নজরুলের জীবন লইয়া অনেক চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি। এই লোকটি আশ্চর্য লোকরঞ্জনের ক্ষমতা লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। যখনই যেখানে গিয়াছেন, যশ অর্থ সম্মান আপনা হইতেই আসিয়া তাঁহার পদতলে লুটাইয়া পড়িয়াছে। রবীন্দ্রনাথ হইতে সত্যেন্দ্রনাথ পর্যন্ত—কবিতা রচনা করিয়া সেকালে অর্থ উপার্জন করিতে পারেন নাই। রবীন্দ্রনাথের বহু পুস্তকের তখন দ্বিতীয় সংস্করণ হইত না। মাসিক পত্রিকার সম্পাদক কবিদের কবিতার জন্য অর্থ তত দিতেনই না—যে সংখ্যায় কবির কবিতা ছাপা হইত, সেই সংখ্যাটি পর্যন্ত কবিকে কিনিয়া লইতে হইত। নজরুলই বোধ হয় বাংলার প্রথম কবি, যিনি কবিতা লিখিয়া মাসিক পত্রিকা হইতেও প্রচুর অর্থ উপার্জন করিয়াছেন।

আগে গ্রামোফোনের জন্য যাহারা গান রচনা করিতেন, গ্রামোফোন কোম্পানীর নিকট হইতে তাহাদের খুব কম লোকই রচনার মূল্য আদায় করিতে পারিতেন। নজরুল গ্রামোফোনের গান রচনা করিয়া শুধু নিজের গানের জন্যেই পারিশ্রমিক আদায় করিলেন না; তাহার আগমনের পর হইতে সকল লেখকই রচনার জন্য উপযুক্ত মূল্য পাইতে লাগিলেন। নজরুল প্রমাণ করিলেন, গানের রেকর্ড বেশী বিক্রয় হয়—সে শুধু গায়কদের সুকণ্ঠের জন্যই নয়, সুন্দর রচনার সহিত সুন্দর সুরের সমাবেশ রেকর্ড বিক্রয়-বাড়াইয়া দেয়। নজরুলের আগমনের পর হইতে গ্রামোফোন কোম্পানী আরও নূতন নূতন রচনাকারীর সন্ধানে ছুটিল, নূতন নূতন সুরসংযোজনকারীর খোঁজে বাহির হইল। নজরুলের রচনা আর সুর লইয়া তাহারা বুঝিতে পরিল, সুন্দর কথার সঙ্গে সুন্দর সুরের সমাবেশ হইলে সেই গান বেশি লোকপ্রিয় হয়। গ্রামোফোনকোম্পানীতে আজ যে এত কথাকার আর এত সুরকার গুঞ্জরণ করিতেছেন, এ শুধু নজরুলের জন্য। একথা কি তাঁহারা কেহ আজ স্বীকার করিবেন?

একটি গান রচনা করা অনেক সময় একটি মহাকাব্য রচনার সমান। মহাকাব্যের লেখক সুবিস্তৃত কাহিনীর পদক্ষেপের মধ্যে আপনার ভাব রূপায়িত করিবার অবসর পান। গানের লেখক মহাকাব্য রচনা করেন অতি-সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথার ভিতর দিয়া। মহাকাব্যের পাঠক বার বার সেই কাব্য পাঠ করেন না; করিলেও সেই কাব্যের ত্রুটি-বিচ্যুতির সন্ধান সহজে পান না। কিন্তু গানের সমঝদার গানটিকে বার বার করিয়া আবৃত্তি করিয়া সেই গানের পুঙ্খানুপুঙ্খ ত্রুটিবিচ্যুতি ও গুণের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই জন্য একটি ভাল গান রচনা করা প্রায় একটি মহাকাব্য রচনার মতই কঠিন। নজরুলের বেলায় দেখিয়াছি, গান রচনা তাঁহার পক্ষে কত সহজ ছিল। তিনি যেন গান রচনা করেন নাই, বালকের মত পুতুল লইয়া খেলা করিয়াছেন। সুরগুলি পাখির মত সহজেই তাহার কথার জালে আসিয়া আবদ্ধ হইয়াছে।

গ্রামোফোন-কোম্পানীতে গিয়া বহুদিন কবিকে গান রচনা করিতে দেখিয়াছি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! এঘরে-ওঘরে গায়কেরা নানা রাগ-রাগিণী ভাজিয়া সুরাসুরের লড়াই বাধাইয়া তুলিয়াছেন, কানে তালা লাগিবার উপক্রম। মাঝখানে কবি বসিয়া আছেন হারোমমানিয়াম সামনে লইয়া। পার্শ্বে অনেকগুলি পান, আর পেয়ালা-ভরা গরম চা। ছয়-সাত জন গায়ক বসিয়া আছেন কবির রচনার প্রতীক্ষায়। একজনের চাই দুইটি শ্যামাসঙ্গীত, অপরের চাই একটি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কীর্তন, একজনের চাই দুইটি ইসলামী সঙ্গীত, অন্যজনের চাই চারিটি ভাটিয়ালী গান, আর একজনের চাই আধুনিক প্রেমের গান। এরা যেন অঞ্জলি পাতিয়া বসিয়া আছেন। কবি তাহার মানস-লোক হইতে সুধা আহরণ করিয়া আনিয়া তাহাদের করপুট ভরিয়া দিলেন।

কবি ধীরে ধীরে হারমোনিয়াম বাজাইতেছেন, আর গুনগুন করিয়া গানের কথাগুলি গাহিয়া চলিয়াছেন। মাঝে মাঝে থামিয়া কথাগুলি লিখিয়া লইতেছেন। এইভাবে একই অধিবেশনে সাতআটটি গান শুধু রচিত হইতেছে না—তাহারা সুর সংযোজিত হইয়া উপযুক্ত শিষ্যের কণ্ঠে গিয়া আশ্রয় লইতেছে। কবির কাব্যের মধ্যে বহু স্থানে বাজে উচ্ছ্বাস ও অসংযমের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু গানের স্বল্পপরিসর আয়তনের মধ্যে আসিয়া কবির রচনা যেন দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছে। কবি যেন তাহার গানের ক্ষুদ্র কৌটার মধ্যে মহাকাশের অনন্ত রহস্য পুরিয়া দিয়াছেন। সেই গান যতই গাওয়া যায়, তাহা হইতে ততই মাধুর্যের ইন্দ্রজাল বিস্তৃত হইতে থাকে। কবির যে গানে রচনার মাধুর্য পাওয়া যায় না, সুরের মাধুর্য সেখানে রচনার দৈন্য পূরণ করে। কবি যখন সাহিত্য করিয়াছেন, সেই সাহিত্যকে তিনি জনসাধারণের উপভোগ্য করিয়া তুলিয়াছেন।

সাহিত্য করিতে করিতে কবি যখন জেলে গেলেন, সেখানেও আত্মসম্মানের মহিমা লইয়া কবি সমস্ত দেশের অন্তর জয় করিয়াছেন। চল্লিশ দিন ব্যাপী অনশনের সুদীর্ঘ বন্ধুর পথে এই নির্ভীক সেনানীর প্রতি পদক্ষেপ তাঁহার দেশবাসীর অন্তর উদ্বেলিত করিয়া তুলিয়াছে। ইদানীং রোগের শর-শয্যায় শয়ন করিয়া কবি দেশবাসীর অন্তরে আরও সমুজ্জল হইয়া বিরাজ করিতেছেন।