ে এল ওরা বাইরে। চারফুট চওড়া রাস্তা। ডান দিকে অল্পদূর গিয়ে আটফুটি রাস্তায় পড়ল ওরা। কিছুদূর পরপর শেড বিহীন বালব ঝুলছে সিলিং থেকে। মাটির নিচে গোলক ধাঁধার পাতালপুরী তৈরি করেছে স্বর্ণমৃগ। গলির দু’পাশে সারি সারি ঘর। এ-গলি-ও গলি পার হয়ে বেশ, কিছুদূর যাওয়ার পর থামল ওরা একটা মোড়ের ওপর। এতক্ষণে মুখ খুলল একজন।
‘এবার দু’জন দু’দিকে। শেষ বিদায় নিয়ে নিতে পারো।’
মোহাম্মদ জানের দিকে চেয়ে হাসল রানা। দাঁতে রক্ত। বলল, ‘ভ্যাগ্যিস পুলিশে খবর দিয়ে ঢুকেছিলাম এখানে!’
‘হ্যাঁ, দশ মিনিটেই হাতকড়া পড়বে ব্যাটাদের হাতে। এতক্ষণে চারদিক ঘিরে ফেলেছে নিশ্চয়ই। আচ্ছা, দেখা হবে। কথাটা শেষ করেই একটা ধাক্কা খেয়ে বাঁয়ে এগোল মোহাম্মদ জান। চারজন গেল সঙ্গে।
এই মিথ্যে কথায় বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য দেখা গেল না ওদের মধ্যে।
একজন হুকুম করল, ‘নাত্থু, তুমি জনা দুই লোক নিয়ে পেছনের পথ দিয়ে বেরোও। রাস্তায় দাঁড়ানো ড্রাইভারকে ধরে প্রথমে আচ্ছামত দুরমুজ করবে, তারপর নিয়ে আসবে ভেতরে। গাড়িটা একজন নিয়ে গিয়ে নুমায়েশ বা গুরুমান্দারের কাছে রেখে আসবে। কিংবা হোটেল মেট্রোপোলের সামনে পার্ক করে রেখে আসতে পারো।’
‘আর তুমি এদিকে,’ ধাক্কা দিল পেছনের লোকটা রানাকে।
আবার কয়েকটা গলি পেরিয়ে একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপল একজন। ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজা। দরজার ফাঁক জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে গুংগা।
চমকে উঠল রানা। বীভৎস চেহারা। শুধু ল্যাংগোঠ ছাড়া কিছুই নেই সারা দেহে। রানাকে দেখেই ছোট ছোট চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল গুংগার। ঘড়ঘড় করে একটা শব্দ বেরোল ওর মুখ দিয়ে। থাবা দিয়ে ধরল সে রানার চুল একহাতে। রানার উরুর সমান মোটা পেশিবহুল সে হাত। অন্য হাতের ইশারায় লোকগুলোকে বিদায় দিয়ে চুলের মুঠি ধরে প্রায় ঝোলাতে ঝোলাতে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল পাশের ঘরে।
সাজানো গোছানো একটা প্রশস্ত ড্রইং-রুম। সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল একজন লোক, পায়ের শব্দে কাগজটা নামাল মুখের সামনে থেকে।
ওয়ালী আহমেদ।
‘আসুন। আসুন, মিস্টার মাসুদ রানা। বসুন ওই সোফায়।’
রানাকে বসতে হলো না। বসিয়ে দিল গুংগা চুলের মুঠি ধরে তার আগেই। পেছন দিকে জোরে একটা লাথি চালাল রানা। হাঁটুর নীচে হাড়ের ওপর গিয়ে লাগল স্টিলের পাত বসানো জুতোর গোড়ালি। আর কেউ হলে বাবাগো, মাগো বলে বসে পড়ত মাটিতে। কিন্তু আশ্চর্য, একবিন্দু বিচলিত হলো না গুংগা।
‘বৃথা চেষ্টা, মিস্টার মাসুদ রানা। ওর শরীর হচ্ছে পেটা লোহা। ও-সবে ওর কিছুই হবে না,’ বলল ওয়ালী আহমেদ।
প্রতিদিন সকালে দুজন জোয়ান প্যাহেলওয়ান মুগুর পেটা করে ওর সর্বাঙ্গ মাটিতে শুইয়ে নিয়ে। সে দৃশ্য দেখলে এই সামান্য প্রয়াসে লজ্জা হত আপনার। গত বিশ বছর ধরে এই রুটিন চলে আসছে। এখন এসব সামান্য আঘাত তো দূরে থাক, তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা বা পিস্তলের গুলিও ওর শরীরে প্রবেশ করানো শক্ত।
