ইহার বহুদিন পরে আমাদের ফরিদপুরে বঙ্গীয় রাষ্ট্বীয় সমিতির অধিবেশন বসিল। এই অধিবেশনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। প্রতিদিন গাড়ী ভরিয়া বহু নেতা আমাদের বাড়ির পাশের স্টেশনে আসিয়া নামিতে লাগিলেন। স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাজ পরিয়া আমরা তাঁহাদের অভ্যর্থনা করিতাম। একদিন আশ্চর্য হইয়া দেখিলাম, কবি নজরুল কয়েকজন শিষ্য সহ আমাদের বাড়িতে উঠিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। কবির সঙ্গে কমিউনিস্ট আবদুল হালিম, গায়ক মণীন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও আর একজন যুবক ছিলেন। আমি কবিকে সানন্দে আমাদের বাড়ি লইয়া আসিলাম। রান্নার দেরি ছিল। কবিকে আমাদের নদীতীরের বাঁশবনের ছায়াতলে মাদুর পাতিয়া বসিতে দিলাম। তখন বড়-পদ্মা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়া প্রবাহিত হইত। এখন চর পড়িয়া পদ্মা অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু একটি ছোট্ট নদীরেখা এখনও আমাদের বাড়ির পাশ দিয়া প্রবাহিত হয়।
কবির হাতে একখণ্ড কাগজ দিয়া বলিলাম, “কবিভাই, আপনি একটা কিছু লিখে দিন।”
আধঘণ্টার মধ্যে কবি একটি অপূর্ব কবিতা লিখিয়া ফেলিলেন। কবিতাটি হারাইয়া ফেলিয়াছি। সেজন্য মনে বড়ই অনুতাপ হয়। তার দুটি লাইন মনে আছে—
“আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ
নদীর তীরে ডিঙিতরী পথিক-ধরা ফাঁদ।”
সন্ধ্যাবেলা নৌকা করিয়া কবিকে নদীর ওপারের চরে লইয়া গেলাম। সেখানে আমি একটি ইস্কুল খুলিয়াছিলাম। গ্রামের লোকেরা রাত্রিকালে আসিয়া সেই ইস্কুলে লেখাপড়া করিত। তারপর সকলে মিলিয়া গান গাহিত। আমার মনে হইয়াছিল, এই গান যদি কবির ভাল লাগে তবে কবিকে এখানে বহু দিন ধরিয়া রাখিতে পারি।
সেদিন কবির আগমনে বালুচরের কৃষাণ-পল্লীতে সাড়া পড়িয়া গেল। ওপাড়া হইতে আজগর ফকিরকে খবর দেওয়া হইল, চরকেষ্টপুরের মথুর ফকিরও আসিলেন। তাহারা যখন গান ধরিলেন, তখন মনে হইল আল্লার আসমান গানের সুরে সুরে কাঁপিতেছে। কবি সে গানের খুবই তারিফ করিলেন। কিন্তু তবু মনে হইল, যেমনটি করিয়া কবিকে এই গানে মাতাইতে চাহিয়াছিলাম, তাহা হইল না। সেই সময়ে কবির মন রণ-দুন্দুভির নিনাদে ভরপুর ছিল। এই সব গ্রাম-গানের ভাববস্তুর জন্য কবির হৃদয়ে কোন স্থান তৈরী হয় নাই।
রাত্রিবেলা এক মুস্কিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠলেন। এই পাড়াগাঁয়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া চা লইয়া আসিব, তাহারও উপায় নাই। রাত্রিকালে কে সাহস করিয়া এত বড় পদ্মা-নদী পাড়ি দিবে? তখন তিন-চার গ্রামে লোক পাঠান হইল চায়ের অনুসন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলিম মাতব্বরের বাড়ি হইতে কয়েটা চায়ের পাতা বাহির হইল। তিনি একবার কলিকাতা গিয়া চা খাওয়া শিখিয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের চা খাওয়াইয়া তাজ্জব বানাইয়া দিবার জন্য কলিকাতর হইতে তিনি কিছু চা-পাতা লইয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া চা-পাতা যখন কম হইয়া আসিত, তখন তাহার সহিত কিছু শুকনা ঘাসপাতা মিশাইয়া চায়ের ভাণ্ডার তিনি অফুরন্তু রাখিতেন। তিনি অতি গর্বের সহিত তাহার কলিকাতা-ভ্রমণের অশ্চর্য কাহিনী বলিতে বলিতে সেই চা-পাতা আনিয়া কবিকে উপঢৌকন দিলেন। চা-পাতা দেখিয়া কবির তখন কী আনন্দ।
