একবার কলিকাতা গিয়া কবির সঙ্গে দেখা করিতে তাঁহার বাসায় যাই। তখন বিবাহ করিয়া সদ্য সংসার পাতিয়াছেন। হাস্যরসিক নলিনী সরকার মহাশয়ের বাসায় তিনি থাকেন। কবি আমাকে শয়ন-গৃহে ডাকিয়া পাঠাইলেন। নতুন ভাবীর সঙ্গে কবি লুডো খেলিতেছিলেন। ভাবীর সঙ্গে আমার পরিচয় করাইয়া দিয়া কবি আমাকেও খেলিতে আহ্বান করিলেন। আমি অনেকক্ষণ তাহাদের সঙ্গে খেলিলাম। ভাবীর সেই রাঙা-টুকটুকে মুখের হাসিটি আজও মনে আছে। তখন কবির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কবিপ্রিয়া কিন্তু আমাকে না খাইয়া আসিতে দিলেন না। আমি কবির কোন রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় নই। তবু কবি আমাকে আপন ভাইএর মত তাঁর গৃহের একজন করিয়া লইলেন। এর পর যখনই কবিগৃহে গমন করিয়াছি, কবি-পত্নীর ব্যবহারে তাঁহাদের গৃহখানি আমার আপন বলিয়া মনে হইয়াছে।
আমি তখন মেছুয়াবাজারে ওয়াই, এম. সি এ হোস্টেলে থাকিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়ি। আমাদের হোস্টেলে মাঝে মাঝে নানা রকম উৎসব-অনুষ্ঠান হইত। তাহাতে হোস্টেলের ছাত্রেরা নিজেদের আত্মীয়া মহিলাদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনিতেন। কলিকাতায় আমার কোন নিকট আত্মীয়া নাই, আমি আর কাহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিব! একদিন সেই কথা ভাবীকে বলিলাম। ভাবী অতি সহজেই আমাদের হোস্টেলে আসিতে রাজী হইলেন। ভাবীর মা খালাআম্মাও সঙ্গে আসিলেন। উৎসব-সভায় তাঁহারা আসিয়া যখন উপবেশন করিলেন, তখন ভাবীকে দেখিবার জন্য ছাত্রমহলে সাড়া পড়িয়া গেল। আমার মনে হয়, কবি-গৃহিণীর জীবনে বাহিরের কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এই প্রথম।
ভাবীর মতন এমন সর্বংসহা মেয়ে বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়। কবির ছন্নছাড়া নোঙরহীন জীবন। এই জীবনের অন্তঃপুরে স্নেহ-মমতায় মধুর হইয়া চিরকাল তিনি কবির কাব্যসাধনাকে জয়যুক্ত করিয়াছিলেন। কোন সময় তাঁহাকে কবির সম্পর্কে কোন অভিযোগ করিতে দেখি নাই। প্রথম জীবনে কবি ভাবীকে বহু সুন্দর সুন্দর পত্র লিখিয়াছেন। ভাবী সেই পত্রগুলি যখের ধনের মত রক্ষা করিতেন। একদিন ভাবীকে বলিলাম, “ভাবী, আমি আপনার ভাই। যদি ভরসা দেন তো একটা অনুরোধ আপনাকে করব?”
