» » স্বামীহারা

বর্ণাকার

[ ঙ ]

সেদিন সকাল হতেই আমার ডান চোখটা নাচতে লাগল, বাড়ির পিছনে অশ্বত্থ গাছটায় একটা প্যাঁচা দিন দুপুরেই তিন তিন বার ডেকে উঠল, মাথার উপর একটা কালো টিকটিকি অনবরত টিক টিক করে আমার মনটাকে আরও অস্থির চঞ্চল করে তুলছিল। আমার অদৃষ্টের সঙ্গে ওদের কী সংযোগ ছিল?

উনি সেই যে ভোরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন একটা লাশ কাঁধে করে নিয়ে, সারাদিন আর ফেরেননি। আমি কেবল ঘর আর বার করছিলুম।

বিকাল বেলায় খুব ঘনঘটা করে মেঘ এল, সঙ্গে সঙ্গে তুমুল ঝড় আর বৃষ্টি। সে যেন মস্ত দুটো শক্তির দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ওঃ এত জল আর পাথরও ছিল সেদিনকার মেঘে। সামনে বিশ হাত দূরে বজ্র পড়ার মতো কী একটা মস্ত কঠোর আওয়াজ শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল, আমি অচেতন হয়ে পড়ে গেলুম।

***

যখন চেতন হল, তখন বাড়িময় একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, চারিদিকে হাহাকার, আর জল পড়ার ঝম ঝম! একটা মস্ত বড়ো বজ্র ঠিক আমার কপাল লক্ষ্য করে ছুটে আসছে।

আমার স্বামীদেবতা তখন বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন, আর মা পাষাণ-প্রতিমার মতো তাঁর দিকে শুধু চেয়ে রয়েছেন। চোখে এক ফোঁটা অশ্রু নেই, যেন হৃদয়ের সমস্ত অশ্রু জমাট বেঁধে গেছে। দৃষ্টিতে কী এক যেন অতীন্দ্রিয় ঔজ্জ্বল্য। সে কী বিরাট নির্ভয়তা।

শুনলুম সেদিন আমাদের পাশের গাঁয়ের দশবারো জন কলেরা রোগীকে গোর দিয়ে কয়েক জনকে ঔষধ পথ্য দিয়ে উনি বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তাঁকে ঐ রোগে আক্রমণ করলে। একটি পুরানো বটগাছের তলায় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, একটু আগে উঠিয়ে আনা হয়েছে।—আবার বৃষ্টি এল, সমস্ত আকাশ ভেঙে ঝম ঝম ঝম। …

তাঁকে ধরে রাখবার ক্ষমতা আর কারুর ছিল না—তাঁর কাজ শেষ হয়ে গেছিল, আর থাকবেন কেন? তিনি চলে গেলেন! যার যতটা ইচ্ছা গেল, কাঁদলে। আমাদের ঘরের আঙিনায় নিমগাছটার পাতা ঝরে পড়ল, ঝর ঝর ঝর! গোয়ালের গরু দড়ি ছিঁড়ে গোঙাতে গোঙাতে ছুটল। দ্বারে কাকাতুয়াটি শুধু একবার একটা বিকট চিৎকার করে অসাড় হয়ে নীচের দিকে মুখ করে ঝুলে পড়ল। চারিদিকে মুমূর্ষুর তীক্ষ্ম একটা আহা আহা শব্দ রহিয়ে রহিয়ে উঠতে লাগলে। সব ব্যেপে উঠতে লাগল শুধু একটা বীভৎস কান্নার রব। কান্নায় যেন সারা বিশ্বের বত্রিশ নাড়ি পাক দিয়ে অশ্রু ঝরছিল, ঝম ঝম ঝম।

শুধু তেমনি অচল অটল হয়ে একটা বিরাট পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন মা!

শুধু তাঁর শেষ সময় বলেছিলেন, ‘বাপ রে, আমাকে তো কাঁদতে নেই, তুই তো আর আমার নস, তোকে খোদার কাছে কোরবানি দিয়েছি! খোদার নামে উৎসর্গীকৃত জিনিসে তো আমার অধিকার নেই!—তবে চল বাপ, তুই তো আমায় ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারিসনে, আমিও তোকে কখনও চোখের আড়াল করিনি। তোর কাজ ফুরিয়েছে, আমারও কাজ ফুরাল আজ।’

কতকগুলো লোকের মগজ নাকি এমনই খারাপ হয়ে যায় যে, তারা এক একটা ছোট্ট মুহূর্তকেই একটা অখণ্ড কাল বলে ভাবে। তবে কী আমারও মাথা সেই রকম খারাপ হয়ে গেছে, তা না হলে আমার বোধ হচ্ছে কেন যে, এসব ঘটনা যেন বাবা আদমের কালে ঘটে গেছে, আর আমি এমনি করে গোরস্থানে বসেই আছি। তুই কিন্তু বলছিস, এই সেদিন তাঁরা মারা গেছেন। তবে তো আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি।

কী বলছিস, এ গোরস্থানে এলুম কেন?—আহা, কথার ছিরি দেখ! এই গোরস্থানে যেখানে সব সত্যিকারের মানুষ শুয়ে রয়েছেন, সেখানে না এসে, যাব কী তবে বনে-জঙ্গলে যেখানে এক রকম জন্তু আছে, যাদের শুধু মানুষের মতো হাত পা আর অন্তরটা শয়তানের চেয়েও কুৎসিত কালো?—আমার বেশ মনে পড়ে, যখন তাঁর লাশ কাঁধে করে বাইরে আনা হল, তখন ওদের কে একজন আত্মীয় আমার চুল ধরে বললে, ‘যা শয়তানি, বেরো ঘর থেকে এখনি। তখনই বলেছিলুম, বুনিয়াদি খানদানের উপর নাল চড়ান, এ সইবে কেন? তোকে ঘরে এনে শেষে বংশে বাতি দিতে পর্যন্ত রইল না কেউ; বেরো রাক্ষুসি, আর গাঁয়ের লোকের সামনে মুখ দেখাস না। আর ইচ্ছা হয় চল, তোর আর একটা নেকা দিয়ে দি?’—অত মার গাল কিছুই বাজে নাই আমার প্রাণে, যত বেজেছিল ঐ একটা নেকার কথায়। ঐ বিশ্রী কথাটা একটা মস্ত আঘাতের মতো বেজেছিল আমার চূর্ণ বক্ষে।—ওগো নেকা কী? সে কী দুবার অন্যের গলায় মালা দেওয়া? শাস্ত্রে নেকার কথা আছে, সে কাদের জন্যে? আচ্ছা ভাই, যারা বাধ্য হয়ে অন্নবস্ত্রাভাবে বা আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে ও রকম করে ভালবাসার অপমান করে, তাদের কী হৃদয় বলে কোনো একটা জিনিস নাই? তা হলেও তাদিগকে ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু যারা শুধু কামনার বশবর্তী হয়ে পবিত্রতাকে, নারীত্বকে ওরকম মাড়িয়ে চলে যায়, তাদের কোথাও ক্ষমা নাই। ভালবাসা—স্বর্গের এমন পবিত্র ফুলকে কামনার শ্বাসে যে কলঙ্কিত করে, তার উপযুক্ত বোধ হয় এখনও কোনো নরকের সৃষ্টি হয় নাই।

‘মউলবি সাহেবরা হয়ত খুব চটে আমার ‘জানাজার নামাজ’ই পড়বেন না, কিন্তু মানুষ আর মউলবিতে অনেক তফাত—শাস্ত্র আর হৃদয়, অনেকটা তফাত।