হুমায়ূন আহমেদ

নিষাদ

মুনিরের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তবে ব্যক্তিগত বিদ্রোহের কারণেও সে এটা করতে পারে। হয়ত সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসগুলো তার পছন্দ নয়। তার অপছন্দের ব্যাপারগুলো সে অন্যদের জানাতে চায়। মিসির আলিকে দিয়ে তার শুরু। পরে অন্যদের কাছে যাবে।

মিসির আলি ঠিক করলেন, যে করেই হোক, ডাক্তার এ মল্লিককে খুঁজে বের করবেন। তাঁকে এই চিঠিটি দেখাবেন। এতে রহস্যের অনেকটা সমাধান হবার কথা। ডাক্তার এ মল্লিককে খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। যেহেতু সরকারি ডাক্তার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলতে পারবে উনি কোথায় আছেন, কোন পোস্টে আছেন। নিশ্চয়ই তাদের ডাইরেক্টরেট আছে।

বাংলাদেশে কোনো কাজই সহজে হয় না। ডাক্তার এ মল্লিকের খোঁজ বের করতে তাঁকে বিস্তর ঝামেলা করতে হল। এ বলে ওর কাছে যান, ও বলে আজ না, সোমবারে আসুন। সোমবারে গিয়ে দেখেন, যিনি খবর দেবেন তিনি শালার বিয়েতে চিটাগাং চলে গেছেন। শেষ পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া গেল। ডাক্তার এ মল্লিক বর্তমানে খুলনার সিভিল সার্জন। তাঁর চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষ। কিছুদিনের মধ্যেই এলপিআরে চলে যাবেন।

খুলনা যাবার ব্যবস্থাও মিসির আলি চট করে করতে পারলেন না। দুটো কোর্স ঝুলছে মাথার উপর। সেশন জট সামলাবার জন্যে স্পেশাল ক্লাস হচ্ছে। মিডটার্ম পরীক্ষা। প্রচুর খাতা জমা হয়ে আছে। খাতা দেখতে হবে। খুলনা জায়গাটাও এমন নয় যে দিনে দিনে গিয়ে চলে আসা যায়।

তিনি মনে-মনে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, মুনিরকে সঙ্গে নিয়েই খুলনা যাবেন। সেই পরিকল্পনাও কার্যকর করা যাচ্ছে না। মুনিরের দেখা নেই। সেই যে ডুব দিয়েছে, ডুবই দিয়েছে। আর উদয় হচ্ছে না। তার ঠিকানা জানা নেই বলে যোগাযোগ করা হচ্ছে না। সে কোথায় থাকে তা একবার মনে হয় বলেছিল—এখন মনে পড়ছে না। মানুষের মস্তিষ্কের একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সে খুব যত্ন করে মনে করে রাখে, প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো মুছে ফেলে। যে-টেলিফোন নাম্বারটি মনে করা দরকার সেটি মনে পড়ে না, অথচ প্রয়োজন নেই এমন টেলিফোন নাম্বারগুলো একের পর এক মনে পড়তে থাকে।

ডাক্তার এ মল্লিক। মানুষটি ছোটখাট। চেহারায় বয়সের তেমন ছাপ নেই, তবে মাথার সমস্ত চুল পাকা। যেন শরতের সাদা মেঘের একটা টুকরো মাথায় নিয়ে হাসিখুশি ধরনের এক জন মানুষ বসে আছেন। ডাক্তার এ মল্লিক বললেন, ‘আমি কি আপনাকে চিনি?’

‘জ্বি-না। আমার নাম মিসির আলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।’

‘ও, আচ্ছা আচ্ছা, আগে বলবেন তো।’

‘আগে বললে কি হত?’

‘না, মানে আরো খাতির করে বসাতাম।’

মিসির আলি হেসে ফেললেন। হাসি থামিয়ে বললেন, ‘আপনি যথেষ্ট খাতির করেছেন। ছুটির দিন, কোথায় যেন বেরুচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বাতিল করলেন।’

‘বাতিল করি নি। বাতিল করলে উপায় আছে? মহিলারা সেজেগুজে বসে আছে। তারা আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। হা হা হা। কি ব্যাপার বলুন।’

‘আমি না-হয় বিকেলে আসি?’