কথাটা শেষ করেই মুখ দিয়ে একটুও শব্দ বের না করে কেবল ঠোঁট নাড়াল ওয়ালী আহমেদ গুংগার উদ্দেশে। রানার সারা দেহ সার্চ করে দেখল গুংগা। সিগারেট কেস, রুমাল এবং লাইটারটা বের করে রাখল নিচু টেবিলের ওপর। কোনও অস্ত্র নেই। হাঁটুর নীচে পায়ের সঙ্গে বাঁধা যে ছোরার খাপ থাকতে পারে সে কথা একবারও চিন্তা করল না সে। সন্তুষ্টচিত্তে রানার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল পিছনে যমদূতের মত।
‘আরাম করে বসুন, মিস্টার রানা। আপনার পেছনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, অসম্ভব দ্রুতগতিতে নড়াচড়া করতে পারে সে। কাজেই কোনও রকম। কুমতলব থাকলে দয়া করে পরিত্যাগ করাই আপনার জন্যে মঙ্গলজনক হবে। ওর হাত এড়িয়ে আমার কাছে পৌঁছতে পারবেন না আপনি কোনদিন। তা ছাড়া আমার হাতের দিকে লক্ষ্য করলে ছোট্ট একটা যন্ত্র দেখতে পাবেন। যন্ত্রটা ছোট হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী। এটা প্রস্তুত থাকবে। বুঝতে পেরেছেন? এবার আরাম করে বসে দু’একটা খোশ-গল্প করা যাক, কী বলেন?’
রানা চেয়ে দেখল একটা পয়েন্ট টু-ফাইভ ক্যালিবারের স্কেলিটন-গ্রিপ বেরেটা অটোমেটিক ধরা ওয়ালী আহমেদের হাতে। টেবিলের ওপর থেকে রুমালটা তুলে নিয়ে নাক মুখের শুকিয়ে আসা রক্ত মুছে ফেলল রানা। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে হেলান দিয়ে বসল ফোম রাবারের নরম সোফায়।
‘আপনাকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারছি না, মিস্টার মাসুদ রানা। দুই দুইবার আপনি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। বুদ্ধিমান ও সাহসী লোক আপনি। কিন্তু শেষমেশ আমার খাঁচায় তো সেই ঢুকতেই হলো আপনাকে।
রানা ভাবছে, তা হলে ওয়ালী আহমেদই স্বর্ণমৃগ? নাকি এটা কোইনসিডেন্স? রানার করাচি আগমনের হেতুটা কী জানতে পেরেছে ওয়ালী আহমেদ?
‘আপনার আঘাত আমি আরও আগেই আশা করেছিলাম। এত দেরী হলো কেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘দেরী কোথায়? যেই মাত্র জানলাম আপনার পরিচয়, তক্ষুণি হুকুম দিয়ে দিলাম। আজ ভাগ্যক্রমে দুবার বেঁচে গেছেন, আমার কিছু বিশ্বস্ত লোকও খুন করে ওভারট্রাম্প করেছেন। কিন্তু আরও অনেক ট্রিক্স ছিল হাতে। আজ রাত পোহাবার আগেই গেম এবং রাবার করে বসে থাকতাম আমি। যাক, ভালই হলো, নিজেই ঠিকানা জোগাড় করে এসে উপস্থিত হয়েছেন।’
‘এবং আরও অনেকে শিগগিরই উপস্থিত হবেন।’
‘এসে লাভ নেই। যদি তাই হয়, গোপন পথে বেরিয়ে যাব আমরা। তেমন প্রয়োজন হলে এই দোকান বন্ধ করে দেব। আমার আসল কাজে কোনও অসুবিধে হবে না। যাক, যা বলছিলাম। আজ বিকেলেই স্থির করলাম আমি, আপনাকে ছাড়া চলবে না। আপনার মত বুদ্ধিমান এবং কৌশলী লোককে হয় নিয়ে নিতে হবে আমার সাথে, নয় সরিয়ে ফেলতে হবে চিরতরে। কাজেই খোঁজ নিলাম। আপনি বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাবার ঠিক বিশ মিনিটের মধ্যেই আপনার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলাম আমি।’ পান মুখে ফেলল সে একটা।
‘আমার অপরাধ?’
