চতুর্থ পরিচ্ছেদ
মনে মনে নানা ভাবের প্রাবল্য
দেবেন্দ্রবিজয় তাড়াতাড়ি গ্রেপ্তার করিলেন বটে, কিন্তু মজিদ দোষী কি নির্দ্দোষ, তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার মনের ভিতরে সেই সন্দেহ পূর্ব্ববৎ রহিল। যে ছুরিতে খুন হইয়াছে, সেই ছুরিখানি মজিদ খাঁর গৃহে পাওয়া গিয়াছে—ইহা একটা খুনের বিশিষ্ট প্রমাণ বটে; এবং এই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়াই তিনি মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন; কিন্তু মজিদ যে দিলজানকে খুন করিয়াছেন, তাহার কোন সুবিধাজনক কারণ দেখিতে পাইলেন না। তিনি বুঝিয়াছিলেন, এ খুনটা অত্যন্ত জটিল রহস্যে পূর্ণ—ইহার স্থির-সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও কঠিন। এরূপ স্থলে এখন যাহার উপরে একটুমাত্র সন্দেহ হইবে, তাহাকে ধরিয়া নাড়াচাড়া দিতে হইবে—নতুবা সহজে রহস্যোদ্ভেদ হইবে না; সেইজন্য দেবেন্দ্রবিজয় মজিদ খাঁকে ঠিক দোষী বলিয়া বুঝিতে না পারিলেও তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা যুক্তিসঙ্গত বোধ করিয়াছিলেন। যেমন সেই ছুরিতে একদিকে মজিদের উপরে দেবেন্দ্রবিজয়ের সন্দেহ প্রবল হইয়াছে; আর একদিকে শ্রীশ প্রমুখাৎ মজিদ ও জোহেরার কথোপকথন সম্বন্ধে যাহা তিনি শুনিয়াছিলেন, তাহাতে মজিদের উপর হইতে সন্দেহটা কিছু হাল্কা হইয়াও গিয়াছে। মজিদের কথার ভাবে বুঝা যায়, তিনি নিজেই মনিরুদ্দীনকে সন্দেহ করিতেছেন। দেবেন্দ্রবিজয় আবার ভাবিলেন, “এমনও হইতে পারে, মজিদ জোহেরাকে মিথ্যা বলিয়াছে—আত্মদোষ ক্ষালনার্থে অনেকেই পরের উপর ঝোঁক্ দিয়া থাকে। মজিদ হয় দোষী, না হয় কোন-না-কোন রকমে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আছেন। আরও বেশ বুঝা যাইতেছে, সৃজান বিবির গৃহত্যাগের সহিত এই খুনের মামলার কিছু সংশ্রব আছে। খুনের রাত্রে যে স্ত্রীলোক সৃজান বিবির সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল, সে কে? দিলজান? দিলজান কেন তাহার সহিত দেখা করিতে যাইবে? দিলজানের কি সহসা এতখানি সাহস হইতে পারে? সে বারাঙ্গনা—মুন্সী জোহিরুদ্দীনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে। তবে এরূপও হইতে পারে, সৃজান বিবি তাহার মনিরুদ্দীনকে কাড়িয়া লইতেছে দেখিয়া, সে সৃজান বিবিকে দুই একটা কঠিন কথা শুনাইয়া দিবার লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই। এইরূপ গাত্রদাহ উপস্থিত হইলে রমণীমাত্রেই দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে; এবং তখন তাহাদের ভালমন্দ বিবেচনা করিবার ক্ষমতা থাকে না। আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই সে দিলজান। দেখিতেছি, এ রহস্য-সমুদ্রের তলদেশ পর্য্যন্ত আমাকে নামিতে হইবে।” মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বাটী হইতে সাধারণ ভদ্রলোকের মত সাদাশিধে পোষাকে বাহির হইয়া পড়িলেন; এবং লতিমন বাইজীর বাটী-অভিমুখে চলিলেন।
লতিমন বাইজী এবার দেবেন্দ্রবিজয়কে খুব খাতির করিয়া নিজের ঘরে লইয়া বসাইল। লতিমন দিলজানকে খুব ভালবাসিত। যাহাতে তাহার হত্যাকারী শীঘ্র ধরা পড়িয়া স্ব-কৃত পাপের ফলভোগ করে, তাহাতে লতিমন বাইজীরও খুব আগ্রহ দেখা গেল। এক্ষণে সে দেবেন্দ্রবিজয়কে প্রচুর সাহায্য করিতেও প্রস্তুত। প্রথম হইতেই সে অযাচিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের প্রতি বহুবিধ উপদেশ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় তাহাতে কাজের কথা কিছুও পাইলেন না। তিনি নিজের একেবারে নিজের কথাই পাড়িলেন! বলিলেন, “সেদিন রাত্রে দিলজান বাটী হইতে বাহির হইয়া যাইবার সময়, কোথায় সে যাইতেছে, সে সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলিয়া গিয়াছিল?”
