» » ধ্বংস পাহাড়

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

ধ্বংস পাহাড়

পাঁচ

খুব দ্রুত হোটেলে ফিরবার প্রয়োজন অনুভব করল রানা। নির্জন রাস্তায় স্পীডমিটারের কাঁটা মাঝে মাঝে ‘৮০’ কে স্পর্শ করল। সেই সঙ্গে রানার অতি দ্রুত চিন্তা স্পর্শ করল কয়েকটা বাস্তব সত্যকে।

এত কাণ্ডের পরও কবীর চৌধুরী ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকল। তার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণও সংগ্রহ করা যায়নি। পুলিশ ওর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। ডিনামাইটগুলো নিয়ে কী করা হবে জানতে পারেনি রানা। যে তিমিরে সেই তিমিরেই আছে ওদের কার্যকলাপ, অথচ রানা নিজেকে দিনের আলোর মত পরিষ্কার করে দিয়ে এসেছে শত্রুপক্ষের কাছে। এখন যে কোনও দিক থেকে যে কোনও মুহূর্তে আক্রমণ চালাবে কবীর চৌধুরী। লক্ষ্যবস্তু তার জানাই আছে। মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলছে এখন রানার মাথার উপর। ওকে শেষ করে দিতে পারলেই কবীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সব তথ্য চাপা পড়ে যাবে। ওকে খুন করার চেষ্টায় কোনও রকম ত্রুটি রাখবে না এই অসামান্য প্রতিভাবান দুর্ধর্ষ বৈজ্ঞানিক।

এখন একমাত্র ভরসা সুলতা রায়। একে যদি এতক্ষণে সরিয়ে ফেলা হয়ে থাকে তবেই সর্বনাশ। কোনও কিছুকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাবার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। আজ রাতেই সুলতাকে সরিয়ে ফেলবে বলছিল কবীর চৌধুরী। যেমন করেই হোক ঠেকাতে হবে তাকে।

সুবীর বাবু বাইরে গেছে শুনে একটু অবাক হলো সুলতা রায়। ভাবল কাছেই কোথাও গেছে বুঝি। ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলের উপর দুজনের খাবার সাজানো আছে। পাশে একটা চিঠি। ভাঁজটা খুলে দেখল তাতে লেখা:

লতা,

আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সাড়ে দশটার মধ্যে না ফিরলে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পোড়ো।

সুবীর

খিদেও লেগেছিল, আর সাড়ে দশটাও গিয়েছিল বেজে। খেয়ে নিল সুলতা। বাথরুমে গিয়ে ঠোঁট-মুখের প্রলেপ আর কপালের টিপ উঠিয়ে ফেলল সে। বিড়ে খোঁপা খুলে চুলগুলো আলতো করে পেচিয়ে নিল হাত-খোঁপায়।

শাড়ি পরে ঘুমাতে পারে না সুলতা, কিন্তু ওটা খুলে রাখতে লজ্জা লাগল ওর। কখন যে তার স্বামীদেবতা এসে উপস্থিত হবে ঠিক নেই। ব্রেসিয়ার খুলে বালিশের তলায় রেখে বেড সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল ঘরের। চোখটা বন্ধ করতেই সুবীর সেনের মুখটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল মনের পর্দায়। চেষ্টা করেও সে ছবি মুছে ফেলতে পারল না সুলতা। মৃদু হেসে মনে মনে কয়েকবার বলল, ‘তোমাকে ভালবাসি, সুবীর। তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। তুমি আমার। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল সে।’

অন্ধকার ঘরে বুকের উপর কার হাত পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল সুলতার। তন্দ্রাচ্ছন্ন আড়ষ্ট কণ্ঠে কখন এলে বলে হাতটা বুকের উপর চেপে ধরে পাশ ফিরে শুলো সে। মনে হলো সুন্দর একটা ফুলের বাগানে কচি কচি ঘাসের উপর বসে আছে ও আর সুবীর! আলতো করে সুবীর ধরে আছে ওর হাত। কানের কাছে মধু ঢালা কণ্ঠে বলছে, ‘তোমায় বড় সুন্দর লাগছে।’ রঙ ধরল পশ্চিমের মেঘে। মনে হলো ‘পেলাম, সমস্ত মন-প্রাণ ভরে পেলাম একজনকে একান্ত আপন করে।’