ভাবী হাসিয়া উত্তর করিলেন, “কি অনুরোধ, বল তো ভাই।”
আমি বলিলাম, “কবিভাই আপনাকে যেসব চিঠি লিখেছেন, তার দু-একখানা যদি আপনি আমাকে দেখান।”
ভাবীর চোখ দু’টি ছলছল করিয়া উঠিল। সামনে খালাআম্মা বসিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “বাবা, সেসব চিঠি কি ওর কাছে আছে। একবার কি-একটা সামান্য কারণে নুরু রাগ করে সবগুলি চিঠি পুড়িয়ে ফেলেছে।”
কবির প্রথম ছেলেটির নাম ছিল বুলবুল। বুলবুলের বয়স যখন পাঁচ-ছয় বৎসর, তখন কবি তাকে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতেন। অতটুকু ছেলে কী সুন্দর গান করিতে পারিত! কেমন মিষ্টি সুরে কথা বলিত। কবির কোল হইতে কাড়িয়া লইয়া আমরা তার মুখের মিষ্টিকথা শুনিতাম। অতটুকু বয়সে ওস্তাদী গানের নানা সুর-বিভাগের সঙ্গে সে পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। কবি হারমনিয়ামে যখন যে কোন সুর বাজাইতেন, বুলবুল শুনিয়াই বলিয়া দিতে পারিত, কবি কোন সুর বাজাইতেছেন। বড় বড় মজলিসে খোকাকে লইয়া কবি বহুবার ইহার প্রমাণ দিয়াছেন। অতটুকু শিশুর সংগীত-জ্ঞান দেখিয়া বড় বড় ওস্তাদ ধন্য ধন্য করিতেন। এই শিশুটিকে পাইয়া কবির ছন্নছাড়া জীবন কতকটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া উঠিতেছিল।
কবিকে আর কবি-পত্নীকে অনন্ত কান্নার সাগরে ডুবাইয়া সেই বেহেস্তের বুলবুল পাখি বেহেস্তে পলাইয়া গেল। কবির গৃহে শোকের তুফান উঠিল। কবি তার বড় আদরের বুলবুলকে গোরের কাফন পরাইয়া মুসলিম প্রথা অনুসারে কবরস্থ করিয়াছিলেন। বুলবুলের যত খেলনা, তার বেড়াইবার গাড়ী, পোষাক-পরিচ্ছদ সমস্ত কবি একটি ঘরে সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন।
বুলবুলের মৃত্যুর সময় আমি কলিকাতা ছিলাম না। কলিকাতা আসিয়া কবি-গৃহে কবির অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম, কবি ডি এম. লাইব্রেরীতে গিয়াছেন। আমি সেখানে গিয়া দেখিতে পাইলাম, কবি এক কোণে বসিয়া হাস্যরসপ্রধান ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক কাব্যের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিতেছেন। পুত্রশোক ভুলিবার এই অভিনব উপায় দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। দেখিলাম, কবির সমস্ত সঙ্গে বিষাদের ছায়া। চোখ দু’টি কাঁদিতে কাঁদিতে ফুলিয়া গিয়াছে। কবি দু-একটি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন। এখনও আমি ভাবিয়া স্থির করিতে পারি না, কোন্ শক্তি বলে কবি পুত্রশোকাতুর মনকে এমন অপূর্ব হাস্যরসে রূপান্তরিত করিয়াছিলেন। কবিতা লিখিবার স্থানটিও আশ্চর্যজনক। যাহারা তখনকার দিনে ডি, এম, লাইব্রেরীর স্বল্পপরিসর স্থানটি দেখিয়াছেন, তাঁহারা অবস্থা অনুমান করিতে পারিবেন। দোকানে অনবরত বেচাকেনা হইতেছে, বাহিরের হট্টগোল কোলাহল—তার এক কোণে বসিয়া কবি রচনা-কার্যে রত।
