একবার পরলোকগত সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে কবি আর হেমন্তকুমার সরকার আমাদের ফরিদপুরে আসিলেন। সরোজিনী নাইডু একদিন পরেই চলিয়া গেলেন। কবিকে আমরা কয়েকদিন রাখিয়া দিলাম।
আমি তখন ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়ি। আমরা সকল ছাত্র মিলিয়া কবিকে কলেজে আনিয়া অভিনন্দন দিব, স্থির করিলাম। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল কামাখ্যাচরণ মিত্র মহাশয় খুশী। হইয়া আমাদের প্রস্তাবে রাজি হইলেন।
খবর পাইয়া ফরিদপুরের পুলিশ-সাহেব আমাদের প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়ের নিকট পত্র লিখিলেন, নজরুলের মতিগতি গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে; তিনি তাঁহার বক্তৃতায় সরলমতি ছাত্রদিগকে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষেপাইয়া তুলিবেন। নজরুলকে যদি কলেজে বক্তৃতা করিতে দেওয়া হয়, তবে সি. আই. ডি. পুলিশদেরও কলেজের সভায় উপস্থিত থাকিতে দিতে হইবে। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল কামাখ্যা বাবুর প্রতিও গভর্নমেন্টের সুনজর ছিল না। বহু বৎসর আগে তিনি পুলিশের কোপদৃষ্টিতে অন্তরীণ ছিলেন। নজরুলকে দিয়া বক্তৃতা করাইলে পরিণামে কলেজের ক্ষতি হইতে পারে বিবেচনা করিয়া তিনি আমাদিগকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “নজরুলকে লইয়া কলেজে যে সভা করার অনুমতি দিয়েছিলাম, তাহা প্রত্যাহার করলাম।”
আমরা মুষড়িয়া পড়িলাম। সবাই মুখ মলিন করিয়া কবির কাছে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদের অবস্থা দেখিয়া কবি বলিলেন, “কুছ পরওয়া নেই। উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে সভা কর। আমি সেইখানে বক্তৃতা দেব।”
তখন আমাদিগকে আর পায় কে! দশ-বিশটা কেরোসিনের টিন বাজাইতে বাজাইতে সমস্ত শহর ভরিয়া কবির বক্তৃতা দেওয়ার কথা প্রচার করিলাম। সন্ধ্যাবেলা অম্বিকা-হলের ময়দান লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার নর-নারী আসিয়া জমায়েত হইলেন কবি-কণ্ঠের বাণী শুনিবার জন্য।
সেই সভায় কবিকে নূতনরূপে পাইলাম। এতদিন কবি শুধু দেশাত্মবোধের কথাই বলিতেন। আজ কবি বলিলেন সাম্যবাদের বাণী। কবি যখন ‘উঠ রে চাষী জগৎবাসী, ধর কষে লাঙ্গল’ অথবা ‘আমরা শ্রমিকদল, ওরে আমরা শ্রমিকদল’—প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সমবেত জনতা কবির ভাব-তরঙ্গের সঙ্গে উদ্বেলিত হইতেছিল। সর্বশেষে কবি তাহার বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতা আবৃত্তি করিলেন। সে কী আবৃত্তি, প্রতিটি কথা কবির কণ্ঠের অপূর্ব ভাবচ্ছটায় উদ্বেলিত হইয়া সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়ে গিয়া ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিতেছিল। মাঝে মাঝে মনে হইতেছিল, কবিকণ্ঠ হইতে যেন অগ্নি-বর্ষণ হইতেছে। সেই আগুনে যাহা কিছু ন্যায়ের বিরোধী, সমস্ত পুড়িয়া ধ্বংস হইয়া যাইবে।