হঠাৎ মনে হলো, দরজা খুলল কী করে সুবীর? সে তো নিজ হাতে দরজায় খিল দিয়ে তারপর ঘুমিয়েছিল! ঘরের মধ্যে একটু দূরে ‘খুক’ করে কে যেন একটা কাশি দিল। এবার চোখ থেকে তন্দ্রার রেশটুকু কেটে গেল সুলতার। চট করে বুকের উপর চেপে ধরা হাতটা ছেড়ে দিয়ে বেড সুইচের দিকে হাত বাড়াতেই একটা টর্চের তীব্র আলো এসে পড়ল ওর মুখের উপর। কানের কাছে মোটা কর্কশ গলায় কেউ বলল, ‘টু শব্দ করেছ কি খুন হয়ে যাবে, ম্যাডাম। চুপ করে থাকো।’

কণ্ঠতালু শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল সুলতার, ঢোক গিলবার চেষ্টা করেও পারল না। এবার তৃতীয় ব্যক্তি ঘরের বাতিটা জ্বেলে দিল। প্রথমজন একটা রুমাল ভরে দেবার চেষ্টা করল সুলতার মুখের মধ্যে। ভয়ের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যেতেই বিছানার উপর লাফিয়ে উঠে বসে, বাধা দেবার চেষ্টা করল সুলতা। কিন্তু একা মেয়েমানুষ তিনজন গুণ্ডার সঙ্গে পারবে কেন? মুখটা চেপে ধরল একজন। প্রাণপণে আঁচড়ে-কামড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল সুলতা। কিন্তু দ্বিতীয়জন ওর হাতদুটো বেঁধে ফেলল পিছমোড়া করে। এবার সহজেই নোংরা ঘামে ভেজা রুমালটা ওর মুখের মধ্যে ভরে দিল প্রথম জন। তার উপর আরেকটা রুমাল দিয়ে মুখটা পেঁচিয়ে গিট দিয়ে দিল পিছন দিকে।

ধস্তাধস্তিতে বোতাম ছিঁড়ে ব্লাউজটা একদিকে সরে গিয়েছিল। লোলুপ দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে নীচের ঠোঁটটা একবার চাটল দ্বিতীয়জন। তারপর গা থেকে খসে পড়া আচলটা দিয়ে পা দুটো শক্ত করে বেঁধে পাজাকোলা করে তুলে নিল সুলতাকে বুকের কাছে।

তৃতীয় ব্যক্তিকে আদেশ করা হলো, ‘আলোটা নিভিয়ে দে। রিভলভার হাতে আমার দু’পাশে চলবি দুজন।’

‘ঠিক হ্যায়, ওস্তাদ!’

হোটেলের সামনে ফোক্সওয়াগেনটা ছাড়াও আরেকটা হুড খোলা টয়োটা জিপকে দাঁড়ানো দেখে একটু অবাক হলো রানা। সামনের কলাপসিবল গেটটায় তালা দেয়া। গলি দিয়ে ঢুকতে গিয়েই দেয়ালের আড়ালে সরে দাঁড়াল সে। ব্যাপার কী? আধো-অন্ধকারে দেখা গেল কয়েকজন লোক বেরিয়ে আসছে গলি দিয়ে। তাদের মধ্যে একজন কিছু একটা ভারী জিনিস বয়ে আনছে।

লোকগুলো গলির মুখ থেকে বেরোতেই সুলতার সঙ্গে চোখাচোখি হলো রানার। দপ করে আশার আলো জ্বলে উঠল ওর বড় বড় চোখ দুটোয়। হুড খোলা গাড়িটার দিকে এগোল লোকগুলো।

এক সেকেণ্ডে মনস্থির করে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা বাম দিকের লোকটার উপর। বাঁ কান বরাবর রানার প্রচণ্ড এক ঘুসি খেয়ে ‘বাপরে’ বলে ছিটকে পড়ল লোকটা তার পাশের জনের ওপর। টপ টপ করে কান থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে ফুটপাথে পড়ল।

‘শালা, হারামি!’ বলে এবার অতর্কিতে এক প্রচণ্ড লাথি মারল রানা ডান দিকের লোকটার তলপেটে। ছিটকে পড়ে গেল রিভলভারটা দূরে। কোক করে একটা চাপা শব্দ করে সে-ও বসে পড়ল মাটিতে।