‘আমার পেছনে লাগতে যাওয়াটা অপরাধই বৈকি। দুই আঙুলে খানিকটা জর্দা টিপে তুলে ছেড়ে দিল সে মুখ বিবরে।
‘আপনার জোচ্চুরি ধরে ফেলায় মৃত্যুদণ্ড? সুবিচারই বটে!’
‘সেজন্যে নয়। ন্যাকামি করছেন আপনি। আপনি ভাল করেই জানেন কেন আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আজ বিকেলে আমার জুয়া খেলা কৌশল আবিষ্কার করে ফেলায় আপনার ওপর যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম আমি। সেই মুহূর্তে মনে মনে আপনার বেতন ধার্য করে ফেলেছিলাম। আপনি এখন পাচ্ছেন মাসে দু’হাজার করে—আমি অবশ্য তখন জানতাম না সে-কথা, পরে জেনেছি। আমি মনে মনে স্থির করেছিলাম আপনাকে মাসে বারো হাজার টাকা বেতন দেব, সেই সাথে হাফ পারসেন্ট কমিশন। অর্থাৎ কোম্পানির হাজার টাকা লাভ হলে পাঁচ টাকা আপনার। বছর শেষে এই কমিশনই গিয়ে দাঁড়াত দুই লাখে।’
‘বাহ, এ তো চমৎকার অফার! কোন্ বোকা এই সুযোগ ছাড়বে?’ টিটকারি মারল রানা।
‘কিন্তু দুঃখের বিষয়,’ রানার টিটকারিতে কান না দিয়ে বলে চলল ওয়ালী আহমেদ, ‘নিরাশ করেছেন আপনি আমাকে। আপনার সম্পর্কে তথ্য যা পাওয়া গেল, তাতে দেখা গেল আমার মৃত্যু গহ্বরে প্রবেশ করবার জন্যেই জন্ম হয়েছিল আপনার। আমার জন্যেই পাঠানো হয়েছে আপনাকে। আরও খবর নিয়ে জানলাম আজ পর্যন্ত কোনও রকম প্রলোভন দেখিয়েই আপনাকে কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করা যায়নি। কাজেই অন্য আর কোনও পথ থাকল না আমার।’
রানা বুঝল ও খোদ স্বর্ণমৃগের সামনে বসে আছে। আর কিছুক্ষণ আগেই যদি বুঝতে পারত! এক মিনিট চুপ করে থেকে নীরবতা ভঙ্গ করল ওয়ালী আহমেদ।
‘আপনি বোধহয় ভাবছেন, আর একটু আগে যদি টের পেতেন যে যার জন্যে এতদূর ধাওয়া করে এসেছেন সে হচ্ছে সুবিখ্যাত শিল্পপতি ওয়ালী আহমেদ, তা হলে…’
হাসল ওয়ালী আহমেদ।
‘এখনও যদি ছেড়ে দিই আপনাকে, সবকিছু জানার পরেও, তা হলেও আপনি আমার গায়ে একটি আঁচড়ও কাটতে পারবেন না। শত চেষ্টা করেও আমার বিরুদ্ধে একটি প্রমাণও জোগাড় করতে পারবেন না।’
‘ছেড়ে দিয়েই দেখুন না!’ বলল রানা। ‘সে সাহস তো নেই!’