সেই সভায় আমি বলিয়াছিলাম, ইনি আমাদের কবি; ইহার অন্তর হইতে যে বাণী বাহির হইতেছে, সেই বাণীর সঙ্গে আমাদের যুগান্তরের দুঃখ-বেদনা ও কান্না মিশ্রিত হইয়া আছে; শত জালিমের অত্যাচারে শত শোষকের পীড়নে আমাদের অন্তরে যে অগ্নিময় হাহাকার শত লেলিহান জিহ্বা মিলিয়া যুগ-যুগান্তরের অপমানের গ্লানিতে তাপ সঞ্চয় করিতেছিল, এই কবির বাণীতে আজ তাহা রূপ পাইল। এই কবির অন্তর হইতে বাণীর বিহঙ্গের অগ্নির পাখা বিস্তার করিয়া আজ দিগ-দিগন্তে সর্বত্যাগের গান গাহিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। কাব্য এই কবির কাছে ভাব-বিলাসের বস্তু নয়। তাহার কাব্যলোক হইতে যে বাণী স্বতঃই উৎসারিত হইতেছে, নিজের জীবনকে ইনি সেই বাণী-নিঃসৃত পথে পরিচালিত করিতেছেন। আমাদের আসমানে, সুবেহ সাদেকে ইনি উদীয়মান শুকতারা। উহার ত্যাগের রক্তরঙ্গিমায় স্নান করিয়া নূতন প্রভাতের অরুণ আলোক দিগদিগন্ত আলোকিত করিয়া তুলিবে।
আমার বক্তৃতার শেষের দিকে আমি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়ের কঠোর সমালোচনা করিয়াছিলাম। পরদিন তিনি আমাকে ডাকাইয়া ইহার জন্য কৈফিয়ৎ চাহিলেন। আমি তাহাকে বলিলাম, “আপনার কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি, তারই জোরে সভায় আপনার বিরূপ সমালোচনা করতে সাহসী হয়েছিলাম। আপনিই তো বলে থাকেন, আমরা রাজভয়ে ন্যায়ের পথ হতে বিচ্যুত হব না। কিন্তু পুলিশ-সাহেবের একখানা পত্র পেয়ে আপনি আপনার পুর্ব-অনুমতি ফিরিয়ে নিলেন।”
আমার কথা শুনিয়া তিনি হাসিয়া উঠিলেন। বুঝিলাম, তিনি আমাকে ক্ষমা করিয়াছেন। বস্তুত তাঁহার মত ক্ষমাসুন্দর শিক্ষক জীবনে খুব কমই দেখিয়াছি।
ইহার পরে আরও একবার কবি আমার বাড়িতে আসিয়াছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম, আমাদের নদী-তীরের বাঁশঝাড়ের ছায়াতলে বসিয়া আমরা দু’টি কবি মিলিয়া উন্মুক্ত প্রকৃতির রহস্যদেশ হইতে মনি মাণিক্য কুড়াইয়া আনিব। কবিও তাহাতে রাজী হইয়াছিলেন। কিন্তু ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব মোটর হাঁকাইয়া আসিয়া একদিন কবিকে শহরে লইয়া আসিলেন। আমার নদীতীরের চখা-চখির ডাকাডাকি কবিকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না।
বাঁশঝাড়ের যে স্থানটিতে কবির বসিবার আসন পাতিয়া দিয়াছিলাম, সেই স্থান শূন্য পড়িয়া রহিল। চরের বাতাস আছাড়িবিছাড়ি করিয়া কাঁদিতে লাগিল। আমার নদীতীরের কুটিরে কবির এই শেষ আগমন।