ঘটনাটা এত হঠাৎ ঘটে গেল যে সামনের লোকটা ভাল করে বুঝতেও পারল না, পিছনে কী ঘটছে। ‘ক্যয়া হুয়া, রে?’ বলে ভারী বোঝাটা নিয়ে যেই ঘুরছে সে, ওমনি ধাই করে নাকের উপর পড়ল এক বিরাশি সিক্কা।

সুলতাকে ধপাস করে ফুটপাথের উপর ফেলে দিয়ে নিজের নাকটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল লোকটা। দুই-তিন টানে সুলতার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল রানা। এমন সময় পিছন থেকে একজন এসে চুলের মুঠি, চেপে ধরল রানার। ঠিক স্টিম ইঞ্জিনের পিস্টনের মত রানার কনুই গিয়ে পড়ল পিছনের লোকটার ভুঁড়ির উপর সোলারপ্লেক্সাস-এ। সটান চিত হয়ে পড়ল লোকটা।

মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটানে সুলতাকে নিয়ে গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল রানা। বলল, ‘এক দৌড়ে ওপরে চলে যাও। ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে দিও। আমি ছাড়া আর কেউ ডাকলে বা দরজা খোলার চেষ্টা করলে চিৎকার করে লোক জড়ো করবে। যাও, দৌড় দাও। আমি আসছি।’

প্রথম যাকে আক্রমণ করা হয়েছিল সেই লোকটা সামলে নিয়ে এবার রিভলভারটা বের করল ওয়েস্টব্যাণ্ড থেকে এক টান দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে উঠল রানার ওয়ালথার। ডান হাতের কব্জিটা ভেঙে গুঁড়ো করে দিল পয়েন্ট থ্রি টু বুলেট। ‘বাবা-গো’ বলে কাতরাতে লাগল লোকটা মাটিতে বসে পড়ে।

মাটি থেকে রিভলভারটা তুলে নিয়ে রানা হুকুম করল, ‘সোজা গাড়িতে গিয়ে ওঠ সবাই। কেউ কোনও চালাকির চেষ্টা করলেই মারা পড়বে।

দলপতি একবার রানার ইস্পাত-কঠিন চেহারার দিকে চাইল। বুঝল, খুন করতে এই লোক দ্বিধা করবে না। অপর দুজনকে বলল, ‘চ্যল্ বে, ভাগ ইয়াহাঁসে!’

তলপেটে লাথি খাওয়া লোকটা তার রিভলভার তুলে নেবার জন্যে এক পা এগোতেই রানা আবার বলল, ‘ওটা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। যাও, সোজা। গাড়িতে ওঠ।’

আহত লোকটাকে দুজন হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলল। তারপর ছেড়ে দিল গাড়ি। গলির সামনে দিয়ে যখন গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে কী মনে করে হঠাৎ রানা একপাশের দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল দুটো বুলেট।

পাঁচ-দশ গজ গিয়ে আবার থামল গাড়িটা। বোধকরি গুলি দুটো ঠিক জায়গা মত লাগল কি না দেখার জন্যে। রানার হাতের রিভলভারটা গর্জে উঠল এবার। একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল—এবং সঙ্গে সঙ্গেই একজস্ট পাইপের মুখ দিয়ে একরাশ ধোয়া ছেড়ে দ্রুত চলে গেল গাড়িটা ‘বিপণীবিতানে’র দিকে।

ফুটপাথের উপর পড়ে থাকা রিভলভারটা তুলে নিল রানা। দেখল দুটোই ওয়েবলি অ্যাণ্ড স্কটের অনুকরণে ফ্রন্টিয়ারের দাররাতে তৈরি থারটি-টু ক্যালিবারের রিভলভার। অনুকরণ এতই চমৎকার এবং নিখুঁত যে ধরাই যায় না যে এটা দেশি মাল। কিন্তু মহাপণ্ডিত পাঠান ছোট্ট একটা ভুল করে বসে আছে, তাই ধরা গেল। নামটা লিখতে দু’ একটা অক্ষর কখন যে এদিক ওদিক হয়ে গেছে, টের পায়নি। মৃদু হেসে প্যান্টের দুই পকেটে দুটোকে ভরে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে উঠে এল রানা দোতলায়।

