» » তৃতীয় খণ্ড : নিয়তি—রহস্যময়ী

বর্ণাকার

পাঁচকড়ি দে

নীলবসনা সুন্দরী

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে

দেবেন্দ্রবিজয় অনেক বলিয়া-কহিয়া, বুঝাইয়া সাখিয়াকে একটু ঠাণ্ডা করিলেন। বুঝাইয়া দিলেন, যাহাতে তাহার বিবি সাহেবার উপরে এই খুনের অপরাধটা না পড়ে, সেই চেষ্টাই তিনি করিতেছেন, তখন সাখিয়া যাহা জানে বলিতে সম্মত হইল। এবং তাহার এজাহার লিখিয়া লইবার জন্য দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে নোটবুকখানি বাহির করিয়া ঠিক হইয়া বসিলেন।

দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “যেদিন রাত্রে তোমার বিবি সাহেবা পলাইয়া যায়, সেদিনকার সমুদয় কথা তোমার এখন বেশ মনে আছে?”

সাখিয়া বলিল, “তা, আর মনে নাই? এই ত সেদিনকার কথা! খুব মনে আছে।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি মনে আছে, বল? সেদিনকার কি জান তুমি?”

সাখিয়া। (চিন্তিতভাবে) সেদিন রাজাব-আলির বাড়ীতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল।

দেবেন্দ্র। কে নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছিল?

সাখি। দুজনেই।

দে। দুইজন আবার কে?

সাখি। বিবি সাহেবা আর জোহেরা বিবি—দুজনেই নিমন্ত্রণে গেছ্লেন।

দে। সেখান হ’তে তাঁরা কখন ফিরলেন?

সাখি। রাত তখন দশটা-কি সাড়ে দশটা হবে! সেদিন বিবি সাহেবার তবিয়ৎ আচ্ছা ছিল না— বড় মাথা ধরিয়াছিল।

দে। আর কিছু ধরিয়াছিল?

লতি। (সহসা মাঝখান হইতে হাসিয়া বলিয়া উঠিল) আর ভূতে ধরিয়াছিল!

দে। আপনি চুপ করুন। (সাখিয়ার প্রতি) মাথা ধরায় তোমার বিবি সাহেবা বড়ই কাবু হইয়া পড়িয়াছিলেন; তাহাতে বোধ হয়, বাড়ীতে আসিয়াই শয়ন করিতে গিয়াছিলেন?

সাখি। না—তা’ ঠিক নয়। আর একজন কে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য এসে ব’সে ছিল, তারই সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।

দে। কে সে?

সাখি। তা’ আমি জানি না।

দে। কোন স্ত্রীলোক না কি?

সাখি। তা’ নয় ত আর কি—রাত এগারটার সময়ে পুরুষ মানুষের সঙ্গে কি—

লতি। (বাধা দিয়া) তোমার বিবি সাহেবার পক্ষে সেটা বড় আশ্চর্য্য নয়।

দে। কে সে স্ত্রীলোক? তাহাকে তুমি দেখিয়াছ?

সাখি। দেখিয়াছি।

দে। কি রকম দেখতে? বয়স কত?

সাখি। তা’ আমি কি ক’রে জানব? আমি তার মুখ দেখতে পাইনি—ঘোম্‌টায় মুখখানা একেবারে ঢাকা ছিল! বয়সও কিছু ঠাহর কর্‌তে পারিনি।

দে। তাহার কাপড়-চোপড় কি রকম?

সাখিয়া কি উত্তর করে শুনিবার জন্য কৌতূহলপূর্ণহৃদয়ে লতিমন সোৎসুকে তাহার মুখের দিকে চাহিল।

সাখি। সবই নীলরঙের-রেশমী কাপড়জামা সব। যে ওড়নাতে মুখখানা ডাহা ছিল, তাও নীলরঙের; তাতে আবার যে রেশমের চমৎকার ফুল-লতার কাজ, তেমন আমি—

লতিমন বাইজীকে আর শুনিতে হইল না। আকুলভবে বলিয়া উঠিল, “তবেই হয়েছে—সে আমাদেরই দিলজান।”

সাখিয়া প্রতিধ্বনি করিয়া বলিয়া উঠিল, “দিলজান! তা’ কেমন ক’রে হবে—আমাদের বাড়ীতে দিলজান-ফিলজানের পা বাড়াতে সাহস হবে না। সে নিশ্চয় কোন বড়লোকের মেয়ে—দিলজান কখনই নয়।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান বটে, সেই নীলবসনা সুন্দরী—দিলজান ছাড়া আর কেহই নহে।”

“কখনই নয়,” বলিয়া সাখিয়া লাফাইয়া উঠিল। বলিল, “কখনই সে দিলজান নয়।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তা’ না হউক, সে কথা যাক্—”

সাখিয়া বলিল, “সে কথা যাবে কেন—সে যদি দিলজানই হয়—তাতে দোষই বা হয়েছে কি?”

দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সাখিয়া বড় ঝগড়াটে। তাহাকে রাগান ঠিক নহে। বলিলেন, “সে কথা যাক, সে দিলজানই হবে—তাতে আর হয়েছে কি? তাহার পর তুমি আর কি দেখিয়াছ, বল? সেই স্ত্রীলোকটি কখন গেল?

সাখি। স্ত্রীলোকটি আবার কেন? দিলজান।

দে। ভাল আপদ! সেই দিলজান কখন গেল? তোমার বিবি সাহেবার কাছে সে কি জন্যে গিয়াছিল?

সাখি। তা’ আমি কেমন ক’রে জানব্? আমার তাতে কি দরকার?

দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সাখিয়াকে রোগে ধরিয়াছে—এখন কোন প্রশ্ন করিতে গেলেই সে ফোঁস করিয়া উঠিবে। বলিলেন, “তোমার তা’ জেনে দরকার নাই। তুমি যা’ জান তুমি যা’ দেখেছ, তাই বল? আমি কোন কথা জিজ্ঞাসা করতে চাহি না।”

সাখিয়া বলিতে লাগিল, “সে দিলজান কি—কে, জানি না বাবু, তার সঙ্গে বিবি সাহেবা দেখা করতে গেলেন। জোহেরা বিবি আপনার মহলে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি শুতে যেতে পারলেম না—কি জানি-কি হুকুম হবে—জেগে ব’সে থাকলেম। তা’ আর কোন হুকুম হয় নি। অনেকক্ষণ তাদের কথাবার্ত্তা হ’ল, তা আমি জানি না; প্রায় একঘণ্টা পরে সে চ’লে গেল।”

দে। কে? দিলজান?

সাখি। দিলজান কি—কে জানি না, সেই নীলরঙের কাপড় পরা মেয়েটি। তারপর আমি বিবি সাহেবার শোবার ঘরের দিকে গেলাম। দেখি, তিনি কবাট বন্ধ ক’রে শুয়ে পড়েছেন। আমি নীচে নেমে এসে যে দু-একটা কাজ বাকী ছিল, শেষ ক’রে ফেললেম। প্রায় রাত বারটা বেজে গেল। কাজ-কর্ম্ম সেরে যখন উপরে আসি, তখনও দেখি, আমাদের বিবি সাহেবার কবাট বন্ধ। আমিও নিজের ঘরে গিয়ে কবাট বন্ধ ক’রে শুয়ে পড়লেম। তার পর বিবি সাহেবা কখন উঠে গিয়েছেন, তা’ বিবি সাহেবাই জানেন।

দে। তাহা হইলে তোমার বিবি সাহেবা রাত বারটা পর্য্যন্ত নিশ্চয়ই বাড়ীতে ছিলেন?

সাখি। রাত বারটার মধ্যে কি ক’রে বাড়ী থেকে যাবেন? তখন সকলেই জেগে—চারিদিকে লোকজন, চাকর-বাকর—তা’ হলে ত তখনই ধরা পড়তেন। সকলে ঘুমুলে কখন চুপি চুপি উঠে গেছেন। আমার বোধ হয়, শেষরাত্রে উঠে গেছেন।

দে। রাত বারটার মধ্যে যে তিনি বাড়ী ছাড়েন নাই, তা’ তুমি বেশ জান?

সাখি। আমি কি মিথ্যাকথা বলছি? আমি তেমন মেয়ে নই। যা’ বলব—তা’ স্পষ্ট মুখের উপরেই বলব।

দেবেন্দ্রবিজয় আপন-মনে বলিলেন, “সাখিয়ার মুখে এখন যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে রাত বারটার পর সেদিন মজিদের সঙ্গে যে স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল, সে সৃজান বিবি নয়। আমারই অনুমান ঠিক, মজিদের আর অস্বীকার করিলে চলিবে না—সে নিশ্চয় দিলজান ভিন্ন আর কেহই নহে।”

সাখি। আর কি মশাই—যা’ আমি জানি সবই ব’লে দেয়েছি—আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে?

