ভদ্রকালীর দ্বাদশ বৎসর বয়সে বিবাহ হয়-মুচিরামের এমনই অদৃষ্ট-বিবাহের পর দুই বৎসরের মধ্যে, ভদ্রকালী চৌদ্দ বৎসরের হইল। চৌদ্দ বৎসরের হইয়াই ভদ্রকালী ভজগোবিন্দের একটি চাকরির জন্য মুচিরামের উপর দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিল, সুতরাং মুচিরাম চেষ্টা চরিত্র করিয়া ভজগোবিন্দের একটি মুহুরিগিরি করিয়া দিলেন।
ইহাতে মুচিরাম কিছু বিপন্ন হইলেন। এক্ষণে ভজগোবিন্দের নিজের কাজ হইল-সে মনোযোগ দিয়া নিজের কাজ করে; মুচিরামের কাজ করিয়া দিবার তাহার তত অবকাশ থাকে না। ভজগোবিন্দ সুপাত্র-শীঘ্রই হোম সাহেবের প্রিয়পাত্র হইল। মুচিরামের কাজের যে সকল ত্রুটি হইতে লাগিল, হোম সাহেব তাহা দেখিয়াও দেখিতেন না। আভূমিপ্রণত সেলাম এবং মাই লার্ড বুলির গুণে সে সকলের প্রতি অন্ধ হইয়া রহিলেন। মুচিরামের প্রতি তাঁহার দয়া অচলা রহিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ সময়ে হোম সাহেব বদলি হইয়া গেলেন, তাঁহার স্থানে রীড সাহেব আসিলেন। রীড অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি। অতি অল্প দিনেই বুঝিলেন-মুচিরাম একটি বৃক্ষভ্রষ্ট বানর-অকর্ম্মা অথচ ভারি রকমের ঘুষখোর। মুচিরামকে আপিস হইতে বহিষ্কৃত করা মনে স্থির করিলেন। কিন্তু রীড সাহেব যেমন বিচক্ষণ, তেমনি দয়াশীল ও ন্যায়বান্; সে কালের হেলীবরির সিবিলিয়ান সাহেবরা বাঙ্গালীদিগকে পুত্রের মত স্নেহ করিতেন। মিছে ছুতাছলে কাহাকে অন্নহীন করিতে রীড সাহেব নিতান্ত অনিচ্ছুক ; কাহাকে একেবারে অন্নহীন করিতে অনিচ্ছুক। মুচিরাম যে বিপুল ভূসম্পত্তি করিয়াছে-রীড সাহেব তাহা জানিতে পারেন নাই। রীড সাহেব মুচিরামকে দুই একবার ইস্তেফা দিতে বলিয়াছিলেন বটে, কিন্তু মুচিরাম চোখে জল আনিয়া দুই চারি বার “গরীব খানা বেগর মারা যায়েগা” বলাতে তিনি নিরস্ত হইয়াছিলেন। তারপর, তাহাকে পেস্কারির তুল্য বেতনে আবকারির দারোগাই দিতে চাহিয়াছিলেন-অন্যান্য মফস্বলি চাকরি করিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন-কিন্তু আবার মুচিরাম চোখে জল আনিয়া বলে যে, আমার শরীর ভাল নহে, মফস্বলে গেলে মরিয়া যাইব-হুজুরের চরণের নিকট থাকিতে চাই। সুতরাং দয়ালুচিত্ত রীড সাহেব নিরস্ত হইলেন। কিন্তু তাহাকে লইয়া আর কাজও চলে না। অগত্যা রীড সাহেব মুচিরামকে ডিপুটি কালেক্টর করিবার জন্য গবর্ণমেণ্টে রিপোর্ট করিলেন। সেই সময়ে হোম সাহেব বাঙ্গাল আপিসে সেক্রেটরি ছিলেন-রিপোর্ট পৌঁছিবামাত্র মুচিরাম ডিপুটি বাহাদুরিতে নিযুক্ত হইলেন।
রীড সাহেব-ইহাতে বিজ্ঞ লোকের মতই কাজ করিয়াছিলেন। তিনি বিলক্ষণ জানিতেন যে, ভারি ঘুষখোরেও ডিপুটি হইলেই ঘুষ খাওয়া ত্যাগ করে; ডিপুটিগিরি এক প্রকারে আমলাদিগের বৈধব্য-বিধবা হইলে আর মাছ খাইতে নাই। আর মুচিরাম যে মূর্খ, তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না; সেরূপ অনেক ডিপুটি আছে; ডিপুটিগিরিতে বিদ্যাবুদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা যায় না। অতএব রীড সাহেব লোকহিতার্থ মুচিরামকে ডিপুটি করিবার জন্য রিপোর্ট করিয়াছিলেন।
আপিসে সম্বাদ পৌঁছিল যে, মুচিরামের উচ্চ পদ হইয়াছে। একজন বুড়া মুহুরি ছিল, সে বড় সাধুভাষা বুঝিত না। “উচ্চ পদ” শুনিয়া সে বলিল, “কি? ঠ্যাঙ্গ উঁচু করেছেন না কি? ভাগাড়ে দিয়া আইবা |”

Leave a Reply