আমি এই সময় প্রায়ই কবির কাছে গিয়া বসিয়া থাকিতাম। একদিন এক ভদ্রলোক একখানা চিঠি দিয়া গেলেন। চিঠিখানা পড়িয়া কবি অজস্রভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। তারপর রুমাল দিয়া চোখ মুছিয়া আবার চন্দ্রবিন্দু পুস্তকের হাস্যরসের গানগুলি লিখিতে মনোনিবেশ করিলেন। চিঠিখানা পড়িয়া দেখিলাম—ইহা লিখিয়াছেন, কবির অন্তরঙ্গ বন্ধু মোজাফফর আহমদ সাহেব জেল হইতে বুলবুলের মৃত্যু-সংবাদ পাইয়া কবিকে এই পত্র লিখিয়া তিনি সমবেদনা জানাইয়াছেন। বুলবুলের মৃত্যুর পর তার শতচিহ্ন-জড়িত গৃহে কবির মন টিকিতেছিল না। তাই ডি, এম, লাইব্রেরীর কোলাহলের মধ্যে আসিয়া কবি হাস্যরসের কবিতা লিখিয়া নিজের মনকে বুলবুলের চিন্তা হইতে সরাইয়া রাখিবার প্রয়াস করিতেছিলেন। আমরা শুনিয়াছি, খোকার অসুখে অজস্র খরচ করিয়া এই সময়ে কবি ভীষণ আর্থিক অভাবে পড়িয়াছিলেন। ডি. এম. লাইব্রেরীতে আসিয়া প্রতিদিন কিছু কিছু লিখিয়া লাইব্রেরীর কর্মকর্তার নিকট হইতে কবি কিছু অর্থ লইয়া যাইতেন। অভাবের তাড়নায় এরূপ শোকতাপগ্রস্ত অবস্থায় কবি চন্দ্রবিন্দুর মত অপূর্ব হাস্যরসের কার্য রচনা করিয়াছেন। যদি তিনি মনের সুখে ‘সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ লিখিতে পারিতেন, তবে সেই লেখা আরও কত সুন্দর হইতে পারিত।
একদিন গ্রীষ্মকালে হঠাৎ কবি আমার পদ্মাতীরের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত। তিনি কেন্দ্রীয়-আইন সভার সভ্য হইবার জন্য দাঁড়াইয়াছেন। এই উপলক্ষে ফরিদপুরে আসিয়াছেন প্রচারের জন্য। আমি হাসিয়া অস্থির : “কবিভাই, বলেন কি? আপনার বিরুদ্ধে এদেশে গোঁড়া মুসলিম-সমাজ কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ভোটযুদ্ধে তারাই হলেন সব চাইতে বড় সৈন্যসামন্ত। আমাদের সমাজ কিছুতেই আপনাকে সমর্থন করবে না।”
কবি তখন তার সুটকেস হইতে এক বাণ্ডিল কাগজ বাহির করিয়া আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “এই দেখ, পীর বাদশা মিঞা আমাকে সমর্থন করে ফতোয়া দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের এত বড় বিখ্যাত পীর যা বলবেন, মুসলিম-সমাজ তা মাথা নিচু করে মেনে নেবে। জসীম, তুমি ভেবো না। নিশ্চয় সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বই ভাগ ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি আমি কিছু পাই, তা হলেই কেল্লা ফতে। যদি নির্বাচিত হয়ে যাই—আর নির্বাচিত আমি তো হবই, মাঝে মাঝে আমাকে দিল্লী যেতে হবে। তখন তোমরা কেউ কেউ আমার সঙ্গে যাবে।”
রাতের অন্ধকারে আকাশে অসংখ্য তারা উঠিয়াছে। আমরা দুই কবিতে মিলিয়া তাদেরই সঙ্গে বুঝি প্রতিযোগিতা করিয়া মনের আকাশে অসংখ্য তারা ফুটাইয়া তুলিতেছিলাম।
কেন্দ্রীয় সভার ভোট-গ্রহণের আর মাত্র দুইদিন বাকী। ভোর হইলেই আমরা দুইজনে উঠিয়া ফরিদপুর শহরে মৌলভী তমিজউদ্দিন খানের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তমিজউদ্দিন সাহেব আইনসভার নিম্ন-পরিষদের সভ্য পদের প্রার্থী ছিলেন। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব। আমরা লাল মিঞা সাহেবের সমর্থক ছিলাম। বাদশা মিঞা তমিজউদ্দিন সাহেবকে সমর্থন করিয়া ফতোয়া দিয়াছিলেন। সেইজন্য আমাদের বিশ্বাস ছিল, তমিজউদ্দিন সাহেবের দল নিশ্চয়ই কবিকে সমর্থন করিবেন। কারণ বাদশা মিঞাও কবিকে সমর্থন করিয়া ইতিপুর্বে ফতোয়া দিয়াছেন। আর, লাল মিঞার দলে তো আমরা আছিই। সুতরাং সবাই কবিকে সমর্থন করিবে।
