» » ধ্বংস পাহাড়

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

ধ্বংস পাহাড়

এক

কাপ্তাইয়ে কার্যরত আইইকো, অর্থাৎ স্যানফ্রান্সিসকোর ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার আর. টি. লারসেন তাঁর সুদৃশ্য বাংলোর সামনে। লনে বসে কফির কাপটা মুখে তুলতে গিয়ে স্তব্ধ বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন সামনে দাঁড়ানো লোকটার মুখের দিকে। ভুরু জোড়া কুঁচকে গেছে তার। একটা আঙুল দিয়ে বর্মা চুরুটের পুরু ছাই ঝাড়লেন। তারপর ভাঙা উর্দুতে বললেন, ‘বল কী, আবদুল! এ কি সম্ভব?’

ফ্রন্টিয়ারের আবদুর রহমান উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘হামি নিজে তিন দিন দেখছি, স্যর। কেউ হামার কোথা বিশওয়াস করে না, হাঁসি উড়ায়। শেষতক আপনার কাছে আসছি, হাজুর। হামি কসম খেয়ে…’

‘আমাকে দেখাতে পারো?’ ওকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মি. লারসেন।

‘আলবাৎ! আর আধঘণ্টা পরেই আসবো তারা। ওই স্পীড বোট হামাদের না, ফিশারীরও না। আজই দেখাতে পারি আপনাকে, হাজুর।’

‘বেশ, আমি তোমাকে হেসে উড়িয়ে দেব না। তুমি যাও, আমি ঠিক সাতটার সময় ড্যামের ওপর আসছি।’

খুশি মনে সাহেবের বাংলো থেকে বেরিয়ে এল আবদুর রহমান। একবার ভাবল, আজ যদি ওরা না আসে? বোকা বনতে হবে সাহেবের কাছে। যাক, দেখা যাক কী হয়।

আজ আট বছর ধরে সে কাজ করছে প্রজেক্টের সারভে ডিপার্টমেন্টের নিম্নতম পদে। কাপ্তাইকে সে ভালবেসে ফেলেছে সমস্ত হৃদয় দিয়ে। ওর চোখের সামনেই তিল তিল করে বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়েছে এই বাঁধ। প্রজেক্টের খুঁটিনাটি ওর নখদর্পণে। ড্যামের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের দিকে লক্ষ রাখার গুরু দায়িত্ব ওর ধারণা ওরই উপর ন্যস্ত আছে। সীমান্ত প্রদেশের আবদুর রহমান এখানে এসে সবার প্রিয় আবদুল হয়ে গেছে। সাহেব সুবোরা স্পীড বোটে করে বেড়াবেন, কি পাহাড়ি গ্রাম দেখতে যাবেন, কিংবা ষাট মাইল উত্তরে যাবেন হরিণ শিকারে, সঙ্গে যাবে কে—ওই আবদুল। সবকিছুতেই ওর অক্লান্ত উৎসাহ। এই পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথায় যায়নি সে? চল্লিশ মাইল পায়ে হেঁটে দুর্গম লুসাই হিলেও গেছে সে। সাহেবদের সঙ্গে।

কদিন ধরে একটা ব্যাপার লক্ষ করে বড় উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে আবদুল ভিতর ভিতর। আর দুইদিন পর প্রেসিডেন্ট আসছেন প্রজেক্ট ওপেন করতে। ছোট্ট, শহরটায় তাই অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। প্রচুর আইবি, সিআইডি ঘুরঘুর করছে শহরের আনাচেকানাচে। কিন্তু আইবি কর্মতৎপরতা বলে এই ঘটনাকে হাল্কা করে দেখতে পারেনি সে। তাই যদি হয় তা হলে ভুড়ভুড়ি কিসের?