লতিমন বলিল, “তাহা ত আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়াছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “কেবল মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে— আর কোথায় নহে কি?”
লতি। কই, আমাকে আর কোনখানে যাইবার কথা কিছু বলে নাই।
দেবেন্দ্র। নাই বলুক—তার ভাব-গতিক দেখিয়া ত কোন কথায় আপনি কি তখন এরূপ একটা অনুমান করিতে পারেন নাই যে, দিলজান সৃজান বিবির নিকটেও যাইবে?
লতি। (সবিস্ময়ে) সৃজান বিবি! সৃজান বিবির কাছে সে কি করিতে যাইবে?
দে। কি করিতে যাইবে, তা’ আমি কি করিয়া বলিব? আমার ধারণা যাহা হউক, একটা—কিছু করিতে সে গিয়াছিল।
দেবেন্দ্রবিজয়, মজিদ ও জোহেরার সেই কথোপকথনের সারাংশ লতিমন বাইজীকে শুনাইয়া দিলেন। বাইজী এতক্ষণে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সব শুনিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তা’ হবে—আর্শ্চয্য কি! আমি ত ইহার কিছুই জানি না।”
দে। তা’ না জানেন—ক্ষতি নাই। মুন্সী জোহিরুদ্দীনের বাড়ীর দাসী-বাঁদীদের কাহাকেও আপনি চিনেন কি?
লতি। চিনি। একজনকে আমি খুব চিনি, সে আমার এখানে দুই-তিন মাস কাজ করিয়া গিয়াছে। তার নাম সাখিয়া—সে এখন খোদ সৃজান বিবিরই বাঁদী।
দে। (সাগ্রহে) বটে! তবে সে নিশ্চয় অনেক খবরই রাখে। কোন রকমে এখন তাকে এখানে যদি একবার আনাইতে পারেন, তাহা হইলে আমার অনেকটা উপকার হয়। তাহার মুখ হইতে সকল কথাই আমি বাহির করিয়া লইতে পারি।
লতি। কেন পারিব না? আমার কথা সে কখনই ঠেলিবে না। এখন কর্ত্রী নাই, কাজকর্ম্মও তার হাতে বিশেষ কিছু নাই; খবর পাইলে এখনই সে আসিবে। আমি তার কাছে লোক পাঠাইতেছি।
দে। এখনই একজন লোক পাঠাইয়া দিন্, বিলম্ব করিবেন না। যতক্ষণ না সে আসে, ততক্ষণ আমাকে তাহার অপেক্ষায় এখানেই বসিয়া থাকিতে হইবে।
“আচ্ছা, আমি এখনই ইহার বন্দোবস্ত করিতেছি,” বলিয়া লতিমন ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। যেমন সে দ্বারের নিকট গিয়াছে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, “দাঁড়ান, আর একটা কথা আছে।”
লতিমন ফিরিয়া দাঁড়াইল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমি দিলজানের ঘরটা একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে চাই; বিশেষতঃ বাক্স-দেরাজগুলি আমাকে একবার ভাল করিয়া দেখিতে হইবে।”
