আবূ উমামাহ আল-বাহিলী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের সম্মুখে ভাষণ দিলেন। তিনি আমাদের সামনে তাঁর অধিকাংশ ভাষণ দাজ্জাল প্রসঙ্গে দিলেন এবং আমাদেরকে তার ব্যাপারে সাবধান করলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন :

  1. হে লোক সকল! আল্লাহ যখন থেকে আদম সন্তানকে সৃষ্টি করেছেন তখন থেকে দাজ্জালের ফিতনার চেয়ে কোন বড় ফিতনা যমিনে সংঘটিত হয়নি।
  2. নিশ্চয় আল্লাহ এমন কোন নাবী প্রেরণ করেননি যিনি তাঁর উম্মাতকে দাজ্জালের ভয় দেখাননি।
  3. আমি সর্বশেষ নাবী আর তোমরা সর্বশেষ উম্মাত।
  4. সে (দাজ্জাল) অবশ্যই তোমাদের মাঝে প্রকাশ পাবে।
  5. আমি তোমাদের মাঝে বর্তমান থাকাবস্থায় যদি সে বের হয়, তাহলে আমি প্রত্যেক মুসলিমের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করবো (তাকে দোষারোপ করব)। আর যদি সে আমার পরে বের হয়, তাহলে প্রত্যেককে নিজের পক্ষে দলিল পেশ করতে হবে। তখন মহান আল্লাহ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আমার খলিফাহ স্বরূপ হবেন (অর্থাৎ তিনি মুসলিমদের দাজ্জাল থেকে রক্ষা করবেন)।
  6. নিশ্চয় দাজ্জাল বের হবে সিরিয়া ও ইরাকের ‘খাল্লা’ নামক স্থান হতে। আর সে তার ডান ও বামে সর্বত্র বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
  7. কেননা, আমি তোমাদের কাছে তার এমন অবস্থা বর্ণনা করব, যা আমার পূর্বে কোন নাবী স্বীয় উম্মাতের কাছে বর্ণনা করেননি।
  8. প্রথমে সে বলবে, আমি নাবী এবং আমার পরে কোন নাবী নেই।
  9. অতঃপর সে দাবী করে বলবে, আমি তোমাদের রব্ব! অথচ তোমরা তোমাদের রব্বকে মৃত্যুর পূর্বে দেখবে না।
  10. সে হবে কানা। আর তোমাদের রব্ব তো কানা নন।
  11. তার দুই চোখের মাঝে (কপালে) লেখা থাকবে ‘কাফির’।
  12. এই লেখা প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তিই পড়তে পারবে, চাই সে শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত।
  13. তার ফিতনা হচ্ছে এই, তার সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নাম (সদৃশ বস্তু) থাকবে। কিন্তু তার জাহান্নাম হবে জান্নাত এবং তার জান্নাত হবে জাহান্নাম।
  14. অতএব যে তার জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, সে যেন আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং সূরাহ কাহ্‌ফ-এর প্রথমাংশ তিলাওয়াত করে।
  15. তখন সেই জাহান্নাম তার জন্য ঠাণ্ডা-শান্তিময় স্থানে পরিণত হবে যেমন আগুন শান্তিময় হয়েছিল ইব্রাহীম (আ)-এর উপর।
  16. দাজ্জালের অন্যতম ফিতনা হচ্ছে এই, সে জনৈক বেদুইনকে বলবে : আমি তোমার জন্য তোমার পিতা-মাতাকে জীবিত করে দিতে পারলে তুমি কি সাক্ষ্য দিবে যে, নিশ্চয় আমি তোমার রব্ব! তখন সে বলবে, হ্যাঁ। তখন তার জন্য দু’টি শয়তান তার পিতা ও মাতার আকৃতি ধারণ করবে। তারা বলবে, হে বৎস! তার আনুগত্য কর। নিশ্চয় সে তোমার প্রতিপালক।
  17. দাজ্জালের আরেকটি ফিতনা হল, সে এক ব্যক্তিকে পরাভূত করে তাকে হত্যা করবে।
  18. এমনকি তাকে করাত দিয়ে দুই টুকরা করে নিক্ষেপ করবে। অতঃপর বলবে, তোমরা আমার এই বান্দার প্রতি লক্ষ্য কর, আমি এখনই তাকে জীবিত করব। তবুও কি কেউ বলবে যে, আমি ছাড়া অন্য কেউ তার রব্ব? অতঃপর মহান আল্লাহ ঐ লোকটিকে জীবিত করবেন। তখন খবীস (দাজ্জাল) তাকে বলবে, কে তোমার রব্ব? সে বলবে, আল্লাহ আমার রব্ব। আর তুই আল্লাহর দুশমন, তুই দাজ্জাল! আল্লাহর শপথ! (তুই যে দাজ্জাল) তা আজকে আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি।
  19. সে আকাশকে বৃষ্টি বর্ষণের নির্দেশ দিবে, তখনই বৃষ্টিপাত হবে। সে যমীনকে ফসল উৎপাদন করতে নির্দেশ দিবে, তখন যমীন ফসল উৎপন্ন করবে।