‘পাগল হয়েছেন? বিকেলে দুটো প্রোগ্রাম। একটা জন্মদিন, একটা বিয়ে। যা বলবার এক্ষুণি বলুন। আমার নিজের কোথাও বেরুতে ইচ্ছা করছে না। আপনি আসায় একটা অজুহাত তৈরি হল। বাড়ির মেয়েদের বলতে পারব কাজে আটকা পড়েছি। হা হা হা। আসুন, আমার একটা ব্যক্তিগত ঘর আছে, সেখানে যাই।’

ডাক্তার সাহেবের ব্যক্তিগত ঘর দেখার মতো। মেঝেতে কার্পেট। বসার জন্যে চমৎকার কিছু রকিং চেয়ার। দেয়ালে অরিজিন্যাল পেইন্টিং। ঘরটিতে এয়ারকুলারও বসান।

‘এটা হচ্ছে আমার নিজস্ব ড্রয়িং রুম। খুব নির্বাচিত কিছু অতিথির জন্যে।’

‘আমি কি খুব নির্বাচিত কেউ?’

‘কি জন্যে আপনি এসেছেন তা জানার পর বোঝা যাবে। তবে একটা অনুমান অবশ্যি করছি। ঢাকা থেকে শুধু আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন, সেই থেকেই অনুমানটা করছি। হা হা হা। একটু বসুন। ঠাণ্ডা কিছু দিতে বলি।’

মিসির আলি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। ঊনিশ কুড়ি বছরের একটি মেয়ে খুব বিনীত ভঙ্গিতে মিষ্টির প্লেট নামিয়ে লাজুক হাসি হাসল। মিসির আলির অস্বস্তি আরো বাড়ল। তাঁর মন বলছে, এই মেয়েটির বিয়ের কোনো কথাবার্তা হচ্ছে। এবং তারা ধরেই নিয়েছে তিনি ঢাকা থেকে এই ব্যাপারেই এসেছেন।

মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, যাচ্ছে না। তার উপর এই বোধহয় নির্দেশ।

‘কি নাম তোমার খুকি?’

‘আমার নাম মীরা।’

‘বাহ্, খুব সুন্দর নাম। কী পড়?’

‘বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে পড়ি।’

‘বাহ্, ডাক্তারের মেয়ে ডাক্তার। এখন কি কলেজ ছুটি?’

‘জ্বি না। বাবা হঠাৎ আসতে লিখলেন…।’

মেয়েটি কথা শেষ করল না। হঠাৎ অস্বাভাবিক লজ্জা পেয়ে গেল। মিসির আলি মনে-মনে ভাবলেন, চমৎকার একটি মেয়ে। এই মেয়ের বিয়ের সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে যুক্ত থাকা একটা ভাগ্যের ব্যাপার।

‘মীরা, তুমি এখন যাও। তোমার বাবাকে পাঠিয়ে দাও।’

ডাক্তার সাহেব ঘরে ঢুকলেন হাসিমুখে, ‘কেমন দেখলেন আমার মেয়েকে?’

খুব ভালো মেয়ে! চমৎকার মেয়ে! আমি কিন্তু আপনার মেয়ের বিয়ের কোনো ব্যাপারে আসি নি। অন্য ব্যাপারে এসেছি। তবে মীরার বিয়ের ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারলে অত্যন্ত খুশি হব।

ডাক্তার সাহেব নিভে গেলেন। মিসির আলির বেশ খারাপ লাগল।

‘ঢাকা থেকে কি কারোর আসার কথা ছিল?’

‘জ্বি, ছিল। গত পরশু আসার কথা। সেই জন্যেই মেয়েটাকে বরিশাল থেকে আনালাম। আমার বড় মেয়ে থাকে রাজশাহী, সেও এসেছে। মোটামুটি একটা বেইজ্জতি অবস্থা?’

‘নিশ্চয়ই কোনো-একটা ঝামেলা হয়েছে, যে জন্যে আসতে পারছে না।’

‘তা তো হতেই পারে। কিন্তু খবর তো দেবে?’

‘আপনি যদি চান তাহলে তৃতীয় পক্ষ হয়ে ঢাকায় ফিরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাতে পারি।’

ডাক্তার সাহেব হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে প্রস্তাবটি তাঁর পছন্দ হয়েছে, তবে সরাসরি হ্যাঁ বলতে তাঁর বাধছে। সম্ভবত স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম আলাপ করবেন। তারপর বলবেন।

মিসির আলি বললেন, ‘আমি কি জন্যে এসেছি সেটা কি আপনাকে বলব?’

‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আপনি কি অনেকদিন নেত্রকোণায় ছিলেন?’

‘হ্যাঁ, ছিলাম। পাঁচ বছর ছিলাম নেত্রকোণা সদর হাসপাতালে। সে তো অনেক দিন আগের কথা।’

‘কামরুদ্দিন সাহেব নামে কাউকে চিনতেন? উকিল? বেশ নামকরা উকিল।’

‘খুব ভালো করে চিনতাম। অত্যন্ত মেজাজি লোক ছিলেন। অসম্ভব দিল-দরিয়া। টাকা রোজগার করতো দুই হাতে, খরচ করতো চার হাতে। কী-একটা অনুষ্ঠান একবার করলেন—ছেলের আকিকা কিংবা মেয়ের জন্মদিনে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য!’