শিহরিত হইয়া সভয়ে লতিমন বলিল, “কেন, বাক্স-দেরাজ দেখিয়া কি হইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দেরাজ-বাক্সে লোকে অনেক রকম জিনিষ রাখে। গুপ্তচিঠি-পত্রও থাকিতে পারে, বিশেষতঃ কোন গুরুতর কারণ উপস্থিত না হইলে স্ত্রীলোক সহজে চিঠি-পত্র নষ্ট করে না। প্রেমপত্রাদি আরও যত্নপূর্ব্বক রক্ষা করে। যদি দিলজানের সেই রকম দুই-একখানা চিঠিপত্র পাওয়া যায়, হয়ত তাহা হইতে দিলজানের পূর্ব্ব-জীবনের অনেক কথা প্রকাশ পাইতে পারে। আর কোন উদ্দেশ্যে কে তাহাকে খুন করিয়াছে, তাহাও জানা যাইতে পারে। আমাদের দেখা আছে, গুপ্তচিঠিপত্রে অনেক সময়ে অনেক কাজ হয়।”
চিন্তিতভাবে লতিমন ক্ষণপরে কহিল, “তাহা হইলে মজিদ খাঁকে খুনী বলিয়া আপনার বোধ হয় না?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সে কথা এখন কিরূপে বলিব? আমি এখন কোন কারণ খুঁজিয়া পাই না, যাহাতে মজিদ দিলজানকে খুন করিয়াছে বলিয়া একটা স্থির-সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি। মজিদ দিলজানকে কেন খুন করিবে? অবশ্যই ইহার ভিতরে একটা অভিপ্রায় থাকা চাই—হাসি-তামাসার কথা নহে—খুন। চলুন, এখন আপনি আমাকে একবার দিলজানের ঘরে লইয়া চলুন দেখি।”
একটু ইতস্ততঃ করিয়া লতিমন কহিল, “সে কাজটা কি ঠিক হয়? আমার বিবেচনায় পরের বাক্স-দেরাজটা খোলা—”
দেবেন্দ্রবিজয় উচ্চহাস্য করিয়া, বাধা দিয়া বলিলেন, “ক্ষতি কি আছে? আপনার দিলজান ত এ জগতে নাই। তাহার হত্যাকারীকে উপযুক্ত দণ্ড দিবার জন্যই আমরা তার বাক্স-দেরাজ খুলিতে চাই—কোন মন্দ উদ্দেশ্য ত নাই। এই উপলক্ষে হয় ত একজন নির্দ্দোষীর জীবনরক্ষাও হইতে পারে।”
লতিমন আর আপত্তি করিল না। দিলজান যে ঘরে বাস করিত, দেবেন্দ্রবিজয়কে সেখানে লইয়া গেল। দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বে আর একবার মাত্র এই ঘরে আসিয়া ছিলেন। সেইদিন এই ঘরেই তিনি সেই বিষাক্ত ছুরি পাইয়াছিলেন। পাঠক তাহা অবগত আছেন।
দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমেই দিলজানের বাক্সের ডালা ও দেরাজের ড্রয়ারগুলি টানিয়া দেখিতে লাগিলেন,—সকলগুলিই চাবি বন্ধ। লতিমনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কাছে দিলজান চাবি রাখিয়া গিয়াছিল?”
লতিমন বলিল, “না, কেবল ঘরের চাবি আমার কাছে দিয়া গিয়াছে, আর সব চাবি তাহারই সঙ্গে ছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিত হইলেন। তাহার পর বলিলেন, “চাবি না থাকে, আপনি এক কাজ করুন আমাকে খানিকটা লোহার তার আনিয়া দিন, ছাতা ভাঙ্গা লোহার শিক্ একটু যদি আনিতে পারেন, খুব সুবিধা হয়।”
“যাই—খুঁজিয়া দেখি, আর অমনি সাখিয়াকে আনিবার জন্য একজন বান্দাকেও পাঠাইয়া দিয়া আসি,” বলিয়া লতিমন ঘরের বাহির হইয়া গেল। এবং ক্ষণপরে একটী ছাতার শিক ও খানিকটা লোহার তার লইয়া ফিরিয়া আসিল।
দেবেন্দ্রবিজয় লোহার তার ও শিক হাতে লইয়া জিজ্ঞাসিলেন, “সাখিয়ার কাছে খবর গেল?”
লতিমন কহিল, “হাঁ, খবর পাঠাইয়াছি।”