  20. দাজ্জালের আরেকটি ফিতনা হলো, সে একটি গোত্রের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে, তারা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবে। ফলে তাদের গৃহপালিত পশু ধ্বংস হয়ে যাবে।
  21. দাজ্জালের আরেকটি ফিতনা হলো, সে অন্য আরেকটি গোত্রের পাশ দিয়ে যাবে। তখন তারা তাকে সত্য বলে মেনে নিবে। ফলে সে আকাশকে বৃষ্টি বর্ষণের নির্দেশ দিবে এবং আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে। অতঃপর সে যমীনকে শস্য উৎপাদনের নির্দেশ দিলে যমীন শস্য উৎপাদন করবে। যমীন ফসলাদি এমনভাবে উৎপন্ন করবে যে, তাদের পশুগুলো সেদিন সন্ধ্যায় খুব মোটাতাজা এবং পেট ভর্তি করে স্তন ফুলিয়ে প্রত্যাবর্তণ করবে।
  22. অবস্থা এমন হবে যে, পৃথিবীর এমন কোন ভূখণ্ড অবশিষ্ট থাকবে না যেখানে দাজ্জাল প্রবেশ না করবে এবং তা তার পদানত না হবে। কিন্তু মাক্কাহ্ ও মাদীনাহ্ ছাড়া।
  23. এই দুই শহরের প্রবেশ পথে খোলা তরবারি হাতে ফিরিশতা নিযুক্ত থাকবেন।
  24. এমনকি ছোট একটি লাল পাহাড়ের কাছে অবতরণ করবে। যা হবে তৃণলতা শূণ্য স্থানের শেষ ভাগ।
  25. অতঃপর মাদীনাহ্ তার অধিবাসী সহ তিনবার প্রকম্পিত হবে। ফলে মুনাফিক পুরুষ ও মহিলা মাদীনাহ্ থেকে বেরিয়ে দাজ্জালের সাথে মিলিত হবে।
  26. এভাবে মাদীনাহ্ তার ভেতরকার ময়লা বিদূরিত করবে, যেমন হাপর লোহার মরিচা দূর করে থাকে।
  27. সেদিনের নাম হবে নাজাত দিবস।
  28. অতঃপর উম্মু শারীক বিনতু আবুল ‘আকর বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেদিন আরবের লোকজন কোথায় থাকবে? তিনি বলেন, সেদিন তারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য হবে।
  29. তাদের অধিকাংশ মু’মিন বান্দা সেদিন বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান করবে।
  30. তাদের ইমাম হবেন একজন সৎ ব্যক্তি।
  31. এমন অবস্থায় একদিন তাদের ইমাম তাদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করবেন। তখন ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ.) সকাল বেলায় (আকাশ থেকে) অবতরণ করবেন। ফলে তাকে দেখে উক্ত ইমাম পিছনে সরে যাবেন যেন ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ.) সামনে গিয়ে লোকদের সালাতে ইমামতি করতে পারেন। তখন ঈসা (আ.) তাঁর হাত উক্ত ইমামের দুই কাঁধের উপর রেখে বলবেন : আপনি সামনে যান এবং সালাতের ইমামতি করুন। কেননা এই সালাত আপনার জন্যই (ইমামতির নিয়্যাত করে) ক়ায়িম হয়েছিল। ফলে তাদের ইমাম তাদের নিয়ে সলাত আদায় করবেন।
  32. অতঃপর সালাত শেষে ঈসা ইবনু মারইয়াম বলবেন : দরজা খুলে দাও। তখন দরজা খুলে দেয়া হবে। আর দরজার পিছনে থাকবে দাজ্জাল।
  33. তার সঙ্গে থাকবে সত্তর হাজার ইয়াহুদী। তাদের প্রত্যেকের সাথে চাঁদরে আবৃত কারুকার্য খচিত তলোয়ার থাকবে।
  34. দাজ্জাল যখন ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ)-কে দেখবে তখনই সে বিগলিত হয়ে যাবে, যেমন লবণ পানিতে গলে যায়।
  35. সে পালাতে থাকবে। তখন ঈসা (আ) বলবেন : তোর প্রতি আমার একটি আঘাত আছে। যা থেকে বাঁচার কোন পথ নেই।
  36. পরিশেষে তিনি তাকে বাবে লুদের পূর্ব দিকে পাবেন এবং তাকে হত্যা করবেন।
  37. আর আল্লাহ ইয়াহুদীদেরকে পরাজিত করবেন। তখন ইয়াহুদীরা আল্লাহর সৃষ্ট যেকোন বস্তুর আড়ালে লুকিয়ে থাকুক না কেন, সে বস্তুকে আল্লাহ বাকশক্তি দান করবেন, চাই তা পাথর, গাছপালা, দেয়াল অথবা কোন জন্তু হোক না। তবে একটি গাছ হবে ব্যতিক্রম, যার নাম গারক়াদাহ। একে ইয়াহুদীদের গাছ বলা হয়। সে কথা বলবে না। তবে সে বলবে : হে আল্লাহর মুসলিম বান্দা! এই তো ইয়াহুদী। তুমি এসো এবং তাকে হত্যা করো।