মহামূল্য চা এখন কে জ্বাল দিবে? এ-বাড়ির বড়বৌ ও-বাড়ির ছোটবৌ—সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া যাহার যত রন্ধন-বিদ্যা জানা ছিল সমস্ত উজাড় করিয়া সেই অপূর্ব চা রন্ধন-পর্ব সমাধা করিল। অবশেষে চা বদনায় ভর্তি হইয়া বৈঠকখানায় আগমন করিল। কবির সঙ্গে আমরাও তাহার কিঞ্চিৎ প্রসাদ পাইলাম। কবি তো মহাপুরুষ। চা পান করিতে করিতে চারাঁধুনিদের অজস্র প্রশংসা করিয়াছিলেন। আমরাও কবির সঙ্গে ধুয়া ধরিলাম। গ্রামচাষীর বাড়িতে যত রকমের তরকারী রান্না হইয়া থাকে, সেই চায়ের মধ্যে তাহার সবগুলিরই আস্বাদ মিশ্রিত ছিল। কমিউনিস্ট-কর্মী আবদুল হালিম বড়ই সমালোচনাপ্রবণ। তাঁহার সমালোচনা মতে সেই চা-রামায়ণের রচয়িত্রীরা নাকি লঙ্কাকাণ্ডের উপর বেশী জোর দিয়াছিলেন। আমাদের মতে চা-পর্বে সকল ভোজনরসের সব গুলিকেই সম মর্যাদা দেওয়া হইয়াছিল। পরবর্তীকালে বহু গুণীজনের কাছে এই চা খাওয়ার বর্ণনা করিয়া কবি আনন্দ পরিবেশন করিতেন।
পরদিন পূর্ব আকাশে অপূর্বদ্যুতি জবাকুসুমের রঙে রঙিন হইয়া সূর্যোদয় হইল। আমরা কবিকে লইয়া বিদায় হইলাম। দুই পাশের শস্যক্ষেত্রে সবুজ নতুন পত্র-মঞ্জরী দেখা দিয়াছে। রাতের শিশির-স্নাত পত্রগুলি বিহানবেলার রৌদ্রে ঝলমল করিয়া কবিকে অভ্যর্থনা করিতেছিল। কবি ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙ্গার গান’ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন। এই বই দুইখানি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। কবির শিষ্যদল কনফারেন্সের অধিবেশনে এই বই বিক্রয় করিবার জন্য, আনিয়াছিলেন। বইগুলি আমার বাড়িতে রাখিয়া কবি ফরিদপুর শহরে কনফারেন্সের ময়দানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। থাকিবার জন্য তাঁহাকে একটি তাঁবু দেওয়া হইল। আমি হইলাম কবির খাস-ভলান্টিয়ার।
এই কনফারেন্সে বাংলাদেশের বহু নেতা আসিয়াছিলেন। তখন কবি ভাল বক্তৃতা করিতে শেখেন নাই। সভায় কবি যাহা বলিলেন, তাহা নিতান্ত মামুলী ধরনের। কিন্তু কবি যখন গান ধরিলেন, সেই গানের কথায় সমস্ত সভা উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। গান ছাড়িলে সভার লোকে আরও গান শুনিবার জন্য চিৎকার করিয়া উঠিতেছিল। কবির কণ্ঠস্বর যে খুব সুন্দর ছিল তাহা নয়, কিন্তু গান গাহিবার সময় গানের কথা-বস্তুকে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়া জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিলেন। কবি যখন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া’ অথবা ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সভায় যে অপূর্ব ভাবরসের উদয় হইতেছিল, তাহা ভাষায় বলিবার নয়। জেল হইতে সদ্য খালাস পাইয়া বহু দেশকর্মী সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। দেশকে ভালবাসিয়া শতসহস্র কর্মী আপন অঙ্গে লাঞ্ছনার তিলক-চিহ্ন ধারণ করিয়াছিলেন। নজরুলের গান যেন তাহাদের দুঃখ-লাঞ্ছনার আশাআকাক্ষার জীবন্ত প্রতীক।
একদিন মহাত্মা গান্ধীর সামনে নজরুল তাঁর ‘ঘোর ঘোর ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর’—গানটি গাহিলেন। গান্ধীজী গান শুনিয়া হাসিয়া কুটিকুটি। কনফারেন্স শেষ হইলে কবি আবার আমার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কবি স্থির করিলেন, তিনি এখানে বসিয়া ‘বাবুচর’ নামে একখানা বই লিখিবেন। কিছুদিন কবির সঙ্গে কাটাইতে পারিব, এই আশায় মন পুলকিত হইয়া উঠিল।
কিন্তু অল্পদিন পরে পাবনা হইতে এক ভদ্রলোক আসিয়া কবিকে চিলের মত ছোঁ মারিয়া লইয়া গেলেন। যাইবার সময় কবি কথা দিয়া গেলেন, ফিরিবার সময় আবার আমার এখানে আসিবেন।
কবির বাজেয়াপ্ত বইগুলির কিছু আমার কাছে রাখিয়া গেলেন। কিন্তু কবি আর ফিরিয়া আসিলেন না। বহুদিন পরে কবি চিঠি লিখিলেন, বইগুলির কিছু যদি বিক্রয় হইয়া থাকে তবে আমি যেন সত্বর তাহাকে টাকাটা পাঠাইয়া দিই। কবির অসুখ। অর্থের খুব টানাটানি। কিন্তু বাজেয়াপ্ত বই কেহ কিনিতে চাহে না। পুলিসে ধরা পড়িবার ভয় আছে। কিছুই বিক্রয় করিতে পারি নাই। আমি তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে গ্রাম্য-গান সংগ্রহের জন্য মাসে সত্তর টাকা করিয়া স্কলারশিপ পাইতাম। সেই টাকা হইতে কিঞ্চিৎ অর্থ কবির নিকট মনিঅর্ডার করিয়া পাঠাইলাম।