একদিন রাত্রে বন্ধুবর লাল মিঞার বাড়িতে আমরা তিন-চার জন মিলিয়া কবির সঙ্গে গল্প করিতে বসিলাম। কবি ভাল কবিতা লেখেন, ভাল বক্তৃতা দেন, ভাল গান করেন—তাহা সকলেই জানেন। কিন্তু মজলিসে বসিয়া যিনি কবির গালগল্প না শুনিয়াছেন, তাহারা কবির সব চাইতে ভাল গুণটির পরিচয় পান নাই। অনেক বড় বড় লোকের মজলিসে কবিকে দেখিয়াছি। মজলিসি গল্পে বিখ্যাত দেশবরণ্যে নেতা ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে কবিকে দেখিয়াছি; সেখানেও একমাত্র কথক কবি—আর সকলেই শ্রোতা। কথায় কথায় কবির সে কী উচ্চ হাসি! আর সেই হাসির তুফানে আশেপাশের সমস্ত লোক তাঁর হাতের পুতুলের মত একবার উঠিতেছে, একবার পড়িতেছে। কিন্তু এইদিন রাত্রে কবিকে যেন আরও নূতন করিয়া পাইলাম। কবির মুখে গল্প শুনিতে শুনিতে মনে হইল, কবির সমস্ত দেহটি যেন এক বীণার যন্ত্র। আমাদের দু-একটি প্রশ্নের মৃদু করাঘাতে সেই বীণা হইতে অপূর্ব সুরঝঙ্কার বাহির হইতেছে। কবি বলিয়া যাইতেছেন তাহার সমস্ত জীবনের প্রেমের কাহিনী। বলিতে বলিতে কখনও কবি আমাদের দুই চোখ অশ্রু-ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতেছেন আবার কখনও আমাদিগকে হাসাইয়া প্রায় দম বন্ধ করিবার উপক্রম করিয়া তুলিতেছেন। সেসব গল্পের কথা আজো বলিবার সময় আসে নাই।
গল্প শুনিতে শুনিতে শুনিতে কোন দিক দিয়া যে ভোর হইয়া গেল, তাহা আমরা টের পাইলাম না। সকালবেলা আমরা কবিকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইলাম।
একবার কবিকে আর একটি সভায় খুব গল্পমুখর দেখিয়াছিলাম। কবির এক গানের শিষ্য পুষ্পলতা দে’র জন্মদিনে। সেই সভায় জাহানারা বেগম, তাঁহার মা, কবির শাশুড়ী এবং কবি-পত্নী উপস্থিত ছিলেন।
আমরা সকলে খাইতে বসিয়াছি। ছোট ছোট মাটির পাত্রে করিয়া নানা রকম খাদ্যবস্তু আমাদের সামনে আনিয়া দেওয়া হইতেছে। কবি তার এক একটি দেখাইয়া বলিতেছেন—এটি খুড়ীমা, এট পিসীমা, এটি মাসীমা।
আমি কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা কবিভাই, সবাইকে দেখালেন—আমার ভাবী কোনটি, তাকে তো দেখালেন না।”
কবি একটুও চিন্তা না করিয়া পানির গেলাসটি দেখাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এইটি তোমাদের ভাবী ৷ যেহেতু আমি তার পাণিগ্রহণ করেছি।”
চারিদিকে হাসির তুফান উঠিল। ভাবী হাসিয়া কুটিকুটি হইলেন। কোন রকমে হাসি থামাইয়া আমরা আবার আহারে মনোনিবেশ করিয়াছি, অমনি কবি গম্ভীর হইয়া উঠিলেন : “জসীম, তুমি লুচি খেও না।”
বাড়ীর গৃহিণীর মুখ ভার। না জানি লুচির মধ্যে কবি কোন ত্রুটি পাইয়াছেন।
আমি উত্তর করিলাম, “কেন কবিভাই?” সকলেই ভোজন ছাড়িয়া কবির দিকে চাহিয়াছিলেন।
কবি বলিয়া উঠিলেন, “যেহেতু আমরা বেলুচিস্তান হতে এসেছি, সুতরাং লুচি খেতে পারব না।”
চারিদিকে আবার হাসির চোটে অনেকেরই খাদ্যবস্তু গলায় আটকাইয়া যাইতেছিল।
বাড়ীর গৃহিণী কৃত্রিম গলবস্ত্র হইয়া কবিকে বলিলেন, “বাবা নুরু, লক্ষ্মীটি, তুমি একটু ক্ষণের জন্য হাসির কথা বন্ধ কর। এদের খেতে দাও।”
আগেই বলিয়াছি, বিষয়বুদ্ধি কবির মোটেই ছিল না। একবার কবির বাড়ি গিয়া দেখি, খালাআম্মা কবিকে বলিতেছেন, “ঘরে আর একটিও টাকা নেই। কাল বাজার করা হবে না।”