কবিকে সঙ্গে লইয়া যখন তমিজউদ্দিন সাহেবের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, তমিজউদ্দিন সাহেব তাঁহার সমর্থক গুণগ্রাহীদের দ্বারা পরিবৃত হইয়া দরবার সাজাইয়া বসিয়াছিলেন। কবিকে দেখিয়া তাঁহারা সবাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কবি যখন তাঁহার ভোটঅভিযানের কথা বলিলেন, তখন তমিজউদ্দিন সাহেবের একজন সভাসদ বলিয়া উঠিলেন, “তুমি কাফের। তোমাকে কোন মুসলমান ভোট দিবে না।”
তমিজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আমাদের শত মতভেদ থাকিলেও তিনি বড়ই ভদ্রলোক। কবিকে এরূপ কথা বলায় তিনি বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন। কবি কিন্তু একটুও চটিলেন না। তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আপনারা আমাকে কাফের বলছেন, এর চাইতে কঠিন কথাও আমাকে শুনতে হয়। আমার গায়ের চামড়া এত পুরু যে আপনাদের তীক্ষ্ণ কথার বাণ তা ভেদ করতে পারে না। তবে আমি বড়ই সুখী হব, আপনারা যদি আমার রচিত দু-একটি কবিতা শোনেন।”
সবাই তখন কবিকে ঘিরিয়া বসিলেন। কবি আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। কবি যখন তাহার “মহরম” কবিতাটি আবৃত্তি করিলেন, তখন যে ভদ্রলোক কবিকে কাফের বলিয়াছিলেন তারই চোখে সকলের আগে অশ্রুধারা দেখা দিল। কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন—যে কাজে আমরা আসিয়াছি, সে দিকে তাঁর দৃষ্টি নাই। আমি কবির কানে কানে বলিলাম, “এইবার আপনার ইলেকসনের কথা ওঁদের বলুন।”
কিন্তু কে কাহার কথা শোনে! কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। তখন আমি মরিয়া হইয়া সবাইকে শুনাইয়া বলিলাম, “আপনারা কবির কবিতা শুনছেন—এ অতি উত্তম কথা। কিন্তু কবি একটি বড় কাজে এখানে এসেছেন। আসন্ন ভোট-সংগ্রামে কবি আপনাদের সমর্থন আশা করেন। এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করুন।”
তমিজউদ্দিন সাহেব চালাক লোক। কবিতা আবৃত্তি করিয়া কবি তাঁহার সমর্থক ও ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে কিঞ্চিৎ প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন। তিনি যে কবিকে সমর্থন করিবেন না, এই আলোচনা তিনি তাঁহাদের সকলের সামনে করিলেন না। কবিকে তিনি আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। পাঁচ-ছয় মিনিট পরে হাসিমুখেই তাহারা দুইজনে আসরে ফিরিয়া আসিলেন। আসিয়া কবি আবার পূর্ববৎ কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। আমি ভাবিলাম, কেল্লা ফতে! কবির হাসিমুখ দেখিয়া এবং আবার আসিয়া তাহাকে কবিতা আবৃত্তি করিতে দেখিয়া ভাবিলাম, নিশ্চয়ই তমিজউদ্দিন সাহেবের দল কবিকে সমর্থন করিবে।
কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। বেলা দুইটা বাজিল। কবির সে দিকে হুঁশ নাই। কবির শ্রোতারাই এ বিষয়ে কবিকে সজাগ করিয়া দিলেন। কবি তাহার কাগজপত্র কুড়াইয়া লইয়া বিদায় হইলেন। তাদের মধ্য হইতে একটি লোকও বলিলেন না, এত বেলায় আপনি কোথায় যাইবেন, আমাদের এখান হইতে খাইয়া যান। আমার নিজের জেলা ফরিদপুরের এই কলঙ্ক-কথা বলিতে লজ্জায় আমার মাথা নত হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু এ কথা না বলিলে, সেই যুগে আমাদের সমাজ এত বড় একজন কবিকে কি ভাবে অবহেলা করিতেন, তাহা জানা যাইবে না। অথচ এদেরই দেখিয়াছি, আলেম-সমাজের প্রতি কী গভীর শ্রদ্ধা! কত গরীব ছাত্রকে তমিজউদ্দিন সাহেব অন্নদান করিয়াছেন!
