- প্রথম পরিচ্ছেদ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ
- নবম পরিচ্ছেদ
- দশম পরিচ্ছেদ
- একাদশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
- বিংশ পরিচ্ছেদ
- একবিংশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদ
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
অন্তিমকাল
বিমলার পলায়নের ক্ষণমাত্র পরেই একজন কর্মচারী অতিব্যস্তে জগৎসিংহের কারাগারমধ্যে আসিয়া কহিল, “যুবরাজ! নবাব সাহেবের মৃত্যুকাল উপস্থিত, তিনি আপনাকে স্মরণ করিয়াছেন।”
যুবরাজ চমৎকৃত হইয়া কহিলেন, “সে কি!”
রাজপুরুষ কহিলেন, “অন্তপুরঃমধ্যে শত্রু প্রবেশ করিয়া নবাব সাহেবকে আঘাত করিয়া পলায়ন করিয়াছে। এখনও প্রাণত্যাগ হয় নাই, কিন্তু আর বিলম্ব নাই, আপনি ঝটিতি চলুন, নচেৎ সাক্ষাৎ হইবে না।”
রাজপুত্র কহিলেন, “এ সময়ে আমার সহিত সাক্ষাতের প্রয়োজন?”
দূত কহিল, “কি জানি? আমি বার্তাবহ মাত্র।”
যুবরাজ দূতের সহিত অন্তঃপুরমধ্যে গমন করিলেন। তথায় গিয়া দেখেন যে, কতলু খাঁর জীবন-প্রদীপ সত্য সত্যই নির্বাণ হইয়া আসিয়াছে, অন্ধকারের আর বিলম্ব নাই, চতুর্দিকে ওসমান, আয়েষা, মুমূর্ষূর অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্রগণ, পত্নী, উপপত্নী, দাসী, অমাত্যবর্গ প্রভৃতি বেষ্টন হইয়া রহিয়াছে। রোদনাদির কোলাহল পড়িয়াছে; প্রায় সকলেই উচ্চরবে কাঁদিতেছে; শিশুগণ না বুঝিয়া কাঁদিতেছে; আয়েষা চীৎকার করিয়া কাঁদিতেছে না। আয়েষার নয়ন-ধারায় মুখ প্লাবিত হইতেছে; নিঃশব্দে পিতার মস্তক অঙ্কে ধারণ করিয়া রহিয়াছেন। জগৎসিংহ দেখিলেন, সে মূর্তি স্থির, গম্ভীর, নিস্পন্দ।
যুবরাজ প্রবেশ মাত্র খ্বাজা ইসা নামে অমাত্য তাঁহার কর ধরিয়া কতলু খাঁর নিকটে লইলেন; যেরূপ উচ্চস্বরে বধিরকে সম্ভাষণ করিতে হয়, সেইরূপ স্বরে কহিলেন, “যুবরাজ জগৎসিংহ আসিয়াছেন।”
কতলু খাঁ ক্ষীণস্বরে কহিলেন, “আমি শত্রু; মরি;-রাগ দ্বেষ ত্যাগ।”
জগৎসিংহ বুঝিয়া কহিলেন, “এ সময়ে ত্যাগ করিলাম।”
কতলু খাঁ পুনরপি সেইরূপ স্বরে কহিলেন, -“যাচ্ঞা–স্বীকার।”
জগৎসিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি স্বীকার করিব?”
কতলু খাঁ পুনরপি কহিতে লাগিলেন, “বালক সব–যুদ্ধ–বড় তৃষা।”
আয়েষা মুখে সরবত সিঞ্চন করিলেন।
“যুদ্ধ–কাজ–নাই–সন্ধি———”
কতলু খাঁ নীরব হইলেন। জগৎসিংহ কোন উত্তর করিলেন না। কতলু খাঁ তাঁহার মুখপানে উত্তর প্রতীক্ষায় চাহিয়া রহিলেন। উত্তর না পাইয়া কষ্টে কহিলেন, “অস্বীকার?”
যুবরাজ কহিলেন, “পাঠানেরা দিল্লীশ্বরের প্রভুত্ব স্বীকার করিলে, আমি সন্ধির জন্য অনুরোধ করিতে স্বীকার করিলাম।”
কতলু খাঁ পুনরপি অর্ধস্ফুটশ্বাসে কহিলেন, “উড়িষ্যা?”
রাজপুত্র বুঝিয়া কহিলেন, “যদি কার্য সম্পন্ন করিতে পারি, তবে আপনার পুত্রেরা উড়িষ্যাচ্যুত হইবে না।”
কতলুর মৃত্যু-ক্লেশ-নিপীড়িত মুখকান্তি প্রদীপ্ত হইল।
মুমূর্ষু কহিল, “আপনি–মুক্ত–জগদীশ্বর–মঙ্গল—” জগৎসিংহ চলিয়া যান, আয়েষা মুখ অবনত করিয়া পিতাকে কি কহিয়া দিলেন। কতলু খাঁ খ্বাজা ইসার প্রতি চাহিয়া আবার প্রতিগমনকারী রাজপুত্রের দিকে চাহিলেন। খ্বাজা ইসা রাজপুত্রকে কহিলেন, “বুঝি আপনার সঙ্গে আরও কথা আছে।”
রাজপুত্র প্রত্যাবর্তন করিলেন, কতলু খাঁ কহিলেন, “কাণ।”
রাজপুত্র বুঝিলেন। মুমূর্ষুর অধিকতর নিকটে দাঁড়াইয়া মুখের নিকট কর্ণাবনত করিলেন। কতলু খাঁ পূর্বাপেক্ষা অধিকতর অস্পষ্ট স্বরে বলিলেন, “বীর।—”
ক্ষণেক স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, পরে বলিতে লাগিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ–তৃষা।”
আয়েষা পুনরপি অধরে পেয় সিঞ্চন করিলেন।
“বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা।”
রাজপুত্রকে যেন বৃশ্চিক দংশন করিল; চমকিতের ন্যায় ঋজ্বায়ত হইয়া কিঞ্চিদ্দূরে দাঁড়াইলেন। কতলু খাঁ বলিতে লাগিলেন, “পিতৃহীনা–আমি পাপিষ্ঠ–উঃ তৃষা।”
আয়েষা পুনঃ পুনঃ পানীয়াভিসিঞ্চন করিতে লাগিলেন। কিন্তু আর বাক্যস্ফুরণ দুর্ঘট হইল। শ্বাস ছাড়িতে ছাড়িতে বলিতে লাগিলেন, “দারুণ জ্বালা–সাধ্বী–তুমি দেখিও—”
রাজপুত্র কহিলেন, “কি?” কতলু খাঁর কর্ণে এই প্রশ্ন মেঘগর্জনবৎ বোধ হইল। কতলু খাঁ বলিতে লাগিলেন, “এই ক–কন্যার–মত পবিত্রা।–তুমি! -উঃ! -বড় তৃষা–যাই যে—আয়েষা।”
আর কথা সরিল না; সাধ্যাতীত পরিশ্রম হইয়াছিল, শ্রমাতিরেক ফলে নির্জীব মস্তক ভূমিতে গড়াইয়া পড়িল। কন্যার নাম মুখে থাকিতে থাকিতে নবাব কতলু খাঁর প্রাণবিয়োগ হইল।