এক টিপ খইনি নীচের ঠোঁট আর দাঁতের ফাঁকে যত্নের সঙ্গে ছেড়ে দিয়ে সেটাকে জিভ দিয়ে ঠিক জায়গামত বসিয়ে নিল আবদুল। তারপর স্পিলওয়ের গার্ডরুমে ঢুকে দোনলা বন্দুকধারী দেশোয়ালী ভাইয়ের সঙ্গে অনর্গল পশতু ভাষায় কিছুক্ষণ ভাব আদান-প্রদান করল।

ঠিক সাতটায় দূর থেকে লারসেন সাহেবকে আসতে দেখে এগিয়ে গেল আবদুল। সন্ধ্যার আর দেরী নেই।

কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর রিজারভয়েরের মধ্যে দূরে একটা স্পীড-বোট দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন মি, লারসেন। উঁচু একটা টিলার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা। আরও আধ ঘণ্টা পর আবদুলের কথামত সত্যিই পানির উপরে ছোট ছোট বুদ্বুদ দেখা গেল। শক্তিশালী টর্চ জ্বেলে দেখা গেল সেই টিলার দিক থেকে বুদ্বুদের একটা রেখা ক্রমেই এগিয়ে আসছে বাঁধের দিকে। গজ পনেরো থাকতে এগোনোটা থেমে গেল—এবার এক জায়গাতেই উঠতে থাকল বুদ্বুদ। মি. লারসেন উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘মাইগড়! আশ্চর্য! আবদুল, তুমি ছুটে যাও তো, স্টোর থেকে আমার নাম করে দুটো অ্যাকুয়ালাঙ (ডুবুরির পোশাক) নিয়ে এসো এক্ষুণি। আর যাওয়ার পথে লোকমানকে বলে যাও আমাদের স্পীড বোট রেডি করে ঘর থেকে যেন আমার রাইফেলটা নিয়ে আসে। যাও, কুইক।’

ঠিক সেই সময়ে দূর থেকে একটা ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শোনা গেল। সেই টিলার দিক থেকেই এল শব্দটা। ক্রমে দূরে মিলিয়ে গেল সেই শব্দ-ফিরে চলে গেল স্পীড-বোট। কিন্তু বুদ্বুদ উঠছেই।

কাপ্তাইয়ের পাঁচ মাইল উত্তর-পশ্চিমে হাতের বামদিকে একটা মাটির টিলা—এখন রিজারভয়েরের পানি বেড়ে ওঠায় ডুবুডুবু। তারই ভিতর দামি আসবাবপত্রে সুসজ্জিত একটা প্রশস্ত ঘর। একটা সোফায় বসে আছেন গৃহস্বামী কবীর চৌধুরী আর অপর একখানায় ভারতীয় গুপ্তচর বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ মাদ্রাজী কর্মকর্তা মি. গোবিন্দ রাজলু। পাশের টিপয়ের উপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে গোবিন্দ রাজলু বলল, ‘অসামান্য আপনার প্রতিভা, মি. চৌধুরী। এই পাহাড়ের মধ্যে এত বড় একটা গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করলেন কী করে? এতসব যন্ত্রপাতি, এত রকম ব্যবস্থাপনা! অথচ বাইরে থেকে কিছুই বুঝবার উপায় নেই।’

এই অকুণ্ঠ প্রশংসায় কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার চাইল রাজলুর চোখের দিকে, তারপর বলল, ‘আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি আছি, মি. রাজলু। বেশ, শুক্রবারেই ঘটবে মহাপ্রলয়।’

দেয়ালের গায়ে দুটো তাকের উপর থরে থরে সাজানো রয়েছে বই। চৌধুরী উঠে গিয়ে একটা বোতাম টিপতেই দেয়ালের খানিকটা অংশ ঘুরে গেল। বইসুদ্ধ সামনের দিকটা অদৃশ্য হয়ে গেল পিছনে, আর পিছন দিক থেকে সামনে চলে এল একটা সিসিটিভি, অর্থাৎ ক্লোজড-সার্কিট টেলিভিশন সেট। সেটটা চালু করে দিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসল চৌধুরী। গোবিন্দ রাজলু অবাক হয়ে দেখল পরিষ্কার কাপ্তাই ড্যামের ছবি দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনে। এক আধটা গাড়ি সাঁ করে চলে যাচ্ছে বাঁধের ওপরের রাস্তাটা দিয়ে। সামনে থৈ-থৈ করছে জল, অল্প বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে সে জলে।

‘রিজারভয়েরের জল এখন কতখানি?’ জিজ্ঞেস করল রাজলু।

‘সী-লেভেল থেকে ৯৯ ফুট। এটা সারভে অভ পাকিস্তানের হিসাব। ড্যামের হিসাব অবশ্য আলাদা—ওরা সী-লেভেলের নয় ফুট নীচ থেকে ধরে। ওরা বলবে এখন ১০৮ ফুট।’

‘আচ্ছা, পুরো ড্যামের ফিল্ ম্যাটেরিয়াল কতখানি? মাত্র তিনটেতেই কাজ হয়ে যাবে বলে মনে করেন?’