উত্তর দিল না ওয়ালী আহমেদ। ইশারা করতেই দেয়াল আলমারির ভিতর থেকে দুটো গ্লাস আর বোতল বের করে আনল গুংগা। ততক্ষণ একটি কথাও না বলে রানার পেটের দিকে ধরে থাকল ওয়ালী আহমেদ পিস্তলটা। গ্লাস দুটো ভরে দিয়ে আবার রানার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল গুংগা। আবার মুখ খুলল ওয়ালী আহমেদ। গুংগার দিকে চোখ ইশারা করে বলল, ‘এ আমার এক অদ্ভুত আবিষ্কার, মিস্টার রানা। এবং গর্বের বস্তু। দেখতে নিগ্রোর মত হলেও ও আসলে পাকিস্তানী নাগরিক। মাকরান থেকে সংগ্রহ করেছি ওকে। আফ্রিকার আদিম অধিবাসীর রক্ত আছে ওর দেহে, তাই ও-রকম. চেহারা। লোকটা বোবা কালা। সেই কারণেই বোধহয় আশ্চর্য তীক্ষ্ণ ওর ঘ্রাণ এবং দৃষ্টিশক্তি। তা ছাড়াও পাথর ছোঁড়ায় অদ্ভুত রকমের দক্ষতা অর্জন করেছে ও। হোটেলের সামনে তিনমণী পাথরটা আজ সন্ধ্যায় ও-ই ফেলেছিল ছাদ থেকে। ও হচ্ছে কিং-কং গরিলার মনুষ্য সংস্করণ। এমন হিংস্র আর ভয়ঙ্কর প্রাণী জীবনে আর চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে একে কন্ট্রোল করা আমার জন্যেও শক্ত হয়ে পড়ে।’
লালচে চুলের মধ্যে কয়েকবার হাত চালিয়ে নিয়ে আবার বলল, ‘আপনাকে এত খাতির যত্ন করে বসিয়ে এসব বাজে গল্প করে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছি কেন, তার কারণ বুঝতে পারবেন কিছুক্ষণ পরেই। ততক্ষণ গল্পটা চালু রাখা যাক। আপনার ওপরওয়ালা শুনেছি খুব বুদ্ধিমান লোক, কিন্তু একাজে আপনাকে পাঠিয়ে উনি একটা মস্ত ভুল করেছেন। আপনার সম্পর্কে যা জানা গেল তাতে বুঝলাম দুঃসাহসিক কাজে পারদর্শিতা, সেই সঙ্গে অল্পবিস্তর কৌশল ছাড়া আর কিছুই পুঁজি নেই আপনার। কিন্তু আমাকে সত্যি সত্যি কাবু করতে হলে অন্য রকমের লোকের প্রয়োজন ছিল। আপনাকে শেষ করা ছাগল ধরে জবাই করার মতই সহজ কাজ। কই, নিন।’
রানা তুলে নিল গ্লাসটা। শ্যাম্পেন। দুই ঢোক খেয়ে নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল একবার ওয়ালী আহমেদের সবুজ চোখের ওপর।
‘আচ্ছা, মিস্টার ওয়ালী আহমেদ, আমাকে যখন শেষ করে দেয়াই স্থির করেছেন, তখন নিশ্চয়ই আমার দু’একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে কৌতূহল মেটাতে কুণ্ঠিত হবেন না?’
‘কী ধরনের প্রশ্ন করবেন তার ওপর নির্ভর করবে আমার উত্তর।’
‘মৃত্যুর আগে আমি জানতে চাই কেন আপনি এত টাকার মালিক হয়েও আবার এই অসৎ কাজে নামলেন।’
‘অসৎ কাজ আমি প্রচুর করি। আপনি কোনটার কথা বলছেন?’
‘সোনা চোরাচালান।’
‘দেখুন, ওটা অসৎ কাজ নয়—অসৎ কাজের একটা উপায় মাত্র। আমি যত টাকা করেছি সবই অসৎ পথে। এতদিন যেভাবে উপার্জন করেছি তা বাইরে থেকে দেখতে ভদ্র-ব্যবসা মনে হলেও তার মধ্যে এতখানি অসততা আছে যে ধরা পড়লে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এমনকী ফাঁসি পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এটাই আমার লাইন। চিরকাল এ-ই করেছি, ভবিষ্যতেও করব। যত টাকাই হোক না কেন, কেউ আমাকে বিপথ থেকে ফেরাতে পারবে না। আমি বর্ন ক্রিমিনাল। চোর পিতার ঔরসে সিফিলিস রোগাক্রান্ত বেশ্যা মায়ের গর্ভে আমার জন্ম। শারীরিক কয়েকটা দুর্বলতা থাকলেও অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছি আমি। যাই হোক, আত্মজীবনী শুনতে চাননি আপনি। বলছিলাম, বিপথই আমার পথ। সোনাতে অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ, তাই এদিকে একটা সাইড বিজনেস খুলেছি। কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্য এটা নয়। আমি এক মহাশক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই। বাছাই করা সব খারাপ লোক নিয়ে গড়ব আমি আমার এই আণ্ডারগ্রাউণ্ড সোসাইটি। টাকা আমার যথেষ্ট আছে, এবার আমি চাই ক্ষমতা অর্জন করতে। অপরাধ জগতে আমি সম্রাট হয়ে মরতে চাই। আমি সোনা চালান দিচ্ছি…’
‘কিভাবে?’
