কবিকে আমি শেষ বার সুস্থ অবস্থায় দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনিলাম মুসলিম-হলে কবি আসিবেন ভোর আটটায়। কিন্তু কবি আসিলেন বেলা দশটায়। সময়-অনুবর্তিতার জ্ঞান কবির কোনদিনই ছিল না। নোঙরহীন নৌকার মত তিনি ভাসিয়া বেড়াইতেন। সেই নৌকায় যে-কেহ আসিয়া হাল ঘুরাইয়া কবির গতি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিত। এক জায়গায় যাইবার জন্য তিনি যাত্রা করিলেন, তাহার গুণগ্রাহীরা তাহাকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য স্থানে লইয়া গেলেন। এজন্য কবিকেই আমরা দায়ী করিয়া থাকি। যবনিকার অন্তরালে থাকিয়া যাহারা কবিকে নিয়ন্ত্রিত করিতেন, তাঁহারা কোনদিনই দায়ী হইতেন না। শিশুর মত আপন-ভোলা কবিকে সে জন্য কত লোকের বিরাগভাজন হইতে হইয়াছে।

আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রূপে দেখিয়া কবি কত সুখী হইলেন। তিনি আমার কানে কানে বলিলেন, “মায়েরা ছেলেদের প্রতি যে স্নেহ-মমতা ধারণ করে, তোমার চোখে-মুখে সমস্ত অবয়বে সেই স্নেহ-মমতার ছাপ দেখতে পেলাম।”

কবি আসিয়াই তাহার স্বভাবসিদ্ধ রূপে ছেলেদের সামনে কবিতাগান আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। আমার ক্লাস ছিল, ঘণ্টাখানেক থাকিয়া আমি চলিয়া গেলাম।

দুপুরবেলা ক্লাস করিতেছি, দেখিলাম ক্লাসে ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। মেয়েরা সবাই অনুপস্থিত। কারণ অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, ফজলুল হক হলে নজরুল আসিয়াছেন। সবাই তাহার বক্তৃতা শুনিতে গিয়াছে। বেলা তিনটার সময় ফজলুল হক-হলে গিয়া দেখি, ছেলে-মেয়েদের চাহিদা অনুসারে কবি গানের পর গান গাহিয়া চলিয়াছেন, কবিতার পর কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিয়াছেন। কবির মুখ শুষ্ক; সমস্ত অঙ্গ ক্লান্তিতে ভরা। খোঁজ লইয়া জানিলাম— সেই যে সকাল দশটায় কবি আসিয়াছেন, বারোটা পর্যন্ত মুসলিম-হলে থাকিয়া তারপর ফজলুল হক-হলে আগমন করিয়াছেন—ইহার মধ্যে কয়েক পেয়ালা চা আর পান ছাড়া কিছুই কবিকে খাইতে দেওয়া হয় নাই। আমার তখন কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এই অবুঝ বয়স্ক-শিশুটিকে লইয়া ছেলেরা কী নিষ্ঠুর খেলাই না খেলিতেছে! কিন্তু অবেলায় কোথাও কিছু খাবার পাইবার উপায় ছিল না। আমি এক রকম জোর করিয়াই সভা ভাঙিয়া দিলাম। খাওয়ার ব্যাপারটা আমি যে এত বড় করিয়া ধরিয়াছি, এজন্য কবি খুব খুশী হইলেন না। দোকান হইতে সামান্য কিছু খাবার আনাইয়া বহু সাধ্যসাধনায় কবিকে খাওয়ান গেল।

সেবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা করিবার সময় আমি কবির বাক্যের ভিতরে কতকটা প্রলাপ-উক্তির আভাস পাইয়াছিলাম। এক জায়গায় কবি বলিয়া ফেলিলেন, “আমি আল্লাকে দেখেছি। কিন্তু সে সব কথা বলবার সময় এখনও আসে নাই। সে সব বলবার অনুমতি যেদিন পাব, সে দিন আবার আপনাদের সামনে আসব।”

ইহার কিছুদিন পরেই শুনিলাম, কবি পাগল হইয়া গিয়াছেন। অসুস্থ অবস্থায় কবিকে দেখিবার জন্য বহুবার কবি-গৃহে গমন করিয়াছি। আগে তিনি আমাকে দেখিলে চিনিতে পারিতেন; আমার আব্বা কেমন আছেন, ছেলেরা কেমন আছে, জিজ্ঞাসা করিতেন। এখন আর চিনিতে পারেন না। কবির কোন কবিতা আবৃত্তি করিলে কবি বড়ই সুখী হন। কিছু খাইতে দিলে খুশী হইয়া গ্রহণ করেন।

কবির শাশুড়ী খালাআম্মার বিষয়ে আমাদের সমাজে প্রচুর বিরূপ আলোচনা হইয়া থাকে। এই নিরপরাধ মহিলার বিষয়ে কিছু বলিয়া প্রসঙ্গের শেষ করিব।

একদিন বেলা একটার সময় কবি-গৃহে গমন করিয়া দেখি, খালআম্মা বিষণ্ণ বদন বসিয়া আছেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার মুখ আজ বেজার কেন?”

