কবি নজরুল ইসলামের বেশী লেখা আমি ইহার আগে পড়ি নাই। মুসলমান লেখকের মধ্যে মহাকবি কায়কোবাদের পর আমি কবি সাহাদাত হোসেন সাহেবকেই সবচেয়ে বড় লেখক বলিয়া মনে করিতাম। নজরুলের ‘বাদল বরিষণে’ নামক একটি প্রবন্ধ পড়িয়াছিলাম, তাহা রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থ অনুকরণ বলিয়া মনে হইয়াছিল।

কবি মোজাম্মেল হক সাহেবের নিকট উৎসাহ পাইয়া পূর্ব অবহেলার ক্ষতগুলির আঘাত আমার মন হইতে কতকটা প্রশমিত হইয়াছিল। আমি নজরুলের সঙ্গে দেখা করিব স্থির করিলাম। পকেটে যে যক্ষের সম্পত্তি জমা ছিল;—তাহা ভাল মত গুণিয়া মনে মনে অঙ্ক কষিয়া দেখিলাম, ইহা হইতে যদি তিনটি পয়সা খরচ করি, তাহা হইলে আমার বাড়ি যাওয়ার ভাড়া কম পড়িবে না। সুতরাং তিনটি পয়সা খরচ করিয়া বৈঠকখানা রোডের এক দর্জীর দোকান হইতে একটি সাদা টুপি কিনিয়া মাথায় পরিয়া নজরুল সন্দর্শনে রওনা হইলাম। টুপির জন্য ইতিপূর্বে মোজাম্মেল হক সাহেবের কাছে অনুযোগ শুনিয়াছি, নজরুলও হয়ত সেইরূপ অনুযোগ করিতে পারেন। সেইজন্য সেই বহু আয়াসের উপার্জিত তিনটি পয়সা খরচ করিতে হইল।

তখন নজরুল থাকিতেন কলেজ স্ত্রীটের বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে। গিয়া দেখি, কবি বারান্দায় বসিয়া কি লিখিতেছেন। আমার খবর পাইয়া, তিনি লেখা ছাড়িয়া ছুটিয়া আসিলেন। আমি তাঁহাকে নিষেধ করিয়া বলিলাম, “আপনি লিখছিলেন—আগে আপনার লেখা শেষ করুন, পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আমি অপেক্ষা করছি।” কবি তাঁহার পূর্ব লেখায় মনোনিবেশ করিলেন। আমি লেখন-রত কবিকে লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। কবির সমস্ত অবয়বে কী যেন এক মধুর মোহ মিশিয়া আছে। দু’টি বড় বড় চোখ শিশুর মত সরল। ঘরের সমস্ত পরিবেশ নিরীক্ষণ করিয়া আমার ইহাই মনে হইল, এত কষ্টের তিনটি পয়সা খরচ করিয়া কিস্তি-টুপিটি না কিনিলেও চলিত। কবির নিজের পোশাকেও কোন টুপি-আচকান-পায়জামার গন্ধ পাইলাম না।

অল্প সময়ের মধ্যেই কবি তাহার লেখা শেষ করিয়া আমার নিকট চলিয়া আসিলেন। আমি অনুরোধ করিলাম, কী লিখিয়াছেন আগে আমাকে পড়িয়া শোনান।

হার-মানা হার পরাই তোমার গলে…ইত্যাদি–

কবি-কণ্ঠের সেই মধুর স্বর এখনও কানে লাগিয়া আছে। কবিকে আমি আমার কবিতার খাতাখানি পড়িতে দিলাম। কবি দুই-একটি কবিতা পড়িয়াই খুব উচ্ছ্বাসিত হইয়া উঠিলেন। আমার কবিতার খাতা মাথায় লইয়া নাচিতে আরম্ভ করিলেন। আমার রচনার যে স্থানে কিছুটা বাকপটুত্ব ছিল, সেই লাইনগুলি বারবার আওড়াইতে লাগিলেন।