হঠাৎ হেসে উঠল ওয়ালী আহমেদ। বেরিয়ে পড়ল এক সারি তরমুজের বিচি। শ্যাম্পেন শেষ হয়ে গেছে—পান মুখে ফেলল সে আরেকটা। সেই সাথে জর্দা।
‘আপনি দেখছি বাঁচার আশা ত্যাগ করেননি এখনও! ভাবছেন, আপনাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে আমার গোপনতম কথা বলতে দ্বিধা করব না আমি। চিরকাল যেমন হয়েছে, তেমনি দৈবক্রমে ছাড়া পেয়ে যাবেন আপনি। আর ছাড়া পেয়েই সমূলে ধ্বংস করে ফেলবেন আমাকে। তাই না? থ্রিল সিরিজের আইডিয়াল নায়ক। আমি আপনাকে এতটুকু আশ্বাস দিতে পারি, মিস্টার রানা, আমার হাত থেকে মুক্তি লাভ করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না। একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু তবু আমি একটি কথাও বলব না আপনাকে। আপনার লাশের কানে কানে হয়ত বলতে পারি, কিন্তু জ্যান্ত থাকতে এই গোপন কথা জানবার অধিকার নেই আপনার।’
‘তার মানে আপনার মনেও ভয় আছে যে চিরকাল যেমন হয়েছে, তেমনি এবারও আপনার হাত থেকে ছুটে যেতে পারি আমি?’
‘তা ঠিক নয়। সাবধানের মার নেই।’
এমন সময় টিপয়ের ওপর রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার কানে তুলে হুঁ-হাঁ করল ওয়ালী আহমেদ কিছুক্ষণ। কথা বলল না একটিও, শুনে গেল কেবল। খুশি হয়ে উঠল ওর মুখের চেহারা। বসন্তের বুটি বুটি দাগ ভরা গাল দুটো কুঁচকে গেল মুচকি হাসিতে। নামিয়ে রেখে দিল সে রিসিভার।
‘আমাকে না হয় হত্যা করবেন। মোহাম্মদ জান কী দোষটা করেছে? ওকে আটকে রেখেছেন কেন?’ রানা বলল।
‘ও-ই আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে এখানে।’
‘মিথ্যে কথা। আমিই এনেছিলাম ওকে সাথে করে।’
‘যাই হোক, যদি বুঝি তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারবে না ও, তা হলে জানে মারব না। হাল্কা কোনও শাস্তি দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেব। আপাতত কদিন বন্দি থাকতে হবে ওকে।’
মেলা কথায় বিরক্ত হয়ে উঠছে রানা। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, ‘এখন আমাকে নিয়ে কী করতে চান, মি. ওয়ালী আহমেদ?’
‘আপনার দ্বারা আমার দুটো উদ্দেশ্য আমি পূরণ করব। এক এক করে বলছি। প্রথমটা হচ্ছে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। আপনি বোধহয় শুনেছেন জিনাতের কাছে, আমি কামনা করেছিলাম ওর দেহ। আমাকে অবহেলা করে ও আত্মসমর্পণ করেছে আপনার কাছে। এর ফলে আমার আহত আত্মাভিমান অপমানে জর্জরিত হয়েছে। আমাকে বেকায়দায় ফেলে টাকা আদায় করে আপনারা যে প্রাণখোলা হাসি হেসেছিলেন, সে হাসি সূচের মত বিঁধেছে আমার মনে। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলেছি আমি। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল ওয়ালী আহমেদের চেহারা। তাই আপনার চোখের সামনে ধর্ষণ করবে জিনাতকে আমার দেহরক্ষী গুংগা প্যাহেলওয়ান। আমি নিজে করব না, তার কারণ, টু টেল ইয়ু দ্য ট্রুথ, আমার সে ক্ষমতা নেই। আমি জন্ম থেকেই ইমপোটেন্ট। কিন্তু এই ব্যাপারে বরাবর আমার অত্যন্ত উৎসাহ আছে। পারভারটেড বলতে পারেন কিন্তু গুংগাকে আসরে নামিয়ে দিয়ে দর্শকের গ্যালারিতে বসে আমি যার-পর-নাই আনন্দ লাভ করি। আপনিও থাকবেন আমার সঙ্গে আজ।’
‘আজ?’ চমকে উঠল রানা।
‘হ্যাঁ। আজ। জিনাতকে আনতে পাঠিয়েছি। এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই।’
‘অসম্ভব!’