দুইটার সময় তমিজউদ্দিন সাহেবের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ভাবিলাম, এখন কোথায় যাই। আমার বাড়ি শহর হইতে দুই মাইলের পথ; হাঁটিয়া যাইতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগিবে। পৌঁছিতে তিনটা বাজিবে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া আজ আর শহরে ফিরিয়া কাজকর্ম করা যাইবে না। স্থির করিলাম, বাজারে কোন হোটলে খাওয়া সারিয়া অন্যান্য স্থানে ভোট-সংগ্রহের কাজে মনোনিবেশ করিব।
পথে আসিতে আসিতে কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তমিজউদ্দিন সাহেবের দল আমাদের সমর্থন করিবে। এবার তবে কেল্লা ফতে!”
কবি উত্তর করিলেন, “না রে, ওঁরা বাইরে ডেকে নিয়ে আমাকে আগেই খুলে বলে দিয়েছেন, আমাকে সমর্থন করবেন না। ওঁরা সমর্থন করবেন বরিশালের জমিদার ইসমাইল সাহেবকে।”
তখন রাগে দুঃখে কাঁদিতে ইচ্ছা হইতেছিল। রাগ করিয়াই কবিকে বলিলাম, “আচ্ছা কবিভাই, এই যদি আপনি জানলেন, তবে ওঁদের কবিতা শুনিয়ে সারাটা দিন নষ্ট করলেন কেন?”
কবি হাসিয়া বলিলেন, “ওরা শুনতে চাইলে, শুনিয়ে দিলুম।”
এ কথার কী আর উত্তর দিব? কবিকে লইয়া হোটলের সন্ধানে বাহির হইলাম। তখনকার দিনে ফরিদপুর শহরে ভাল হোটেল ছিল না। যে হোটেলে যাই, দেখি মাছি ভনভন করিতেছে। ময়লা বিছানা-বালিশ হইতে নোংরা গন্ধ বাহির হইতেছে। তারই মধ্যে অপেক্ষাকৃত একটি পরিষ্কার হোটেল বাছিয়া লইয়া কোন রকমে ভোজনপর্ব সমাধা করিলাম।
শ্রেষ্ঠ কবিকে আমার দেশ এই সম্মান জানাইল। এই জন্যই বুঝি আধুনিক মুসলিম-সমাজে বড় লেখক বা বড় কবির আগমন হয় নাই। মিশর, তুরস্ক, আরব—কোন দেশেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের উদয় হইতেছে না। অথচ ইসলামের আবির্ভাবের প্রারম্ভে আমাদের সমাজে কত বিশ্ববরেণ্য মহাকবির আবির্ভাব ঘটিয়াছিল। হাফিজ, রুমী, সানী, ওমর খৈয়াম—এদের লেখা পড়িয়া জগৎ মোহিত। কিন্তু আজ কি দেখিতেছি? সমস্ত মুসলিম-জগতে কোথা হইতেও প্রতিভার উদয় হইতেছে না। প্রতিভাকে বড় ও পুষ্ট করিয়া তুলিবার মত মানসিকতা আমাদের সমাজ-জীবন হইতে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বনে জঙ্গলে আগাছার অন্তরালে বহু ফুল ফুটিয়া থাকে। কে তাহাদের সন্ধান রাখে? ফুলের বাগান করিতে হইলে উপযুক্ত মালির প্রয়োজন; ফুলগাছের তদ্বির-তালাসী করিবার প্রয়োজন। গাছের গোড়া হইতে আগাছা নষ্ট করিয়া দিতে হয়; গোড়ায় পানি ঢালিতে হয়। তবেই ফুলের গাছে ফুল ফোটে, সেই ফুলের গন্ধে দুনিয়া