এমন সময় বিশ্বপতি চোধুরী মহাশয় কবির সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। তখন বিশ্বপতিবাবুর ‘ঘরের ডাক’ নামক উপন্যাস প্রবাসীতে ধারাবাহিক ভাবে বাহির হইতেছে। দুই বন্ধুতে বহু রকমের আলাপ হইল। কবি তাহার বহু কবিতা আবৃত্তি করিয়া শুনাইলেন। সেইদিন কবির মুখে তাঁহার পলাতকা কবিতাটির আবৃত্তি বড়ই ভাল লাগিয়াছিল :

আচমকা কোন্ শশক-শিশু চমকে ডেকে যায়,

ওরে আয়–

আয়ুরে বনের চপল চখা,

ওরে আমার পলাতক!

ধানের শীষে শ্যামার শিষে

যাদুমণি বল সে কিসে

তোরে কে পিয়াল সবুজ স্নেহের কাঁচা বিষে রে!

এই কবিতার অনুপ্রাস-ধ্বনি আমাকে বড়ই আকর্ষণ করিয়াছিল। আজ পরিণত বয়সে বুঝিতে পারিতেছি, কবিতার মধ্যে যে করুণ সুরটি ফুটাইয়া তুলিতে কবি চেষ্টা করিয়াছেন, অনুপ্রাস বরঞ্চ তাহাকে কতকটা ক্ষুণ্ণ করিয়াছে। কিন্তু একথা ভুলিলে চলিবে না, নজরুলের বয়স তখন খুবই অল্প।

গল্পগুজব শেষ হইলে কবি আমাকে বলিলেন, “আপনার কবিতার খাতা রেখে যান। আমি দুপুরের মধ্যে সমস্ত পড়ে শেষ করব। আপনি চারটার সময় আসবেন।”

কবির নিকট হইতে চলিয়া আসিলাম। কিন্তু কবির ব্যক্তিত্ব আর স্নেহ-মধুর ব্যবহার আমার অবচেতন মনে কাজ করিতে লাগিল। কোন্ অশরীরী ফেরেস্তা যেন আমার মনের বীণার তারে তাহার কোমল অঙ্গুলি রাখিয়া অপূর্ব সুর-লহরীর বিস্তার করিতে লাগিল। তাহার প্রভাবে সমস্ত বিশ্ব-প্রকৃতি, এমন কি, কলিকাতার নোংরা বস্তি গাড়ী-ঘোড়া-ট্রামও আমার কাছে অপূর্ব বলিয়া মনে হইতে লাগিল।

চারিটা না বাজিতেই কবির নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, কবি আমারই কবিতার খাতাখানা লইয়া অতি মনোযোগের সঙ্গে পড়িতেছেন। খাতা হইতে মুখ তুলিয়া সহাস্যে তিনি আমাকে গ্রহণ করিলেন। অতি মধুর স্নেহে বলিলেন, “তোমার কবিতার মধ্যে যেগুলি আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, আমি দাগ দিয়ে রেখেছি। এগুলি নকল করে তুমি আমাকে পাঠিয়ে দিও। আমি কলিকাতার মাসিকপত্র গুলিতে প্রকাশ করব।”

এমন সময় কবির কয়েকজন বন্ধু কবির সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। কবি তাহাদিগকে আমার কয়টি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন। বন্ধুরা আমার কবিতা শোনার চাইতে কবিকে কোথাও লইয়া যাইবার জন্য মনোযোগী ছিলেন। কবি হাবিলদারের পোশাক পরিতে পরিতে গান গাহিয়া উচ্চ হাস্যধ্বনি করিয়া লাফাইয়া ঝাপাইয়া নিজের প্রাণ-চাঞ্চল্যের প্রকাশ করিতে লাগিলেন। আমি কবির নিকট হইতে বিদায় লইয়া চলিয়া আসিলাম।

কার্তিকদার আড্ডায় আসিয়া দেখি, তিনি মাথায় হাত দিয়া বসিয়া আছেন। আমারই মতন জনৈক পথে-কুড়ান ভাই তাঁহার বাক্স হইতে টাকাপয়সা যাহা-কিছু ছিল, সমস্ত লইয়া পলাইয়া গিয়াছে। আমার কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এই লোকটি আমাদের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করিতেন : নিজে অভুক্ত থাকিয়া, কতদিন দেখিয়াছি, এমনই পথে-পাওয়া তার কোন অনাহারী ভাইকে খাওয়াইতেছেন। এই কি তার প্রতিদান!

আমি দেশে চলিয়া যাইব বলিতে কার্তিকদা খুশী হইলেন। আমাকে বলিলেন, “তুমি দেশে গিয়ে পড়াশুনা কর। মানুষ হয়ে আবার কলকাতা এসো। দেখবে, সবাই তোমায় আদর করবে। আমিও তোমার মত দেশে গিয়ে পড়াশুনা করতাম, লজ্জায় যেতে পারছি না। যে সব ছাত্র আমার মত বিদ্যালয়ের গোলামখানা ছেড়ে আসেনি, তাদের কত গালি দিয়েছি; টিটকারী করে বক্তৃতা দিয়েছি। আবার তাদের মধ্যে কোন্ মুখে ফিরে যাব?”

বিদায় লইবার সময় আমার মাদুর খানা কার্তিকদাকে দিয়া আসিলাম, কার্তিকদা তাহা বিনা দামে কিছুতেই লইলেন না, তিনি জোর করিয়া আমার পকেটে মাদুরের দামটা দিয়া দিলেন। স্টেশনে আসিয়া আমার টিকিট খরিদ করিয়া দিলেন। বিদায় লইয়া আসিবার সময় তিনি আমাকে বলিলেন, “জসীম, যখন যেখানেই থাকবি, মনে রাখিস তোর এই কার্তিকদার মনে তোর আসনটি চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। আমার জীবন হয়তো এই ভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে। পড়াশুনা করে মানুষ হবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তা জীবনে ঘটবে না। নেতাদের কথায় কলেজ ছেড়ে যে ভুল করেছি, সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে হয়তো সারা জীবন করতে হবে। কিন্তু তোর জীবনে এই ভুল সংশোধন করার সুযোগ হল; তুই যেন বড় হয়ে তোর কার্তিকদাকে ভুলে যাসনে। নিশ্চয় তুই একজন বড় কবি হতে পারবি। তখন আমাদের কথা মনে রাখিস।”

আমি অশ্রুসজল নয়নে বলিলাম, “কার্তিকদা, তোমাকে কোনদিন ভুলব না। ভাল কাজ করলে সেই কাজে বোনা বীজের মত মানুষের মনে অঙ্কুর জন্মাতে থাকে। হয়তো সকলের অন্তরে সেই বীজ হতে অঙ্কুর হয় না। কিন্তু একথা মনে রাখবেন, ভাল কাজ বৃথা যায় না। আপনার কথা এই দূরদেশী ছোট ভাইটির মনে চিরকাল জাগ্রত থাকবে।”

তখনকার কিশোর বয়সে এইসব কথা তেমন করিয়া গুছাইয়া বলিতে পারিয়াছিলাম কিনা মনে নাই। কিন্তু আজও আমার মনের গহন কোণে কার্তিকদার সৌম্য মূর্তি চির-উজ্জ্বল হইয়া আছে। এতটুকুও ম্লান হয় নাই। দেশে ফিরিয়া আসিয়া কার্তিকদার কাছে পত্র লিখিয়াছিলাম। কোন উত্তর পাই নাই। হয়তো তিনি তখন অন্যত্র বাসা বদল করিয়াছিলেন। তারপর কতজনের কাছে কার্তিকদার অনুসন্ধান করিয়াছি। কেহ তাহার খবর বলিতে পারে নাই। আজ আমার কিঞ্চিৎ কবিখ্যাতি হইয়াছে। আমার বইগুলি পড়িলে কার্তিকদা কত সুখী হইতেন! বঙ্গ বিভাগের পর তিনি কোথায় গিয়াছেন, কে জানে? হয়তো অনেকগুলি ছেলেমেয়ে লইয়া তিনি কোন সুদূর পশ্চিম অঞ্চলে দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া কোন রকমে বাঁচিয়া আছেন।

দেশে ফিরিয়া আসিয়া দেখি, আমার মা আমার জন্য চিন্তা করিয়া শুখাইয়া গিয়াছেন। পিতা নানাস্থানে আমার খোঁজখবর লইয়া অস্থির হইয়াছেন। আজীবন মাস্টারী করিয়া ছেলেদের মনোবিজ্ঞান তাঁর ভাল ভাবেই জানা ছিল। তিনি জানিতেন চোদ্দপনর বৎসরের ছেলেরা এমনি করিয়া বাড়ি হইতে পলাইয়া যায়; আবার ফিরিয়া অস। সেই জন্য তিনি আমার ইস্কুলের বেতন ঠিকমত দিয়া আসিতেছিলেন।

মা আমাকে সামনে বসাইয়া খাওয়াইতে লাগিলেন। বাড়ির আম সেই কবে পাকিয়াছিল, তাহা অতি যত্নে আমার জন্য রাখিয়া দিয়াছেন। অর্ধেক পচিয়া গিয়াছে তবু ছোট ভাই-বোনদের খাইতে দেন নাই আমি আসিলে খাইব বলিয়া।

আবার ইস্কুলে যাইতে লাগিলাম। নজরুল ইসলাম, সাহেবের নিকট কবিতার নকল পাঠাইয়া সুদীর্ঘ পত্র লিখিলাম। কবির নিকট হইতে কবিতার মতই সুন্দর উত্তর আসিল। কবি আমাকে লিখিলেন—

“ভাই শিশুকবি, তোমার কবিতা পেয়ে সুখী হলুম। আমি দখিন হাওয়া। ফুল ফুটিয়ে যাওয়া আমার কাজ। তোমাদের মত শিশু কুসুমগুলিকে যদি আমি উৎসাহ দিয়ে আদর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি, সেই হবে আমার বড় কাজ। তারপর আমি বিদায় নিয়ে চলে যাব আমার হিমগিরির গহন বিবরে।”

কবির নিকট হইতে এরূপ চার-পাঁচখানা পত্র পাইয়াছিলাম। তাহা সেকালের অতি উৎসাহের দিনে বন্ধুবান্ধবদের দেখাইতে দেখাইতে হারাইয়া ফেলিয়াছি। কিছুদিন পরে মোসলেম ভারতে যে সংখ্যায় কবির বিখ্যাত ‘বিদ্রোহ’ কবিতা প্রকাশিত হইয়াছিল, সেই সংখ্যায় ‘মিলন-গান’ নামে আমারও একটি কবিতা ছাপা হইয়াছিল। চট্টগ্রাম হইতে প্রকাশিত সাধনা পত্রিকাতেও আমার দুই-তিনটি কবিতা ছাপা হয়। ইহা সবই কবির চেষ্টায়। আজও ভাবিয়া বিস্ময় লাগে, তখন কী-ই বা এমন লিখিতাম। কিন্তু সেই অখ্যাত অস্ফুট কিশোর কবিকে তিনি কতই না উৎসাহ দিয়াছিলেন।

তারপর বহুদিন কবির কোন চিঠি পাই নাই। ইনাইয়াবিনাইয়া কবিকে কত কী লিখিয়াছি, কবি নিরুত্তর। হঠাৎ একখানা পত্র পাইলাম, কবি আমাকে ফরিদপুরের অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার নরেন্দ্র রায় মহাশয়ের পুত্রবধূ এবং তাঁর নাতি-নাতকুড়দের বিষয়ে সমস্ত খবর লিখিয়া পাঠাইতে অনুরোধ করিয়াছেন। নরেন্দ্রবাবুর এক নাতি আমারই সহপাঠি ছিল। তাহার সঙ্গে গিয়া তাহার মায়ের সঙ্গে দেখা করিলাম। ভদ্রমহিলা আমাকে আপন ছেলের মতই গ্রহণ করিলেন। আমি তাহাকে মাসীমা বলিয়া ডাকিলাম। তাঁহাদের বাসায় গিয়া শুনিতে পাইলাম, মাসীমার বড় বোন বিরজাসুন্দরী দেবীকে কবি মা বলিয়া ডাকেন। কবির বিষয়ে তিনি আরও অনেক কথা বলিলেন। সেই হইতে মাসীমা হইলেন কবির সঙ্গে আমার পরিচয়ের নূতন যোগসূত্র। কবি আমাকে পত্র লিখিতেন না। কিন্তু মাসীমা বড়বোন বিরজাসুন্দরী দেবীর নিকট হইতে নিয়মিত পত্র পাইতেন। সেইসব পত্র শুধু নজরুলের কথাতেই ভর্তি থাকিত।

মাসীমা কবির প্রায় অধিকাংশ কবিতাই মুখস্থ বলিতে পারিতেন। নজরুলের প্রশংসা যে দিন খুব বেশী করিতাম, সেদিন মাসীমা আমাকে না খাওয়াইয়া কিছুতেই আসিতে দিতেন না। মাসীমার গৃহটি ছিল রক্ষণশীল হিন্দু-পরিবারের। আজ ভাবিয়া বিস্ময় মনে হয়, কি করিয়া একজন মুসলিম কবির আরবী-ফরাসী মিশ্রিত কবিতাগুলি গৃহ-বন্দিনী একটি হিন্দু-মহিলার মনে প্রভাব বিস্তার করিতে পারিয়াছিল।

নজরুলের রচিত ‘মহরম’ কবিতাটি কতবার আমি মাসীমাকে আবৃত্তি করিতে শুনিয়াছি। মাসীমার আবৃত্তি ছিল বড় মধুর। তার চেহারাটি প্রতিমার মত ঝকমক করিত। একবার আমি নজরুলের উপর একটি কবিতা রচনা করিয়া মাসীমাকে শুনাইয়াছিলাম। সেদিন মাসীমা আমাকে পিঠা খাওয়াইয়াছিলেন। সেই কবিতার কটি লাইন মনে আছে—

নজরুল ইসলাম!

তছলিম ঐ নাম!

বাংলার বাদলার ঘনঘোর ঝঞ্ঝায়,

দামামার দমদম লৌহময় গান গায়;

কাঁপাইয়া সূর্য ও চন্দ্রের কক্ষ,

আলোড়িত আসমান ধরণীর বক্ষ;

সেই কালে মহাবীর তোমারে যে হেরিলাম,

নজরুল ইসলাম।

নজরুল কাব্য-প্রতিভার যবনিকার অন্তরালে আমার এই মাসীমার এবং তার বোনদের স্নেহ-সুধার দান যে কতখানি, তাহা কেহই কোনদিন জানিতে পারিবে না। বৃক্ষ যখন শাখাবাহু বিস্তার করিয়া ফুলে ফুলে সমস্ত ধরণীকে সজ্জিত করে, তখন সকলের দৃষ্টি সেই বৃক্ষটির উপর। যে গোপন মাটির স্তন্যধারা সেই বৃক্ষটিকে দিনে দিনে জীবনরস দান করে, কে তাহার সন্ধান রাখে? কবি কিন্তু তার জীবনে ইহাদের ভোলেন নাই। মাসীমাকে কবি একখানা সুন্দর শাড়ী উপহার দিয়াছিলেন। মৃত্যুর আগে মাসীমা বলিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহাকে শ্মশানে লইয়া যাইবার সময় যেন তাঁর মৃতদেহ সেই শাড়ীখানা দিয়া আবৃত করা হয়।

মাসীমার বড় বোন বিরজাসুন্দরী দেবী অশ্রুসজল নয়নে আমাকে বলিয়াছিলেন, “তোমার মাসীমার সেই শেষ ইচ্ছা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছিল।”

বহুদিন কবির চিঠি পাই না। হঠাৎ এক পত্র পাইলাম, কবি ‘ধূমকেতু’ নাম দিয়া একখানা সাপ্তাহিক পত্র বাহির করিতেছেন। তিনি আমাকে লিখিয়াছেন ধূমকেতুর গ্রাহক সংগ্রহ করিতে। ছেলেমানুষ আমি—আমার কথায় কে ধূমকেতুর গ্রাহক হইবে? সুফী মোতাহার হোসেন অধুনা কবিখ্যাতিসম্পন্ন; সে তখন জেলা ইস্কুলের বোর্ডিং-এ থাকিয়া পড়াশুনা করিত। সে আমার কথায় ধুমকেতুর গ্রাহক হইল। তখন দেশে গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলন চলিতেছিল। দেশের নেতারা পুঁথিপত্র ঘাটিয়া রক্তপাতহীন আন্দোলনের নজির খুঁজিতেছিলেন। নজরুলের ধূমকেতু কিন্তু রক্তময় বিপ্লববাদের অগ্নি-অক্ষর লইয়া বাহির হইল। প্রত্যেক সংখ্যায় নজরুল যে অগ্নি উদারী সম্পাদকীয় লিখিতেন, তাহা পড়িয়া আমাদের ধমনীতে রক্ত প্রবাহ ছুটিত। সেই সময়ে বিপ্লবীরা বৃটিশ গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে যে মারণ যজ্ঞের আয়োজন করিয়াছিলেন, নজরুল-সাহিত্য তাহাতে অনেকখানি ইন্ধন যোগাইয়াছিল। তাহার সেই সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলি আমরা বার বার পড়িয়া মুখস্থ করিয়া ফেলিতাম। একটি প্রবন্ধের নাম ছিল “ম্যাঁয় ভুখা হুঁ! ভারতমাতা অন্তরীক্ষ হইতে বলিতেছেন, আমি রক্ত চাই, নিজ সন্তানের রক্ত দিয়া তিমিররাত্রির বুকে নব-প্রভাতের পদরেখা অঙ্কিত করিব।” ধূমকেতুর মধ্যে যে সব খবর বাহির হইত, তাহার মধ্যেও কবির এই সুরটির রেশ পাওয়া যাইত।

ধূমকেতুতে প্রকাশিত একটি কবিতার জন্য কবিকে গ্রেপ্তার করা হইল। বিচারে কবির জেল হইল। জেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা না মানার জন্য কর্তৃপক্ষ কবির প্রতি কঠোর হইয়া উঠিলেন। কবি অনশন আরম্ভ করিলেন। কবির অনশন যখন তিরিশ দিনে পরিণত হইল তখন সারা দেশ কবির জন্য উদগ্রীব হইয়া উঠিল। রবীন্দ্রনাথ হইতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পর্যন্ত সকলেই কবিকে অনাহার-ব্রত ভঙ্গ করিতে অনুরোধ করিলেন। কবি নিজ সঙ্কল্পে অচল অটল। তখনকার দিনে বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সভাপতিত্বে কবির অনশন উপলক্ষে গভর্নমেন্টের কার্যের প্রতিবাদে কলিকাতায় বিরাট সভার অধিবেশন হইল। সেই সভায় হাজার হাজার লোক কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাইলেন। দেশবন্ধু তাঁহার উদাত্ত ভাষায় কবির মহাপ্রতিভার উচ্চ প্রংশসা করিলেন। বাংলাদেশের খবরের কাগজ গুলিতে প্রতিদিন নজরুলের কাব্য-মহিমা বাঙালীর হৃদয় তন্ত্রীতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। নজরুলের বিজয়বৈজয়ন্তির কী-ই না যুগ গিয়াছে! কেহ কেহ বলিতে লাগিলেন, নজরুল রবীন্দ্রনাথের চাইতেও বড় কবি।