‘খুবই সম্ভব। নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।’
‘জিনাত এখন তার বাপের বাড়িতে নিরাপদে আছে। ওকে রক্ষা করবার জন্যে যথেষ্ট সশস্ত্র লোক আছে সে বাড়িতে।’
‘জানি। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই আপনার—তাই আপনার এই সন্দেহ প্রকাশ করবার ধৃষ্টতা ক্ষমা করে দিচ্ছি। জিনাতকে ওই বাড়ি থেকে বের করে আনা অত্যন্ত সহজ কাজ। মাত্র তিনজন লোক পাঠিয়েছি। সাথে নিয়ে গেছে একখানা বড় সাইজের রেডিয়োগ্রাম। কলিং বেল টিপলে বেরিয়ে আসবে বাইরে মোহাম্মদ জানের লোক, তাকে বলা হবে আগামী কাল জিনাত সুলতানার জন্মদিন উপলক্ষে ওটা মাসুদ রানার উপহার। কেউ কিছুমাত্র সন্দেহ করবে না। কাঠের ডালা তুলে দেখানো হবে অত্যন্ত দামি রেডিয়োগ্রামের কিছুটা অংশ। সাদরে ডেকে নিয়ে যাবে জিনাত ওদেরকে ওর ঘরে। রেডিয়োগ্রামটা পছন্দসই জায়গায় ফিট করে দেবে আমার লোক। তারপর ফেরার সময় সেই কাঠের বাক্সের মধ্যে করে নিয়ে আসবে জিনাতের জ্ঞানহীন দেহটা সবার সামনে দিয়ে। এবার বুঝেছেন?’
বিস্মিত দুই চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে রানা ওয়ালী আহমেদের মুখের দিকে। কয়েকটা অশ্লীল গালাগালি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। গালি শুনে তরমুজের বিচি বের করে হাসল ওয়ালী আহমেদ, গায়ে মাখল না। পায়ে বাঁধা ছুরিটার কথা মনে হলো রানার। কিন্তু না। এখন স্থির থাকতে হবে। এখনও সময় আছে।
‘আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন থেকে জোগাড় করা আমার হাজার কয়েক প্রিয় মাছ বহুদিন মুখরোচক খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে, ওদের একটু আনন্দ দান করা। জিনাতের ধর্ষিত নগ্ন দেহ আপনার দেহের সঙ্গে একসঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে নামিয়ে দেয়া হবে পানিতে। আমি স্টপ ওয়াচ নিয়ে থাকব কাছেই। ব্যাপারটা অনেকটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মত আর কী। এ ব্যাপারেও আমার উৎসাহের অভাব নেই। উজ্জ্বল বাতি থাকবে ট্যাঙ্কের ওপর। পরিষ্কার দেখা যাবে আপনাদের দেহ। আমার নিজের বিশ্বাস স্ত্রীলোকের চাইতে পুরুষের মাংসই ওরা বেশি পছন্দ করে। সেই পরীক্ষাও হয়ে যাবে এই ফাঁকে। তবে আমার স্থির বিশ্বাস কোনও অবস্থাতেই তিন মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। সেটাও আজই বোঝা যাবে।’
‘হাঙ্গর?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আপনি একটা গর্দভ। হাজার হাজার হাঙ্গর পুষব কী করে আমি? এত খাবারই বা দেব কোত্থেকে? আর এজন্যে দক্ষিণ আমেরিকাতেই বা যাব কেন? এটা খুব ছোট মাছ। ছয় থেকে আট ইঞ্চি। শতখানেক এনেছিলাম শখ করে। এখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্রিড করিয়েছি। এখন আমার স্টকে আছে পনেরো হাজার।’
‘পিরানহা!’ গলাটা শুকিয়ে এল রানার।
‘এইবার ঠিক বলেছেন। পিরানহা। ক্ষুরের মত ধারাল দাঁত দিয়ে পাঁচ মিনিটেই একটা আস্ত ঘোড়া খতম করে দেয় ঝুঁকের মধ্যে বাগে পেলে।’