‘ভদ্রলোক মারা গেলেন কীভাবে?’

‘অ্যাপেনডিসাইটিস। মফস্বল শহরের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। অপারেশনের সে রকম সুবিধা নেই। আমিও ছিলাম না। থাকলে একটা কিছু অবশ্যই করতাম। ঐ দিনই রাত দশটার ট্রেনে ময়মনসিং চলে আসি। আপনি এইসব জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

‘একটা কারণ আছে। কারণটা এই মুহূর্তে বলতে চাই না। পরে বলব।’

‘আপনি কি ওদের কোনো আত্মীয়?’

‘জ্বি-না। কামরুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী সম্পর্কে কি আপনি কিছু জানেন?’

‘কোন বিষয়ে বলুন তো?’

‘উনি কেমন ছিলেন, কীভাবে মারা গেলেন, এইসব।’

‘খুব রূপবতী মহিলা ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো মানসিক পরিবর্তন ওঁর হয়েছিল কি না জানি না, তবে নানান রকম গুজব শহরে ছড়িয়ে পড়ে।’

‘কি রকম গুজব?’

‘অভিভাবকহীন রূপবতী মেয়েদের নিয়ে যেসব গুজব সাধারণত ছড়ায়, সেইসব আর কি। সহজলভ্য মেয়ে—এই সব কথাবার্তা। পুরুষদের খুব আনাগোনাও নাকি ছিল।’

‘মারা যান কীভাবে?’

‘সেই সম্পর্কেও নানান গল্প আছে। কুৎসিত গল্প। পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল, গ্রাম্য উপায়ে খালাস করতে গিয়ে কি সব হয়েছে… আমি এর বেশি কিছু জানি না। গুজবের ব্যাপারে আমার উৎসাহ কিছু কম। তবে এইসব গুজবের পেছনে কিছু সত্যি সাধারণত থাকে।’

মিসির আলি পকেট থেকে প্যাডের কাগজটি বের করে বললেন, ‘ভালো করে দেখুন তো এই কাগজের লেখাটি আপনার?’

‘আমার তো বটেই।’

‘আপনার নিজের হাতে লেখা!’

‘নিশ্চয়ই।’

‘লেখাটা দয়া করে পড়ে দেখুন।’

মল্লিক সাহেব লেখা পড়ে দীর্ঘ সময় চুপ করে বসে রইলেন। একটি কথা ও বললেন না।

‘আপনি লিখেছেন এ লেখা?’

‘না।’

‘হয়তো অন্য কোনো কামরুদ্দিন সম্পর্কে লিখেছেন।’

‘এই নামে নেত্রকোণায় অন্য কোনো উকিল ছিল না, এবং আমি অপারেশনের ব্যাপারে সাহায্য চেয়েও চিঠি লিখি নি।’

‘হয়তো আপনার মনে নেই।’

‘দেখুন প্রফেসর সাহেব, আমার স্মৃতিশক্তি ভালো। আপনার ব্যাপারটা আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি কি কোনোভাবে আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছেন?’

‘ছি ডাক্তার সাহেব, ভুলেও এ-রকম কিছু ভাববেন না। আমি একটা জটিল রহস্যের জট ছাড়াবার চেষ্টা করছি। এর বেশি কিছু না। আমি আজ উঠি?’

‘আমার লেখা এই চিঠি আপনাকে কে দিল?’

‘অন্য এক দিন আপনাকে বলব।’

‘অন্য কোনোদিন আপনাকে আমি পাব কোথায়?’

‘আমি আমার ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি।’

মিসির আলি ঠিকানা লিখলেন। মল্লিক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি জিগাতলায় থাকেন?’

‘জ্বি।’

‘রহমান সাহেবের বাসা চেনেন? ২২/১৩, তিনতলা বাড়ি। আই স্পেশালিস্ট টি রহমান?’

‘জ্বি-না। তবে আপনি যদি তাঁদের কাছে কোনো খবর পাঠাতে চান, আমি ঠিকানা বের করে খবর পৌঁছে দেব।’

কোনো খবর দিতে হবে না।

‘ও-বাড়ি থেকেই কি কারো আসার কথা ছিল?’

‘আপনি কী করে বুঝলেন?’

‘অনুমান করছিলাম।’

ডাক্তার এ মল্লিক অপ্রসন্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি চিন্তিত ও বিরক্ত। তাঁর আজকের ছুটির দিনটি নষ্ট হয়েছে।

‘যাই ডাক্তার সাহেব?’

তিনি জবাব দিলেন না।