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আছে বৈ কি—তোমার বিবি সাহেবা কেমন দেখতে ছিলেন, বল দেখি?”

সাখিয়া বলিল, “তুমি কি রকম ভদ্রলোক, মশাই! ভদ্রঘরের মেয়ের রূপের খোঁজে তোমার কি দরকার? সে সব কথা আমি কিছুই জানি না। এ সব—”

সাখিয়া আরও কিছু বলিতে যাইতেছিল, এমন সময়ে দিলজানের ফোটোগ্রাফখানি তাহার চঞ্চল দৃষ্টিপথে পড়িল। সুর বদলাইয়া বলিল, “এই যে, আপনি আমাদের বিবি সাহেবের একখানি তসবীরও যোগাড় করেছেন!”

দেবেন্দ্রবিজয় তাড়াতাড়ি দিলজানের ফোটোগ্রাফখানি সাখিয়ার হাতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানি তোমার বিবি সাহেবার তসবীর না কি?”

সাখিয়া তসবীর দেখিতে দেখিতে বলিল, “হাঁ, এ আমাদের বিবি সাহেবারই তসবীর। মুন্সী সাহেব বুঝি, বিবি সাহেবার সন্ধান কররার জন্য আপনাকে একখানা তসবীর দিয়েছেন?”

লতিমন বলিল, “আরে পোড়ার-মুখী সাখি, তুই কি আজকাল চোখেও কম দেখিস্ নাকি? এ যে আমাদের দিলজানের তসবীর।”

সাখিয়া বলিল, “আমি চোখে কম দেখতে যাব কেন? যে আমাকে ‘কম দেখে’ বলে, সে নিজে দু’চোখ কাণা। কে জানে কে তোমার দিলজান—তার মুখে আগুন, এ তসবীর তার হ’তে যাবে কেন? এ ত আমাদের বিবি সাহেবার তসবীর।”

লতিমন ছাড়িয়া কথা কহিবার পাত্রী নহে। বলিল, “কে জানে, কে তোমার বিবি সাহেবা—মুখে আগুন তার! এ আমাদের দিলজানের তসবীর।”

দেখিয়া-শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় অবাক্! এবার তিনি ইহার মুখের দিকে চাহেন, একবার উহার মুখের দিকে চাহেন—কেহই কম নহেন, উভয়েরই মুখের স্রোত সমান। গতিক বড় ভাল নয় দেখিয়া, ফটো দুইখানি ও সেই পত্রের তাড়াটি নিজের পকেটের ভিতরে পুরিয়া ফেলিলেন। অমনি সেই সঙ্গে দুইটি টাকা পকেট হইতে বাহির করিয়া সাখিয়ার হাতে দিতে—যেন জ্বলন্ত আগুনে জল পড়িল; ঝগড়া ভুলিয়া সাখিয়া পরমানন্দে সেই টাকা দুটি বাজাইয়া আঁচলের খুঁটে বাঁধিতে লাগিল। তাহার সুর এবার একেবারে বদলাইয়া গেল—কতমতে সে দেবেন্দ্রবিজয়ের ভদ্রলোকত্ব সপ্রমাণ করিতে লাগিল।

দেবেন্দ্রবিজয় তাহাতে কর্ণপাত করিলেন না। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে—সৃজান ও মৃজান উভয়েরই আকৃতি এরূপ সৌসাদৃশ্য থাকিবার কারণ কি? নিশ্চয়ই তাহারা উভয়ে একরকম দেখিতে; নতুবা একজনের ফটোগ্রাফ লইয়া লতিমন ও সাখিয়ার এরূপ গোলযোগ বাধিবে কেন? দিলজান সৃজানের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল, এবং উভয়ের নামেও অনেকটা মিল আছে। বোধ হয়, সৃজান দিলজানের কোন নিকট-আত্মীয়া হইবে। উভয়ের মধ্যে একটা কিছু সম্পর্ক থাকা খুবই সম্ভব; নতুবা বারনারী হইয়া দিলজান সৃজানের সহিত দেখা করিতে সাহসী হইবে কেন? এখন দিলজান ওরফে মৃজানের গোড়ার খবরগুলি আমার সংগ্রহ করা চাই। সেজন্য আপাততঃ খিদিরপুরে গিয়া মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত একবার সাক্ষাৎ করা বিশেষ প্রয়োজন হইতেছে। যে ব্যক্তি এই ফটোগ্রাফ তুলিয়াছে ইতোমধ্যে একবার তাহারও সহিত দেখা করিতে হইবে।