ম্যানেজারের কাউন্টারে কেউ নেই। লাউঞ্জের দুটো টেবিল লম্বালম্বি ভাবে জড়ো করে হাসান আলী শুয়ে আছে, মাথার উপর একটা ফ্যান ফুল-স্পীডে ঘুরছে। একটু নাড়া দিতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল হাসান আলী।

‘আমার কোনও টেলিগ্রাম এসেছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘দুটো এসেছে, স্যর।’

বালিশের তলা থেকে দুটো খাম বের করে দিল সে। রানা দেখল দুটোই আর্জেন্ট টেলিগ্রাম। একটা ওর নামে, আরেকটা সুলতার। খাম ছিঁড়ে দেখল রানা। প্রথমটায় লেখা:

সামথিং হ্যাঁপেণ্ড ইন কাপ্তাই স্টপ মিট আইইকো চিফ স্টপ ইনভেস্টিগেট অ্যাণ্ড রিপোর্ট।

আইটিসি

রানা ভাবল, কাপ্তাইয়ে আবার কী ঘটল? আগামী শুক্রবার অর্থাৎ পরশু তো প্রেসিডেন্ট ওপেন করছেন প্রজেক্ট। সঙ্গে থাকবেন গভর্নর, ওয়াপদা চিফ, ইউএস-এর রাষ্ট্রদূত, আরও কত হোমরা-চোমরা লোকজন। সেখানে আবার এমন কী ঘটে গেল যে তাকে এমন আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করা দরকার হয়ে পড়ল?

দ্বিতীয় টেলিগ্রামে লেখা:

সেন সিক অ্যাট ঢাকা স্টপ নেগোসিয়েশন ব্রেক ডাউন স্টপ ক্লোজ ডিল উইথ নিউ কোম্পানি স্টপ ফর সলভেনসি রেফার টু চৌধুরী।

জেটিটি

দুটো টেলিগ্রামই পকেটে পুরে রানা বলল, ‘ঢাকায় একটা ফোন করা দরকার, হাসান আলী। ফোনের চাবিটা কি তোমার কাছে?’

‘খুলে দিচ্ছি, স্যর,’ বলে হাসান আলী ম্যানেজারের কাউন্টারের উপর রাখা টেলিফোনটার তালা খুলে দিল। প্রথমে ৯১ ডায়াল করে ৮০০৮৩ ঘোরাল রানা। একবার রিং হবার সঙ্গে সঙ্গেই নারী কণ্ঠে শোনা গেল, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশন। মিস নেলী বলছি।’

‘আমি চিটাগাং থেকে সুবীর সেন বলছি, ডারলিং। এক্ষুণি রামকৃষ্ণের লাইন দাও, জলদি।’

‘শাট আপ!’ নেলীর কৃত্রিম রাগত স্বর শোনা গেল। ঠিক দুই সেকেণ্ড পরেই রাহাত খানের ঠাণ্ডা গম্ভীর গলা পাওয়া গেল।

‘বল। খবর আছে কিছু?’

‘আমার স্ত্রীর কাছে একটা টেলিগ্রাম এসেছে। তাতে দেখলাম ঢাকায় নাকি আমার এক বন্ধুর অসুখ…’

‘ওসব জানি। তোমার কী খবর?’ রানার কথায় বাধা দিলেন রাহাত খান।

‘শরীরটা বেশি ভাল যাচ্ছে না, স্যর।’

‘খুব বেশি খারাপ?’ (রানা অনুভব করল রাহাত খানের কাঁচা-পাকা ভুরু জোড়া কুঁচকে গেছে।)

‘না, স্যর, তেমন কিছু নয়, এই সামান্য। এখানে হাসপাতালের খবরও বেশি ভাল না—জনা তিনেক মারা গেছে। আমাকেও ডাক্তাররা ছাড়তে চাইছিল না।’

‘আচ্ছা!’

