হুমায়ূন আহমেদ

নিষাদ

নিউরোলজিস্ট প্রফেসর আসগর বিশালদেহী মানুষ। গোলগাল মুখ। মাথাভর্তি টাক—তীক্ষ্ণ চোখ। শিশুরা ভয় পেয়ে যাবার মতো চেহারা, কিন্তু মানুষটি হাসিখুশি। কারণে অকারণে রোগীকে ধমক দেয়ার বাজে অভ্যাসটি এখনো অর্জন করেন নি।

ভদ্রলোক অনেক ঝামেলা করলেন। প্রথম বারের স্ক্যানিং ভালো হয় নি, দ্বিতীয় বার করলেন। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলেন না। চোখে পড়ার মতো কোনো অস্বাভাবিকতা ব্রেইন ওয়েভে নেই। তিনি হেসে বললেন, ‘আপনি এক জন খুবই সুস্থ মানুষ। শুধু শুধু আমার কাছে এসেছেন। আপনার অসুবিধা কী?’

‘কোনো অসুবিধা নেই। মাঝে মাঝে আজেবাজে স্বপ্ন দেখি, এই অসুবিধা।’

‘আজেবাজে স্বপ্ন তো সবাই দেখে। আমিও দেখি। একবার কী দেখলাম জানেন? বাংলা একাডেমিতে গ্রন্থমেলা হচ্ছে, আমি শুধু একটা আণ্ডারওয়্যার পরে সেই গ্রন্থমেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। হা হা হা।’

মুনির হেসে ফেলল।

মিসির আলি বললেন, ‘বাংলাদেশে ক্যাট স্কেনের কোনো ব্যবস্থা আছে? আমি এই ছেলের ব্রেইনের একটা ক্যাট স্কেন করাতে চাই।’

‘শুধু শুধু ক্যাট স্কেন কেন করাবেন?’

‘পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে চাই যে, ওর মস্তিষ্কে কোনো সমস্যা নেই।’

‘বাংলাদেশে ক্যাট স্কেনার নেই। মাদ্রাজে নিয়ে যেতে পারেন। সেখানে আছে।’ ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে মিসির আলি বললেন, ‘তোমার নিশ্চয়ই পাসপোর্ট নেই।’

‘জ্বি-না।’

‘কাল সকাল দশটার দিকে এসো, পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে একটা দরখাস্ত করে দিই।’

‘পাগল হয়েছেন নাকি স্যার?’

‘আমি পাগল হব কেন? পাগল হচ্ছ তুমি। তা পুরোপুরি হবার আগেই একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’

‘অনেক টাকার ব্যাপার স্যার।’

‘তা তো বটেই। আমার কাছেও এত টাকা নেই। একটা ব্যবস্থা করতে হবে। পাসপোর্টটা তো করা থাকুক। চা খাবে নাকি? এস, চা খাওয়া যাক।’

দু’ জন চা খেল নিঃশব্দে। চায়ের দোকানে রেডিও বাজছে। মিসির আলি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রেডিও শুনছেন। তাঁর চোখ ছায়াচ্ছন্ন। গানের বিষাদ তাঁকে স্পর্শ করেছে।

‘যখন মইরা যাইবারে হাছন

মাটি হৈব বাসা।

কোথায় রইবো লক্ষণ ছিরি,

রঙ্গের রামপাশা।’

মুনির অবাক হয়ে লক্ষ করল, মিসির আলির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এই মানুষটির প্রতি গভীর মমতা ও ভালবাসায় মুনিরের হৃদয় আর্দ্র হল। পৃথিবীতে ভালো-মানুষের সংখ্যা কম। কিন্তু এই অল্প ক’জনের হৃদয় এত বিশাল যে, সমস্ত মন্দ মানুষ তাঁরা তাঁদের হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন।

মিসির আলি রুমাল বের করে চোখ মুছে অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন। থেমে-থেমে বললেন, ‘মানুষের মন বড় বিচিত্র। এই গান আগে কতবার শুনেছি, কখনো এরকম হয় নি। আজ হঠাৎ চোখে পানিটানি এসে এক কাণ্ড! চল, ওঠা যাক।’

মুনির বলল, ‘একটু বসুন স্যার, আপনাকে একটা কথা বলি।’

‘বল।’

‘ঐদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন চেষ্টা করতে, নিজে-নিজে ঐ জগতে যেতে পারি কি না।’

‘চেষ্টা করেছিলে?’

‘জ্বি। আমি যেতে পারি। ইচ্ছে করলেই পারি।’

‘বল কী!’

‘হ্যাঁ স্যার। গত তিন দিনে আমি চার বার গিয়েছি। যাওয়াটা খুবই সহজ।’

মিসির আলি চুপ করে রইলেন। মুনির বলল, ‘আমি আপনার জন্যে দুটো জিনিস ওখান থেকে নিয়ে এসেছি।’

‘কী জিনিস?’