  38. দাজ্জালের সময়কাল হবে চল্লিশ বছর।
  39. তার একটি বছর হবে অর্ধ বছরের সমান। আরেক বছর হবে এক মাসের সমান এবং এক মাস হবে এক সপ্তাহের সমান।
  40. তার শেষ দিনগুলো এমন ভয়াবহ হবে, যেমন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বায়ুমণ্ডলে উড়ে বেড়ায়।
  41. তোমাদের কেউ মাদীনার এক ফটকে সকাল অতিবাহিত করলে অন্য ফটকে যেতে না যেতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
  42. তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! এতো ছোট দিনে আমরা কিভাবে সলাত আদায় করবো? তিনি বললেন : তোমরা অনুমান করে সলাতের সময় নির্ধারণ করে নিবে, যেমন তোমরা লম্বা দিনে অনুমান করে সলাতের সময় নির্ধারণ করে থাকো। আর এভাবে সলাত আদায় করবে।
  43. ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ) আমার উম্মাতের একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও ইনসাফকারী ইমাম হবেন। তিনি ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবেন। শূকর হত্যা করবেন। জিযিয়া মওকূফ করবেন। সদাক়াহ উসূল করা বন্ধ করবেন। বকরী ও উটের উপর যাকাত ধার্য বন্ধ হবে এবং লোকদের মাঝে পারষ্পরিক হিংসা বিদ্বেষের অবসান ঘটবে। প্রতিটি বিষাক্ত জন্তুর বিষ দূরীভূত হবে। এমনকি দুধের শিশু তার হাত সাপের মুখে ঢুকিয়ে দিবে কিন্তু সে তার কোন ক্ষতি করবে না।
  44. একজন ক্ষুদ্র মানব শিশু সিংহকে তাড়া করবে। সেও তার কোন ক্ষতি করবে না। নেকড়ে বাঘ বকরীর পালে এমনভাবে থাকবে যে, যেন সে তার (রক্ষক) কুকুর।
  45. পৃথিবী শান্তিপূর্ণ হয়ে যাবে। যেমন পানিতে পাত্র পরিপূর্ণ হয়। তখন সকলের কালেমা এক হবে। আল্লাহ ছাড়া কারোর ইবাদাত করা হবে না। যুদ্ধ-বিগ্রহ তার সরঞ্জাম রেখে দিবে। কুরাইশদের রাজত্বের অবসান হবে। যমীন রূপার তৈরি তশতরীর মত হয়ে যাবে। সে এমন ফসল উৎপন্ন করবে যেমন আদম (আঃ) এর যুগে উৎপন্ন হতো। এমনকি কতিপয় লোক একটি আংগুরের খোসার মধ্যে একত্রিত হতে পারবে এবং তা সকলকে পরিতৃপ্ত করবে। লোকজন একটি ডালিমের জন্য একত্রিত হবে এবং তা সকলকে পরিতৃপ্ত করবে। তাদের বদল গরু হবে এই এই মুল্যের এবং ঘোড়া স্বল্প মূল্যে বিক্রি হবে।
  46. তারা বললো, হে আল্লাহর রাসূল! ঘোড়ার মূল্য কম হবে কেন? তিনি বললেন, কারণ যুদ্ধের জন্য কেউ অশ্বারোহী হবে না।
  47. তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, গরুর মূল্য বেশি হবে কেন? তিনি বললেন, সমগ্র ভূখণ্ডে কৃষিকাজ সম্প্রসারিত হবে।
  48. দাজ্জালের আবির্ভাবের তিন বছর পূর্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। তখন মানুষ চরমভাবে ক্ষুধায় কষ্ট পাবে। প্রথম বছর মহান আল্লাহ আকাশকে তিন ভাগের একভাগ বৃষ্টি আটকে রাখার নির্দেশ দিবেন। আর যমীনকে নির্দেশ দিবেন, ফলে সে তিন ভাগের একভাগ ফসল উৎপন্ন করবে। অতঃপর তিনি আসমানকে দ্বিতীয় বছর একই নিদের্শ দিবেন। তখন তা দুই তৃতীয়াংশ বৃষ্টি বন্ধ রাখবে এবং যমীনকে নির্দেশ দিবেন, ফলে যমীন দুই তৃতীয়াংশ ফসল কম উৎপন্ন করবে। অতঃপর মহান আল্লাহ তৃতীয় বছর একই নির্দেশ দিবেন, তখন সে সম্পূর্ণরূপে বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দিবে। ফলে যমীনে কোন ঘাস জন্মাবে না, কোন সবজি অবশিষ্ট থাকবে না। বরং তা ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে আল্লাহ যা চাইবেন।
  49. জিজ্ঞেস করা হলো : তখন লোকেরা কিভাবে বেঁচে থাকবে? তিনি বললেন : তারা তাহলীল, তাকবীর, তাসবীহ, তাহমীদ বলতে থাকবে, সেগুলো তাদের খাদ্য নালিতে প্রবাহিত করা হবে।