☼ পাঁচকড়ি দে ☼
নীলবসনা সুন্দরী
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
কারণ–দুর্জ্ঞেয়
হরিপ্রসন্ন বাবু আর কালবিলম্ব না করিয়া মজিদ খাঁর বাসাতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হামিদা তখন বাড়ীতেই ছিল। হরিপ্রসন্ন বাবু হামিদাকে ডাকিয়া বলিলেন, “আমাকে একবার মজিদ খাঁর ঘরে লইয়া চল। বিশেষ আবশ্যক আছে।”
হামিদা বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবুকে চিনিত। খুব খাতির করিয়া তাঁহাকে মজিদ খাঁর ঘরে লইয়া গিয়া বসাইল।
বসিয়া হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আমি তোমাকে দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই। যাহা জান, সত্য বলিবে।”
হামিদা বলিল, “আপনার সঙ্গে মিথ্যাকথা কি, মশাই? আমি মিথ্যাকথা কখনও কহি না—আমাকে এখানকার সকলেই জানে।”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “মজিদ খাঁর ঘর কে পরিষ্কার করে?”
হামিদা বলিল, “আমি—আর কে করবে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “মনে পড়ে, তুমি এ ঘরে কখনও একখানা বাঁটভাঙ্গা ছুরি টেবিলের উপরে প’ড়ে থাকতে দেখেছ?”
হামিদা অঙ্গুলীতে অঞ্চল জড়াইতে জড়াইতে চিন্তা করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে বলিল, “হাঁ, একখানা বাঁটভাঙ্গা ছুরি দেখেছি বটে।”
হরি। কতদিন পূর্ব্বে?
হামি। বেশি দিন না—এই সেদিন হবে। কোন্ দিন তা, ঠিক আমার মনে হচ্ছে না। একদিন সন্ধ্যার সময়ে খাঁ সাহেব বাড়ীতে এলেন। এসেই পকেট থেকে একখানা ভাঙ্গা ছুরি বের ক’রে এই টেবিলের উপরে রাখলেন— আমি তখন এই ঘরটা পরিষ্কার করছিলেম। তার পর তিনি গা ধুতে নীচে চ’লে গেলেন; তখনই তাড়াতাড়ি গা ধুয়ে উপরে উঠে এলেন, আবার কাপড়-চোপড় প’রে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময়ে আমাকে খানা তৈয়ারী রাখতে মানা ক’রে দিলেন। বললেন, “ফিরতে অনেক রাত হবে, হোটেলেই খাবেন,” আমার তা’ বেশ মনে আছে।
হরি। ছুরিখানা কি তখনও টেবিলের উপরেই প’ড়ে ছিল?
হামি। সেই ছুরিখানা? হাঁ, টেবিলের উপরেই পড়েছিল বৈকি। তা’ আমি সেখানা একখানা ছবির পাশে তুলে রেখে দিই। কেন—কি হয়েছে?
হরি। রাত্রে মজিদ খাঁ ফিরে এসেছিল?
হামি। হাঁ, অনেকরাত্রে। রাত তখন শেষ হ’য়ে এসেছে।
হরি। তখন মজিদের মেজাজ্ কেমন ছিল?
হামি। বড় ভাল নয়—মুখ চোখের ভাবে আমি তা’ বেশ বুঝতে পারলেম। বাড়ীর ভিতরে এসে সরাসর উপরে উঠে গেলেন। এমন কি আমাকে সামনে দেখতে পেয়েও আমার সঙ্গে একটী কথা কহিলেন না।
হামিদার নিকটে আর বিশেষ কিছু সংবাদ পাওয়া গেল না। হরিপ্রসন্ন বাবু হামিদার বাটী ত্যাগ করিয়া পুনরায় জোহেরার সহিত দেখা করিতে তাহাদিগের বাড়ীর দিকে চলিলেন।
অনন্তর জোহেরার সহিত দেখা করিয়া তিনি হামিদার প্রমুখাৎ যাহা কিছু শুনিয়াছিলেন সমুদয় তাহাকে বুঝাইয়া দিলেন। তাহার পর বলিলেন, এখন বুঝিতে পারিতেছ, মজিদ খাঁর অনুকূলে একটা খুবই প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। মজিদ খাঁ এই ছুরি দ্বারা দিলজানকে খুন করে নাই, তাহা এখন আমি হামিদাকে দিয়া সপ্রমাণ করিতে পারিব।”
জোহেরা বলিল, “তাহাতে এখন আমাদের এমন বিশেষ কি কাজ হইবে? ঐ ছুরিতে খুন না করিলেও, তিনি অপর ছুরি দ্বারা দিলজানকে খুন করিয়াছেন, এই কথাই এখন তাঁহার বিপক্ষেরা বলিলেন।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাহা হইলেও ত মোকদ্দমা অনেকখানি হালকা হইয়া গেল। দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃঢ় ধারণা, ঐ ছুরি দ্বারা দিলজান খুন হইয়াছে। মজিদ যে এই খুন করিয়াছে, তিনি এ পর্য্যন্ত তাহার আর এমন কোন কারণ দেখিতে পান নাই। কেবল ওই ছুরিখানা মজিদের ঘরে পাওয়ায় তিনি সন্দেহের বশেই তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন।”
জো। তবে এখন উপায়?
হ। উপায় আমি করিতেছি। মুন্সী সাহেব এখন বাড়ীতে আছেন কি?
জো। আছেন। সৃজান বিবি গৃহত্যাগ করার পর তিনি আর বাহিরে যান না, কাহারও সহিত দেখাও করেন না— দিনরাত উপরের বৈঠকখানায় একা ব’সে থাকেন।
হ। তাঁহার সহিত একবার দেখা করিতে হইবে।
জো। কেন?
হ। সৃজান বিবির সম্বন্ধে দুই-একটি কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাস্য আছে। সৃজান বিবি কখন গৃহত্যাগ করিয়াছিল, কখন তিনি তাহা প্রথম জানিতে পারিলেন—
জো। (বাধা দিয়া) তাহাতে কি উপকার হইবে? সে সম্বন্ধে বোধ হয়, তিনি আপনাকে বিশেষ কিছু বলিতে পারিবেন না। হয় ত রাগও করিতে পারেন। আপনি জনিতে চাহেন, সৃজান বিবি গৃহত্যাগের পর মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিল কি না—যদিই সেখানে গিয়া থাকে, তাহাতে আমাদের এমন কি উপকার হইবে?
হ। তোমার বয়স কম, বুদ্ধিও সেরূপ অপরিপক্ক—কি উপকার হইবে কি না, তুমি তাহার কি বুঝিবে? ইহাতে হয়তো পরে কেস্টা এমন হইয়া যাইতে পারে যে, তখন মজিদ খাঁকে নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন করিতে আর আমাদিগকে বিশেষ কষ্ট স্বীকার করিতে হইবে না।