‘ফিল্ ম্যাটেরিয়াল হচ্ছে পনেরো কোটি ছেষট্টি লক্ষ আশি হাজার সিএফএস। হ্যাঁ, আমার মতে তিনটেই যথেষ্ট। মেইন ড্যামটা দু’হাজার দুশো ফুট লম্বা; আর চওড়া হচ্ছে, ওপরটা বাইশ ফুট—নীচটা এক শ’ পয়তাল্লিশ ফুট। তিনটে জায়গা ভেঙে দিতে পারলে বাকিটা আপনিই উড়ে যাবে। তাছাড়া দেখুন, স্পিলওয়ের ষোলোটা গেট—প্রতিটা বত্রিশ বাই চল্লিশ ফুট—আমার লোক সব ক’টা। লক গেট সম্পূর্ণ খুলে দিয়ে সরে পড়বে সবাই যখন প্রেসিডেন্টের ওপেনিং নিয়ে ব্যস্ত, সেই সুযোগে। এ ছাড়াও পাওয়ার হাউসের টানেল ডায়ামিটার হচ্ছে বত্রিশ ফুট হর্‌স্‌শূ—সেখান দিয়েও বেরোচ্ছে পানি। সবটা মিলে মোট এফেক্ট হচ্ছে এক কথায় যাকে বলে ডিভাসটেটিং, ভয়ঙ্কর। পুরো রিজারভয়ের, অর্থাৎ দুশো তেপ্পান্ন বর্গমাইলের এতদিনকার জমা পানি একসঙ্গে বেরোবার চেষ্টা করছে—কল্পনা করুন একবার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মি. রাজলু, এই তোড়ের মুখে প্রেসিডেন্টের চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাক-চীন প্যাক্ট নিয়েও ভারতকে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে না।’

‘আমাকে আপনি আশ্চর্য করে দিচ্ছেন, মি. চৌধুরী। ভয়ানক নিষ্ঠুর লোক আপনি, মশাই। এত সাংঘাতিক একটা কাজ এমন ঠাণ্ডা মাথায় কী করে করছেন আপনি? এতটুকু বিকার নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে একবারও কি দ্বিধা হচ্ছে না, কিংবা হচ্ছে না এক বিন্দু বিবেক-দংশন?’

‘দেখুন, সে অনেক কথা। আমাদের কারও হাতেই অত সময় নেই যে এ নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করব। তবু এটুকু আপনাকে বলতে পারি যে এমন হঠাৎ করে যদি প্রয়োজন হয়ে না পড়ত তা হলে হয়ত এত প্রাণ নষ্ট না করে অন্য উপায় অবলম্বন করতাম আমি। কেবল মাত্র আকস্মিক প্রয়োজনের তাগিদেই আপনাদের সাহায্য নিতে হচ্ছে আমাকে—এবং কেবলমাত্র এই জন্যেই প্রজেক্ট ওপেনিং-এর দিন ড্যাম ভাঙার গর্হিত প্রস্তাব আমাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিতে হল।’

কথার ফাঁকে ফাঁকে বাঁকা পাইপটায় টোবাকো ভরা হচ্ছিল, এবার সেটা ধরিয়ে নিয়ে টেলিভিশন সেটের একটা নব সামান্য ঘুরিয়ে ছবিটা আরও পরিষ্কার করে দিল কবীর চৌধুরী। তারপরই কী দেখে চমকে উঠে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে একপাশে টেবিলের উপর রাখা ওয়ায়েরলেস ট্রান্সমিটারের সামনে গিয়ে বসল।

হঠাৎ চৌধুরীকে একটু ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখে বিস্মিত গোবিন্দ রাজলু টেলিভিশনের দিকে চেয়ে দেখল তাতে দেখা যাচ্ছে একজন মার্কিন সাহেবকে। হাত নেড়ে কাউকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে সে—বাঁধের কাছেই জলের মধ্যে কিছু লক্ষ্য করছে সাহেব টর্চ জ্বেলে।

কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে ইলেভেন মেগাসাইকেলসে সিগনাল দিল চৌধুরী।

‘এক্স ওয়াই জেড কলিং এসবি টু, ক্যান ইউ হিয়ার মি?’ দুবার বলল কথাটা চৌধুরী।

‘এসবি টু স্পীকিং। হিয়ার ইউ লাউড অ্যাণ্ড ক্লিয়ার।’ সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এল স্পীড-বোট থেকে।

‘তেরো নম্বরকে বোটে ফিরিয়ে আনো—সিগনাল দাও।’

খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর উত্তর এল, ‘আমাদের সিগনাল পাচ্ছে না তেরো নম্বর—অনেক দূর চলে গেছে। এগিয়ে যাব সামনে?’

এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল চৌধুরী, ‘না, ফিরে চলে এসো এক্ষুণি।’

চিন্তিত মুখে আবার কী-বোর্ডে কিছুক্ষণ আঙুল চালিয়ে বলল, ‘এক্স ওয়াই জেড কলিং কে পি ফাইভ, এক্স ওয়াই জেড কলিং কে পি ফাইভ, এক্স ওয়াই জেড কলিং কে পি ফাইভ। ক্যান ইউ হিয়ার মি?’ বার কয়েক কথাটা উচ্চারণ করল সে। তারপর উত্তর এল।

‘দিস ইজ কে পি ফাইভ। হিয়ার ইউ লাউড অ্যাণ্ড ক্লিয়ার, স্যর। কাপ্তাই ভিআইপি রেস্ট হাউসের একটা কামরায় ওয়াকি টকির সামনে বসে শুনছে কে পি ফাইভ।

‘ড্যামের গায়ে আনলাকি থারটিন কাজ করছে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ধরা পড়বে ও। তুমি গিয়ে পানিতে নামবে সবার আগে। যন্ত্রপাতি মাটি চাপা দিয়ে দেবে এবং তেরো নম্বরের মৃতদেহ নিয়ে ওপরে উঠবে। বুঝতে পেরেছ? তেরো যেন জ্যান্ত পানির ওপর না ওঠে।’

‘বুঝেছি, স্যর, যাচ্ছি এখুনি।’

সিক্সটি মডেলের একটা কালো শেভ্রোলে আইইকো-চীফ মি. লারসেনের পাশে এসে থামল জোরে ব্রেক কষে। জানালা দিয়ে মুখটা বের করে আরোহী বলল, ‘হ্যালো, লারসেন, কী করছ এখানে?’

‘হ্যাল্লো, ইসলাম। তুমি কোত্থেকে? নেমে এসো, একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখাচ্ছি তোমাকে।’

‘কী ব্যাপার?’ বলে নেমে এল গাড়ি থেকে রাফিকুল ইসলাম। অফিসারস ক্লাবের হিরো এই ইসলাম। ক্লাবে মোটা স্টেকে ব্রিজ, ফ্ল্যাশ, পোকার খেলে এবং প্রতিবার প্রচুর টাকা হেরে, মাঝে মাঝেই পার্টি দিয়ে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছে সে সবার কাছে। বছর কয়েকের নিয়মিত যাতায়াতে সবার সঙ্গেই খাতির জমিয়ে নিয়েছে এই সদালাপী সুদর্শন ধনী যুবক। লারসেন সাহেবও একে খুব স্নেহের চোখে দেখেন।

‘ওই দেখো। ওখানে বুদ্বুদ কীসের বলতে পারো?’

টর্চের আলোয় পানির উপর অনেকগুলো বুদ্বুদ দেখল ইসলাম। বলল, ‘আশ্চর্য! এ তো অ্যাকুয়ালাঙ-এর ভুড়ভুড়ি। ওখানে কাউকে নামিয়েছ নাকি নীচে?’

‘না। ওই টিলার কাছ থেকে কেউ পানির নীচ দিয়ে এসেছে বাঁধের গায়ে। লোকটা কী করছে জানা দরকার।’

‘কাল গিয়েছিলাম কক্সবাজারের সী-তে ফিয়াসের জন্যে রেয়ার কিছু শঙ্খ তুলতে। গাড়ির পেছনে অ্যাকুয়ালাঙটা বোধহয় রয়ে গেছে। নেমে দেখব নাকি?’