‘আরও একটা খবর, এই একটু আগে আমার স্ত্রীকে বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে এসেছিল ওর তিনজন মাসতুত ভাই। এত রাতে আর দিলাম না যেতে। ওদের দুজনের শরীরও বেশি ভাল দেখলাম না।’

‘কাণ্ডই বাধিয়ে বসেছ দেখছি।’

‘উৎসবে অনেক বাজি পটকা ফুটেছে। আমার শ্বশুর বাড়িতে যদি একটা খবর দিয়ে দিতেন, স্যর, তা হলে আমি অনেক হয়রানি থেকে বাঁচতে পারতাম।’

‘বুঝলাম। আচ্ছা, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। তা তোমার জন্মদিনে কী উপহার পেলে অত বাক্স ভর্তি, বললে না?’

‘একটা রেড়িয়ো ট্রানজিস্টার আর তিনটে বড় বড় ডিনার সেট।’

‘বলো কী? ডিনার সেট দিয়ে কী করবে?’

‘দেখি কী করা যায়, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, স্যর।’

‘তোমার বন্ধুদেরকে কবে নিমন্তন্ন করছ শ্বশুর বাড়িতে?’

‘আলাপ হয়েছে, তবে এখনও নেমন্তন্নের পর্যায়ে যায়নি। আমার পরিচয় পেয়ে অনেক খাতির যত্ন করল, ছাড়তেই চাচ্ছিল না।’

‘বেশ, যা ভাল বোঝ করো। শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখবে—বিশেষ করে আজ রাতে। আর কিছু বলার আছে?’

‘না, স্যর।’

‘বেশ, রাখলাম।’

পাঁচতলায় উঠে এল রানা। ঘরের দরজায় ভিতর থেকে ছিটকিনি দেয়া। টোকা দিতেই কাছে এসে রানার গলা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা খুলল সুলতা। হাতে পয়েন্ট টু-ফাইভ ক্যালিবারের ছোট্ট একটা অ্যাস্ট্রা পিস্তল ধরা। বাঁটটা মাদার অভ পার্লের। উজ্জ্বল বাতির আলোয় একবার ঝিক করে উঠল।

‘ওরেব্বাবা! তোমার কামানের মুখটা একটু সরাও। গুলি বেরিয়ে পড়লে একেবারে ছাতু হয়ে যাব!’ বলল রানা।

এসব রসিকতায় কান না দিয়ে উৎকণ্ঠিত সুলতা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার লাগেনি তো?’

‘সামান্য লেগেছে। তোমার?’

‘আমার লাগবে কেন, আমি কি মারামারি করতে গেছি? একটু থেমে আবার বলল, ইশ, তোমার গায়ে করডাইটের গন্ধ। মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরলে। কাপড়টা ছেড়ে ফেলো।’

রানা দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াতেই ওর মুখের দিকে চেয়ে চমকে উঠে সুলতা, বলল, ‘তোমার মুখে এত কাটাকুটি কেন? রক্ত বেয়ে পড়ছে। এখন ডেটল কোথায় পাই বলো তো!’ ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে উঠল সুলতা।

‘আমার সুটকেসের মধ্যে আফটার-শেভ লোশন আছে। বের করে দাও, তাই খানিকটা লাগিয়ে নিচ্ছি। আর আমার স্লিপিং গাউনটাও বের করো, এক্ষুণি খেয়ে শুয়ে পড়ব।’

একটা চেয়ারের উপর গাউন আর ওল্ড স্পাইসের শিশিটা বের করে রাখতেই একটা টার্কিশ টাওয়েল কাঁধে ফেলে ওগুলো তুলে নিতে গেল রানা।

‘রাখো তো ওগুলো, আমি লাগিয়ে দেব,’ বলে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে রানাকে বাথরুমের মধ্যে নিয়ে গেল সুলতা। ‘কোথায় কোথায় লেগেছে দেখি?’

টী-শার্টের বোতামগুলো খুলে ফেলল সুলতা আলতো হাতে। গেঞ্জিটা খুলে রানার দেহের দৃঢ় পেশিগুলোর দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘বাব্বা, কী অসম্ভব জোর তোমার গায়ে। তিনজন ষণ্ডা মার্কা লোকও পারল না তোমার সঙ্গে! নাও, এখন মুখটা ধুয়ে ফেললো তো আগে।’