মাতোয়ারা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে যদি ভুলেও দু-একটা ফুলগাছ জন্মে, আমরা গোড়ায় পানি ঢালা তো দূরের কথা, কুঠার লইয়া তাহাকে আঘাত করিতে প্রবৃত্ত হই। নজরুল-জীবনের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তারা সকলেই এ কথার সাক্ষ্যদান করিবেন। নজরুলের কবিজীবনের আবির্ভাবের সময় আমাদের সমাজ যে কুৎসিত ভাষায় কবিকে আক্রমণ করিয়াছেন, যে ভাবে তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছেন, তাহার কণ্টক-ক্ষতগুলি মহাকাল কবির কাব্যের সঙ্গে বহন করিয়া চলিবে। অনাগত যুগের কাব্য-রসগ্রাহীদের কাছে আমরা এইজন্য হেয় হইয়া থাকিব।
যাক এসব কথা। কবি কিন্তু আসন্ন ভোটযুদ্ধে বড়ই আশাবাদী ছিলেন। আমি লোক-চরিত্র কিছুটা জানিতাম; আমাদের সমাজের মানবিকতার কথাও অবগত ছিলাম। তাই কবির মনকে আগে হইতেই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করিবার জন্য তৈরি রাখিতে চেষ্টা করিতেছিলাম। কিন্তু সবই বৃথা। পীর বাদশা মিঞার সমর্থন-চিঠি তিনি পাইয়াছেন। আরও বহু মুসলিম নেতা কবিকে সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু মুসলিম-সমাজের কাগজগুলি বহুদিন হইতে তাঁহার বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার করিতেছিল, তাহার ধাক্কায় শত বাদশা মিঞা ভাসিয়া যাইবেন—এই বয়স্ক-শিশুকে তাহা আমি কেমন করিয়া বুঝাইব?
প্রথম ভোটের দিন কবিকে ভোটগ্রাহক অফিসারের সামনে বসাইয়া দিলাম। কবির সামনে গিয়া ভোটারেরা ভোট দিবেন। মনে একটু ভরসা ছিল, কবিকে সামনে দেখিয়া ভোটারেরা হয়তো তাহাকে সমর্থন করিবেন। কবি সন্ধ্যাবেলায় আসিয়া আমাকে বললেন, বহু লোক তাহাকে ভোট দিয়াছেন; তাঁহাদের মুখ দেখিয়াই নাকি কবি ইহা বুঝিতে পারিলেন। পরদিন সকালে আমরা নদীতে গোসল করিতে চলিয়াছি। কবি আমাকে বলিলেন, “দেখ জসীম, ভেবে দেখেছি, এই ভোটযুদ্ধে আমার জয় হবে না। আমি ঢাকা চলে যাই। দেখি, অন্ততপক্ষে জামানতের টাকাটা যাতে মারা না যায়।”
তখন বড়ই হাসি পাইল। জয়ী হইবেন বলিয়া কাল যিনি খুশীতে মশগুল ছিলেন, হারিয়া গিয়া জামানতের টাকা মার যাওয়ার চিন্তা আজ তাঁহার মনে কোথা হইতে আসিল। ব্যবহারিক জীবনে এই বয়স্ক শিশুটির সারা জীবন ভরিয়া এমনই ভুল করিয়া প্রতি পদক্ষেপে নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হইয়াছেন।
দুপুরের গাড়ীতে কবি চলিয়া গেলেন। মনটা বড়ই খারাপ হইয়া গেল। হঠাৎ এমন করিয়া কবির সাহচর্য হইতে বঞ্চিত হইব, তাহার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।