‘দাঁড়াও, আবদুলকে স্টোরে পাঠিয়েছি—ও আসুক, দুজন একসঙ্গে নেমো। পানির নীচে একাধিক লোক থাকতে পারে, অস্ত্রশস্ত্রও থাকতে পারে।’

হেসে উড়িয়ে দিল কথাটা ইসলাম। তারপর গাড়ির পিছন থেকে কম্প্রেসড এয়ারের সিলিণ্ডার ফিট করা কিম্ভুতকিমাকার ডুবুরি পোশাক বের করে পরে নিল আধ মিনিটের মধ্যে। কাঁটাতারের বেড়া টেনে ধরলেন মি. লারসেন, বাঁধের গায়ে সাজিয়ে রাখা বড় বড় কালো পাথরগুলোর উপর সতর্ক পা ফেলে তরতর করে নেমে গেল ইসলাম পানিতে।

কিছুদূর নেমেই ভাইজারের কাঁচের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল, প্রায় সত্তর-আশি ফুট নীচে একটা তীব্র আণ্ডারওয়াটার টর্চ জ্বেলে কী যেন করছে আনলাকি থারটিন। আনলাকিই বটে! হাসল ইসলাম।

পনেরো ফুট কাছে যেতেও যখন লোকটা টের পেল না তখন পকেট থেকে সরু একটা টর্চ বের করল ইসলাম। ওর ভয় কেবল লোকটার পাশে মাটিতে রাখা হার্পন বন্দুকটাকে।

আর তিন হাত এগোতেই হঠাৎ তেরো নম্বর কাজ বন্ধ করল, তারপর চট করে ঘুরে ইসলামের দিকে টর্চের আলো ফেলেই একটানে হার্টুনটা তুলে নিল হাতে। টর্চের তীব্র আলো পড়ায় মস্তবড় একটা কাতলা মাছ সড়াৎ করে সরে গেল সামনে দিয়ে।

সঙ্গে সঙ্গেই হাতের পেন্সিল-টর্চ জ্বেলে সিগনাল দিল ইসলাম। হার্পনের ট্রিগার থেকে আঙুলটা সরে গেল তেরো নম্বরের। প্রত্যুত্তরে সেও সিগনাল দিয়ে হার্টুনের সেফটিক্যাচটা আবার তুলে দিল উপরে। তারপর সেটা নামিয়ে রেখে একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্যে বসে পড়ল মাটিতে। এতক্ষণ একটানা পরিশ্রমে রাবারের ভিতরে দর দর করে ঘাম ঝরছে ওর দেহ থেকে। ভাবল, বোধহয় তার কাজ তদারক করবার জন্যে এল কেউ। কিন্তু কেন জানি বুকের ভিতরটা একবার কেঁপে উঠল ওর।

বরফে গর্ত করবার একটা ফিনবোর দিয়ে বাঁধের গায়ে গর্ত খুঁড়ছে তেরো নম্বর। ফিনল্যাণ্ডে এই যন্ত্রের ব্যবহার খুব বেশি। হাতে তুলে নিয়ে দেখল ইসলাম প্রায় সাড়ে তিন ফুট লম্বা আর পানির নীচে সের দুয়েক ওজনের এই যন্ত্র অনায়াসে বারো ইঞ্চি ব্যাসের গর্ত তৈরি করতে পারে মাটিতে। মিনিয়াপোলিসের রাপালা কোম্পানির তৈরি এই ফিনবোর। ইচ্ছে করলে অনেক লম্বা করা যায় একে রড জুড়ে জুড়ে।

বন্দুকটা হাতে তুলে নিল ইসলাম। দেখল ফ্রান্সের নাম করা চ্যাম্পিয়ান হার্পুন গান ওটা। সমুদ্রে হাঙ্গর, ব্যারাকুড়া, এমনকী বিশাল সব তিমি পর্যন্ত মারতে এ জিনিস অদ্বিতীয়।

আবার কাজ করবার ইঙ্গিত করতেই আনলাকি থারটিন যন্ত্রটা নিয়ে ঝুঁকে পড়ল গর্তের উপর। আর ওর অজান্তে ইসলামের ডান হাতে ধরা সিরিঞ্জের সূচটা ঢুকে গেল রাবারের পোশাক ভেদ করে ওর পিঠে, হার্টের কাছটায়। সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়ে গেল লোকটা, ঠিক যেন ঘুমিয়ে পড়ল এক মুহূর্তে।

এবার গর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ ঢুকিয়ে দিল ইসলাম যন্ত্র ও তার সঙ্গের রডগুলো। তারপর মুখটা মাটি দিয়ে চেপে বন্ধ করে দিল।

উজ্জ্বল আলোটা ঘুরিরে ফিরিয়ে অনেক মাছ দেখতে পেল সে। যেন একটা মস্তবড় অ্যাকুয়েরিয়ামের মধ্যে চলে এসেছে ও। ছোট ছোট মাছ নির্ভয়ে ওর পাশ দিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। বড় বড় গলদা চিংড়ির উপর আলো পড়তেই আট হাত-পা কুঁকড়ে ওগুলো কয়েক পা পিছিয়ে যাচ্ছে লেজের উপর ভর করে—টুকটুকে লাল চোখ বের করে অবাক হয়ে দেখছে ওকে। অসংখ্য কাঁকড়া গর্ত থেকে অর্ধেকটা শরীর বের করে ওর গতিবিধি লক্ষ করছে—এগোলেই সুড়ৎ করে ঢুকে পড়বে গর্তে। টর্চের আলো দেখে কৌতূহলী বড় বড় রুই কাতলা ভদ্র দূরত্ব বজায় রেখে আশপাশে ঘুরঘুর করছে।

তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করবার তাগিদ অনুভব করল ইসলাম। অনায়াসে গোটা আষ্টেক মাছ মারল সে হার্টুন দিয়ে। তারপর একটা সরু শক্ত দড়ি দিয়ে মাছগুলোকে বেঁধে নিয়ে তেরো নম্বরের মাথার ঢাকনিটা খুলে আলগা করে দিল।

একহাতে হার্টুন আর মাছের দড়ি আর অন্য হাতে তেরো নম্বরের মৃতদেহটা ধরে এবার টেনে নিয়ে চলল ইসলাম উপরে। মাঝপথে আসতেই দেখা গেল আবদুল নামছে নীচে। আবদুলের হাতে মৃতদেহটার ভার দিয়ে আগে আগে উপরে উঠে এল ইসলাম।

বাঁধের উপর এখন অনেক লোক জড় হয়েছে। কয়েকজন গার্ডও এসে গেছে। একজন গেছে থানায় ওসি সাহেবকে ডাকতে। রীতিমত হুলস্থুল কাণ্ড।

খোঁড়াতে খোঁড়াতে উপরে উঠে এল ইসলাম। মাথা থেকে ঢাকনিটা খুলতেই লারসেন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটা কোথায়? মাছ কিসের?’

‘আবদুল আনছে লোকটাকে। ব্যাটা হার্টুন দিয়ে আমাকে প্রায় খুন করার জোগাড় করেছিল। নেমে দেখি ভদ্রলোক বাঁধের গায়ে বসে বসে মাছ মারছেন।’

‘আই সী! তা হলে মাছ চুরি হচ্ছে রিজারভয়ের থেকে এই কায়দায়। আমি ভেবেছিলাম, না জানি কী। তুমি জখম হওনি তো?’

‘না, বেকায়দায় পড়ে পা-টা শুধু মচকে গেছে। ভেঙেও গিয়ে থাকতে পারে। এক্ষুণি হাসপাতালে যাওয়া দরকার।’

এমন সময় আবদুল উঠল লোকটাকে নিয়ে। সবাই ধরাধরি করে কাঁটাতারের এপাশে নিয়ে এল দেহটা। আবদুলের চোখে চোখ পড়তেই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল রাফিকুল ইসলাম।

এরপর আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেশনের চেষ্টা—কিভাবে ধস্তাধস্তিতে লোকটার মাথার ঢাকনি খুলে গেছে তার মনগড়া বিবরণ, পুলিশের ডায়েরি, হাসপাতাল, পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা।

কালো শেভ্রোলের বিলীয়মান ব্যাক লাইট দুটোর দিকে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে আবদুল বলল, ‘শুয়ার কা বাচ্চা!’