খালাআম্মা বলিলেন, “জসীম, তোমারা জান, সব লোকে আমার নিন্দা করে বেড়াচ্ছে। নুরুর নামে যেখান থেকে যত টাকা-পয়সা আসে, আমি নাকি সব বাক্সে বন্ধ করে রাখি। নুরুকে ভালমত খাওয়াই না, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি না। তুমি জান, আমার ছেলে নেই; নুরুকেই আমি ছেলে করে নিয়েছি। আর, আমিই বা কে! নুরুর দু’টি ছেলে আছে—তারা বড় হয়ে উঠেছে। আমি যদি নুরুর টাকা লুকিয়ে রাখি, তারা তা সহ্য করবে কেন? তাদের বাপ খেতে পেল কিনা, তারা কি চোখে দেখে না। নিজের ছেলের চাইতে কি কবির প্রতি অপরে দরদ বেশী? আমি তোকে বলে দিলাম, জসীম এই সংসার থেকে একদিন আমি কোথাও চলে যাব। এই নিন্দা আমি সহ্য করতে পারি নে।”

এই বলিয়া খালাআম্মা কাঁদিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম, “খালাআম্মা, কাঁদবেন না একদিন সত্য উদ্ঘাটিত হইবেই।”

খালাআম্মা আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গেলেন, যে ঘরে নজরুল থাকিতেন সেই ঘরে। দেখিলাম, পায়খানা করিয়া কাপড়-জামা সমস্ত অপরিষ্কার করিয়া কবি বসিয়া আছেন। খালাআম্মা বলিলেন, “এই সব পরিষ্কার করে স্নান করে আমি হিন্দু-বিধবা তবে রান্না করতে বসব। খেতে খেতে বেল পাঁচটা বাজবে। রোজ এই ভাবে তিন-চার বার পরিষ্কার করতে হয়। যারা নিন্দা করে তাদের বোলো, তারা এসে যেন এই কাজের ভার নেয়। তখন যেখানে চক্ষু যায়, আমি চলে যাব।”

তখন বুঝতে পারি নাই, সত্য সত্যই খালা-আম্মা ইহা করিবেন।

ইহার কিছুদিন পরে খালাআম্মা সেই যে কোথায় চলিয়া গেলেন, কিছুতেই তাহার খোঁজ পাওয়া যায় নাই। আজ দুই-তিন-বৎসরের উপরে খালা-আম্মা উধাও। কবির দুই পুত্র কত স্থানে তাহার অনুসন্ধান করিতেছে, তাঁহাকে পাওয়া যায় নাই।

দু-একজন কৃত্রিম নজরুল-ভক্তের মুখে আজও খালাআম্মার নিন্দা শোনা যায়। তাঁহারা বলিয়া থাকেন, “নজরুলের টাকা সমস্ত তার শাশুড়ীর পেটে।” বিনা অপরাধে এরূপ শাস্তি পাইতে আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। রক্ষণশীল হিন্দু-ঘরের এই বিধবা নিজের মেয়েটির হাত ধরিয়া একদিন এই প্রতিভাধর ছন্নছাড়া কবির সঙ্গে অকূলে ভাসিতেছিলেন। নিজের সমাজের হাতে আত্মীয়-স্বজনের হাতে সেদিন তাহার গঞ্জনার সীমা ছিল না। সেই লাঞ্ছনা-গঞ্জনাকে তিনি তৃণের মত পদতলে দলিত করিয়াছেন। কিন্তু পরবর্তী নিন্দা অন্য ধরনের। এই নিন্দা তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না।

খালাআম্মা আজ বাঁচিয়া আছেন কিনা জানি না, ইহলোকে বা পরলোকে যেখানেই থাকুন, তিনি যেন তার এই পাতান বোনপোটির একফোটা অশ্রুজলের সমবেদনা গ্রহণ করেন। মুহূর্তের জন্যও যেন একবার স্মরণ করেন, ভাল কাজ করিলে তাহা বৃথা যায় না। খালাম্মার সেই নীরব আত্মত্যাগ অন্তত পক্ষে একজনের অন্তরের বীণায় আজও মধুর সুরলহরে প্রকাশ পাইতেছে।

আমার ভাবী সাহেবার কথা আর কি বলিব! কত সীমাহীন দুঃখের সাগরেই না তিনি ভাসিয়া চলিয়াছেন! অর্ধাঙ্গ হইয়া তিনি বিছানা হইতে উঠিতে পারেন না। তবু মুখে সেই মধুর হাসিটি— যে হাসি সেই প্রথম বধূজীবনে তাঁহার মুখে দেখিয়াছিলাম। যে হাসিটি দিয়া ছন্নছাড়া কবিকে গৃহের লতা শৃঙ্খলে বাঁধিয়াছিলাম। যে হাসিটির বিনিময়ে আকাশের চাঁদ হইতে, সন্ধ্যা-সকালের রঙিন মেঘ হইতে নুড়ি পাথর কুড়াইয়া আপন বুকের স্নেহমমতায় শিশু কুসুমগুলি গড়িয়া কবির কোলে সাজাইয়া দিয়াছিলেন। সেই হাসি এখনও তাঁহার মুখ হইতে ম্লান হইয়া যায় নাই।

রোগগ্রস্ত কবি প্রায় অধিকাংশ সময় ভাবীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া পুরাতন পুস্তকের পাতা উল্টাইতে থাকেন। হায়রে, কবির অতীত জীবন-নাট্যের বিস্মৃত পাতাগুলি আর কি তাহার কাছে অর্থপূর্ণ হইয়া উঠিবে?