মুখ ধুতে গিয়ে ডানহাতের তালুতে পানি লাগতেই জ্বালা করে উঠল। কাটা জায়গাটা দেখে আঁতকে উঠল সুলতা। কাঁচা দগদগে জখম থেকে এখনও রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। নীল হয়ে গেছে দু’পাশের জায়গাটা। খানিকটা লোশন ঢেলে দিতেই কড়ে আঙুলটা কাটা মুরগির মত লাফিয়ে উঠল কয়েকবার আপনাআপনি। জ্বালার চোটে কাতরে উঠল রানা। নিজের একটা রুমাল দিয়ে বেঁধে দিল সুলতা হাতটা। তারপর তোয়ালেটা পানিতে ভিজিয়ে মুছে নিয়ে মুখে, ঘাড়ে, পিঠে আর বাম কনুইয়ে লোশন লাগিয়ে দিল। ওর নরম বুক মাঝে মাঝে রানার দেহকে আলতো করে ছুঁয়ে গেল নিজেরই অজান্তে। লোশনের জ্বলুনির উপর প্রলেপের কাজ করল সে স্পর্শ।

‘আমার জন্যেই তোমার এই অবস্থা!’ সুলতা নিজেকে অপরাধী মনে করছে।

দেহের উপরের ভাগটায় লোশন লাগানো হয়ে গেল। সুলতা জিজ্ঞেস করল, ‘নীচের দিকে কেটেছে কোথাও?’

‘বোতামগুলো খুলেই দেখো না!’ মৃদু হেসে বলল রানা।

‘যাহ্, তুমি ভারি পাজী,’ বলে সত্যিসত্যিই বোতাম খুলবার উপক্রম করল সুলতা।

ওর হাতটা চেপে ধরল রানা। হঠাৎ কী হলো, দু’জন যেন বড় বেশি কাছে চলে এল। রানার বাঁ হাতটা সুলতার ক্ষীণ কটি ধরল জড়িয়ে। সুলতার সুন্দর চোখ দুটো একটু বিস্ফারিত। মুখটা উঁচু করে রানার চোখের দিকে চেয়ে আছে। নরম ভেজা ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হয়ে আছে। ইঞ্চি তিনেক দূরে এসে দুই সেকেণ্ডের জন্যে থমকে দাঁড়াল রানার ঠোঁট। তারপর আর দূরত্ব থাকল না।

এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট। দুই হাতে রানাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগল সুলতা। একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘চলো, খেয়ে নাও ঘরে এসে।’

‘তুমি যাও আমি কাপড়টা ছেড়েই আসছি।’

সাত কোর্সের ডিনার রাখা আছে টেবিলে। কিন্তু সবই ঠাণ্ডা। এক নজর দেখেই খাবার রুচি নষ্ট হয়ে গেল রানার। একজোড়া চিংড়ির কাটলেটের মাঝখানে খানিকটা টম্যাটো-সস্ ঢেলে নিয়ে নাক-মুখ বুজে কোনও মতে খেয়ে নিল সে।

‘আচ্ছা, বলতে পারো, আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল কারা?’

‘কবীর চৌধুরীর ভাড়া করা গুণ্ডা। এক গ্লাস পানি খেয়ে ঠক করে টেবিলের উপর গ্লাসটা রেখে জবাব দিল রানা।’

‘তাই নাকি? কিন্তু, কারণ কী?’

‘কারণ তোমার রূপ। মনে ধরে গিয়েছিল ওর।’

‘যাহ্!’ হাসল সুলতা। ‘কিন্তু লোকটাকে দেখে তো এমন বলে মনে হয়নি!’

‘চোখের দেখায় সবাইকে কি চেনা যায়? আমাকেই বা কতটুকু চিনেছ তুমি?

‘ও, হ্যাঁ, তুমি হঠাৎ কোত্থেকে এলে? কোথায় গিয়েছিলে, বাইরে? মনে হলো যেন আমাকে রক্ষা করবার জন্যেই দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলে?’

‘একা একা ভাল লাগছিল না, বেরিয়ে পড়েছিলাম বাইরে। একটা নাইট শোতে ঢুকেছিলাম, ভাল লাগল না—কিছুদূর দেখে হাফ টাইমের সময় বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছিলাম।’

‘জানো, আমি জীবনে কখনও এমন অবস্থায় পড়িনি। আর একবার শুধু এমন অসহায় লেগেছিল—তোমাকে বলেছি। তুমি এসে না পড়লে কী যে হত ভাবতেই শিউরে উঠছি।’

‘কিন্তু ঘরে ঢুকল কী করে ওরা? ছিটকিনি লাগাওনি?’

