» » এক : মাঝারি গৃহস্থ-ঘরে

বর্ণাকার

এক : মাঝারি গৃহস্থ-ঘরে

মাঝারি গৃহস্থ-ঘরে বাড়ির কর্তা যখন যক্ষ্মারোগে মারা যান, তখন তিনি পরিবারটিকেও আধমরা করিয়া যান। সুলোচনার স্বামী পতিতপাবন ঠিক তাহাই করিয়া গেলেন। বর্ষাধিককাল রোগে ভুগিয়া একদিন বর্ষার দুর্দিনে গভীর রাত্রে তিনি দেহত্যাগ করিলেন। সুলোচনা কাল স্বামীর শেষ প্রায়শ্চিত্ত করাইয়া দিয়া পার্শ্বে আসিয়া বসিয়াছিলেন, আর উঠেন নাই। স্বামী নিঃশব্দে প্রাণত্যাগ করিলেন, সুলোচনা তেমনি নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন, চিৎকার করিয়া পাড়া মাথায় করিলেন না। ত্রয়োদশবর্ষীয়া অনূঢ়া কন্যা হেমনলিনী কিছুক্ষণ পূর্বে অদূরে মাদুরের উপর ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, তাহাকেও জাগাইলেন না। সে ঘুমাইতে লাগিল, পিতার মৃত্যুর কথা জানিতেও পারিল না। বাড়িতে একটি ভৃত্য নাই, দাসী নাই, দূর সম্পর্কীয় কোন আত্মীয় পর্যন্ত নাই। পাড়ার লোকেও ক্রমশ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল, বিশেষ অপরাহ্ণ হইতেই বৃষ্টি চাপিয়া আসিয়াছিল বলিয়া, দয়া করিয়া আজ আর কেহ রাত্রি জাগিবার নাম করিয়া ঘুমাইতে আসে নাই।

বাহিরে অবিশ্রাম বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। ভিতরে মৃত স্বামীকে চোখের সামনে লইয়া সুলোচনা কাঠ হইয়া বসিয়া রহিলেন। পরদিন সংবাদ পাইয়া সকলেই আসিলেন, পুরুষেরা মড়া বাহির করিয়া শ্মশানে লইয়া গেল। স্ত্রীলোকেরা গোবর-জল ছড়া দিয়া কাঁদিতে বসিয়া গেলেন।

সুলোচনার থাকিবার মধ্যে শুধু একখানি ছোট আম-কাঁঠালের বাগান অবশিষ্ট ছিল। পাড়ার লোকের সাহায্যে সেইটি একশত টাকায় বিক্রয় করিয়া যথাসময়ে স্বামীর শেষ কাজ সমাধা করিয়া চুপ করিয়া ঘরে বসিলেন। মেয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কি হবে মা এবার?

মা জবাব দিলেন, ভয় কি মা? ভগবান আছেন।

শ্রাদ্ধ-শেষে যাহা বাঁচিয়াছিল, তাহাতে একমাস কোনমতে কাটিয়া গেল। তার পর একদিন আকাশ মেঘমুক্ত দেখিয়া, প্রভাত না হইতেই তিনি ঘরে-দোরে চাবি দিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

মেয়ে প্রশ্ন করিল, কোথায় যাবে মা?

মা বলিলেন, কলকাতায়, তোর দাদার বাড়িতে।

আমার আবার দাদা কে? কোনদিন ত তাঁর কথা বলনি?

মা একটু চুপ করিয়া বলিলেন, এতদিন আমার মনে পড়েনি মা।

হেম অতিশয় বুদ্ধিমতী, সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কাজ নেই মা কারু বাড়ি গিয়ে। দেশে থেকে দুঃখ করলে আমাদের দুটো পেটের ভাত জুটবে—আমি ঘর ছেড়ে কোথাও যাব না।

সুলোচনা উদ্বিগ্ন-কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, দাঁড়াস নে হেম, সকাল হয়ে যাবে।

চলিতে চলিতে বলিলেন, তিনি তোকে অনেক লেখাপড়া শিখিয়েছেন—সে-সমস্ত জলে ফেলিস নে। তুই আমাকে কি বলবি হেম! আমি জানি, ঘরে বসে মায়ে-ঝিয়ে দুঃখ করলে পেটের ভাতটা জুটবে, কিন্তু তোর বিয়ে দেব কি করে বল্‌ দেখি মা?

হেম বলিল, বিয়ে নাই দিলে?

জাত যাবে যে রে।

হেম বলিল, গেলই বা মা। আমরা দুটি মায়ে-ঝিয়ে থাকব—দুঃখ করে খাব, আমাদের জাত থাকলেই বা কি, গেলেই বা কি! পৃথিবীতে আরো অনেক জাত আছে, মেয়ের বিয়ে না দিলে তাদের জাত যায় না। আমরা না হয় তাদের মত হয়ে থাকব।

মেয়ের কথা শুনিয়া সুলোচনা এত দুঃখের মাঝেও একটুখানি হাসিলেন, বলিলেন, তা হলেও গাঁ ছাড়তে হবে। জাত গেলে কেউ উঠান ঝাঁট দিতেও ডাকবে না।

হেম আর জবাব দিল না। বিস্তর অপ্রীতিকর স্মৃতি ইহার পশ্চাতে উদ্যত হইয়াছিল, সেগুলা দমন করিয়া লইয়া সে সে চুপ করিয়া পথ চলিতে লাগিল।

যে পথটা গঙ্গার পাশ দিয়া, গ্রামের ভিতর দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া শ্রীরামপুর স্টেশনে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, তাঁহারা সেই পথ ধরিয়া প্রায় ক্রোশ-খানেক আসিয়া পথিপার্শ্বে সিদ্ধেশ্বরীর ঘরের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিয়া উঠিয়া হেম বলিল, মা, সকাল হয়ে গেছে, আমার পথ চলতে লজ্জা হচ্ছে।

সুলোচনার নিজেরও লজ্জা করিতেছিল। নীচে এক বৃদ্ধা প্রাতঃস্নানে আসিতেছিলেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা, শ্রীরামপুর ইস্টিশানের এই পথ না?

বৃদ্ধা ক্ষণকাল তাঁহার মুখপানে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, তোমরা কোথা থেকে আসচ মা?

সুলোচনা সে কথার জবাব না দিয়া বলিলেন, ইস্টিশানে যাবার আর কোন পথ নেই মা?

দেবালয়ের বিপরীত দিকে একটি ছোট গলি বরাবর রেলওয়ে লাইনের উপর আসিয়া পড়িয়াছিল। বৃদ্ধা সেই পথটি দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, এই গলিটা বামুনদের বাড়ির পাশ দিয়ে বরাবর রেলের রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। এই পথ দিয়ে যাও। রেলের রাস্তা ধরে সোজা বাঁ-দিকে গেলে ছিরামপুর ইস্টিশানে পৌঁছুবে—যাও মা, ভয় নেই, কেউ কিছু বলবে না।

সুলোচনা কোনরূপ দ্বিধা না করিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া গলির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলেন।