মাসের প্রথম দিকেই আমি আসিয়াছিলাম। চার-পাঁচ দিন পরে যখন পোলাও-গোস্ত খাওয়ার পর্ব শেষ হইল, আমার বোন অতি আদরের সঙ্গে আমার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “সোনাভাই, আমাদের সংসারের খবর তুই জানিস না। এখন থেকে আমরা কোনদিন বা অনাহারে থাকব। আমাদের সঙ্গে থেকে তুই এত কষ্ট করবি কেন? তুই বাড়ি যা।”

আমি যে সঙ্কল্প লইয়া কলিকাতায় আসিয়াছি, তাহা সফল হয় নাই। কলিকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে এখনও আমি পরিচিত হইতে পারি নাই। বোনকে বলিলাম, “বুবুজান, আমার জন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না। কাল থেকে আমি উপার্জন করতে আরম্ভ করব।”

বুবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবে উপার্জন করবি রে?”

আমি উত্তর করিলাম, “এখন তাহা আপনাকে বলব না। পরে জানাব।”

পরদিন সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া খববের কাগজের অপিসে ছুটিলাম। তখনকার দিনে ‘বসুমতী’ কাগজের চাহিদা ছিল সব চাইতে বেশী। কয়েকদিন আগে টাকা জমা দিলে হকাররা কাগজ পাইত না। ‘নায়ক’ কাগজের তত চাহিদা ছিল না। বসুমতী অপিসে চার-পাঁচ দিন আগে টাকা জমা দেওয়ার সঙ্গতি আমার ছিল না। সুতরাং পাঁচখানা নায়ক কিনিয়া বেচিতে বাহির হইলাম। রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া ‘নায়ক, নায়ক’ বলিয়া চীৎকার করিয়া ফিরিতে লাগিলাম। সারাদিন ঘুরিয়া পঁচিশখানা নায়ক বিক্রয় করিয়া যখন বাসায় ফিরিলাম, তখন শ্রান্তিতে আমার শরীর অবশ হইয়া আসিয়াছে। পঁচিশখানা বিক্রয় করিয়া আমার চৌদ্দ পয়সা উপার্জন হইল। আমার পরিশ্রান্ত-দেহে হাত বুলাইতে বুলাইতে বোন সস্নেহে বলিলেন, “তুই বাড়ি যা। এখানে এত কষ্ট করে উপার্জন করার কি প্রয়োজন? বাড়ি গিয়ে পড়াশুনা কর।”

কিন্তু এসব উপদেশ আমার কানে প্রবেশ করিল না। এইভাবে প্রতিদিন সকালে উঠিয়া খবরের-কাগজ বিক্রয় করিতে ছুটিতাম। রাস্তায় দাঁড়াইয়া কাগজে বর্ণিত খবর গুলি উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করিতাম। মাঝে মাঝে কাগজের সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতাম। কলিকাতা সহরে কৌতূহলী লোকের অভাব নাই। তাহারা ভীড় করিয়া জড়াইয়া আমার বক্তৃতা শুনিত। কিন্তু কাগজ কিনিত না।

কাগজ বিক্রয় করিতে করিতে কার্তিকদাদার সঙ্গে পরিচয় হইল। বিক্রমপুরের কোন গ্রামে তাহার বাড়ি। তিনিও খবরের কাগজ বিক্রয় করিতেন। কি ভাবে তাহার সঙ্গে আলাপ হইল, আজ সমস্ত মনে নাই। তবে এতটুকু মনে আছে, আমার অবিক্রীত কাগজগুলি কার্তিকদাদা বিক্রয় করিয়া দিতেন। আমারই মত অনেক হকারের এটা-ওটা কাজ তিনি করিয়া দিতেন। সেইজন্য আমরা সকলে তাহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করিতাম।

আপার সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে কার্তিক দাদা থাকিতেন। আমার বোনের বাড়িতে থাকার অসুবিধার কথা শুনিয়া কার্তিক দাদা আমাকে তাহার বাসায় উঠিয়া আসিতে বলিলেন। আট আনায় একটি মাদুর কিনিয়া লইয়া কার্তিকদাদার বাসায় উপস্থিত হইলাম। এক ভাঙা বাড়ির দ্বিতল কক্ষ কার্তিকদাদা ভাড়া লইয়াছিলেন। কক্ষটির সামনে প্রকাণ্ড খোলা ছাদ ছিল। সেই ছাদেই আমরা অধিকাংশ সময় যাপন করিতাম। বৃষ্টি হইলে সকলে ছাদ হইতে মাদুর গুটাইয়া আনিয়া ঘরের মধ্যে আসিয়া আশ্রয় লইতাম।

সকাল হইলে যে যার মত খবরের কাগজ লইয়া বিক্রয় করিতে বাহির হইতাম। দেড়টা বাজিলে সকলে বাসায় ফিরিয়া আসিতাম। তারপর দুইটা তিনটার মধ্যে রান্না ও খাওয়া শেষ করিয়া তাড়াতাড়ি ছুটিয়া যাইতাম খবরের কাগজের আপিসে। তখনকার দিনে বাংলা কাগজগুলি বিকেলে বাহির হইত। রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত কাগজ বিক্রয় করিয়া বাসায় ফিরিয়া আসিতাম। তারপর রান্নাখাওয়াটা কোন রকমে সারিয়া ছাদের উপর মাদুর বিছাইয়া তাহার উপর শ্রান্ত ক্লান্ত দেহটা ঢালিয়া দিতাম। আকাশে তারাগুলি মিটিমিটি করিয়া জ্বলিত। তাহাদের দিকে চাহিতে চাহিতে আমরা ঘুমাইয়া পড়িতাম। আকাশের তারাগুলি আমাদের দিকে চাহিয়া দেখিত কিনা কে জানে?

কোন কোন রাত্রে মোমবাতি জ্বালাইয়া কার্তিকদাদা আমার কবিতাগুলি সকলকে পড়িয়া শুনাইতেন। আমার সেই বয়সের কবিতার কতটা মাধুর্য ছিল, আজ বলিতে পারিব না। সেই খাতাখানা হারাইয়া গিয়াছে। আর আমার শ্রোতারা সেই সব কবিতার রস কতটা উপলব্ধি করিত, তাহাও আমার ভাল করিয়া মনে নাই।

কিন্তু তাহাদেরই মত একজন হকার যেসব কাগজ তাহারা বিক্রয় করে সেই সব কাগজের লেখার মত করিয়া যে লিখিতে পারিয়াছে, ইহা মনে করিয়া তাহারা গর্ব অনুভব করিত। কার্তিকদাদা আই. এ. পর্যন্ত পড়িয়াছিলেন। নন-কোঅপারেশন করিয়া কলিকাতায় আসিয়া খবরের কাগজ বিক্রয় পেশা হিসাবে লইয়াছেন। তিনি কট হামসুন ও ম্যক্সিম গোর্কীর জীবনী পড়িয়াছেন। আমাকে লইয়া তাঁহার গর্বের অন্ত ছিল না। কোন শিক্ষিত লোকের সঙ্গে দেখা হইলেই সগর্বে আমাকে কবি বলিয়া পরিচয় করাইয়া দিতেন।

আমাদের সংসারে ছিল দিন আনিয়া দিন খাওয়া। কেহই বেশী উপার্জন করিতে পারিত না। নন-কোঅপারেশন করিয়া আমাদের মতই বহু ভদ্রঘরের ছেলে খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে। সুতরাং কাগজ বিক্রয় করার লোকের সংখ্যা ছিল অত্যধিক। সারা দিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করিয়াও আমাদের কেহ চার-পাঁচ আনার বেশী উপার্জন করিতে পারি না। আমি চৌদ্দ পয়সার বেশী কোন দিনই উপার্জন করিতে পারি নাই। মাঝে মাঝে শরীর খারাপ থাকিলে বেশী ঘুরিতে পারিতাম না, সুতরাং উপার্জনও হইত না। সেই দিনটার খরচ কার্তিকদাদা চালাইয়া দিতেন। পরে তাহার ধার শোধ করিতাম। কোন কোন দিন আমার সেই বোনের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইতাম।

একদিনের কথা মনে পড়ে। কাগজ বিক্রয় করিয়া মাত্র এক আনা সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি! দুই পয়সার চিড়া আর দুই পয়সার চিনি কিনিয়া ভাবিলাম, কোথায় বসিয়া খাই? দুপুরবেলা আমার সেই বোনের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইলাম। বোন আমার শুষ্ক মুখ দেখিয়া প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। তিনি আমার হাত হইতে চিড়া আর চিনির ঠোঙা ফেলিয়া দিয়া আমাকে আদর করিয়া বসাইয়া ভাত বাড়িয়া দিলেন।

আমি বলিলাম, “বুবু, আপনি তত খান নাই। আপনার ভাত আমি খাব না।”

বুবু বলিলেন, “আমায় আজ পেট ব্যথা করছে। আমি খাব না। তুই এসে ভাল করলি। ভাতগুলি নষ্ট হবে না।”

আমি সরল মনে তাহাই বিশ্বাস করিয়া ভাতগুলি খাইয়া ফেলিলাম। তখন অল্প বয়সে তাঁহার এ স্নেহের ফাঁকি ধরিতে পারি নাই। এখন সেই সব কথা মনে করিয়া চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসে। হায় রে মিথ্যা! তবু যদি তাঁর মায়ের পেটের ভাই হইতাম! সাতজন্মে যাকে কোন দিন চোখে দেখেন নাই, কত দূরের সম্পর্কের ভাই আমি, তবু কোথা হইতে তাহার অন্তরে আমার জন্য এত মমতা সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। এইরূপ মমতা বুঝি বংলাদেশের সকল মেয়েদের অন্তরেই স্বতঃপ্রবাহিত হয়। বাপের বাড়ির কোন আত্মীয়কে এদেশের মেয়েরা অযত্ন করিয়াছে, এরূপ দৃষ্টান্ত ক্বচিৎ মেলে।

কার্তিকদার আড্ডায় দিনগুলি বেশ কাটিয়া যাইতেছিল। কিন্তু আমাকে খবরের কাগজ বিক্রয় করিলেই চলিবে না। কলিকাতায় আসিয়া লেখাপড়া করিতে হইবে। নেতাদের কথায় গোলামখানা ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি এখানকার জাতীয় বিদ্যালয়ে আমাকে পড়াশুনা করিতে হইবে। আমহাস্ট স্ট্রীটে একদিন জাতীয় বিদ্যালয় দেখিয়া আসিলাম। ক্লাসে গিয়াও যোগ দিলাম। ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক সবাই ইংরেজীতে পড়ান হয়। মাস্টার একজনও বাংলায় কথা বলেন না। কারণ ক্লাসে হিন্দীভাষী ও উর্দুভাষী ছাত্র আছে। বাংলায় পড়াইলে তাহারা বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু নবম শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে ইংরেজীতে বক্তৃতা দিলে কতটাই বা তাহারা বুঝিতে পারিবে! তাদের ইংরেজী বিদ্যার পুঁজি তো আমার চাইতে বেশী নয়। সুতরাং জাতীয় বিদ্যালয়ের মোহ আমার মন হইতে মুছিয়া গেল। নেতাদের মুখে কত গরম গরম বক্তৃতা শুনিয়াছি। ইংরেজ-আমলের বিদ্যালয়গুলি গোলামখানা; উহা ছাড়িয়া বাইরে আইস। এখানে বসন্তের মধুর হাওয়া বহিতেছে। আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ে আসিয়া দেখ, বিদ্যার সূর্য তার সাত ঘোড়া হাঁকাইয়া কিরূপ বেগে চলিতেছে। কিন্তু গোলামখানা ছাড়িয়া আমি কতদিন আসিয়াছি, বসন্তের হাওয়া তো বহিতে দেখিলাম না। জাতীয় বিদ্যালয়ের সেই সাত ঘোড়ার গতিও অনুভব করিতে পারিলাম না।

জাতীয় বিদ্যালয়ের এই সব মাস্টারের চাইতে আমাদের ফরিদপুরের জেলা-ইস্কুলের দক্ষিণাবাবু কত সুন্দর পড়ান, যোগেনবাবু পণ্ডিত মহাশয় কত ভাল পড়ান! আমার মন ভাঙিয়া পড়িল। সারাদিন খবরের কাগজ বেচিয়া রাত্রে ছাদের উপর শুইয়া পড়িতাম, এপাশের ওপাশের সহকর্মীরা ঘুমাইয়া পড়িত, কিন্তু আমার ঘুম আসিত না। মায়ের কথা ভাবিতাম, পিতার কথা ভাবিতাম। তাঁহারা আমার জন্য কত চিন্তা করিতেছেন! চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়া যাইত। এ আমি কি করিতেছি? এইভাবে খবরের কাগজ বিক্রয় করিয়া জীবন কাটাইয়া দিব? আমি লেখাপড়া শিখিব, মূর্খ হইয়া থাকিব? কে যেন অদৃশ্য স্থান হইতে আমার পিঠে সপাং সপাং করিয়া বেত্রাঘাত করিতেছে। নাঃ, আমি আর সময় নষ্ট করিব না, দেশে ফিরিয়া যাইব। দেশে ফিরিয়া গিয়া ভালমন্দ লেখাপড়া করিয়া মানুষ হইব। আমি সংকল্প স্থির করিরা ফেলিলাম।

দেশে ফিরিবার পূর্বে আমি কলিকাতার সাহিত্যিকদের কাছে পরিচিত হইয়া যাইব। ছেলেবেলা হইতে আমি সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুরাগী ছিলাম। তাঁহার সওগাত নামক গল্পগ্রন্থখানিতে মুসলমানদের জীবন লইয়া কয়েকটি গল্প লেখা ছিল। তাহা ছাড়া চারুবাবুর লেখায় যে সহজ কবিত্ব মিশ্রিত ছিল, তাহাই আমাকে তাহার প্রতি অনুরাগী করিয়া তুলিয়াছিল। আমি ভাবিলাম, তাঁহার কাছে গেলে তিনি আমাকে উৎসাহ দিবেন। এমন কি, আমার একটি লেখা প্রবাসীতেও ছাপাইয়া দিতে পারেন। তিনি তখন প্রবাসীর সহকারী-সম্পাদক।

অনেক কষ্টে প্রবাসী-অফিসের ঠিকানা সংগ্রহ করিয়া একদিন সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তখনকার দিনে কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে ব্রাহ্মসমাজের নিকটে এক বাড়ি হইতে প্রবাসী বাহির হইত। প্রবাসী-অফিসের দারোয়ানের কাছে চারুবাবুর সন্ধান করিতেই দারোয়ান মোটা একটি কালো লোককে দেখাইয়া আমাকে বলিল, উনিই চারুবাবু। সেই ভদ্রলোকের সামনে গিয়া সালাম করিয়া দাঁড়াইলাম।

“কি চাই?” বলিয়া তিনি আমাকে প্রশ্ন করিলেন।

আমি বলিলাম, “আমি কিছু কবিতা লিখেছি, আপনি যদি অনুগ্রহ করে পড়ে দেখেন বড় সুখী হব।”

ভদ্রলোক বলিলেন, “আমার তো সময় নেই।”

অতি বিনয়ের সঙ্গে বলিল, “বহুকাল হতে আপনার লেখা পড়ে আমি আপনার অনুরাগী হয়েছি। আপনি সামান্য একটু যদি সময়ের অপব্যয় করেন!”

এই বলিয়া আমি বগলের তলা হইতে আমার কবিতার খাতাখানা তাঁর সামনে টানিয়া ধরিতে উদ্যত হইলাম। ভদ্রলোক যেন ছুৎমার্গ গ্রস্ত কোন হিন্দু বিধবার মত অনেকটা দূরে সরিয়া গিয়া আমাকে বলিলেন, “আজ আমার মোটেই সময় নেই।” কিন্তু ডুবন্ত লোকের মত এই তৃণখণ্ডকে আমি কিছুতেই ছাড়িতে পারিতেছিলাম না। কাকুতিমিনতি করিয়া তাহাকে বলিলাম, “একদিন যদি সামান্য কয়েক মিনিটের জন্যও সময় করেন।” ভদ্রলোকের দয়া হইল। তিনি আমাকে ছয়-সাত দিন পরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসিতে বলিলেন। তখন আমার প্রবাসের নৌকার নোঙর ছিড়িয়াছে। দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য আমার মন আকুলিবিকুলি করিতেছে। তবুও আমি সেই কয়দিন কলিকাতায় রহিয়া গেলাম। আমার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, একবার যদি তাহাকে দিয়া আমার একটি কবিতা পড়াইতে পারি, তবে তিনি আমাকে অতটা অবহেলা করিবেন না। নিশ্চয়ই তিনি আমার কবিতা পছন্দ করিবেন।

আবার সেই খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে যাই। পথে পথে ‘নায়ক-নায়ক’—বলিয়া চীৎকার করি। কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে আমার গৃহগত মনের আবেগে সিক্ত হইয়া উঠে। দলে দলে ছেলেরা বই লইয়া ইস্কুলে যায়। দেখিয়া আমার মন উতলা হইয়া উঠে। আমিও পড়িব। দেশে গিয়া ওদের মত বই লইয়া আমিও ইস্কুলে যাইব। এত যে পয়সার অনটন, নিজের আহারের উপযোগী পয়সাই সংগ্রহ করিতে পারি না, তবুও মাঝে মাঝে এক পয়সা দিয়া একটা গোলাপফুল কিনিতাম। দেশে হইলে কারও গাছ হইতে বলিয়া বা না বলিয়া ছিড়িয়া লইলে চলিত। এখানে ফুল পয়সা দিয়া কিনিতে হয়। আমার একহাতে খবরের কাগজের বাণ্ডিল, আর এক হাতে সেই গোলাপফুল। সঙ্গীসাথীরা ইহা লইয়া আমাকে ঠাট্টা করিত।

আজও আবছা আবছা মনে পড়িতেছে—তের-চৌদ্দ বৎসরের সেই ছোট্ট বালকটি আমি, মোটা খদ্দরের জামা পরিয়া দুপুরের রৌদ্রে কলিকাতার গলিতে গলিতে ঘুরিয়া ‘চাই নায়ক’ ‘চাই নায়ক ‘চাই বিজলী’ করিয়া চিৎকার করিয়া ফিরিতেছি। গলির দুই পাশে ঘরে ঘরে কত মায়া, কত মমতা, কত শিশুমুখের কলকাকলি। গল্পে কত পড়িয়াছি, এমনি এক ছোট্ট ছেলে পথে পথে ঘুরিতেছিল; এক সহৃদয়া রমণী তাহাকে ডাকিয়া ঘরে তুলিয়া লইলেন। আমার জীবনে এমন ঘটনা কি ঘটিতে পারে না! রবীন্দ্রনাথের “আপদ” অথবা “অতিথি” গল্পের সহৃদয়া মা-দু’টি তো এই কলিকাতা শহরেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। মনে মনে কত কল্পনাই করিয়াছি। কিন্তু মনের কল্পনার মত ঘটনা আমার জীবনে কখনও ঘটিল না। আমার নিকট সুবিস্তৃত কলিকাতা শুধু ইট-পাটকেলের শুষ্কতা লইয়াই বিরাজ করিল।

একদিন খবরের কাগজ লইয়া গলিপথ দিয়া চলিয়াছি। ত্রিতল হইতে এক ভদ্রলোক হাত ইশারা করিয়া আমাকে ডাকিলেন। উপরে গিয়া দেখি তাহার সমস্ত গায়ে বসন্তের গুটি উঠিয়াছে। কোন রকমে তাকে কাগজখানা দিয়া পয়সা লইয়া আসিলাম। সেদিন রাত্রে শুধু সেই বসন্তরোগগ্রস্ত লোকটিকেই মনে হইতে লাগিল। আর মাঝে মাঝে ভয় হইতে লাগিল, আমাকেও বুঝি বসন্তরোগে ধরিবে।