‘লাগিয়েছিলাম।’

রানা উঠে গিয়ে দেখল চৌকাঠের একটা ফাঁক দিয়ে অনায়াসেই ছিটকিনি খোলা যায়। অর্থাৎ, জেগেই কাটাতে হবে রাতটা।

একটা সিগারেট ধরিয়ে পশ্চিমের জানালাটা খুলে দিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল রানা। বাতি নিভিয়ে দিয়ে পাশে চলে এল সুলতা। স্নিগ্ধ চাঁদের আলো। এসে পড়ল ওদের চোখে-মুখে।

ঘুমিয়ে পড়েছে শহরটা। মাঝে মাঝে দূর থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে আসছে। হয়ত নাইট-ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরছে কোনও ভদ্রলোক। তা ছাড়া সব নিঝুম। পাশেই কোনও বাড়িতে বাচ্চা কেঁদে উঠল। তারপর আবার চুপ।

সুলতার হাতটা তুলে নিল রানা হাতে। মনে হলো অদ্ভুত এক স্বপ্নের রাজ্যে চলে এসেছে ও আর সুলতা। মিটমিট করছে তারাগুলো। উজ্জ্বল চাঁদের পাশে নিস্প্রভ লাগছে ওদের। মনে হলো, এমন লগন যদি চিরস্থায়ী হত! মনে হলো, বলি, তোমাকে ভালবাসি। পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল আর কলুষ থেকে অনেক, অনেক দূরে সরে গিয়ে, এই রূপকথার রাজকন্যেকে বলি, তোমায় ভালবাসি! কিন্তু মনের একটি কথাও বেরোল না রানার মুখ দিয়ে।

কিন্তু এ কেমন হলো? শত্রুপক্ষের একটা মেয়েকে ওর এত ভাল লাগল কেন? কী এর পরিণাম? মনটা কিছুতেই আজ শাসন মানতে চাইছে না কেন?

‘কী ভাবছ?’ জিজ্ঞেস করল সুলতা।

‘কিছু না।’

‘কিছু না?

‘ভাবছি, আমি সুখী।’

দূর থেকে একটা জাহাজের ভেঁপু বেজে উঠে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলল এ-বাড়ি ও-বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে। আওয়াজটা শুনলে উদাস হয়ে যায় মন।

‘সারাদিন অনেক ধকল গেছে—চলো শুয়ে পড়বে। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব মাথায় হাত বুলিয়ে।’ রানার হাত ধরে টানল সুলতা।

অনেক গল্প হলো। কথায় কথায় রানা বুঝতে পারল কলকাতা অফিস থেকে কতগুলো শব্দই কেবল মুখস্থ করিয়ে দেয়া হয়েছে সুলতাকে। ডিনামাইটগুলো কোথায় ফাটানো হবে সে সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই ওর। কী ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে ওকে কোনও আভাস দেয়া হয়নি।

‘ঘুমিয়েছ?’ রানাকে কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখে জিজ্ঞেস করল সুলতা।

‘না। সারাদিন অনেক ধকল গেছে,’ বলল রানা, ‘তুমি শুয়ে পড়ো গিয়ে!’

‘আর তুমি?’

‘তিনটে পর্যন্ত পাহারা দেব, তারপর তোমাকে তুলে দিয়ে আমি ঘুমাব বাকি রাত।’

‘যেতে ইচ্ছে করছে না।’

চুপ করে থাকল রানা। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, সুলতা, ‘তোমাকে এত ভাল লাগছে কেন বলো তো? আর কখনও তো কাউকে এমন লাগেনি!’

‘সত্যি!’