অনশন ব্রত কবির জীবনে একটা মহাঘটনা। যাঁহারা কবিকে জানেন, তাঁহারা লক্ষ্য করিয়াছেন, কবি সংযম কাহাকে বলে জানিতেন না। রাজনৈতিক বহু নেতা এরূপ বহুবার অনশন-ব্রত অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহারা ছিলেন ত্যাগে অভ্যস্ত। কবির মত একজন প্রাণচঞ্চল লোক কি করিয়া জেলের মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন, তাহা এক আশ্চর্য ঘটনা। দিনের পর দিন এইরূপ অনশন একেবারে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়। কিন্তু নজরুল-জীবনের এই সময়টি এক মহামহিমার যুগ। কোন অন্যায়ের সঙ্গেই মিটমাট করিয়া চলিবার পাত্র তিনি ছিলেন না। সেই সময়ে দেখিয়াছি, কত অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া তাঁহার দিন গিয়াছে। যদি একটু নরম হইয়া চলিতেন, যদি লোকের চাহিদা মত কিছু লিখিতেন, তবে সম্মানের আর সম্পদের সিংহাসন আসিয়া তাঁহার পদতলে লুটাইত।

তাঁহার ভিতরে কবি এবং দেশপ্রেমিক একসঙ্গে বাসা বাঁধিয়াছিল। আদর্শবাদী নেতা এবং সাহিত্যিকের সমন্বয় সাধিত হইয়াছিল তাঁহার জীবনে। চল্লিশ দিন অনশনের পর কবি অন্ন-গ্রহণ করিলেন। তারপর জেল হইতে বাহির হইয়া আসিলে চারিদিকে কবির জয় ডঙ্কা বাজিতে লাগিল। আমার মত শিশু-কবির ক্ষীণ কণ্ঠস্বর সেই মহা কলরব ভেদ করিয়া কবির নিকট পৌঁছিতে পারিল না।

আমি তখন সবে আই. এ. ক্লাসে উঠিয়াছি। আমার কবিতার রচনা-রীতি পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। পূর্বে রবীন্দ্র-রচনার পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া যাহা লিখিতাম, বহু কাগজে তাহা ছাপা হইয়াছে। এমন কি প্রবাসী কাগজে পর্যন্ত আমার লেখা প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু গ্রাম্য-জীবন লইয়া গ্রাম্য-ভাষায় যখন কবিতা রচনা করিতে আরম্ভ করিলাম, কেহই তাহা পছন্দ করিল না। কাগজের সম্পাদকেরা আমার লেখা পাওয়া মাত্র ফেরত পাঠাইয়া দিতেন। সবটুকু হয়তো পড়িয়াও দেখিতেন না। সেই সময়ে আমার মনে যে কি দারুণ দুঃখ হইত, তাহা বর্ণনার অতীত।

একবার গ্রীষ্মকালে দুপুরবেলায় আমাদের গ্রামের মাঠ দিয়া চলিয়াছি, এমন সময় পিয়ন আসিয়া ভারতবর্ষ হইতে অমানেনীত “বাপের বাড়ির কথা” নামক কবিতাটি ফেরত দিয়া গেল। পিয়ন চলিয়া গেলে আমি মনোদুঃখে সেই ঢেলা-ভরা চষা-ক্ষেতের মধ্যে লুটাইয়া পড়িলাম। কিন্তু চারিদিক হইতে যতই অবহেলা আসুক না কেন আমার মনের মধ্যে জোর ছিল। আমার মনে ভরসা ছিল, আমি যাদের কথা লিখিতেছি, আরও ভাল করিয়া লিখিতে পারিলে নিশ্চয়ই দেশ একদিন আমার কবিতার আদর করিবে।

সেই সময়ে আমার কেবলই মনে হইত, একবার যদি কবি নজরুলের সঙ্গে দেখা করিতে পারি, নিশ্চয় তিনি আমার কবিতা পছন্দ করিবেন। গ্রাম্য-জীবন লইয়া কবিতা লিখিতে লিখিতে আমি গ্রাম-কবিদের রচিত গানগুলিরও অনুসন্ধান করিতেছিলাম। আমার সংগৃহীত কিছু গ্রাম-গান দেখিয়া পরলোকগত সাহিত্যিক যতীন্দ্রমোহন সিংহ মহাশয় আমাকে শ্রদ্ধেয় দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে দেখা করিতে পরামর্শ দেন।