আস্তে আস্তে চারুবাবুর সঙ্গে দেখা করার সেই নির্দিষ্ট দিনটি নিকটে আসিল। বহু কষ্টের উপার্জিত দুইটি পয়সা খরচ করিয়া একটি বাংলা সাবান কিনিয়া ধূলি-মলিন খদ্দরের জামাটি পরিষ্কার করিয়া কাচিলাম। দপ্তরীপাড়ার কোন দপ্তরীর সঙ্গে খাতির জমাইয়া কবিতার খাতাখানিতে রঙিন মলাট পরাইলাম। তারপর সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত নির্দিষ্ট সময়টিতে প্রবাসী-অফিসের দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। অল্পক্ষণ পরেই আমার সেই পূর্ব-পরিচিত চারুবাবুকে সামনে দিয়া চলিয়া যাইতে দেখিলাম। তিনি আমার দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন না। আমি তাড়াতাড়ি সামনে আগাইয়া গিয়া পদধুলি গ্রহণ করিয়া তাঁহার সামনে দাঁড়াইলাম। তিনি পূর্বদিনের মত করিয়াই আমাকে প্রশ্ন করিলেন,

“তা কি মনে করে?”

আমি তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিলাম, “আপনি আমাকে আজ এই সময় আসতে বলেছিলেন। আপনি যদি আমার দু-একটি কবিতা দেখে দিতেন…”

তিনি নাক সিটকাইয়া বলিলেন, “দেখুন, কবিতা লিখে কোন কাজই হয় না। আপনি গদ্য লিখুন।”

আমি আমার পদ্য-লেখা খাতাখানা সামনে ধরিয়া বলিলাম, “আমি তো গদ্যও কিছু লিখেছি।”

ভদ্রলোক দাঁত খিঁচাইয়া ধমকের সঙ্গে বলিলেন, “মশায়, আপনি কি ভেবেছেন আপনার ঐ আজেবাজে লেখা পড়ার সময় আমার আছে?” এই বলিয়া ভদ্রলোক আগাইয়া চলিলেন। কিছুতেই আমার বিশ্বাস হইতেছিলেন না, আমার ধ্যানলোকের সেই সাহিত্যিক চারুবাবু ইনিই হইতে পারেন। ভদ্রলোকের চাকর মাছের খালুই হাতে করিয়া তাঁহার পিছনে পিছনে যাইতেছিল। আমি গিয়া তাহাকে ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। চাকর কি-একটা নাম যেন বলিল। তাহাতে বুঝিতে পারিলাম, তিনি চারুবাবু নহেন।

রামানন্দ বাবুর বাড়ি আবার গিয়া কড়া নাড়িতেই এক নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। তাহার নিকট হইতে চারুবাবুর ঠিকানা লইয়া শিবনারায়ণ দাস লেন তার বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। খবর পাঠাইতেই আমাকে দ্বিতলে যাইবার আহ্বান আসিল। অর্ধশায়িত অবস্থায় সেই আগের লোকটির মতই তিনি আমাকে প্রশ্ন করিলেন, “কি চাই?” ঘরে বোধ হয় আরও দু-একজন ভদ্রলোক ছিলেন। পূর্বের লোকটির কাছ হইতে প্রত্যাখ্যাত হইয়া আসিয়াছি, তার চিহ্ন বোধ হয় মুখে-চোখে বর্তমান ছিল। তার উপরে একতলা হইতে দ্বিতলে উঠিয়া শ্রান্তিতে দীর্ঘনিঃশ্বাস লইতেছিলাম। কোন রকমে বলিলাম, “আমার কিছু কবিতা আপনাকে দেখাতে এসেছি।”

ভদ্রলোক অতি কর্কশ ভাবে আমাকে বলিলেন, “তা আমার বাড়িতে এসেছেন কবিতা দেখাতে?”

কল্পলোকের সেই চারুবাবুর কাছে আমি এই জবাব প্রত্যাশা করি নাই। আমি শুধু বলিলাম, “আমার ভুল হয়েছে, আমাকে মাফ করবেন।”

এই বলিয়া রাস্তায় নামিয়া আসিলাম। তখন সমস্ত আকাশবাতাস আমার কাছে বিষে বিষায়িত বলিয়া মনে হইতেছিল। ইচ্ছা হইতেছিল, কবিতার খাতাখানা ছিড়িয়া টুকরা টুকরা করিয়া আকাশে উড়াইয়া দিই। নিজের কর্ম-শক্তির উপর এত অবিশ্বাস আমার কোন দিনই হয় নাই। আজ এই সব লোককে কত কৃপার পাত্র বলিয়া মনে করিতেছি। কী এমন হইত, গ্রামবাসী এই ছেলেটিকে যদি তিনি দুটি মিষ্টিকথা বলিয়াই বিদায় দিতেন। যদি একটা কবিতাই পড়িয়া দেখিতেন, কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হইত।

আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলার অধ্যাপক, চারুবাবু তখন জগন্নাথ কলেজে পড়ান। একবার আলাপ-আলোচনায় এই গল্প তাঁহাকে কিছুটা মৃদু করিয়া শুনাইয়াছিলাম। তিনি বলিলেন, “আমার জীবনে এই ঘটনা ঘটেছে, এটা একেবারে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।”

বস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে চারুবাবু বহু অখ্যাত সাহিত্যিককে উৎসাহ প্রদান করিয়াছেন।

আমার কলিকাতা আসার সকল মোহ কাটিয়া গিয়াছে, এবার বাড়ি যাইতে পারিলেই হয়। কিন্তু আমার যে টাকা আছে তাহাতে রেল-ভাড়া কুলাইয়া উঠিবে না। ফরিদপুরের তরুণ উকিল অধুনা পাকিস্তান গণ-পরিষদের সভাপতি মৌলবী তমিজউদ্দিন সাহেব তখন ওকালতি ছাড়িয়া কলিকাতা জাতীয় কলেজে অধ্যাপনা করিতেছেন। তিনি ছোটকাল হইতেই আমার সাহিত্য-প্রচেষ্টায় উৎসাহ দিতেন। তাহার নিকটে গেলাম বাড়ি যাইবার খরচের টাকা ধার করিতে। তিনি হাসিমুখেই আমাকে একটি টাকা ধার দিলেন, আর বলিলেন, “দেখ, ভোলার কবি মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে আমি তোমার বিষয়ে আলাপ করেছি। তুমি যদি তার সঙ্গে দেখা কর, তিনি তোমাকে উৎসাহ দেবেন। এমন কি তোমার দু-একটি লেখা ছাপিয়েও দিতে পারেন।”

ছোটকাল হইতে কি করিয়া আমার মনে একটা ধারণা জন্মিয়াছিল, মুসলমানেরা কেহ ভাল লিখিতে পারেন না। সেইজন্য মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিবার আমার বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তমিজউদ্দিন সাহেব আমাকে বার বার বলিয়া দিলেন, “তুমি অবশ্য মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যেও।”

সাধারণ কৌতূহলের বশেই মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম। তিনি তখন কারমাইকেল হোস্টেলে থাকিতেন। মোজাম্মেল হক সাহেব আমার কয়েকটি কবিতা পড়িয়া খুবই প্রশংসা করিলেন এবং আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “বৎসরের প্রথম মাসে আমার পত্রিকায় কোন নূতন লেখকের লেখা ছাপি না। কিন্তু আপনার লেখা আমি বৎসরের প্রথম সংখ্যাতেই ছাপব।”

আমি মুসলমান হইয়া কেন মাথায় টুপি পরি নাই—এই বলিয়া তিনি আমাকে অনুযোগ করিলেন। আমি লজ্জায় মরিয়া গেলাম। আমি বাড়ি হইতে টুপি লইয়া আসি নাই, আর এখানে টুপি কেনার পয়সা আমার নাই, সেকথা বলিতে পারিলাম না। সে আজ তিরিশ বৎসরেরও আগের কথা। তখনকার দিনে মুসলমানেরা অধিকাংশই ধুতি আর মাথায় টুপি পরিতেন। বড়রা সকলেই দাড়ি রাখিতেন। আজ নতুন ইসলামী জোস লইয়া মুসলমান-সমাজ হইতে টুপি ও দাড়ি প্রায় অন্তর্হিত হইয়াছে।

তিনি তখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।

মোজাম্মেল হক সাহেব আমাকে আরও বলিয়াছিলেন, “আপনি অবশ্য অবশ্য হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি আপনার লেখার আদর করবেন। আপনার লেখার সঙ্গে তাঁর লেখার কিছু সাদৃশ্য আছে।”