‘সত্যি’, বলে একটা হাই তুলল সুলতা, তারপর বুকের আঁচলটা খসে পড়ল বিছানার উপর। রানা টেনে নিল ওকে। নিজের পা দুটো আলতো করে তুলে নিল সুলতা বিছানার উপর। টিশ টিশ শব্দে খুলে গেল কয়েকটা টিপবোতাম। চুমোয় চুমোয় পাগল করে তুলল রানা ওকে।

পরম নিশ্চিন্তে রানার বাম বাহুর উপর মাথা রেখে গভীর ঘুমে অচেতন সুলতা রায়। আস্তে করে মাথাটা তুলে বালিশের উপর রেখে, কপালের উপর থেকে এলোমেলো এক গোছা চুল সরিয়ে দিল রানা। তারপর উঠে গিয়ে সুটকেস থেকে স্কচ উইস্কির বোতলটা বের করে রাখল টেবিলের উপর।

সারা রাত জাগতে হবে। যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও দিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে। কাপড়ের ভাঁজে সযত্নে রাখা সাইলেন্সারটা বের করে রাখল টেবিলের উপর। তারপর ইজিচেয়ারে গিয়ে বসল।

ঘুমে আর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে শরীরটা। একটা বেঞ্জেড্রিন ট্যাবলেট মুখে ফেলে এক ঢোক উইস্কি দিয়ে সেটা গিলে ফেলল রানা। জ্বলতে জ্বলতে নেমে গেল নীচে অ্যালকোহল, কোন রাস্তা দিয়ে গেল পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়ে। আরও কয়েক ঢোকের পর ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে উঠল শরীরটা। একটা সিগারেট ধরিয়ে এবার ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিল রানা।

ঘুমন্ত সুলতার একটানা ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আর রিস্টওয়াচের একঘেয়ে টিকটিক করে বেজে যাওয়া। এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের ভিতর। অনেক কথা মনে এল রানার। অনেক টুকরো টুকরো ঘটনার স্মৃতি। জীবনের কত ছোট-খাটো সাধারণ কথা কোন্ ফাঁকে স্মৃতির পাতায় লেখা হয়ে গেছে। মণিমুক্তোর মত অমূল্য মনে হচ্ছে সেগুলোকে এখন। বড় বিচিত্র মানুষের মন। দূরে কোথাও ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল তিনবার। রাত তিনটে।

ঘুমের ঘোরে সুলতাকে বিড় বিড় করে কিছু বলতে শুনে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল রানা। কিছুই বোঝা গেল না অস্পষ্ট এক আধটা অর্থহীন শব্দ ছাড়া। একটু হেসে টেবিলের কাছে ফিরে গিয়ে আধ গ্লাস উইস্কি দুই ঢোকে শেষ করল রানা, তারপর পশ্চিমের জানালাটার ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

ডুবে যাচ্ছে চাঁদ। নিপ্রভ হলদেটে দেখাচ্ছে ওটাকে। সেই ম্লান আলোয় হঠাৎ রানার নজরে পড়ল, দু’জন লোক উঠে আসছে উপরে ছাঁদের ট্যাঙ্কে পানি তুলবার পাইপ বেয়ে।

মৃদু হাসল রানা। এবারের আক্রমণটা তা হলে এই পথে আসছে!

উপরের দিকে না চেয়ে নিশ্চিন্ত মনে সন্তর্পণে উঠে আসছে লোকগুলো। টেবিলের উপর থেকে সাইলেন্সরটা নিয়ে এসে ধীরে সুস্থে পেঁচিয়ে লাগাল রানা পিস্তলের মুখে। পাঁচ-ছয় হাত বাকি থাকতে প্রথম লোকটা দেখতে পেল রানাকে। কিন্তু বড়ো দেরি হয়ে গেছে তখন। টুথপেস্টের টিউব থেকে বুদ্বুদ বেরিয়ে যেমন শব্দ হয় তেমনি ‘ফট’ করে একটা শব্দ বেরোল রানার ওয়ালথার থেকে। পাইপ ছেড়ে নিঃশব্দে লোকটা তার সঙ্গীর উপর গিয়ে পড়ল। আচমকা আঘাতে সে-ও টাল সামলাতে পারল না। দু’জন একই সঙ্গে দ্রুত নেমে গেল নীচে। ঠিক চার সেকেণ্ড পর পশ্চিম দিকের আবর্জনাময় সরু সুইপার প্যাসেজে ভারী কিছু পতনের শব্দ হলো।

খালি বিছানাটায় শুয়ে পড়ল এবার রানা। বালিশের তলায় পিস্তল রেখে সেটার বাটের উপর ডান হাতটা রাখল ও অভ্যাস মত। তার পর ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্ত মনে।