কংগ্রেস-অফিসের সাময়িক স্বেচ্ছাসেবক হইয়া তাহাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করিতে করিতে আমি কলিকাতা আসিয়া উপস্থিত হই। পথের যত ধূলি আর গুঁড়ো-কয়লা রজক গৃহ-সম্পর্কহীন আমার শ্রীঅঙ্গের মোটা খদ্দরে, কিস্তি-নৌকার মত চর্ম-পাদুকাজোড়ায়, এবং তৈলহীন চুলের উপর এমন ভাবে আশ্রয় লইয়াছিল যে তাহার আবরণীর তল ভেদ করিয়া আমার পূর্বপরিচিত কেহ আমাকে সহজে আবিষ্কার করিতে পারিত না।

সুবিস্তৃত জন-অরণ্য কলিকাতায় আমি কাহাকেও চিনি না। কোথায় গিয়া আশ্রয় পাইব? কে আমাকে থাকিবার জায়গা দিবে। যদি কবি নজরুলের সন্ধান পাই, তার স্নেহের শিশু-কবিকে নিশ্চয় তিনি অবহেলা করিবেন না। মুসলিম পাবলিশিং হাউসে আসিয়া আফজল মিঞার কাছে কবির সন্ধান লইলাম। আফজল মিঞা বলিলেন, “আপনি অপেক্ষা করুন। কবি একটু পরেই এখানে আসবেন।”

অল্পক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের মত কবি আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

আফজল সাহেব বলিলেন, “জসীম উদ্দীন এসেচে আপনার সঙ্গে দেখা করতে।”

“কই জসীম উদ্দীন?” বলিয়া কবি এদিক-ওদিক চাহিলেন। আফজল সাহেব আমাকে দেখাইয়া দিলেন। আমি কবিকে সালাম করিলাম।

কবি আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “কই, তোমার লেখা কোথাও তো দেখিনি?” আমি কবির নিকট আমার কবিতার খাতাখানা আগাইয়া দিতে গেলাম। কিন্তু কবি তাঁহার গুণগ্রাহীদের দ্বারা এমনই পরিবৃত হইলেন যে আমি আর ব্যূহভেদ করিয়া কবির নিকটে পৌঁছিতে পারিলাম না।

অল্পক্ষণ পরেই কবি ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন, “আমাকে এখন হুগলী যেতে হবে।”

আগাইয়া গিয়া বলিলাম, “আমি বহুদূর থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”

কবি আমাকে বলিলেন, “একদিন হুগলীতে আমার ওখানে এসো। আজ আমি যাই।”

এই বলিয়া কবি একটি ট্যাক্সী ডাকিয়া তাহাতে আরোহণ করিলেন। আমিও কবির সঙ্গে সেই ট্যাক্সীতে গিয়া উঠিলাম। কবির প্রকাশক মৈনুদ্দিন হুসেন সাহেবও কবির সঙ্গে ছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম, ট্যাক্সীতে বসিয়া কবির সঙ্গে দু-চারটি কথা বলিতে পারি। কিন্তু মৈনুদ্দিন সাহেবই সব সময় কবির সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন। আমি মৈনুদ্দিন সাহেবকে বলিলাম, “আপনি তো কলকাতায় থাকেন। সব সময় কবির সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। আমাকে একটু কবির সঙ্গে কথা বলতে দিন।”

কবি কহিলেন, “বল বল, তোমার কি কথা?”

আমি আর কি উত্তর করিব। কবি আবার মৈনুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন। ট্যাক্সী আসিয়া হাওড়ায় থামিল। কবি তাড়াতাড়ি ট্যাক্সী হইতে নামিয়া রেলগাড়ীতে গিয়া উপবেশন করিলেন। রাশি রাশি ধূম উদ্গারণ করিয়া সোঁ-সোঁ শব্দ করিয়া গাড়ী চলিয়া গেল। আমি স্তব্ধ হইয়া প্লাটফর্মে দাঁড়াইয়া রহিলাম। গাড়ীর চাকা যেন আমার বুকের উপর কঠিন আঘাত করিয়া চলিতে লাগিল।

এখন আমি কোথায় যাই—কাহার নিকটে গিয়া আশ্রয় লই? ফরিদপুরের এক ভদ্রলোক হারিসন রোডে ডজ-ফার্মেসীতে কাজ করিতেন। তাঁহার সন্ধানে বাহির হইলাম। কিন্তু হারিসন রোডের ডজ-ফার্মেসী কোথায় আমি জানি না। একে তো ট্রেনভ্রমণে ক্লান্ত, তার উপর সারাদিন কিছু আহার হয় নাই। হাওড়া হইতে শিয়ালদহ পর্যন্ত রাস্তার এপারে-ওপারে তিন-চার বার ঘুরিয়া ডজ-ফার্মেসীর সন্ধান পাইলাম। ফার্মেসীতে কংগ্রেসের জন্য সংগৃহীত টাকার বাক্সটি রাখিয়া ফুটপাথের উপর শুইয়া পড়িলাম। তখন আমি এত ক্লান্ত যে সারাদিনের অনাহারের পরে খাওয়ার কথা একেবারেই ভুলিয়া গেলাম।