কবি আমাকে সঙ্গে লইয়া চলিলেন তাঁর গ্রন্থ-প্রকাশকের দোকানে। পথে আসিয়া কবি ট্যাক্সি ডাকিলেন। কলেজ ষ্টীটের কাছে আসিয়া আমাকে ট্যাক্সিতে বসাইয়া রাখিয়া চলিলেন কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের দ্বিতল কক্ষে ‘আর্যস্থান পাবলিশিং হাউসে’ টাকা আনিতে। প্রায় আধ ঘণ্টা কাটিয়া গেল, কবির দেখা নাই। এদিকে ট্যাক্সিতে মিটার উঠিতেছে। যত দেরী হইবে, কবিকে তত বেশী ট্যাক্সী ভাড়া দিতে হইবে। বিরক্ত হইয়া আমি উপরে উঠিয়া গেলাম। দেখি, কবি প্রকাশকের সঙ্গে একথা-ওকথা লইয়া আলাপ করিতেছেন। আসল কথা—অর্থাৎ টাকার কথা সেই গল্পের মধ্যে কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। কবির কানে কানে আমি সমঝাইয়া দিলাম, কিন্তু কবির সেদিকে খেয়াল নাই তখন রাগত ভাবেই বলিলাম, “ওদিকে ট্যাক্সির মিটার উঠছে, সেটা মনে আছে?” কবি তখন প্রকাশকের কানে কানে টাকার কথা বলিলেন।
প্রকাশক অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া কবির হাতে পাঁচটি টাকা দিলেন। অল্পে তুষ্ট কবি মহাখুশী হইয়া তাহাই লইয়া গাড়ীতে আসিলেন। দেখা গেল, গাড়ীর মিটারে পাঁচ টাকা উঠিয়াছে। ট্যাক্সিওয়ালাকে তাহাই দিয়া কবি পায়ে হাঁটিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন।
কবিকে কত ভাবে কত জায়গায় দেখিয়াছি! যখন যেখানে তাহাকে দেখিয়াছি, স্ব-মহিমায় তিনি সমুজ্জ্বল। বড় প্রদীপের কাছে আসিয়া ঘোট প্রদীপের যে অবস্থা আমার তাহাই হইত। অথচ পরের গুণপনাকে এমন অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করিতে নজরুলের মত আর কাহাকেও দেখি নাই। অপর কাহাকেও প্রশংসা করিতে পারিলে তিনি যেন কৃতার্থ হইয়া যাইতেন। অপরকে হেয় করিয়া নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে তিনি কোনদিনই প্রয়াস পান নাই। কবি যখন গানের আসরে আসিয়া বসিয়াছেন, সেখানে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক। সকলেই তার গান শুনিতে চাহিতেন। হয়তো বা সেই সভায় কবির চাইতেও অনেক সুকণ্ঠ গায়ক বর্তমান। তেমনি গল্পের আসরে, সাহিত্যের মজলিসে, রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চে—সব জায়গায় সেই এক অবস্থা। ইহার একমাত্র কারণ স্বাভাবিক গুণপনা তো কবির ছিলই, তার সঙ্গে ছিল তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সেই ব্যক্তিত্বের কাছে স্বেচ্ছায় সকলে নত হইয়া পড়িল। তবু এই লোকের শত্রুর অন্ত ছিল না। দেশ-জোড়া প্রশংসা শুনিয়া তাহারা ঈর্ষায় জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিত। কাগজে নানারূপ ব্যঙ্গরচনা করিয়া তাহারা কবিকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা পাইত। কবি প্রায়ই সেদিকে খেয়াল করিতেন না। যদিই বা তাহাদের কামড়ে উত্ত্যক্ত হইয়া কখনো কখনো কবি দু-একটি বাক্যবাণ ছুঁড়িয়াছেন, কবির রচনার জাদুর স্পর্শে তাহা বাংলা-সাহিত্যে অমর হইয়া আছে।