‘দুটো ছবি।’

‘বল কী তুমি! দেখি।’

মুনির একটা খাম এগিয়ে দিল। মৃদু গলায় বলল, ‘বাসায় গিয়ে দেখবেন স্যার। প্লীজ।’

মিসির আলি কৌতূহল সামলাতে পারলেন না। ছবি দুটো দেখলেন। একটি বিয়ের ছবি—বর এবং কনে পাশাপাশি বসে আছে। তাদের ঘিরে আছে আত্মীয়স্বজন। বর মুনির। কনে নিশ্চয়ই বিনু নামের মেয়েটি।

অন্যটি স্বামী-স্ত্রীর ছবি। ওদের কোলে ফুটফুটে একটি শিশু। ছবির উল্টো পিঠে লেখা—

‘আমাদের টগরমণি। বয়স এক বছর।’

মুনির বলল, ‘এ আমাদের ছেলে। চার বছর বয়সে মারা যায়। নিউমোনিয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা উল্টাপাল্টা চিকিৎসা করেছেন।’

বলতে-বলতে মুনিরের গলা আর্দ্র হয়ে গেল। মিসির আলি দীর্ঘ সময় মুনিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘কোনো খবরের কাগজ আন নি?’

‘জ্বি-না স্যার। কিছু আনার কথা তখন মনে থাকে না। ছবিগুলো কেমন করে চলে এসেছে, আমি জানি না। ছবিগুলো হাতে নিয়ে দেখছিলাম, হঠাৎ ঘোর কেটে গেল—দেখি আমি আমার ঘরে বসে আছি। আমার হাতে দুটো ছবি।’

‘চল, রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটি।’

‘চলুন।’

তারা দু’ জন উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত হেঁটে বেড়াল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। মিসির আলির মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। একসময় তিনি বললেন, ‘তুমি কি এর পরেও নিজাম সাহেবের বাসায় গিয়েছিলে?’

‘জ্বি-না স্যার।’

‘চল, আজ যাওয়া যাক।’

‘কেন?’

‘এম্নি যাব। দেখব। কথা বলব। ভয় নেই, ছবির কথা কিছু বলব না।’

‘আমার স্যার যেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘বেশ, তুমি না গেলে। কীভাবে যেতে হয় আমাকে বল। আমি একাই যাব।’

‘স্যার, আমি চাই না ঐ মেয়েটি ছবি সম্পর্কে কিছু জানুক।’

‘ও কিচ্ছুই জানবে না।’

মুনির খুব অনিচ্ছার সঙ্গে ঠিকানা বলল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে।

‘স্যার, যাই?’

‘আচ্ছা, দেখা হবে।’

মুনির ঘর থেকে বের হয়েও বেশ কিছু সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল, যেন চলে যাবার ব্যাপারটায় তার মন ঠিক সায় দিচ্ছে না, আবার না-যাওয়াটাও মনঃপুত নয়।

মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন—মনে-মনে বললেন, অদ্ভুত মানবজীবন। মানুষকে আমৃত্যু দ্বিধা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে বাস করতে হয়।

তিনি নিজেও তাঁর জীবন দ্বিধার মধ্যে পার করে দিচ্ছেন। সমাজ-সংসার থেকে আলাদা হয়ে বাস করতে তাঁর ভালো লাগে, আবার লাগে না। মানুষের মঙ্গলের জন্যে তীব্র বাসনা অনুভব করেন। এক জন মমতাময়ী স্ত্রী, কয়েকটি হাসিখুশি শিশুর মাঝখানে নিজেকে কল্পনা করতে ভালো লাগে। আবার পর মুহূর্তেই মনে হয়—এই তো বেশ আছি। বন্ধনহীন মুক্ত জীবনের মতো আনন্দের আর কী হতে পারে? পুরোপুরি নিঃসঙ্গও তো নন তিনি। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরির দিকে তাকালে মন অন্য রকম হয়ে যায়। সারি-সারি বই। কত বিচিত্র চিন্তা, কত বিচিত্র কল্পনার কী অপূর্ব সমাবেশ। এদের মাঝখানে থেকে নিঃসঙ্গ হবার কোনো উপায় নেই।

মিসির আলি বইয়ের তাকের দিকে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ালেন। যে-বই হাতে উঠে আসে, সে বইটিই খানিকক্ষণ পড়বেন। এটা তাঁর এক ধরনের খেলা। সব সময়ই এমন একটা বই উঠে আসে, যা পড়তে ইচ্ছে করে না। আবার পড়তে শুরু করলে ভালো লাগে।

আজও তাই হল। কবিতার বই হাতে। এই একটি বিষয়ে পড়াশোনা তাঁর ভালো লাগে না। কবিতার বই সজ্ঞানে কখনো কেনেন নি, এখানে যা আছে সবই নীলু নামের তাঁর এক ছাত্রীর দেয়া উপহার। মেয়েদের এই এক অদ্ভূত সাইকোলজি, উপহার দেবার বেলায় কবিতার বই খোঁজে।

মিসির আলি বইটির পাতা ওল্টাতে লাগলেন। ইংরেজি কবিতা। কার লেখা কে জানে? অবশ্য নামে কিছু যায় আসে না। তিনি ভূ কুঁচকে কয়েক লাইন পড়তে চেষ্টা করলেন—

I can not see what flowers are at my feet,

Nor what soft incense hangs upon the boughs,

এর কোনো মানে হয়।

কোনো মানে হয় না, তবু পড়তে এত ভালো লাগে! মিসির আলি পড়তে শুরু করলেন।