দ্রুত চিন্তা করছে রানা। অসম্ভব। নিশ্চয়ই খামোকা ভয় দেখাবার জন্যে বোম্বাস্টিক গুল মারছে ওয়ালী আহমেদ। এক ধরনের ম্যানিয়াতে ভুগছে লোকটা। কিছুতেই এসব সত্যি হতে পারে না। এ হচ্ছে ওর বিকৃত মস্তিষ্কের বিকারগ্রস্ত প্রলাপ। কিন্তু যদি সত্যি হয়…
‘এবার আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে ক্ষমা করতে হবে, মিস্টার মাসুদ রানা। আপনাকে এক্ষুণি রেপিং চেম্বারে নিয়ে যাবে গুংগা। অল্পক্ষণের মধ্যেই জিনাতও এসে পড়বে। আমিও কয়েকটা হাতের কাজ সেরেই আসছি।’
নিঃশব্দে আবার কিছু বলল ওয়ালী আহমেদ গুংগাকে। মাথা নাড়ল গুংগা। তারপর ইঙ্গিত করল রানাকে উঠে দাঁড়াবার জন্যে। বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই। টেবিলের ওপর থেকে জিনিসগুলো তুলে আবার পকেটে চালান দিল রানা। তারপর উঠে দাঁড়াল বিনা বাক্যব্যয়ে। দেখল এখনও ওর দিকে ধরা আছে ওয়ালী আহমেদের হাতের পিস্তলটা। শেষ চেষ্টা একবার করতেই হবে—কিন্তু এখন নয়।
পিছন থেকে গুংগার হাতের মৃদু ঠেলা খেয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল রানা। আবার সেই চারফুটি এবং আটফুটি করিডোর ধরে এগিয়ে গেল ওরা। শেডহীন বালবগুলোকে উলঙ্গ লাগল রানার কাছে। প্রতিধ্বনি উঠল ওর জুতোর শব্দের। এই গোলক ধাঁধার মত রাস্তায় উত্তর-দক্ষিণ পুব-পশ্চিম ঠিক রাখতে পারল না ও। এদিকটা অপেক্ষাকৃত অন্ধকার। আবছা অন্ধকারে একটা ঘরে চাবি লাগাল গুংগা। আর সেই সুযোগে আলগোছে পায়ে বাধা খাপ থেকে ছুরিটা বের করে পকেটে ফেলল রানা। ঝাঁপিয়ে পড়বে কি না ভাবছিল, কিন্তু গুংগা ততক্ষণে আবার থাবা চালিয়েছে চুলের ওপর। রানা মনে মনে ভাবল, যত খারাপই দেখাক, এ যাত্রা যদি রক্ষা পায় তা হলে ক্রু-কাট করে রাখবে মাথার চুল।
একটা সুন্দর ডাবলসাইজের খাট পাতা রয়েছে আলোকোজ্জ্বল ঘরটার এককোণে। দামি-কাভারে ঢাকা। ওদিকে পাঁচ-ছ’টা চেয়ার খাটের দিকে মুখ করা। একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল গুংগা রানাকে। হাতলের ওপর হাত রেখেই বুঝল ও আলগা ওটা। জোরে হেঁচকা টান দিলে খুলে আসার সম্ভাবনা আছে। যদিও এই সামান্য অস্ত্র দিয়ে এই পাহাড় প্রমাণ দৈত্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করা ছেলেমানুষী, কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কী? এরপর আর কোনও সুযোগ না ও আসতে পারে।
এটাই তা হলে রেপিং চেম্বার! কী পৈশাচিক বিকৃতি! এই দানব ওই খাটের ওপর জিনাত সুলতানাকে ধর্ষণ করবে, ছটফট করতে থাকবে জিনাত রানার চোখের সামনে, ওর নিরুপায় দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে গুংগা নগ্ন লালসা নিয়ে, চিন্তা করতেই রানার মাথার মধ্যে আগুন ধরে গেল। প্রাণ থাকতে এ দৃশ্য দেখতে পারবে না ও। তার আগে এর হাতে শেষ হয়ে যাওয়াও ভাল।
পিছন ফিরে বিছানার দিকে এগোচ্ছিল গুংগা। এক টানে মড়াৎ করে ভেঙে ফেলল রানা চেয়ারের হাতলটা। গুংগার কানে সে-শব্দ পৌঁছল না। কিন্তু রানা উঠে দাঁড়াতেই ঘরের মধ্যে যে সামান্য একটু আলোছায়ার পরিবর্তন হলো। তাতেই বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল সে।
মাঝপথে একবার ঝিক করে উঠল তীক্ষ্ণধার ছুরিটা।